সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/পার্লামেণ্টের ঘড়ি
(পৃ. ১৬৬-১৬৭)
বিলাতের যে শাসন-সভা, যেখানে সে দেশের খরচপত্র আইনকানুন ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতি নানা ব্যাপারের আলোচনা ও ব্যবস্থা করা হয়—তার নাম পার্লামেণ্ট। পার্লামেণ্টের বাড়ির দুই মাথায় দুই চূড়া—তারই একটার গায়ে মাটি হইতে প্রায় একশো পঁচিশ হাত উঁচুতে পার্লামেণ্টের ঘড়ি বসানো। ঘড়িটা এত বড়ো যে রাস্তার লোকে এক মাইল দুর হইতে সেই ঘড়ি দেখিয়া অনায়াসে সময় ঠিক করিতে পারে।
রাস্তা হইতেই প্রকাণ্ড ঘড়িটা চোখে পড়ে, কিন্তু বাস্তবিক ঘড়িটা যে কত বড়ো তাহা বুঝিতে হইলে একটিবার তাহার ভিতরে ঢোকা দরকার। একটি লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি ঘুরিয়া ঘড়ির কামরায় ঢুকিতে হয়। ঘড়ির চারিদিকে চারিটি মুখ, এক-একটি মুখে এক-একটি ঘর, তাতে দোতালা বাড়ির মতো উঁচু ঘষা কাচের জানলা। জানলার বাহিরে ঘড়ির কাঁটা-এক-একটা সাড়ে সাত হাত লম্বা। রাত্রে সেই ঘরগুলির মধ্যে জানলার পিছনে অনেকগুলি বড়ো-বড়ো গ্যাসের বাতি জ্বালাইয়া রাখে, তাহাতে ঘড়ির সমস্ত মুখটা আলো হইয়া উঠে। কিন্তু এই ঘরের মধ্যে ঘড়ির কলকব্জা কিছুই দেখা যায় না। ঘড়ির যে ঘণ্টা বাজে তাহাও এখান হইতে দেখিবার জো নাই—সে-সমস্ত ভিতরের আর-একটা ঘরের মধ্যে। ঘণ্টাটি একটি দেখিবার জিনিস। গম্বুজের মতো প্রকাণ্ড কাঁসার ঘণ্টা, তার ওজন সাড়ে তিনশত মণেরও বেশি। প্রথম যখন ঘণ্টাটি তৈয়ারি হইয়াছিল তখন কিছুকাল ব্যবহারের পর সেটা ফাটিয়া যায়। তখন সেটাকে আবার ঢালাই করিয়া নূতন করিয়া গড়া হইল। কিছুদিন পরে নূতন ঘণ্টাতেও ফাটল দেখা দিল। তার পর বছর তিনেক ঘণ্টা বাজানো বন্ধ ছিল। পরে হাতুড়িটা বদলাইয়া একটা হালকা, অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ মণ ওজনের হাতুড়ি দেওয়ায় আর ফাটল বাড়িতে পারে নাই। এই বড়ো ঘণ্টাটি ছাড়া আরো চারিটি ছোটো-ছোটো ঘণ্টা আছে, সেগুলি পনেরো মিনিট অন্তর টুং টাং করিয়া বাজে। 'ছোটো’ বলিলাম বটে কিন্তু এগুলির এক-একটির ওজন ত্রিশ হইতে একশো মণ। ঘড়ির পেণ্ডুলামটি প্রায় সাড়ে আট হাত লম্বা, দোলকটির ওজন প্রায় চার মণ।
ঘড়িতে দম দেওয়া এক প্রকাণ্ড ব্যাপার। প্রতি সোম বুধ ও শুক্রবার দুইজন লোককে ক্রমাগত কয় ঘণ্টা পরিশ্রম করিয়া এই কাজটি করিতে হয়। ছোটো-ছোটো ঘণ্টাগুলি যতক্ষণ বাজিতে থাকে, সেই ফাঁকে তাহারা একটু বিশ্রাম করিয়া নেয়, আবার মিনিট পনেরো চাবি ঘুরায়—এইরকম করিয়া সারাটা বিকাল ধরিয়া দম দেওয়া হয়। এই-সমস্ত কলকারখানার উপরে, একেবারে চড়ার আগায় একটা প্রকাণ্ড বাতি বাতি যখন দপ্ করিয়া জ্বলিয়া উঠে তখন লোকে বুঝিতে পারে, পার্লামেণ্টে সভা বসিয়াছে। চূড়ার কাছে উঠিলে আর একটা আশ্চর্য জিনিস দেখা যায়-ঘড়ির কলকব্জার অনেক নীচে একটা জায়গায় দিনরাত একটা প্রকাণ্ড চুল্পি জ্বলিতেছে। চুল্লির আঁচে ঘড়ির ভিতরটা সকল সময় সমানভাবে গরম থাকে। কোথাও এলোমেলো ঠাণ্ডা লাগিয়া কলকজা বিগড়াইতে পারে না।
এত বড়ো ঘড়ি, ইহার জন্য খরচও হইয়াছে কম নয়। ঘড়ির চারটি মুখের জানায় লেখা কাঁটা ইত্যাদি সুদ্ধ প্রায় আশি হাজার টাকা লাগিয়াছে। ঘণ্টাগুলির দাম প্রায় লাখ টাকা কলকব্জার ষাটহাজার টাকা। সমস্ত ঘড়িটার মোট দাম প্রায় সওয়া তিনলক্ষ টাকা।