সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/কর্কশার ধীরতা

R. D. SORNOKAR, ENGR
১২৩

কর্কশার ধীরতা।

সেক্‌সপিয়র।


কর্কশার ধীরতা।


 পাদুয়া নামক প্রসিদ্ধ নগর মধ্যে ব্যাপ্তিস্তা নামা এক জন সম্ভ্রান্ত ধনী বসতি করিতেন। তাহার কেথারিন্ ও বাএন্‌কা নামিকা দুই কন্যা হয়। জ্যেষ্ঠা কেথারিন্ কর্কশ প্রকৃতি, কলহ প্রিয়া, এবং স্বর পারুষ্যে পুরবাসি সকলের সাতিশয় বিরাগভাজন হওয়াতে শৈশবাবধি কর্কশা কেথারিন্ নামে বিগীতা হইল সুতরাং তদীয় আত্মীয় স্বজন মনে২ সন্দেহ করিতে লাগিলেন কোন বিশিষ্ট সন্তান সস্পৃহ হইয়া তাহার পাণি পীড়ন বা না করেন। ফলতঃ কালক্রমে তাহার বয়ঃক্রম প্রবৃদ্ধ হইল তথাচ কেহ আসিয়া বিবাহের প্রসঙ্গ করিল না। তদীয়া কনীয়সী ভগিনীর পাণি গ্রহণ নিমিত্ত ভূরি২ যোগ্য বর আসিতে লাগিল কিন্তু ব্যাপ্তিস্তা কনিষ্ঠার পরিণয়ে অনুমতি দিতে শৈথিল্য করিলেন এবং বরপাত্রদিগের নিকট তদ্বিষয়ের এই হেতু দর্শাইলেন যে বাএন্‌কার অগ্রজা অপরিণীতা আছেন আদৌ তাঁহাকে পাত্রসাৎ করা যাউক পশ্চাৎ ইহাঁর বিবাহের কথা হইবেক।

 কিয়ৎ কালানন্তর পেত্রুসিও সংজ্ঞক কোন সম্ভ্রান্ত পুরুষ দার পরিগ্রহার্থ আগ্রহান্বিত হইয়া পাদুয়া নগরে আগমন করিলেন এবং কেথারিনের রীতি প্রকৃতি অবগত হইলেও তাহাকেই বিবাহ করিবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইলেন। ঐ কামিনীর কমনীয় রূপ লাবণ্য ও প্রচুর ঐশ্বর্য্য সম্পত্তির বিষয় বিদিত হওয়াতে তাঁহার দৃঢ়তর প্রতিজ্ঞা হইল পাণি পীড়নানন্তর স্ববশে অনিয়া দুঃশীলার স্বভাব সংশোধন পুরঃসর তাঁহাকে নিজ প্রণয়িনী করিব। বস্তুতঃ এই দুরূহ ব্যাপার সাধনে ব্যক্তিরই বিশেষ যোগ্যতা ছিল কেননা তিনি কেথারিনের তুল্য পরুষ প্রকৃতি না হইলেও বাগ্‌বিভঙ্গি ও আকৃতি বিক্রিয়া দ্বারা বিবিধ স্বভাব প্রকাশ করিতে পারিতেন। সাতিশয় সুস্থিরতার সময় যখন কোপারোপ করিলে আপনারই হাস্যোদয় হয় তাদৃশ অবসরেও রোষ পরবশ প্রকৃতির কল্পনা পূর্ব্বক তাদৃক্ আকার দর্শাইতে পারিতেন। অপর তাঁহার চরিত্র বিনয়ৌদার্য্য ধৈর্য্যে স্বভাবতঃ স্বলঙ্কৃত থাকিলেও কেথারিনের ভর্ত্তা হইয়া অবধি তদীয় প্রকৃতির পরাভব নিমিত্ত আরোপিত কোপন মূর্ত্তি ধারণ পুরঃসর সতত অধীরতা প্রদর্শন করিতেন। ফলতঃ তাঁহার এই কৌশলেই পরে কর্কশা কেথারিনের রীতি প্রকৃতি বিচিত্ররূপে পরিবর্ত্তিত হয়।

 পেত্রুসিও বিবাহার্থী হইয়া পাদুয়া নগরে প্রবেশ পূর্ব্বক কেথারিনের প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত প্রথমতঃ তদীয় তাত ব্যাপ্তিস্তার নিকট প্রার্থনা করিলেন আমি আপনার দুহিতার পাণি পীড়ন করিতে বাসনা করি অতএব তাহার সহিত রহস্যালাপে স্বাতন্ত্র্য প্রদানাজ্ঞা হয়। পরে আপনার পরিচয় প্রদান চ্ছলে সশ্লেষ বচনে নিবেদন করিলেন কামিনীর সুনীতি বিনীতি এবং সৎ প্রকৃতির বিষয় পরম্পরায় অবগত হইয়া তাঁহার প্রেমাভিলাষে বেরোনা নগর হইতে আসিয়াছি। ব্যাপ্তিস্তা যদিও তনয়ার পরিণয় নির্ব্বাহ নিমিত্ত ব্যস্ত সমস্ত ছিলেন তথচ তাহার পরিচয় দিয়া আত্মমুখে ব্যক্ত করিতে বাধ্য হইলেন আমার কন্যা সুশীলা নহেন কেননা তৎক্ষণেই তাহার অসৎ স্বভাবের একটা লক্ষণ সকলের সমক্ষে প্রকাশমান হইল। কেথারিনের বাদ্যশিক্ষক সাতিশয় বেগে ধাবমান হইয়া নিকটে আগমন পূর্ব্বক ম্লানমুখে বিমর্ষ প্রকাশ করত কহিতে লাগিল মহাশয় আমার শিষ্যা কীদৃশী সুশীলা অবলোকন করুন্ বাদ্য বিষয়ে দোষানুভব করিয়া বীণাঘাতে আমার মস্তক ভগ্ন করিয়া দিল। পেত্রুসিও বাদ্যোপদেশকের প্রমুখাৎ এতাব্দৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া ব্যাপ্তিস্তাকে কহিলেন আহা যুবতীর কি সাহস? মহাশয়, প্রণয়ানুবন্ধন নিমিত্ত কামিনীর সহিত কথোপকথন করিতে আমার আরো মহৎ ঔৎসুক্য জন্মিল। পরে প্রার্থিত বিষয়ে আশু প্রত্যুত্তর প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নিবেদন করিলেন মহাশয় আমি কর্ম্মান্তরে ব্যস্ততা প্রযুক্ত প্রত্যহ আপনকার সন্নিধানে আগমন করিতে পারিব না। আমার জনকের সহিত আপনার আলাপ পরিচয় ছিল সম্প্রতি তাঁহার লোকান্তর প্রাপ্তি হইয়াছে আমি তদীয় স্থাবরাস্থাবর সমুদায় বিভবে অধিকারী হইয়াছি। আপনকার তনয়ার প্রণয়েৎপাদন পুরঃসর যদিস্যাৎ তাহাকে পরিণয় করি তবে আপনি দুহিতাকে কি যৌতুক প্রদান করিবেন অঙ্গীকার করুন। ব্যাপ্তিস্তা মনোমধ্যে বিতর্ক করিতে লাগিলেন এ ব্যক্তি প্রেম পদার্থ কি, বোধ হয় অবগত নহে, যাহা হউক, দুহিতাকে পাত্রসাৎ করা আবশ্যক, এ ব্যক্তি স্বতঃ পাণি গ্রহণে আগ্রহান্বিত অতএব আর কাল বিলম্ব বিধেয় নহে। এই বিবেচনা করিয়া উত্তর করিলেন আমি কন্যাকে আপাততঃ বিংশতি সহস্র মুদ্রা যৌতুকস্বরূপে প্রদান করিব পরে পরলোক যাত্রা কালে সমস্ত ধন সম্পত্তির অর্দ্ধাংশ দিয়া যাইব। পেত্রুসিও ইহাতে সম্মত হওয়াতে বিবাহ সম্বন্ধ অবধারিত হইল। অনন্তর ব্যাপ্তিস্তা সানন্দ মনে নন্দিনীর সদনে গমন পূর্ব্বক তদীয় প্রণয়ার্থির আবেদন জ্ঞাপন করিলেন এবং পেত্রুসিওর সহিত প্রেমালাপ করণার্থ তাহাকে পাঠাইয়া দিলেন।

 ব্যাপ্তিস্তা গমন করিলে পর পেত্রুসিও একাগ্রচিত্তে চিন্তা করিতেছিলেন কামিনীর সহিত কিরূপে আলাপ করিব এবং তদর্থ বিবিধ বিষয়ের আন্দোলন করত মনোমধ্যে কহিতেছিলেন কর্কশা আগমন করিবা মাত্র তদীয় প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত অগ্রে আমি সুমধুর বচনে কথোপকথন আরম্ভ করিব। তাহাতে যদিস্যাৎ তিনি স্বভাব দোষে অসন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক তিরস্কার করেন ক্ষুব্ধ বা ভগ্নচিত্ত হইব না বরং সহাস্য আস্যে প্রশংসা পুরঃসর কহিব প্রিয়ে বুলবুল পক্ষিণীর তুল্য কি চমৎকার স্বরে মধুর গান করিতেছ। প্রেয়সী যদি রোষ পরবশ হন তবে ললিত বচনে এতাবন্মাত্র বলিব আহা তোমার বদনের শোভা অভিনব বিকসিত শিশির রসাভিষিক্ত গোলাব কুসুমের তুল্য কি চমৎকার হইল। যদি আমার সহিত আলাপ না করেন বিনা প্রসঙ্গেই তদীয় বক্তৃতা শক্তির ভূরি২ প্রশংসা করিব। অপর প্রিয়া আসিয়া উপস্থিত হইলে আমি স্বয়ং তাঁহার সন্নিধানে উপবেশন করিব তাহাতে যদি অন্তরে যাইবার আদেশ করেন তবে এতাদৃক্‌ ভঙ্গি করিয়া অগণ্য ধন্যবাদ প্রদান করিব যেন তাহার সহিত সপ্ত দিবস ব্যাপিয়া সহবাস করিবার অনুমতি দিলেন। প্রণয়ানুবন্ধনের নিমিত্ত মনে এই সকল উপায় কল্পনা করিতেছেন ইতিমধ্যে কর্কশা কেথারিন্ আসিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মানা হইলেন কিন্তু বাঙ্নিষ্পত্তি করিলেন না। পেত্রুসিও প্রেয়সীর সহিত আলাপ নিমিত্ত স্বয়ং সম্ভাষণ পুরঃসর কহিলেন কেত নমস্কার। সুন্দরি আমি তোমার এই সংজ্ঞা শ্রবণ করিয়াছি। কর্কশা তদীয় অভ্যর্থনায় আনন্দ প্রকাশ না করিয়া অশ্রদ্ধা পূর্ব্বক কর্কশ বাক্যে কহিলেন যাহারা আমার সঙ্গে কথা কহে তাহারা কেথারিন্ বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাকে। পেত্রুসিও সরস বচনে উত্তর করিলেন হে সুলোচনে তোমার এ কথা অলীক, কেননা তোমাকে কেহ কেবল কেত কেহবা কান্ত কেত বলিয়া আহ্বান করিয়া থাকে এবং অনেকের নিকট কর্কশা কেথারিন্ বলিয়াও বিখ্যাত আছ। যাহা হউক হে কেত খ্রীষ্টিয়ান রাজ মধ্যে তোমার রূপ লাবণ্য ও সুশীলতার গৌরব প্রচরদ্রূপ। আমি তোমার রূপ গুণের খ্যাতি নগরে২ শ্রবণ করত ত্বদীয় পাণি পীড়নাশয়ে এখানে আসিয়াছি।

 অনন্তর তাঁহাদের পরস্পর প্রণয়ালাপ আশ্চর্য্য প্রকারে প্রবর্ত্তমান হইল। কেথারিন্ রোষ প্রকৃতির পরবশতা প্রযুক্ত পরুষ বচন প্রয়োগ পূর্ব্বক উচ্চস্বরে সম্ভাষণ করিতে আরম্ভ করিলেন তাহাতে তাঁহার কর্কশা উপাধি প্রাপ্তির হেতু স্বতঃ প্রকাশমান হইতে লাগিল। কিন্তু সুরসিক পেত্রুসিও তাঁহার পারুষ্যে রুষ্ট বা বিরক্ত না হইয়া সরস বচনে কথোপকথন করিতে থাকিলেন এবং মধ্যে২ বারম্বার বিলাসিনীর বাক্যের প্রশংসা করত কহিতে লাগিলেন আহা সুন্দরি তোমার বাক্য কি মধুর। ত্বদীয় বচন শ্রবণে আমার শ্রবণেন্দ্রিয় যেন সুধাভিষিক্ত হইতেছে। কিয়ৎ কাল বিলম্বে সংবাদ পাইলেন কামিনীর পিতা তথায় আগমন করিতেছেন অতএব পরিণয়ের বিষয় অবধারিত করিবার আশয়ে সুন্দরীকে সম্বোধন পূর্ব্বক বলিলেন প্রিয়ে এখন অনর্থক কথা বার্ত্তা ত্যাগ কর তুমি আমার পরিণীতা বনিতা হও এতদ্বিষয়ে তোমার পিতার সম্পূর্ণ মত আছে এবং তন্নিমিত্ত যৌতুকের বিষয় ধার্য্য করিয়াছেন, এক্ষণে তোমার মত হউক বা না হউক আমি তোমাকে বিবাহ করিব।

 এই কথোপকথনের কালে ব্যাপ্তিস্তা তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলে পেত্রুসিও সন্তোষ প্রকাশ পুরঃসর তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন আপনকার কন্যা যথোচিত অভ্যর্থনা করিয়া অঙ্গীকার করিলেন আগামি রবিবারে আমার গলে বরমাল্য প্রদান করিবেন। কামিনী এতদ্বাক্যে বৈরক্তি ব্যক্ত করত জনক সন্নিধানে নিবেদন করিলেন তাত ইহার সকল কথাই অলীক, এ ব্যক্তিকে বরণ করা অন্তরে থাকুক বরং আমার এবম্বিধ বাসনা ভাবি ভানু বাসরে যেন ইহাকে উদ্বন্ধনে লম্বমান দেখিতে পাই। হে পিতঃ এ অতি দুরাচার উন্মত্ত, আপনি আমার জনক হইয়া কি বিবেচনায় ইহাকে বরপাত্র করিতে অবধারিত করিয়াছেন? পেত্রুসিও সীমন্তিনীর ঈদৃশ সরোষ বচন শ্রবণেও নির্বিকার আকারে তদীয় তাত সমক্ষে কহিতে লাগিলেন মহাশয় আপনি নিজ অঙ্গজার এই অনুযোগে মনোযোগ করিবেন না, আপনার কন্যা আমাকে কহিয়াছেন আপনকার সমক্ষে পরিণয়ে অনিচ্ছা প্রকাশ করিবেন। আপনি এখানে পদার্পণ করিবার পূর্ব্বে আমরা দুই জন যখন নির্জ্জনে ছিলাম আপনার তনয়া আমার প্রতি কতই প্রেমানুরাগ ব্যক্ত করিতেছিলেন। পরে প্রেয়সীর প্রতি কোমল সম্বোধন পূর্ব্বক উক্তি করিলেন অয়ি কেত তোমার নিমিত্ত সুশোভন বৈবাহিক বসন ক্রয় করিতে সংপ্রতি বেনিস্ নগর গমন করি, পাণি প্রদান পূর্ব্বক বিদায় দাও। অনন্তর ব্যাপ্তিস্তাকে বলিলেন মহাশয় কন্যাযাত্রিদিগকে নিমন্ত্রণ এবং ভোজের আয়োজন করুন। আমি বসন ভূষণ সঙ্কলন পুরঃসর ত্বরায় প্রত্যাগমন করিতেছি আপনকার কন্যাকে স্বলঙ্কৃতা করিব। পরে পুনর্ব্বার প্রিয়তমার প্রতি সস্পৃহ নয়ন নিক্ষেপ করত কহিতে লাগিলেন প্রিয়ে একবার চুম্বন প্রদান কর আর কি, আমাদের শুভ বিবাহ আদিত্য দিবসে সম্পন্ন হইবেক। এই বলিয়া স্বয়ং তদীয় অধর চুম্বন পূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন।

 অনন্তর দিনকর দিন সমাগত হইলে উপযমের সমাজ সুসজ্জীভূত হইল। নিমন্ত্রিত ব্যক্তিরা সমাগমন পুরঃসর যথাস্থানে অধিষ্ঠান করিলেন এবং অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত বর পাত্রের আগমন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিন্তু কেথারিন্ পরিষদ্ মধ্যে পদার্পণাবধি এই ভাবিয়া অনবরত বাষ্প বিসর্জ্জন করিতেছিলেন পেত্রুসিও তাঁহার সহিত পরিহাস করিয়া গিয়াছেন। সে যাহাহউক। কিয়ৎ ক্ষণ পরে বর বিবাহের সভায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। কিন্তু পাণি গ্রহণ নিমিত্ত অঙ্গীকৃত বসন ভূষণ কিছুই তাঁহার সঙ্গে ছিল না এবং আপনিও বিবাহার্থির তুল্য বহুমূল্য পরিচ্ছদ পরিধান করেন নাই, সামান্য বস্ত্রে কলেবর আবরণ পুরঃসর পরিষদে প্রবেশ করিলেন। অপর তাঁহার যে কএক জন কিঙ্কর শকটোপরি আরোহণ করিয়া সমভিব্যাহারে আসিল তাহারাও যৎকুৎসিত বেশ ধারণ করিয়াছিল।

 পারিষদ্ পুরুষেরা পরিচ্ছদ পরিবর্ত্তন নিমিত্ত পেত্রুসিওকে অনেক অনুরোধ করিলেন কিন্তু কোন প্রকারে তদ্বিষয়ে তাঁহার প্রবৃত্তি হইল না। বসনের কথায় পরিহাস পূর্ব্বক সভ্যদিগকে কহিলেন কেথারিন্ আমাকে বিবাহ করিবেন পরিচ্ছদ পরিণয় করিবেন না অতএব অপকৃষ্ট বস্ত্র অঙ্গে থাকিলে হানি কি? অনন্তর সভাসদ্‌গণ তাঁহার সহিত বসন পরিবর্ত্তনের বিতণ্ডা বিফল দেখিয়া আশু শুভ কর্ম্ম সম্পাদন মানসে বর কন্যা সমভিব্যাহারে ধর্ম্মশালায় প্রবেশ করিলেন। পেত্রুসিও সেখানে গিয়া ক্ষিপ্তের ন্যায় আচরণ করিতে লাগিলেন। পুরোহিত যখন তাঁহার প্রতি প্রশ্ন করিলেন কেথারিন্ কি তোমার বনিতা হইবেন? তখন অত্যুচ্চ কর্কশ স্বরে উত্তর দিলেন হাঁ ইনি আমার ভাবি বনিতা। তাঁহার অকস্মাৎ গগণ স্পর্শি নীরস চীৎকার শ্রবণে সকলে সাতিশয় বিস্ময়াকুল হইল এবং পুরোহিতের কর হইতে পরিণয় পুস্তক ভূতলে পড়িয়া গেল। অনন্তর যাজক হস্ত ভ্রষ্ট পুস্তক পুনর্ব্বার গ্রহণ নিমিত্ত যেমন নত হইতেছিলেন তৎকালে বরপাত্র তাঁহার উপরি এরূপ একটা মুষ্টি প্রহার করিলেন যে তদাঘাতে পুরোহিত ভূমিতলে পড়িয়া অবলুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। অপর যাবৎ উদ্বাহের ব্যাপার সমাধা হইতে ছিল তাবৎ পর্য্যন্ত বরপাত্র বাতূলতা প্রকটন পুরঃসর এবম্প্রকারে অবনীর উপর পদাঘাত ও উচ্চস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করিতেছিলেন যে তদীয় ভাব ভঙ্গি অবলোকনে সাহসি কেথারিনেরও অন্তঃকরণ ভয়ে ব্যাকুল এবং কলেবর কম্পমান হইতে ছিল। সে যাহা হউক পাণিগ্রহণ ব্যাপার সমাধা হইলে বরপাত্র পানপাত্র গ্রহণ পুরঃসর সুরা সেবন করিতে বসিলেন এবং হস্তে চষক গ্রহণ পূর্ব্বক চীৎকার স্বরে সভাস্থ সকলের কুশল প্রার্থনা করিলেন। অনন্তর পান করিয়া চষকের অবশিষ্ট আসব ধর্ম্মশালাস্থ পরিচারকদিগের বদনে নিক্ষেপ করত কহিলেন তোমাদের শ্মশ্রুলোম সূক্ষ্মরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং সুধা সেবন সময়ে আমার অনুমান হইয়াছিল যেন এই চষকের তলস্থ বস্তুতে তোমরা স্পৃহান্বিত অতএব অবশিষ্ট অংশ তোমাদিগকে প্রদান করিলাম। এতদ্রূপে ঈদৃক্ বাতুলতা প্রকাশ করিলেন যে বিবাহের সমাজে কেহ কদাপি তাদৃশ অদ্ভুত উন্মত্ততা অবলোকন করেন নাই। কিন্তু পেত্রুসিও কেবল প্রেয়সীর কর্কশ প্রকৃতির দমন মানসে এই সমস্ত অভব্য ব্যবহার করিলেন।

 ব্যাপ্তিস্তা দুহিতার বিবাহোপলক্ষে বন্ধু বান্ধব বর্গের ভোজের আয়োজন করিয়াছিলেন কন্যা ও জামাতাকে আলয়ে লইয়া তাঁহাদের সমক্ষে ঐ উৎসব করিবেন ঈদৃশ সংকল্প ছিল কিন্তু পেত্রুসিও বিবাহ সংস্কার সমাধা হইলে পর ধর্ম্মশালা হইতে বহির্গমন সময়ে পত্নীর পাণি ধারণ পূর্ব্বক কহিলেন সুন্দরি বৈবাহিক ব্যাপার সম্পন্ন হইল চল এক্ষণে আপনাদের ভবনে গমন করি। ব্যাপ্তিস্তা উক্ত কারণে তৎক্ষণেই বিদায় দিতে অনিচ্ছুক হইয়া জামাতাকে নিষেধ করিলেন এবং তাহাদিগকে স্বীয় আবাসে লইয়া যাইবার নিমিত্ত যত্ন করিতে লাগিলেন। অপর কেথারিন্ কোপে কম্পমানা হইয়া বিবিধ কটূক্তি করিল। কিন্তু পেত্রুসিও শ্বশুরের অনুরোধ রক্ষণ অথবা অধীরা রমণীর সরোষ পরুষ বচন শ্রবণ করিলেন না, ভার্য্যার উপর ভর্ত্তার যে ক্ষমতা আছে তন্মাত্র প্রার্থনা করিলেন। পরে এক্ষণে আমি স্বীয় সীমন্তিনীর সহিত যথেচ্ছ ব্যবহার করিব এই কহিয়া কেথারিনের করাকর্ষণ পূর্ব্বক প্রস্থান করিলেন। তাঁহার স্থির প্রতিজ্ঞতা ও সাহস দর্শনে দর্শকগণ বিস্ময়াপন্ন হইল কাহার ভরসা হইল না যে নিবৃত্ত করণার্থ গমনে বাধা দেয়।

 পেত্রুসিও নব দারকে আগারে লইয়া যাইবার নিমিত্ত একটা কুৎসিত কৃশ ঘোটক নির্ব্বাচন পূর্ব্বক সমভিব্যাহারে আনয়ন করিয়াছিলেন সেই অশ্বে অভিনব পরিণীতা বনিতাকে আরোহণ করাইলেন এবং আপনিও ভৃত্য সহ তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট তুরঙ্গে আরূঢ় হইলেন না সুতরাং সকলেই বাহন দোষে অসমান ও পঙ্কিল পথে গমন করিতে লাগিলেন অধিকন্তু কেথারিনের দুর্ব্বল ঘোটক বারম্বার স্খলিত পদ হইতে লাগিল। পেত্রুসিও সেই অকর্মণ্য পশুর উপলক্ষে কল্পিত কোপ প্রকাশ পুরঃসর বিবিধ ভর্ৎসন ও তর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিলেন অথচ সেই তুরঙ্গ স্বয়ং মনোনীত করিয়া আনেন। সে এবম্প্রকার ক্ষীণ ও দুর্ব্বল ছিল যে আপনার দেহের ভার বহনেই অশক্ত হইয়া সহজে ধীরে২ পদক্ষেপ করিত।

 যাহা হউক বাহন দোষে বর্ত্ম মধ্যে মহাকষ্ট হইলেও পেত্রুসিও পরিশেষে ভৃত্য কলত্র সমভিব্যাহারে স্বাবাসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার নবোঢ়া নায়িকা বিশেষ ক্লান্তিযুক্ত এবং সেই ক্লান্তির সঙ্গে অনবরত কান্তের ও কিঙ্করের তুরগোপলক্ষে তর্জ্জন গর্জ্জন শ্রবণ করাতে সাতিশয় খিন্ন হৃদয়া হইয়াছিলেন। পেত্রুসিও স্বভাবতঃ শিষ্ট প্রকৃতি ও মিষ্ট ভাষী অতএব জায়াকে আলয়ে প্রবেশ করাইয়া অভ্যর্থনা করত একবার তাহার সহিত শিষ্টালাপ করিলেন। কিন্তু সে দিবস সীমন্তিনীকে দিবাভাগে ভোজন অথবা নিশা সময়ে শয়ন পূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে দিলেন না। আহারীয় দ্রব্য সামগ্রী প্রস্তুত হইলে যখন ভোজন স্থানে সে সকলের পরিবেশন হইল তখন আসনে বসিয়া আদৌ আপনি প্রত্যেক পাত্রস্থ ভক্ষ্য পেয়ে হস্তার্পণ পূর্ব্বক কিঞ্চিৎ মুখে দিলেন পরে কপটতা পূর্ব্বক অপকৃষ্ট বলিয়া ক্রমশঃ সমুদায় ভূমিতে নিক্ষেপ করিয়া দিতে লাগিলেন শেষে কিঙ্কর দিগকে সেই সমস্ত খাদ্য স্থানান্তর করিতে আদেশ করিয়া কহিলেন অদ্য আহারীয় দ্রব্য কিছুই উত্তমরূপে প্রস্তুত হয় নাই প্রিয়াকে ঈদৃশ বিরস সামগ্রী ভোজনার্থ প্রদান করিতে পারি না। কেথারিন্ একে অধ্বখিন্না ছিলেন তাহাতে আবার বুভুক্ষার সময় আহার পাইলেন না সুতরাং যৎপরোনাস্তি শীর্ণ ও ম্লান হইলেন এবং অবসন্ন হইয়া কিয়ৎ ক্ষণ বিলম্বে শয়নার্থ গমন করিলেন। পেত্রুসিও ভোজন কালে যদ্রূপ ছল করিয়া প্রিয়ার অবসাদ বৃদ্ধি করিলেন শয়ন সময়েও তাদৃশ আচরণে প্রবৃত্ত হইলেন। পত্নীর সহিত শয়নার্থ গমন করিয়া পর্য্যঙ্কোপরি আরোহণ পুরঃসর শয্যার দোষ আরোপ করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তন্নিমিত্ত কিঙ্করদিগকে অপরাধি করিয়া অনল্প রোষ প্রকাশ পূর্ব্বক তল্প ছিন্ন ভিন্ন করত উপধান আস্তর প্রভৃতি নিম্নে নিক্ষেপ করিয়া দিলেন সুতরাং কামিনীকে কাষ্ঠময় খট্টায় বাহুলতা বালিশ করিয়া শয়ন পূর্ব্বক যামিনী যাপন করিতে হইল। তথাপি শ্রান্তি ও ক্ষুধা জন্য অবসাদে তাহার নয়ন দ্বয় নিদ্রায় আকৃষ্ট হইতে লাগিল, কিন্তু পেত্রুসিও নবোঢ়া ভার্য্যার কদর্য্য শয্যা নিমিত্ত ভৃত্যবর্গের প্রতি অনবরত কপট তর্জ্জন করাতে সমস্ত নিশা বিনিদ্র হইয়া রহিল।

 রজনী প্রভাতা হইলে পেত্রুসিও প্রেয়সীর সহিত পূর্ব্বদিনের ব্যবহার করিলেন অর্থাৎ অন্য সময়ে মধুরালাপ করিয়া প্রীতি দর্শাইলেন কিন্তু যখন তাহার সহিত আহার করিতে গেলেন তখন গত রাত্রিতে যদ্রূপ অভ্যবহারের দ্রব্য সামগ্রী ফেলিয়া দিয়াছিলেন সেই প্রকারে সকল খাদ্য জঘন্য বলিয়া ভূতলে বিস্তীর্ণ করিয়া দিলেন সুতরাং পরদিনেও কেথারিনের ভোজন হইল না। তিনি বুভুক্ষায় একেবারে নির্জীব হইয়া পড়িলেন এবং ভৃত্যদের নিকট গোপনে কিঞ্চিৎ অভ্যবহারের দ্রব্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার স্বামির শিক্ষানুসারে একে২ সকল কিঙ্কর কহিল কর্ত্তার অগোচরে একটী তিল কাহাকেও প্রদান করিতে আমাদের সামর্থ্য নাই। অতএব কর্কশা নৈরাশ্যাপন্না হইয়া বিষাদ করত কহিতে লাগিলেন হায় পেত্রুসিও কি উপোষণ দ্বারা দেহ শোষণ পুরঃসর সংহার করিবার নিমিত্ত মদীয় পাণি পীড়ন করিলেন। আহা আমার জনকের পুরদ্বারে কত শত দীন দরিদ্র লোক অনায়াসে অন্ন পাইতেছে আমি এখানে কিঞ্চিৎ খাদ্য দ্রব্যের নিমিত্ত কাতর। আমি ধনি বদান্য পিতার নন্দিনী, আহারীয় সামগ্রীর নিমিত্ত কি প্রকার বিনয় করিতে হয় কখন জানি না। আহা অন্নাভাবে দুর্বল ও নিদ্রাভাবে ক্ষীণ হইয়া মৃতপ্রায় হইলাম। স্বামী শয়ন সময়ে শয্যার দোষ উদ্ভাবন পূর্ব্বক ভৃত্যেরদের প্রতি আক্রোশ করত চীৎকারে যামিনী যাপন করেন, ভোজন কালে আহারীয় সামগ্রী প্রস্তুত করণের ত্রুটি প্রদর্শন পূর্ব্বক সকল খাদ্য নষ্ট করিয়া ফেলেন, কিঞ্চিন্মাত্র অশন করিতে দেন না। আমার সহিত অহোরাত্র এতদ্রূপ নিষ্ঠুর ব্যবহার করিতেছেন অথচ মুক্তকণ্ঠে বলিয়া থাকেন আমাকে অতিশয় ভাল বাসেন ও চতুরতা প্রকাশ করিয়া ব্যঙ্গ করেন। কামিনী এবম্প্রকারে আক্ষেপ করিতেছেন ইত্যবসরে পেত্রুসিও অসিয়া উপস্থিত হওয়াতে তাঁহাকে অবলোকন করিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। অনাহারে ললনার প্রাণ বিনাশ করিবেন পেত্রুসিওর ঈদৃশ মানস ছিল না অতএব কিঞ্চিৎ আহারীয় সামগ্রী সমভিব্যাহারে আনয়ন করিলেন এবং তাহা বহিষ্করণ পূর্ব্বক আপনার করতলে লইয়া প্রেয়সীর সম্মুখবর্ত্তী হওত জিজ্ঞাসা করিলেন ভাবিনি কেমন্ আছ, এ দিকে একবার কটাক্ষ পাত হউক, আমি কীদৃক্ কর্ম্মঠ নিরীক্ষণ কর স্বহস্তে তোমার নিমিত্ত খাদ্য প্রস্তুত করিয়া আনিলাম। প্রিয়ে আমি তোমার প্রেমে আসক্ত হইয়া এবম্প্রকার স্নেহবান্ ইহাতে অসংশয় তোমার ধন্যবাদাস্পদ হইতে পারি, বাঙ্‌নিষ্পত্তি করিতেছ না কেন? এ আহারীয় দ্রব্য কি মনোনীত হইল না? কামিনী এতাবৎ উক্তিতে কোন উত্তর না দেওয়াতে কিয়ৎ ক্ষণ পরে নিকটস্থ ভৃত্যকে আজ্ঞা করিলেন তবে ভক্ষ্য সামগ্রীর পাত্র স্থানান্তরিত কর। কেথারিন্ জঠর জ্বালায় অধীরা এবং বুভুক্ষায় বিগত গর্ব্বা হইয়াছিলেন যদিও পরিণেতার অত্যাচারে অন্তঃকরণ কোপে পরিপূর্ণ ছিল তথাপি ক্ষুধার ক্লেশ অসহিষ্ণু হইয়া জীবন রক্ষণ মানসে মৃদুস্বরে বলিলেন নিবেদন করি খাদ্য স্থাপনে অনুমতি হউক। পেত্রুসিও প্রেয়সীর মুখে এবম্বিধ বিনয়গর্ভ বচন শ্রবণ করিয়া যদিও অন্তর্হৃষ্ট হইলেন তথাপি প্রিয়াকে তাবন্মাত্র পরিমাণে সুধীরা করণের অভিপ্রায় না থাকাতে অশন সামগ্রী পুনঃ স্থাপনের আদেশ করিবার পূর্ব্বে তাহাকে কহিলেন সামান্য উপকার করিয়াও লোকে ধন্যবাদ প্রাপ্ত হয়, আমি স্বহস্তে তোমার নিমিত্ত এই খাদ্য প্রস্তুত করিয়াছি অতএব স্পর্শ করণের অগ্রে আমাকে নমস্কার করা উচিত। কেথারিন্ ক্ষুধার দায়ে অগত্যা সবিনয় বাক্যে বলিলেন মহাশয় আপনাকে অভিবাদন করি। পরে পেত্রুসিও সেই যৎ সামান্য অদনীয় তাঁহার বদনে প্রদান পূর্ব্বক বলিলেন কেত এ উপকারি খাদ্য শীঘ্র ভোজন কর। প্রিয়ে চল অতঃপর অমরা পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদ পরিধান পূর্ব্বক তোমার পিত্রালয়ে গমন করি। তদনন্তর বসন ভূষণে ভূষিত করিবার প্রতিজ্ঞায় বনিতার বিশ্বাসাধান নিমিত্ত ইতি পূর্ব্বে যে সূচিজীবি ও বস্ত্র বিক্রয়ি দিগকে নূতন বসন প্রস্তুত করিতে আদেশ করিয়াছিলেন তাহাদিগকে আহ্বান করিতে লোক প্রেরণ করিলেন। তৎপরে ক্ষুধার্ত্তা কেথারিনের অর্দ্ধাশন না হইতে২ সম্মুখ হইতে ভোজন পাত্র অপসৃত করিয়া কিঙ্করের করে সমর্পণ করিলেন এবং আজ্ঞা দিলেন স্থানাস্তরে রাখিয়া আইস। অনন্তর প্রেয়সীর প্রতি প্রিয় বচনে প্রশ্ন করিলেন কেমন্ তোমার আহার হইয়াছে? ইত্যবসরে বসনবিক্রয়ী আসিয়া উপস্থিত হইল এবং সমভিব্যাহারে আনীত অভিনব শিরোবসন সম্মুখে ধারণ করিল। পেত্রুসিও সেই শিরোবসন করে ধারণ পূর্ব্বক চতুর্দিক নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন এ সুদৃশ্য হয় নাই লইয়া আপনার আলয়ে গমন কর বৃহদাকারে পুনর্বার প্রস্তুত করণানন্তর আনিয়া দিও। কেথারিন্ সেই শিরোবসন দর্শন করিয়া কান্তকে কহিলেন অমি ইহা গ্রহণ করিতে অভিলাষ করি ইদানী ভদ্র কুলাঙ্গনাগণ এতাদৃশ বস্ত্র ধারণ করিয়া থাকেন। পেত্রুসিও প্রিয়ার এই প্রার্থনায় প্রতিবচন প্রদান করিলেন তুমিও যখন ভদ্র হইবে তখন এপ্রকার বস্ত্র প্রাপ্ত হইবে কিন্তু যাবৎ স্বভাবের সংশোধন না কর তাবৎ ঈদৃশী আশা অন্তরে রাখ। কেথারিন্ যদিও বুভুক্ষা নিবৃত্তি পূর্ব্বক আহারীয় সমস্ত দ্রব্য অভ্যবহার করিতে পান্ নাই তথাপি যৎকিঞ্চিৎ অশনে বলাধান হইয়াছিল অতএব নৈসর্গিক পরুষ প্রকৃতি ধারণ পূর্ব্বক বলিলেন মহাশয় আমাকে কথা কহিতে অনুমতি করুন অথবা আমি অবশ্যই উত্তর প্রত্যুত্তর করিব কেননা অব্রুবাণা নহি, আপনি বা কি বিজ্ঞতার অভিমান করেন, আপনা অপেক্ষা মান্য সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থির হইয়া আমার কথা কত বার আকর্ণন করিয়াছেন, যদিস্যাৎ আপনি শ্রবণে অসহিষ্ণু হন্ বাধির্য্য অবলম্বন করুন্, আমি কথা কহিতে প্রবৃত্তা হই। পেত্রুসিও রমণীর এই সরোষ কর্কশ বচনে প্রণিধান করিলেন না কেননা বনিতার সহিত বিতণ্ডা না করিয়া বশীভূতা করিবার অন্য পন্থা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন অতএব সহজ কথায় উত্তর প্রদান করত কহিলেন তুমি যাহা কহিলে যথার্থ বটে কিন্তু এ আচ্ছাদন খানা বিজাতীয় বিশ্রী, ইহা মনোনীত না করিলে তোমার প্রতি সাতিশয় প্রীত হইব। কামিনী এতৎ শ্রবণে কর্কশ স্বরে কহিতে লাগিলেন ঐ বসনে আমার মনো মোহিত হইয়াছে অবশ্যই গ্রহণ করিব তদ্ভিন্ন অন্য লইতে চাহি না। পেত্রুসিও যেন পত্নীর সমস্ত কথা বুঝিতে পারিলেন না এবম্বিধ ভাব প্রদর্শন পূর্ব্বক কহিলেন প্রিয়ে তুমি কি অধোংশুক দর্শনের বাসনা করিতেছ এতদবসরে সূচিজীবী আসিয়া উপস্থিত হইল এবং পরিপাটী রূপে প্রস্তুতীকৃত হস্তাবরণ আর একটা ঘাঘরা আনিয়া তাঁহাদের সম্মুখে স্থাপন করিল। পেত্রুসিও সে সময় কোন সামগ্রী সীমন্তিনীর করে অর্পণ করিতে মানস করেন নাই এ কারণ ঐ২ পরিচ্ছদে দোষারোপ করত কহিলেন হাঃ পরমেশ্বর এ কি বসন, ওহে সৌচিক তুমি কি ইহাকে হস্তাবরণ বল, এ কি? ইহা যে যৎপরোনাস্তি কুৎসিত হইয়াছে। সৌচিক নিবেদন করিল মহাশয় অধুনাতন রীত্যনুসারে প্রস্তুত করিবার আদেশ হইয়াছিল তন্নিমিত্ত এবম্প্রকার করিয়াছি। কেথারিন্ কহিলেন কেন এতো উত্তম হইয়াছে, এতদপেক্ষা উৎকৃষ্ট কদাপি দৃষ্ট হয় নাই। পেত্রুসিও সূচিজীবির লাঞ্ছনা দ্বারা পত্নীর অপমান করিবার মানসে পূর্ব্বে ভৃত্যবর্গকে বলিয়া রাখিয়াছিলেন আমি সৌচিককে ভর্ৎসনা করিয়া বাটী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলে তোমরা বসনের প্রকৃত মূল্য প্রদান পূর্ব্বক তাহার নিকট হইতে বস্ত্র গ্রহণ করিও এবং অকারণে বিমাননা নিমিত্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিও অতএব কামিনী বসনের গুণ বর্ণনে উদ্যম করিলে আপনি তাহা জঘন্য বলিয়া ঘৃণা করত সৌচিককে তিরস্কার পূর্ব্বক দূর করিয়া দিলেন। অনন্তর অঙ্গনার প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ পূর্ব্বক বলিলেন প্রিয়ে চল আমাদের যে সামান্য বসন আছে তাহাই পরিধান পুরঃসর তোমার পিত্রালয়ে গমন করি। পরে অশ্ব পালক দিগকে বাজি সুসজ্জিত করিতে আজ্ঞা দিয়া কহিলেন এখন বেলা সপ্তম ঘণ্টামাত্র, শ্বশুর মহাশয়ের আগারে ভোজন সময়ে অনায়াসে উপনীত হইতে পারা যাইবেক। বস্তুতঃ যখন তিনি শ্বশুরালয়ে গমনের প্রসঙ্গ করেন তখন প্রাতঃকাল নয়, দ্বিতীয় প্রহর অতীত হইয়াছিল। কেথারিনের পরুষ প্রকৃতি স্বামির এবম্বিধ উগ্র স্বভাবে পরাভূত হইল। মহিলা সুশীলতা অবলম্বন পূর্ব্বক ললিত বচনে আপনার নাথকে নিবেদন করিলেন মহাশয় মধ্যাহ্ণের উপর বরং পাঁচ দণ্ড অতীত হইয়াছে অতএব আমার পিতৃ ভবনে দিবা ভোজনের মানস পরিত্যাগ করুন বরং নিশার অশন হইবে। কিন্তু পেত্রুসিও মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলেন কান্তাকে তদীয় জনক নিকেতনে লইয়া যাইবার অগ্রে এবম্প্রকার বশতাপন্ন করিবেন যে কোন প্রস্তাবে অমত বা বিতণ্ডা করণে তাহার কদাপি প্রবৃত্তি না হয় অতএব কামিনীর বেলার কথায় আপনি যেন দিবাকরের কর্ত্তা এবম্বিধ ভঙ্গি করত কহিলেন যত ইচ্ছা করিব যাত্রার অগ্রে তাবন্মাত্র বেলা হইবে, আমি যাহা বলি ও করি এখনও তাহা খণ্ডন করিতেছ, এই ক্ষণেই তথায় গমন করিব যাত্রাকালীন যত দণ্ড দিবামান কহিব তাহাই হইবেক। কেথারিন্ এক দিন আপনার প্রাক্তন প্রকৃতির দমন পূর্ব্বক নবপ্রকাশিত শান্ত স্বভাবের আচরণ করিয়াছিলেন কিন্তু যাবৎ তদীয় গর্ব্ব সম্পূর্ণ রূপে খর্ব্বতাপন্ন না হইল এবং সকল কথায় বাদ বিতণ্ডা করণাভ্যাস বিস্মৃতা না হইলেন তাবৎ পর্য্যন্ত পেত্রুসিও তাঁহাকে পিত্রালয়ে প্রেরণ করেন নাই। পরে যখন আপনি সমভিব্যাহারে লইয়া গমন করিলেন তখন পথিমধ্যে দিবা দ্বিপ্রহরের সময় প্রিয়াকে সম্বোধন করত কহিলেন সুন্দরি অবলোকন কর নিশাকর আকাশ মণ্ডলে উদিত হইয়া কেমন স্নিগ্ধ উজ্জ্বল প্রভা বিতরণ করিতেছেন। কেথারিন্ এ কথায় কান্তকে কহিলেন সে কি এখন যে দিবস, দিবাকর প্রখর করে অবনির রসাকর্ষণ করিতেছেন। পেত্রুসিও পত্নীর এই প্রকৃত উক্তিতেও কোপ প্রকাশ করিলেন এবং তাঁহার এই প্রাতিকূল্যাচরণাপরাধে তদীয় পিত্রালয় গমনে বিরতি অবলম্বন পূর্ব্বক আপন ভবনের প্রতি প্রতিনিবৃত্ত হইতে উদ্যত হইয়া কহিলেন কি আমার বাক্যে অন্যথা আশঙ্কা কর আমি আত্ম শপথ করিয়া বলিতেছি তোমার পিতৃ নিলয়ে গমনের অগ্রে চন্দ্র অথবা নক্ষত্র যাহা কহিব তাহাই হইবেক। অনন্তর এরূপ ভঙ্গি করিলেন যেন সদনে প্রত্যাগমন করেন তাহাতে কান্তা কেথারিন্ কর্কশ স্বভাব পরিহার পুরঃসর সুশীলা মহিলার তুল্য হইয়া সবিনয়ে নিবেদন করিলেন প্রভো অধিক পথ আসিয়াছি এখন এখান হইতে নিবৃত্ত হওয়া কর্ত্তব্য হয় না আমি করপুটে বিনয় করিতেছি চলুন অগ্রসর হই আপনি নভোমণ্ডলোদ্দীপক ঐ জ্যোতির্ময় পদার্থকে চন্দ্র বা সূর্য্য যাহা কহেন তাহাই বটে আপনি যদিস্যাৎ উহাকে প্রদীপ কহেন এক্ষণ অবধি তাদৃশোক্তিও সপ্রমাণ বোধ করিব। পেত্রুসিও প্রেয়সীর মুখ হইতে এবম্প্রকার বাক্য নির্গত হইতে কদাপি শ্রবণ করেন নাই যদিও এই উক্তিতে অন্তঃকরণ মধ্যে আকূত পূর্ণ হইলেন তথাপি প্রেয়সীর প্রকৃতির সম্পূর্ণরূপ পরিবর্ত্তন হইল কি না পরীক্ষা করিতে অভিলাষী হইয়া পুনর্ব্বার তাঁহাকে সম্বোধন করত কহিলেন প্রিয়ে আমি বলি ঐ গোল উজ্জ্বল বস্তু চন্দ্রমণ্ডল। কেথারিন্ কান্তের ছন্দানুবর্ত্তিনী হইয়া তৎক্ষণাৎ কহিলেন উহা হিমকর বটে আমারও বিদিত আছে। কামিনীর এই কথায় পেত্রুসিও বলিলেন তুমি অলীক কহিতেছ উহা চন্দ্র কেন? দিনমণি। কেথারিন্ স্বামির প্রাগল্‌ভ্যে বিনির্জিত হইয়াছিলেন তৎক্ষণাৎ তদীয় মনোরঞ্জনাশয়ে নিবেদন করিলেন তবে তাহাই বটে। হে নাথ যদি আপনি এখন এই পদার্থকে অসূর্য্য বলেন আমি আপনকার সহিত একবাক্য হইয়া তাহাই স্বীকার করিব। আপনি যে পদার্থের যে নামধেয় বিধান করিবেন তাহা তন্নামাই হইবে এবং আমি চিরকাল সেই সংজ্ঞাতে তাহা ব্যবহার করিব। পেত্রুসিও প্রেয়সীর এই কথা শুনিয়া মনোমধ্যে মহা হর্ষিত হইলেন এবং তাঁহাকে অগ্রসর হইতে অনুমতি করিলেন। কিন্তু বনিতার স্বভাব সম্পূর্ণ রূপে বিশোধিত হইল কি না এবং এবম্বিধ ছন্দানুবৃত্তি অবিচ্ছেদে প্রবর্ত্তমান থাকিবেক কি না এতদ্বিষয়ের পরীক্ষা নিমিত্ত যাইতে২ বর্ত্ম মধ্যে এক স্থবির পুরুষ নয়ন গোচর হওয়াতে তাহাকে কামিনী সম্বোধন করিয়া কহিলেন অয়ি সুশীলে ললনে তোমাকে নমস্কার করি। পরে সমভিব্যাহারিণী নিজ রমণীকে জিজ্ঞাসা করিলেন কেমন প্রিয়ে ঈদৃশী সুশ্রী যোষা কখন দর্শন করিয়াছিলে? অনন্তর সেই বৃদ্ধ পুরুষের আতাম্র গণ্ডস্থল এবং ঈষৎ শোণিত নয়ন দ্বয় নক্ষত্র নিকরের সহিত তুলনা করিয়া বিস্তর প্রশংসা করিলেন এবং পুনর্ব্বার বিলাসিনি বলিয়া সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন তোমাকে নমস্কার। শেষে স্বীয় প্রেয়সীর প্রতি কটাক্ষ নিক্ষেপ পুরঃসর বলিলেন মধুরিকে কেত, এই সুন্দরীর রূপ লাবণ্য কেমন চমৎকার? অগ্রসর হইয়া ইহাঁকে আলিঙ্গন কর। কেথারিন্ পতির অনুপম প্রগল্‌ভতায় সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত হইয়াছিলেন কান্তের অসঙ্গত কথায় বাঙ্‌নিষ্পত্তি না করিয়া তৎক্ষণাৎ বর্ষিষ্ঠের সন্নিকর্ষে গমন পূর্ব্বক মিষ্ট ভাষায় তাহার সহিত শিষ্টালাপ করত কহিলেন হে নবীন তরুণি আহা তোমার তারুণ্য লাবণ্য কি মনোহর। হে সুন্দরি কোথা হইতে আগমন করিতেছ? কোন স্থানে তোমার আবাস? যাহা হউক ধন্য তোমার পিতা মাতা, বুঝি তাঁহারদের পুণ্যের ইয়ত্তা নাই, আহা এতাদৃশী রূপ লাবণ্যান্বিতা কন্যা লাভ করিয়াছিলেন। অনন্তর পেত্রুসিও বশম্বদা যোষাকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন কেত তোমার এ কীদৃশ আলাপ, তুমি কি ক্ষিপ্ত হইয়াছ কেননা এ সকল যে উন্মত্ত প্রলাপ। মুগ্ধে যাহার সহিত কথোপকথন করিলে ইনি লোলিত কায় প্রাচীন পুরুষ, কুমারী নহেন, তোমার কি দৃষ্টি বিভ্রম হইয়াছে, সমক্ষে নিরীক্ষণ করিতেছ না? কেথারিন্ কান্তের এই কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ আপনার ভ্রম স্বীকার করিলেন পরে প্রাচীনকে সম্মান করত কহিলেন হে সম্ভ্রান্ত মহাশয় ক্ষমা করুন তপনের উত্তপ্ত আতপে মদীয় নেত্রের জ্যোতিঃ বিকৃত হইয়াছে সকলি ধূমবৎ দর্শন করি এই নিমিত্ত ভ্রান্ত হইয়া উক্ত প্রকার উক্তি করিয়াছি। এখন বিশেষ পর্য্যালোচনায় ভ্রান্তি দূর হইল এবং জানিতে পারিলাম আপনি আমার পিতৃ তুল্য মর্য্যাদাবান পুরুষ। অতএব অনুগ্রহ বিতরণ পুরঃসর অপরাধ মার্জ্জনা করুন। তৎপরে পেত্রুসিও প্রাচীনকে জিজ্ঞাসা করিলেন মহাশয় আপনি কোন দিকে গমন করিবেন আমরা যে পথে গমন করিতেছি আপনকার যদিস্যাৎ এই পন্থা হয় পরম হর্ষে সমভিব্যাহারে যাত্রা করিব। স্থবির তাহাদিগের উভয়কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন হে তরুণ হে তরুণি তোমরা আমার উপলক্ষে কি বাক্‌কলহ করিতেছিলে? তোমাদের দুই জনের বাগ্বিতণ্ডা শ্রবণে সাতিশয় চমৎকৃত হইয়াছি। হে যুবক আমার নাম ভিন্‌সেন্‌সিও, আমার পুত্র পাদুয়া পুরে রহিয়াছেন, তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত তথায় যাইতেছি। ইহাতে পেত্রুসিও প্রচীনের পরিচয় পাইলেন যে ব্যাপ্তিস্তার কনিষ্ঠা কন্যা বাএন্‌কার সহিত যে সম্ভ্রান্ত লিউসেন্‌সিওর পরিণয় নির্ণীত হয় এই ব্যক্তি তাঁহার জনক। অতএব বর্ষিষ্ঠকে যথেষ্ট সমাদর করত এই শুভ সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন মহাশয় আপনার আত্মজের অত্যুত্তম বিবাহ সম্বন্ধ হইয়াছে। বৃদ্ধ এই শুভ সমাচার অবগত হইয়া হর্ষে পুলকিত হইলেন এবং সপত্নীক পেত্রুসিও সমভিব্যাহারে পরম কৌতুকে কথোপকথন করিতে২ গমন করিয়া ব্যাপ্তিস্তার সদনে উপনীত হইলেন। সে দিবস সেখানে বাএন্‌কা ও লিউসেন্‌সিওর উদ্বাহ ব্যাপার নির্ব্বাহ নিমিত্ত মহতী সভা এবং ভূরি লোকের সমাগম হইয়াছিল। ব্যাপ্তিস্তা জ্যেষ্ঠা তনয়াকে পাত্রস্থ করণানন্তর প্রীতি ফুল্ল চিত্তে কনিষ্ঠা নন্দিনীর বিবাহের সমারোহ করিয়াছিলেন।

 অতএব বৈবাহিক এবং জামাতৃ সমভিব্যাহারিণী জ্যেষ্ঠা দুহিতা আলয়ে আসিয়া উপস্থিত হইলে কন্যাসম্প্রদাতা ব্যাপ্তিস্তা অসীম সন্তোষ প্রকাশ পুরঃসর আহ্লাদিত হইয়া উদ্বাহোৎসবে মিলিত হইবার নিমিত্ত তাঁহাদের অভ্যর্থনা করিলেন। এই সময়ে আর দুইটী অভিনব কৃতোদ্বাহ যুবক যুবতী তথায় উপস্থিত ছিলেন।

 বিবাহের ব্যাপার শেষ হইলে বাএন্‌কার স্বামী লিউসেন্‌সিও এবং উল্লেখিত নব বিবাহিত যুবক হার্তেন্‌সিও এই দুই জনে পেত্রুসিওর প্রণয়িনীর পরুষ প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য করিয়া ব্যঙ্গ করিতে আরম্ভ করিলেন এবং পরিহাস পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন স্ত্রী ভাগ্য সুকৃত সাপেক্ষ, আমরা কেমন সুশীলা সরলা মহিলা লাভ করিলাম, পেত্রুসিওর অদৃষ্টে অধীরা রমণী ঘটিয়া গিয়াছে। যে সকল ললনা পরিণয় দর্শন নিমিত্ত অগমন করিয়াছিলেন তাঁহারা যাবৎ তথায় অবস্থিতি করিলেন পেত্রুসিও তাবৎ ঐ কথা কর্ণগোচর হইলেও মৌনাবলম্বন পুরঃসর বসিয়া রহিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে ভোজন সমাপনানন্তর অঙ্গনাগণ স্ব২ ভবনে প্রস্থান করিলে পেত্রুসিও দেখিতে পাইলেন যে শ্বশুর ব্যাপ্তিস্তাও উক্ত দুই যুবকের সহিত পরিহাস রসে কৃতাদর হইয়াছেন কেননা যখন পেত্রুসিও এই দুই ব্যক্তির প্রতি উক্তি করিলেন মদীয় কান্তা কেথারিন্ তোমাদের বনিতাপেক্ষা বিনীতা ও সৎস্বভাবা তখন ব্যাপ্তিস্তা অব্যাজে বলিলেন বৎস কর্কশা কেথারিন্‌কে তোমার কলত্র করিয়া দিয়া আমি সাতিশয় শঙ্কিত আছি। পেত্রুসিও বলিলেন মহাশয় সে কি? আমার বনিতা অতি বিনীতা কার্কশ্য বা প্রাতিকূল্য কদাপি তাঁহার দৃক্‌পথেও পতিত হয় নাই, আপনি যদিস্যাৎ আমার কথায় প্রত্যয় না করেন আমি পণ প্রতিজ্ঞা পূর্ব্বক ইহার সত্যতা সপ্রমাণ করিতে পারি। আজ্ঞা করুন আমরা তিন জনে স্ব২ জায়াকে এই স্থানে আহ্বান করি যাহার প্রেয়সী সঙ্কেত মাত্রে আসিয়া পার্শ্ববর্ত্তিনী হইবেক তিনি বশীকৃত কলত্রতা নিমিত্ত পণ জয় করিবেন। পেত্রুসিওর এই কথায় ঐ দুই তরুণ কৌতুকাবিষ্ট হইয়া সম্মত হইলেন, কেননা তাহাদের স্ব২ সীমন্তিনী কর্কশা কেথারিন্ অপেক্ষা শীলাদি সম্পন্না ও আজ্ঞানুবর্ত্তিনী এতদ্বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল অতএব তাঁহারা তৎক্ষণাৎ বিংশতি মুদ্রা পণ স্থাপনের প্রস্তাব করিলেন। পেত্রুসিও উপহাস করত কহিলেন আমি আপন পালিত পক্ষি ও পশুর উপর ঈদৃশ পণ রাখিতে পারি পত্নীর উপলক্ষে এতদপেক্ষা বিংশতি গুণ পণ স্থাপন না করিলে শোভা পায় না। তাহাতে সেই দুই যুবক তৎক্ষণাৎ পণের মুদ্রা বৃদ্ধি করিয়া এক শত করিলেন এবং আদৌ লিউসেন্‌সিও আপন প্রমদার বশম্বদতা প্রদর্শন নিমিত্ত তাঁহাকে আহ্বান করিতে কিঙ্কর প্রেরণ করিলেন। কিন্তু অবিলম্বে তাঁহার ভৃত্য প্রতিনিবৃত্ত হইয়া নিবেদন করিল কর্ত্রী আদেশ বার্ত্তা শ্রবণে উত্তর দিলেন সংপ্রতি গৃহকার্য্যে ব্যাপৃতা আছেন সুতরাং আসিতে পারেন না। পেত্রুসিও বিস্ময় প্রকাশ পুরঃসর জিজ্ঞাসিলেন ইহাঁর গৃহিণী কি বলিলেন কর্ম্মে নিবিষ্টতা প্রযুক্ত আসিতে পারেন না? ভার্য্যা হইয়া ভর্ত্তার অনুমতিতে এরূপ উত্তর দেওয়া কি উচিত হয়? ইহাতে তাঁহারা হাস্য করত বলিলেন কেথারিন্ যদিস্যাৎ তোমার নিদেশে এতদপেক্ষা নিকৃষ্ট প্রতিবচন প্রেরণ না করেন তাহা হইলে একথা শোভা পাইবেক। অনন্তর হার্তেন্‌সিও আদেশমাত্রে স্বীয় সীমন্তিনীকে সমীপে আনয়নার্থ ভৃত্য প্রেরণ করত তাহাকে বলিয়া দিলেন গৃহিণীকে ত্বরায় আসিবার নিমিত্ত বিনীতি বিজ্ঞাপন পূর্ব্বক নিবেদন করিও। পেত্রুসিও এতৎ শ্রবণে চমৎকার প্রকাশ করত কহিতে লাগিলেন হায় এ কি আশ্চর্য্য পরিণীতা বনিতার আহ্বান নিমিত্ত বিনয়গর্ভ বিজ্ঞাপন পাঠাইতে হইল তবে আপনার নিকট তাহার আগমন অযুক্ত। হার্তেন্‌সিও একথায় প্রত্যুক্তি করিলেন মহাশয় আমি এই সভামধ্যে মুক্তকণ্ঠে কহিতেছি আপনকার জায়ার সমীপে আপনি গিয়া বিনয় করিলেও কিছু হইবেক না। তাঁহার এই বচনের অবসানেই প্রেষিত দাস গৃহিণী সমভিব্যাহারে না আসিয়া একাকী প্রত্যাগমন করিল তাহাতে বিস্ময়াপন্ন হইয়া ভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন কি রে কর্ত্রী কোথায়? কিঙ্কর নিবেদন করিল মহাশয় ঠাকুরাণী কহিলেন বোধ হয় আপনি কোন কৌতুক করিবেন একারণ আসিলেন না আপনাকে সমীপে যাইতে আজ্ঞা করিলেন। পেত্রুসিও বলিলেন আপনকার বনিতা অধিক বশীভূতা বটে দেখা গেল। পরে আপনার কিঙ্করকে ডাকিয়া আদেশ করিলেন অরে তোর কর্ত্রীর সন্নিধানে গিয়া বল্ আমি তাহাকে এখানে আগমন করিতে আজ্ঞা করিতেছি। পেত্রুসিওর ভৃত্য প্রভুর নিদেশ গ্রহণ পূর্ব্বক প্রস্থান করিলে সকলের মনে কেথারিন্ আদেশ পালন করেন কি না এই চিন্তার উদয় না হইতে২ ব্যাপ্তিস্তা দূর দৃষ্টি করিয়া আশ্চর্য্য প্রকাশ পূর্ব্বক উচ্চ স্বরে বলিলেন আ দেখ২ আমার ধন্যা কন্যা কেথারিন্ দ্রুতগতি আগমন করিতেছেন। পরে রমণী সভাগারে প্রবেশ করিয়া নম্র ভাবে পতিকে নিবেদন করিলেন কি নিমিত্ত আহ্বান হইল? পেত্রুসিও তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার সহোদরা এবং হার্তেন্‌সিওর কান্তা কোথায়? কেথারিন্ উত্তর করিলেন তাঁহারা বহিঃ প্রকোষ্ঠে উপবিষ্ট হইয়া অগ্নিসেবন করিতে২ কথোপকথন করিতেছেন। পেত্রুসিও বলিলেন তুমি তথায় গিয়া তাহাদিগকে এখানে আনয়ন করিতে পার? কামিনী একথায় উত্তর না দিয়া সত্বর স্বামির আদেশ পালন নিমিত্ত তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে প্রস্থান পূর্ব্বক ভগিনীর সন্নিধানে গমন করিলেন। তদনন্তর লিউসেন্‌সিও বিস্ময় প্রকাশ পুরঃসর বলিতে লাগিলেন যদি চমৎকারের কথা হয় তবে এতদপেক্ষা চমৎকার নাই। হার্তেন্‌সিও তাঁহার বাক্যে পোষকতা করিয়া কহিলেন সত্য এ অলৌকিক চমৎকার, দেখিয়া শুনিয়া অবাক্ হইলাম কিন্তু এ ব্যাপারে কি পতিপত্নীর মুখ্য প্রয়োজন সম্বদ্ধ আছে? পেত্রুসিও বলিলেন ইহা দম্পতীর পরম মঙ্গলের লক্ষণ। ইহাতে পরস্পরের প্রণয় স্থৈর্য্য এবং সুখ সম্ভাবনা প্রকাশ পাইতেছে। ব্যাপ্তিস্তা জ্যেষ্ঠা তনয়ার রীতি প্রকৃতির এবম্প্রকার পরিবর্ত্তন অবলোকনে আনন্দ প্রবাহে নিমগ্ন হইলেন এবং হর্ষ গদ্গদ স্বরে জামাতাকে আশীর্ব্বাদ করত কহিলেন বৎস পেত্রুসিও তোমার মঙ্গল হউক তুমি পণ জয় করিয়াছ। আমি তনুজার যৌতুকার্থ আর বিংশতি সহস্র মুদ্রা প্রদান করিতেছি। আহা আমার সেই কর্কশা কেথারিন্ ঈদৃশ কোমল প্রকৃতি হইয়াছেন, তাঁহাকে যেন পুনর্জাতা দেখিলাম। পেত্রুসিও সম্মান প্রদর্শন পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন মহাশয় যে বিষয়ের পণে জয়ী হইলাম তাহার আরো ভূরি২ নিদর্শন আছে মহিলার সুশীলতা ও বশবর্ত্তিতার অনেক চিহ্ণ দেখাইব। ইত্যবসরে আপন প্রেয়সীকে দুই যোষা সমভিব্যাহারে আসিতে দেখিয়া বনিতা নিমিত্ত গর্ব্বকারি সেই দুই ব্যক্তিকে বলিলেন ঐ দেখুন কেথারিন্ আপনাদের সীমন্তিনী সঙ্গে লইয়া পুনর্ব্বার আসিতেছে। পরে বশম্বদা প্রমদা আসিয়া উপস্থিত হইলে তাহাকে কহিলেন কেথারিন্ তোমার শিরোভূষণ উত্তম দৃষ্ট হইতেছে না উন্মোচন পূর্ব্বক পদতলে নিক্ষেপ কর। কেথারিন্ স্বামির আদেশমাত্রে তৎক্ষণাৎ মস্তক হইতে আভরণ অবতারণ পুরঃসর ভূমিতে নিক্ষেপ করিলেন। ইহাতে হার্তেন্‌সিওর রমণী অসন্তোষ প্রকাশ করত কহিলেন পরমেশ্বর যেন এতাদৃশ নির্বোধের কর্ম্ম করিতে প্রবৃত্তি না দেন। বাএন্‌কা বলিলেন ভগিনি ছি এ কি ক্ষিপ্তের ন্যায় কর্ম্ম করিলে? তখন বাএন্‌কার স্বামী তাঁহাকে বলিতে লাগিলেন সুন্দরি তুমিও এইরূপ উন্মত্তের ন্যায় আচরণ করিলে আমার সন্তোষ হইত, বাএন্‌কা তুমি ঈদৃশ জ্ঞানের কার্য্য করিয়াছ যে তাহাতে ভোজনানন্তর আমার একশত মুদ্রা দণ্ড হইল। বাএন্‌কা বলিলেন তুমি অতি নির্বোধ, আমার কার্য্যের বিষয়ে কেন পণ রাখিয়াছিলে? পেত্রুসিও এই কথা শুনিয়া আপনার কান্তাকে কহিলেন কেথারিন্ এই অবাধ্য অবলা দিগকে উপদেশ দেও পতির প্রতি পত্নীর কি কর্ত্তব্য। তাহাতে নব সুশীলা মহিলা স্বামির প্রতি স্ত্রীলোকের কর্ত্তব্য বিষয়ের বর্ণনা পূর্ব্বক এবম্প্রকার সদ্বক্তৃতা করিলেন যে তৎশ্রবণে সকলে চমৎকৃত হইয়া বোধ করিতে লাগিলেন ইনি স্বেচ্ছাক্রমে পেত্রুসিওর আজ্ঞাবহ হইয়াছেন। অতএব তাঁহার কর্কশা সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইল এবং পাদুয়া নগর মধ্যে সুশীলা মহিলা বলিয়া প্রতিষ্ঠিত হইতে লাগিলেন ইতি।