সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/আগুন

পুণ্যলতা চক্রবর্তী, কল্যাণী কার্লেকর সম্পাদিত
(পৃ. ২৩০-২৩৩)
আগুন

 আজকালকার সভ্য মানুষ, যাহারা দিব্য আরামে ঘরে বসিয়া দিয়াশলাই ঠুকিয়া আগুন জ্বালায়, তাহারা ভাবিয়াই দেখে না যে এই আগুন মানুষের কত তপস্যার ধন। যে-আগুন বনে জঙ্গলে দাবানল হইয়া জ্বলে, যে আগুন আগ্নেয় পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় জিভ মেলিয়া ধুঁকিতে থাকে-সেই আগুনকে মানুষ যখন আপনার শক্তিতে জ্বালাইতে শিখিল, সেইদিন মানুষ এমন বিদ্যা শিথিল যাহা মানুষ ছাড়া আর কেহ জানে না। চমকি পাথর ঠুকিয়া বা কাঠে কাঠে ঘষিয়া সেই যে কোন কালের আদিম মানুষ আগুন জ্বালাইবার উপায় বাহির করিয়াছিল, আজও পৃথিবীর কত অসভ্য জাতি ঠিক সেই উপায়ে প্রতিদিন আগুন জ্বালিতেছ। এই কাজ করিতে কৌশল ও পরিশ্রম দুয়েরই দরকার হয়। কাঠের মধ্যে কাঠ ঘুরাইয়া আগুন জ্বালিবার প্রথা আমাদের দেশে বহুকাল হইতে প্রচলিত ছিল-বেদে এবং পুরাণে তার কথা অনেক স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকবার এইভাবে আগুন জ্বালানো বড়ো সহজ কথা নয়, সেইজন্য একবার আগুন জ্বালানো হইলে তাহাতে বার বার কাঠ-কুটা শুকনা পাতা ইত্যাদি দিয়া সেই আগুনকে বাঁচাইয়া রাখা দরকার হইত। কেবল আমাদের দেশে নয়, এইরকম আগুন রক্ষার আয়োজন রোম গ্রীস ইজিপ্ট প্রভৃতি সকল দেশেই ছিল। অনেক সময় রীতিমতো মন্দির গড়িয়া পুরোহিত রাখিয়া এই আগুনের তদ্বির করা হইত। লোকে সেই-সকল মন্দির হইতে প্রতিদিন আগুন লইয়া আসিত এবং সকলে মিলিয়া আগুনের সম্মান ও পূজা করিত।

 আগুন না থাকিলে মানুষের অবস্থা কি হইত? আগুন ছিল তাই মানুষ শীতের মধ্যেও টিকিতে পারিয়াছে, কত হিংস্র জন্তর হাত হইতে আপনাকে বাঁচাইতে পারিয়াছে, রান্না করিতে শিখিয়াছে, মাঠি পোড়াইয়া বাসন গড়িতে শিখিয়াছে, লোহা তামা প্রভৃতি ধাতুকে কাজে লাগাইতে শিখিয়াছে। শহরে গ্রামে ঘরের আশেপাশে সর্বদা যে-সব জিনিস কাজে লাগে, তাহার দিকে চাহিয়া দেখ, আগুন না হইলে তাহার কোনটা তৈয়ারি করা সম্ভব হইত? মাটির হাঁড়ি, কাঁসার বাসন, সোনা রূপার অলংকার এ-সব তো ছাড়িয়াই দিলাম। জুতাটি যে পায়ে দিয়াছ, তাহার কাঁটাগুলি তো লোহার, ঐ জুতা সেলাইয়ের জন্য লোহার ছুঁচ দরকার হইয়াছিল তো? আগুন না থাকিলে তাহা সম্ভব হইত কিরূপে? ঘরে এত যে সাবান সুগন্ধি ওষুধপত্র ব্যবহার কর, তাহার মালমসলার জন্য কত কারখানায় কত চুল্লি জ্বালিতে হয় তাহা একবার ভাবিয়া দেখ তো। রাত্রে যে আলো জ্বালাইয়া পড়াশুনা কর, সেই আলোটুকু যদি না থাকিত তবে কেমন অসুবিধা হইত বল দেখি। আর ঐ যে কাঁচের চশমা পর, কাঁচের ‘থার্মোমিটার' দিয়া জ্বর মাপ, আর অণুবীক্ষণ দূরবীক্ষণ প্রভৃতি অসংখ্য কাঁচের যন্ত্র ব্যবহার কর, ক্ষার চুণ ও বালি আগুনে না গলাইলে সে কাচ আসিত কোথা হইতে? আগুন ছাড়া পৃথিবী যদি কল্পনা করিতে চাও তো এই-সমস্ত জিনিস বাদ দিতে হয়—এই-সমস্ত জিনিসের সাহায্যে মানুষ জ্ঞানবিজ্ঞান ও সত্যতায় যাহা কিছু উন্নতি লাভ করিয়াছে সে-সমস্ত লোপ করিতে হয়। আর মানুষকে কল্পনা করিতে হয় সেই আদিম কালের অসভ্যের মতো—যাহারা ফলমূল ও কাঁচা মাংস খাইয়া, গাছের ছাল-বাকল ও জানোয়ারের চামড়া পরিয়া, গাছ পাথরের অস্ত্রে সাজিয়া, গাছে জঙ্গলে গুহা গহ্বরে লুকাইয়া ফিরিত। সে সময়ের পৃথিবীতেও কাঠ ছিল, কয়লা ছিল, আগুন জ্বালিবার মালমসলা সবই ছিল। ছিল না কেবল আগুন–ছিল না কেবল সেই জ্ঞানটুকু যাহাতে আগুন জ্বালিবার সংকেতটি জানা যায়। সেই মানুষ, আর এখনকার এই মানুষ! এ দুয়ের মধ্যে এত যে প্রকাণ্ড তফাত দেখিতেছ, তাহার প্রধান কারণ এই আগুনের আবিষ্কার।

 আমাদের দেশে আগুনকে বলে,'সর্বভুক’। একবার যদি সে জিভ মেলিয়া বাহির হইল, তবে তাহার ক্ষুধার আর শেষ নাই—সে তখন সব খাইয়া উজাড় করিতে পারে। আগুনকে যদি তুষ্ট করিতে চাও, কাজে লাগাইতে চাও, তবে তাহার ক্ষুধা মিটাইর খোরাক দেওয়া চাই। কাগজ দাও, খড় দাও, কাঠ দাও, কয়লা দাও, তেল ঘি কেরোসিন যাহা সে হজম করিতে পারে তাহাই দাও-একটা কোনো খোরাক না জোগাইলে সে জ্বলিতে পারে না। আগুন জ্বালিবার জন্য মানুষে প্রতি বৎসর কত বন জঙ্গল উজাড় করে, মাটির ভিতরে ঢুকিয়া কত লক্ষ লক্ষ মণ কয়লা খুঁড়িয়া তোলে, কত বড়ো-বড়ো ব্যবসা ফাঁদিয়া কেরোসিন প্রভৃতি খনির তেল দেশ-বিদেশে চালান দেয়, কত মোম চর্বি ঘি তেল খরচ করিয়া ঘরে ঘরে বাতি জ্বালায়, তাহার হিসাব লইতে গেলে অবাক হইতে হয়। আজকালকার নিতান্ত অসভ্য মানুষ-লঙ্কা দ্বীপের ‘ভেদ্দা' বা আফ্রিকার ‘বুশম্যান’—তাহারাও আগুনের ব্যবহার জানে। অতি প্রাচীন কালে আগুন ছাড়া মানুষ যাহারা ছিল তাহারা যে আগুনওয়ালা মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়া টিঁকিতে পারিত না, এ কথা সহজেই বোঝা যায়। শীতের অত্যাচারে, শত্রুর অত্যাচারে, হিংস্র জন্তর অত্যাচারে-নানারকম বিপদে আপদে আগুনের সাহায্য না পাইলে আজকালকার এই মানুষেরা আজ কোথায় থাকিত, কে জানে? হয়তো মানুষ জাতিটাই পৃথিবী হইতে লোপ পাইবার জোগাড় হইত।

 হিংস্র জন্তু পোষ মানিলেও তাহার হিংস্রতা একেবারে দূর হয় না। সেইজন্য সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়, কখন তাহার হিংসা বুদ্ধি জাগিয়া উঠে। আগুনকে বাগ মানাইতে গিয়াও মানুষকে পদে পদেই এইরকম বিপদে পড়িতে হইয়াছে। আমরা একবার শিলং পাহাড়ে গিয়াছিলাম। সেখানে পাহাড়ের গায়ে লম্বা লম্বা দাগ দেখিয়া দূর হইতে ভাবিয়াছিলাম, ওগুলি বুঝি পাহাড়ে উঠিবার রাস্তা। পরে কাছে গিয়া বুঝিলাম ওগুলি রাস্তা নয়, জঙ্গলের মাঝে মাঝে চওড়া ফিতার মতো ফাঁকা জমি-ঠিক যেন পাহাড়ের মাথার উপর ক্ষুর চালাইয়া খালের মতো করিয়া চাচিয়া রাখিয়াছে! শুনিলাম, আগুনের ভয়ে নাকি ওরকম করা হইয়াছে। কোথাও আগুন লাগিলে, ঐ ফাঁকা জায়গা পর্যন্ত আসিয়া অগুন আর ছড়াইতে পারে না। আমেরিকার বড়ো-বড়ো Prairie বা ঝোপজমিতে কেবল ঝোপজঙ্গল ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না-সেখাম আগুন লাগিলে এক-এক সময়ে ব্যাপার ভারি মারাত্মক হইয়া দাঁড়ায়। সে আগুন এমন হু হু করিয়া ছড়াইয়া পড়ে যে মানুষে অনেক সময়ে ঘোড়া ছটাইয়াও তাহার হাত এড়াইয়া পলাইতে পারে না।

 এ-সব তো গেল বাহিরের আগুনের কথা। মানুষের ঘরে ঘরে সংসারের কাজের জন্য প্রতিদিন যে আগুনের দরকার হয়, সেই আগুন যখন এক-একবার ছাড়া পাইয়া ঘরবাড়ি শহর গ্রাম সব খাইয়া শেষ করে, তাহাও কি কম সাংঘাতিক! কখন কাহার অসাবধানতায় আগুন ছড়াইয়া সর্বনাশ উপস্থিত হয়, তাহার জন্য কতরকমে মানুষকে সতর্ক হইতে হয়। বড়ো-বড়ো শহরে দমকলের স্টেশন থাকে, আগুন নিভাইবার জন্য কত লোকলস্কর ও কতরকম আয়োজন রাখিতে হয়। বড়ো-বড়ো দমকল, যাহা হইতে জলের ফোয়ারা ছুটিয়। আগুনের মধ্যে গিয়া পড়ে; তিনতলা চারতলার সমান লম্বা লম্বা মই, যাহাকে দুরবীনের মতো গুটাইয়া রাখা যায়; আর বড়ো-বড়ো মোটর বা ঘোড়ার গাড়ি, যাহাতে আগুনের জায়গায় চট‌্‌পট্ ছুটিয়া যাওয়া যায়; আর আগুন লাগিলে পর আগুনের আফিসে তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছাইবার জন্য নানারকম ব্যবস্থা। টেলিফোনের আফিসে একটিবার ‘ফায়ার!' (Fire) বলিয়া খবর দাও, অমনি মুহুর্তের মধ্যে আগুনস্টেশনের সাড়া শুনিবে—“কোথায় আগুন?” বাস্। এক মিনিটের মধ্যে ঢং ঢং শব্দে দমকল ছুটিয়া বাহির হইবে। সে শব্দ শুনিলে রাস্তার গাড়ি ঘোড়া মোটর সাইকেল সব শশব্যস্ত হইয়া পথ ছাড়িয়া দেয়। যারা আগুনের পল্টনে কাজ করে, তাহাদের শিক্ষা এবং সাহস দুই দরকার। ইউরোপ ও আমেরিকায় ইহাদের বীরত্বের অনেক আশ্চর্য কাহিনী শুনিতে পাওয়া যায়।

 বড়ো-বড়ো আগুনের দৃশ্য একদিকে যেমন ভয়ানক, আর একদিকে তেমনি সুন্দর। আগুনে শহর বাড়ি পুড়াইয়া কত মানুষের সর্বনাশ করে, তাহাতে মানুষ হাহাকার করে আবার সেই আগুনেরই প্রচণ্ড গম্ভীর তেজ দেখিয়া বিস্ময়ে মানুষ অবাক হইয়া থাকে। এমডেন (Emden) নামে জার্মানদের একটা যুদ্ধ জাহাজ কয়েকদিন বঙ্গোপসাগরে ভারি উৎপাত করিয়াছিল। সেই জাহাজের একটা গোলা মান্দ্রাজের একটা প্রকাণ্ড কেরোসিনের চৌবাচ্চায় পড়িয়া সমুদ্রের ধারে যে অগ্নিকাণ্ড লাগাইয়াছিল 'তামাশা' হিসাবে সে দৃশ্য নাকি অতি চমৎকার হইয়াছিল! আর কেরোসিনের জন্ম যেখানে যেখানে ব্যবসার জন্য খনি খুঁড়িয়া, কুয়া বসাইয়া, কেরোসিনের হ্রদ বিল ও কেরোসিনের ফোয়ারার সৃষ্টি করা হয় সেখানে যখন আগুন ধরিয়া যায়, আর লক্ষ লক্ষ মণ কেরোসিন ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতে থাকে তখন ব্যাপারটি যে কেমন হয়, তাহার আর বর্ণনা হয় না। পেটুক আগুন তখন মনের মতো খোরাক পাইয়া উল্লাসে লক্ষ লক্ষ জিভ মেলিয়া ধোয়ার হুংকার ছাড়িয়া স্বর্গ মর্ত গ্রাস করিতে চায়। তাহার কাছে লঙ্কাকাণ্ডই-বা কি আর খাণ্ডবদাহনই-বা লাগে কোথায়।

সন্দেশ—অগ্রহায়ণ, ১৩২৫