সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/যুদ্ধের আলো

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ১৮৯-১৯০)
যুদ্ধের আলো

 সেকালে অর্থাৎ পুরাণে যে কালের কথা বলা হয় সেই কালে লড়াইটা হত দিনের বেলায়। ভীষ্মপর্বে দশ দিন ধরে লড়াই হল। প্রতিদিনই দেখি সন্ধ্যা না হতেই শখধ্বনি করে যুদ্ধ থেমে গেল, তার পর যে যার মতো শিবিরে ফিরে গেল। এইরকম দিনেরবেলা লড়াই করে রাত্রে সবাই নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করত। কিন্তু অজিকালকার যুদ্ধে এরকম হবার জো নেই। এখন কি দিন কি রাত, কোনো সময়েই নিশ্চিন্ত থাকা সম্ভব নয়। শত্রু যে কখন কোন সুযোগে ঘাড়ে এসে পড়বে, তার জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হয় সৈন্যেরা যুদ্ধ থামিয়ে সবাই মিলে অস্ত্রশস্ত্র গুটিয়ে শিবিরে ফিরে গেল, এরকমটি কোনো সময়েই হতে পারে না। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে সব সময়েই সৈন্য হাজির রাখতে হয়।

 কামানেরও বিশ্রাম নেই। রাত্রের অন্ধকারে ঝড়ে বাদলে যখন তখন সে হুংকার দিয়ে উঠছে। তার চোখে দেখবার দরকার হয় না, কেবল ম্যাপ দেখে অঙ্ক কষে হিসাব করে সে গোলা ছুড়ছে। দিনেরাতে কোনো সময়েই শত্রুকে নিশ্চিন্ত থাকতে দেয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যরা খাদ কেটে তারই মধ্যে হয়তো খোলা ময়দানে কত রাত কাটাচ্ছে। সেখানে সারারাত ধরে কড়া পাহারা বসান আছে—কোনোখানে টু শব্দটি হলেই তারা কান খাড়া করে শোনে। কোথাও কোনো ভয়ের কারণ দেখলেই ঘণ্টা বাজিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেয়—আর আকাশে তারাবাজি ছুটিয়ে চারদিক আলো করে দেখে, শত্রু আসছে কি না।

 যেমন ডাঙায় তেমনি জলে-আবার আকাশেও তেমনি। কোথাও দিনের অপেক্ষায় কেউ বসে থাকে না। কত যুদ্ধের জাহাজ সারারাত সমুদ্রের মধ্যে হাঁ হাঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার ‘Search light'-এর ঝকঝকে আলো খড়্গের মতো অন্ধকার কেটে চারিদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। সেই আলো যেখানে পড়ে সেখানে যেন একেবারে রাতকে দিন করে ফেলে। সেই আলোর মুখে যদি কোনো শক্রজাহাজ পড়ে তবে তার আর লকোবার জো নাই। সে যেদিকে যাবে, আলো তার পিছন পিছন ঘুরবে। আর সেই আলোতে পরখ করে যুদ্ধজাহাজ তার উপর কামান দাগবে। তখন তার প্রাণভয়ে পালানো ছাড়া আর উপায় নেই। অন্ধকার রাত্রে জার্মানদের বোমাওয়ালা ‘জেপেলিন' বেলনগুলো যখন আকাশ বেয়ে চোরের মতো আসতে থাকে তখন তার সাড়া পেলেই অমনি বড়ো-বড়ো আলোর ঝাপটা চারিদিকে ছুটে বেরোয়-আকাশ হাতড়ে খুঁজবার জন্য। যুদ্ধের সময় আলোর ব্যবহারটা যতই ভয়ানক হোক-না কেন, তামাশা হিসাবে আলোটা দেখতে ভারি সুন্দর। বড়ো-বড়ো দরকারি ব্যাপারের সময় দশ-বিশটা জাহাজ একসঙ্গে মিলে যখন আলোর খেলা দেখাতে থাকে তখন সে এক চমৎকার দৃশ্য হয়।

 কিন্তু জাঁকাল ব্যাপারের কথা যদি বলো তবে রাত্রে ডাঙায় লড়াইয়ের সময় যে আলোর খেলা চলে, তার আর তুলনা হয় না। চারিদিকে হাজার হাজার কামান আর বন্দুক, তাদের মুখে মুখে লাল আগুন ঝিকমিক করে উঠছে। থেকে থেকে রঙ-বেরঙের তারাবাজি ছুঁড়ে নানারকম সংকেত চলছে। মনে কর, জার্মান খাদের উপর তারা ফুটছে—সাদা লাল, সাদা লাল—তার মানে, ‘শত্রু সৈন্য এদিকে আসছে-কামান চালাও। খানিক পরে হয়তো দেখবে, লাল সবুজ লাল সবুজ লাল সবুজ-জার্মানরা বলছে, “আমরা কোণঠাসা হয়েছি—শীঘ্র উদ্ধার কর। মাঝে মাঝে এক-একটা বড়ো-বড়ো ‘ফানুষ তারা' আস্তে আস্তে জ্বলতে জ্বলতে চারিদিক আলো করে মাটিতে পড়ছে—সেই আলোতে লড়াই আবার জমে উঠছে। হয়তো আশেপাশে ভাঙাচোরা গ্রামগুলোতে আগুন ধরে একএকদিকে আকাশের গায়ে লাল হয়ে উঠেছে। তার উপর থেকে থেকে শত্রুদের চোখ ধাঁধিয়ে বিদ্যুতের আলোর মতো ‘সার্চ লাইট’ এসে পড়েছে। উপরে নীচে চারিদিকে বড়ো-বড়ো গোলা ফাটছে—এক মুহর্ত আলোর ঝিলিক্, তার পর পাহাড় প্রমাণ ধোঁয়া। আলোয় আঁধারে ছায়ায় ধোঁয়ায় মিলে কি ভীষণ তামাশা!

সন্দেশ–আষাঢ়, ১৩২৪