সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/নৌকা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৩৮-২৪০)
নৌকা

 আমি একজন ছেলের কথা জানিতাম, সে কখনো নৌকা দেখে নাই। ইংরাজি বইয়ে সে ছবি দেখিয়াছিল এবং নৌকা যে জলে ভাসে এটুকুও তাহার জানা ছিল। কিন্তু সত্যিকারের নৌকা কখনো সে চোখে দেখে নাই। আশা করি সন্দেশের পাঠক-পাঠিকাদের এমন কেউ নাই যাহাকে, নৌকা জিনিসটা কিরূপ, তাহা বুঝাইয়া বলা দরকার। এই আমাদের দেশেই নদী নালায় খালে বিলে কত রকম-বেরকম নৌকা দেখা যায়। ভারী ভারী বজরা, ছোটোছোটো ডিঙি, লম্বা লম্বা ছিপ্-এক-একটা এক-এক রকম।

 গাড়ি তৈয়ারি করিবার আগেই বোধ হয় মানুষ নৌকা তৈয়ারি করিতে শিখিয়াছিল। এখনো অনেক অসভ্য জাত দেখা যায়, তাহারা গাড়ি ঘোড়ার ব্যবহার জানে না কিন্তু নৌকা বানাইতে জানে। তাহার কারণ, ডাঙায় মানুষ যেমন ইচ্ছা হাঁটিয়া যাইতে পারে, গাড়ি চড়িবার দরকার সে বোধ করে না, সে কথাটা তাহার মাথায়ও আসে না। কিন্তু নৌকা না হইলে জলের মধ্যে কতটুকুই-বা যাওয়া আসা চলে? সেইজন্য মানুষের এমন একটি জিনিসের দরকার যাহা জলে ভাসে এবং যাহার উপর চড়িয়া এদিক ওদিক চলাফিরা করা যায়।

 সবচাইতে সহজ নৌকা কলার ভেলা। তোমরা হয়তো তাহাকে নৌকা বলিতেই আপত্তি করিবে। কিন্তু তাহাতে নৌকার কাজ যে চমৎকার চলিয়া যায়, এ কথা স্বীকার করিতেই হইবে। তবে যদি তুমি শৌখিন লোক হও আর কাপড়-চোপড় কিংবা হাত-পা ডিজাইতে তোমার আপত্তি থাকে, তাহা হইলে আট-দশটা ভেলার উপর মাচা বাঁধিয়া তুমি অনায়াসে একটু আরাম করিয়া বসিতে পার। আর ভেলারই-বা দরকার কি? চার কোণে চারটি কলসী বা জালা বাঁধিয়া লইলেই তো চমৎকার হয়। কিন্তু সাবধান! কোথাও গুঁতা লাগিয়া কলসী যদি ফুটা হইয়া যায়, তবেই কিন্তু বিপদ! একটা বড়োরকমের গামলা পাইলে তাহাতেও নৌকার কাজ বেশ ভালোরকমেই চলিতে পারে।

 আমি এগুলি কিছুই কল্পনা করিয়া বলিতেছি না। যতরকমের বর্ণনা দিলাম সবরকমের নৌকারই রীতিমতো ব্যবহার হইতে দেখা যায়। পেরু প্রভৃতি অনেক দেশে অস্ট্রেলিয়ার দ্বীপপুঞ্জে ভেলার উপর লতাপাতা ও ডালপালা দিয়া মাচা খাটানো হয় অথবা খড়ের গদি বানাইয়া বসিবার চৌকি বানানো হয়। মেসোপটেমিয়ার লোকেরা এখনো গোল-গোল গামলায় চড়িয়া বড়ো-বড়ো নদী পার হইয়া যায়। জলের উপর মাচা ভাসাইবার জন্য বড়ো-বড়ো জালাও সেদেশে ব্যবহার করে।

 অনেক দেশেই বড়ো-বড়ো গাছের গুড়ি লম্বালম্বি চিরিয়া তার মাঝখানটা ফাঁপা করিয়া নৌকা বানানো হয়। যাহারা অস্ত্রের ব্যবহার জানে তাহারা চেরা গাছের পেট কূরিয়া খোল বানায়। যাহাদের সে বিদ্যাও নাই তাহার কাঠের মাঝখানটা পোড়াইয়া পোড়াইয়া গর্ত করিয়া ফেলে। কিন্তু বোধ হয়, বেশির ভাগ নৌকাই আলগা তক্তা জোড়া দিয়া বানাইতে হয়।

 পুরীর সমুদ্রে জেলেরা যে কাটামারণ ব্যবহার করে, কোনো সভ্যদেশের কোনো নাবিক তাহাতে চড়িয়া সমুদ্রে নামিতে সাহস পাইবে কিনা সন্দেহ। কতগুলি আলগা কাঠ নারকেলের দড়ি দিয়া বাঁধিয়া তাহারা নৌকা বানায়, আর সেই নৌকায় চড়িয়া এক মাইল দেড় মাইল পর্যন্ত সমুদ্রে অনায়াসে চলিয়া যায়।

 সমুদ্রে ব্যবহারের জন্য অনেক জাহাজের সঙ্গে বড়ো-বড়ো নৌকা লওয়া হয়। হঠাৎ জাহাজের কোনো বিপদ হইলে লোকেরা জাহাজ ছাড়িয়া নৌকায় করিয়া সমুদ্রে নামে। এই সমস্ত নৌকাকে life boat অর্থাৎ 'প্রাণ-বাঁচানো নৌকা’ বলে। জাহাজ বেশিরকম জখম হইলে অনেক সময় নৌকা নামানো অসম্ভব হয়। এই অসুবিধা দূর করিবার জন্য বার্থ সাহেব একরকম হালকা নৌকা বানাইয়াছেন, তাহাকে মুড়িয়া রাখা যায় এবং জলে ফেলিয়া দিলে আপনি ভাসিতে থাকে। নাবিকেরা তখন তাহার আশেপাশে সাঁতরাইয়া জলের মধ্যেই নৌকা খাটাইয়া ফেলে।

 এইবার আমাদেরই দেশের একটা অত্যন্ত অদ্ভুত ‘নৌকা’র কথা বলিয়া শেষ করি। ভিস্তিওয়ালা আস্ত জন্তুর চামড়া দিয়া যে 'মশক' বানায় সেই যে যাহার মধ্যে সে জল পুরিয়া রাখে - তাহা দেখিয়াছি তো? ঐরকম প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মশকে বাতাস ভরিয়া ফুটবলের মতো ফুলাইয়া পঞ্জাব অঞ্চলের লোকে অনেক সময় নদী পার হইয়া থাকে। নৌকাটির চেহারা কিরকম বীভৎস হয়, তাহা দেখিলেই বুঝিতে পারিবে।

সন্দেশ-বৈশাখ, ১৩২৬