সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/শনির দেশে
(পৃ. ২৪৬-২৪৯)
কেউ যদি বলে যে, এই পৃথিবীর বাইরে যেখানে বলবে, সেখানে নিয়ে তোমাদের তামাশা দেখিয়ে আনবে-তা হলে তোমরা কোথায় যেতে চাও? আমি জানি, সেরকম হলে আমি নিশ্চয় শনিগ্রহে যেতে চাইব। পৃথিবীর আকাশে আমরা শুধু চোখে যতটুকু দেখতে পাই, তাতে মনে হয় যে, সব চাইতে সুন্দর জিনিস হল চাঁদ। সেখানে একবার যেতে পারলে আর কিছু না হোক, এই পৃথিবীটাকে কেমন মস্ত আর জমকাল চাঁদের মতো দেখায়, সেটা নিশ্চয়ই একটা দেখবার মতো জিনিস। কিন্তু শনিগ্রহে যাবার পথে সেটা আমরা দেখে নিতে পারব।
যাক, মনে কর যেন শনিগ্রহে যাত্রা করাই স্থির হল। মনে কর এমন আশ্চর্য আকাশ-জাহাজ তৈরি হল যাতে পৃথিবী ছেড়ে, পৃথিবীর বাতাস ছেড়ে ফাঁকা শূন্যের ভিতর দিয়ে চলে যাওয়া যায়। তোমার বয়স কত? দশ বৎসর? বেশ তা হলে ১৯১১ খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা স্বপ্ন-জাহাজে রওনা হলাম শনিগ্রহে যাবার জন্য। আমাদের জাহাজটা মনে কর খুব দ্রুত এরোপ্লেনের মতো ঘণ্টায় একশো মাইল বা একশো পঁচিশ মাইল করে চলে।
আমরা আকাশের ভিতর দিয়ে হু হু করে চলেছি আর পৃথিবীর ঘরবাড়ি সব ছোটো হতে হতে একে একে মিলিয়ে যাচ্ছে। বড়ো-বড়ো শহর, বড়ো-বড়ো নদী, সব বিন্দুর মতো, রেখার মতো হয়ে আসছে। এই গোল পৃথিবীর গায়ে পাহাড় সমুদ্র, দেশ মহাদেশ ক্রমে সব ততি নিখুঁত মানচিত্রের মতো দেখা যাচ্ছে। ঐ ফ্যাকাশে হলদে মরুভূমি, ঐ ঘন সবুজ বন, ঐ ছেয়ে-নীল সমুদ্র, ঐ সাদা সাদা বরফের দেশ। মভেম্বর মাসে আমরা, এখান থেকে চাঁদ যতদূর, ততদূর চলে গিয়েছি। এক বছরে ১৯২০ খৃস্টাব্দের আগস্ট মাসে আমরা প্রায় দশ লক্ষ মাইল এসে পড়েছি। পুথিবী থেকে চাঁদটাকে যেমন দেখি এখন পৃথিবীটাকে ঠিক তেমনি দেখাচ্ছে। হিমালয় পাহাড়কেও আর পাহাড় বলে ভালো বোঝাই যাচ্ছে না। চাঁদের যেমন অমাবস্যা পূর্ণিমা হয়, দিনে দিনে কলায় কলায় বাড়ে কমে, পৃথিবীরও ঠিক তেমনি। এমনি করে বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে, কিন্তু কই? শনিগ্রহ তো একটুও কাছে আসছে বলে মনে হয় না। শুনেছিলাম সে এক প্রকাণ্ড গ্রহ, তার চারিদিকে আংটি ঘেরা। কিন্তু তোমার তো বিশ বছর বয়স হল, গোঁফদাড়ি বেরিয়ে গেল, এখনো তো সে-সবের কিছুই দেখা গেল না! ঐ লাল রঙের মঙ্গলগ্রহটা যেন একটুখানি কাছে এসেছে, কিন্তু সেও তো খুব বেশি নয়। আমাদের বৈজ্ঞানিক পণ্ডিতটি বলছেন, মঙ্গল পর্যন্ত পৌঁছতে আরো চল্লিশ বৎসর লাগবে। ও হরি। তা হলে শনিতে পৌছব কবে? শনি পর্যন্ত যেতে লাগবে প্রায় আটশো বৎসর। তা হলে উপায়? একমাত্র উপায়, আরো বেগে যাওয়া। আরো পাঁচ গুণ দশ গুণ বিশ গুণ বেগে কামানের গোলার মতো বেগে ঘটায় দুহাজার মাইল বেগে ছুটতে হবে। তাই ছোটা যাক।
আরো দুই বৎসরে মঙ্গল পর্যন্ত এসে পড়া গেল। ওখানে গিয়ে একবার নামলে মন্দ না। ঐ লম্বা-লম্বা আঁচড়গুলা সত্যিকারের খাল কিনা, ওখানে সত্যি সত্যি বুদ্ধিমান জীব কেউ আছে কিনা, একটিবার খবর নেওয়া যেত। কিন্তু আমাদের তো অত অবসর নেই, যেমনভাবে চলছি এমনি করে চললেও শনিতে পৌঁছতে আরো অন্তত চল্লিশ বৎসর লাগবে। সুতরাং সোজা চলতে থাকি।
মঙ্গলের পথ পার হয়ে এখন বৃহস্পতির দিকে চলেছি। মাঝে মাঝে ছোটো-বড়ো গোলার মতো ওগুলো কি সামনে দিয়ে হু করে ছুটে পালাচ্ছে? কোনোটা দশ মাইল, বিশ মাইল, কোনোটা একশো মাইল বা দুশো মাইল চওড়া-আবার কোনোটা ছোটোখাটো ঢিপির মতন বড়ো, কোনো কোনোটা সামান্য গুলি-গোলার মতো। এরা সবাই গ্রহ। যে নিয়মে বড়োবড়ো গ্রহেরা সূর্যের চারিদিকে চক্র দিয়ে ঘোরে—এরাও প্রত্যেকেই, এমন-কি, যেগুলি ধুলিকণার মতো ছোটো সেগুলিও, ঠিক সেই নিয়মেই নিজের নিজের পথে নিজের নিজের তাল বজায় রেখে সূর্যের চারিদিকে ঘুরে বেড়ায়।
এমনি করে ছুটতে ছুটতে আরো দশ বৎসর কেটে গেল, ছোটো ছোটো গ্রহগুলিকে আর যেন দেখাই যায় না। পৃথিবী সূর্যের আশেপাশে মিট্মিট্ করে জ্বলছে। সূর্যও দেখতে অনেকখানি ছোট্টো হয়ে গেছে—সেই পৃথিবীর সূর্য আর এই সূর্য যেন ফুটবলটার কাছে একটি ক্রিকেট বল। ক্রমে আরো আট-দশ বছর ছুটে, গ্রহরাজ বৃহস্পতির চক্রপথের সীমানায় এসে হাজির হওয়া গেল। কোথায় পৃথিবী আর কোথায় বৃহস্পতি। তিনশোপঁয়ষট্টি দিনে পৃথিবীর এক বৎসর-কিন্তু বৃহস্পতি যে প্রকাণ্ড পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সেই পথে একবার পাড়ি দিতে তার প্রায় বারো বৎসর সময় লাগে। ধোঁয়ায় ঢাকা প্রকাণ্ড শরীর—তার মধ্যে হাজার খানেক পৃথিবীকে অনায়াসেই পুরে রাখা যায়। অথচ এই বিপুল দেহ নিয়ে গ্রহরাজকে লাটিমের মতো ঘোরপাক খেতে হচ্ছে। এ কাজটি করতে পৃথিবীর চব্বিশ ঘণ্টা সময় লাগে, কিন্তু বৃহস্পতির দশ ঘণ্টাও লাগে না। বৃহস্পতির চারিদিকে সাতআটটি চাঁদ-তার মধ্যে চারটি বেশ বড়ো-বড়ো—তিনটি আমাদের চাঁদের চাইতেও বড়ো।
বৃহস্পতির এলাকা পার হয়েছি। শনির আলো ক্রমে আরো উজ্জ্বল হয়ে আসছে। -ক্রমে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, তার চেহারাটা ঠিক অন্য গ্রহের মতো নয়। মনে হয় কেমন যেন লম্বাটে মতন-দুপাশে যেন কি বেরিয়ে আছে। আরো কাছে গিয়ে দেখ তার গায়ের চমৎকার আংটিটা ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। পৃথিবী থেকে ছোটোখাটো দুরবীন দিয়ে যেমন দেখেছি এখন শুধু চোখেই সেইরকম দেখতে পাচ্ছি। অংটিটা বাসনের কানার মতে, উকিলের শাম্লার ঘেরের মতো—খুব পাতলা আর চওড়া। শনিগ্রহকে অমিরা যে দেখি, সব সময়ে ঠিক একরকম দেখি না-কখনো একটু উঁচু থেকে, কখনো একটু নিচু থেকে, কখনো আংটির উপর দিকটা, কখনো তার তলাটা, কখনো সামনে ঝোঁকা, কখনো পিছন-হেলান। যখন ঠিক খাড়াভাবে অংটির কিনারা থেকে দেখি, তখন আংটিটাকে দেখি সরু একটি রেখার মতো-এত সরু যে খুব বড়ো দুরবীন না হলে দেখাই যায় না।
প্রায় চল্লিশ বৎসর হল আমরা পৃথিবী ছেড়েছি-এখন আর আট-দশ বৎসর গেলে আমরা শনিতে পৌঁছব। ততদিনে তোমার চুল দাড়ি গোঁফ সব পেকে যাবে—তুমি ষাট বছরের বুড়ো হয়ে যাবে। শনিকে অনেকখানি ডাইনে রেখে আমরা ছুটে চলেছি। শনিও ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে ঐ বাঁয়ের দিকে ছুটে আসছে, আর কয়েক বৎসর পরে সে ঠিক আমাদের সামনে এসে হাজির হবে। সেও কিনা সূর্যের প্রজা, কাজেই সূর্যের চারিদিকে তাকেও প্রদক্ষিণ করতে হয়। কিন্তু আমাদের উনত্রিশটা বছরেও তার একটা পাক পুরো হয় না।
যাক—এতদিনে পথের শেষ হয়েছে। অমির শনিগ্রহের উপরে এসে পৌঁছেছি। ‘আংটি'টার দিকে একবার তাকিয়ে দেখ, আকাশের উপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত যেন আলোর খিলান গেঁথে দিয়েছে। খিলানের মধ্যে খিলান, তার মধ্যে ঝাপসা আলোর আরেকটি খিলান। তার উপর আবার শনিগ্রহের ছায়া পড়েছে। সূর্যের এই প্রকাণ্ড রাজত্বের মধ্যে যতদূর যাও, এমন দৃশ্য আর কোথাও দেখবে না—আমাদের পৃথিবীর দুরবীনের দৃষ্টি যতদূর পর্যন্ত যায়, এমন জিনিস আর দ্বিতীয় কোথাও পাওয়া যায় নি।
আকাশে কত চাঁদ। একটি নয়, দুটি নয়, একেবারে আট-দশটা চাঁদ-ছোটো-বড়ো মাঝারি নানারকমের! সওয়া দশ ঘণ্টায় এখানকার দিনরাত-ঘুমের পক্ষে ভারি অসুবিধা। দিনটাও তেমনি—পৃথিবীর রোদ এখানকার চাইতে একশো গুণ কড়া। পৃথিবী থেকে সর্যকে যদি চায়ের পিরিচের মতো বড়ো দেখায়, তবে এখান থেকে তাকে দেখায় যেন আধুলিটার মতো। যখন তখন চন্দ্রগ্রহণ আর সূর্যগ্রহণ তো লেগেই আছে। তার উপর আবার থেকে থেকে চাঁদে চাঁদেও গ্রহণ লেগে যায়, এক চাঁদ আর-এক চাঁদকে ঢেকে ফেলে। এখানকার জন্য যদি পঞ্জিকা তৈরি করতে হয়, তবে তার মধ্যে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা কেবল গ্রহণের হিসাব লিখতেই কেটে যাবে।
আংটিগুলি যেন অসংখ্য চাঁদের ঝাঁক-ছোটো-ছোটো ঢিপির মতো, পাথরের ভেলার মতো, কাঁকরের কুচির মতো, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি চাঁদ কেউ কারও গায়ে ঠেকে না, আশ্চর্য নিয়মে প্রত্যেকে নিজের পথে শনিকে প্রদক্ষিণ করছে। আর সমস্তে মিলে আশ্চর্য সুন্দর আংটির মতো চেহারা হয়েছে।
এখন অসুবিধার কথাটাও একটু ভাবা উচিত। গরম বাতাস আর ধোয়ার ঝড় তো এখানে আছেই। তার উপর সবচাইতে অসুবিধা এখানে দাঁড়াবার মতো ডাঙা পাবার জো নাই-ডাঙা খুঁজতে গেলে অনেক হাজার মাইল গভীর গরম ধোঁয়াটে মেঘের সমুদ্রের মধ্যে ডুব দিতে হবে। সেই মেঘের মধ্যে জীবজন্তু কেউ বাঁচতে পারে কিনা খুবই সন্দেহ। সুতরাং এখন ফিরবার উপায় দেখতে হবে।
এসেছিলাম কামানের গোলার মতন বেগে-কিন্তু তার চাইতেও তাড়াতাড়ি চলা যায় কি? আলো চলে সবচাইতে তাড়াতাড়ি-প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় একলক্ষ নব্বইহাজার মাইল। তা হলে সেইরকম বেগে অলোর সওয়ার হয়ে ছোটা যাক। পৃথিবীতে পৌঁছতে কতক্ষণ লাগবে? এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট।