সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ডাকের কথা
(পৃ. ২৭১-২৭২)
মাস্টারমশাই ইতিহাস পড়াতে পড়াতে বললেন, “শের শা ঘোড়ার ডাকের সৃস্টি করেছিলেন।” একটি ছেলে অমনি জিজ্ঞাসা করল, “তার আগে কি ঘোড়ায় ডাকত না?” মাস্টারমশাই হো হো করে হেসে উঠলেন আর বললেন, “ঘোড়ায় ডাকত বটে, কিন্তু ডাক বইত না।” তখন ছেলেটি বুঝতে পারলে যে ‘ডাক’ মানে এখানে গলার ‘ডাক’ নয়-এ হচ্ছে চিঠির ডাকের কথা। এখনো অনেক দেশে ঘোড়ার ডাক চলছে; কিন্তু প্রায় সব দেশেই তার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি ডাক পাঠাবার বন্দোবস্ত হয়েছে।
মানুষের স্বভাবই এই যে, সে যত পায় তত চায়। রেলের সৃষ্টি হওয়ার পর আমরা শত শত মাইল দূরের চিঠিও একদিনেই পেয়ে যাই; কিন্তু সেখানে যদি একদিনের দেরি হয়, তা হলেই আমরা অনেক সময় বিরক্ত হই।
শুধু যদি রেল আর জাহাজে করেই ডাক নেওয়া হত তা হলে তো আর কোনো ভাবনাই ছিল না। কিন্তু, তা তো আর হবার জো নাই। সব জায়গায় রেলও চলে না; জাহাজও সব জায়গায় যায় না। সে-সব জায়গায় যে কতরকমে ডাক যায়, তা আর কি বলব! মানুষে তো পিঠে করে ডাক নিয়ে যায়ই-তাকে 'রানার’ বলে তা ছাড়া,ঘোড়ার পিঠেও ডাক যায়। এ ছাড়া কতরকমের গাড়ি করে যে ডাক যায় তাই-বা কি বলব! ঘোড়ার গাড়ি, গোরুর গাড়ি, উটের গাড়ি, মানুষে-টানা গাড়ি, ঠেলা গাড়ি আরো কতরকমের গাড়ি! মোটর গাড়িও হয়েছে আজকাল। গাড়ি ছাড়া নৌকা করেও ডাক যায়-ডিঙি, ডোঙা, পানসি, সাম্পান, বজরা—আরো কতরকমের। যেখানে নৌকা চলে না অথচ জল পার হতে হয়, কিম্বা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যেতে হয়, সেখানে অনেক সময় দড়ি কিম্বা তারে ডাকের থলি ঝুলিয়ে পার করে। যে-পারে থলিটা পাঠাতে হবে, সে-পারে একটু নিচু জায়গায় দড়ি কিম্বা তার বাঁধে, এপারে বেশ উঁচু জায়গায় বাঁধে। থলিটাতে একটা বড়ো কড়া লাগিয়ে দিয়ে দড়ির ভিতরে সেই কড়া পরিয়ে দেয়। তার পর, দড়িটা টান করে ধরলে থলিটা আপনা থেকেই সড়সড় করে গড়িয়ে ও-পারে চলে যায়।
যে-সব দেশে মোটেই রেলগাড়ি ঢলে না, সেখানেই বড়ো মুস্কিল। তুর্কিস্থানে রেল নাই, সেখানে শত শত মাইল পথে কেবল ঘোড়ার ডাকই চলে। দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যদি কোনো চিঠি পাঠাতে হয়, তা হলে প্রায় দেড় মাস সময় লাগে! তোমরা হয়তো ভাবছ, “এমন দেশও আছে এখন? কিন্তু এ কথা একবার ভেবে দেখ-না কেন যে, এর চেয়েও খারাপ অবস্থা আছে অনেক দেশের ডাকের বন্দোবস্তই নাই সে-সব জায়গায়।
এ তো গেল একদিকের কথা। আরেকদিকে দেখ, কত তাড়াতাড়ি ডাক পাঠাবার বন্দোবস্তু হচ্ছে আজকাল! রেলে ডাক পাঠিয়েও সন্তুষ্ট নয়—এখন এরোপ্লেনে পাঠাবার বন্দোবস্তু হচ্ছে অনেক দেশে। তাতে এত তাড়াতাড়ি ডাক যাবে যে এখনকার সঙ্গে তুলনাই হয় না। রেলগাড়ি খুব তাড়াতাড়ি চললেও গড়পড়তা পঞ্চাশ-ষাট মাইলের বেশি প্রায় যায় না। কিন্তু এরোপ্লেন অনায়াসেই ঘণ্টায় একশো মাইলের বেশি হয়। তা ছাড়া, এরোপ্লেন একেবারে সোজা রাস্তা ধরে চলে-তার জন্য আর রাস্তা তৈরি করতে হয় না-কোনো বাধাই নাই তার। আমেরিকাতে অজিকাল নিয়মমতো এরোপ্লেনে ডাক যা। ভারতবর্ষের এক কোনা থেকে আরেক কোনায় ডাক যেতে যত সময় লাগে কয়েক বৎসর পর হয়তো সেই সময়ের মধ্যেই বিলাতের ডাক এদেশে এরোপ্লেনে পৌছে যাবে।