সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/বেগের কথা

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২২৬-২২৮)
বেগের কথা

 যে লোক শৌখিন, সামান্য কষ্টেই কাতর হইয়া পড়ে তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলা হয় ‘ফুলের ঘায়ে মুর্ছা যায়'। রঘুবংশে আছে যে দশরথের মা ইন্দুমতী সত্যসত্যই ফুলের ঘায়ে কেবল মুর্ছা নয়, একেবারে মারাই গিয়াছিলেন। ইন্দ্রের পারিজাতমালা আকাশ হইতে তাঁহার গায়ে পড়ায় তাঁহার মৃত্যু হয়। প্রথম যখন এই বর্ণনাটা শুনিয়াছিলাম তখন ইহাকে অসম্ভব কল্পনা বলিয়া বোধ হইয়াছিল। কিন্তু এখন ভাবিয়া দেখিতেছি ইহা নিতান্ত অসম্ভব কিছু নয়।

 তালগাছের উপর হইতে ভাদ্রমাসের তাল যদি ধুপ করিয়া পিঠে পড়ে তবে তার আঘাতটা খুবই সাংঘাতিক হয়। কিন্তু ঐ তালটাই যদি তালগাছ হইতে না পড়িয়া এ পেয়ারাগাছ হইতে এক হাত নীচে তোমার পিঠের উপর পড়িত, তাহা হইলে এতটা চোট লাগিত না। কেন লাগিত না? কারণ, তাহার বেগ কম হইত। কোনো জিনিস যখন উঁচু হইতে পড়িতে থাকে তখন সে যতই পড়ে ততই তার বেগ বাড়িয়া চলে। যে হাড়ের টুকরাটি হইতে একতলায় মানুষের মাথায় পড়িলে বিশেষ কোনোই অনিষ্ট হয় না-সেইটিই যখন চিলের মুখ হইতে পড়িতে পড়িতে অনেক নীচে প্রবল বেগে আসিয়া নামে তখন তাহার আঘাতে মানুষ রীতিমতো জখম হইতে পারে। ফুলের মালাটিকেও যদি যথেষ্ট উচু হইতে ফেলিয়া দেওয়া যায় তবে তাহার আঘাতটি যে একেবারেই মোলায়েম হইবে না, এ কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায়।

 ঘূর্ণী বায়ুর সময় সামান্য খড়কুটা পর্যন্ত যে ঝড়ের বেগে গাছের ছালে বিধিঁয়া যায়, ইহা অনেক সময়ই দেখা যায়। একটা নরম মোমবাতিকে বন্দুকের মধ্যে পুরিয়া গুলির মতো করিয়া ছুটাইলে সে যে পরু তক্তা ফুটা করিয়া যায়, ইহাও মানুষে পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে। বন্দুকের গুলি জিনিসটা আসলে খুব মারাত্মক নয়; হাতে ছুঁড়িয়া মারিলে তাহাতে চোট লাগিতে পারে, কিন্তু সে চোট খুব সাংঘাতিক হয় না। কিন্তু সেই জিনিস যখন বন্দুকের ভিতর হইতে বারুদের ধাক্কায় প্রচণ্ডবেগে ছুটিয়া বাহির হয় তখন আস্ত মানুষটাকে এপার-ওপার ফুঁড়িয়াও তাহার রোখ থামিতে চায় না।

 জলের কল হইতে যে-জলধারা পড়িতে থাকে, তাহার মধ্যে আঙুল চালাইয়া দেখ-যেটুকু বাধা বোধ করিবে তাহা নিতান্তই সামান্য। কিন্তু ঐরকম সরু একটি জলের ধারা যখন খুব প্রবলবেগে ছুটিয়া বাহির হয় তখন মনে হয় সে যেন লোহার মতো শক্ত—তখন তাহাকে কুড়াল দিয়াও কাটা যায় না। ফ্রান্সের একটা কারখানায় চারশত হাত উঁচু পাহাড় হইতে জলের স্রোত আনিয়া তাহার জোরে কল চালানো হয়। সেই জল যখন এক আঙুল মোটা একটি নলের ভিতর হইতে ভীষণ তোড়ে বাহির হয় তখন তাহাতে তলোয়ার দিয়া কোপ মারিলে তলোয়ার ভাঙিয়া খান খান হইয়া যায়। এমন-কি, বন্দুকের গুলিও তাহাকে ভেদ করিতে পারে না -তাহাতে ঠেকিয়া ঠিকরাইয়া পড়ে। আমেরিকার কোনো কোনো কারখানার নর্দমা দিয়া যে-জল পড়ে, তাহার উপর কুড়াল মারিয়া দেখা গিয়াছে, জলের মধ্যে কুড়াল বসে না-জলের এমন বেগ!

 চলন্ত জিনিস মাত্রেরই এইরূপ একটা ধাক্কা দিবার ও বাধা দিবার শক্তি আছে। পণ্ডিতেরা বলেন, জগতে যা কিছু তেজ দেখি, যে কোনো শক্তির পরিচয় পাই, সমস্তই এই চলার রকমারি মাত্র। বাতাসে ঢেউ উঠিল, অমনি শব্দ আসিয়া কানে আঘাত করিল - আকাশে তরঙ্গ ছুর্টিল, অমনি চোখের মধ্যে আলোর ঝিলিক্, জ্বলিল। কেবল তাহাই নয়, প্রত্যেক ধূলিকণার মধ্যে কোটি কোটি পরমাণু ছুটাছুটি করিতেছে। ভিতরের এই ছুটাছুটি বাড়িলেই সব জিনিস গরম হইয়া উঠে। যখন ঠাণ্ডা হয় তেজ কমিয়া আসে তখন বুঝিবে এই পরমাণুর ছুটাছুটি ঢিমাইয়া পড়িতেছে।

 যে-জিনিসটা ছুটিতে চায় তাহাকে বাধা দিলে সে গরম হইয়া ওঠে। তাহার বাহিরের বেগ বন্ধ হইয়া তখন ভিতরে পরমাণুর বেগকে বাড়াইয়া তোলে। বন্দুকের গুলিটা লোহায় লাগিয়া থামিয়া গেল হাত দিয়া দেখ, এত গরম যে হাতে ফোস্কা পড়িবে। একটা শক্ত জিনিসের উপর ক্রমাগত হাতুড়ি মার, হাতুড়ির বেগ যতবার বাধা পাইবে ততই দেখিবে হাতুড়িটা গরম হইয়া উঠিতেছে-আর যাহার উপর আঘাত করিতেছে, তাহাকেও গরম করিয়া তুলিতেছে। রেলগাড়ি যখন লোহার রেলের উপর দিয়া যায় তখন চাকার সঙ্গে রেলের ঘষা লাগিয়া সে ক্রমাগত বাধা পাইতে থাকে। ট্রেন চলিয়া যাইবার পর যদি রেলের উপর হাত দিয়া দেখ, দেখিবে লোহাগুলি বেশ গরম হইয়া উঠিয়াছে। ট্রেন যখন স্টেশনে আসিয়া থামে, তখন তার চাকায় হাত দিলে দস্তুরমতো গরম বোধ হয়।

 কেৰল যে কঠিন জিনিসেই বাধা দেয় তাহা নয়, বাতাসের মতো হালকা জিনিসেরও বাধা দিবার শক্তি আছে। খুব বড়ো একটা পাখা লইয়া জোরে চালাইতে গেলে বেশ বোঝা যায় যে বাতাসের ঠেলা লাগিতেছে। তোমরা নিশ্চয়ই উল্কা দেখিয়াছ। মাঝে মাঝে আকাশে যে তারার মতো জিনিসগুলি হঠাৎ কোথা হইতে বোঁ করিয়া ছুট দিয়া পালায়, সেগুলিই উল্কা। উল্কাগুলি এই পৃথিবীরই মতো ভীষণভাবে ঘণ্টায় পঞ্চাশহাজার বা লক্ষ মাইল বেগে ছুটিতে থাকে। বাহিরের আকাশ তাহাকে বাধা দেয় না, কিন্তু দৈবাৎ যদি সে পৃথিবীর বাতাসের মধ্যে আসিয়া পড়ে অমনি বাতাস তাহাকে বাধা দিতে থাকে। এই বাধাতেই তাহার বেগ কমিয়া যায়, সে গরমে জ্বলিয়া আগুন হয়। সেই আগুনকে ছুটিতে দেখিয়া আমরা বলি ‘ঐ উল্কা পড়িল'।  পৃথিবীর তুলনায় উল্কাগুলি নিতান্তই ছোটো। তাই তাহাদের ধাক্কায় পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হয় না, উল্কাগুলিই মরিয়া শেষ হয়। কিন্তু দুইটা বড়ো-বড়ো পৃথিবী যদি এইরকম ছুটাছুটি করিয়া ধাক্কা লাগায় তবে কাণ্ডটা কিরকম হয়। মানুষের কল্পনা তাহার ধারণাই করিতে পারে না। দুইটার মধ্যে যখন ধাক্কা লাগে তখন তাহাদের প্রচণ্ড বেগ বাধা পাইবামাত্র জ্বলিয়া আগুন হইয়া বাহির হয়। সেই আগুন হইতে পাহাড়প্রমাণ স্ফুলিঙ্গ চারিদিকে হাজারে হাজারে ছুটিয়া যায়। দেখিতে দেখিতে দুই পৃথিবীর শেষ চিহ্ন ঘুচিয়া গিয়া কেবল লক্ষ লক্ষ মাইল জুড়িয়া আগুনের শিখা জ্বলিতে থাকে। এরূপ ঘটনা যে একেবারেই হয় না তাহা নয়; কিছুদিন আগে যে নুতন তারা দেখা গিয়াছিল তাহাও এইরূপ একটা লুপ্তবেগের আগুনমাত্র! কবে ব্রহ্মাণ্ডের কোন কিনারে এই আগুন জ্বলিয়াছিল; তাহারই জ্বলন্ত কিরণ আকাশে তরঙ্গ তুলিয়া ছুটিতে ছুটিতে এতদিনে আমাদের চোখে আসিয়া আঘাত করিয়া গেল। সেই যে অলোকের বেগ, তাহার কাছে আর সমস্ত বেগই হার মানিয়া যায়। কামানের গোলা এত যে প্রচণ্ড বেগে ছুটিয়া যায়, তাহার গতিও আলোকের গতির তুলনায় যেন রেলগাড়ির কাছে শামুকের চলার মতো।

সন্দেশ কার্তিক, ১৩২৫