সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/হাওয়ার ডাক
(পৃ. ২৭৪-২৭৬)
একটা সরু চোঙার মধ্যে ঢিলাভাবে একটা ছিপি বসাইয়া চোঙার মধ্যে ফুঁ দিলে ছিপিঠা হাওয়ার ঠেলায় ছুটিয়া বাহির হয়। যদি মুখে ফুঁ না দিয়া পাম্প-কলের দম্কা হাওয়া দেওয়া যায় তাহা হইলে বেশ একটু ভারি জিনিসকেও অনেক দূর পর্যন্ত ঠেলিয়া নিয়া যায়। বিলাতের কোনো কোনো বড়ো দোকানে এই উপায়ে ছোটোখাটো জিনিস দোকানের নানাস্থানে পাঠানো হয়। খুচরা টাকাপয়সা দোকান বিভাগ হইতে অফিস বিভাগে পাঠাইতে হইলে একটি সরু চোঙার মধ্যে ভরিয়া, সেই চোঙাটিকে একটা লম্বা নলের মুখে পুরিয়া দেয়। তার পর একটা হাতল চাপিয়া দিলেই নলের মধ্যে দম্কা বাতাস ঢুকিয়া চোঙাটাকে একেবারে অফিস পর্যন্ত ঠেলিয়া দেয়। অফিস হইতে দোকানের প্রত্যেক বিভাগের সঙ্গে এইরকম নলের যোগ থাকে। কোনো গোলমাল হাঙ্গামা নাই, লোকজনের ছুটাছুটি নাই, মুহর্তের মধ্যে কাজ শেষ।
প্রায় কুড়ি বৎসর আগে একজন ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার বলিয়াছিলেন যে, এইরকমে নলের সাহায্যে বড়ো-বড়ো শহরের নানা স্থানে ডাক চালাচালি করিতে পারিলে খুব সুবিধা হয় এবং তাহাতে টেলিগ্রাফের মতো তাড়াতাড়ি কাজ হওয়া সম্ভব! আজকাল ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক বড়ো-বড়ো শহরে এইরূপ হাওয়ার ডাকের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। শহরের মধ্যখানে একটা বড়ো অফিস, তাহার চারিদিকে শহরের নানাস্থান পর্যন্ত নলের শাখা, কোনো কোনো নল তিন-চার মাইল পর্যন্ত লম্বা হয়। মনে কর, আমরা প্যারিস শহরে আছি, তোমার যদি আমার কাছে কোনো জরুরি চিঠি পাঠাইবার দরকার হয় তাহা হইলে প্রথমে তোমাকে ডাকঘরে গিয়া একরকম পাতলা পোস্টকার্ড কিনিতে হইবে। এই কার্ডের দাম অবশ্য সাধারণ পেস্টিকার্ডের চাইতে কিছু বেশি। কিন্তু টেলিগ্রাফ করিতে যে মাশুল লাগে, সে হিসাবে নিতান্তই সামান্য। সেই কার্ডে চিঠি লিখিয়া নলঘরের বাক্সের মধ্যে চিঠি পোস্ট করিতে হয়। অধিকাংশ স্থানে মেয়েরাই সেখানকার কাজ করে। তাহাদের একজন আসিয়া তোমার চিঠিখানা লইয়া সেটিকে একটি চোঙার মধ্যে পুরিয়া দিবে। চোঙাটি রবার ও বনাত দিয়া মোড়া এবং এমনভাবে তৈরি যে সেটাকে হাওয়ার নলের ভিতর ঢুকাইয়া দিলে চোঙার মুখ ও নলের মাঝে একটুকুও ফাঁক থাকে না—ফাক থাকিলে হাওয়া বাহির হইয়া যায় এবং তাহাতে হাওয়ার জোর কমিয়া যায়। চোঙাটিকে নলের মধ্যে ভরিয়া নলের মুখ বন্ধ করিয়া একটা হাতল ঘুরাইয়া দিলেই পাস্পকলের হাওয়ায় তাহাকে বড়ো আফিসে পৌঁছাইয়া দিবে। সেখানকার লোকেরা আবার সেটাকে অন্য একটা নলের মধ্যে পুরিয়া, আমার বাড়ি যে পোস্টাফিসের এলাকায় সেই পোস্টাফিসে চালান করিয়া দিবে। তার পর যেমন করিয়া টেলিগ্রাফ বিলি হয় তেমনি করিয়া সেই চিঠি আমার বাড়িতে বিলি করা হইবে। তোমার নিজের হাতের চিঠি টেলিগ্রাফের মতন তাড়াতাড়ি এবং তাহার চাইতে অনেক সস্তায় আমার বাড়িতে আসিয়া হাজির হইবে।
কলকব্জা থাকিলেই তাহা বিগড়াইবার সম্ভাবনা থাকে; নলের মধ্যে দৈবাৎ যদি কোথাও চোঙা আটকাইয়া যায় তাহা হইলে কি হইবে? সেইরূপ অবস্থায় মাটি খুঁড়িয়া না পরীক্ষা করিতে হয় এবং দরকার হইলে নল মেরামত করিয়া দোষ সারাইতে হয়। কিন্তু দুই মাইল বা চার মাইল লম্বা নল, তাহার কোন জায়গাটিতে মাটি খুঁড়িতে হইবে তাহা বুঝিবে কিরূপে? তাহা বাহির করিবার একটা চমৎকার উপায় আছে। এ-সকল ডাকঘরে এমন বন্দোবস্ত থাকে যে, চোঙা চলিতে চলিতে কোথাও আটকাইয়া গেলে তাহা তৎক্ষণাৎ টের পাওয়া যায়-কোথাও কোথাও তখনই একটা ঘণ্টা বাজিয়া ওঠে। তখন পাম্প্কলের হাওয়া বন্ধ করিয়া নলের মুখের কাছে বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজ করা হয়। খানিকক্ষণ পরে সেই আওয়াজ যখন চোঙায় লাগিয়া ফিরিয়া আসে তখন নলের মুখে একটা প্রতিধ্বনি শোনা যায়। চোঙা যত দূরে থাকে, প্রতিধ্বনি আসিতে ততই বেশি দেরি হয়। বন্দুকের শব্দ ও তাহার প্রতিধ্বনি, এই দুয়ের মধ্যে কতটুকু সময়ের তফাত হইতেছে, তাহা দেখিলেই হিসাব করিয়া বলা যায় যে কতখানি দূরে চোঙা আটকাইয়াছে। তা বলিয়া মনে করিও না যে যখন-তখন বুঝি এরূপভাবে চোঙা আটকাইয়া যায়। ফিলাডেলফিয়া শহরে প্রথম দু-তিন বৎসরের মধ্যে কেবল একবারমাত্র এইরূপ দুর্ঘটনা ঘটিয়াছিল। তখন ঐরূপ প্রতিধ্বনির সাহায্যে হিসাব করিয়া যে জায়গায় খুঁড়িতে বলা হয়, তাহার দু-এক হাতের মধ্যেই চোঙাটাকে পাওয়া যায়। দেখা গেল যে, মাটি বসিয়া যাওয়াতে নলটা এক জায়গায় জখম হইয়াছে এবং সেইখানে চোঙা আটকাইয়া রহিয়াছে।
চিঠি যখন নলের ভিতর দিয়া ভীষণ বেগে ছুটিয়া যায় তখন কেবল যে তাহার পিছন হইতে যাওয়ার ধাক্কা দেওয়া হয় তাহা নহে। কোনো জিনিস ছুটিতে গেলেই সম্মুখের বাতাস তাহাকে বাধা দিয়া তাহার বেগ কমাইয়া দেয়। এইজন্যে নলের সম্মুখ দিকেও একরকম পাম্পকল যোগ করিয়া দেওয়া হয়। তাহাতে সম্মুখের বাতাসকে টানিয়া বাহির করিয়া দেয় এবং সেই টানে চলন্ত চোঙা আরো জোরে চলিতে থাকে। আজকাল আমেরিকার কোনো কোনো শহরে এই উপায়ে কেবল চিঠি নয়, ছোটোখাটো পার্সেল পর্যন্ত চালান দেওয়া হইতেছে। সেখানে শহরের রাস্তার নীচে খুব বড়ো-বড়ো নল বসানো থাকে, তাহার ভিতর প্রায় একমণ ওজনের একটি লোহার চোঙাকে খুব দ্রুত ডাকগাড়ির চাইতেও অনেক বেশি বেগে ছুটাইয়া দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত এই-সকল হাওয়ার ডাক কেবল শহরের মধ্যেই কাজ করিতেছে, কিন্তু কালে এই উপায়ে এক শহর হইতে দূরের অন্য শহর পর্যন্ত ডাক পাঠাইবার ব্যবস্থা হওয়া কিছুই অসম্ভব নয়। কয়েক মাইল পর পর এক একটি পাম্প-কলের স্টেশন বসাইয়া হাওয়ার নলে অনেক দূর পর্যন্ত খুব তাড়াতাড়ি ডাক পাঠানো যাইতে পারে।