সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/মামার খেলা
(পৃ. ২৬৯-২৭০)
মামা বললেন, “আয়, একটা নুতন খেলা খেলবি আয়।” শুনে সবাই দৌড়ে এসে বসল, “কি খেলা, মামা?”
মামা বলেন, “এ খেলার নিয়ম খুব সহজ, কিন্তু খেলতে হলে খুব হুঁশিয়ার হওয়া চাই। নিয়ম হচ্ছে এই যে, সবাই যেমন ইচ্ছা কথা বলতে পারবে, কিন্তু এক-একটা অক্ষর বাদ দিয়ে।” সবাই বললে, “সে আবার কিরকম?”
মামা—এই মনে কর, যেন ‘ক’ বলব না—এমন কোনো কথাই বলব না, যার মধ্যে কোথাও ‘ক’ আছে। যেমন -কলা, কৃপণ, হাল্কা, বাক্স এ-সব কিছুই বলতে পারব না। পটলা অমনি চট্ করে বলে উঠল, “এ আর মুস্কিল কিসের? ও-সব না বললেই হল।”
মামা বললেন, “না বললে তো হলই, কিন্তু না বলে পারিস কিনা একবার দেখ তো।”
পটলা আচ্ছা বেশ -এই দেখ, আমি ‘ক’ বলব না -
মামা - আচ্ছা আয় দেখি, আমার সঙ্গে গল্প কর, আমিও ‘ক’ বলব না। এই খেলা আরম্ভ হচ্ছে-ওয়ান টু থ্রি। -হ্যঁরে পটলা, তুই এখন বোধোদয় পড়িস?
পটলা-বোধোদয়! সে তো কোনো কালে -ঐ যা! ‘ক’ হয়ে গেল। আচ্ছ। দাঁড়াও, আবার বলছি। বোধোদয় আমি অনেকদিন হল-
হারু, বিশু, কালু- অ্যাঁ! 'অনেক’ বললে যে!
পটলা- ও তাই তো। আচ্ছা বলছি - বোধোদয় আমার বহুত দিন হল শেষ হয়েছে-এখন চারুপাঠ দ্বিতীয় ভাগ পড়ছি।
মামা- বেশ বেশ, খুব বলেছিস। পড়াশুনো বেশ চলছে তো? না রোজ মাস্টারমশাই মার লাগান?
পটলা- ইস্! তা বৈ-বাস্ রে, বড্ডো সামলে গেছি। না মারবেন কেন? দুত্তরি এ ছাই খেলা।
হারু-আমি খেলব মামা -আমি ‘ল’ বলব না।
মামা- বলবি নে? আচ্ছা আমি এক্ষুনি বলাচ্ছি তোকে। আমিও ‘ল’ বাদ দিলাম-ওয়ান টু থ্রি। হ্যারে হারু, তুই মাথা মুড়িয়েছিস কেন?
হারু- ওটা ওটা নাপিতে কামিয়ে দিয়েছে।
মামা-নাপিতে কামড়িয়ে দিয়েছে কেন?
হারু- না, কামড়িয়ে নয়-কামিয়ে।
মামা-ও, কামিয়ে? কি দিয়ে? কাস্তে দিয়ে?
হারু-না, ক্ষুর দিয়ে -
মামা-বেশ বেশ। তা কিরকম করে কামায় একটু বুঝিয়ে দে তো, সবাই শুনুক।
হারু–এই একটা বাটির মধ্যে খানিকটা ঐ যা। দাঁড়াও বলছি-খানিকটা Water দিয়ে তার পর একটা চামড়ার উপর ক্ষুর ঘষে ঘষে ধার দিয়ে, কচ্কচ্ করে—হু—কচ্কচ্ করে—
পটলা—কচকচ্ করে চালিয়ে দিল।
বিশু-বুলিয়ে গেল। না, তা হলেও হয় না—
হারু-কচ্কচ্ করে সব সাবাড় করে দেয়।
মামা- বেশ, বেশ, এই তো চমৎকার হচ্ছে। হুঁশিয়ার থাকা চাই আর চট্পট্ কথা জোগানো চাই। আচ্ছা, তোর বড়দা আসবে কবে?
হারু - (মাথা চুলকাইয়া) এই-আজকের দিনের পরের দিন।
মামা - দুপুরের ট্রেনে বুঝি?
হারু- না, বিকেল—ঐ যা! “ল' হয়ে গেল।
কালু- আমি খেলব। আমি ‘ঘ’ বলব না।
মামা তার চেয়ে বল না, হয়ে ময়ে ‘হ্ম’ বলব না? সব গোলমাল চুকে যায়।
কালু - তা হলে কোনটা বলব না বলে দাও।
মামা—আচ্ছা, ন’ বলিস নে। আয় দেখি –ওয়ান টু থ্রি-খেলাটা বুঝতে পেরেছিস তো?
কালু - হ্যাঁ।
মামা –কিরকম বুঝেছিস বল তো—
কালু– খুব ভালো।
মামা-(ভ্যাংচাইয়া) খুব ভালো। তুই কথা বলতে শিখেছিস কবে থেকে?
কালু —ছেলেবেলা।
মামা-আর এই বুড়োবেলায় বুঝি বোবামি শিখেছিস?
কাল - দ্যুৎ!
মামা- এটা দেখি আচ্ছা ট্যাটা মুখ বুজেই থাকবে। ওরে, একটু কথা-টথা বল, চুপ করে থাকলে কি খেলা হয়?
কালু-(অনেক ভাবিয়া) মামা, তুমি কি খাও?
মামা –তোমার মাথা খাই। গাধা কোথাকার। বলি ঝগড়ার সময় কি তুই ঘাড় গুঁজে চুপ করে থাকিস্?
কালু -উঁহু।
মামা – কি করিস তা হলে?
কালু- ঝগড়া করি!
মামা – (চটিয়া) ঝগড়াটা কিরকম শুনি—(জিভ কাটিয়া) হ্যাঁ, কিরকম বল তো।
অমনি সকলের তুমুল চীৎকার –“ন” বলেছে—মামা 'ন' বলেছে—মামা কালুর সঙ্গে হেরে গিয়েছে।”
মামা বললেন, “যা! তোদের আর খেলাটেলা কিছু শেখাব না—তোরা বেজায় ফচ্কে হয়েছিস!”