সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/ব্যস্ত মানুষ

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৪০-২৪২)

ব্যস্ত মানুষ

 অসভ্য মানুষ যে কাজ নিজের হাতে করে, সভ্য মানুষে তারই জন্যে কলকব্জার ব্যবহার করে। গ্রীষ্মকালের এই যে গরম যার জন্য কতকাল ধরে লোকে নানারকম হাতপাখার ব্যবহার করে এসেছে, এই গরমে কলে-চালানো বিদ্যুতের পাখা না হলে আর আজকালকার মানুষের মন ওঠে না। যে মানুষ এক সময় পায়ে হেঁটে দেশ-দেশান্তর ঘুরে বেড়াত, সেই মানুষ এখনকার যুগে গাড়ি ঘোড়া চড়েও সন্তুষ্ট নয়, কত সাইকেল মোটর ট্রাম রেল, কত বাষ্প বিদ্যুতের কারখানা করে তবে তার চলাফেরা করতে হয়। এক সময় দিনে পঞ্চাশ মাইল গেলে সে ভাবত খুব এসেছি। এখন এরোপ্লেনে চড়ে ঘটায় এ মাইল গিয়েও সে বলছে, এখনো যথেষ্ট হয় নি।

 এই-সকল কলকব্জার দৌলতে একদিকে মানুষের সুখ হয় আরাম হয়, সময় আর পরিশ্রম বাঁচে, আর একদিকে হাঙ্গামাও বাড়ে, নূতন নূতন বিপদের কারণ দেখা দেয়। কলকারখানার চিমনির ধোঁয়ায় শহরের বাতাসকে বিষাক্ত করে মানুষের স্বাস্থ্য নষ্ট করে; রাস্তায় মোটরের উৎপাতে নিরীহ পথিক চাপা পড়ে; জলে স্থলে আকাশে নানারকম নূতন দুর্ঘটনায় নূতন নূতন ভয়ের সৃষ্টি হয়। কিন্তু তবু লাভ-লোকসানের হিসাব করে মানুষ সর্বদাই বলে ‘লাভের চেয়ে লোকসান অনেক কম'। একশো বছর আগে এখান থেকে বিলাত যেতে তিন মাস চার মাস, কখনো বা আরো বেশি সময় লাগত। এখন ষোলো-সতেরো দিনে যাওয়া যায়। এরোপ্লেনের বন্দোবস্ত হলে চার-পাঁচ দিনে যাওয়া যাবে। কিন্তু সে বন্দোবস্ত হতে না হতে এখনই ভাবতে বসেছে, তার চাইতেও ভালো ব্যবস্থা সম্ভব কি না অর্থাৎ আজকে কলকাতায় ভাত খেয়ে বেরুলাম, কাল রাত্রে লণ্ডনে গিয়ে ঘুমোলাম, এইরকম বন্দোবস্ত হয় কি না!

 একখানা বাড়ি বানাতে কত সময় লাগে? এখন আমেরিকায় শুনতে পাই, সাত দিনের মধ্যে নাকি বাড়ি তৈরি হয়ে যায়! যারা তৈরি করে তাদের নমুনা-মতো নক্‌শা পছন্দ করে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াও-আট-দশ দিন বাদে ঘুরে এসে দেখবে, তোমার জন্যে দিব্যি দোতলা দালান তৈরি হয়ে আছে! ঢালাই-করা পাথর জমিয়ে এই-সব বাড়ি তৈরি হয়। ঢালাই করবার জন্যে নানারকম তৈরি-ছাঁচ মজুত রাখতে হয়। বাড়ি করতে হলে আগে ছাঁচগুলো খাটিয়ে এক-একটা ফাঁপারকমের কাঠামো তৈরি হয়। তার পর সেই ছাঁচের ভিতরে পাথুরে মসলা ঢেলে দেয়। দুই দিনের মধ্যে মসলা জমে পাথর হয়ে যায়। এইরকমে এক-একখানা অস্তি দেয়াল, আস্ত ছাদ বা মেজে তৈরি করে তার পর সেগুলোকে কল দিয়ে তুলে খাটিয়ে বসালেই বাড়ি হয়ে গেল।

 এমনি করে মানুষ একদিকে কাজের সময়টাকে খুব সংক্ষেপ করে আনছে আর একদিকে দূরের জিনিসকে সে আর দূরে থাকতে দিচ্ছে না। পৃথিবীর এ-পিঠে আমরা বসে আছি, আর বারোহাজার মাইল দূরে ও-পিঠের মানুষরা আমেরিকায় বসে কি করছে, প্রতিদিন তার খবর পাচ্ছি। কোথায় যুদ্ধ হল, কোথায় জাহাজ ডুবল, কোথায় মানুষের কি নূতন কীর্তির কথা জানা গেল, অমনি ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী' পার হয়ে দেশ-বিদেশে খবর ছুটল-আমরা সকালে উঠে দিব্যি আরামে নিশ্চিন্তে বসে খবরের কাগজে তার সংবাদ পড়লাম। কিন্তু তাতেও কি মানুষের মন ওঠে? মানুষে চেষ্টা করছে, খবরের সঙ্গে সঙ্গে তার ছবিসুদ্ধ টেলিগ্রামে পাঠাতে। চেষ্টা করছে’ই বা বলি কেন-সত্যি করেই টেলিগ্রামে ছবি পাঠাবার যন্ত্র তৈরি হয়েছে। এই যন্ত্রের এক মাথায় ছবি বসিয়ে তার উপর গ্রামোফোনের মতো ছুঁচের কলম বুলিয়ে যায়, আর দুশো-আড়াইশো মাইল দূরে আরেক মাথায় সেই ছবির অবিকল নকল উঠে যায়। কয়েক বৎসর আগে বিলাতের 'ডেইলি মিরর' কাগজের জন্য লণ্ডন থেকে ম্যানচেস্টার (প্রায় দুশো মাইল দূর) এইরকম করে ছবি পাঠানো হয়েছিল। সেই সময়ে এই ছবি পাঠাতে প্রায় পনেরো মিনিট লেগেছিল। আজকাল এর চাইতেও কম সময়ে আরো ভালো ছবি পাঠাবার যন্ত্র তৈরি হয়েছে। হয়তো আরো কয়েক বছর পরে বিলাত থেকে এদেশে ছবি পাঠাবার এইরকম বন্দোবস্ত হতে পারবে। ততদিনে হয়তো বিলাতের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবারও ব্যবস্থা হবে। তোমরা যদি কেউ সে সময়ে বিলাত যাও, তা হলে এ দেশের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কথা বলা তো চলবেই, তারা তোমার চেহারা দেখতে চাইলে অমনি ছবি তুলিয়ে টেলিগ্রাম করলেই তোমার সেই দিনকার টাটকা ছবি দেখতে দেখতে এসে পড়বে।

 একজন ফরাসী বৈজ্ঞানিক একরকম দ্রুত ডাকের যন্ত্র বানিয়েছেন, তাতে চিঠি-বোঝাই গাড়িগুলো তার-বাঁধানো বিদ্যুতের পথের উপর উড়ে উড়ে চলে। এই উড়ু্ক্কু গাড়ি নাকি ঘটায় তিনশো মাইল বেগে ছুটতে পারে। পঞ্চাশ মণ ওজনের একটা গাড়িকে অনায়াসেই শূন্যে ঝুলিয়ে পার করা যায়। আজকালকার ডাকের গাড়ি এখান থেকে বর্ধমন যেতে না যেতেই এই গাড়ি একেবারে কাশীতে গিয়ে হাজির হবে।

 পরিশ্রমের কাজ কিংবা কুলিমজুরের হাতের কাজ, যার জন্যে খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না, সেগুলো নাহয় কলে করা গেল। কিন্তু মাথা ঘামিয়ে বুদ্ধি খরচ করে পদে পদে হিসাব করতে হয়, তেমন কাজ কি কলে হতে পারে? হ্যাঁ, তাও পারে—যেমন, অঙ্কের কল বা পাটিগণিত-যন্ত্র। এই যন্ত্রে বড়ো-বড়ো অঙ্কের যোগফল আপনা থেকেই বলে দেয়। বড়ো-বড়ো কারখানার জমাখরচের হিসাব এই কলের সাহায্যে চট‌্‌পট্ বার করে ফেলা হয়। কলের মধ্যে কাগজ বসিয়ে ঠিক ‘টাইপরাইটারে'র মতো চাবি টিপে টিপে অঙ্কগুলো লিখে যাও—তার পর ডানদিকের হাতলখানা চেপে দিলেই আপনা থেকেই তার যোগফল কাগজের উপর ছাপা হয়ে যাবে। মানুষে হিসেব করতে গিয়ে অনেক সময়ে ভুল করে, তাড়াতাড়িতে বড়ো-বড়ো পণ্ডিত লোকেরও গোল বেধে যায়—কিন্তু কলের কাজ একেবারে নির্ভুল। অঙ্কটা যদি ঠিকমতো দেওয়া হয়, কলের জবাবও ঠিক হবেই। কারণ কল কখনো অন্যমনস্ক হয় না—তার হুশিয়ারির কোনো ত্রুটি হয় না। বড়ো-বড়ো ব্যাঙ্কের হিসাব রেখে রেখে যারা পাকা হয়ে গেছে, এই কলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তারা পর্যন্ত হার মেনে যায়। তাদের কাজ অর্ধেকটুকু বা সিকিটুকু হতে না হতেই কলের কাজ শেষ হয়ে যায়, আর সেটা ঠিক হল কিনা তাও দুবার করে মিলিয়ে দেখবারও দরকার হয় না।

সন্দেশ-জ্যেষ্ঠ, ১৩২৬