সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/মজার খেলা
(পৃ. ২২৮-২৩০)
একবার একটা মজার দৌড়-খেলা দেখিয়াছিলাম। কতগুলা লোককে বড়ো-বড়ো ছালার মধ্যে গলা পর্যন্ত ভরিয়া মাঠের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে-কে আগে যাইতে পারে। কয়েকজন অত্যন্ত সন্তর্পণে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পেঙ্গুইন পাখির মতো হেলিয়া চলিতেছে, আর কয়েকজন মাটিতে পড়িয়া একেবারে 'কুমড়ো গড়ান’ গড়াইতেছে। মাঠসুব্ধ লোক একেবারে হাসিয়া অস্থির। ফ্রান্সে একটি 'মোটা মানুষের সমিতি’ আছে; অন্তত সাড়ে তিন মণ ওজন না হইলে তাহাতে ভর্তি হওয়া যায় না। তাহারা একবার মোটা লোকদের জন্য দৌড় খেলার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। যাহাদের ওজন পাঁচ-সাত মণের কম হইবে না-এমন অনেক লোকে তাহাতে দৌড়াইয়াছিল। সে দৌড় আমি দেখি নাই কিন্তু তাহার যে ফোটো দেখিয়াছি, সে অতি চমকার-দেখিলে না হাসিয়া থাকা যায় না।
বহুকাল আগে একটা বিলাতি পত্রিকায় এইরকম কতগুলি অদ্ভুত মজার খেলার কথা পড়িয়াছিলাম। তাহার মধ্যে একটা ছিল খাওয়ার পাল্লা। কতগুলি রেকাবি সম্মুখে লইয়া সকলে টেবিলের কাছে বসিয়াছে; 'এক-দুই-তিন’ বলিতেই তাহাদের পাতে একেবারে উনান হইতে সাংঘাতিক গরম ‘চপ্’ ছাড়িয়া দেওয়া হইল। কাঁটা চামচ নাই, খাবারে হাতও লাগাইতে পারিবে না-এখন যে আগে খাইতে পারিবে তাহারই জিত। যে লোকটা জিতিয়াছিল সে প্রথমেই মাথা দিয়া টুঁ মারিয়া চপ্টাকে চ্যাপ্টাইয়া জুড়াইবার সুবিধা করিয়া লইয়াছিল। মাথায় চুল আছে, তাই সহজে গরম লাগে না। আর-একটা খেলাতে কোনো ফল কিম্বা অন্য কোনো খাবার সুতায় বাঁধিয়া ঠিক নাকের সামনেই ঝুলাইয়া রাখা হয়। যে হাত না দিয়া সকলের আগে পরিষ্কার করিয়া খাওয়া শেষ করিবে তাহার জিত। কাজটা শুনিতে বেশ সহজ, কিন্তু কাজে তেমন সহজ নয়। সুতাটা শূন্যে ঝুলিতেছে, মুখ ঠেকাইতে গেলে সেটা আরো দুলিত থাকে।
একটা গল্প পড়িছিলাম যে এক জায়গায় খেলা হইতেছিল, কে কত উৎকট মুখভঙ্গি করিতে পারে। একজনের উপর ভার ছিল, তিনি বিচার করিয়া বলিবেন, কাহার মুখের ভঙ্গি সকলের চাইতে বিশ্রী ও বিদঘুটে। খেলার জায়গায় এক বেচারা তামাশা দেখিতেছিল, তাহার মুখখানা বাস্তবিকই কদাকার। বিচারক তাহাকে দেখাইয়া বলিলেন, “আমাদের মধ্যে ইনি ‘ফার্স্ট প্রাইজ' পাইবার যোগ্য!” সে লোক আশ্চর্য হইয়া বলিল, “আমি তো এ খেলায় যোগ দিই নাই।” বিচারক গম্ভীরভাবে বলিলেন, “তাই নাকি? তা, আপনি কোনো চেষ্টা না করিয়াই ফাস্ট হইয়াছেন। আপনি থাকিতে ও প্রাইজ আর কেউ পাইতে পারে!” লোকটি প্রাইজ পাইয়া খুশি হইবে কি দুঃখিত হইবে, তাহা বুঝিতে পারিল না।
ঘরে বসিয়া অনেকজনে মিলিয়া খেলা যায় এমন দু-একটা খেলার কথা বলি। কতগুলা খেলা আছে তাহাতে বেশ চটপটে এবং সতর্ক হওয়া দরকার। তার মধ্যে একটা খেলা এই-একজন লোক বেশ ধীরে ধীরে একটি গল্প বলিয়া বা পাঠ করিয়া যাইবে। সেই গল্পটি এমন হওয়া চাই যে, তাহার মধ্যে অনেকগুলি বেখাপ্পা কথা থাকে। অর্থাৎ এক জায়গায় যেরকম বলা হইয়াছে, আর এক জায়গায় তার উলটারকম কথা থাকিবে। যেমন এক ভদ্রলোকের বর্ণনা দেওয়া গেল তার মাথা ভরা টাক, তার পরে আর-এক জায়গায় হয়তো বলা হইল যে তিনি আয়নার সামনে বাহার করিয়া টেরি ফিরাইতেছেন। এইরকম গল্পের একটি নমুনা দেওয়া গেল-
“রবিবার, শ্রাবণের কৃষ্ণা চতুর্থী। সন্ধ্যার আকাশ দেখিতে দেখিতে মেঘে ঢাকিয়া আসিল, দেখিতে দেখিতে মুষলধারে বৃষ্টি নামিল। গৃহহীন পিতৃমাতৃহীন যোগেশচন্দ্র অফিসের বেশে বিনা ছাতায় ভিজিতে ভিজিতে নির্জন পথ দিয়া চলিতেছেন—সঙ্গে ট্রামের পয়সাটি পর্যন্ত নাই। স্কুল কলেজ হইতে ছুটি পাইয়া ছাত্রগণ কোলাহল করিয়া ছুটিতেছে— যোগেশচন্দ্রের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই, তিনি ভিড় ঠেলিয়া চলিতেছেন, আর ভাবিতেছেন কতক্ষণে পৌঁছিব। একে শীতকাল, তার উপর গায়ে কেবল শতছিন্ন পাতলা ফুটবলের সার্ট, যোগেশচন্দ্র কাঁপিতে কাঁপিতে আপনার গৃহর সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন। এমন সময় কে যেন ডাকিয়া উঠিল, “অন্ধ নাচারকে ভিক্ষা দেও।” যোগেশচন্দ্র দেখিলেন এক হস্তপদহীম ভিখারী কাতরভাবে ভিক্ষা চাইতেছে। দেখিয়াই তাহার মনে দয়ার উদয় হইল। তিনি পকেট হইতে একটি টাকা বাহির করিয়া ভিখারীর হস্তে গুঁজিয়া দিয়া গৃহে প্রবেশ করিলেন এবং ভিজা জুতা ও ছাতা বারান্দায় রাখিয়া গিয়া মুর্ছিত হইয়া পড়িলেন। পতন শব্দে তাঁহার বাপ-মা ‘হায় হায়' করিয়া ছুটিয়া আসিলেন।”
ইহার মধ্যে কি কি ভুল আছে বাহির কর তো? খেলিবার সময় কতগুলা কাগজ পেনসিল দিয়া সকলকে বসাইয়া দিবে এবং ধীরে ধীরে দুইবার গল্পটি পাঠ করিয়া শুনাইবে। তার পর দু-তিন মিনিট সময় দিবে, তাহার মধ্যে যে সবচাইতে বেশি ভুল ধরিতে পারিবে, সেই বাহাদুর। অনেকটা এই ধরনের আর-একটা খেলা আছে, তাহাতে কথা মনে রাখার উপর হারজিত নির্ভর করে। একটা কোনো জিনিসের খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়া তার পর সকলকে বলিতে হয় সমস্ত বর্ণনাটা শুনিয়া আবার মন হইতে লিখিয়া দাও। যেমন একজন মানুষের কথা বললাম তাহার বয়স পঁচিশ হইবে, চোখে কালো চশমা, মাথার সামনের দিকে টাক, খোঁচা খোঁচা ভুরু ও ঝাটার মতো গোঁফ, দাড়ি কামানো, মোটা বেঁটে চেহারা, হাতে একটা সবুজ ক্যাম্বিসের ব্যাগ, গলায় পশমের গলাবন্ধ, গায়ে কালো গরম কোট, তার পকেটে লাল রুমাল, হাতে একটা বাঁশের ছাতা, পায়ে প্রকাণ্ড বুট জুতা, কানে শোনেন কম, চলেন খোঁড়াইয়া-তার উপর গলার আওয়াজখানা ভিজা ঢাকের মতো। এখন এইটুকু ধীরে ধীরে দুবার পড়িয়া তার পর বেশ ভাবিয়া লিখ তো—দেখিবে এইটুকু বর্ণনার মধ্যে হয়তো কিছু কিছু ভুল হইয়া যাইবে।
এইবার অন্যরকমের আর-একটি খেলার কথা বলি যাহা শুনিতে খুব সহজ শোনায় কিন্তু কাজে ভারি শক্ত। একখানা আয়নার সামনে একটা কাগজ–আয়নার ছায়া দেখিয়া কাগজে কিছু আঁকিবার অথবা লিখিবার চেষ্টা করিয়া দেখ। ভারি একটা অদ্ভুত কাণ্ড হয়। হাতটা যেন কিছুতেই বাগ মানিতে চায় না। অনেক লোককে দেখাইতে হইলে একটা বোর্ডের উপর বেশ বড়ো করিয়া একটা সহজ 'V' আঁকিয়া, সকলকে বল বোর্ডের দিকে না তাকাইয়া কেবল আয়নার ছায়া দেখিয়া তাহার উপর দাগ বুলাইতে। বিশেষত যাহারা খব ভালো ‘ড্রয়িং’ জানেন বলিয়া প্রশংসা পান তাহাদের ধরিয়া এই সামান্য কাজে লাগাইয়া বেশ জব্দ করিতে পার।
এবারে আর-একটা মজার কথা বলিয়া শেষ করিব। বারো আঙুল লম্বা দুখানি ঝাঁটার কাঠিকে মোড়াইয়া দুটি ইংরাজি V তৈয়রি কর। তার পর আর-একটি লম্বা কাঠির উপর তাহাদের চড়াইয়া, একখানা সমান বুটিং বা অন্য কোনো খসখসে কাগজের উপর ধরিয়া রাখ। A-দুটি যেন ভিতরের দিকে হেলিয়া থাকে। হাতটাকে একেবারে আলগা রাখিও যেন কিছুর উপর ভর করিয়া না থাকে। তাহা হইলে দেখিবে আস্তে আস্তে ঝাটার কাঠি দুইটা কাছাকাছি আসিতেছে। তোমার হাত যতই কাঁপিবে, সে কঁপুনি যতই সামান্য হোকনা কেন, কাঠিটা ততই কাগজের ঘষায় ঘষায় ভিতরদিকে সরিতে থাকিবে!