সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ঘুড়ি ও ফানুষ
(পৃ. ১৮২-১৮৫)
জলের চাইতে হালকা জিনিস যেমন জলে ভাসে বাতাসের চেয়ে হালকা জিনিস তেমনি বাতাসে ভাসে। আগুনের উপরকার তপ্ত বাতাস সাধারণ ঠাণ্ডা বাতাসের চাইতে অনেক পাতলা; তাই সে উপরে উঠে—আর সেই উপরমুখী স্রোতের টানে যত রাজ্যের কয়লা ধুলা সবসুদ্ধ টেনে তোলে। সেই কয়লা ধুলাসুদ্ধ ময়লা বাতাসের স্রোতকে আমরা বলি ধোঁয়া।
এইরকম হালকা ধোঁয়াকে পাতলা থলির মধ্যে পুরে আমরা তাকে আকাশে ওড়াই-আর সেই কাগজের থলিকে বলি ফানুষ। সেই ফানুষ যদি খুব বড়ো হয়, আর মজবুত করে তৈরি হয়, তখন তাকে বলি ‘বেলুন'।
এ তো গেল হালকা জিনিসের কথা। কিন্তু বাতাসের চাইতে ভারি জিনিসও অনেক সময় আকাশে ওঠে—যেমন ঘুড়ি। চলন্ত বাতাসের কেমন একটা ধাক্কা দিবার শক্তি আছে, সে বড়ো-বড়ো ভারী জিনিসকেও ঠেলে তোলে। ঘূর্ণী বায়ুর সময়ে বাতাসের জোর যখন খুব বেড়ে ওঠে তখন তার ধাক্কায় ঘরবাড়ি পর্যন্ত উড়িয়ে নেয়। ঘুড়ির সূতায় যতক্ষণ টান থাকে ততক্ষণ আপনা হতেই বাতাসের ধাক্কায় ঘুড়িকে উপর দিকে ঠেলে রাখে, কিন্তু বাতাস যখন থেমে আসে তখন ঘুড়ির সুতো ধরে ক্রমাগত টান না দিলে সে বাতাসের ধাক্কাও পায় না, কাজেই তার উপর ভর করে উঠতেও পারে না।
ফানুষকে বাড়িয়ে যেমন প্রকাণ্ড বেলনের সৃষ্টি হয়েছে তেমনি সাধারণ ঘুড়ির ‘পরিবতিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ' হচ্ছে মানুষ তোলা ধাউস ঘুড়ি। এরোপ্লেনের সৃষ্টি হবার আগে লোকে এইরকম ঘুড়িতে চড়ে নানারকম পরীক্ষা করে দেখেছে। এরকম করে শত্রুর চালচলন দেখবার জন্য নানারকম ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এর অসুবিধা এই যে বাতাসের জোর না থাকলে কিছু করবার উপায় নাই। তা ছাড়া, ঘুড়ি মাত্রেই এক জায়গায় আটকা থাকে, তার পক্ষে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো সম্ভব নয়। সুতরাং ঘুড়িই বলো আর ফানুষই বলো, সকলেই বাতাসের খেয়ালের অধীন।
মানুষ অনেককাল হতেই চায়, পাখির মতো আকাশে উড়তে। কেবল ফানুষে চড়ে বা ঘুড়িতে উঠে হাওয়ার ঠেলায় ভেসে বেড়িয়ে তার মন উঠে না। পাখির নকল করে বড়ো-বড়ো ডানা বানিয়ে তার সাহায্যে উড়ে বেড়াবার চেষ্টা অনেকদিন হতেই চলে আসছে। হাতে পিঠে ডানা লাগিয়ে লোকে সাহস করে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়েছে—আর তাতে কতজনের প্রাণও গিয়েছে। লিলিয়েন্থ প্রভৃতি যাঁরা এই বিষয়ে বেশ কৃতকার্য হয়েছিলেন তাঁরাও অতিরিক্ত সাহস করতে গিয়ে শেষে মারা পড়েন। তবু লোকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করতে ছাড়ে নি। পরীক্ষার ফলে মোটের উপর এইটুকু বোঝা গেছে যে পাখির মতো ডানা ঝাপটিয়ে ওড়া মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে বাতাস ভালো থাকলে একটু উঁচু জায়গা থেকে আরম্ভ করে অনেক দূর পর্যন্ত হাওয়ায় ভেসে যাওয়া যায়। শুধু ভেসে যাওয়া নয়, অনেক সময় ডাইনে-ধাঁয়ে এদিক-ওদিক একটু-আধটু ঘোরাফেরাও সম্ভব হয়। এ বিষয়ে আমেরিকার দুটি ভাই—অর্ভিল ও উইলবার রাইট-সকলের চেয়ে বাহাদুরি দেখিয়েছেন। তাঁরা তাঁদের তৈরি ডানার সাহায্যে দশ-বিশ মাইল পর্যন্ত অনেকবার ঘুরে এসেছেন। কিন্তু এতে করে উপর থেকে নীচে নামা বেশ সহজ বটে, কিন্তু বাতাস ঠেলে উপরে ওঠা একরকম অসম্ভব বললেই হয়। ঘুড়ির যখন সুতো ছিঁড়ে যায় তখন সে পাথরের মতো ধপ করে না পড়ে কেমন ভেসে ভেসে হেলে দুলে এগিয়ে পড়ে। নানা কৌশল খাটিয়ে নানারকম আকারের ঘুড়িকে এইভাবে বাতাসে ভাসিয়ে কত হাজাররকম পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে; এবং তার ফলে এটুকু বোঝা গেছে যে, জাহাজ যেমন করে জল কেটে এগিয়ে চলে তেমনি করে যদি বাতাস কেটে ঘুড়িকে ঠেলে নেওয়া যায়, তবে হয়তো তাকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে চালানো যেতে পারে। এই চেষ্টার ফলে যে জিনিস দাঁড়িয়েছে তারই নাম এরোপ্লেন।
এরোপ্লেনের চেহারা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলবার দরকার নাই, কারণ, তার ছবি তোমরা অনেক দেখেছ। কিন্তু সেটা যে একটা ঘুড়িমাত্র এ কথাটা তার পাখির মতো চেহারা দেখে সব সময়ে মনে আসে না। কিন্তু বাস্তবিক সেটা ঘুড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঘুড়িকে ওড়াতে হলে যেমন সুতো ধরে টানা দরকার, এরোপ্লেনকে ঠিক তেমনি বাতাস ঠেলে কলের জোরে টানতে হয়। সুতরাং ঘুড়িতে যতরকম বদভ্যাস আর কেরামতি দেখা যায়, এরোপ্লেনেও প্রায় সেইরকম। ঘুড়ির মতো সেও বেখাপ্পা ‘গোঁৎ' খেতে চায়, হঠাৎ শূন্যের মাঝে কাত হয়ে পড়তে চায়, আর এলোমেলো বাতাসে ঘুরপাক খেয়ে উলটাতে চায়। এতরকম তাল সামলে তবে এরোপ্লেন চালানো শিখতে হয়। ঘুড়িতে যদি বেখাপ্পা জোরে হ্যাঁচকা টান দেও তবে সে যেমন ফস্ করে ফেঁসে যেতে পারে, এরোপ্লেনও তেমনি ডানা ভেঙে ধপ্ করে পড়ে যাওয়া কিছু বিচিত্র নয়। যারা এ বিষয়ে ওস্তাদ, তাদের কাছে এরোপ্লেনের এ-সব পাগলামি নিতান্তই সামান্য ব্যাপার। তারা ইচ্ছা করেই কত সময় এরোপ্লেন সুদ্ধ শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে তামাশা দেখায়, এরোপ্লেনকে নানারকমে গোঁৎ খাওয়ায়।
ঘুড়ি আর ফানুষে যে তফাত, 'এরোপ্লেন’ আর ‘এয়ারশিপ’ বা আকাশ-জাহাজে ঠিক সেই তফাত। ফানুষকে অর্থাৎ বেলুনকে ইচ্ছামতো এদিক-ওদিক চালাবার চেষ্টাতেই আকাশ-জাহাজের সৃষ্টি। গোল বেলুন বাতাসের উলটোমুখে চলতে গেলে চ্যাপ্টা হয়ে যায়, তাই তাকে চমচমের মতো ছুঁচাল করে বানায়-তা হলে সে সহজেই বাতাস ফুঁড়ে এগতে পারে। তার পিছনে হাল ও আশেপাশে মাছের ডানার মতো থাকে—তা দিয়ে জাহাজকে ইচ্ছামতো ডাইনে বাঁয়ে উপর নীচে চালানো যায়। আর থাকে বিদ্যুতের পাখার মতো মস্ত একটা ঘুরন্ত জিনিস, সেইটার ধাক্কায় বাতাস ঠেলে জাহাজ চলে। এরোপ্লেনেও অবশ্য ঠিক এইরকম পাখা থাকে।
এই যুদ্ধের সময়ে এরোপ্লেন আর এয়ারশিপগুলি কিরকম কাজে লেগেছে তার সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলি। এরোপ্লেনগুলো চলে ব্যস্তবাগীশের মতো ফর্ফর্ করে, তারা দিনদুপরে যখন তখন যেখানে সেখানে উড়ে যায় আর নানারকম খবর আনে। দরকার হলে ধাঁ করে শত্রুর শিবিরে বা গোলা-বারুদের গুদামে বা অস্ত্রের কারখানায় দু-দশটা বোমা ফেলে আসে, অথবা বন্দুক দিয়ে শত্রুর এরোপ্লেন বা জাহাজ আক্রমণ করে। এ-সব ছোটোখাটো কাজে এরোপ্লেনেই সুবিধা বেশি। দশ বছর আগে বিলাতের লোকেও এরোপ্লেন জিনিসটাকে একটা আশ্চর্য তামাশার ব্যাপার মনে করত, অথচ এখন এই যুদ্ধে কত হাজার হাজার এরোপ্লেন ঘোরাফিরা করে-কে তার খবর রাখে?
আকাশ-জাহাজগুলো প্রকাণ্ড গম্ভীর জিনিস, একেবারে কুড়ি-ত্রিশ মণ বোমা নিয়ে ফেরে। তার উপর কামান বন্দুকও সঙ্গে থাকে। তারা আসে যায় অন্ধকার রাত্রে চোরের মতোদিনের বেলা বেরুতে গেলে তাদের আর রক্ষা নাই—কারণ, অত বড়ো জিনিসকে গোলা মেরে ফুটো করতে কতক্ষণ? রাতদুপুরে যখন তারা ঘুমন্ত শহরের উপর বোমা ফেলতে থাকে—তখন চারদিক হতে বড়ো বড়ো 'Search light'-এর আলোর ধারা আকাশ হাতড়ে তাকে খুঁজে বেড়ায় একবারটি তার উপর আলো ফেলতে পারলেই যত রাজ্যের তার উপর তাক্ করতে থাকে। তার পর চারিদিক হতে এরোপ্লেনগুলা ভিমরুলের মতো ঘিরে আসে। তখন জাহাজটিকে প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়। এরকম অবস্থায় এরোপ্লেনের সর্বদাই চেষ্টা থাকে জাহাজের উপরে উঠবার জন্য। কারণ, উপর থেকে বোমা ফেলে তার পিঠ ভেঙে দেওয়াই হচ্ছে জাহাজ মারবার সবচাইতে ভালো উপায়। ফানুষ জাহাজ যত উঁচুতে যেমন তাড়াতাড়ি উঠতে পারে ঘুড়ির নৌকা তেমন পারে না। কাজেই জাহাজ কাছে আসবার আগে থেকেই এরোপ্লেন অনেকখানি উঠে থাকে-যাতে ঠিক সময়ে সে জাহাজের ঘাড়ের উপর নামতে পারে।