সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/লাইব্রেরি
(পৃ. ২৩৩-২৩৫)
লাইব্রেরি মানে পুস্তকাগার বা কেতাবখানা-অর্থাৎ যেখানে বই রাখা হয়। আজকাল আমাদের দেশে শহরে গ্রামে নানা জায়গায় ছোটো-বড়ো নানারকম লাইব্রেরি দেখা দিয়েছে, সুতরাং লাইব্রেরি জিনিসটা যে কিরকম সেটা আর কাউকে বুঝিয়ে দেবার দরকার নাই।
পৃথিবীর বড়ো-বড়ো লাইব্রেরির নাম করতে গেলে লণ্ডনের রৃটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরির নামটা নিশ্চয় করা উচিত। এই লাইবেরিতে সকল দেশের সকল সময়ের এবং সকলরকমের বই সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। আসিরিয়া বা অসুর দেশের রাজা অসুর-বানিপালের আড়াইহাজার বছরের পুরানো লাইব্রেরি খুঁড়ে সেখান থেকে প্রায় বিশহাজার ইটের পুঁথি এখানে এনে রাখা হয়েছে। তাতে তীরের ফলকের মতো খোচা-খোঁচা সব অক্ষর; সেই অক্ষর বুঝবার জন্য কত বড়ো-বড়ো পণ্ডিতকে কত বছরের পর বছর ভাবতে হয়েছে। তাতে আসিরিয়া দেশের জ্যোতিষ পুরাণ ইতিহাস আইন আর ধর্মকর্মের কথা আছে, গল্পের বই কবিতার বই আছে, এমন-কি, লাইব্রেরির ক্যাটালগ বা বইয়ের ফর্দ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে। তার চাইতেও অনেক পুরাতন পুঁথি কিছু কিছু আছে, সেগুলি বেবিলনিয়ার ভাষায় লেখা। তার মধ্যে একখানা পুঁথি প্রায় হাজার বছর আগেকার। পেপিরস গাছের নরম হালের উপর ছবির অক্ষরে লেখা ইজিপ্টের পুঁখিও সেখানে অনেক আছে।
ভারতবর্ষের নানান ভাষার পুঁথি, যে-ভাষা এখন কেউ পড়তে পারে না সেই-সব অজানা ভাষার পুঁথি, চীনেদের হিজিবিজি অক্ষরের সেই আদ্যিকালের পুঁথি, আফ্রিকা আমেরিকার অদ্ভুত ভাষার পুঁথি, পাথরে খোদাই করা পুঁথি, তামা লোহা ইঁট কাঠের পুঁথি, কাগজ কাপড় রেশম পশম চামড়া বাকলের পুঁথি, হাতের লেখা হাজার হাজার পুঁথি, আর লক্ষ লক্ষ ছাপানো পুঁথি—ঐ এক লাইব্রেরির মধ্যে এই-সমস্ত জিনিস পাওয়া যায়। লাইব্রেরিতে যে বইয়ের ফর্দ রয়েছে সেই ফর্দ লিখবার জন্যই প্রায় দেড়হাজার প্রকাণ্ড বড়ো-বড়ো খাতার দরকার হয়েছে।
এই লাইব্রেরিতে পড়বার জন্য পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ থেকে বড়ো-বড়ো পণ্ডিতেরা পড়বার ঘরে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করেন। তাঁদের দরকার মতো বই, বলবামাত্র চট্পট্ এনে দেবার জন্য দু-তিনশো কেরাণী কর্মচারী সমস্তক্ষণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বৃটিশ মিউজিয়াম লাইব্রেরি প্রায় দুশো বছরের পুরানো। অক্সফোর্ডের বড়লিয়ান লাইব্রেরির বয়স প্রায় পাঁচশো বছর। তার আটলক্ষ ছাপানো বই আর একচশ্লিশ হাজার হাতের লেখা পুঁথির মধ্যে এমন অনেক জিনিস আছে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। বিশেষত প্রথম যখন মুদ্রাযন্ত্র হয়, সেই সময়কার ছাপানো বইয়ের এমন চমৎকার সংগ্রহ আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। পারিসের জাতীয় লাইব্রেরি (Bibliotheque Nationale) কেবল যে বয়সে সাত-আটশো বৎসর তা নয়, তার আয়তনও লণ্ডনের লাইব্রেরির চাইতে বেশি ছাড়া কম নয়। এই লাইব্রেরিতে প্রায় ত্রিশলক্ষ ছাপানো বই, হাতের লেখা একলক্ষ পুঁথি, আড়াইলক্ষ মানচিত্র আর দশলক্ষ ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে। পুবদেশীয় প্রাচীন পুঁথির অর্থাৎ এশিয়ার নানা অঞ্চলের পুঁথির নানারকম দৃষ্টান্ত এখানে যেমন আছে, পৃথিবীর আর কোথাও তেমন নাই।
কিন্তু লাইব্রেরির চূড়ান্ত কাণ্ড যদি দেখতে হয় তবে আমেরিকায় যাওয়া দরকার। সেখানে ঠিক বৃটিশ মিউজিয়াম বা পারিস্ লাইব্রেরির মতো অত বড়ো লাইব্রেরি না থাকতে পারে কিন্তু যেগুলি আছে সেগুলিও বড়ো সামান্য নয়। আর তাদের বন্দোবস্ত এমন চমৎকার যে পৃথিবীর আর কোথাও তেমন সুন্দর ব্যবস্থা দেখা যায় না। লাইব্রেরি যত বড়োই হোক বইয়ের সংখ্যা দশলাখই হোক কি বিশলাখই হোক যে-কোনো বই চাইবামাত্র ঠিক দু-মিনিটের মধ্যে যদি হাজির না হয় তবেই লাইব্রেরির দুর্নামের কারণ হয়। বই পেতে হলে কেবল তার নাম কিংবা নম্বরটি জানাতে হয়। অমনি লাইব্রেরিতে টেলিফোন করে দেয় আর দেখতে দেখতে তারের গাড়ি চড়ে বই এসে পড়বার ঘরে হাজির হয়। আমেরিকা কুবেরের দেশ, লক্ষপতি ক্রোড়পতি মহাজনের দেশ। লাইব্রেরির জন্য সেদেশে টাকার অভাব হয় না। সাধারণ লোকের ব্যবহারের জন্য আমেরিকার যুক্তরাজ্যে যে-সব বড়ো-বড়ো লাইব্রেরি আছে তেমন লাইব্রেরি পৃথিবীর আর কোথাও নাই। বস্টন পাবলিক লাইব্রেরিতে লোকে টাকা জমা দিয়ে বই পড়তে নেয়। এইরকমে প্রতিদিন কত বই আসছে যাচ্ছে বই-বিলির খাতায় তার হিসাব থাকে। সেই হিসাবে দেখা যায় যে এক বৎসরে পনেরেলক্ষ বার সেখানে বই বিলি করা হয়েছে।
পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে জঁকাল লাইব্রেরি হচ্ছে আমেরিকান কংগ্রেস লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির বাড়িটার জন্যই সওয়া দুকোটি টাকা খরচ হয়েছে। লাইব্রেরিতে চল্লিশ লক্ষ বই রাখার মতো জায়গা রয়েছে। লাইব্রেরির তদ্বিরের জন্য প্রতি বৎসর দশ-বিশ লাখ টাকা মঞ্জুর করা হয়। ঘর বাড়ি আলমারি আসবাবপত্র সব এমনভাবে তৈরি যে আগুনে ভূমিকম্পে ঝড় বিদ্যুতে তার কোনো অনিষ্ট করতে পারে না। এমন-কি, বইগুলো যাতে পোকায় না কাটতে পারে তার জন্য মোটা মোটা মাইনে দিয়ে লোক রাখা হয়—তাদের কাজ হচ্ছে কেবল পোকা ধ্বংস করবার জন্য নানারকম ব্যবস্থা করা।
একালের মতো প্রাচীনকালেরও অনেক বড়ো লাইব্রেরির নাম শোনা যায়। অসুরবানি-পালের লাইব্রেরি আর বেবিলনিয়ার কথা আগেই বলা হয়েছে। তার চাইতেও আধুনিক সময়ে অর্থাৎ প্রায় দুহাজার বছর আগে গ্রীকদের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির নাম খুব শোনা যেত।
এই লাইব্রেরির উপর রাজাদের খুব অনুগ্রহ ছিল, তারা নানারকমে তার সাহায্য করতেন। বিদেশী জাহাজে যদি কখনো পুঁথি পাওয়া যেত, তা হলে সেই পুঁথিগুলো রেখে তার নকল দিয়ে জাহাজকে বিদায় করা হত। ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে নানা দেশ থেকে নানারকমের পুঁথি নিয়ে আসা হত। এথেন্সে দুর্ভিক্ষের সময়ে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে শস্য জোগানো হয়েছিল এবং তার দাম হিসাবে এথেন্সের ভালো ভালো সরকারি বই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিতে ভর্তি করা হয়েছিল। গ্রীকদের এই লাইব্রেরিটির সঙ্গে রোমানদের পার্গেমাম লাইব্রেরির ভারি রেষারেষি ছিল। রোমানরা তাদের লাইব্রেরি বাড়াবার জন্য লোকের উপর অত্যাচার করত, জবরদস্তি করে যার তার পুঁথি কেড়ে নিয়ে যেত, এমন-কি, গ্রীকদের লাইব্রেরি থেকে লোক ভাগিয়ে নেবার জন্য সর্বদাই চেষ্টা করত।
সে সময়ে কাগজের সৃষ্টি হয় নি, খালি পেপিরসের ছালকে পিটিয়ে লম্বা লম্বা রোল বা থান তৈরি হত। সেইগুলোতে লিখে লাটাইয়ের মতো গুটিয়ে লাইব্রেরিতে বই বলে জমা করা হত। রোমানদের জব্দ করবার জন্য গ্রীকেরা এই পেপিরসের চালান বন্ধ করে দেয়। রোমানরা তখন অনেক চেষ্টা করে চামড়া থেকে একরকম পাতলা কাগজের মতো জিনিস (পার্চমেণ্ট) তৈরি করে, তাই দিয়ে পুঁথি বানাতে শেখে।