সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/মাটির বাসন

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৭৯-১৮২)
মাটির বাসন

 মাটির বাসন গড়িতে জানে না, এমন জাতি পৃথিবীতে খুব কমই আছে। নিতান্ত অসভ্য মানুষ যাহারা কাপড় পরিতে জানে না, যাহারা বনে জঙ্গলে ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহাদের মধ্যেও মাটির বাসনের চল আছে। অতি প্রাচীনকালের মানুষ, যাহারা পাথর শানাইয়া অস্ত্র গড়িত, যাহারা ধাতুর ব্যবহার শিখে নাই, তাহাদের কবর খুঁড়িলে মাটির গেলাস ঘটি বাটি পাওয়া যায়। কেবল তাহাই নয়, এক-একটা জিনিসের উপর তাহারা নানারূপ কারুকার্য করিয়া তাহাদের সৌন্দর্যবোধের যে পরিচয় রাখিয়া গিয়াছে পর্যন্ত তাহার চিহ্ন মাঝে মাঝে দেখিতে পাই। যাহারা আগুনের ব্যবহার করিতে জানিত না তাহারা মাটির বাসন গড়িয়া রোদে শুকাইয়া লইয়া নিশ্চিন্ত থাকিত। কোনো কোনো স্থলে বাঁশের বা পাতার ঝুড়ি বানাইয়া তাহার গায়ে মাটি লেপিয়া বাসন বানানো হইত, এরূপও দেখা গিয়াছে।

 দশহাজার বৎসর আগে ইজিপ্ট দেশে যে মাটির বাসন তৈয়ারি হইত, তাহার সুন্দর সুন্দর নমুনা পাওয়া গিয়াছে। বাসনগুলি সমস্তই হাতে গড়া, কারণ, কুমারের চাকে মাটি গড়িবার কায়দা সে সময়ে তাহাদের জানা ছিল না। কিন্তু এ কাজে তাহাদের হাত এমন সাফাই ছিল যে, বড়ো-বড়ো জালার মতো পাত্রগুলির গড়নেও কোথাও খুঁত ধরিবার জো নাই। বড়ো-বড়ো জাহাজী নৌকা করিয়া এই-সকল বাসন দেশ-বিদেশে চালান হইত এবং তখনকার লোকে আগ্রহ করিয়া তাহা কিনিত। বাসনগুলির উপর চকচকে কালো পালিশ থাকিত, তাহার গায়ে সাদা রঙের কারুকার্য।

 মার্টির বাসন নানারকমের। সাধারণ ‘মেটে বাসন' যাহা অল্প আঁচে পোড়াইলেই চলে, আমাদের দেশে তাহার কিছুমাত্র অভাব নাই। গেলাস, ভাড়, সরা, মলিসা হইতে আরম্ভ করিয়া কুঁজা, কলসী, জালী পর্যন্ত ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই দেখিতে পাইবে। কিন্তু 'সাধারণ মার্টির’ জিনিসও যে কত সুন্দর হইতে পারে, অতি প্রাচীনকাল হইতেই নানা দেশের লোকে নানাভাবে তাহা দেখাইয়া আসিতেছে।

 আর একরকম মাটির জিনিস হয়, তাহাকে পাথুরে মাটি বলা যায়। এগুলিকে কড়া আগুনে পোড়াইলে পাথরের মতো মজবুত হয় এবং তখন তাহাকে অসংখ্য প্রকার দরকারি কাজে লাগানো যায়। বাড়ি বানাইবার টালি, ড্রেনের পাইপ, নানারূপ খেলনা প্রভৃতি কত জিনিস তৈয়ারি হয়। তাহাতে আবার নানারকম রঙ দেওয়া ও ইচ্ছামতো পালিশ ধরানো চলে।

 সাদা মাটির বাসন হইলেই আমরা অনেক সময়ে তাহাকে ‘চীনেমাটি’ বলি—কিন্তু আসল চীনামাটি অতি উঁচু দরের জিনিস। চীনেমাটির বাসন এক সময়ে কেবল চীন দেশেই তৈয়ারি হইত। প্রায় সাতশত বৎসর আগে মুসলমান সম্রাট সালাদিনের কাছে চীন সম্রাট কতগুলা উপহার পাঠাইয়াছিলেন তাহার মধ্যে কতগুলী চীনা বাসন ছিল। তেমন বাসন কেহ চক্ষে দেখে নাই। পাতলী ঝিনুকের মতো স্বচ্ছ, ডিমের খোলার মতো হালকা, সে আশ্চর্য বাসনের কথা চারিদিকে রটিয়া গেল।

 এই চীনা বাসনের সংকেত শিখিবার জন্য ছয় শতাব্দী ধরিয়া কত লোকে যে কতরকম চেষ্টা করিয়াছে, তাহার আর অন্ত নাই। এই একটি বিদ্যাকে অয়িত্ত করিবার চেষ্টায় কত লোকে জীবনপাত করিয়াছে এবং তাহার ফলে কেবল এইটুকুমাত্র জ্ঞানলাভ করিয়াছে যে, অমন পাতলা স্বচ্ছ সুন্দর জিনিস করা একেবারেই সহজ নয়। জিনিসটা পাতলা হয় তো স্বচ্ছ হয় না, স্বচ্ছ যদি হয় তবে এমন ঠুনকো যে একটু ধরিতে গেলেই ভাঙিয়া যায়। হয়তো আর সবই ঠিক হইল কিন্তু উপরের মোলায়েম পালিশটুকু ধরিল না, হয়তো কোথায় একটি চুল বা এক কণা বালি ছিল কিংবা চুল্লির আঁচ ঠিক সমান ছিল না, তাহাতেই বাসনটি পোড়াইবার সময় ফার্টিয়া গেল। এইরকম করিয়া লোকে হাজারবার ঠেকিয়া ঠেকিয়া তবে এ বিদ্যা শিখিয়াছে।  গ্রীস প্রভৃতি দেশে এক সময়ে অতি সুন্দর মাটির ঘড়া ও ফুলদানি তৈয়ারি হইত কিন্তু গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হইবার পর এই শিল্প নষ্ট হইয়া যায়। ইহার পর বহু বৎসর পর্যন্ত ইউরোপে মাটির জিনিস বলিতে সাধারণ মোটা বাসনপত্রই বুঝিত। তার পর মুসলমানদের দৌলতে যখন এই লুপ্ত শিল্প আবার জাগিয়া উঠে তখন হইতে দক্ষিণ ইউরোপে, বিশেষত ইটালিতে নানারূপ শিল্পের বাসন দেখা দিতে লাগিল। তখনো তাহারা চীনামাটি গড়িতে পারে নাই বটে কিন্তু মাটির উপর সাদা পালিশ চড়াইয়া তাহার চমৎকার নকল করিতে শিখিয়াছিল। বহুদিন পর্যন্ত এই ব্যবসায় ইটালির একচেটিয়া ছিল।

 যাহাদের চেষ্টায় ও যত্নে এই শিল্পের ব্যবসা ইউরোপের চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে, তাহাদের মধ্যে প্যালিসির নাম বিশেষভাবে করা যায়। বার্নার্ড প্যালিসির বাড়ি ছিল ফ্রান্স দেশে। সেখানে ছবি আঁকিয়া, কাঁচ রঙাইয়া ও জরীপের কাজে ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাঁহার দিন যাইত। হয়তো এইভাবেই তাহার সারা জীবন কাটিয়া যাইত। কিন্তু একদিন তিনি একখানা মাটির পেয়ালা দেখিলেন, তেমন জিনিস আর তিনি কখনো দেখেন নাই-বিশেষত তাহার উপর যে পালিশ করা এনামেলের কাজ ছিল, তাহাতেই প্যালিসিকে একেবারে মুগ্ধ করিয়া ফেলিল। প্যালিসি তখন একেবারে প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন, ঐরকম পালিশের সংকেত না শিখিয়া তিনি ছাড়িবেন না।

 সেইদিন হইতে তাহার আর অন্য চিন্তা নাই, জীবনের আর কোনো কাজ নাই, তিনি কেবল চুল্লি জ্বালাইয়া ভাঙা পাথর আর মাটির মসলা গলাইতেছেন, আর দেখিতেছেন পালিশ ঠিক হইল কিনা। নিজে লেখাপড়া জানেন না, কোনোদিন এ ব্যবসা শিখেন নাই, অথচ উৎসাহের তাড়নায় শক্তি সময় ও অর্থ অজস্র ঢালিয়া দিতেছেন-তাহাতে কি যে লাভ হইবে তাহা কেহই বোঝে না। লোকে পাগল বলিতে লাগিল, তাঁহার স্ত্রী বিরক্ত হইয়া উঠিলেন, বাড়ির লোকে অস্থির হইয়া পড়িল, কিন্তু তাহার সেদিকে ভ্রক্ষেপমাত্র নাই। দুই বৎসর হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর তিনশত মাটিব পেয়ালা গড়িয়া তাহার উপর নানারকম মসলার প্রলেপ দিয়া তিনি চুল্লিতে চড়াইলেন। চুল্লি জুড়াইলে পর দেখা গেল, একটি মাত্র বাসনের গায়ে অতি চমৎকার সাদা পালিশ ধরিয়াছে। তখন প্যালিসির আনন্দ দেখে কে!

 এতদিন পর্যন্ত তিনি চারি ক্রোশ পথ হাঁটিয়া এক ব্যবসায়ীর চুল্লিতে তাঁহার জিনিসগুলা পোড়াইয়া আনিতেন। এখন হইতে তিনি নিজের বাড়িতে একটি চুল্লি বানাইতে সংকল্প করলেন। ইটের পঁজায় ইঁট কিনিয়া তিনি নিজে তাহা বহিয়া অনিতেন এবং আপনার হাতে সাজাইয়া চুল্লি গড়িতেন। তার পর, চুল্লি খাড়া হইলে তিনি অনেক কাঠ ও কয়লা সংগ্রহ করিয়া চুল্লি জ্বালাইলেন এবং একশত মাটির বাসন বসাইয়া তাহাতে মসলা চড়াইলেন—এই মসলা গলিলে পর বাসনে এনামেলের মতো সাদা পালিশ হইবে। কিন্তু মসলা আর গলিতে চায় না। সারারাত কাটিয়া গেল, তার পর দিন গেল রাত গেল, এমনি করিয়া ছয়দিন ছয়রাত্র চুল্লির পাশে বসিয়া বৃথায় কাঠিল। তখন প্যালিসি নুতন মসলা বানাইয়া আবার আগুন চড়াইলেন। প্যাসিসির তখন আর দিক্‌বিদিক জ্ঞান নাই। তিনি আহার-নিদ্রা ছাড়িয়া কেবল চুল্লিতে কাঠ জোগাইতেছেন। ক্রমে কাঠ সব ফুরাইয়া আসিল—তিনি বাগানের কাঠের বেড়া ভাঙিয়া আগুনে দিলেন। তাহাও যখন ফুরাইয়া আসিল তখন বাড়ির টেবিল চেয়ার যাহা সম্মুখে পাইলেন সব ভাঙিয়া ভাঙিয়া জ্বালানি কাঠ করিতে লাগিলেন। এদিকে তাঁহার স্ত্রী পুত্র পরিবার সকলে কাঁদিতে কাঁদিতে শহরের মধ্যে ছুটিয়া বাহির হইয়াছে, আর সকলকে ডাকিয়া বলিতেছে যে প্যালিসি পাগল হইয়া বাড়িঘর ভাঙিয়া ফেলিতেছেন। শুনিয়া সকলে ব্যস্ত হইয়া দেখিতে আসিল, ব্যাপারখানা কি। ততক্ষণে প্যালিসির মসলা গলিয়া চমৎকার সাদা পালিশ হইয়া ফুটিয়াছে—তিনি অতি যত্নে সেগুলিকে ঠাণ্ডা করিয়া বাহির করিতেছেন।

 প্যালিসি স্থির করিলেন তিনি তাহার আবিষ্কারকে ব্যবসায়ে লাগাইবেন। এক কুমারের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া তিনি ছয় মাসে তাহাকে দিয়া কতগুলি সুন্দর সুন্দর বাসন গড়াইলেন। কিন্তু সেগুলিতে পালিশ ধরাইবার সময় তাঁহার চুল্লি ফার্টিয়া ধুলা ও ঝুল পড়িয়া তাঁহার চমৎকার পালিশ করা বাসনগুলিতে দাগ ধরাইয়া দিল। প্যালিসি কিছু বলিলেন না, বাসনগুলি ভাঙিয়া আবার চুল্লি মেরামত করিতে লাগিলেন। তাঁহার সে ধৈর্য আর বীরত্বের আর তুলনা হয় না। খোলা বাগানে সারাদিন রোদে ঘামিয়া বৃষ্টিতে ভিজিয়া তিনি চুল্পির তদ্বির করিতেন। বাড়ির বাহির হইলে লোকে তাঁহাকে দেখিয়া হাসাহাসি করিত। সারাদিন পরিশ্রমের পর যখন তাহার শরীর মন অবসন্ন হইয়া আসিত, তিনি বাড়িতে ঢুকিবামাত্র চারিদিক হইতে সকলে ঠাট্টা বিদ্রুপ নিন্দা ও অভিযোগ করিত। এতরকম অশান্তির মধ্যে ষোলো বৎসর অক্লান্ত পরিশ্রম করিয়া প্যালিসি আপনার ব্যবসায়কে সফল করিয়া রাজসম্মান লাভ করেন। কিন্তু এখানেও তাঁহার দুঃখের শেষ হয় নাই। ব্যবসায়ে কৃতকার্য হইবার পরেও শেষ বয়স পর্যন্ত তাঁহাকে নানা শত্রুর হাতে অনেক অত্যাচার সহিতে হইয়াছিল। সে-সকল অত্যাচার তিনি যেরূপ তেজের সহিত সহ্য করিয়াছিলেন তাহা প্যালিসির মতো বীরেরই উপযুক্ত। সকল বিষয়ে তিনি যাহা সত্য বুঝিতেন নির্ভীকভাবে তাহা প্রচার করিতেন। এইজন্য তাঁহার নিজের স্বাধীন ধর্মমত বজায় রাখিতে গিয়া তিনি নানারকমে লাঞ্ছিত হন এবং অবশেষে আশি বৎসর বয়সে মৃত্যুভয়কে অগ্রাহ্য করিয়া এক অন্ধকার কয়েদখানায় বন্দী অবস্থায় মারা যান।

সন্দেশ-ফাল্গুন, ১৪২৩