সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/দক্ষিণ দেশ
(পৃ. ২১৩-২১৭)
কলম্বসের আগে লোকে আমেরিকার কথা জানিত না—সে সময়ে লোকে তিনটিমাত্র মহাদেশের কথা জানিত। আমেরিকা আবিষ্কারের পর প্রায় একশত বৎসর পর্যন্ত আর কোনো নুতন মহাদেশের কথা শুনা যায় নাই। ১৬০১ খৃস্টাব্দে এক পর্তুগীজ নাবিক আসিয়া বলে যে ভারত মহাসাগরের দক্ষিণ অঞ্চলে সে এক প্রকাণ্ড নুতন দেশ দেখিয়াছে। তার পাঁচ বৎসর পরে স্পেন দেশের এক জাহাজের কাপ্তান বলে সেও নাকি ঐ দেশের কাছ দিয়া আসিয়াছে। তার পর বহুদিন পর্যন্ত ওলন্দাজ নাবিকদের মুখে ঐ দেশের কথা মাঝে মাঝে শুনা যাইত। কেহ কেহ সেই নুতন দেশে যাইবার চেষ্টায় জাহাজ ডুবি হইয়া মারা যায়। দু-একজন দেশে ফিরিয়া বলে, “দেশটা একেবারে ফাঁকা-দেখিবার কিছু নাই।”
১৬৪২ খৃস্টাব্দে টাসমান নামে এক সাহসী ওলন্দাজ নাবিক এই নূতন দেশের সন্ধানে বাহির হন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে একটা দ্বীপে গিয়া জাহাজ ভিড়াইলেন, তাঁহারই নামে সেই দ্বীপের নাম হইয়াছে টাসমানিয়া। দ্বীপটাকে তিনি দ্বীপ বলিয়া বুঝিতে পারেন নাই—তিনি ভাবিলেন, এই সেই প্রকাণ্ড নূতন দেশ। দুঃখের বিষয় দ্বীপটা তাঁহার ভালো করিয়া দেখা হয় নাই। একদল নাবিক লইয়া তীরে নামিতেই তাঁহারা দেখিলেন একটা গাছের গায়ে কতগুলা খাঁজ কাটা রহিয়াছে। অস্ত্রের দাগ দেখিয়া তাঁহারা বুঝিলেন এখানে মানুষ আছে। তিনহাত-সাড়ে তিনহাত অন্তর এক-একটি খাঁজ দেখিয়া নাবিকেরা ভাবিল ঐ খাঁজে খাঁজে পা দিয়া যাহারা গাছে চড়ে তাহাদের পা নিশ্চয়ই সাংঘাতিক লম্বা, সুতরাং তাহারা নিশ্চয়ই রাক্ষস। রাক্ষসের ভয়ে তাহাদের আর নূতন দেশ দেখা হইল না। টাসমানের পর যাহারা নূতন দেশ দেখিতে আসে তাহারা সকলেই হল্যাণ্ড দেশের লোক-তাহারা সে দেশের নাম দিল নুতন হল্যাণ্ড। ইহার প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পরে ড্যাম্পিয়ার নামক এক ইংরাজ অষ্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে জাহাজ লাগাইলেন। সে এক আশ্চর্য সুন্দর জায়গা। তীরে নামিতেই তাজা ফুলের গন্ধে তাঁহাদের মনটা খুশি হইয়া উঠিল। সবুজ গাছগুলি ফুলে ফুলে রঙিন হইয়া উঠিয়াছে, তাহার মধ্যে রঙ-বেরঙের নানান পাখি উড়িয়া উড়িয়া ফিরিতেছে। তাহারা ডাঙায় নামিয়া চারিদিক ঘুরিয়া কত অদ্ভুত দৃশ্য আর তাহার চাইতেও কত অদ্ভুত জন্তু দেখিতে পাইলেন। একটা জন্তু, তার ইঁদুরের মতো মুখ, প্রায় মানুষের মতো বড়ো—সে দুই পায়ে ভর দিয়া বিশ হাত লম্বা লাফ দেয়। তোমরা জান সে জন্তুর নাম কাঙারু কিন্তু সে-সময়ে অমন জন্তু কেহ দেখে নাই। সেদেশের মানুষদের তিনি দেখিলেন—রোগা লম্বা, সরু সরু হাত-পা আর কুচকুচে কালো। তাহারা কাপড় পরিতে জানে না। গাছের ছাল পরিয়া থাকে।
ড্যাম্পিয়ারের পর আরো প্রায় আশি বৎসর কেহ সে দেশের বড়ো একটা খবর লয় নাই। ১৭৬৯ খৃষ্টাব্দে আবার আর-একজন ইংরাজ নাবিক তাহার সন্ধান করিতে বাহির হইলেন। ইহার নাম কাপ্তান কুক। কাপ্তান কুকের মতো অমন সাহসী নাবিক সেকালে খুব কমই ছিল। তিনি জাহাজে করিয়া কত যে নুতন দেশের সন্ধানে ঘুরিয়াছিলেন তাহার বর্ণনা করিতে গেলেও প্রকাণ্ড পুঁথি হইয়া যায়। কাপ্তান কুক প্রথম যেখানে গেলেন সেটা অস্ট্রেলিয়া নয়, সেটাকে এখন নিউজিল্যাণ্ড বলা হয়। নিউজিল্যাণ্ডের চারিদিক ঘুরিয়া তিনি দেখিলেন এটা একটা দ্বীপ-আসল মহাদেশটা আরো পশ্চিমে। তার পর নিউজিল্যাণ্ড ছাড়িয়া উনিশ দিন পরে তিনি 'নতুন হল্যাণ্ডে' উপস্থিত হইলেন। অনেক ঘুরিয়া একটা সুবিধামতো জায়গায় জাহাজ ঠেকাইতেই চারিদিক হইতে কতগুলা কাদামাখা অদ্ভুত লোক আসিয়া ভীড় করিয়া দাঁড়াইল। তার পর নাবিকেরা যখন জাহাজ হইতে ডাঙায় নামিবার চেষ্টা করিল তখন তাহারা বল্লম ছুঁড়িয়া মারিতে লাগিল। জাহাজ হইতে কতগুলা ফাঁকা আওয়াজ করিতে তাহারা একটু ভয় পাইল, কিন্তু তাহাতে কেহ মরিল না দেখিয়া আবার তাহাদের সাহস ফিরিয়া আসিল। তখন একটা লোকের পায়ে ছর্রা মারিতেই তাহারা ভয় পাইয়া পলাইল।
জাহাজ মেরামতের জন্য কাপ্তান কুককে কিছুদিন সেখানে থাকিতে হইল। এই সময়ের মধ্যে নাবিকেরা সেদেশী লোকেদের সঙ্গে বেশ ভাব করিয়া লইয়াহিল। জাহাজ মেরামত হইলে কাপ্তান কুক তীর ধরিয়া ধরিয়া উত্তর দিক পর্যন্ত ঘুরিয়া দেখিলেন। নূতন দেশের সমস্ত পূর্ব দিকটাতে ইংরাজের অধিকার ঘোষণা করিয়া তিনি তাহার নাম রাখিলেন “নিউ সাউথ ওয়েলস'। তার পর কথা উঠিল এই নূতন দেশটাকে লইয়া কি করা যায়। ইংরাজ গভর্নমেণ্ট বলিলেন, 'যে-সকল কয়েদী অপরাধীদের দ্বীপান্তরে তাড়ানো আবশ্যক, তাহাদের ঐখানে চালান করিয়া দাও।' তখন এগারটি জাহাজ বোঝাই করিয়া কয়েদী পাঠানো হইল। তাহাদের পাহারার জন্য সৈন্য গেল। শাসন ব্যবস্থার জন্য সরকারি কর্মচারী গেল, স্ত্রী পুত্র পরিবার লইয়া দলে দলে ডাক্তার নাবিক মজুর গেল। কাপ্তান ফিলিপ হইলেন এই দলের গভর্নর বা শাসনকর্তা। তাঁহারা সুবিধামতো জায়গা খুঁজিয়া সেইখানে কাঠের ঘরবাড়ি বসাইয়া বেশ ছোটোখাটো একটি শহর পত্তন করিলেন।
কাপ্তান ফিলিপ সেদেশী লোকদের মনে সদ্ভাব জাগাইবার জন্য নানারকম চেষ্টা করিয়াও তাহাদের ভয় ও সন্দেহ দুর করিতে পারেন নাই। ভালো-ভালো বকসিস দিয়া নানারকমে লোভ দেখাইয়া তিনি দুই-এক জনকে অনেকটা বশ করিয়াছিলেন। তাহার মধ্যে বেলিনি নামে একজন ছোকরাকে তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া কয়েকদিন, খুৰ আমোদে রাখিয়াছিলেন। বেলিনি যখন তাহার লোকদের কাছে ফিরিয়া গেল তখন তিনি একদিন অনেকরকম উপহার সইয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে গেলেন। দুঃখের বিষয় একজন সেদেশী লোকের সঙ্গে ‘হ্যাণ্ডশেক' করিতে যাওয়ায় সে হঠাৎ কেমন ভুল বুঝিয়া তাহাকে অক্রিমণ করিয়া কঁধের কাছে বল্লম বিঁধাইয়া দেয়। বেলিনির যত্নে ও সাহায্যে সেবার তিনি বাঁচিয়া গেলেন। ইহার পর হইতে বেলিনি তাঁহার খুব ভক্ত হইয়া উঠিল এবং ক্রমে সেদেশী লোকেদের সঙ্গে তাহার অনেকটা বনিবনাও হইয়া গেল।
এমনি করিয়া নুতন দেশে ইংরাজের উপনিবেশ আরম্ভ হইল। কথা ছিল মাঝে মাঝে বিলাত হইতে জাহাজে করিয়া রসদ আসিবে, তাহাতে তাহাদের খাবার কষ্ট ঘুচিবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইংলণ্ড হইতে জাহাজ আসিয়া পৌছিতে অসম্ভবরকম বিলম্ব হইয়া গেল। শহরের চাল ময়দা শাক সবজী গোরু ছাগল সব ফুরাইয়া আসিল। গভর্নর হইতে আরম্ভ করিয়া প্রত্যেক লোকেই দিনে তিন ছটাক ময়দার রুটি, দুই ছটাক মাংস আর এক ছটাক চালের ভাত খাইয়া সপ্তাহের পর সপ্তাহ কোনোরকমে দিন কাটাইতে লাগিল।
তাহাতেও যখন খাদ্য প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় একদিন তিন জাহাজ বোঝাই করিয়া রসদ আসিয়া হাজির হইল। এইরকম কষ্টের মধ্যে অষ্ট্রেলিয়ায় ইংরাজ রাজ্যের পত্তন হইল। তাহার পর আরো কত লোক সেদেশে আসিতে আরম্ভ করিল; কেহ চাষবাসের জন্য, কেহ খনি খুঁড়িবার জন্য, কেহ দেশ আবিষ্কারের জন্য, কেহ কেবলমাত্র চাকুরি খুঁজিবার জন্য। একটা শহর ছিল দেখিতে দেখিতে দুই-চার দশটা শহর জাগিয়া উঠিল। ততদিনে তাহার ‘নিউ হল্যাণ্ড' নাম ঘুচিয়া নুতন নাম হইয়াছে অস্ট্রেলিয়া বা ‘দক্ষিণ দেশ'।
অস্ট্রেলিয়ার মাঝখানে অনেকটাই সে সময়ে অজানা দেশ ছিল। বড়ো-বড়ো মরুভূমি, সেখানে কি আছে তাহা অনেকদিন পর্যন্ত কেহ জানিত না। ঐ-সকল অজানা দেশে যাইবার জন্য অনেক লোকে চেষ্টা করিতে লাগিল। এই-সকল ভ্রমণবীরের বীরত্ব-কাহিনী শুনিলে অবাক হইতে হয়। ফিণ্ডার্স আর বাস্ নামক দুই ইংরাজ ছোকরা নানা জায়গায় ঘুরিয়া অনেক নুতন স্থানের সংবাদ আনিয়াছিল। একটা সামান্যরকমের নৌকায় চড়িয়া তাহারা নদীতে ও সমুদ্রে পাড়ি দিয়া ফিরিত, ফিল্ডার্স বড়ো আমুদে লোক ছিল, সে একবার কতগুলী সেদেশী লোকের হাতে পড়ে। তাহাদের ভাবগতিক মোটেই সুবিধামতো ছিল না, তাই তাহাদের খুশি রাখিবার জন্য সে নানারকম কাণ্ড করিয়াছিল। এমন-কি, শেষটায় রসিকতা করিয়া তাহাদের কয়েকজনের দাড়ি পর্যন্ত কাঁচি দিয়া ছাঁটিয়া দিয়াছিল। তাহাতে সেই লোকেরা নাকি ভারি খুশি হইয়া তাহাকে ছাড়িয়া দেয়।
অস্ট্রেলিয়ার অজানা দেশে যাওয়া বড়োই বিপদের কথা। লোকের অত্যাচার আর মরুভূমি তো আছেই, তাহার উপর মাঝে মাঝে এমন চোরামাটি যে তাহার উপর চলিতে গেলে পাঁকে ডুবিয়া মরিতে হয়। সে দেশের নদীগুলাও কেমন বেয়াড়া, তাহাদের মতিগতির যেন কিছুই স্থির নাই। লেফটেনাণ্ট অক্সলি এক জায়গায় প্রকাণ্ড নদী দেখিয়াছিলেন, সে নদীতে বান আসিয়া তাঁহাকে অনেকবার নাকাল করিয়াছিল। ছয় বৎসর পরে কাপ্তান স্টার্ট সেইখানে গিয়া দেখেন খটখটে শুকনা ডাঙা, তাহার মাঝে মাঝে ছোটোখাটো বিলের মতো—নদীর চিহ্নমাত্র নাই!
১৮৪০ খৃষ্টাব্দে আয়ার নামে এক সাহেব অস্ট্রেলিয়ায় মাঝখানের অজানা দেশটা দেখিবার জন্য বাহির হন। তিনি দক্ষিণ হইতে উত্তরে চলিতেছিলেন-দিনের পর দিন চলিয়া কেবল লাল বালি আর শুকনা হ্রদ ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পান না; তার পর তিনি পশ্চিমমুখে গিয়া সেদিকেও সামান্য কাঁটাঝোপ ছাড়া আর কোনো গাছ পাইলেন না। জলের কষ্ট এত বেশি যে চল্লিশ দিনে তিনি দেড়শত মাইল পথও যাইতে পারেন নাই-বার বার জলের জন্য ফিরিতে হইত। অন্য কোনো লোক হইলে সেইখানে উৎসাহ নিভিয়া যাইত, কিন্তু আয়ার বলিলেন, সমুদ্র না পাওয়া পর্যন্ত এইভাবে চলিব, নাহয় মরিব। লোকজন সকলে বিদায় লইল, সঙ্গে রহিল কেবল ব্যাকস্টার নামে এক সাহেব আর তিনটি সেদেশী লোক। চলিতে চলিতে মরুভূমির ধুলায় তাঁহাদের চোখ অন্ধপ্রায় হইয়া আসিল, জলের কষ্ট অসহ্য হইয়া উঠিল, তাঁহাদের ঘোড়াগুলি একে একে পড়িয়া মরিল, সঙ্গের ছাগল-ভেড়াগুলিও দুর্বল হইয়া মরিতে লাগিল, তার উপর কোথা হইতে একরকম মাছি আসিয়া দেখা দিল, তাহার কামড়ের যন্তণায় সর্বাঙ্গ জ্বলিতে থাকে। খাবার জিনিস যখন ফুরাইয়া আসিল, তখন সঙ্গের দুটি লোক ব্যাকস্টারকে মারিয়া খাবার চুরি করিয়া পলাইল। একজন মাত্র দেশী লোক সঙ্গে লইয়া আয়ার চলিতে লাগিলেন। একটি ঘোড়া তখনো বাঁচিয়াছিল, তাহারা সেইটিকে মারিয়া তার কাঁচা মাংস খাইলেন। সেই মাংসও যখন পচিয়া উঠিল তখন কেবল এক-এক মুঠা ময়দা জলে গুলিয়া তাহাতেই একদিনের আহার চালাইতে লাগিলেন। শেষটায় এমন দিন আসিল যখন ময়দাও ফুরাইয়া গেল। সেদিন খালি পেটে ঘুরিতে ঘুরিতে তাঁহারা এক অজানা সমুদ্রের ধারে আসিয়া দেখেন কোথা হইতে এক জাহাজ আসিয়াছে। আর কতগুলি ফরাসী নাবিক নৌকায় করিয়া তীরে আসিয়া উঠিয়াছে। আয়ার অবাক, নাবিকেরাও অবাক। এমনি করিয়া মরিতে মরিতে আয়ার বাঁচিয়া গেলেন। আয়ারের পর ডাক্তার লাইকহার্ড ঐ মরুভূমি পার হইতে গিয়া দলেবলে মারা পড়েন। কাপ্তান স্টার্ট আর একবার চেষ্টা করিতে গিয়া অন্ধ হইয়া যান। ম্যাকডুয়াল স্টুয়ার্ট দুইবার চেষ্টা করিয়া দুইবারই মরিতে মরিতে বাঁচিয়া আসেন। আরো অনেকে আধাপথ সিকিপথ গিয়া আর যাইতে পারে নাই। তার পর বার্ক আর উইলস্ এক প্রকাণ্ড দল লইয়া বাহির হন। মরুভূমির মাঝখানে একটা হ্রদ পর্যন্ত গিয়া তাহার ধারে আড্ডা বসানো হইল এবং বার্ক আর উইলস্ আর দুইজন ইংরাজকে সঙ্গে লইয়া আরো অগ্রসর হইয়া চলিলেন। তাহারা গিয়াছিলেন ভালোই কিন্তু ফিরিবার সময় খাবার ফুরাইয়া গিয়া তাহাদের বিপদ ঘটিল। তাঁহারা যতদিনের হিসাব করিয়াছিলেন, পথে নানা গোলমাল হইয়া তাহার তিন-চারগুণ সময় লাগিয়া গেল।
আড্ডায় ফিরিতে যখন আর চার দিন মাত্র বাকি তখন ঐ চারজনের মধ্যে একজন অবসন্ন হইয়া মারা গেল। বাকি তিনজন এত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিল যে তাহাকে কবর দিতে তাহাদের সমস্ত দিন লাগিল। এই দেরিতেই তাহাদের সর্বনাশ হইল। চারদিন পরে কোনোরকমে পথ পার হইয়া যখন আড্ডায় পৌঁছিল তখন দেখিল সেখানকার লোকজন তার কয়েক ঘণ্টা পূর্বেই তাহাদের আশা ছাড়িয়া দিয়া সে আড্ডা ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। হায়! হায়! আর কয়েক ঘণ্টা আগে আসিলেই তাহাদের এ সর্বনাশ হইত না। তিনজনেই তখন অবসন্ন আর চলিবার শক্তি নাই। তাহারা কোনোরকমে উঠিয়া বসিয়া হামাগুড়ি দিয়া চলিতে লাগিল—যদি দলের দেখা পায়। এরকম করিয়া আর কতদিন চলা যায়! খানিক পথ গিয়া উইলস্ এক গাছতলায় শুইয়া পড়িল। সেই তার শেষ শোয়া। একে নিজেদের কষ্ট, তার উপর বন্ধুর এই অবস্থা-বার্ক আর কিং পাগলের মতো হইয়া আহার খুঁজিতে বাহির হইল। কোনোরকমে দুই মাইল গিয়া বার্কও পথের পাশেই মরিয়া পড়িল। তার পর কিং একাই ঘুরিতে ঘুরিতে এক জায়গায় সেদেশী খাবারের সন্ধান পাইয়া বাঁচিয়া গেল। পরে যখন আড্ডার লোকেরা তাহাদের উদ্ধারের জন্য লোক পাঠাইল, তখন তাহারা দেখিল একটা নদীর ধারে ছেঁড়া ময়লা কাপড়পরা পাগলের মতো চেহারা, ধুলামাখা জটা চুল একটি লোক বসিয়া আছে—অনেক কষ্টে তাহারা চিনিতে পারিল, এই লোকটিই কিং!