সুকুমার রায় সমগ্র রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড)/নানা নিবন্ধ/সূর্যের রাজ্য
(পৃ. ২৯৩-২৯৬)
সূর্য নানারকমে আমাদের পৃথিবীর উপর কর্তৃত্ব করে। পৃথিবীর গতির একটা কেমন ঝোঁক আছে, সে যদি কোনোরকম সুবিধা পাইত তবে নিশ্চয়ই ছুটিয়া পথছাড়া হইয়া কোথায় সরিয়া পড়িত। কিন্তু তাহা হইবার জো নাই; সুর্যের আকর্ষণীশক্তি তাহাকে বেশ মজবুত করিয়া টানিয়া রাখিয়াছে এবং পৃথিবীও অগত্যা বাধ্য হইয়া সূর্যের চারিদিকে ঘোরপাক খাইতেছে। পৃথিবী ছাড়া আরো কতকগুলি প্রকাণ্ড গোলক সুর্যের চারিদিকে ঘুরিতেছে। এইগুলিকে গ্রহ বলে। এই গ্রহগুলির মধ্যে আবার কয়েকটির সঙ্গী বা উপগ্রহ আছে। এই উপগ্রহগুলির কাজ গ্রহের চারিদিকে ঘোরা। যেমন পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ। এই-সকল গ্রহ, উপগ্রহ এবং অনেক উল্কা ও ধূমকেতু ইত্যাদি লইয়া সূর্যের রাজ্য।
রাজ্যের কর্তা সূর্য; সুতরাং তাহার খবরটা আগে লওয়া আবশ্যক। আমরা এখান হইতে সূর্যকে একটা উজ্জ্বল গোলার মতো দেখি। আর সেটা যে নিতান্ত ঠাণ্ডা নয়, তাহাও বেশ বুঝিতে পারি। সূর্য এখান হইতে নয় কোটি মাইলেরও বেশি দূরে। কিন্তু এত বড়ো সংখ্যা আমাদের কল্পনায় আসে না। আলো এত দ্রুত চলে যে, এক সেকেণ্ডে সাতবার পৃথিবীর চারিদিকে পাক দিয়া আসিতে পারে। কিন্তু তবু সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসিতে সাড়ে সাত মিনিট সময় লাগে। সুর্যটা যে খুবই মস্ত, তাহা না বলিলেও চলে। তেরো লক্ষটা পৃথিবী একত্র করিলে তবে সূর্যের সমান বড়ো একটা গোলক তৈয়ারি হইতে পারে।
আমরা সূর্যের যতটুকু দেখি, উহাই তাহার সমস্ত নহে। উহা ছাড়া তাহার চর্তুদিকে জ্বলন্ত বাষ্পের একটা আবরণ বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়া আছে। কিন্তু সেটা তত উজ্জ্বল নহে বলিয়া সুর্যের প্রখর তেজে আমরা তাহার কিছুই দেখিতে পাই না। সূর্যের যখন পূর্ণ গ্রহণ হয়, অর্থাৎ চন্দ্র যখন সুর্যের ও আমাদের পৃথিবীর মাঝে আসিয়া সুর্যকে একেবারে ঢাকিয়া ফেলে, তখন এই বাষ্পীয় আবরণ অতি চমৎকার দেখায়। এইজন্যে জ্যোতির্বিদ পণ্ডিতেরা পূর্ণগ্রহণ দেখিবার সুযোগ ছাড়েন না। আজকাল বর্ণবীক্ষণ যন্ত্রের (Spectoscope) সাহায্যে দিবালোকেই এ-সকল বিষয়ের চর্চা করা সম্ভব হইয়াছে। সূর্য যেরূপ প্রচণ্ড তেজে জ্বলিতেছে, তাহা আমাদের কল্পনা করা অসম্ভব। তাহার গরমের তুলনায় আমাদের কয়লার আগুন তো ঠাণ্ড। সেখানে আগুনের ঝড় ঘূর্ণীপাকের মতো অনবরত ঘুরিতেছে। সেই ফুটন্ত সমুদ্র তোলপাড় করিয়া অবিশ্রান্ত অগ্নিপ্রবাহ চলিতেছে। জ্বলন্ত শিখা চারিদিকে রক্তজিহ্বার ন্যায় লাফাইয়া উঠিতেছে এবং দেখিতে দেখিতে শতসহস্র মাইল ছড়াইয়া পড়িতেছে।
প্রধান গ্রহের সংখ্যা আটটি; চারিটি বড়ো, আর চারিটি ছোটো। আমাদের পৃথিবী কনিষ্ঠ গ্রহের মধ্যে গণ্য। সূর্যের নিকটতম গ্রহের নাম বুধ, তাহার পর শুক্র, তাহার পরে পৃথিবী, তাহার পরে মঙ্গল—এই চারিটিই ছোটো গ্রহ। ইহার মধ্যে পৃথিবীই সর্বাপেক্ষা বড়ো; শুক্র প্রায় পৃথিবীর সমান, মঙ্গল পৃথিবীর আট ভাগের এক ভাগ এবং বুধ পৃথিবী ও চন্দ্রের মাঝামাঝি। মঙ্গল সকল সময় সূর্যের কাছে কাছেই ফিরে সুতরাং তাহার সাক্ষাৎ পাওয়া সচরাচর ঘটে না। শুক্র অথবা শুকতারা যখন সর্যোদয়ের পর্বে পৰ্বদিকে অথবা সর্যাস্তের পর পশ্চিমদিকে ঝলমল করিতে থাকে তখন তাহার উজ্জ্বল জ্যোতির কাছে সকল গ্রহ নক্ষতই ম্লান বোধ হয়। শুধু চোখে মঙ্গল গ্রহকে একটা লালচে রঙের তারার মতো বোধ হয়। এই গ্রহের সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য কথা জানিবার আছে। ইহার উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর কাছে সাদা বরফ দেখা যায় এবং সেই বরফ গ্রীষ্মকালে কমে ও শীতকালে বাড়ে সুতরাং মঙ্গলে জল আছে, এ কথা স্বীকার করা যাইতে পারে। তাহা ছাড়া এই গ্রহের গায়ে খুব সরু সোজা সোজা লম্বা লম্বা অনেক দাগ দেখা যায়। এই দাগগুলি এলোমেলোভাবে ছড়ান নাই। বরং ইহা দেখিয়া স্বভাবতই মনে হয়, ঐ লম্বা রাস্তার মতো জিনিসগুলি ইচ্ছাপূর্বক বুদ্ধি খাটাইয়া নির্মাণ করা হইয়াছে। ইহা হইতে অনেকে অনুমান করিতেছেন যে, মঙ্গলে বুদ্ধিমান জীব থাকা সম্ভব, হয়তো তাঁহারা জলের সুবন্দোবস্তের জন্য বড়ো-বড়ো খাল কাটিয়াছেন, সেই খালের দুধারে গাছপালা হওয়ায় আমরা সেগুলিকে লম্বা লম্বা রেখার মতো দেখি। মঙ্গলের দুটি চাঁদ আছে, সেগুলি এতই ছোটো যে, খুব বড়ো দূরবীক্ষণ ছাড়া তাহাদের দেখাই যায় না। ইহার একটি এত তাড়াতাড়ি মঙ্গলের চারিদিকে ঘুরিয়া আসে যে, মঙ্গলের এক দিনে (সাড়ে চব্বিশ ঘণ্টায়) তাহার দুইবার উদয় ও দুইবার অস্ত হয়। মঙ্গলের পর অনেকগুলি খুব ছোটো ছোটো গ্রহ আছে, সেগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য নহে। এই গ্রহগুলির পরেই বৃহস্পতি।
বৃহস্পতি ইহাদের মধ্যে প্রধান। ইহার আয়তন প্রায় সাড়ে বারোশত পৃথিবীর সমান। এ পর্যন্ত ইহার সাতটি চাঁদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু সাধারণ দুরবীক্ষণে চারিটির বেশি দেখা যায় না। এই চারিটি চন্দ্রই আমাদের চাঁদের চাইতে বড়ো। বৃহস্পতি খুব বড়ো হইলেও এত তাড়াতাড়ি ঘুরে যে, প্রায় দশ ঘণ্টায় তাহার একদিন হয়। এত তাড়াতাড়ি ঘোরার দরুন তাহার মাঝখানটা বেশ ফুলিয়া উঠিয়াছে, সুতরাং বৃহস্পতিকে গোল না দেখাইয়া কতকটা বাদামী ধরনের দেখায়। বৃহস্পতির গায়ে সকল সময়েই কালো মেঘের মতো টান দেখা যায়।
বৃহস্পতির পরেই শনি। ইহা আয়তনে বৃহস্পতির অর্ধেক। এই গ্রহের একটা আশ্চর্য বিশেষত্ব এই যে, ইহার চারিদিকে একটা আংটির মতো কি দেখা যায়। আংটিটা বেশি পুরু নয়, কিন্তু খুব চওড়া। ভালো দূরবীক্ষণ দিয়া দেখিলে দেখা যায়, আংটিটার মাঝে মাঝে ফাঁক আছে, যেন কয়েকটা আংটি পর পর একটার ভিতর আরেকটা সাজানো রহিয়াছে। এ পর্যন্ত ইহার দশটি উপগ্রহ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার মধ্যে কয়েকটি আমাদের চন্দ্রের অপেক্ষাও বড়ো।
এ পর্যন্ত যে গ্রহগুলির কথা বলা হইল, ইহার সকলগুলিই শুধু চোখে বেশ উজ্জ্বল দেখায়। সেইজন্য অতি পুরাতন কাল হইতেই মানুষ ইহাদের কথা জানে। ১৭৮১ খৃস্টাব্দে সার্ উইলিয়াম হার্শেল তাঁহার স্বহস্তনির্মিত দূরবীক্ষণের সাহায্যে এক নুতন গ্রহ আবিষ্কার করেন। তাহার নাম রাখা হইল ইউরেনাস্। ইউরেনাস্ আয়তনে শনি অপেক্ষা ছোটো এবং এ পর্যন্ত ইহার চারটি চন্দ্র আছে বলিয়া জানা গিয়াছে।
ইউরেনাসের আবিষ্কারের পর দেখা গেল যে, তাহার গতিবিধির মধ্যে একটা কেমন গোলমাল আছে। গণনার যে সময়ে ইউরেনাসের যে স্থানে থাকিবার কথা, উহা ঠিক স্থানে থাকে না। ইহা হইতেই গণনা করিয়া দুইজন পণ্ডিত সিদ্ধান্ত করিলেন যে, ইউরেনাসের বাহিরে এক গ্রহ আছে, তাহারই আকর্ষণে ইহার চলাফিরার এরূপ ব্যতিক্রম হয়। তাহারা গণিতের সাহায্যে নির্দেশ করিলেন যে, অমুক দিন, অমুক স্থানে দূরবীক্ষণ দিয়া খুঁজিলে গ্রহটিকে পাওয়া যাইবে। এইরূপে নেপচুনের আবিষ্কার হইল। নেপচুনের আয়তন ইউরেনাসের মতো। ইহার একটি চাঁদ আছে। এই-সকল গ্রহ উপগ্রহ ছাড়া সূর্যরাজ্যে কতকগুলি ধূমকেতু ও উল্কারাশি আছে। এই ধুমকেতুগুলির চালচলন দেখিয়া বোধ হয় যে, ইহারা বাস্তবিক এ রাজ্যের লোক নয়। বাহির হইতে আসিয়াছিল, এই রাজ্যের ভিতর দিয়া যাইতে গিয়া কি করিয়া সূর্যের টানে ধরা পড়িয়াছে। প্রতি বৎসরই কত ধূমকেতু সূর্যের রাজ্যের মধ্য দিয়া চলিয়া যায়, তাহারা অধিকাংশ সহজেই সূর্যের হাত এড়াইয়া যায়, খালি কখনো দু-এক বেচারা নিতান্ত বেগতিকে কোনো গ্রহের কাছে গিয়া পড়ায় আর সামলাইয়া উঠিতে পারে না। তখন তাহারা বাধ্য হইয়া সুর্যের চারিদিকে ঘুরিতে থাকে।
সুর্য হইতে নেপচুনের দূরত্ব পৃথিবী হইতে সূর্যের দূরত্বের একত্রিশ গুণ এবং সেই সুদূর প্রদেশেই এ রাজ্যের সীমা।