সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ভুঁইফোঁড়

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৬৭-২৬৮)
ভুঁইফোঁড়

 কেঁচোরী যে মাটি খুঁড়ে চলে তা তোমরা সকলেই জান, কিন্তু কেমন করে চলে জান কি? কেঁচোর শরীরটা একটা লম্বা ফাঁপা চোঙার মতো, তার দুইদিকেই ফুটো। একদিক দিয়ে কেঁচো মাটি গিলতে থাকে, আর-একদিক দিয়ে সেই মাটি সরু সুতোর মতো হয়ে ক্রমাগতই বেরিয়ে যায়। এমনি অদ্ভুতরকম করে মাটি খেয়ে খেয়ে আর সরিয়ে সরিয়ে কেঁচোরা মাটির মধ্যে ঢোকে।

 কেঁচোর বিদ্যেটাকে আজকাল মানুষও শিখে নিয়েছে! মানুষে ভাবি ভারি কেঁচো-কল বানিয়ে, তা দিয়ে মাটির মধ্যে বড়ো বড়ো সুড়ঙ্গ কেটে ফেলে। ইউরোপ আমেরিকার অনেক শহরের তলায় মাটির নীচে যে-সমস্ত রেল রাস্তার সুড়ঙ্গ থাকে, সেগুলোর অধিকাংশই কেঁচো-কল দিয়ে কাটানো হয়।

 কেঁচো-কল কিরকম জানো? প্রকাণ্ড মজবুত লোহা-বাঁধানো নলের মতো জিনিস, তার মধ্যে ভারী কলকব্জা। নলের মাথাটা কলের ধাক্কায় ক্রমাগত জমাট মাটির মধ্যে ঢুঁ মেরে এগিয়ে চলতে চায়। মাটি আর সরবার পথ পায় না, কাজেই সে হাঁ-করা চোঙার ভিতর দিয়ে নলের মধ্যে ঢুকে কলের পিছন দিকে বেরিয়ে এসে জমতে থাকে। এমনি করে কেঁচো-কল এগিয়ে চলে আর আপনি আপনি সড়ঙ্গ কাটা হয়ে যায়। কলের সঙ্গে সঙ্গে লোকজন সব চলতে থাকে, তারা ক্রমাগতই মাটি সরায়, রেল বসায়, আর সুড়ঙ্গের ভিতরটাকে মজবুত লোহায় মোড়া পাকা গাঁথনি দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়। বড়ো-বড়ো এক-একটা কেঁচো কল এক-এক দমে পাঁচ-ছয় হাত এগিয়ে যায়। তার পর আবার কলকব্জা গুটিয়ে দম নিতে থাকে। এমনি করে নরম মাটিতে সারাদিনে হয়তো একশো হাত সুড়ঙ্গ কাটে।

 লণ্ডন শহরের পঁচিশ-ত্রিশ বা চল্লিশ হাত নীচেকার মাটি খুব নরম। কেঁচোকলের ঠেলায় পড়লে সে মাটি কচ্‌কচ্ করে কেটে যায়। কিন্তু মাটি যদি ইটের মতন শক্ত হয়-যদি পাথরের মধ্যে সুড়ঙ্গ কাটা দরকার হয় তা হলে আর কেঁচোকলের শক্তিতে কুলায় না। তখন অন্যরকম ভুঁইফোড় কলের ব্যবস্থা করতে হয়। মাটি কাটার চাইতে পাথর কাটার হাঙ্গামা অনেক বেশি। কতরকম সাংঘাতিক কল দিয়ে পাথরকে কেটেকুটে খুঁড়েফঁড়ে খুঁচিয়ে পিটিয়ে তবুও যখন পারা যায় না—যখন যন্ত্রের মুখ ক্রমাগতই ভোঁতা হয়ে যায়, কলের ফলা বারেবারেই ভাঙতে থাকে, সারাদিন পরিশ্রমের পর সুড়ঙ্গ পাঁচ হাত এগোয় কিনা সন্দেহ-তখন বোমাবারুদ ফুটিয়ে, পাথর উড়িয়ে পথ করতে হয়। এমন পরিশ্রমের কাজ খুব কমই আছে। এক-একটা ছোটোখাটো পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ বসাতে কত সময়ে বছরের পর বছর কেটে যায়।

 লণ্ডনের যে সুড়ঙ্গ-রেল, তাকে সেদেশে ‘টিউব' (Tube) বলে। শহরের মাঝে মাঝে টিউব স্টেশন থাকে, সেখানে ঢুকে টিকিটঘরের জানালা দিয়ে টিকিট কিনতে হয়, অথবা টিকিট-কলে এক পেনি বা দু পেনি ফেলে দিয়েও টিকিট নেওয়া যায়। তার পর একটা লিফট বা চল্‌তিঘরে ঢুকতে হয়, সেখানে টিকিট দেখে। চল্‌তিঘর বোঝাই হলেই লোহার দরজা বন্ধ করে দেয় আর ঘরসদ্ধ সবাই একটা খাড়া পাতকুয়ার মতো সুড়ঙ্গ বেয়ে মাটির মধ্যে অন্ধকারে নামতে থাকে। পাঁচতলা বা সাততলা বাড়ির সমান নীচে নামলে পর পাতকুয়ার তলায় স্টেশনের প্লাটফরম পাওয়া যায়। সেখানে চারিদিকে বিদ্যুতের আলো। দুমিনিট পরে পরে একটা করে ট্রেন আসে আর আধ মিনিট করে থামে। এক-একটা ট্রেনে লম্বা-লম্বা পাঁচ-সাতটা গাড়ি, প্রত্যেক গাড়ির সামনে পিছনে লোহার ফটক। ফটকের পাশে লোক বসে থাকে, তারা “আর্লস্ কোর্ট’ ‘পিক্যাডিলি’ ‘হোবর্ণ’ বলে সব টেশনের নাম ডাকে আর ফটক খুলে দেয় আর লোকেরা সব হুড়্‌হুড়্ করে ওঠে আর নামে।

 ট্রেনের বন্দোবস্ত এমন আশ্চর্য কোথাও বিপদের ভয় নেই। সামনে যদি কোথাও ট্রেন আটকিয়ে থাকে, তা হলে পিছনের ট্রেন আপনা থেকেই থেমে পড়বে। ট্রেনের ড্রাইভার বা চালক যদি হঠাৎ মরেও যায়, তবুও ট্রেন স্টেশনের ধারে এসেই দাঁড়িয়ে যাবে। পাতালপুরীর ট্রেন, সেখানে বাতাস চলবার ব্যবস্থা খুব ভালো করেই করতে হয়। বড়ো বড়ো দমকলের হাওয়া দিয়ে সমস্ত টিউবটাকে সারাক্ষণ ভরিয়ে রাখতে হয়। ট্রেনগুলি সব বিদ্যুতে চলে, তাতে আগুনও জ্বলে না, ধোঁয়াও ছাড়ে না।

 অনেক সময় নদীর তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ বসাবার দরকার হয়। নদী যদি খুব বড়ো আর খুব গভীর হয়, তা হলে তার তলা দিয়ে মাটির মধ্যে সুড়ঙ্গ নেওয়া এক ভীষণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় এ কাজটিকে সহজ করার জন্য এক চমৎকার কৌশল খাটানো হয়। আগে ডাঙার উপর সুড়ঙ্গ বানিয়ে, তার পর সেই সুড়ঙ্গ ভাসিয়ে নদীর মধ্যে ঠিক জায়গায় নিয়ে ডুবিয়ে দেয়। তাতে হাঙ্গামাও কমে, খরচও বাঁচে, কাজও হয় খুব তাড়াতাড়ি।

 বড়ো-বড়ো শহরের বড়ো-বড়ো কাণ্ড। ঘোড়া মোটর রেল ট্রাম তো সারাদিনই লোকে ভর্তি, তার উপর ডাক পার্শেল মাল মোটেরও অন্ত নাই। রাস্তার উপরেও যেমন, নীচেও তেমন-উপরেই বরং হৈচৈ, মাটির নীচে সব ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়ম বাঁধা। এক আমেরিকার শিকাগো শহরেই সুড়ঙ্গের রেলগাড়িতে প্রতিদিন সাড়ে সাতলক্ষ মণ মাল পারাপার করে। সেখানকার বড়ো-বড়ো দোকানের আর গুদামখানার নীচের তলায় সুড়ঙ্গ থাকে, একেবারে মাটির নীচে রেলের লাইন পর্যন্ত! তারা মালপত্র সব সেখান দিয়ে শহরের তলায় তলায় চালান করে।

 কথা হচ্ছে, কলকাতায় এইরকম ভূঁইফোড় সুড়ঙ্গের রেল বসানো হবে। তা যদি হয়, তখন আর বর্ণনা করে বোঝাবার দরকার হবে না, টিকিট কিনে চড়ে দেখলেই পারবে, আর মনে করবে, এ আর একটা আশ্চর্য কি? এখন কলকাতার শহরে মোটর গাড়ি দেখলে কেউ ফিরেও তাকায় না। কিন্তু আমার বেশ মনে পড়ছে, এক সময়ে সামান্য একটা বাইসাইকেল দেখবার জন্য আমরা কিরকম উৎসাহ করে দৌড়ে আসতাম।

সন্দেশ-আশ্বিন, ১৩২৭