সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/বায়োস্কোপ

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৬৫-২৬৬)
বায়োস্কোপ

 ঘরের বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। চেয়ে দেখ, খাড়া খাড়া রেখার মতো বৃষ্টির ধারা পড়ছে। এক-একটি ধারা এক-একটি বৃষ্টির ফোঁটা; কিন্তু ফোটাগুলো মোটেইফোঁটার মতো দেখাচ্ছে না- দেখাচ্ছে ঠিক লম্বা লম্বা আঁচড়ের মতো। একটা দড়ির আগায় একটা পাথর বেঁধে যদি খুব তাড়াতাড়ি ঘোরাতে পার তা হলে দেখতে মনে হবে, যেন আস্ত একটা চাকা ঘুরছে। কিন্তু তা বলে পাথরটা ঘুরবার সময় তো আর সত্যি করে চাকার মতো হয়ে যায় না। তবে এরকম দেখায় কেন?

 অন্ধকার রাত্রে আকাশের গা দিয়ে যখন উল্কা ছুটে যায় তখন তাদেরও দেখায় ঠিক ঐরকম একটানা লম্বা দাগের মতো। উল্কাটা জ্বলতে জ্বলতে যে পথ দিয়ে ছুটে গেল, মনে হয় যেন সেই পথের সমস্তটা বা অনেকখানি এক সঙ্গে জ্বলতে দেখলাম। কিন্তু আমরা জানি, উল্কাটা সত্যি সত্যি একই সময়ে ততখানি লম্বা জায়গা জুড়ে ছিল না। সেটা আগে এখানে, পরে ওখানে, তার পর সেখানে, এমনি করে ক্রমাগত ছুটে চলেছে-কিন্তু সে খুব তাড়াতাড়ি চলছে বলে মনে হয় যেন একই সময়ে তাকে এখানে ওখানে সেখানে দেখতে পাচ্ছি। বৃষ্টির ফোঁটার বেলাও তেমনি হয়। এইমাত্র তাকে দেখছি মাটির থেকে বিশ হাত উঁচুতে; কিন্তু এই দেখাটুকু মন থেকে মুছতে না মুছতে সেই ফোঁটাটা একেবারে মার্টি পর্যন্ত নেমে পড়েছে। তাই মনে হচ্ছে যেন একই সময়ে বিশ হাত উঁচু থেকে মাটি পর্যন্ত সমস্তটা জায়গা জুড়েই ফোঁটাটাকে দেখতে পাচ্ছি।

 এইরকম পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, চোখ দিয়ে আমরা যা দেখি, চোখের দেখা শেষ হলেও তাকে আমাদের মন খানিকক্ষণ পর্যন্ত ধরে রাখে। সে অতি অল্প সময়-এক সেকেণ্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ, অথবা তার চাইতেও কম।

 মনে কর, একটা ছবির দিকে তুমি তাকিয়ে আছ। আমি মাঝে থেকে তোমার চোখের সামনে আড়াল দিলাম, তুমি আর সে ছবি দেখতে পারছ না। যদি আড়াল সরিয়ে নেই, অমনি আবার দেখতে পাবে। যদি বার বার আড়াল দেই আর বার বার সরাই, তা হলে মনে হবে, ছবিটা বার বার দেখা যাচ্ছে আর বার বার অদৃশ্য হচ্ছে। কিন্তু এই কাজটি যদি খুব তাড়াতাড়ি করতে পারি। অর্থাৎ মনে কর প্রতি সেকেণ্ডে যদি দশবার আড়াল পড়ে আর দশবার দেখতে পাও, তা হলে আর আড়াল-দেওয়া টের পাবে না। মনে হবে আগাগোড়াই স্থিরভাবে ছবিটা দেখতে পাচ্ছি। প্রথম যে ছবি দেখছ, তার জের ফুরোতে না ফুরোতে দ্বিতীয়বারের ছবিটা এসে পড়ছে। এই দ্বিতীয়বারের ‘রেশটুকু' থাকতে থাকতেই আবার তৃতীয়বারের ছবিটা চোখে পড়ছে। তাই মনে হয়, আগাগোড়াই সমান দেখতে পাচ্ছি।

 কিন্তু ছবিটা যদি আগাগোড়া একইরকম না থেকে ক্রমাগত বদলিয়ে যেতে থাকে। মনে কর, একটা সঙ খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পর ক্রমে সে কাত হয়ে শুয়ে পড়ছে, তায় পর মাথা নিচু করে ঠ্যাং দুটোকে ঘুরিয়ে, কেমন ডিগবাজি খেয়ে, শেষটায় আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে! এই ছবিগুলো যদি খুব তাড়াতাড়ি একটার পর একটা ঠিকমত তোমার চোখের সামনে ধরে দেওয়া যায়, তা হলে তোমার মনে হবে সত্যি সত্যি যেন ছবিতে সঙটা ডিগবাজি খাচ্ছে।

 আজকাল যে শহরে শহরে, এমন-কি, পাড়াগাঁয়ে পর্যন্ত লোকেরা বায়োস্কোপ দেখে তার সংকেতও এইরকম। খুব চট্‌পট্ করে যদি কোনো চলতি জিনিসের অনেকগুলো ফোটো নেওয়া হয়—আর তার পর যদি সেই ফোটোগুলোকে তেমনি তাড়াতাড়ি, সেকেণ্ডে দশ-বারোটা করে পরপর চোখের সামনে ধরে দেখানো হয়, তা হলেই বায়োস্কোপ দেখানো হল। মনে কর, বায়োস্কোপে তোমার, ভাত-খাওয়ার ছবি নেওয়া হচ্ছে। তা হলে কিরকম হবে? প্রথম ছবিতে হয়তো তুমি ভাতের গ্রাস ধরেছ, তোমার মুখটা তখনো বোজা আছে। দ্বিতীয় ছবিতে থালা থেকে তোমার হাত উঠছে, মুখটাও একটু খুলতে চাচ্ছে। তৃতীয় ছবিতে হাতখানা আরো উঠেছে, মুখেও বেশ ফাঁক দেখা দিয়েছে। তার পর হাতটা ক্রমেই মুখের কাছে এগিয়ে আসছে আর মুখের হাঁটাও বেশ বড়ো হয়ে আসছে। তার পর হাত গিয়ে মুখে ঠেকেছে, তার পর মুখের মধ্যে গ্রাস ঢুকছে ইত্যাদি।

 প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে প্রথম যে বায়োস্কোপের ছবি তোলা হয়েছিল, সেই ছবি তুলবার জন্য চব্বিশটা ফোটোগ্রাফের কল পর পর সাজানো হয়েছিল আর প্রত্যেকটা কলের সামনে এক-একটা সুতো এমনভাবে টেনে বাধা হয়েছিল যে ঘোড়াটা কলের সামনে দিয়ে যেতে গেলেই সুতো ছিঁড়ে যাবে, আর ক্যামেরাতে ঘোড়ার ফোটো উঠে যাবে। আজকালকার বায়োস্কোপকলের বন্দোবস্ত এরকম নয়। তাতে একটা লম্বা ফিতের উপর পর পর হাজার হাজার ছোটোছোটো ফোটো তোলা হয়। এক-একটা ছবি ওঠে আর ফিতেটা এক-এক ঘর সরে যায়। এমন করে প্রত্যেক সেকেণ্ডে দশ-বারোটা করে ফোটো তোলা হয়-ঘণ্টায় প্রায় চল্লিশহাজার!

 এমন কলও তৈরি হয়েছে যাতে প্রতি সেকেণ্ডে পাঁচহাজার ফোটো তোলা যায়। এইরকম তাড়াতাড়ি ফোটো তুলে তার পর যদি দেখাবার সময়ে বেশ ধীরে ধীরে সাধারণ বায়োস্কোপের ছবির মতো দেখানো হয় তা হলে খুব দ্রুত ঘটনার ছবিও বেশ স্পষ্ট করে সহজভাবে দেখবার সুবিধা হয়। একটা সাবানের বুদ্বুদের ভিতর দিয়ে বন্দুকের গুলি ছুটে গেলে বুদ্বুদটা কিরকম করে ফেটে যায় তাও দেখানো যায়। চোখে দেখলে এই ব্যাপারটা হঠাৎ এক মুহর্তে শেষ হয়ে যায়-বন্দুক ছুটল আর বুদ্বুদ ফাটল এইটুকুই খালি বোঝা যায়। কিন্তু ছবিতে স্পষ্ট করে দেখা যায় কেমন করে গুলিটা বুদটাকে ফুটো করে ঢোকে, আবার ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়, আর বুদ্বটাও ফেটে চুপসে একেবারে মিলিয়ে যায়। আবার যেব্যাপারটা ঘটতে অনেক সময় লাগে তাকেও বায়োস্কোপের ছবিতে খুব অল্প সময়য়ের মধ্যে চটপট ঘটিয়ে দেখানো যায়। ফুলগাছের টবে সবেমাত্র অঙ্কুর গজাচ্ছে, সেই অঙ্কুর থেকে গাছ হবে, সেই গাছ বাড়বে, তাতে কুঁড়ি ধরবে, তার পর ফুল ফুটবে-বসে বসে দেখতে গেলে কতদিন সময় লাগে! বায়োস্কোপে যদি তার ছবি তোল, এক-এক দিনে দশ-বারোটা বা পঁচিশ-ত্রিশটা করে আর দেখবার সময় চটপট দেখিয়ে যাও—তা হলে দেখবে যেন চোখের সামনেই দেখতে দেখতে গাছ গজিয়ে বেড়ে উঠছে আর ফুল ফুটছে!

সন্দেশ-ভাদ্র, ১৩২৭