সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/রেলগাড়ির কথা
(পৃ. ১৬৭-১৭০)
এমন কত জিনিস আছে যা আমরা সর্বদাই দেখে থাকি এবং তাতে কিছুমাত্র আশ্চর্য বোধ করি না। অথচ, সেই-সব জিনিসই যখন প্রথম লোকে দেখেছিল, তখন খুব একটা হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। প্রথম যে বেচার ছাতা মাথায় দিয়ে ইংলণ্ডের রাস্তায় বেরিয়েছিল, তাকে সবাই মিলে ঢিল ছুঁড়ে এমনি তাড়াহুড়ো করেছিল যে, বেচারার প্রাণ নিয়ে টানাটানি। সার ওয়াল্টার র্যালে যখন বিলাতে আলু আর তামাকের প্রচলন করলেন, তখনো তাঁকে রীতিমত নাকাল হতে হয়েছিল। শোনা যায়, তিনি একদিন খুব আরাম করে নিজের ঘরে বসে ‘পাইপ’ মুখে দিয়ে তামাক টানছিলেন, এমন সময় তাঁর চাকর এসে সেই ব্যাপার দেখে, মনিবের মুখে আগুন লেগেছে মনে করে, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। কি করবে কিছু বুঝতে না পেরে সে এক বালতি জল নিয়ে সার ওয়াটারের মাথায় ঢেলে দিল। আলু খেতেও প্রথমটা লোকে কম আপত্তি করে নি। আলু ভয়ানক বিষাক্ত জিনিস, ‘আলু খেয়ে লোক মরে যাচ্ছে', এইরকম সব অদ্ভুত গুজব চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে বহুদিন পর্যন্ত লোকের মনে ভয় জন্মিয়ে রেখেছিল।
কলকাতায় হাওড়ার পোল যখন তৈরি হয় নি, তখন একজন সাহেব বলেন যে নৌকার উপর খিলান ভাসিয়ে এইরকম পোল তৈরি হতে পারে। এ কথাটা সে সময়ে লোকের কাছে এমনই অদ্ভুত ঠেকেছিল যে খবরের কাগজে পর্যন্ত সেই বেচারার নামে নানারকম ঠাট্টা-তামাশা বেরিয়েছিল। অথচ এখন হাজার হাজার লোকে প্রতিদিন পোলের উপর যাওয়া-আসা করছে—সেটা বাস্তবিক একটা অদ্ভুত ব্যাপার কিনা, কেউ সে কথা ভেবে দেখবার অবসর পায় না।
রেলগাড়ির প্রচলনও এমনি করেই হয়েছিল। প্রায় একশো বৎসর আগে জর্জ স্টিফেনসন বাষ্পের জোরে গাড়ি চালিয়ে তাতে লোকের যাতায়াতের ব্যবস্থা করবার প্রস্তাব করেন। তখন সে প্রস্তাবে এতরকম আপত্তি উঠেছিল যে, ক্রমে তর্কটা পার্লামেট পর্যন্ত গড়ায়। শেষটায় অনেক ঝগড়াঝাটি গণ্ডগোলের পর, স্টিফেনসনকে নানারকম জেরা করে তার পর অনুমতি দেওয়া হল—“আচ্ছা, তোমার রেলগাড়িটা নাহয় একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক!” স্টিফেনসন সহজে জেদ ছাড়বার লোক ছিলেন না-তাই তিনি শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে ছাড়েন নি।
এই জর্জ স্টিফেনসনের জীবনের কথা অতি অদ্ভুত। নিতান্ত গরিবের ঘরে যার জন্ম, যে লেখাপড়ার কোনোরকম সুযোগ পায় নি এবং ত্রিশ বৎসর বয়স পর্যন্ত কেবল কয়লার খনিতে সামান্য কাজ করেই জীবন কাটিয়েছে, তার মনে এমন আশ্চর্য শক্তি আসে কোথা হতে, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। স্টিফেনসনের ছয় ভাইবোন। বাপ-মা অত্যন্ত গরিব, কাজেই ছেলেবেলা থেকেই সব কটি ভাইকে টাকা উপার্জনের চেষ্টা করতে হত। তারা নানান কাজ করে একেকজন দিনে প্রায় দু-আনা রোজগার করত। খনিতে নানারকম কল-কারখানা থাকে, সেগুলার উপর জর্জের ভারি নজর ছিল। সুযোগ পেলেই সে সেগুলাকে নেড়েচেড়ে তার ভিতরের কলকব্জা খুলে দেখত। বইটই কিছুমাত্র না পড়েও কেবল নিজে দেখেশুনে এ-সকল বিষয়ে তার আশ্চর্য দখল জমেছিল। সে সময়ে কয়লার খনিতে যে-সকল এঞ্জিন ব্যবহার হত তাদের ‘খাড়া এঞ্জিন’ বলা যায়—অর্থাৎ সে এঞ্জিন এক জায়গায় খাটানো থাকে। তার চাকার সঙ্গে দড়ি শিকল বা লোহার হাতল জুড়ে গাড়ি টানা, মোট বওয়া, জিনিসপত্র উঠানো-নামানো প্রভৃতি নানারকম কাজ চালানো হয়। সেই সময় হতেই চাকায়-বসানো চলন্ত এঞ্জিন গড়বার খেয়াল স্টিফেনসনের মাথায় চেপেছিল।
যা হোক ক্রমে স্টিফেনসনের অবস্থার উন্নতি হতে লাগল। ক্রমে তার সপ্তাহে বারো শিলিং (নয় টাকা) মাইনে হল—তার উপর জুতা সেলাই করে আর ঘড়ি মেরামত করেও সে কিছু কিছু উপার্জন করতে লাগল। সকলে বলল, “জর্জ মস্ত রোজগেরে হয়েছে।” এইভাবে প্রায় ত্রিশ বৎসর কেটে গেল, এর মধ্যেই পাকা এঞ্জিনিয়ার বলে স্টিফেনসনের বেশ একটু নাম হয়েছে।
১৮১৪ খৃস্টাব্দে তেত্রিশ বৎসর বয়সে এক খনির মালিককে রাজি করিয়ে স্টিফেনসন তার প্রথম চলন্ত এঞ্জিনের পরীক্ষা করেন। এই এঞ্জিনের সঙ্গে কয়লার গাড়ি জুড়ে দেখা গেল যে পাঁচশত মণ কয়লা উঁচু রাস্তায় ঘণ্টায় চার মাইল করে নেওয়া যায়। আগে ট্রামের লাইন বসিয়ে তার উপর লোকেরা গাড়ি ঠেলে নিত, সেই লাইনের উপরই এঞ্জিন বসিয়ে কয়লা চালানো হতে লাগল। তার পর বছরখানেকের মধ্যে আরো ভালো দুটি এঞ্জিন তৈয়ারি হল। ক্রমে আশেপাশে আরো কত কয়লার খনিতে স্টিফেনসনের এঞ্জিন চলতে লাগল। এমনি করে আট-দশ বৎসর কেটে গেল।
তখন স্টকটন হতে ডার্লিংটন পর্যন্ত কয়েক মাইল ট্রামের লাইন বসিয়ে ঘোড়ার ট্রাম করবার কথা হচ্ছিল। স্টিফেনসন প্রস্তাব করলেন, ঐ লাইনের উপর এঞ্জিনের গাড়ি চালানো হোক। অনেক কথাবার্তা হাঁটাহাঁটির পর, ট্রামের কর্তারা রাজি হলেন। ১৮২৫ খৃস্টাব্দে এই লাইন যেদিন খোলা হল তখন ‘ষ্টিফেনসনের লোহার ঘোড়া' দেখবার জন্য ভিড় জমে গিয়েছিল। কয়লা আর ময়দায় বোঝাই হয়ে একগাড়ি যাত্রী নিয়ে স্টিফেনসনের এঞ্জিন স্টকটন হতে রওয়ানা হল; স্টিফেনসন নিজে তার ড্রাইভার। গাড়ির আগে আগে কোম্পানির লোক ঘোড়ায় চড়ে নিশান নিয়ে ছুটল। কিন্তু ষ্টিফেনসন তাঁর এঞ্জিনে পুরো দম দিয়ে এমন ছুটিয়ে দিলেন যে, সে লোকটির আর সঙ্গে যাওয়া হল না। ডার্লিংটনে সমস্ত মালপত্র নামিয়ে সমস্ত ট্রেনটিকে পঙ্গপালের মতো লোক-বোঝাই করে স্টিফেনসন স্টকটনে ফিরে এলেন। না জানি সে সময়ে লোকের মনে কিরকম উৎসাহ হয়েছিল।
কিন্তু এতেও গোলমাল মিটল না। এর পর যখন মানচেস্টার থেকে লিভারপুল পর্যন্ত রেল করবার কথা হল, তখন আবার তুমুল ঝগড়া আরম্ভ হল। রেলগাড়ি জিনিসটাতেই অনেকের আপত্তি। কেউ কেউ তাকে ‘শয়তানের যন্ত্র' বলে গাল দিতেও ছাড়ে নি। এর মধ্যে আবার অন্য কয়েকটি এঞ্জিনওয়ালা এসে বললেন, “আমরা আরো ভালো এঞ্জিন বানিয়েছি—আমাদের উপর ভার দাও।” কেউ বললেন, “ষ্টিফেনসন আবার কোথাকার। কে? নাম জানি না, ধাম জানি না—এত বড়ো কাজের ভার কি যার তার উপর দেওয়া যায়?” তখন চারিদিক থেকে পার্লামেণ্টের কাছে দরখাস্ত যেতে লাগল। পার্লামেণ্টের হকুমে সব এঞ্জিন এক জায়গায় আনিয়ে তার পরীক্ষা নেয়া হল। পরীক্ষায় স্টিফেনসনের এঞ্জিন অর সবকটাকে একেবারে পিছনে ফেলে ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল ছুটে সকলের মনে এমন তাক লাগিয়ে দিল যে, যারা ঝগড়া করতে এসেছিল তাদের আর কথাটি কইবার মুখ রইল না। এঞ্জিনওয়ালারা তাদের এঞ্জিনের ঝ্যাঁক্-ঝ্যাঁকানি বন্ধ করে লজ্জায় বাড়ি চলে গেল।
এমনি করে ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে রীতিমতো রেলের চলাচল আরম্ভ হল। তার পর কত এঞ্জিন তৈরি হল, কত দিকে কত রেলের লাইন বসে গেল, গরিবের ছেলে স্টিফেনসন মস্ত ধনীলোক হয়ে গেলেন। কিন্তু জীবনের শেষপর্যন্ত তাঁর সাদাসিধা চালচলন আর সহজ সরল ব্যবহারের কোনো পরিবর্তন হয় নি। ফিটফেনসনের একমাত্র ছেলে রবার্টও কালে একজন নামজাদা এঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন: রেলের পোল তৈরি বিষয়ে তাঁর বিশেষ রকম সুনাম ছিল।