সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/সমুদ্র বন্ধন

সমুদ্রবন্ধন

 মানুষ টেলিগ্রাফের কৌশল যখন আবিষ্কার করল, সে প্রায় একশো বছরের কথা। সেই সময় থেকে এই পৃথিবীটার আষ্টেপৃষ্টে খুঁটি মেরে তার বসিয়ে মানুষ দেশ-বিদেশে খবর চালাচালি করবার ব্যবস্থা করে আসছে। তারের পথ দিয়ে বিদ্যুতের খবর চলে; সেই তার মানুষ যেখান দিয়েই নিতে পেরেছে—সেখান দিয়েই খবর চলবার পথ খুলে গিয়েছে। কেবল ডাঙায় নয়, গভীর সমুদ্রের ভিতর দিয়েও হাজার হাজার মাইল তার পৃথিবীর এপার-ওপার জুড়ে ফেলেছে। সমুদ্রের মধ্যে খোঁটা বসাবার জো নাই, এমন কিছু নাই যার সঙ্গে তার বেঁধে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যায়-কাজেই সেখানে টেলিগ্রাফের তার বসাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে তারের দুই মাথা ডাঙায় রেখে বাকি সমস্ত তারটিকে জলের মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়া।

 সত্তর বৎসর আগে যখন এইরকমভাবে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে ফ্রান্সের তারের যোগ করবার প্রস্তাব হয়েছিল তখন লোকে সেটাকে পাগলের প্রস্তাব বলে ঠাট্টা করেছিল। অথচ এখন তার চাইতে বড়ো-বড়ো, একটি নয়, দুটি নয়, অন্তত দুহাজার টেলিগ্রাফের লাইন সমদ্রের নীচে বসানো হয়েছে। মানুষের যত বড়ো-বড়ো র্কীতি আছে তার মধ্যে এই সমুদ্রবন্ধনের কীর্তিটা বোধ হয় কারও চাইতে কম আশ্চর্য নয়। এর জন্য মানুষকে যে কতরকম বাধাবিপদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে তা আর বলে শেষ করা যায় না। ইংল্যাণ্ড আর ফ্রান্সের মধ্যে পঁচিশ-ত্রিশ মাইল সমুদ্রের ফারাক। সে সমুদ্রও খুব গভীর নয়। ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে অনেক হাজার টাকা খরচ করে এইটুকু সমুদ্রের মধ্যে তার ফেলা হল আর সেই তার দিয়ে এপার-ওপার খবর চলাচল হল-তখন টেলিগ্রাফ কোম্পানির মনে খুবই উৎসাহ হয়েছিল। কিন্তু সে উৎসাহ চব্বিশ ঘটার বেশি থাকে নি। কারণ, একটা দিন যেতে না যেতেই জেলে জাহাজের জালের টানেই তীরের লাইন ছিঁড়ে গিয়ে খবর আসা বন্ধ হয়ে গেল। পরের বছর আবার দুইলক্ষ টাকা খরচ করে অনেক কষ্টে আরো মোটা আর মজবত তার বানিয়ে নতুন লাইন বসানো হল। সেই তারে, অনেকদিন বেশ কাজ চলবার পর লোকের মনে বিশ্বাস হল যে-হ্যাঁ, ছোটোখাটো সমুদ্রের মধ্যে তার বসানো চলতে পারে।

 পরের বৎসর ইংল্যাণ্ড ও স্কটল্যাণ্ড থেকে আয়ার্ল্যাণ্ড পর্যন্ত টেলিগ্রাফের লাইন বসাবার জন্য তিনবার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তিনবারই সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। দুবার জোয়ার- ভাঁটার বিষম টানে পাহাড়ের গায়ে আছাড় খেয়ে খেয়ে তারের লাইন ভেঙেচুরে ভেসে গেল। আর তৃতীয়বারে তারের জাহাজ সমুদ্রের ওপারে পেঁছিবার আগেই সব তার ফুরিয়ে গেল-তারের অগাটা সমুদ্রেই পড়ে গেল—আয়ার্ল্যাণ্ড পর্যন্ত আর পৌঁছলই না। যা হোক, চতুর্থবারের চেষ্টায় আইরিশ সমুদ্রের ভিতর দিয়ে নিরাপদে তারের লাইন বসানো হল। তার পর দেখতে দেখতে পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে ইউরোপে আমেরিকায় অনেক দেশেই সমুদ্রের ভিতরে, পঁচিশ-পঞ্চাশ বা একশো মাইল পর্যন্ত লম্বা তার বসানো হয়ে গেল। তখন ইংল্যাণ্ডের এক টেলিগ্রাফ কোম্পানি সাহস করে বলল, “আমরা অতলান্তিক মহাসাগরের ভিতর দিয়ে ইংল্যাণ্ড আর আমেরিকা পর্যন্ত টেলিগ্রাফের তার বসাব।”

 মোকে বলল, “সে কি কথা! অতলান্তিকের ওপর যে দুহাজার মাইল দূর! সেখানকার সমুদ্র যে তিন মাইল গম্ভীর! সমুদ্রের নীচটা উঁচুনিচু পাহাড়ের মতো, তাতেই যে হাজার মাইল তার খেয়ে যাবে! অসম্ভব লম্বা তার, অসম্ভবরকম ভারী, করাতে অসম্ভব খরচ—সবই অসম্ভব!” কিন্তু টেলিগ্রাফ কোম্পানির যাঁরা পাণ্ডা তাঁরা কোমর বেঁধে বসলেন, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। কোম্পানির মূলধন হল পঞ্চাশলক্ষ টাকা। একুশহাজার মাইল লম্বা তামার তারকে দড়ির মতন পাকিয়ে পাকিয়ে, তার উপর আঙুলের মতো পুরু করে রবারের প্রলেপ দিয়ে, তার উপর সাড়ে তিনলক্ষ মাইল লোহার তার পেঁচিয়ে টেলিগ্রাফের লাইন তৈরি হল। এই সমস্ত তার যদি একটানা সোজা করে বসানো হত, তা হজে পৃথিবীটাকে প্রায় চোদ্দোবার পাক দিয়ে বেঁধে ফেলা যেত-কিংবা এখান থেকে চাঁদ পর্যন্ত পৌছানো যেত! লাইনের ভিতরকার তামার তারটুকু দিয়েই বিদ্যুৎ চলে। রবারের কাজ কেবল বিদ্যুৎটাকে তারের মধ্যে আটকে রাখা। লোহার প্যাঁচালো তারটুকু হল বর্ম। ওটা না থাকলে পাহাড়ের ঘষায় স্রোতের ধাক্কায় জলজন্তুর উৎপাতে দুদিনে তার নষ্ট হয়ে যায়-গভীর জলে লাইন বসাতে গিয়ে আপনার ভারে তার আপনি ছিড়ে যায়। সমস্ত লাইনটির ওজন হল সত্তরহাজার মণ।

 ১৮৫৭ খৃস্টাব্দের ফেব্রয়ারি মাসে দুই জাহাজে বোঝাই তার আমেরিকার দিকে রওনা হল। তারের এক মাথা আয়াল্যাণ্ডের তীরের উপর রেখে কোম্পানির জাহাজ পশ্চিম মুখে তার ফেলতে ফেলতে চলল। বড়ো-বড়ো চৌবাচ্চার মধ্যে তারের কুণ্ডলী জুড়ানে। রয়েছে। ক্রমাগত ঘষায় ঘষায় তারের লাইন গরম হয়ে ওঠে, তাই চৌবাচ্চায় জল ভরে রাখতে হয়। জাহাজের উপর 'ব্রেক' বসানো, তাতে তারটাকে ওজনমতো টেনে ধরে-পাছে হুড়্‌ হূড়্ করে সব তার বেরিয়ে যায়। জাহাজ যদি ঘণ্টায় পাঁচ মাইল যায়, তা হলে সমুদ্রের উঁচুনিচু হিসাব বুঝে, ঘণ্টায় ছয় মাইল কি সাত মাইল তার ছাড়তে হয়। আবার বেশি টান পড়লে পাছে তার ছিড়ে যায় সেজন্যে তারের ‘টান’ মাপবার জন্য একটা যন্ত্র আছে। টান বেশি হলেই ব্রেক ঢিলা করে দেয়। তারের ভিতর দিয়ে দিনরাত ডাঙার সঙ্গে জাহাজের সংকেত চলতে থাকে। হঠাৎ কোথাও তার ছিঁড়ে গেলে বা জখম হলে অমনি সে সংকেত বন্ধ হয়ে যায়। তা হলেই জাহাজের লোকেরা বুঝতে পারে কোথাও কিছু গোলমাল হয়েছে। তখন আবার তার গুটিয়ে গুটিয়ে, সেই জখম জায়গা পর্যন্ত ফিরে গিয়ে, নষ্ট লাইন মেরামত করতে হয়।  এমনি সমস্ত আয়োজন করে কোম্পানির জাহাজ রওনা হল। কিন্তু পাঁচ মাইল যেতে না যেতেই হঠাৎ কোথায় টান লেগে তারের লাইন ছিঁড়ে গেল। তখন ফিরে এসে তীরের দিক থেকে সমস্ত তারটিকে টেনে টেনে, তার ভাঙা মুখ বার করে তার সঙ্গে নুতন তার জুড়ে জাহাজ আবার পশ্চিমে চলল। দু-তিন দিন নিরাপদে চলতে চলতে প্রায় চারশো মাইল তার বসাবার পর হঠাৎ ব্রেক কষাবার দোষে তার ছিঁড়ে আড়াই মাইল গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গেল। জাহাজের লোকে হতাশ হয়ে বন্দরে ফিরে চলল, কোম্পানির সাড়ে তিনলক্ষ টাকার মাল (চারশো মাইল তার) সমুদ্রের নীচেই পড়ে রইল।

 পরের বৎসর আবার নূতন করে চেষ্টা আরম্ভ হল। এবার স্থির হল এই যে, সমুদ্রের মাঝখানে দুই জাহাজের তীরের মুখ একত্র করে তার পর দুই জাহাজ দুই দিকে তার বসিয়ে চলবে—একটা যাবে আমেরিকার দিকে, আরেকটা আয়ার্ল্যাণ্ডের দিকে। মাঝসমুদ্রে যাবার পথে এমন ঝড় উঠল যে তেমন ঝড় খুব কমই দেখা যায়। সপ্তাহ ভরে ঝড়ের আর বিরাম নাই। তারের ভারে বোঝাই জাহাজ ঝড়ের ধাক্কায় ডোবে-ডোবে অবস্থায় সমুদ্রের মধ্যে নিরুপায় হয়ে মাতালের মতো টলতে লাগল। অনেক কষ্টে প্রাণ বাঁচিয়ে ষোলো দিন পর তারা মাঝ সমুদ্রে হাজির হল। তার পর এর-লাইন ওরলাইনে জুড়ে দিয়ে তারা দুইজনে দুই মুখে চলল। তারের ভিতর দিয়ে এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজ পর্যন্ত বিদ্যুতের সংকেত চলছে কিন্তু চল্লিশ মাইল পার না হতেই হঠাৎ সংকেত বন্ধ হয়ে গেল, এক জাহাজ থেকে আরেক জাহাজের কোনো সাড়াই পাওয়া যায় না। আবার দুই জাহাজ মুখোমুখি হয়ে তারের সঙ্গে তার জুড়ে দুই দিকে ছুটল। এবারের দৌড় একশো মাইল। তার পরেই আর সাড়াশব্দ নাই—আবার কোথায় লাইন ফেঁসে গেছে। আরম্ভেই দুই-দুইবার ব্যাঘাত পেয়ে আর নানারকমে নাকাল হয়ে জাহাজ আবার নিরাশ হয়ে ফিরে এল। লাভের মধ্যে, 'কোম্পানিকা মাল, দরিয়ামে ঢাল।'

 এইবার কোম্পানির উৎসাহ প্রায় নিভে এসেছিল। অনেকেই পরামর্শ দিলেন যে, এ অসম্ভব কাজের পিছনে আর অনর্থক টাকা নষ্ট করা উচিত নয়। কোম্পানির বড়োবড়ো পাণ্ডারা পর্যন্ত বলতে লাগলেন, এখন তারের লোহালক্কড় সব বিক্রি করে টেলিগ্রাফ কোম্পানির কারবার বন্ধ করে দেওয়াই ভালো। কেবল দু-একজন উৎসাহী লোক বলল যে, তারা এখনো হার মানতে প্রস্তুত নয়। শেষটায় সেই দু-একজনেরই বিশেষ চেষ্টায় সেই বছরেই আর একবার প্রাণপণ আয়োজন করে, অনেকরকম হাঙ্গামার পর আয়ার্ল্যাণ্ডথেকে আমেরিকা পর্যন্ত নিরাপদে লাইন বসানো হল—টেলিগ্রাফ কোম্পানির জয়-জয়কার পড়ে গেল। তখন এদেশের সিপাহী বিদ্রোহ সবেমাত্র শেষ হয়েছে—কিন্তু সে খবর তখনও আমেরিকায় পৌঁছায় নি। বিদ্রোহের জন্য কানাডা থেকে দুই দল ইংরাজ সৈন্য এ দেশে আসবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তারের লাইন বসানো হতেই ইংল্যাণ্ড থেকে খবর গেল, 'সৈন্য পাঠাবার দরকার নাই।' ঐ খবর যদি না যেত তা হলে মিছামিছি সৈন্য পাঠিয়ে, গভর্নমেণ্টের অন্তত সাতলক্ষ টাকা খামখা বাজে খরচ হয়ে যেত। এই কথাটা প্রচার হওয়াতে টেলিগ্রাফ কোম্পানির খুব বিজ্ঞাপন হয়ে গেল। সমুদ্র পার করে টেলিগ্রাফ পাঠাবার সুবিধা যে কি, মানুষকে তা বোঝাবার জন্য আর বেশি ব্যাখ্যা বা বক্তৃতা দরকার হল না। তুমুল উৎসাহে টেলিগ্রাফ কোম্পানির ব্যবসার আরম্ভ হল।

 কিন্তু হায়! কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই টেলিগ্রাফের সাড়া ক্ষীণ হতে হতে একদিন একেবারেই সব বন্ধ হয়ে গেল—এপারের বিদ্যুৎ আর ওপারে পৌঁছায়ই না। এত সাধের টেলিগ্রাফ-লাইন, তার কিনা এই অকাল মৃত্যু-তিন মাসও তার আয়ু হল না। পণ্ডিতেরা পরীক্ষা করে বললেন যে, তারের মধ্যে যে বিদ্যুৎ চালানো হয়েছে—সেই বিদ্যুতের তেজ খুব বেশি হওয়াতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।

 তার পর সাত বৎসর গেল আবার নূতন করে লাইন বসাবার আয়োজন করতে। অনেকরকম আলোচনা আর পরীক্ষার পর, আরো মজবুত করে নুতন তার তৈরি হল। সেই তারের লাইন প্রকাণ্ড এক জাহাজে করে সমুদ্রে পাঠানো হল। জাহাজ চুয়াল্লিশ মাইল সমুদ্র পার হতেই বোঝা গেল, তারের মধ্যে কোথাও গলদ রয়ে গেছে। সেটা খুঁজে মেরামত করে তার পর সাতশো মাইল পর্যন্ত বিনা উৎপাতে গিয়ে আবার এক মারাত্মক গলদ। আবার অনেক মাইল তার গুটিয়ে নিয়ে তার পর এক জায়গায় প্রকাণ্ড জখম পাওয়া গেল। সেইটুকু দেখে মেরামত করতে প্রায় দশ ঘণ্টা সময় নষ্ট হল। প্রায় বারশো মাইল যাবার পর আবার সেইরকম বাধা। আবার সেই গভীর সমুদ্র থেকে তার টেনে তুলে, কোথায় দোষ আছে খুঁজে বার করে মেরামত করতে হবে। কিন্তু এবারে মাইলখানেক তার গুটিয়ে তুলতেই বাকি তারটুকু চোখের সামনেই পট করে ছিঁড়ে জলের মধ্যে ফস্কে পড়ল।

 জাহাজের কর্তারা পরামর্শ করলেন, আঁকড়শি দিয়ে ঐ তার তুলতে হবে। প্রকাণ্ড লোহার শিকলের আগায় অদ্ভুত নখওয়ালা যন্ত্র ঝুলিয়ে, তাই দিয়ে নাবিকেরা সমুদ্রের তলায় হাতড়াতে লাগল। একবার মনে হল আঁকড়শিতে তার আঁকড়িয়েছে—অমনি টানাটানির ধুম পড়ে গেল। প্রায় আড়াই মাইল গভীর সমুদ্র, তার নীচ পর্যন্ত শিকল নেমেছে, সে শিকল গুটিয়ে তোলা কি সহজ কথা! এক হাত দু হাত, দশ হাত বিশ হাত, একশো হাত দুশো হত, এমনি করে প্রায় মাইলখানেক শিকল তুলবার পর তারে-গাঁথা আঁকড়শিসুদ্ধ দেড়মাইল শিকল ছিড়ে জলের মধ্যে অন্তর্ধান! তখন মোটা শনের দড়ি দিয়ে আবার সমুদ্রের মধ্যে নূতন করে আঁকড়শি ফেলা হল। তিন-চারদিন ক্রমাগত চেষ্টার পর আবার তারের লাইন আঁকড়িয়ে পাওয়া গেল। কিন্তু এবারেও তুলবার সময় তারের ভারে দড়িদড়া সব ছিড়ে আঁকড়শিটা জলের ভিতর তলিয়ে গেল। তার পর আরো দুইখানা আঁকড়শি এইরকমে হারিয়ে জাহাজের শিকল দড়ি সব প্রায় শেষ করে ইংল্যাণ্ডের জাহাজ ইংল্যাণ্ডেই ফিরে চলল।

 এতদিনের আশা ভরসার পর এইরকম দুঃসংবাদ। কিন্তু মানুষের প্রতিজ্ঞার কি জোর। পরের বৎসর (১৮৬৬) সেই জাহাজ আবার নুতন তার বোঝাই করে নুতন উৎসাহে সমুদ্রে বেরুল-দুই সপ্তাহের মধ্যে সে জাহাজ সারা সমুদ্র লাইন বসিয়ে আমেরিকার টেলিগ্রাফ স্টেশন পর্যন্ত তার জুড়ে ফেলল। তখনকার আনন্দের কথা বর্ণনায় শেষ করা যায় না। কোম্পানির একজন এঞ্জিনিয়ার সে সময়ে লিখেছিলেন, “যখন তার বসানো শেষ হল, তোপের গর্জন আর মানুষের আনন্দধ্বনির মধ্যে জাহাজের নাবিকেরা পাগলের মতো চীৎকার করতে লাগল, তখন গৌরবে আমারও শরীরের রক্ত প্রবল বেগে আমার বুকের মধ্যে তোলপাড় করছিল। কতগুলো লোক লাইনের তার ধরে নেচে নেচে গাইতে লাগল। কেউ কেউ পাগলের মতো তারটাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল। চোখের জলে আনন্দের কোলাহলে হাসিকান্না সব মিশিয়ে সকলে মিলে মহোৎসব লাগিয়ে দিল।”

 এখানেও তাদের উৎসাহের শেষ হয় নি। সেই জাহাজ আবার ফিরে গিয়ে আঠারো দিন অজানা সমুদ্রের ভিতর হাতড়িয়ে, আগেরবারের সেই হারানো লাইন উদ্ধার করে, সেই লাইনকেও আমেরিকা পর্যন্ত পৌছে দিল। এতদিনে, প্রায় চারকোটি টাকা নষ্ট করবার পর, কোম্পানির কারবারের পাকা প্রতিষ্ঠা হল।

সন্দেশ—আষাঢ়, ১৩২৬