সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/দেন্মার্কীয় যুবরাজ হামলেত্‌

R. D. SORONKAR, ENGR
১৪৫

হামলেত্‌।

সেক্‌সপিয়র।


দেন্মার্কীয় যুবরাজ হাম্‌লেত।


 দেন্মার্ক দেশে হাম্‌লেত নামা এক নরপতি ছিলেন। তাঁহার অকালে কালধর্ম্ম প্রাপ্তি হইলে রাজমহিষী শোক সন্তাপ না করিয়া দুই মাসাভ্যন্তরে দেবরের গলে বরমাল্য প্রদান পূর্ব্বক তদীয় পুনর্ভূ হইলেন। রাণীর প্রণয় ভাজন দেবর স্বামির সমান সুশ্রী বা সুজন ছিল না। তাহার কুৎসিতাকৃতির ন্যায় নীচাশয়তা নানা বিষয়ে নিরন্তর প্রকাশমান হইত। অপর মহীপতির মৃত্যুর পরে রাজ্যমধ্যে এই জনাপবাদ হইয়াছিল যে ঐ ব্যক্তি মৃত ভূপতির পত্নীর পাণিগ্রহণ এবং রাজার উত্তরাধিকারি কুমার হাম্‌লেতের অধিকার নিরাকরণ পুরঃসর স্বয়ং সিংহাসনাধিরোহণ মানসে গোপনে ভূপতির প্রাণ সংহার করিয়াছে। অতএব পতি বিয়োগের অনতিবিলম্বে তাহার অঙ্কলক্ষ্মী হওয়াতে নৃপরমণীর চরিত্রে কলঙ্ক ও লোক সমাজে যৎপরোনাস্তি অপযশঃ হইল।

 রাজকুমার অতি সুশীল সদাচার বিশেষতঃ ধর্ম্মনিষ্ঠ ছিলেন এবং পিতার প্রতি সাতিশয় ভক্তিমান্ থাকাতে সর্ব্বদা দেববৎ জনকের স্মরণ করিতেন। মাতার এই অবিজ্ঞতাচরণ দর্শন করিয়া মনোমধ্যে সাতিশয় খিন্ন হইতে লাগিলেন। জনকের অকাল মৃত্যু জন্য পরিতাপ এবং জননীর পরিণয় জনিত লজ্জায় অবসন্ন হওয়াতে তাঁহার দৈহিক মানসিক স্ফূর্ত্তি একেবারে বিলীন হইয়া গেল। যৌবন কালের ক্রীড়া কৌতুকে তদীয় মানস নিরুৎসুক হইল এবং শাস্ত্রালোচন অথবা অন্যপ্রকার সচ্চিন্তনেও চিত্তের অপ্রবৃত্তি হইতে লাগিল। অপর সংসার তত্ত্ব বিচারে তৎপ্রতি মহতী ঘৃণা জন্মিল সুতরাং সংসারাশ্রম জীবিতাবস্থার সুখোদ্যান জ্ঞান না করিয়া ক্লেশকর কানন ও তত্রস্থ বিষয় নিকর সুরম্য কুসুমের সদৃশ সুখকর না জানিয়া অরণ্য তৃণ তুল্য জঘন্য বোধ করিলেন। তরুণ রাজনন্দন দিগের অন্তঃকরণ ক্রমাগত রাজ্যাধিকার ভ্রংশ হইবার সম্ভাবনা দেখিলে গুরুতর ক্ষতিবোধে মহা বিষণ্ণ এবং অপমান জ্ঞানে নিরন্তর চিন্তাকুল হইয়া থাকে যুবা হামলেতও জননীর পাণিগ্রাহি পিতৃব্য দ্বারা পৈতৃক রাজত্বে পরিভ্রষ্ট হইবার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হইতে পারিতেন। কিন্তু প্রসূতির তাতপ্রতি অসদ্ব্যবহারে যাদৃশ ক্ষোভ প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন রাজ্যাধিকার বিনাশের ভাবনায় তাদৃশ ভাবিত হইলেন না। বিমনা হইয়া সাশ্চর্য্যচিত্তে নিয়ত কেবল এই চিন্তা করিতে লাগিলেন জনক জীবদ্দশায় জননীর প্রতি স্নেহবান্‌ ছিলেন এবং নিরন্তর সদ্ব্যবহার করিতেন মাতাও তৎকালে অনুরাগ বা প্রেমের নিদর্শন দর্শাইতে ক্রটি করেন নাই, কিন্তু এ কি চমৎকার ব্যাপার, পিতার মৃত্যুর পর এখনও দুই মাস অতীত হইল না, জননী ইতিমধ্যে তাঁহার সমুদয় প্রণয় ও সদ্ব্যবহার বিস্মৃতা হইয়া গেলেন। সম্বন্ধের সন্নিকর্ষ প্রযুক্ত যাহার সহিত পরিণয় যুক্তি বিরুদ্ধ ও শাস্ত্র নিষিদ্ধ, অবিলম্বে অবলীলাক্রমে তাহাকে বিবাহ করিলেন? ফলতঃ মহারাজ হামলেতের মৃত্যুর পর সাতিশয় ত্বরা সহকারে রাজ লক্ষণ বিহীন ব্যক্তিকে স্বামির সিংহাসন ও শয্যার অধিকারি করাতে নৃপ জায়ার যে অপযশঃ হয় তাহাতেই যুবরাজের অন্তঃকরণ যৎপরোনাস্তি পরিমান হইল এবং প্রসূতির অপ্রতিষ্ঠা রাজ্য বিনাশাপেক্ষা দশ গুণ দুঃখদায়ক হইয়া তাঁহাকে ব্যাকুল করিতে লাগিল।

 নৃপবনিতা এবং তদীয় পৌনর্ভব ভর্ত্তা ক্লাদিয়স্, কুমার হাম্‌লেতের শোকাবেগ নিবারণ নিমিত্ত নানা উপায় কল্পনা করিলেন। কিন্তু কিছুতেই রাজনন্দনের খিন্ন অন্তঃকরণ শান্ত হইল না। যুবরাজ মহারাজের আকস্মিক পরলোক প্রাপ্তি জন্য দুঃখে সতত সন্তাপিত রহিলেন, পিতার মৃত্যুর পর বিষাদ সূচক যে অসিত বসন পরিধান করেন নিরন্তর তাহাই ধারণ করিয়া থাকিলেন এবং সেই বেশেই রাজ সভায় যাতায়াত করিতে লাগিলেন। পিতৃব্যের সহিত জননীর পরিণয় দিবসে তাঁহার সম্ভ্রমার্থও সে পরিচ্ছদের পরিবর্ত্তন করিলেন না। রাণীর পুনর্ব্বার বিবাহোপলক্ষে মহা২ উৎসব হইল তাহাতে অনেকে গিয়া অমোদ আহ্লাদ করিলেন কিন্তু রাজতনয় ঐ ব্যাপার বিজাতীয় অপমান জনক জ্ঞান করিতে লাগিলেন সুতরাং তাহার সংস্রবেও গেলেন না।

 যুবরাজ জনকের অকস্মাৎ নিধন প্রাপ্তির কারণ নির্দ্দিষ্ট না হওয়াতেই সাতিশয় পরিতাপান্বিত হন্। রাজসহোদর ক্লাদিয়স্ রাজ্যমধ্যে জনরব করিয়া দিয়াছিল ভূপাল হাম্‌লেত ভুজঙ্গ দংশনে কৃতান্তের করাল দশনে পতিত হইলেন। কিন্তু রাজনন্দন তদ্বিষয়ে সন্দিহান হইয়া মনে২ বিতর্ক করিতে লাগিলেন বুঝি পিতৃব্যই খল সর্প, রাজ্যলোভে আমার জনককে দংশন করিয়াছেন। বস্তুতঃ জন প্রবাদানুসারে যে অহি মহীপাল হাম্‌লেতের জীবন বিনষ্ট করে সেই ব্যক্তিই রাজ বিয়োগানন্তর সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়।

 রাজকুমারের এই সন্দেহ জননীর ব্যবহার দর্শনে প্রগাঢ় হইতে লাগিল। তাঁহাকে দেবরের প্রতি অনুরক্তা দেখিয়া এক২ বার মনে করিলেন নৃপতির প্রাণ নাশের ষড়্‌যন্ত্রে ইহাঁরও যোগ থাকিবে। ফলতঃ এই বিষম ব্যাপার মাতার জ্ঞাতসার এবং তাঁহার সম্মতি ক্রমে ঘটিয়াছে কি না এই সংশয়ও কুমারের হৃদয়ে আস্পদ করিয়াছিল।

 কিয়দ্দিনানন্তর রাজনন্দন একটা কিম্বদন্তী শুনিলেন দুই তিন দিবস অবধি নিশীথ সময়ে নৃপসদনের সম্মুখ স্থিত মঞ্চে মৃত মহীপতির আকৃতি বিশিষ্ট এক ভূত আবির্ভূত হইতেছে এবং বিভাবরীর প্রহরিগণ প্রত্যক্ষ করিয়াছে যে লোকান্তরস্থ রাজা জীবদ্দশায় সর্ব্বদা যাদৃশ পরিচ্ছদ ধারণ করিতেন ঐ দেবযোনির অবিকল সেই সজ্জা। যে সকল ব্যক্তি ভূত দর্শন করিয়াছিল তাহাদের মধ্যে রাজতনয়ের হোরেসিও নামা এক জন প্রিয় মিত্র ছিলেন অতএব ঐ জনরবে নৃপকুমারের বিশ্বাস জন্মিল। অনন্তর দর্শকেরা জিজ্ঞাসিত হইয়া ভূতের আকৃতি প্রকৃতি এবং প্রকাশের সময় বর্ণনা করত কহিল দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি অতীত হইবামাত্র মঞ্চোপরি ভূতের আবির্ভাব হয়। তাহার বর্ণ চিক্কণ, লপন কোপাপেক্ষা চিন্তার লক্ষ্মে বিলক্ষণ লক্ষিত, শ্মশ্রু সাতিশয় ভয়ানক। ফলতঃ লোকান্তর প্রাপ্ত পৃথ্বীপাল জীবদ্দশায় যদ্রূপ অঙ্গ ভঙ্গি ও মানসিক ভাব প্রকাশ করিতেন আবির্ভূত ভূত অবিকৃত তদ্রূপ ভাব ভঙ্গি সম্পন্ন। আমরা তাহাকে কত প্রকার প্রশ্ন করিয়াছিলাম কিন্তু এক বিষয়েও উত্তর দিল না। বোধ হয় একবার যেন প্রতি বচন প্রদান নিমিত্ত মস্তক উত্তোলনের উপক্রম করিয়াছিল হঠাৎ সেই সময় কুক্কুটে প্রভাতীয় রব করাতে দ্রুতগতি প্রস্থান পূর্ব্বক দৃষ্টি পথের বহির্ভূত হইল।

 যুবরাজ দর্শকদিগের প্রমুখাৎ দেবযোনির বিবরণ শ্রবণ করিয়া অতিশয় চমৎকৃত হইলেন এবং মনো নিবেশ পুরঃসর তদ্বিষয়ের চিন্তা করত বিবিধ তর্ক বিতর্ক করিয়া মীমাংসা করিলেন প্রহরিদের দৃষ্ট পদার্থ আমার পিতার ছায়া বটে বোধ হয় তাঁহার কিছু জ্ঞাপ্তব্য থাকিবেক, অনর্থক আবির্ভাব হয় নাই, যাহা হউক অদ্য যামিনীযোগে প্রহরিগণ সমভিব্যাহারে প্রহরিতা করিয়া স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিতে হইল। অপর আপনা আপনি বিবেচনা করিলেন যদিও সেই অপচ্ছায় এপর্য্যন্ত কাহারো কথায় প্রত্যুক্তি করে নাই তথাপি আমি সন্তান, অপত্যস্নেহে আমার সহিত আলাপ করিতে পারেন অতএব রাত্রি আগমনের প্রতীক্ষায় অধৈর্য্য হইতে লাগিলেন।

 অনন্তর সর্ব্বরী সমাগত হইলে যুবরাজ হোরেসিও এবং মার্সেলস্ প্রহরির সমভিব্যাহারে প্রহরিতা করত ভূতের আবির্ভাব স্থানে গমন পূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। নিশায় শিশির পতন এবং প্রবল পবনের বহনে সাতিশয় ক্লেশানুভব হওয়াতে রাজকুমার সঙ্গিগণ সঙ্গে শীতলতার প্রসঙ্গে কথোপকথন করিতে আরম্ভ করিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে দেবযোনির ছায়া প্রকাশমানা হইল তাহাতে হোরেসিও নৃপনন্দনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন ঐ দেখ ভূত অসিতেছে সুতরাং তাহাদের অন্যালাপ স্থগিত হইল।

 রাজতনয় সমক্ষে প্রকাশমানা লোকান্তরস্থ পিতার ছায়া অবলোকনে বিস্ময় ও সন্ত্রাসে ক্ষণকাল ব্যাকুল হইলেন এবং উপস্থিত আকৃতি সৎ বা অসৎ, শ্রেয় বা অশ্রেয়ের লক্ষণ, এতন্নির্ণয় করণে অক্ষমতা প্রযুক্ত ঈশ্বরীয় দূত ও স্বর্গীয় কর্ম্মচারিদিগের স্তব করত আত্ম রক্ষার প্রার্থনা করিতে লাগিলেন কিন্তু বারম্বার অনিমিষ নয়নে নিরীক্ষণ করাতে ক্রমে তাঁহার ভীতি নিরাকৃত ও সাহস সঞ্জাত হইল। অনতিবিলম্বে বোধ করিলেন দেবযোনি যেন দয়া দৃষ্টি বিস্তার করিতেছে এবং তাঁহার সহিত স্নিগ্ধালাপ করিতে যেন সমুৎসুক। রাজকুমার দেবযোনির ছায়ায় জনকের অনুরূপ আকার এবং স্নেহ ও কারুণ্যের লক্ষণ প্রত্যক্ষ করিয়া সাহসে নির্ভর করত আপনার বক্তব্য ব্যক্ত করিবার উপক্রম করিলেন এবং পরম ভক্তিভাবে বিনয়গর্ব্ভ এই বাক্য কহিতে লাগিলেন হে পিতঃ মহারাজ হাম্‌লেত, আপনকার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া যথাবিধি সম্পন্ন হইলেও আপনি কি পৃথিবীর কৌতুক ও নিশাকরের কর অবলোকন নিমিত্ত পুনর্ব্বার শ্মশান হইতে গাত্রোত্থান করিয়াছেন? আপনকার আত্মার সুস্থিরতা নিমিত্ত কর্ত্তব্য কর্ম্মের যদিস্যাৎ কিঞ্চিৎ অবশেষ থাকে আজ্ঞা করুন। দেবযোনি যুবরাজের এতদ্বচন শ্রবণে প্রীতি প্রকাশ পুরঃসর কর প্রসারণ করিয়া সঙ্কেত করিলেন আমরা দুই জন নির্জনে কথোপকথন নিমিত্ত স্থানান্তরে যাই চল। কুমার অভিনয় দর্শনে ভূতের অভিপ্রায় বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ একাকী তাহার অনুবর্ত্তী হইতে প্রবৃত্ত হইলেন তাহাতে সমভিব্যাহারী মিত্র হোরেসিও এবং প্রহরী মার্সেলস্ নিবারণ করত তাঁহার হস্ত ধারণ করিল এবং ভয় প্রদর্শন পুরঃসর কহিতে লাগিল ভূতযোনি বিশ্বাস্য নয়, দুর্জ্জনতা পুর্ব্বক নিকটবর্ত্তি সাগর নীরে নিমগ্ন অথবা ভয়ঙ্কর ভৃগু হইতে নিক্ষেপ করিয়া অজ্ঞান করিতে পারে অতএব একাকী ইহার সহিত গমন করিও না। রাজনন্দন জননীর অসদাচরণ বিলোকনাবধি আপন জীবনে ঘৃণা করিতেন সুতরাং তদ্বিনাশের সম্ভাবনায় ভীত হইতেন না। অপর আত্মা অনশ্বর, ভূতে তাহার কোন ক্ষতি করিতে সমর্থ নহে স্বীয় বুদ্ধি ও বিবেক বলে এতদ্বিষয় নির্ণয় করিয়াছিলেন। অতএব সমভিব্যাহারি প্রহরিদের নিবারণ বচনে মনোনিবেশ করিলেন না। আপনার জিজ্ঞাসা নিবৃত্তি নিমিত্ত পুরুষসিংহের তুল্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইলেন। সঙ্গিরা অনিষ্টাশঙ্কায় ধারণ করিয়া রাখিবার চেষ্টা করিলে বলে তাহাদের হস্ত উন্মোচন পুরঃসর দেবযোনির পশ্চাৎ গমন করিলেন।

 আবির্ভূত ভূত কুমার সমভিব্যাহারে বিরল স্থান প্রাপ্ত হইলে আপনার মৌন ভঙ্গ করিয়া স্নেহান্বিত বচনে কহিতে লাগিল হে প্রিয় তনয়, আমি তোমার জনক, দেন্মার্কাধিপতি মৃত হাম্‌লেতের ছায়া, দুরাত্ম সোদরের নিষ্ঠুরতায় হত হইয়াছি, তাহার বিবরণ বর্ণন করি অবধান কর। হে পুত্র আমার প্রাণ বিয়োগের বিষয়ে তুমি যে সন্দেহ করিয়াছ তাহাই যথার্থ, তোমার পিতৃব্য ক্লাদিয়সই আমার জীবন বিনাশক। বৎস আমি জীবদ্দশায় অভ্যাসানুসারে এক দিন উদ্যানস্থ ভবনের শয়নাগারে অপরাহ্ণ সময়ে শয়ান হইয়া নিদ্রা যাইতেছিলাম আমার সুষুপ্তি দশা উপস্থিত হইলে সেই বিশ্বাসঘাতী পাপিষ্ঠ সহোদর বিষ লতার রস আনয়ন পূর্ব্বক আমার কর্ণ কুহরে নিক্ষেপ করে। বিষ রস মানব জীবনের মহা বৈরী, সুতরাং শ্রবণ রন্ধ্র যোগে শরীর মধ্যে প্রবেশ মাত্র পারদের গতির ন্যায় সমস্ত শিরায় সঞ্চারিত হইয়া শোণিত শোষণ করিয়াছিল। তাহাতে অবিলম্বে দেহের উপরিস্থ চর্ম্ম কুষ্ঠরোগাবির্ভাবের ন্যায় গলিত ও প্রাণ বিনির্গত হয়। আমার সহোদর সিংহাসন ও রাজ মহিষী পরিগ্রহ করণাশয়ে এই রূপে আমার জীবন বিনাশ করিয়াছে। অতএব হে পুত্র যদিস্যাৎ তোমার পিতৃভক্তি থাকে আমি তোমাকে দিব্য দিয়া কহিতেছি সেই দুরাত্মার জিঘাংসা কর। পরে খেদ প্রকাশ পুরঃসর কহিতে লাগিল বৎস তোমার জননীও সদাচারী নহে, তাহার ধর্ম্মাধর্ম্ম বোধ নাই, আমার সহিত প্রথম পরিণয়ের নিয়ম উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক মদীয় অসুবিনাশককে অক্ষোভে বিবাহ করিল। যাহা হউক হে বৎস সে তোমার মাতা পরম গুরু, তাহার শরীরে তুমি হস্ত উত্তোলন করিও না, তাহার নিজ ধর্ম্মই পরকালে সমুচিত দণ্ড বিধান করিবে। তুমি কেবল কৃতঘ্ন পিতৃব্যের দুরাচারের প্রতিক্রিয়ার্থ যত্ন কর। অনন্তর যুবরাজ লোকান্তরস্থ পিতার প্রতিকৃতির সন্নিধানে কৃতাঞ্জলি হইয়া প্রাণ পণে আজ্ঞাপালনাঙ্গীকার করিলে দেবযোনি তৎক্ষণাৎ তিরোহিত হইল।

 ভূত অন্তর্ধান করিলে যুবরাজ নির্জনেবসিয়া মনে২ বিবেচনা করিলেন পুস্তক পাঠে এবং দর্শনযোগে যে সকল বিষয়ের শিক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছি তাহা সর্ব্বদা স্মৃতিপথে আবির্ভূত হইলে ভূতের আদেশ পালনে যদি কোন ব্যাঘাত জন্মে অতএব সে সকল বিস্মরণ পূর্ব্বক কেবল দেব যোনির বচন ও নিদেশ মনোমধ্যে জাগরূক করিয়া রাখিব। অনন্তর সমভিব্যাহারি দিগের সন্নিধানে আগমন পূর্ব্বক আপনার প্রিয় মিত্র হোরেসিওকে গোপনে সমস্ত বিষয় কহিলেন। তদ্ব্যতীত অপর কেহই ভূতের বৃত্তান্ত জানিতে পারিল না। পরে মার্সেলস্ এবং হোরেসিও দুই জনকেই নিষেধ করিলেন অদ্য রাত্রিযোগে যে ব্যাপার হইল কাহার নিকট প্রকাশ করিও না।

 যুবরাজ হাম্‌লেতের চিত্ত পূর্ব্বাবধি ক্ষুণ্ণ ও বিকৃতিভাবাপন্ন ছিল, ভূত দর্শনের পর অধিক উদ্বেগান্বিত হইতে লাগিল। কিন্তু অন্তঃকরণের বৈক্লব্য অবলোকনে পাছে পিতৃব্য আপনার মানস জানিতে পারে এবং পিতার মৃত্যুর বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ যাহা প্রকাশ ছিল তদপেক্ষা অধিক বিবরণ অবগত হইবার কথা শুনিয়া পাছে সাবধান হয় এই নিমিত্ত মনে২ পরামর্শ করিয়া স্থির করিলেন আমি আপন মানসিক এই উদ্বেগ উন্মাদ রূপে প্রকাশ করি। ফলতঃ যদি উন্মত্তের তুল্য আচার ব্যবহার করি তাহা হইলে পিতৃহন্তা পিতৃব্য আমার মনস্থ অবগত হইতে পারিবেক না মনের চাঞ্চল্য কৃত্রিম উন্মাদে আচ্ছন্ন হইলে তজ্জন্য সন্দেহই জন্মিবেক না যদি হয় সামান্য ভাবে হইবেক।

 অতএব নৃপতনয় তৎকালাবধি বাতুলের বেশ ধারণ পুরঃসর তদ্রূপ আচার ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিলেন তাহাতে অপন সংকল্প সিদ্ধি করিয়া কৃতকার্য্য হইবার সম্ভাবনাও হইল কেননা ক্লাদিয়স্ ও নৃপজায়া ভূতের আবির্ভাব বৃত্তান্ত জানিতে পারে নাই সুতরাং জনকের অকালে করাল কাল করে নিপাত নিমিত্ত যুবরাজের শোকাবেগ এবং তজ্জন্য চিত্ত বিক্ষেপ অনুমান করিতে অক্ষম হইয়া মনে করিল কুমার কন্দর্প বাণে বিদ্ধ মনাঃ হইয়া প্রেম পীড়ায় পীড়িত হইয়াছেন।

 যুবরাজ হাম্‌লেত উক্ত প্রকারে উন্মত্তের আকার ধারণ করণের অগ্রে রাজমন্ত্রির পরম সুন্দরী ওফিলিয়া নাম্নী কন্যার সহিত প্রণয়াভিলাষী হইয়াছিলেন এবং সেই কামিনীর প্রতি প্রেমানুরাগ প্রকাশ পূর্ব্বক অঙ্গুরী প্রদান করিয়া সর্ব্বদা লিপি প্রেরণ করিতেন। মন্ত্রি কন্যাও কুমারের গুণে আকৃষ্ট মনা হইয়া অনুরাগিণী হন্ এবং বিবিধ প্রকারে আপনার প্রণয়চিহ্ণ প্রকাশ করেন সুতরাং তাঁহাদের পরস্পর পরিণয় অবধারিত হয়। কিন্তু কুমার যদবধি জনকের মৃত্যু বিবরণ অবগত হইলেন তদবধি শোকে ব্যাকুল হওয়াতে নায়িকা প্রণয় বিসর্জ্জন দিলেন এবং সেই সময় হইতে কামিনীর সহিত প্রণয়ি ব্যবহার না করিয়া বরং অসদাচরণ করিতে লাগিলেন। মন্ত্রি কন্যা অতিশয় গুণবতী এবং বুদ্ধি বিবেকে বিভূষিতা ছিলেন প্রণয়ির হঠাৎ এবম্বিধ ভাব অবলোকন করিয়া মনে করিলেন নৃপনন্দনের মনঃ অবশ্য অন্য কোন মানসিক ক্লেশে বিক্ষিপ্ত হইয়া থাকিবে যেহেতু তাল লয় বিহীন বাদ্য যাদৃশ কর্কশ ধ্বনি তুল্য বোধ হয় চিত্ত ক্ষোভ হেতু এক্ষণে প্রণয়ালাপও প্রিয়তমের শ্রবণপথে তদ্রূপ নীরসবৎ ভাসমান হইতেছে অতএব নায়কের এই অন্তঃকরণ বিকারে কারণান্তর থাকিবেক সুতরাং প্রণয়ির বিপরীত ব্যবহারে আপনি ক্ষুব্ধ হইলেন না এবং তাঁহাকেও কিছু অনুযোগ করিলেন না।

 নৃপনন্দন হাম্‌লেত সেই সময় পিতৃহন্তার প্রতি হিংসা করণার্থ ব্যস্ত সমস্ত থাকাতে যদিও প্রণয়িনীর সহিত সপ্রণয় ব্যবহার করিলেন না বরং অন্তঃকরণের উদ্বেগ জন্য কখন২ বিপরীতাচার করিতে লাগিলেন তথাপি কামিনীর প্রতি অনুরাগ তাঁহার অন্তর হইতে একেবারে অন্তর হইল না। শোকাবেগে অপ্রণয়ির কর্ম্ম করিয়া অব্যবহিত পরেই মনোমধ্যে অনুতাপ করিতেন রমণীর প্রতি অন্যায় অসদাচরণ বা কাঠিন্য ব্যবহার করিলাম। অতএব কৃত্রিম উন্মাদের অনুসারে অসঙ্গতার্থ শব্দ বিন্যাস পূর্ব্বক মধ্যে২ প্রণয়িনীর নিকট যে পত্র প্রেরণ করিতেন তাহাতে স্নেহ প্রকাশক দুই এক পদও থাকিত। যুবতী সেই লিপি দর্শনে আপন মনোমধ্যে প্রবোধ দিতে পারিতেন যুবরাজ তাঁহার প্রণয় বিস্মৃত হন নাই। রাজকুমার একবার প্রিয়তমার প্রতি লিপিযোগে এই প্রকার অসঙ্গতার্থ বাক্যে প্রেম প্রকাশ করেন যথা হে সুন্দরি নভোমণ্ডলোদ্দীপক নক্ষত্রমণ্ডল অনল পদার্থ কি না এবং দিবাকর ভ্রমণ করেন কি না অপর সত্য পদার্থ মিথ্যা কি না ঈদৃশ সংশয়কে আপন মনে স্থান দান করিও কিন্তু আমি তোমার প্রেমাসক্ত কি না এমত সন্দেহ যেন ত্বদীয় মানসে কদাপি স্থান প্রাপ্ত না হয়। মন্ত্রিসুতা ওফিলিয়া ঐ লিপি প্রাপ্ত হইয়া আপনার পিতাকে দেখাইলেন। মন্ত্রী তাহা রাজসদনে লইয়া গিয়া কৌতুক করত রাণী ও তদীয় নায়ক ক্লাদিয়সের জ্ঞাতসার করিলেন। অতএব তাঁহাদের দৃঢ় প্রতীতি হইল যুবরাজ হাম্‌লেত কেবল প্রেম পীড়ায় পীড়িত এবং তজ্জন্যই তাঁহার উন্মাদ। নৃপমহিষী মন্ত্রির প্রমুখাৎ শুনিয়া আহ্লাদ প্রকাশ করত কহিলেন ওফিলিয়ার রূপ লাবণ্য দর্শনে পুত্রের উন্মত্ততা হইয়া থাকিলে ভাল বটে পরিণয় হইলেই সন্তান সুস্থ হইবে এবং এ বিবাহে উভয়ের গৌরব আছে।

 কিন্তু যুবরাজের চিত্তবিক্ষোভ বাস্তবিক প্রেম পীড়ায় জন্মে নাই সুতরাং নৃপাঙ্গনা প্রতীকারের যে উপায় মনে করিলেন তাহাতে শান্তির সম্ভাবনা ছিল না। পিতৃভক্ত রাজতনয় জনকের আকার বিশিষ্ট দেবযোনির দর্শনাবধি তাহার আদেশে যে চিন্তায় চিন্তিত হন্ তাহাই তাঁহার অন্তঃকরণকে ব্যাকুল করিয়া রাখিয়া ছিল। যাবৎ পিতৃহন্তার প্রতিহিংসা না করিলেন তাবৎ মনের উদ্বেগ দূরীভূত হইল না। বরং যত কাল বিলম্ব হইতে লাগিল ততই পিত্রাজ্ঞায় অবজ্ঞা করিলাম বলিয়া পাপভয়ে সমধিক বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিলেন। জনকের বৈরি ক্লাদিয়স্ যখন বাহিরে বসিতেন তখন তদীয় শরীর রক্ষার নিমিত্ত প্রহরিগণ চতুর্দিকে দণ্ডায়মান থাকিত এবং অন্তঃপুরস্থ হইলে আপনার জননী নৃপমহিষী তাহার পার্শ্বে অবস্থিতি করিতেন সুতরাং কুমার পিতৃদ্বেষির অসু বিনাশ পূর্ব্বক বৈর নির্যাতন করিয়া সংকল্প সিদ্ধ করা সুযোগ বিরহে কঠিন কর্ম্ম জ্ঞান করিতে লাগিলেন। অপর যদিও ক্লাদিয়স্ তাঁহার পৈতৃক রাজ্যাধিকার বিনষ্ট করিয়াছিলেন তথাপি গর্ব্ভধারিণীর পৌনর্ভব ভর্ত্তা হওয়াতে সহসা সংকল্পিত সাধনে শঙ্কাও হইতে লাগিল বিশেষতঃ কোমল প্রকৃতি প্রযুক্ত একটা সহযোগি জীবের জীবন বিনাশ মহা ভয়ানক ও ঘৃণাকর বোধ হইল। ফলতঃ রাজনন্দন বহু দিবসাবধি পিতৃব্যের প্রতি সন্দিহান হইয়া ক্ষুণ্ণমনা ছিলেন বটে কিন্তু বিশেষ প্রমাণ কিছুই প্রাপ্ত হন্ নাই কেবল দেবযোনির প্রমুখাৎ তদ্বিবরণ শ্রবণ করিলেন। ভূতে সকল আকার ধারণ করিতে পারে তদ্বিষয় অবগত থাকাতে সেই অপচ্ছায় বস্তুতঃ জনকের ছায়া কিনা তাহাতেও সংশয় হইল সুতরাং কখন২ মনে করিলেন জন্মদাতার আকৃতি ধারণ পুরঃসর কোন ভূত বুঝি ঘোর প্রাণিহত্যার পাপে প্রবৃত্তি দিয়া গেল। অপর এক২ বার ঈদৃশী আশঙ্কা করিতে লাগিলেন দেবযোনির ছায়া দর্শন স্বপ্ন ও ভ্রান্তি যোগেও হইতে পারে অতএব পিতার আকৃতি ধারি ভূতের বিষয়ে সংশয়ান্বিত হইয়া অবশেষে নিদ্ধার্য্য করিলেন প্রবল প্রমাণ না পাইলে সংকল্পিত কার্য্য সমাধা করণে অগ্রসর হইব না।

 যুবরাজ আপনার কর্ত্তব্য বিষয়ে উক্ত প্রকার মত স্থির করিয়া কিঞ্চিৎ শান্ত হইলে কিয়দ্দিন পরে কতিপয় নট নাট্যক্রিয়া করিবার আশয়ে রাজসভায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কুমার সেই নটদিগের নাট্য ইতিপূর্ব্বে একবার অবলোকন করিয়াছিলেন। তাহাদের মধ্যে এক জন ত্রয় দেশের অধিপতি প্রায়েমের মৃত্যুর পর তদীয় মহিষীর শোক সন্তাপ অপূর্ব্ব ভাব ভঙ্গি সহকারে বক্ততা পূর্ব্বক যে অভিনয় করে তাঁহার স্মরণ পথে তাহা জাগরূক ছিল। অতএব পরিচিত চারণ গণের যথেষ্ট সমাদর করিয়া সেই নাট্যের পুনর্বার অভিনয় করিতে অনুরোধ করিলেন। সুশিক্ষিত নট রাজনন্দনের আদেশে অবিকল ভাব ভঙ্গি সহিত সেই নাট্যের অভিনয়ে প্রবৃত্ত হইল এবং ত্রয়ের প্রাচীন রাজা নিষ্ঠুরতা পূর্ব্বক নিহত ও প্রজাপুঞ্জ ছিন্ন ভিন্ন এবং অগ্নিদ্বারা নগর দাহ হইলে রাজমহিষী শোকে ব্যাকুল হইয়া যে প্রকারে বিলাপ করেন অর্থাৎ নৃপরমণী আপনার যে মস্তকে মহার্হ মণিময় মুকুট ধারণ করিতেন তাহাতে আচ্ছাদন মাত্র নিমিত্ত ছিন্ন বসন এবং যে কটিদেশে রাজপরিচ্ছদ অহর্নিশ শোভা পাইত তাহাতে জীর্ণ এক খণ্ড কম্বল মাত্র অর্পণ পূর্ব্বক রিক্ত পদে প্রাসাদের নিম্নদেশে অবিশ্রান্ত পর্য্যটন করত যদ্রূপে শোক প্রকাশ করেন তাহা আশ্চর্য্য প্রকারে অভিনয় করিয়া দেখাইল। নটের ভাব ভঙ্গি দর্শনে দর্শক গণের অনুভব হইতে লাগিল যেন ত্রয়ের রাজমহিষীর শোক সন্তাপ সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিতেছি সুতরাং সকলের নয়ন বাষ্পে পরিপূর্ণ হইল নাট্যকারীও ভাবে গদ্গদ হইয়া আপনাকে যথার্থ রাজাঙ্গনা জ্ঞানে তাদৃক্ দুঃখ প্রকাশ করত লোচন নীরে ভাসিতে লাগিল। এই নাট্য সমাপন হইলে রাজতনয় স্বীয় মনোমধ্যে বিতর্ক করিতে লাগিলেন এ নট ত্রয় দেশীয় রাজমহিষীকে কদাপি নয়ন গোচর করে নাই, কত শত বৎসর অতীত হইল সেই মহিলার মৃত্যু হইয়াছে, এ ব্যক্তি তাহার দুরবস্থার বিষয় অভিনয় করিতে প্রবৃত্ত হইয়া আপন কল্পনায় আবির্ভূত তদীয় দুঃখ অনুভব করত মহা বিষণ্ণ হইল এবং তন্নিমিত্ত অজস্র অশ্রুপাত করিল। আঃ আমার অন্তঃকরণ কি পাষাণময়, আমার জনককে এক জন প্রাণে নিহত করিল আমি তজ্জন্য শোক সন্তাপ পরিত্যাগ করিয়া নিশ্চিন্ত বসিয়া আছি, পিতৃহন্তাকে প্রতিফল প্রদানের অভিপ্রায় অন্তর হইতে অন্তর হইয়া গিয়াছে ফলতঃ সে মানসকে সংপ্রতি যেন শয্যাগত বা পঙ্কিল হ্রদে নিমগ্ন করিয়া নিরুদ্বেগ আছি। তদনন্তর নাটকে বর্ণিত অন্যান্য মহোদয়ের জীবন চরিত্র স্মৃথিপথে উদিত হইল এবং তদ্বিষয় চিন্তা করিতে২ সাক্ষাৎ দর্শন কারির ন্যায় মনোমধ্যে তত্তৎ ভাবের উদয় হইতে লাগিল। তৎপরে এক জন প্রাণ হন্তার ব্যাপার স্মৃতি পথারূঢ় হইল, সে ব্যক্তি নাটক দর্শন করিতে গিয়া প্রাণহন্তার বেশধারি নটের ভাব ভঙ্গি বিলোকনে আত্মবিস্মরণ পূর্ব্বক স্বয়ং স্বীয় কুক্রিয়া স্বীকার করিয়াছিল। অতএব হাম্‌লেত পিতৃহন্তার প্রতিহিংসার্থ পুনর্ব্বার ব্যস্ত হইয়া তদ্বিষয়ে সন্দেহ নিরসন নিমিত্ত যুক্তি পূর্ব্বক উপায় স্থির করিলেন এই চারণ গণকে গোপনে উপদেশ দিয়া রাজসভায় পিতৃব্য সমক্ষে একটা হত্যার ব্যাপার বর্ণন পূর্ব্বক এক দিন নাট্য ক্রিয়া করাই, তাহা হইলে নাট্য দর্শনে পিতৃব্যের কিরূপ ভাবোদয় হয় আকার ইঙ্গিতে অবশ্য প্রকাশ পাইবে তাহাতে তিনি আমার পিতৃহন্তা কি না নিশ্চয় করিতে পারিব। রাজকুমার মনোমধ্যে এই পরামর্শ করিয়া পিতৃহত্যার ব্যাপারের তুল্য এক গল্প রচনা পূর্ব্বক তদুপলক্ষে অপূর্ব্ব নাটক প্রস্তুত করাইলেন এবং তাহার অভিনয়ার্থ চারণ দিগকে অনুমতি দিয়া রাজসিংহাসনাধিষ্ঠিত পিতৃব্য এবং রাজমহিষীকে দর্শনের নিমন্ত্রণ করিলেন।

 এই নূতন নাটকে বায়না দেশীয় এক জন সম্ভ্রান্ত মনুষ্যের হত্যার ব্যাপার কল্পিত হইয়াছিল, সেই মান্য পুরুষের নাম গঞ্জেগ, তাহার বনিতা ব্যাপ্তিস্তা নাম্নী। নটেরা এই নবীন নাট্যে সেই মর্য্যাদাবান্‌ পুরুষ লুসিয়ানস্ নামক এক জন আত্মীয় ব্যক্তির দ্বারা সম্পত্তি হরণ মানসে উদ্যান ভবনে বিষলতার রস যোগে যে প্রকারে নিহত হন্ এবং তদীয় মহিলা স্বল্প কাল মধ্যে স্বামি শোক বিস্মরণ পূর্ব্বক যদ্রূপে তাহার প্রণয়িনী হয় অবিকল ভাব ভঙ্গি প্রদর্শন পূর্ব্বক অভিনয় করিতে আরম্ভ করিল।

 নৃপকুমার এই নাট্য যোগে আপনার সংশয় নিরাকরণ নিমিত্ত যে বাগুরা বিস্তার করিলেন রাজা ক্লাদিয়স্ তাহা জানিতে পারেন নাই, সুতরাং নূতন নাট্য দর্শন নিমিত্ত কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া স্বীয় প্রেয়সী এবং সভাসদ্‌গণ সমভিব্যাহারে পরিষন্মধ্যে আসিয়া অধ্যাসীন হইলেন। নাট্য অবলোকনে পিতৃব্যের মুখে কি প্রকার ভাবের চিহ্ণ আবির্ভূত হয় তন্নিরীক্ষণ নিমিত্ত রাজতনয় তাঁহার অদূরে উপবেশ করিলেন। অনন্তর নাট্য ক্রিয়ার আরম্ভ হইলে গঞ্জেগ ও তাহার বনিতা ব্যাপ্তিস্তায় কিয়ৎক্ষণ পরস্পর প্রণয়ালাপ হইতে লাগিল তাহাতে ব্যাপ্তিস্তা বল্লভের প্রতি সাতিশয় অনুরাগ প্রকাশ পূর্ব্বক দৃঢ় প্রণয়ের প্রমাণ নিমিত্ত প্রতিজ্ঞা করিল নাথ ঈশ্বর না করুন যদিস্যাৎ দুরদৃষ্ট বশতঃ অথবা কাল সহকারে কদাচিৎ তোমাবিহীন হইয়া বিধবা হই, তথাপি অন্য পুরুষকে আর পাণি দান করিব না। তোমার সাক্ষাৎ শপথ করিলাম যদি পুরুষান্তর গামিনী হই যেন পাপের নিষ্কৃতি না হয়। হে প্রিয়তম যে সকল দুঃশীলা মহিলা পতি ঘাতিনী, তাহাদেরই ঐ রূপ ব্যবহারে প্রবৃত্তি হয়। যুবরাজ হাম্‌লেত এই সময়ে পিতৃব্যের প্রতি নেত্রপাত করাতে নিরীক্ষণ করিলেন কনিষ্ঠ তাতের বদন বিবর্ণ এবং জননীর বৈরক্তি ভাবের আবির্ভাব হইতেছে। তদনন্তর নাট্য প্রতিপাদ্য উপন্যাসানুসারে যখন এক জন নট লুসিয়ানসের রূপ ধারণ পূর্ব্বক উদ্যান সদনে পর্য্যঙ্কোপরি সুখ সুপ্ত গঞ্জেগের শরীরে বিষলতার রস সংযোগ নিমিত্ত গমনের অভিনয় করিল তখন প্রাচীন রাজা হাম্‌লেতকে বিষ প্রয়োগ পুরঃসর বিনষ্ট করণের ব্যাপার ক্লাদিয়সের স্মৃতিপথারূঢ় হওয়াতে বিজাতীয় চাঞ্চল্য হইল অতএব নাট্যশালায় অধিক কাল অবস্থিতি করিতে অসমর্থ হইয়া ভৃত্যদিগকে শয়নাগারে আলোক দানের আজ্ঞা দিলেন এবং পীড়ার ছলে ঝটিতি নাট্যশালা হইতে বহির্গত হইয়া গেলেন। রাজা সভা হইতে উত্থান করিলে সুতরাং নাটক্রিয়া স্থগিত হইল। কুমার পিতৃব্যের এই ভাব অবলোকন করিয়া এক্ষণে ব্যপেতসন্দেহ হইলেন এবং বন্ধু হোরেসিওর নিকট কহিতে লাগিলেন দেবযোনির প্রমুখাৎ যাহা২ শুনিয়াছি সকলই সত্য, আমার ভ্রম বিলসিত নহে, অতএব কোন বিষয়ে সংশয় নিরাস হইলে অন্তঃকরণ মধ্যে যাদৃক্ সন্তোষ জন্মে, তাদৃশ সন্তোষান্বিত হইয়া ব্যক্ত করিলেন যাহা হউক ভূতের দর্শনে আমার যথেষ্ট লভ্য হইয়াছে। পরে বিবেচনা করিতে বসিলেন এখন পিতৃহন্তা পিতৃব্যের প্রতিফল প্রদান নিমিত্ত কি উপায় করি। যুব হাম্‌লেত একাকী এতদ্বিষয়ে তর্ক বিতর্ক করিতেছেন, ইত্যবসরে রাজমহিষী কথোপকথন করণার্থ আপনার নিভৃতালয়ে তাঁহাকে আহ্বান করিয়া পাঠাইলেন।

 ক্লাদিয়স্ ঐ নাট্যে রাজকুমারের ষড়যন্ত্র জানিতে পারিয়া শঙ্কান্বিত হইয়াছিলেন একারণ রাণীকে সঙ্কেত করেন তনয়কে সন্নিধানে আহ্বান পূর্ব্বক সকোপ বাক্যে অনুযোগ করিয়া বিজ্ঞাপন কর তোমার আচরণে আমাদের ক্রমশঃ সাতিশয় অসন্তোষ জন্মিতেছে। রাজ্ঞী প্রিয়ের আজ্ঞা পালন নিমিত্ত কথোপকথন করিবার ছলে কুমারকে নিকটে ডাকেন। ক্লাদিয়স্ ঐ বিষয়ে তাঁহাদের মাতা পুত্রে কি প্রকার কথাবার্ত্তা হয় শ্রবণের নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি উৎসুক হইলেন যদিও রাণীর প্রণয়ানুরাগ তৎকালাবধি দেদীপ্যমান দেখিয়া তাঁহার প্রমুখাৎ যুবরাজের সকল বাক্য শ্রবণের সম্পূর্ণ আশ্বাস করিতেন তথাপি সংশয়াকুলতা প্রযুক্ত বিতর্ক করিতে লাগিলেন অপত্যস্নেহ স্বভাবতঃ বলবান্‌, কি জানি রাণী যদি স্নেহপরবশ হইয়া তনয়ের প্রতি পক্ষপাতিতাচরণ পুরঃসর অবিকল সকল ব্যক্ত না করেন অতএব মাতাপুত্রের তাবৎ কথোপকথন গোপনে শ্রবণ পূর্ব্বক জ্ঞাপন নিমিত্ত রাজ্যের প্রাচীন মন্ত্রি পোলোনিয়স্‌কে রাজ জায়ার ভবনান্তর্ব্বর্ত্তি যবনিকার ব্যবধানে অবস্থিতি পূর্ব্বক শুনিতে পাঠাইয়া দিলেন। পোলোনিয়স্ মন্ত্রী ধূর্ত্ত শিরোমণি, এতাদৃশ ব্যাপারে ব্যাপৃত হইবার উপযুক্ত ছিল। সে ব্যক্তি ক্রমাগত রাজ্যসংক্রান্ত ব্যাপারের বিপর্যয় করিয়াও চাতুর্য্য প্রভাবে বিশিষ্ট নীতিজ্ঞ বলিয়া বিখ্যাত হয়। অতএব রাজার ইঙ্গিত মাত্রে রাজ্ঞীর আলয়ান্তর্ব্বর্ত্তি তিরস্করিণীর অন্তরালে গমন পুরঃসর দণ্ডায়মান হইয়া রহিল।

 যুবরাজ গৃহাভ্যন্তরে আসিয়া উপস্থিত হইলে রাজমহিষী তাহার অসদাচরণ নিমিত্ত ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন হাম্‌লেত তুমি তোমার পিতার নিকট অতিশয় অপরাধী হইয়াছ। রাণী প্রিয় দেবর ক্লাদিয়সের পুনর্ভূ হইয়া তদবধি তাহাকে হাম্‌লেতের পিতা বলিয়া আহ্বান করিতেন। কিন্তু কুমার পিতৃহন্তা ব্যক্তিকে পিতা বলিয়া কদাপি গণ্য করেন নাই অতএব নৃপাঙ্গনাকে আপনার পক্ষ হইয়া তাহার প্রতি ঐ রূপ সম্মানান্বিত বচন প্রয়োগ করিতে দেখিয়া অন্তর্ব্যথিত এবং কোপে কম্পিত কলেবর হইয়া উত্তর করিলেন জননি আপনি আমার জনক সন্নিধানে বিস্তর ত্রুটি করিয়াছেন। রাজ্ঞী ঈষৎ কোপাবেশে বলিলেন এ কি উত্তর হইল? যুবরাজ কহিলেন প্রস্তাবের উপযুক্ত প্রতিবচন হইয়াছে। পরে নৃপরমণী রোষ প্রকাশ পুরঃসর জিজ্ঞাসিলেন যাহার সহিত কথা কহিতেছ ইহাকে কি ভুলিয়া গিয়াছ? নৃপনন্দন সাক্ষেপ বচনে উত্তর করিলেন আঃ বিস্মরণ হইলেই তো ভাল হইত, ভুলিয়াছি কোথায়? তুমি আমার মাতা, মৃত মহারাজের পট্ট মহিষী, এক্ষণে দেবরের পুনর্ভূ হইয়াছ, এ সকল বিষয় আমার মনোমধ্যে সতত প্রকাশ পাইয়া যৎপরোনাস্তি যাতনা দিতেছে। রাণী এই কথা আকর্ণন করিয়া কহিলেন কি আমাকে অবজ্ঞা করিলে? এই দণ্ডে গমন করিয়া তোমার অনুরূপ ব্যক্তি দিগকে এখানে পাঠাইয়া দিতেছি, তাহারাই তোমার সঙ্গে উচিত আলাপ করিবে। ইহা কহিয়া মন্ত্রি পোলোনিয়স্ অথবা রাজা ক্লাদিয়স্‌কে যুবরাজ সন্নিধানে প্রেষণ নিমিত্ত ক্রোধভরে বহির্গমনোদ্যত হইলেন। কুমার এক্ষণে জননীকে নির্জ্জনে পাইয়া ছিলেন অসদাচরণ নিমিত্ত পুনঃ২ অনুযোগ করিলে যদি মাতার মনোমধ্যে ঘৃণা এবং চৈতন্যের উদয় হয় এতদাশয়ে তাঁহাকে গৃহ হইতে নির্গমন করিতে দিলেন না, প্রস্থানের উপক্রম দেখিয়া বলে বাহু ধারণ পূর্ব্বক বসাইলেন। রাণী তনয়ের কাঠিন্যাচরণ দর্শনে ভীতা হইলেন এবং মনে করিতে লাগিলেন পুত্র একবার ক্ষিপ্ত হইয়াছিল, বুঝি পুনর্বার উন্মাদের উদয় হইল, পাছে আর কোন উৎপাত করে, অতএব সাতিশয় আর্ত্তস্বরে চীৎকার করিলেন। তাহাতে যবনিকার পশ্চাদ্ভাগ হইতে এই শব্দ হইতে লাগিল রাজ্ঞীকে রক্ষা কর, রাজ্ঞীকে রক্ষা কর। এই শব্দ কর্ণগোচর হইবা মাত্র রাজনন্দন মনে করিলেন ক্লাদিয়স্ তিরস্করিণীর অন্তরালে লুক্কায়িত হইয়া আছেন অতএব তৎক্ষণাৎ তূণ হইতে তীক্ষ্ণ বাণ নিষ্কাসন পূর্ব্বক শরাসনে সন্ধান করিয়া সেই শব্দের দিকে লক্ষ্য করত নিক্ষেপ করিলেন এবং তদনন্তর আর কোন শব্দ শ্রুতি গোচর না হওয়াতে অনুমান করিলেন দুরাত্মা ক্লাদিয়স্ বাণে বিদ্ধ হইয়া গত প্রাণ হইয়াছে। কিন্তু পরে যখন পর্দ্দার বাহিরে গমন পূর্ব্বক শব আকর্ষণ করত সম্মুখে আনিলেন তখন দেখিতে পাইলেন মৃতব্যক্তি ক্লাদিয়স্ নহে, পোলোনিয়স্ মন্ত্রী পরাধিকার চর্চ্চা করিয়া গোপনে যবনিকার ব্যবধানে ছিল, বাণে বিক্ষত হইয়া, পঞ্চত্ব পাইয়াছে। নৃপভামিনী সম্মুখে শব দর্শনে চমৎকৃতা হইয়া কহিলেন হা কপাল এ কি? হাম্‌লেত তুমি অপরিণাম দর্শী হইয়া বাণ মোচন করত একটা মহাপ্রাণি বিনষ্ট করিলে। যুবরাজ এক্ষণে রোষ পরবশতা প্রযুক্ত অক্ষান্তি দ্বারা আক্রান্ত হৃদয় হইয়াছিলেন অতএব স্পষ্ট বাক্যে কহিতে লাগিলেন মা আমি একটী মানবের প্রাণ হত্যা করিয়া কুকর্ম্ম করিলাম সত্য বটে, কিন্তু তুমি অবনীপতির জীবন বিনাশ পূর্ব্বক তদীয় বিশ্বাস ঘাতি সোদরকে বর মাল্য দিয়া যে জঘন্য কার্য্য করিয়াছ এ তত্তুল্য ঘৃণ্য নহে।

 যদিও মহাগুরু পিতামাতার দোষের কথা সন্তানদিগের বাচ্য নহে তথাপি গুরুতর অপরাধে উগ্রতাবলম্বন পূর্ব্বক তাহাদের প্রতি কঠিন বচন প্রয়োগ অবিধেয় নয় কেননা তাহাতে কুৎসিত বর্ত্ম হইতে প্রত্যানয়নের সম্ভাবনা, সুতরাং তাহা জনক জননীর হিতার্থ ব্যতিরিক্ত অপবাদার্থ বলাযায় না। অতএব নৃপকুমার ধার্ম্মিক হইয়াও মাতার প্রতি ঐ রূপ কটূক্তি করিলেন এবং তাঁহার আচরণের জঘন্যতা দর্শাইয়া অনুযোগ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন তুমি আমার জনককে কি একেবারে বিস্মরণ করিয়াছ কেননা তাঁহার পরলোক প্রাপ্তির পর অত্যল্প কাল মধ্যে তদীয় প্রাণ হিংসকের লোকবিগীতা বনিতা হইলে? আমার জনকের সহিত প্রথম পরিণয় সময়ে কি২ প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে স্মরণ কর দেখি। তোমার ইদানীন্তন ব্যবহার দেখিয়া অবলা কুলের সকল প্রতিজ্ঞাতেই সন্দেহ জন্মায় এবং তাবৎ ধর্ম্ম ভণ্ডতাচ্ছন্ন রূপে সপ্রমাণ হয়। অপর বিবাহের শপথ দ্যূতকারির দিব্যের তুল্য অস্থির এবং ধর্ম্ম কথা কেবল কথার কথা বোধ হয়। মা তুমি যে কর্ম্ম করিয়াছ তাহাতে স্বর্গ সলজ্জ এবং ধরণী ভারাক্রান্তা হইয়াছেন। আমার মহাত্মা পিতা এবং দুরাত্মা পিতৃব্যের এই দুই খানি প্রতিমূর্ত্তি সম্মুখে আছে, নয়ন উন্মীলন পূর্ব্বক অবলোকন করিয়া বিবেচনা কর দেখি, উভয়ের মধ্যে কত প্রভেদ। এই মূর্ত্তির ভ্রূলতা কেমন শোভান্বিতা, দেবতার ন্যায় কি সুন্দর মনোহর রূপ, আহা ইহার শিরস্য কেশ সরস্বতীর চিকুরের সদৃশ অতি রমণীয়। ললাট বৃহস্পতি তুল্য কেমন চিক্কণ, নয়নের তারা মঙ্গল গ্রহের ন্যায় কি সুন্দর উজ্জ্বল। আহা শৈলোপরি উত্থিত বুধ নামা নক্ষত্র যেমন স্বর্গাভিমুখে গমন করেন তাঁহার সমান এই আকৃতি যেন শোভন গমন করিতেছেন। মা তোমার প্রথম পরিণেতার এই প্রতিকৃতি, নিরীক্ষণ করিয়া স্মরণ কর। তদনন্তর ক্লাদিয়সের প্রতিমূর্তি প্রদর্শন করত কহিলেন এক্ষণে যাহার অঙ্কলক্ষ্মী হইয়াছ এই তাহার আকৃতি, অবলোকন কর, এ দুরাত্মা স্বভাবতঃ কুৎসিতাকার, তেজস্বি সহোদরের প্রাণ সংহার করিয়া কীদৃশ পরিম্লান ও নিষ্প্রভ হইয়াছে দেখিলে? রাজমহিষী সন্তানের অনুযোগ শ্রবণ এবং স্বামি দেবরের প্রতিকৃতি অবলোকন করিয়া গভীর ভাবে চিন্তা করত এক্ষণে বুঝিতে পারিলেন যৎপরোনাস্তি কুক্রিয়া করিয়াছি এবং আপনার গর্ব্ভজ পুত্র তদ্বিষয়ে চৈতন্যোদয় করিয়া দেওয়াতে লজ্জিত হইলেন। তদনন্তর কুমার জিজ্ঞাসা করিলেন মা যে দুরাত্মা তোমার পরিণেতার প্রাণ হত্যা পূর্ব্বক চোরের তুল্য চাতুর্য্য করিয়া রাজসিংহাসন হরণ করিয়াছে এখনও কি গৃহিণী হইয়া তাহার সহিত সহবাসের বাসনা করিবে? এই সময়ে যে দেবযোনি মৃত মহারাজ হাম্‌লেতের জীবদ্দশার আকৃতি ধারণ পূর্ব্বক পূর্ব্বে যুবরাজকে দর্শন দিয়াছিল সেই দেবযোনির ছায়া রাণীর ভবনাভ্যন্তরে প্রকাশমানা হইল। রাজনন্দন অবলোকন মাত্রে সাশঙ্ক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন কি আদেশ হয়? ভূত কহিল আমার অসুবিনাশকের প্রতি হিংসা করিতে অঙ্গীকার করিয়া বিস্মৃত হইয়াছ এতাদৃক্ বোধ হওয়াতে স্মরণ করিয়া দিবার জন্য আগমন করিলাম। হে পুত্র তোমার জননীর সহিত কথোপকথন কর নচেৎ শোক ও সন্ত্রাসে ইহার প্রাণ নাশের সম্ভাবনা। সেই অপচ্ছায় রাণীর দৃষ্টিপথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক তনয়ের নয়ন গোচরে দণ্ডায়মান হইয়াছিল সুতরাং কুমার চিহ্ণ অথবা বাক্য দ্বারা বর্ণনা করিয়া দেবযোনিকে জননীর পরিচিত করিতে পারিলেন না। রাজ্ঞী কুমারকে অদৃষ্ট ব্যক্তির সহিত কথোপকথন করিতে দেখিয়া সভয়ান্তঃকরণে বিবেচনা করিতে ছিলেন এখনও বুঝি পুত্রের উন্মাদ শান্তি হয় নাই। যুবরাজ জননীর অভিপ্রায় বুঝিয়া তাঁহাকে কহিলেন মা এমত বিবেচনা করিও না যে আমার এই সমস্ত বাক্য উন্মত্ত প্রলাপ, তোমার দুষ্ক্রিয়া জন্য জনক মহাশয়ের ছায়া অবনী মধ্যে প্রকাশমানা হইয়া এ সকল কথা কহিলেন, আমার হস্ত ধারণ পূর্ব্বক নাড়ী নিরীক্ষণ কর কোন ধাতুর বৈষম্য হয় নাই, আমি সজ্ঞানাবস্থায় আছি, ক্ষিপ্ত নহি। পরিশেষে বাষ্পাকুল লোচন হইয়া নিবেদন করিলেন মা আপনার অতীত কুক্রিয়া নিমিত্ত এক্ষণে জগদীশ্বর সন্নিধানে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং দুরাত্মা ক্লাদিয়স্‌কে পরিত্যাগ পূর্ব্বক অসৎ সংসর্গ হইতে নিবৃত্ত হও। তুমি আমার জনকের প্রতি সম্মান দর্শাইলে আমিও তোমাকে শ্রদ্ধেয় মাতা জানিয়া তোমার নিমিত্ত পরমেশ্বরের নিকট অনুগ্রহ প্রার্থনা করিব। রাজ্ঞী পুত্রের সদুপদেশে প্রবোধ প্রাপ্ত হইলেন এবং তাঁহার অভিপ্রায়ানুসারে ব্যবহার করিতে অঙ্গীকার করিলেন অতএব মাতাপুত্রের কথোপকথন সমাপ্ত হইল।

 অনন্তর রাজনন্দন হাম্‌লেত অবকাশ লাভে বিবেচনা করিতে লাগিলেন অপরিণাম দর্শী হইয়া তখন্ কাহার প্রাণ হত্যা করিলাম। তাহাতে স্মরণ হইল যে ওফিলিয়া তাঁহার প্রেমভাজন, নিহত ব্যক্তি তাহার পিতা পোলোনিয়স্। অতএব অনুতাপ করিতে২ সেই শবটী এক দিকে স্থাপন পূর্ব্বক আপনার কার্য্যের উপলক্ষে বিলাপ ও রোদন আরম্ভ করিলেন।

 এদিকে ক্লাদিয়স্ রাজকুমার দ্বারা অনিষ্ট সম্ভাবনা দেখিয়া তাহার প্রাণ বিনাশের উপায় চিন্তা করিতেছিলেন কিন্তু প্রজাজন সকলেই যুবরাজকে ভাল বাসে এবং সন্তান শত২ অপরাধ করিলেও তাহার প্রতি মাতার স্নেহ নিবৃত্ত হয় না। সুতরাং রাণীও আপন নন্দনের জীবন সংহার করিতে দিবেন না এই সমস্ত বিবেচনা করাতে শমন ভবন প্রেষণের কোন পন্থা দেখিতে পাইলেন না। এতদবসরে কুমারের বাণে মন্ত্রির মৃত্যু সংবাদ প্রাপ্ত হওয়াতে মনে করিলেন এই অপদেশে রাজত্বের কণ্টকোদ্ধার করিতে পারিব। অন্যায় হত্যার অপরাধে হাম্‌লেতকে এতদ্রাজ্য হইতে বহিষ্করণ পুর্ব্বক নির্ব্বাসিত করি। অনন্তর মন্ত্রিবর্গ দ্বারা কুমারকে আজ্ঞা করিলেন পোলোনিয়সের হত্যাবিষয়ক অভিযোগ রাজসভায় উপস্থিত হইলে বিচারে তোমার উপর বিপদ্ ঘটিবার সম্ভাবনা, অতএব দুই জন সভাসদ্ সমভিব্যাহারে অবিলম্বে ইংলণ্ডে প্রস্থান কর। তৎকালে ইংলণ্ডীয় রাজা দেন্মার্কাধিপের করপ্রদ থাকাতে নবীন রাজা ধূর্ত্ততা পূর্ব্বক স্বীয় অভিলাষ পূর্ণ করিতে মানস করিলেন, অতএব তদ্দেশীয় বিচারালয়ে সমর্পণ নিমিত্ত গোপনে সেই দুই সভাসদের হস্তে এক খানি বিজ্ঞাপনী লিপি দিলেন তাহার মর্ম্ম এই, হাম্‌লেত রাজ্য মধ্যে ভয়ানক কুক্রিয়া করাতে ইহাকে ইংলণ্ডে প্রেরণ করিলাম সেখানে উপস্থিত হইলে প্রাণদণ্ড করিবে। যুবরাজ দুরাত্ম পিতৃব্যের প্রকৃত অভিপ্রায় অবগত হইতে পারেন নাই অতএব অকারণে মানব বিনাশের অভিযোগে দোষী হইবার ভয়ে ত্বরায় দুই জন পারিষদ সমভিব্যাহারে বৃহৎ পোতারোহণ পূর্ব্বক ইংলণ্ড যাত্রা করিলেন। কিন্তু পিতৃব্যের চরিত্র স্মৃতিপথে নিরন্তর জাগরূক থাকাতে হঠাৎ সন্দিগ্ধ মনা হইয়া পথিমধ্যে এক দিন বিতর্ক করিতে লাগিলেন দুরাত্মা কি প্রতারণা পূর্ব্বক আমাকে দেশ হইতে নিষ্কাসিত করিল? পরে রজনী উপস্থিত হইলে গোপনে সমভিব্যাহারি সভাসদ্‌দিগের বস্ত্র হইতে লিপি খানি উন্মোচন করিয়া লইলেন এবং বিকসিত করণানন্তর বাচনাবসানে জানিতে পারিলেন যে বিষয়ের সন্দেহ করিতে ছিলেন দুরাত্মা তাহারই অনুষ্ঠান করিয়াছে। কিন্তু ধূর্ত্তের উপরি ধূর্ত্ততা প্রকাশ করিতে স্থির করিয়া সেই লিপি মধ্যস্থ আপন নাম মোচন পূর্ব্বক সেই স্থলে ক্লাদিয়সের প্রিয় পাত্র সঙ্গি দুই জনের নাম লিখিয়া দিলেন এবং পুনর্ব্বার মুদ্রিত করণ পুরঃসর যথা স্থানে বান্ধিয়া রাখিলেন। কিয়দ্দিন পরে সমুদ্র পথে যাইতে২ তাঁহাদের অর্ণব তরি নাবিক তস্করদিগের হস্তে পতিত হইল। তাহাতে সাগরোপরি দস্যুগণের সঙ্গে সংগ্রাম উপস্থিত হওয়াতে যুবরাজ বীরত্ব প্রকাশ পুরঃসর করে করবাল ধারণ করিলেন এবং বৈরিদিগের রণতরি আক্রমণ করিয়া সাহস প্রদর্শন পূর্ব্বক একাকী তন্মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহার সমভিব্যাহারিরা ভীরুতা প্রযুক্ত ঐ অবসরে আপনাদের পোত লইয়া পলায়ন করিল সুতরাং রাজতনয় তস্কর দিগের তরিতে যাহা ঘটিবে একাকী তাহা ভোগ করিবার নিমিত্ত উপস্থিত রহিলেন। কিন্তু সেই অনুচরদের সঙ্গে ক্লাদিয়সের ঐ লিপি খানি গেল যাহাতে যুবরাজ আপনার নাম মোচন পূর্ব্বক তাহাদের সংজ্ঞা অঙ্কিত করিয়া দিয়াছিলেন।

 রাজনন্দন একাকী নাবিক দস্যু দিগের হস্তে পড়িলে তাহারা বিদ্রোহাচরণে ক্ষান্ত হইয়া সদ্ব্যবহার করিল এবং অসহায় নৃপতনয় দেন্মার্কাধিপতির সকাশে থাকিলে অবশ্য কোন প্রকার আশ্রয় প্রাপ্ত হইবেন এতদ্বিবেচনায় দয়ার্দ্র হইয়া দেন্মার্কের দিকে যাত্রা করত তদ্দেশের এক ঘাটে তাঁহাকে নামাইয়া দিয়া আপনারা স্বস্থানে প্রস্থান করিল। যুবরাজ পুনর্ব্বার পিতৃরাজ্যে উপস্থিত হওয়াতে সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন এবং তরি হইতে অবতরণের পরেই যে রূপ বিস্ময়াবহ ঘটনা ক্রমে স্বদেশ পুনঃপ্রাপ্ত হইলেন তত্তাবতের বিবরণ তথা আগামি দিবসে রাজসভায় উপস্থিত হইবার অভিপ্রায় লিপি যোগে ক্লাদিয়সের সুগোচর করিলেন।

 অনন্তর রাজবেশ্ম প্রবেশের বর্ত্ম অবলম্বন পূর্ব্বক পদব্রজে আগমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ পথ আসিলে পর এক স্থানে একটা শোকাবহ ব্যাপার দেখিতে পাইলেন, এ ব্যাপার ওফিলিয়ার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া। সেই মহিলা আপনার পিতা পোলোনিয়সের মৃত্যুতে খেদান্বিতা হইয়া নিরন্তর পরিতাপ করিতেন হায় যে ব্যক্তির প্রতি আমার সাতিশয় অনুরাগ ছিল তাঁহারই হস্তে আমার জনক প্রাণে বিনষ্ট হইলেন। এই পরিতাপ ভাবনা সহকারে উত্তরোত্তর বৃদ্ধিশীল হওয়াতে যুবতীর জ্ঞান বিগম এবং ক্রমে পূর্ণ উন্মাদ উপস্থিত হয়। রমণী পিতৃশোকে উন্মত্ত হইয়া কখন২ রাজসদনের অঙ্গনে পর্য্যটন পূর্ব্বক পুরস্থ মহিলা গণকে এক২টী কুসুম প্রদান পূর্ব্বক কহিতেন আমার জনকের স্বর্গার্থ তোমাদিগকে এই উপহার দিলাম। বায়ুর বিচিত্র প্রভাবে কখন বা প্রেম কখন বা করুণ রস পূর্ণ সুললিত গীত বিরচিত করিয়া উচ্চ স্বরে গান করিতেন। সেই সংগীত মধ্যে কোন২ পদ নিরর্থক প্রযুক্ত হওয়াতে শ্রোতৃমণ্ডলী অনুমান করিত ওফিলিয়া পূর্ব্ব ঘটনা সকল বিস্মরণ হইয়াছে। যুবতীর আবাস ভূমির অনতিদূরে কতক গুলা বেতস লতা ছিল তাহার অনেক শাখা লম্বমান হইয়া নিকটস্থ নদী স্রোতে পড়িয়া ছিল তাহাতে স্রোতস্বীর সলিল পত্রের প্রতিবিম্বে সুশোভিত হইত। এক দিন রমণী রক্ষক বিহীন হইয়া থাকাতে বন্য কুসুমের হার গ্রন্থন করিতে২ কাল প্রেরিতের ন্যায় অকস্মাৎ ঐ বেতসের মূলে গিয়া উপস্থিত হইলেন এবং উন্মত্ততা প্রযুক্ত এক ছড়া পুষ্পের মালা সেই লতার উপরি অর্পণ পূর্ব্বক দোলায়মান করিতে মানস করিলেন। কিন্তু ঊর্দ্ধবাহু হইয়া উল্লম্ফন করত যেমন শাখা ধারণ করিলেন তৎক্ষণাৎ বিটপ ভগ্ন হওয়াতে আপনার পরিধেয় মধ্যে স্থিত দ্রব্য সামগ্রী সহিত স্রোতোজলে পতিতা হইলেন। স্রোতে পড়িয়াও শুষ্ক ও লঘু বসনাদি নিমিত্ত কিয়ৎ ক্ষণ জলের উপরি ভাসিতে লাগিলেন কিন্তু অপ্রকৃতিস্থতা প্রযুক্ত বিপদ্ অনুধাবনে অক্ষম হইয়া প্রাণ রক্ষার্থ কিঞ্চিন্মাত্র যত্ন করিলেন না বরং সেই অবস্থাতেও সংগীতে রতা রহিলেন সুতরাং কিয়ৎ ক্ষণানন্তর বসনাদি জল প্রবেশে আর্দ্র হওয়াতে ভারাক্রমণে নিমগ্না ও তরঙ্গিণীর পঙ্কিল তলে বিলীনা হইলেন। কিয়দ্দিন পরে সেই সুন্দরীর শব জলের উপর ভাসিয়া উঠাতে তাহার সহোদর লেয়ার্তিস্ শ্মশানে লইয়া অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া করিল এবং তদুপলক্ষে ক্লাদিয়স রাজা তদীয় প্রেয়সী ও সভাসদ্‌গণ তথায় দণ্ডায়মান ছিলেন। রাজকুমার এ সমস্ত ব্যাপার কিঞ্চিন্মাত্র অবগত ছিলেন না। অতএব বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসায় অধীর হইতে লাগিলেন কিন্তু আপনার জিজ্ঞাসা নিবৃত্তি করিতে গেলে পাছে শব সৎকার ব্যাপারে কোন ব্যাঘাত জন্মে এই আশঙ্কা মনোমধ্যে উদিত হওয়াতে কাহাকেও কোন প্রশ্ন করিলেন না, একান্তে দাঁড়াইয়া রহিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে নিরীক্ষণ করিলেন অপরিণীত স্ত্রীলোকের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার নিয়মানুসারে রাজমহিষী শ্মশানের চতুষ্পার্শ্বে পরিক্রমণ পূর্ব্বক পুষ্প বিকিরণ করিতে২ কহিতেছেন বৎসে মনে করিয়াছিলাম তুমি আমার তনয়ের গৃহিণী হইবে বিবাহের কুসুম তোমার শয্যায় অর্পণ করিব, হায় তোমার শ্মশানে পুষ্প প্রক্ষেপ করিতে হইল। অপর দেখিলেন কুমারীর সহোদর ভগিনীর সমাধি স্থল হইতে কুসুমোদ্গমের প্রার্থনা করিয়া শোকাবেগ বশতঃ লম্ফ প্রদান পূর্ব্বক শ্মশান মধ্যে পড়িয়া ভৃত্যদিগকে আদেশ করিতেছে আমার উপর মৃত্তিকা রাশি নিক্ষেপ কর আমিও অনুজার সঙ্গে মানব লীলা সম্বরণ করি। মৃত কুমারীর প্রতি তদীয় সোদর লেয়ার্তিসের ঈদৃশ স্নেহ প্রবৃত্তি সন্দর্শনে রাজনন্দনের প্রেমানল উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল যে প্রেয়সীকে অধিক ভাল বাসিতেন তাহারই অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া হইতেছে অবগত হইয়া কহিতে লাগিলেন কি যুবতীর অকাল মৃত্যুতে আমা অপেক্ষা ভ্রাতার শোক অধিক হইল আমি যে ইহাকে চত্বারিংশৎ সহস্র সোদর অপেক্ষা অধিক ভাল বাসিতাম। পরে লেয়ার্তিসের শোক প্রকাশ দর্শনে অশক্ত হইয়া তদপেক্ষা আপন শোকের গুরুত্ব প্রদর্শন মানসে যেখানে লেয়ার্তিস্ পড়িয়াছিল সেই স্থানে লক্ষ্য প্রদান পূর্ব্বক হঠাৎ পতিত হইলেন। মন্ত্রি নন্দন তাঁহাকে পিতৃহন্তা ও সহোদরার জীবনান্তক বলিয়া জানিত অতএব বৈরশুদ্ধি করণ দ্বারা শোকাবেগ নিবারণ মানসে তাঁহাকে ধারণ পূর্ব্বক ঘোরতর আঘাত করিতে লাগিল যাবৎ ভৃত্যবর্গ দুই জনকে পৃথক্ করিয়া না দিল তাবৎ তাঁহাকে ত্যাগ করিল না। অনন্তর শব সৎক্রিয়া সমাপন হইলে যুবরাজ সৌজন্য প্রকাশ পূর্ব্বক লেয়ার্তিসের নিকট ত্রুটি স্বীকার করিয়া বলিলেন ওফিলিয়ার অকাল মরণে সর্ব্বাপেক্ষা আমার অধিক বিষাদ হইয়াছে রোষ বশম্বদ হইয়া আমি ক্রূরাচরণ করিয়াছিলাম ইহাতে তাহাদের দুই জনের পুনর্ব্বার সম্প্রীতি হইবার উপক্রম হইল।

 ক্লাদিয়স্ যুবরাজকে পুনরাগত দেখিয়া স্বীয়ানিষ্ট শঙ্কা করত তাঁহার বিনাশের নিমিত্ত অন্য উপায় সন্ধান করিতে লাগিল। মন্ত্রিতনয় লেয়ার্তিস্ জনক ও অনুজার শোকে ব্যাকুল থাকাতে তাহাকে পরামর্শ দিল রাজকুমার তোমার পিতৃহন্তা এবং তোমার ভগিনীর জীবনান্তক অতএব কপট মিত্রতা প্রদর্শন পূর্ব্বক কৌশলে তাহার প্রাণ সংহার করিয়া বৈরশুদ্ধি কর। তুমি তাহার সহিত এক দিন শস্ত্র ক্রীড়া করিবার প্রস্তাব কর তাহা হইলে ক্রীড়া যোগে কৃতকার্য্য হইতে পারিবে। লেয়ার্তিস্ রাজার মন্ত্রণায় এক দিন যুবরাজের নিকট গমন করিল এবং অন্যান্য কথোপকথনের পর প্রসঙ্গ করিল মিত্র তোমার সহিত এক দিবস শস্ত্র ক্রীড়া করিতে বাসনা করি। নৃপনন্দন তাহাতে তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন, তদ্দণ্ডেই দিন স্থির হইল। অনন্তর নির্দ্দিষ্ট দিবস সমাগত হইলে অস্ত্রক্রীড়ার ক্ষেত্রে রাজা এবং রাজসভাসদ্ গণ কৌতুক দর্শনার্থী হইয়া আগমন করিলেন। লেয়ার্তিস্ ও রাজকুমার উভয়েই শস্ত্র যুদ্ধে সুশিক্ষিত এ কারণ পরস্পরের রণ কৌশল প্রকাশ করণে উৎসাহ নিমিত্ত জয়ির পারিতোষিক সম্মুখে স্থাপিত হইল। পরে দুই বন্ধু অর্থাৎ লেয়ার্তিস্ ও রাজকুমার ক্রীড়া ভূমি প্রবিষ্ট হইয়া অস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক অসি যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। লেয়ার্তিস দুরাত্মা ক্লাদিয়সের কুমন্ত্রণাক্রমে বিষাক্ত শস্ত্র আনিয়াছিল। কুমারের অন্তঃকরণে এতাদৃশ সন্দেহ হয় নাই যে ঐ ব্যক্তি বিশ্বাস ঘাতকতা করিবে অতএব প্রতিযোগির শস্ত্র পরীক্ষা না করিয়া ক্রীড়া যুদ্ধে যাদৃশ অস্ত্র গ্রহণ করিতে হয় তাদৃক্ একটা সামান্য করবাল ধারণ করিলেন, কিন্তু লেয়ার্তিস্ ক্রীড়ার ছলে তাহার প্রাণ সংহার নিমিত্ত বিষময় শাণিত শস্ত্র লইল। অনন্তর ক্রীড়ারম্ভ হইলে লেয়ার্তিস্ আদৌ যুবরাজের বিরুদ্ধে অস্ত্রোত্তোলন না করিয়া তাঁহাকে তরবারি চালাইতে কহিল। নৃপকুমার রণ কৌশল প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলে ক্লাদিয়স্ তাঁহার যথেষ্ট প্রশংসা করিতে লাগিল এবং জয়ির নিমিত্ত পণ স্থাপন পূর্ব্বক কুমারের মঙ্গলোদ্দেশে মদ্য পান করিল। কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে লেয়ার্তিস্ কৃত্রিম কোপ প্রকাশ পুরঃসর সেই বিষময় শস্ত্র দ্বারা যুবরাজের শরীরে সাংঘাতিক আঘাত করিল। বিপক্ষের ষড়্‌যন্ত্র রাজতনয়ের বিদিত না থাকিলেও কৌতুক যুদ্ধে মর্মান্তিক প্রহার প্রাপ্তে রোষপরবশ হইলেন এবং লেয়ার্তিসের সেই শস্ত্র স্বয়ং গ্রহণ পূর্ব্বক ক্রোধভরে তাহার প্রতি নিক্ষেপ করিয়া তদ্দ্বারা তাহাকে বিলক্ষণ আঘাতিত করিলেন সুতরাং লেয়ার্তিসের বিশ্বাস ঘাতকতার ফল তদণ্ডে ফলিবার সোপান হইল। এই সময়ে রাজমহিষী সাতিশয় ত্রস্তা হইয়া চীৎকার করিতে লাগিলেন আ আমি কালকূট পান করিলাম এবং কিয়ৎ ক্ষণমধ্যে বিষজ্বালায় গতাসু হইয়া ভূমিতে পড়িলেন। রাণীর বিষোপযোগ হইবার বিবরণ এই, দুরাত্মা ক্লাদিয়স্ রাজতনয়ের জীবন বিনাশ নিতান্ত আবশ্যক স্থির করিয়াছিল। লেয়ার্তিস্‌কে কূটশস্ত্রে অস্ত্রক্রীড়া করিতে নিয়োগ করিয়া ভাবিয়াছিল যদি কৃতকার্য্য হইতে না পারে, অতএব সুরা সঙ্গে বিষ পান করাইয়া অভীষ্ট সিদ্ধি করিবার আশয়ে কালকূট নিক্ষেপ পূর্ব্বক একটা পানপাত্র সুরা পূর্ণ করিয়া রাখিয়াছিল, বিস্মৃতিক্রমে রাণীকে সেই পাত্র গ্রহণ করিতে নিষেধ করে নাই সুতরাং রাজ্ঞী পিপাসু হইয়া সেই পান পাত্র গ্রহণ করাতে উপযোগের পরেই পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। কুমার এই ঘটনা অবলোকনে বিস্ময়ান্বিত হইলেন এবং বিতর্ক করিলেন অবশ্য এ বিষয়ে কোন প্রকার বিশ্বাসঘাতকতার ব্যাপার থাকিবেক। অতএব দ্বার সকল রুদ্ধ করিয়া তথ্যানুসন্ধান করিতে লাগিলেন। লেয়ার্তিস্ বিষাক্ত শর প্রহারে আপনার জীবনাশা বিসর্জ্জন করিয়াছিল অতএব তদানীং মুক্তকণ্ঠে সমস্ত বৃত্তান্ত ব্যক্ত করত কহিতে লাগিল যুবরাজ কি অন্বেষণ কর, আমিই বিশ্বাসঘাতী, অসৎ প্রবৃত্তির ফল এখনি প্রাপ্ত হইব। পরে সেই কালকূটময় কূটশস্ত্র তাঁহাকে দর্শাইয়া কহিল এই অস্ত্র সাক্ষাৎ কৃতান্ত, এতদ্দ্বারা শরীর বিদ্ধ হইলে অর্দ্ধ দণ্ড কাল জীবন ধারণের সম্ভাবনা নাই, কোন ওষধি প্রতীকার করিতে পারে না, তুমি আমি উভয়েই এই শস্ত্রের প্রহার প্রাপ্ত হইয়াছি কিয়ৎ ক্ষণ মধ্যেই লৌকিক লীলা সম্বরণ করিব। যাহা হউক, এক্ষণে তোমার নিকট প্রার্থনা করি আমার অপরাধ ক্ষমা কর। এইরূপ উক্তি করিতে২ তৎক্ষণাৎ গতাসু হইয়া পড়িল। অনন্তর যুবরাজ হাম্‌লেত শরীরের ভাবে বুঝিলেন তাঁহারও অন্ত কাল উপস্থিত। পরে সেই বিষাক্ত শস্ত্র গ্রহণ করাতে দেখিতে পাইলেন তাহাতে তখনও কিঞ্চিৎ গরল সংলগ্ন আছে অতএব পিতৃব্যের প্রতি লক্ষ্য করিয়া সাতিশয় তেজে সেই শস্ত্র নিক্ষেপ পূর্ব্বক তাহাকে বধ করিলেন এবং পিতার ছায়ার নিকট যে অঙ্গীকার করিয়াছিলাম তাহার পালন হইল এই বোধে কৃতার্থম্মন্য হইলেন। অতঃপর কালকূট প্রভাবে কুমারের প্রাণ বায়ুর বিনির্গম এবং কণ্ঠ রোধের উপক্রম হইল অতএব প্রিয় মিত্র হোরেসিওর প্রতি দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক মুমুর্ষু স্বরে প্রার্থনা করিলেন সখে তোমার ইঙ্গিতে বুঝিয়াছি আত্ম হত্যা করিয়া আমার সহগামী হইবার সংকল্প করিয়াছ, মিত্র বিনয় করি সে মানস পরিত্যাগ কর আমার এই উপন্যাস জগতে ঘোষণা করিয়া দেও। হোরেসিও মুমুর্ষু মিত্রের কাতরতা দর্শনে করুণার্দ্র হইলেন এবং পরম স্নেহ প্রদর্শন পূর্ব্বক অঙ্গীকার করত কহিলেন তোমার জীবন বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত আমার বিদিত আছে নিঃসন্দেহ প্রচার করিব। বন্ধুর এই বাক্য কুমার হাম্‌লেতের কর্ণগোচর হইলে পর তাঁহার প্রাণ প্রয়াণ হইল এবং দর্শকগণ পিতৃভক্ত মহাসত্ত্ব সুজন যুবরাজের আত্মা ঈশ্বরে লীন হইবার প্রার্থনা করিতে লাগিল। পরে সকলে এই বলিয়া বিলাপ করিল হাম্‌লেত অতি সুশীল সদাচার যুবরাজ ছিলেন সদয় ব্যবহার নিমিত্ত সাধারণের প্রিয়পাত্র হন্‌, জীবিত থাকিলে দেন্মার্ক দেশের সর্ব্ব গুণান্বিত মহামহিম মহীপতি হইতেন ইতি।