সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/প্রলয়ের ভয়
(পৃ. ১৯০-১৯৩)
পুরাণে আমরা প্রলয়ের কথা পড়েছি। কবে প্রলয় হয়েছিল, আবার কবে হবে, কেমন করে প্রলয় হয়, এই-সবের নানারকম বর্ণনাও তাতে আছে। প্রলয়ের সময়ে সমস্ত সৃষ্টি যে জলে ডুবে যাবে এ কথাও বার বার করে বলা হয়েছে। আশ্চর্য এই যে, নানান দেশে নানান জাতির ইতিহাসে প্রলয়ের প্রায় একই ধরনের বর্ণনা আছে। অন্তত এ কথাটা অনেক দেশের অনেক পুরাণেই শোনা যায় যে, একবার প্রলয় হয়ে এই পৃথিবীটা ডুবে গেছিল। তাতে সমস্ত জীবজন্তু প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। পণ্ডিতেরা বলেন, এ কথাটার মধ্যে একটুখানি সত্যিকারের ইতিহাস আছে। যারা ভূতত্ত্ববিদ অর্থাৎ যাঁরা পাথর পাহাড় ঘেঁটেঘুটে পৃথিবীর পুরানো কথার সংবাদ নিয়ে ফেরেন তাঁরা বলেন যে মানুষের জীবনে বড়ো-বড়ো রোগের মতো পৃথিবীর জীবনেও এক-একটা বড়ো-বড়ো ‘সংকট যুগ’ দেখা গিয়েছে। যুগে যুগে বড়ো-বড়ো দেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হয়েছে, গ্রীষ্মের দেশ হিমেল হাওয়ায় বরফে ঢেকে গিয়েছে, আর দুরন্ত শীতের দেশে বরফ ঠেলে সবুজ ঘাস আর বনজঙ্গল দেখা দিয়েছে। যেখানে দেশ ছিল সেখানে কত সাগর হয়েছে—আবার, কত কত সাগর ফুঁড়ে নতুন দেশ মাথা তুলেছে। আর, মাঝে মাঝে এক-একটা বন্যা এসে পাহাড় ধুয়ে পৃথিবী ধুয়ে দেশকে দেশ সাফ করে দিয়েছে। এইরকম ছোটো বড়ো কত প্রলয় এই পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে গিয়েছে—আমরা এখনো পুরাণের মধ্যে, গল্পের মধ্যে তারই একটু আভাস পাই, আর পাহাড়ে পর্বতে পাথরের স্তরে তার নানারকম পরিচয় দেখি।
একজন জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত এক বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, “এই যে সূর্য এ চিরকাল এমন থাকবে না। একদিন এরও তেজ ফুরিয়ে যাবে-এ-ও তখন নিভে যাবে।” এই কথা শুনে একজন ভীতু-গোছের ভদ্রলোক তাঁকে চিঠি লেখেন যে, “মহাশয়, আপনি যেরকম বিপদের কথা বললেন তা শুনে আমার বড়ো ভয় হয়েছে। সেরকম প্রলয়টা কবে হবে, আর আমার ছেলেপিলেদের জন্য তা হলে কিরকম ব্যবস্থা করলে তারা বাঁচতে পারে—আমায় একটু জানাবেন কি?” জ্যোতির্বিদ পণ্ডিত তার উত্তরে লিখলেন, “আপনার এত ব্যস্ত হবার কোনো কারণ নেই—আপনার ছেলেরা যদি লাখ বছরও বেঁচে থাকে, তব এ সূর্যকে আজ যেমন দেখছে তখনো তেমনই দেখবে-তেজ ফুরাতে আরো অনেক দেরি আছে। সুতরাং আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। লোকে বড়ো-বড়ো ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প আগুনের উৎপতি দেখে তা থেকে প্রলয় জিনিসটা কি রকম, তার একটা আন্দাজ করে। বাস্তবিক, ছোটোখাটো প্রলয় পৃথিবীর উপর দিয়ে সব সময়েই চলেছে। কিন্তু আজ যে প্রলয়ের কথা বলব সেটা কিন্তু সত্যিকার প্রলয় নয়—লোকে প্রলয়ের হজুকে যে নানারকম মিথ্যা ভয়ের সৃষ্টি করে, তারই কথা।
অপরিচিত জিনিস দেখলেই তার সম্বন্ধে মানুষের ভয় বিস্ময় বা কৌতুহল জাগ্রত হওয়া স্বাভাবিক। যে জিনিস সর্বদাই দেখতে পায় তাতে মন এমন অভ্যস্ত হয়ে যায় যে সেটাতে আর কোনোরকম আশ্চর্য বোধ হয় না। মনে কর, এই সূর্য যদি প্রতিদিন না উঠে হঠাৎ এক-একদিন ঐরকম ভয়ানক আগুনের মতো মুর্তি নিয়ে হাজির হত, তা হলে অধিকাংশ লোকেই যে একটা প্রলয়কাণ্ড হবে মনে করে ভয়ে অস্থির হত তা বুঝতেই পার। চাঁদকেও যদি দু-দশ বছরে কৃচিৎ এক-আধবার দেখা যেত তবে লোকে না জানি কত আগ্রহ করে কত আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখত, আর না জানি সেটা আমাদের চোখে কি সুন্দর লাগত।
ধূমকেতুগুলো যদি মাঝে মাঝে এক-আধটা না এসে ঐ চন্দ্র সূর্যেরই মতো নিতান্ত সাধারণ জিনিস হত, তবে তাদের ঐ ঝাপসা ঝাঁটার মতো চেহারা দেখে ভয় পাবার কোনোই কারণ থাকত না। কিন্তু তারা কিনা হঠাৎ কেমন করে খবর না দিয়ে আসে যায়, মানুষের কাছে তাই তাদের এত খাতির। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের লোকেই ধুমকেতুকে একটা অলক্ষণ কিংবা উৎপাত বলে মনে করে। ধুমকেতু যখন আসে তখন যার যা কিছু বিপদ-আপদ সবের জন্যেই ঐ ধুমকেতুকেই লোকে দোষী করে। সে সময়ে রোগ মৃত্যু যুদ্ধ বিদ্রোহ সবই ঐ ধূমকেতুর জন্য। সুতরাং ধুমকেতু এসে পৃথিবী ধ্বংস করবে, এই ভয়টা মানুষের মধ্যে থাকা কিছু আশ্চর্য নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কত বড়োবড়ো দুর্ঘটনাকে যে মানুষ ধুমকেতুর ঘাড়ে চাপিয়েছে তা আর বলে শেষ করা যায় না। নানা দেশের ইতিহাসে নানা সময়কার ধমকেতুর যেরকম অদ্ভুত ভয়ংকর সব বর্ণনা পাওয়া যায় তাতেই বোঝা যায় যে লোকে তাদের কিরকম ভয়ের চোখে দেখেছে। আমরা ছেলেবেলায় একবার খবরের কাগজে গুজব শুনেছিলাম যে কোথাকার এক ‘পাগলা ধূমকেতু’ নাকি পৃথিবীর দিকে আসছে—আর কোনো জ্যোতিষী নাকি গুণে বলেছেন যে সে অমুক তারিখে এই পৃথিবীকে এমন টুঁ লাগাবে যে তখন কেউ বাঁচে কিনা সন্দেহ। এই খবরটা নিয়ে তখন চারিদিকে খুব একটা হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। কয়েক বৎসর আগে যখন ‘হ্যালির ধুমকেতু’ এসে দেখা দেয় তখন কেউ কেউ গুণে দেখিয়েছিলেন যে ঐ ধূমকেতুর ঝাঁটার মতো লেজটা পৃথিবীর উপর এসে পড়বে। ঐ লেজের বাড়ি থেলে পৃথিবীর অবস্থাটা কি হবে তাই নিয়ে কাগজেপত্রে খানিকটা তর্কাতর্কিও হয়েছিল, কিন্তু সময় হলে দেখা গেল যে তাতে পৃথিবীর তো কিছু হলই না, বরং লেজটাই ছিড়ে দু টুকরো হয়ে গেল। সুতরাং ধুমকেতুর ধাক্কা লেগে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার কল্পনাটা কোনো কাজের কল্পনা নয়, কারণ ধূমকেতুর লেজটা এমনই অসম্ভবরকম হালকা যে পৃথিবীর সঙ্গে গুঁতোগুঁতি করতে গেলে তারই বিপদ হবার কথা। তবে পণ্ডিতেরা বলেন যে পৃথিবীকে যদি কোনোদিন কোনো ধুমকেতুর মাথাটার ভিতর দিয়ে যেতে হয় তা হলে অবস্থাটা কেমন হয়, ঠিক বলা যায় না। সম্ভবত তখন খুব একটা জমকাল গোছের উল্কাবৃষ্টি হবে।
উল্কাবৃষ্টি জিনিসটা আমি কখনো চোখে দেখি নি, কিন্তু তার যে বর্ণনা শুনেছি সে ভারি চমৎকার। আকাশে মাঝে মাঝে তারার মতো এক-একটা কি যেন হঠাৎ ছুট দিয়ে কোথায় মিলিয়ে যায়-দেখে লোকে বলে 'তারা খস্ল’। কিন্তু আসলে সে তারা নয়—উল্কা। ঐরকম উল্কা যদি মাঝে মাঝে এক-আধটা না খসে একেবারে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজারে হাজারে আকাশের উপর দিয়ে ছুটে যায় তখন তাকে বলে 'উল্কাবৃষ্টি'। এর মতো জমকাল ব্যাপার অতি অল্পই আছে। আমরা আকাশে যে-সব গ্রহ-নক্ষত্র দেখি তারা সবাই ভালো মানুষের মতো স্থির হয়ে থাকে, তারা ওরকম পাগলের মতো ছুটাছুটি করে না। সুতরাং হাজার হাজার উকাকে অমনভাবে ছুটাছুটি করতে দেখলে হঠাৎ মনে কেমন ভয় হয়—যদি দু-চারটা ঘাড়ে এসে পড়ে, তা হলে অবস্থাটা কিরকম হবে। কিন্তু আসলে তেমন ভয় পাবার কিছুই নেই। উল্কাগুলির প্রায় সমস্তই পৃথিবীতে পড়বার ঢের আগেই বাতাসের ঘষায় আপনা হতেই জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদি না জ্বলত তবে আমরা তাদের দেখতেই পেতাম না। কারণ, একে তারা অধিকাংশই নিতান্ত ছোটো, তার উপর তাদের নিজেদের কোনো আলো নেই; কেবল মরবার সময় যখন তারা আপন “বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে” জ্বলে মরে তখন তার সেই শেষ আলোতে আমরা তাদের একটুক্ষণ দেখি মাত্র। যা হোক, ভয়ের কারণ নাই-বা থাকুক একেবারে হাজার হাজার উল্কা পৃথিবীর উপর ঝাঁপ দিয়ে পুড়ে মরছে এ কথা ভাবতেও খুব অশ্চর্য লাগে। ব্যাপারটা চোখে দেখতে আরো আশ্চর্য, তাতে আর সন্দেহ কি?
আর একটি ভয়ানক জমকাল ব্যাপারের কথা না বললে একটা মস্ত কথা বলি থেকে যায়—সেটি হচ্ছে সূর্যের পুর্ণগ্রহণ। এ জিনিসটি যিনি একবার চোখে দেখেছেন তিনি আর কখনো ভুলতে পারেন না। যখন গ্রহণটা পূর্ণ হয়ে আসতে থাকে, চারিদিক অন্ধকারে ঘিরে ফেলে, চাঁদের প্রকাণ্ড কালো ছায়া দেখতে দেখতে চোখের সামনে পাহাড় নদী সব গ্রাস করে ছুটে আসতে থাকে-যখন বনের পশু আর আকাশের পাখি পর্যন্ত ভয়ে কেউ স্তধ হয়ে থাকে, কেউ চীৎকার করে আর্তনাদ করে তখন মানুষের মনটাও যে ভয়ে বিস্ময়ে কেঁপে উঠবে তাতে আর আশ্চর্য কি? বিশেষত যারা অশিক্ষিত বা অসভ্য যাদের কাছে সুর্যের এই হঠাৎ নিভে যাওয়ার কোনোই অর্থ নেই, তারা যে তখন পাগলের মতো অস্থির হয়ে বেড়াবে, এ তো খুবই স্বাভাবিক। তারাও প্রলয় বলতে ঠিক এইরকমই একটা কিছু কল্পনা করে—এমনই একটা অদ্ভুত বিরাট গম্ভীর ব্যাপার-যার ভয়ংকর মুর্তিতে মানুষের মনকে একেবারে দমিয়ে অবশ করে দেয়।