সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/পিরামিড

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২১০-২১৩)
পিরামিড

ইংরাজিতে Seven Wonders of the world বা পৃথিবীর সাতটি আশ্চর্য কীর্তির কথা শুনিতে পাই। ইজিপ্টের পিরামিড তার মধ্যে একটি। একটি বলিলাম বটে কিন্তু আসলে পিরামিড একটি নয়, অনেকগুলি। ইজিপ্টের নানা জায়গায় ঘুরিলো হয়তো একশো গণ্ডা পিরামিড খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে। কিন্তু তাহার মধ্যে অধিকাংশই ভাঙা ইট পাথরের স্তুপমাত্র। বাস্তবিক দেখিবার মতো নামজাদা পিরামিড খুব অল্পই আছে, তাহাদের মধ্যে কাইরো নগরের কাছে যে তিনটি পিরামিড সেইগুলিই সকলের চাইতে আশ্চর্য।

আশ্চর্য বলি কিসে? প্রথম আশ্চর্য তার বিপুল আয়তন। সবচাইতে বড় যে পিরামিড, যাহাকে চেয়প্‌স্ বা খুফুর পিরামিড বলে সেটি প্রায় সাড়ে তিন শো হাত উচু! একটা সাধারণ তিনতলা বাড়ির দশ গুণ। দূর হইতে দেখিলে মনে হয় একটা ইটের পাঁজা—তাহার গায়ে কোনো কারুকার্য নাই, গঠনের কোনো বিশেষত্ব নাই। দেখিয়া বিশেষ কোনো সম্ভ্রমের উদয় হয় না। কিন্তু একটিবার কাছে গিয়া তাহার নীচে দাঁড়াইয়া দেখ, কি বিরাট কাণ্ড। এক-একটি ইঁট এক-একটি প্রকাশ পাথর—তার মধ্যে নিতান্ত ছোটো যেটি, তাহার ওজন পঞ্চাশ মণের কম হইবে না। আর খুব বড়ো-বড়োগুলা এক-একটি হাজার দেড়হাজার মণ।

 কত পাথর। চারিদিকে চাহিয়া দেখ কেবল পাথরের উপর পাথর। না জানি কত বৎসর ধরিয়া কত সহস্র লোকের প্রাণপণ পরিশ্রমে এত পাথর একত্র করিয়া এমন স্তূপ গড়িয়াছে। ভাবিতে গেলে মাথা ঘুরিয়া যায়। প্রায় একশত বিঘা জমির উপরে এই প্রকাণ্ড জিনিসটাকে দাঁড় করানো হইয়াছে। এই কলিকাতা শহরের সমস্ত ঘরবাড়ি ভাঙিয়া যদি পিরামিড গড়িতে যাও দেখিবে তাহাতেও মালমসলায় কুলাইবে না—সমস্ত শহর স্তুপাকার করিয়াও অত বড়ো পিরামিড গড়িতে পারিবে না। অথচ এমন অসম্ভব কাজও মানুষে করিয়াছে। নীল নদীর ওপার হইতে পাহাড় কাটিয়া মানুষ পাথর আনিয়াছে, সেই পাথর নৌকায় তুলিয়া নদী পার করিয়াছে, তার পর দুই মাইল পথ সেই পাথর টানিয়া লইয়াছে, আর ধাপে ধাপে সেই পাথর সাজাইয়া প্রকাণ্ড পিরামিড গড়িয়াছে।

 সে কি অজিকার কথা! প্রায় ছয়হাজার বৎসর হইল, রাজা চেয়প্‌স্ ভাবিয়াছিলেন নিজের গোরস্থান বানাইয়া পৃথিবীতে অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া যাইবেন, সেই কল্পনাই ত্রিশ বৎসরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পিরামিডের মূর্তি ধরিয়া দাঁড়াইল।

 এই ছয়হাজার বৎসরে পিরামিডের চেহারা অনেকটা বদলাইয়া গিয়াছে। আগে তাহার উপরে সাদা পাথরের পালিশ করা ঢাকনি ছিল, এখন কেবল দু-এক জায়গায় তাহার একটু-আধটু চিহ্নমাত্র বাকি আছে। একটা পিরামিডের চূড়ায় এখনো সেকালের সেই সাদা ঢাকনিটি লাগিয়া আছে, তাহাতে দেখা যায় যে ছয়হাজার বৎসর আগে পিরামিডের চেহারা কেমন মোলায়েম ছিল। এখন আর তাহার সে চেহারা নাই, চারিদিকে পাথরের ধাপ বাহির হইয়া পড়িয়াছে—চেষ্টা করিলে তাহার সাহায্যে পিরামিডের গা বাহিয়া চূড়ায় উঠা যায়। এমন দুরবস্থা না হইবে-বা কেন? অন্তত দু-তিনহাজার বৎসর ধরিয়া লোকে এই পিরামিডের পাথর বসাইয়া সেই পাথরে নিজেদের ঘরবাড়ি মসজিদ বানাইয়াছে। পিরামিডের কাছাকাছি যত কোঠা দালান তাহার মধ্যে কতগুলা। যে এইরূপ চোরাই মালে তৈরি তাহার আর সংখ্যা নাই।

 ছয়হাজার বৎসর আগেকার মানুষ, তাহারা কেমন করিয়া এত বড়ো-বড়ো পাথর সাজাইয়া এমন পিরামিড গড়িল একালের মানুষ ভাবিয়া তাহার কিনারা পায় না। তবে সেকালের গ্রীক লেখক হেরোডোটস এ-বিষয়ে যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতে পিরামিড বিষয়ে মোটামুটি অনেক সংবাদ পাওয়া যায়।

 তাহাতে দেখা যায় যে নদীর ওপার হইতে পিরামিডের ভিত্তি পর্যন্ত পাথর বহিবার জন্য প্রায় দুইহাজার হাত লম্বা, চল্লিশ হাত চওড়া এক রাস্তা বানাইতে হইয়াছিল। রাস্তা আগোগোড়া পালিশ-করা পাথরের তৈরি, তার একদিক প্রায় বত্রিশ হাত উঁচু, আর-একদিক ক্রমে তালু হইয়া নদী পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে। একলক্ষ লোক ক্রমাগত দশ বৎসর পরিশ্রম করিয়া এই রাস্তা বানাইয়াছিল। যতক্ষণ রাস্তা বানানো হইতেছিল, ততক্ষণে আরএকদল লোকে পাহাড়ে জমি ভাঙিয়া পিরামিডের ভিত্তি সমান করিতেছিল। সেই ভিত্তির উপর আশ্চর্য কৌশলে ঘর বসাইয়া তাহারই চারিদিকে রাজার সমাধি-মন্দির তৈরি হইয়াছে।

 হেরোডোটস বলেন পিরামিড শেষ করিতে আরো বিশ বৎসর লাগিয়াছিল। কত অসংখ্য ক্রীতদাস কত হাজার হাজার প্রজা মিলিয়া এই কাজে লাগিয়াছিল তাহার আর হিসাব পাওয়া যায় না। কিন্তু একটি যে হিসাব পাওয়া গিয়াছে সে অতি চমৎকার। এক সময়ে পিরামিডের গায়ে আয়-ব্যয়ের একটা ফর্দ লেখা ছিল—তাহারই একটুখানি হেরোডোটসের সময় পর্যন্ত টিকিয়াছিল। তাহাতে দেখা যায় যে মজুরদের খোরাকির জন্য পেঁয়াজ রসুন অর মুলা এই তিন জিনিসেরই খরচ লাগিয়াছিল প্রায় ত্রিশলক্ষ টাকা। এখন ভাবিয়া দেখ সমস্ত পিরামিডটাতে না জানি কত কোটি কোটি টাকা খরচ হইয়াছিল। শোনা যায় রাজা ইহার জন্য তাঁহার যথাসর্বস্ব বিক্রয় করিয়া একেবারে সর্বস্বান্ত হইয়াছিলেন। তাঁহার নিজের ধনরত্ন যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাহার প্রায় সমস্তই তাহার সঙ্গে কবরের মধ্যে সমাধিস্থ করা হইয়াছিল। কিন্তু আজ তাহার কিছুই বাকি নাই, আছে কেবল শূন্য কবরের কতগুলা ভাঙা পাথর মাত্র। ভিতরে মূল্যবান যাহা কিছু ছিল মানুষে লুঠ করিয়া তাহার আর কিছু রাখে নাই। পিরামিডের ভিতরটা কিরকম, অনেকদিন পর্যন্ত তাহা জানিবার কোনো উপায় ছিল না, এমন-কি, উহা বাস্তবিকই সমাধিস্তম্ভ কিনা, সে-বিষয়ে নানারকম তর্ক শোনা যাইত। কিন্তু এখন মানুষে আবর্জনা সরাইয়া তাহার ভিতরে ঢুকিবার সুড়ঙ্গ পথ বাহির করিয়াছে। ভিতরের ব্যবস্থাও অতি আশ্চর্য।

 পিরামিডের গোড়ার কাছেই একটা নীচমুখী সুড়ঙ্গ—সেটা খানিক দূরে গিয়া দুমুখো হইয়া গিয়াছে। একটা মুখ মাটির নীচে একটা খালি ঘর পর্যন্ত নামিয়া গিয়াছে—আরএক মুখ উপরের দিকে উঠিয়াছে। সেদিকে রানীর কবরঘর-তার উপর প্রকাণ্ড সিঁড়ি, তার পরে রাজার সমাধি। সমাধির উপরে আবার পাঁচতলা ঘর। তা ছাড়া আরো ছোটোখাটো ঘর আছে, ঘরের মধ্যে বাতাস আনিবার জন্য বড়ো-বড়ো লম্বা নলের মতো-সুড়ঙ্গ আছে—আর আছে কতগুলো বড়ো-বড়ো পাথর যাহার কোনো অর্থ বোঝা যায় না।

 কেবল প্রকাণ্ড জিনিস বলিয়াই যে পিরামিডের সম্মান করি তাহা নয়-যাহারা পিরামিড গড়িয়াছে, ওস্তাদ কারিকর হিসাবেও তাহারা নমস্কারযোগ্য। বড়ো-বড়ো পাথরকে অদ্ভুত কৌশলে তাহারা এমন নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়াছে যে, আজও সেই জোড়ের মুখে একটি ছুঁচ চুকাইবার মতোও ফাঁক হয় নাই। যে চতুষ্কোণ জমির উপরে পিরামিড বানানো হইয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি কোণ সূক্ষম হিসাবে মাপিয়া সমান করা হইয়াছে, চতুষ্কোণের চারটি দিক এমন নিখুঁতভাবে সমান, যে নিপুণ জরীপের হিসাবে তাহাতে দু আঙুল পরিমাণও তফাত পাওয়া যায় না। ঘড়ির কলের মতো এমন সূক্ষম হিসাব ধরিয়া যে জিনিস খাড়া করা হইল, তাহার ওজন ১৯০,০০০,০০০, উনিশকোটি মণ! এই ভারতবষের অর্ধেক লোককে যদি দাঁড়িপাল্লায় চাপাও তবে এইরকম একটা ওজন পাইতে পার। যাহারা পিরামিড বানাইল, তাহারা কিরকম লোক ছিল? তাহাদের চালচলন পোশাক পরিচ্ছদ বাড়িঘর আচার-ব্যবহার এ-সবই-বা কিরকম ছিল? জানতে ইচ্ছা হয় না কি? যাহারা পুরাতত্ত্ববিদ পণ্ডিত, কেবল প্রাচীনকালের খবর খুঁজিয়া ফেরেন, তাঁহারা ইজিপ্টের মাটি খুঁড়িয়া তাহার ভিতর হইতে সেই কোনকালের ইতিহাসকে টানিয়া বাহির করিয়াছেন। কত ঘরবাড়ি, কত আসবাবপত্র, কত অদ্ভুত হবি, কত মোমে আঁটা মৃতদেহ, (Mummy) তাহার আর অন্ত নাই। ইজিপ্টে মৃতদেহ রক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল, সে অতি আশ্চর্য। মৃতদেহকে পরিষ্কার করিয়া নানারকম মসলা মাখাইয়া মোমজামার ফিতা দিয়া এমন করিয়া মোড়া হইত যে হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া সে দেহ আর পচিতে পারিত না। ফিতার উপর ফিতা, প্যাঁচের উপর প্যাঁচ। এক-একটি রাজার মৃতদেহ মুড়িতে পাঁচ-দশ মাইল ফিতা অনায়াসেই খরচ হইয়া যাইত। তাহার মধ্যে দেহগুলি কাঠ হইয়া শুকাইয়া থাকিত, কিন্তু পচিত না। এইরূপে অতি প্রাচীনকালের ইতিহাসে যে-সকল রাজার নাম শোনা যায় তাহাদেরও অনেকের আস্ত দেহ পাওয়া গিয়াছে।

 ইজিপ্টের আর-একটি জিনিস তাহার ‘ছবির ভাষা'। তাহাদের মনের কথাগুলি ভাষার অক্ষরে না লিখিয়া তাহারা ছবি আঁকিয়া বুঝাইয়া দিত। ইহাতে কত সুবিধা হইয়াছে বুঝিতেই পার। 'রাজা যুদ্ধ করিতে গেলেন’ ইহা ভাষায় না বলিয়া যদি জলজ্যান্ত ছবি আঁকিয়া দেখাই তবে এ কথাটুকু তো বলা হয়ই, সঙ্গে সঙ্গে রাজা কিরকম পোশাক পরিতেন, কিরকম রথে চড়িতেন, কিরকম অস্ত্র লইতেন, তাহাও বোঝাইয়া দেওয়া যায়। বাস্তবিকই এই-সমস্ত ছবি আর ঘরবাড়ির চিত্র দেখিয়া সেকালের ইজিপ্টকে কল্পনার চোখে বেশ পরিষ্কার করিয়া দেখা সম্ভব হয়।

সন্দেশ-জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৫