সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/অলীক কর্ম্মে আড়ম্বর

অলীক
কর্ম্মে
আড়ম্বর।

 R. C. KORMOKAR, ENGR.
৯৭

সেক্‌সপিয়র।


অলীক কর্ম্মে আড়ম্বর।


 মেসিনা নগরীর অধিপতি লিয়নেত নামক রাজার হীরো নাম্নী কুমারী এবং বিয়েত্রিশ্‌ নামিকা একটী ভ্রাতৃতনয়া ছিল। এই দুই কন্যা মেসিনাস্থ নৃপনিকেতনে পরস্পর সৌহৃদ্য ভাবে একত্র বাস করিত।

 বিয়েত্রিশ্‌ স্বীয় প্রকৃতির চাঞ্চল্য প্রযুক্ত গভীর স্বভাবা হীরোর কৌতূহল নিমিত্ত সর্ব্বদা ক্রীড়া কৌতুক করিতেন এবং রসিকতা প্রকাশ করত সকল বিষয়ে হাস্য পরিহাস পূর্ব্বক আমোদ প্রমোদ করিতে ভাল বাসিতেন।

 যৎকালে এই দুই কুমারীর খ্যাতি প্রচার হইতে আরম্ভ হয় সে সময় কতিপয় তরুণ সেনানায়ক কোন সমরে গমন করিয়া শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ পুরঃসর রণ সমাপনানন্তর পথ ঘটিত মেসিনা নগর দিয়া প্রত্যাগমন করিতেছিলেন অতএব তত্রত্যাধিপতি লিয়নেতের সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে সকলে তাঁহার আগারে গিয়া উত্তরিলেন। এই যুবক সম্প্রদায় মধ্যে এরাগন দেশীয় দন্‌প্রিদ্রু নামা রাজনন্দন এবং তদীয় বয়স্য ফ্লোরেন্স নগরীয় ক্লাদিও এই দুই ব্যক্তি মহাসম্ভ্রান্ত এবং তাঁহাদিগের সমভিব্যাহারী পাদুয়া নগরের বেনিদিক্‌ নামা এক জন বিশেষ মর্য্যাদাবান ও রসিক চূড়ামণি ছিলেন।

 উক্ত তরুণ সেনানায়ক গণ যদিও বিদেশীয়, তথাপি পূর্ব্বে আর এক বার মেসিনা নগরে আগমন করাতে লিয়নেতের সহিত তাহাদের আলাপ হইয়াছিল অতএব তাঁহারা সময়ান্তরে পুনর্ব্বার আলয়ে আসিয়া উপস্থিত হইলে আতিথেয় রাজা যথোচিত সৎকার করণানন্তর স্বীয় তনয়া ও ভ্রাতৃপুত্রীর নিকট তাঁহাদের পরিচয় দিলেন ইহাঁরা আমার পুরাতন মিত্র।

 বেনিদিক্‌ বাচাল প্রকৃতি বশতঃ গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়াই লিয়নেত ও নৃপনন্দন দন্‌পিদ্রুর সহিত কৌতুকাবহ বচন প্রয়োগ পুরঃসর সম্ভাষা করিতে আরম্ভ করিলেন। বিয়েত্রিশ্‌ স্বীয় বাগ্মিত্বাভিমানে পরিপূর্ণা ছিলেন সুতরাং স্বভাবতঃ অন্যের কথোপকথনে অসন্তুষ্টা হইতেন, আগন্তুক ব্যক্তিকে হঠাৎ পরিহাস পূর্ব্বক বক্তৃতা করিতে দেখিয়া বৈরক্তি প্রকাশ করত পরুষ ভাষায় কহিলেন মহাশয় কি আশ্চর্য্য আপনকার কথায় কেহ আমোদ করিতেছেন না তথাপি আপনি স্বয়ং বাগাড়ম্বর করিতেছেন। বিয়েত্রিশের ন্যায় বেনিদিক্‌ও প্রগল্‌ভ্যান্বিত ছিলেন অতএব কামিনীর কর্কশ বাক্যে সাতিশয় বিরক্ত হইলেন এবং মনে২ বিবেচনা করিলেন স্ত্রীলোকের এপ্রকার ধৃষ্টতা ও পরুষোক্তি সুশীলতার লক্ষণ নহে। অপর স্মরণ করিয়া তাঁহার চমৎকার বোধ হইল গত যাত্রায় যখন লিয়নেতের নিকেতনে বাস করেন তৎকালে বালা বিয়েত্রিশ্‌ তাঁহার সহিত নানাপ্রকার হাস্য পরিহাস করিয়া কথোপকথন করিয়াছিলেন অথচ এবার তাঁহার কৌতুকে বিরাগ প্রকাশ করিলেন। যে সকল ব্যক্তিরা স্বয়ং পরিহাস রসে রসিক, এবং তাদৃশ বাক্য প্রয়োগ করিতে অধিক রত, তাহারা প্রায় অন্যের হাস্য কৌতুকে কুতূহলান্বিত হয় না। বেনিদিক্‌ ও বিয়েত্রিশ্‌ উভয়ে হাস্য রসে রসিক ছিলেন, এবং তৎ প্রযুক্ত দুই জনেরই মাৎসর্য্য স্বভাব জন্মে, কিন্তু পরস্পরের আত্ম প্রকৃতি বিদিত ছিল না। তাঁহাদের উভয়ের ইতিপূর্ব্বে যখন সাক্ষাৎ হইয়াছিল সে সময়েও অন্যোন্যের কৌতুকামোদে পরস্পর অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং পরিহাস মধ্যে বিসম্বাদ উপস্থিত হওয়াতে পরস্পর ভিন্ন২ স্থানাবলম্বন পূর্ব্বক পৃথক হইয়াছিলেন। যাহাহউক, বিয়েত্রিশ্‌ বেনিদিকের বক্তৃতা কালে মাৎসর্য্য প্রকাশ পুরঃসর যাহা কহিলেন তাহাতে কেহ মনোযোগ করিলেন না। যুবা বেনিদিক্‌ বিয়েত্রিশের বচনে অপ্রতিভম্মন্য হইয়া ঘৃণা দ্বারা বৈরশুদ্ধির মানসে সঙ্কেত বাক্যে ব্যঙ্গ করত কহিলেন অশ্রদ্ধে অদ্যাপি জীবিতা আছ? এই ইঙ্গিতে উভয়ের মধ্যে তুমুল বাক্‌কলহ আরব্ধ হইল। যদিও বিয়েত্রিশের বিশিষ্টরূপে বিদিত ছিল ঐ যুবা যুদ্ধে মহাবল বিক্রম প্রকাশ পুরঃসর সুখ্যাতি প্রাপ্ত হইয়া আসিয়াছেন তথাপি ব্যঙ্গোক্তি করত কহিলেন তুমি শোর্য্য বীর্য্য প্রদর্শন পূর্ব্বক যাবৎ সংখ্যক মানবকে সমর শায়ী করিয়াছ অমি অবলা বটে কিন্তু তাবৎ সংখ্যক ব্যক্তিকে একেবারে কবলীকৃত করিতে পারি। তদনন্তর ঐ মুখরা রামা রাজনন্দনকে বেনিদিকের কথায় আমোদ করিতে অবলোকন করিয়া ঈর্ষান্বিত বচনে বলিলেন ওহে তরুণ পুরুষ তুমি নৃপকুমারের তোষামোদী প্রকৃত ভণ্ড। বিয়েত্রিশের সকল কথাতেই বেনিদিকের মনে বিরাগ জন্মিতেছিল কিন্তু এই অবজ্ঞা বাক্যে তাঁহার অন্তঃকরণ অসন্তোষে আচ্ছন্ন হইল। গর্ব্বিতা বালা তাঁহার প্রতি ইঙ্গিতে ভীরুতার অপবাদ আরোপ পূর্ব্বক কহিলেন মহাবীর কর্ত্তৃক সমর মস্তকে শোর্য্য প্রকাশ পুরঃসর যত মানব নিহত হইল আমি তাহাদিগকে এক গ্রাসে ভোজন করিতে পারি সে কথা গ্রাহ্য করিলেন না কেননা আত্ম প্রত্যয়ে আপনাকে সাহসিক বলিয়া নিশ্চয় জানিতেন। কিন্তু যে সকল ব্যক্তি স্বভাবতঃ কৌতুকামোদী হয় তাহাদিগকে ভণ্ড বলিলে বিশেষ অধিক্ষেপ হয় কারণ তাহারা কখন২ ঐপ্রকার আচরণ যথার্থতঃ করিয়া থাকে অতএব বেনিদিক্‌ কামিনীর শেষোক্ত তিরস্কার বচনে মনোমধ্যে সাতিশয় ক্ষুব্ধ হইলেন এবং তাঁহাকে নিতান্ত নিন্দক স্বভাব জ্ঞান করিতে লাগিলেন।

 রাজকুমারী হীরো অতি সুশীলা ও লজ্জান্বিতা, এপ্রযুক্ত অভ্যাগত সম্ভ্রান্ত সেনানী গণ মধ্যে মৌনাবলম্বন পূর্বক উপবিষ্টা ছিলেন। তাঁহার রূপ লাবণ্য ও বয়োধর্ম্মে স্বতঃ প্রকাশমান হাব ভাব অতিশয় মনোহারী ছিল। ক্লাদিও তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া অবধি আপনার মনোমধ্যে তদীয় সৌন্দর্য্য অনুধ্যান করিতেছিলেন। রাজপুত্র প্রথমাবধি বেনিদিক্‌ ও বিয়েত্রিশের সাহঙ্কার কৌতুকালাপ মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করিলেন অতএব উক্ত যুবক যুবতীর বাক্‌কলহে কুতূহলান্বিত হইয়া লিয়নেতের কর্ণমূলে মৃদুস্বরে বলিলেন এই তরুণী যেমন রসবতী বেনিদিক্‌ও তদ্রূপ রসিক, ইহাঁদের দাম্পত্য ভাব উপযুক্ত হয়। লিয়নেত উপহাস করত সহাস্য বচনে উত্তর করিলেন হাঁ ইহাঁদের উভয়ের পরস্পর পতিপত্নীভাব হইলে অবিশ্রান্ত জল্প করিয়া সপ্তাহের মধ্যে দুই জনেই উন্মত হয়। লিয়নেতের এই কথায় যদিও স্পষ্ট প্রকাশ হইল ঐ যুবক যুবতীর জায়াপতি ভাব অত্যন্ত অনুপযুক্ত, তথাপি রাজকুমার পরিণয় দ্বারা উক্ত রসিক রসিকাকে পরস্পর সংযুক্ত করিবার মানস পরিত্যাগ করিলেন না।

 পরে রাজতনয় স্বীয় বয়স্য ক্লাদিও সমভিব্যাহারে মেসিনাধিপতির নিকট বিদায় গ্রহণ পুরঃসর প্রত্যাগমনের উদ্‌যোগ করিবেন এতদবসরে পরম্পরায় অবগত হইলেন তাঁহাদিগের সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়েত্রিশের সহিত বেনিদিকের বিবাহ ভিন্ন অন্য এক বিবাহের কল্পনা হইয়াছে। অধিকন্তু প্রিয়মিত্র ক্লাদিও তাঁহার সাক্ষাতে হীরোর ভূরি২ প্রশংসা করিতেছিলেন তাহাতে সেই মহিলার প্রতি বন্ধুর যাদৃশ মনোভিলাষ তাহাও বুঝিতে পারিলেন। অতএব রাজনন্দন গমনের আয়োজনে ক্ষান্ত হইয়া বয়স্যকে জিজ্ঞাসা করিলেন সখে হীরোর প্রতি তোমার অন্তঃকরণ কি প্রণয় প্রবণ হইয়াছে? ক্লাদিও উত্তর দিলেন মহাশয় গতবারে যখন এতন্নগরে আগমন করিয়াছিলাম সে সময় আমি যোদ্ধার নয়নে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করি সুতরাং সে বার তৎপ্রতি আমার প্রণয় সঞ্চার কিঞ্চিন্মাত্র হয় নাই কিন্তু সেই সুলোচনার লোচন কি শুভক্ষণে আমার উপরে পতিত হয় তিনি নয়ন গোচর করিবামাত্র আমার প্রতি স্পৃহয়ালুতা প্রকাশ করেন। এবার বিপক্ষ পক্ষ নিরাকৃত হওয়াতে আমার চিত্তে সমর চিন্তা নাই একারণ ঐ কোমলাঙ্গীর রূপ লাবণ্যানুধ্যান মদীয় মানসে প্রবেশ করিয়া আমাকে যেন কহিল হীরোর সৌন্দর্য্য মাধুর্য্য বিবেচনা কর অধিকন্তু যেন স্মরণ করাইয়া দিল যে ঐ লাবণ্যবতী বিগ্রহ যাত্রার অগ্রে আমার মনোনীত হইয়াছিলেন। ক্লাদিও এবম্প্রকারে হীরোর প্রতি আপনার প্রেমানুবন্ধ প্রকাশ করিলে রাজকিশোর অবিলম্বে মেসিনাধিপতির সম্মুখবর্ত্তী হইয়া বিনয় পুরঃসর কহিতে লাগিলেন মহাশয় আপনি আমার বয়স্য ক্লাদিওকে জামাতৃত্ব রূপে বরণ করণে যদি স্বীকার করেন তাহা হইলে আমি আপনকার চির বাধিত হই। মেসিনাধিরাজ রাজনন্দনের আগ্রহ দর্শনে তাঁহার অনুরোধে অঙ্গীকার করিলেন। তদনন্তর রাজতনয় ক্লাদিওর নিবেদন শ্রবণ নিমিত্ত সহজেই সুধীরা হীরোর প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দিলেন যেহেতু ঐ ব্যক্তি সর্ব্বগুণান্বিত ছিলেন। পরে ক্লাদিও রাজকুমারের আনুকূল্যে আপন মনোহারিণী হীরোর সহিত পরিণয় ত্বরায় সম্পাদন নিমিত্ত লিয়নিতের মত করিয়া দিলেন।

 মনোমোহিনী কামিনীর পাণিগ্রহণ সম্পাদন নিমিত্ত ক্লাদিওকে কতিপয় মাত্র দিবস প্রতীক্ষা করিতে হইল কিন্তু সেই কএক দিন তাঁহার পক্ষে তাবৎ সংখ্যক বৎসর তুল্য দুর্যাপনীয় বোধ হইতে লাগিল। ফলতঃ যুবা পুরুষেরা যখন কোন বিষয়ে উৎসাহান্বিত হন্‌ তখন তাহা সম্পন্ন করিবার নিমিত্ত অধৈর্য্য হইয়া থাকেন সুতরাং অত্যল্প কাল বিলম্বও অসহ্য হইয়া উঠে। অতএব রাজতনয় অন্য মনস্কতা দ্বারা বয়স্যের সময় ক্ষেপ মানসে তাঁহার নিকট একটা কৌতুকাবহ ব্যাপারের প্রসঙ্গ করিলেন অর্থাৎ তাঁহাকে কহিলেন এক্ষণে বেনিদিক্‌ ও বিয়েত্রিশ্‌ এই দুই জনের মনে প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত কৌশলে কোন উপায় করা যাউক। নৃপনন্দনের এতৎ প্রস্তাবে ক্লাদিও কুতূহলাক্রান্ত হইয়া আমোদ করিতে লাগিলেন এবং চতুরতা প্রকাশ পূর্ব্বক কৃতকার্য্য হইবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইলেন। অপর মেসিনাধিপতি লিয়নেতও তদ্বিষয়ে সাধ্যানুসারে আনুকূল্য করিতে অঙ্গীকার করিলেন। অধিকন্তু হীরো প্রতিজ্ঞা করিয়া কহিলেন আমি ভগিনীর নিকট বেনিদিকের অনুপম গুণের বিষয় প্রসঙ্গতঃ বর্ণনা করিয়া তাহার প্রতি অনুরাগ জন্মাইয়া দিতে সর্ব্বতোভাবে যত্ন করিব।

 তদনন্তর রাজকুমার বিবেচনা করিয়া এই উপায় স্থির করিলেন সম্প্রদায়স্থ ব্যক্তিদিগের দ্বারা কোন কৌশলে বেনিদিকের মনে বিশ্বাসাধান করা যাউক বিয়েত্রিশ্‌ তাঁহার অঙ্গসৌষ্ঠব ও বাঙ্মাধুর্য্যে বিমুগ্ধা হইয়া তৎপ্রতি সাতিশয় অনুরাগবতী হইয়াছেন এবং হীরো নিজ ভগিনী বিয়েত্রিশের হৃদয়ে এতাদৃশ প্রত্যয় উৎপাদন করুন বেনিদিক্‌ তাঁহাকে অবলোকন করিয়া অবধি মনোমধ্যে তদীয় প্রেমাভিলাষ করত তাঁহার নিমিত্ত উৎকলিকাকুল আছেন।

 পরে রাজকিশোর, লিয়নেত এবং ক্লাদিও তিন জনে সংকল্পিত সিদ্ধির নিমিত্ত আদৌ উদ্যোগ করিলেন। যে সময় বেনিদিক্‌ উদ্যানে গমন পূর্ব্বক নির্জ্জনে উপবেশন করিয়া গ্রন্থালোচনা করিতে ছিলেন তৎকালে প্রচ্ছন্ন ভাবে তথায় উপস্থিত হইয়া তরুপংক্তির অন্তরালে তাঁহার সন্নিকট দণ্ডায়মান হইলেন। সে স্থলে রাজকুমার স্বীয় দুই সহচর সহিত যে কথোপকথন করিলেন তাহা বেনিদিকের কর্ণগোচর হইল। নৃপতনয় উচ্চস্বরে লিয়নেতকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন মহাশয় সে দিবস আমাকে বলিতে ছিলেন না, আপনকার ভ্রাতৃকন্যা বেনিদিকের প্রতি অনুরাগিণী হইয়াছেন? কি আশ্চর্য্য, আমার কখন মনেও হইত না যে সেই কামিনী কাহারো প্রতি প্রণয়িনী হইবেন। লিয়নেত উত্তর দিলেন সত্য বটে, আমিও পূর্ব্বে ঐরূপ অনুমান করিতাম, এখনও তাঁহার বাহ্য ব্যবহার দর্শন করিলে বোধ হয় বেনিদিক্‌কে অবজ্ঞা করেন কিন্তু অন্তঃকরণ মধ্যে তাঁহার প্রতি সাতিশয় অনুরাগবতী। পরে ক্লাদিও সাক্ষ্য দিয়া কহিলেন হীরো আমার সাক্ষাতে সে দিন বলিতেছিলেন বটে বিয়েত্রিশ্‌ বেনিদিকের ভাবে এপ্রকার আসক্ত হইয়াছেন যদিস্যাৎ ঐ যুবা তাঁহার সহিত প্রণয় না করেন তাহা হইলে মনস্তাপে তরুণীর তনুত্যাগ হইবার সম্ভাবনা। কিন্তু অব্যবহিত পরেই লিয়নেতের সহিত ক্লাদিও একবাক্য হইয়া বলিতে লাগিলেন কেবল কামিনীর অনুরাগে কি হইবেক বেনিদিকের মনে অঙ্গনা প্রণয় উৎপন্ন হওয়া দুর্ঘট। তিনি যাবতীয় বিলাসিনী বিশেষতঃ বিয়েত্রিশের সঙ্গে সর্ব্বদা নীরস পরিহাস করিয়া থাকেন।

 রাজপুত্র যেন বিয়েত্রিশের প্রতি সাতিশয় সদয়, এতাদৃশ ভাব প্রকাশ পূর্ব্বক ঐ কথোপকথন শ্রবণ করিতেছিলেন অতএব তাঁহাদের কথাবসানে বলিলেন তবে বিয়েত্রিশের অনুরাগ বেনিদিকের জ্ঞানগোচর করিলে ভাল হয়। ক্লাদিও এতদ্বাক্য আকর্ণনে আক্ষেপ করত উক্তি করিলেন তাঁহার নিকট এ বিষয় প্রকাশ করিলে কি হইবে, তিনি একথা শুনিলে সুন্দরীকে পরিহাস করিবেন তাহাতে কামিনীর অধিক মনোদুঃখ হইবার সম্ভাবনা। রাজকুমার কিঞ্চিৎ কোপাবেশে বলিলেন কি, বেনিদিক্‌ এবম্প্রকার কৌতুক করিলে তাঁহার প্রাণদণ্ড করা উচিত, আহা বিয়েত্রিশ্‌ কি ভ্রান্তা, তাঁহার বুদ্ধি কি একেবারে উৎসন্না হইয়া গিয়াছে, কি আস্বাদে বেনিদিক্‌কে সপ্রণয় নয়নে নিরীক্ষণ করিলেন ও তাহার প্রতি অন্তঃকরণ প্রেম প্রবণ হইল। এই কথা কহিয়া সঙ্গিগণকে ইঙ্গিতে বলিলেন এক্ষণে এস্থান হইতে প্রস্থান করা যাউক আমাদের কথোপকথন বেনিদিকের কর্ণগোচর হইয়াছে এখন মনোমধ্যে আন্দোলন করুক।

 বেনিদিক্‌ মনোযোগ পুরঃসর ঐ সকল কথা বার্ত্তা শ্রবণ করিতেছিলেন। বিয়েত্রিশ্‌ তাঁহার প্রেমাভিলাষিণী হইয়াছেন এ কথা কর্ণগোচর হইবামাত্র মনে২ কহিলেন ইহা কি সম্ভব? ঐ কোণে কি বায়ু অবস্থিতি করিতেছে? কিন্তু নৃপনন্দন সঙ্গিগণ সমভিব্যাহারে গমন করিলে পর পুনর্ব্বার অন্তঃকরণে তর্ক করিতে লাগিলেন তাঁহারা যাহা কহিতেছিলেন তদ্বিষয়ে প্রতারণা অনুমান করিতে পারাযায় না, কেননা অকপট মুখে পরস্পর কথোপকথন করিতে ছিলেন। অপর আমার প্রতি ঐ কামিনীর প্রেমানুরাগের বিবরণ হীরোর নিকটেও শ্রবণ করিতে তাঁহাদের চিত্ত যেন দুর্ভাবনায় ব্যাকুল হইয়াছে এমত বোধ হইল। কি আশ্চর্য্য বিয়েত্রিশ্‌ আমার প্রতি অনুরাগিণী হইলেন, তবে তো আমারও প্রেম প্রতিদান করা উচিত হয়। বিবাহের ভাবনা নাই, পূর্ব্বে কহিয়াছিলাম বটে দার পরিগ্রহ করিয়া গলগ্রহ করিব না, অবিবাহিতাবস্থাতেই দেহপাত করিব, তখন এতাদৃশ বোধ হয় নাই যে আমার পরিণয় হইবেক। এক্ষণে তাঁহাদের প্রমুখাৎ শুনিলাম সেই সুন্দরী সুধীরা ও রূপ গুণে মনোহারিণী, বস্তুতঃ এপ্রকার বটেন, কিন্তু সর্ব্বগুণ ধারণ করিলেও আমার প্রতি প্রণয়িনী হওয়াতে অতিশয় নির্গুণের কার্য্য করিয়াছেন, ইহাতে তাঁহার বুদ্ধির অভাব অথবা বিকৃতি প্রকাশ পাইল। যাহা হউক, আমার পক্ষে এতদ্বিষয়ে ঔদাস্য করা শ্রেয়স্কর নহে, আপনিও স্নেহ প্রদর্শনের পন্থা দেখি। এই প্রকার চিন্তা করিয়া জাতানুরাগ হওত পরিক্রমণ করিবার উপক্রম করিতেছেন, ইত্যবসরে অদূরে দেখিতে পাইলেন বিয়েত্রিশ্‌ আগমন করিতেছেন। তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়াই আপনাআপনি কহিতে লাগিলেন অদ্য তরুণীর মধুর রূপ দেখিতেছি এবং ইহাঁতে প্রেমের চিহ্নও দৃষ্ট হইতেছে। অনন্তর বিয়েত্রিশ্‌ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া স্বীয় স্বভাব বশতঃ পরুষ ভাষায় বলিলেন আমার ইচ্ছা ছিল না তোমার নিকট আসি কিন্তু কি করি ভোজনার্থ আহ্বান করিতে আমাকেই পাঠাইলেন। বেনিদিক্‌ ইতি পূর্ব্বে কামিনীর সহিত মিষ্টালাপ করেন নাই কিন্তু এক্ষণে মৃদু মধুর ভাষায় সম্বোধন করত বলিলেন হে সুকুমারাঙ্গি তুমি এতন্নিমিত্ত ক্লেশ স্বীকার পূর্ব্বক কেন আগমন করিলে? তোমার এই সদ্ভাব নিমিত্ত বাধিত হইলাম। বিয়েত্রিশ্‌ স্বভাবতঃ কর্কশা এপ্রযুক্ত তাদৃশ সদালাপে কর্ণপাত না করিয়া নীরস ভাষায় অপর কএকটী কথা কহিলেন এবং পূর্ব্ববৎ পরুষ প্রকৃতি প্রকাশ করত অবিলম্বে চলিয়া গেলেন। বেনিদিক্‌ এক্ষণে কামিনীর কর্কশ বাক্য মধ্যেও গূঢ় স্নেহরস বোধ করিতে ছিলেন অতএব মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করিয়া বলিলেন এখন যদি তাঁহার প্রতি স্নেহান্বিত না হই তবে দুরাত্মতা প্রকাশ হইবেক, যদি প্রেম না করি তবে আমা অপেক্ষা নরাধম নাই, অতএব আমি গমন করি এবং তাঁহার চিত্তানুবৃত্তি করিতে সত্বর হই।

 রাজনন্দন আপন মানস সফল করণাশয়ে সঙ্গিগণের সহিত পরামর্শ করিয়া যে বাগুরা বিস্তীর্ণ করিলেন তাহাতে বেনিদিক্‌ আবদ্ধ হইলেন। এক্ষণে হীরো বিয়েত্রিশ্‌কে প্রতারণা জালে নিক্ষেপ করিবার নিমিত্ত সুযোগ করিতে লাগিলেন। অর্সুলা ও মার্গেরেত্‌ নাম্নী দুই সহচরীকে আহ্বান করিয়া মার্গেরেত্‌কে কহিলেন প্রিয়সখি তুমি ত্বরায় সভাগারে গমন কর সেখানে আমার ভগিনী বিয়েত্রিশ্‌ রাজকুমার ও ক্লাদিওর সহিত কথোপকথন করিতেছেন, তাঁহার কর্ণকুহরে অনুচ্চস্বরে কহিয়া আইস হীরো স্বীয়া প্রিয়সখী অর্সুলার সহিত উদ্যানে ভ্রমণ করিতে২ কেবল তোমারই কথা কহিতেছেন যদি প্রত্যয় না হয় নিকুঞ্জের যে স্থলে তরুলতাবলীর পত্র পল্লব দ্বারা দিনকরের কর প্রবেশ হয় না তথায় গোপনে গমন পূর্ব্বক বরং স্বকর্ণ শ্রবণ কর। মার্গেরেত্‌ এতৎ শ্রবণে সহর্ষা হইয়া কহিল আমি এখনি যাইতেছি তাঁহাকে প্রবৃত্তি দিয়া নিশ্চয় সেখানে প্রেরণ করিব। হীরো যে স্থানে বিয়েত্রিশ্‌কে আনয়ন করিবার নিমিত্ত এই কৌশল করিলেন কিয়ৎ ক্ষণ পূর্ব্বে বেনিদিক্‌ সেই স্থলে রাজনন্দন ও তদীয় সমভিব্যাহারিগণের কথোপকথন শ্রবণ করিয়াছিলেন।

 অনন্তর হীরো স্বীয় সহচরী অর্সুলা সমভিব্যাহারে নির্দ্দিষ্ট উদ্যানে উপস্থিত হইয়া সখীকে কহিলেন দেখ অর্সুলা, বিয়েত্রিশ্‌ এখানে আগমন করিলে আমরা এই ক্ষুদ্র বর্ত্ম দিয়া যাতায়াত করিতে২ কেবল বেনিদিকের কথা কহিব। আমি যখন২ তাঁহার নাম গ্রহণ করিব তখন তুমি সমস্ত পুরুষাপেক্ষা তাঁহার প্রতিষ্ঠা করিও। তোমার সঙ্গে কথোপকথন করিতে২ কহিব বেনিদিক্‌ বিয়েত্রিশের ভাবে মুগ্ধ হইয়া তাহার প্রতি আসক্ত হইয়াছেন। তৎপরে চারি দিক্ অবলোকন করিয়া বলিলেন হে সখি আইস ত্বরায় কথা আরম্ভ করি ঐ দেখ বিয়েত্রিশ টিট্টিভী প্রায় ভূমিতে মিশাইয়া গোপনে আমাদের কথোপকথন আকর্ণন করিবার নিমিত্ত দ্রুতগতি আগমন করিতেছেন। পরে তাঁহারা পরস্পর কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন। হীরো যেন অর্সুলার কথার উত্তর দিতেছেন এবম্প্রকার ভঙ্গি করত কহিলেন বিয়েত্রিশ্‌ সাতিশয় অহঙ্কৃতা, পর্ব্বতীয় পক্ষির ন্যায় তাঁহার প্রকৃতি অতি প্রগল্‌ভ। অর্সুলা বলিল ঠাকুরাণি আপনি কি নিশ্চয় অবগত আছেন বেনিদিক্‌ বিয়ত্রিশের প্রেমাভিলাষী? হীরো উত্তর দিলেন রাজকুমার এবং ক্লাদিওর প্রমুখাৎ শুনিয়াছি বেনিদিক্‌ তন্নিমিত্ত অন্তঃকরণ মধ্যে সাতিশয় উৎকণ্ঠান্বিত। তাঁহারা দুই জনে আমাকে ঐ বিষয় বিয়েত্রিশের নিকট প্রকাশ করণার্থ অনুরোধ করিয়াছিলেন কিন্তু আমি তাঁহাদিগকে বিনতি করিয়া কহিলাম তোমরা যদিস্যাৎ বেনিদিকের স্নেহান্বিত বন্ধু হও তবে এ কথা কখন বিয়েত্রিশের কর্ণগোচর করিও না। অর্সুলা বলিল সত্য বটে কামিনীর যাদৃশ স্বভাব তাহাতে বেনিদিকের আসক্তির কথা তাঁহার জ্ঞানগোচর করা যুক্তি সিদ্ধ হয় না। কি জানি যদি পরুষভাষায় কৌতুক করিয়া বসিলেন।

 হীরো বলিলেন কিন্তু আমি এপর্য্যন্ত কখন কামিনীর মুখে কোন রূপবান্‌ যুবা বিশেষতঃ বিজ্ঞ পুরুষের কুৎসার কথা শ্রবণ করি নাই। অর্সুলা বলিল তাহাও সত্য, গুণি ব্যক্তির গ্লানি করাতে যে আপনার অপ্রতিষ্ঠা হয় ইহা কি তিনি বুঝেন না? অবশ্য বুঝিতে পারেন। হীরো উত্তর করিলেন যাহা হউক আমার সাধ্য নাই যে এ কথা তাঁহাকে বলি। আমি কহিতে গেলে পরিহাস করিয়া উড়াইয়া দিবেন। অর্সুলা বলিল ঠাকুরানি আপনি অন্যায় উক্তি করিতেছেন তিনি কি এমনই অর্বাচীন যে বেনিদিকের তুল্য সুশ্রী সুরূপ সর্ব্বগুণান্বিত পাত্র পরিত্যাগ করিবেন? হীরো বলিলেন বেনিদিকের যথেষ্ট সুখ্যাতি শ্রুত আছে বটে, প্রিয় ক্লাদিও ব্যতীত ইটালি দেশের মধ্যে তিনি অতি প্রধান এবং সকল লোকের মান্য ও অগ্রগণ্য। পরে সখীকে সঙ্কেত করিয়া বলিলেন এক্ষণে আমরা এ বিষয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক অন্য কোন প্রসঙ্গ করিয়া কথোপকথন করি আইস। তাহাতে অর্সুলা তাঁহাকে সম্বোধন পুরঃসর সস্নেহ বচনে জিজ্ঞাসা করিল ঠাকুরাণি আপনকার বিবাহ কবে হইবেক? হীরো উত্তর করিলেন আগামি দিবসে ক্লাদিওর সহিত আমার পরিণয় হইবেক। পরে তাহাকে অনুরোধ করত বলিলেন তুমি আমার নূতন পরিচ্ছদ দেখিবে আইস। চল দেখি গিয়া দুই জনে বিবেচনা করি কল্য কোন বসন পরিধান করিব। এই কহিয়া সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। বিয়েত্রিশ্‌ লতা ব্যবহিতা হইয়া তাঁহাদের সমস্ত কথোপকথন মনোযোগ পুরঃসর শ্রবণ করিতেছিলেন অতএব তাঁহারা তথা হইতে গমন করিলে পর সোদ্বেগ মনে আপনা আপনি বলিতে লাগিলেন আমার কর্ণ কুহরে এ কি হুতাশন প্রবেশ করিল? যাহা শুনিলাম সত্য না কি? যাহা হউক, হে ঘৃণা দেবি, হে তাচ্ছীল্য মহাশয়, হে কৌমারাভিমান, তোমরা বিদায় হও। কি আশ্চর্য্য, বেনিদিক্‌ আমার প্রণয়াভিলাষী হইয়া অনুরাগী হইয়াছেন। আমি আপনার অশিষ্ট স্বান্ত শান্ত করত অবশ্য তাঁহার প্রতি প্রেম করিব।

 সুচতুর রসিক রাজকিশোরের বুদ্ধি কৌশলে এই প্রকারে চির বিরোধি যুবক যুবতীর অন্তঃকরণে বৈরিতাপসরণ পুরঃসর অনুরাগের অবির্ভাব হইলে তাঁহাদের উভয়ের প্রথম সন্দর্শনের সপ্রণয়ালাপ সাতিশয় আনন্দ জনক হইবার সম্ভাবনা হইল। কিন্তু কোন খলের দুরাত্মতায় হীরোর অদৃষ্টে দৈবাৎ একটা দুর্ঘটনা ঘটাতে তিনি সমস্ত আহ্লাদে বঞ্চিতা হইলেন। যে দিবস প্রাতঃকালে তাঁহার পাণিগ্রহণ হইত সেই দিন তাঁহার এবং তদীয় জনকের মনে মহাসন্তাপের শঙ্কু নিখাত হইল।

 রাজনন্দনের দঞ্জন্‌ নামা এক জন সাপত্ন ভ্রাতা ছিল। সে ব্যক্তিও সমরাবসানে তাহাদের সমভিব্যাহারে মেসিনা নগরে আগমন করিয়াছিল। সে সর্ব্বদা ঈর্ষা বিমর্ষে পরীত থাকাতে কুতর্ক ও কুৎসিত কল্পনা করত অসন্তোষে কাল হরণ করিত। রাজ তনয়ের প্রতি তাহার আন্তরিক সদ্ভাব ছিল না, তাঁহাকে মনে২ দ্বেষ করাতে তদীয় অকৃত্রিম মিত্র ক্লাদিওরও হিংসা করিত। সে আপনার খল প্রকৃতির পরবশতা প্রযুক্ত মৎসরী হইয়া হীরোর সহিত ক্লাদিওর বিবাহ নির্ব্বাহে ব্যাঘাত উত্থাপন পূর্ব্বক রাজতনয় ও তাঁহার পরম প্রণয়াস্পদ বয়স্যকে অসুখী করিবার মানস করিল কেননা তাহার বিদিত হইয়াছিল এই পরিণয় সম্পাদন নিমিত্ত রাজকুমার ও তাঁহার সখা ক্লাদিও উভয়ে সাতিশয় ব্যগ্র। ঐ দুরাত্মা আপনার দুষ্ট অভিপ্রায় সুসিদ্ধি করিবার নিমিত্ত আত্মবৎ দুঃশীল বোরাকিও নামা এক ব্যক্তিকে পুরস্কারের লোভ প্রদর্শন পূর্ব্বক সহকারিতা করণে নিযুক্ত করিল। হীরোর সহচরী মার্গেরেতের সহিত বোরাকিওর সাতিশয় প্রণয় ছিল। দুরাত্মা দঞ্জন্‌ তাহা বিলক্ষণ জানিত। অতএব বোরাকিওকে কহিল বন্ধো তুমি মার্গেরেতের নিকট গমন পূর্ব্বক তাহাকে অনুরোধ কর অদ্য নিশাভাগে হীরো আপনার আগারে নিদ্রাগতা হইলে তদীয় পরিচ্ছদ পরিধান পুরঃসর সেই গৃহের গবাক্ষ হইতে যেন তোমার সহিত কথোপকথন করেন, তাহা হইলে ক্লাদিও বিশ্বাস করিবেন হীরোই কথা কহিতেছে তবেই আমার অভিলষিত সফল হইবে।

 দুরাত্মা দঞ্জন্‌ এই রূপ পরামর্শ প্রদান পুরঃসর বোরাকিওকে প্রেরণ করিয়া আপনি রাজনন্দন ও ক্লাদিওর নিকট গমন করিল এবং হীরোর সহিত ক্লাদিওর বিবাহের প্রসঙ্গ করত কহিল আমি সটীক শুনিয়াছি সেই যুবতীর চরিত্র পবিত্র নহে। তিনি রজনীযোগে আপন ভবনের গবাক্ষ দ্বার দিয়া পুরুষের সঙ্গে আলাপ কৌশল করেন। সে যে সময় তাঁহাদিগের সন্নিধানে গমন করিয়াছিল সে সময় পরিণয়ের অগ্রিম দিনের সায়ংকাল, অতএব কহিল তোমরা যদিস্যাৎ দেখিতে চাহ চল অদ্য যামিনীযোগে একত্র হইয়া তাহার আলয়ের নিকট গমন পুর্ব্বক প্রত্যক্ষ করত চক্ষু কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করি। নৃপনন্দন এবং ক্লাদিও এতৎ শ্রবণে বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন, এবং অবিলম্বে তাহার সমভিব্যাহারে গমন করিতে চাহিলেন। অপর ক্লাদিও মুক্তকণ্ঠে কহিলেন যদিস্যাৎ অদ্য রাত্রিতে কিছু দেখিতে পাই তাহা হইলে কি নিমিত্ত কামিনীর করগ্রহণ করিব না কল্য বিবাহের সভায় সকলের সমক্ষে বিস্তারিত করিয়া কহিব এবং সেই দুঃশীলাকে যৎপরোনাস্তি লজ্জা দিব। রাজকুমারও কহিলেন মিত্র তোমার সহিত তাহার বিবাহ হয় এতদর্থ আদ্যাবধি আমি যথেষ্ট যত্ন পাইয়াছি অতএব আমিও তোমার সহিত মিলিত হইয়া তাহার অপমান করিব।

 অনন্তর কিঞ্চিৎ রজনী হইলে দঞ্জন্‌ তাঁহাদের দুই জনকে সমভিব্যাহারে লইয়া গোপনে হীরোর আগারের সন্নিকটে আসিল। সে সময় ঐ দুরাত্মার উপদেশানুসারে বোরাকিও হীরোর গৃহের গবাক্ষ তলে দণ্ডায়মান ছিল এবং মার্গেরেত্‌ হীরোর বসন পরিধান পূর্ব্বক গবাক্ষ দ্বারে মুখ দিয়া তাহার সহিত বিরলে কথাবার্তা কহিতেছিল। রাজনন্দন ও ক্লাদিও হীরোর গবাক্ষ দ্বারে তদীয় পরিচ্ছদ ধারিণী রমণী নয়ন গোচর করিবা মাত্র জাত প্রত্যয় হইলেন হীরোই নির্জনে পুরুষান্তর সহ বিশ্রম্ভালাপ করিতেছেন।

 এই ব্যাপার স্বচক্ষুতে অবলোকন করিবা মাত্র ক্রোধে ক্লাদিওর অন্তর্দাহ হইতে লাগিল এবং তাঁহার যে অন্তঃকরণে নির্দোষা হীরোর প্রতি পরম প্রীতি জন্মিয়াছিল তাহা ঘৃণায় পরিপূর্ণ হইল। তিনি কহিলেন কল্য প্রভাতে সভা মধ্যে এই সমস্ত বিষয়ের বর্ণন করিয়া দুঃশীলাকে বিলক্ষণ লজ্জা দিব। রাজকুমারও কামিনীর এই চরিত্র প্রত্যক্ষ করিয়া অশ্রদ্ধান্বিত হইলেন অতএব বয়স্যের সহিত এক মত হইয়া তাহাই কর্ত্তব্য বলিয়া ধার্য্য করিলেন এবং সাশ্চর্য্য চিত্তে বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন রমণীর কি সাহস, এক জন সম্ভ্রান্ত পুরুষের সহিত প্রভাতে পরিণয় হইবেক নিশাভাগে শয়নাগারের গবাক্ষ হইতে পরপুরুষের সঙ্গে এই ব্যাপার।

 পর দিবস পূর্ব্বাহ্নে পূর্ব্ব সংকল্পিতানুসারে বিবাহের সভা সুসজ্জিতা হইল এবং ভূরি২ ধন্য মান্য সভ্য ভব্য ব্যক্তি আসিয়া অধ্যাসীন হইলেন। পুরোহিত বরকন্যাকে সম্মুখে দণ্ডায়মান করত পাণিগ্রহণের মন্ত্র উচ্চারণ করিবেন ইত্যসরে ক্লাদিও সকোপ বচনে নির্দোষা হীরোর চরিত্রে কলঙ্কারোপ করিতে লাগিলেন। দোষলেশের সম্পর্ক শূন্যা হীরো সেই অদ্ভুত বাক্য আকর্ণনে বিস্ময়ান্বিতা হওত ক্ষণকাল স্তব্ধ হইয়া রহিলেন পরে মৃদুস্বরে প্রাণেশ্বরের প্রতি উক্তি করিলেন অয়ি নাথ আপনি কি প্রকৃতিস্থ হইয়া এই সমস্ত নিদারুণ দূষণ বচন প্রয়োগ করিতেছেন?

 লিয়নেত ক্লাদিওর উক্তি শ্রবণ করিয়া চমৎকৃত হইলেন এবং সাতিশয় বিমনস্কতা প্রকাশ পূর্ব্বক রাজতনয়কে বলিলেন আপনি কি নিমিত্ত মৌনাবলম্বন করিতেছেন কোন কথা কহেন না কেন? রাজনন্দন উত্তর দিলেন আমি কি কহিব স্বয়ং যৎপরোনাস্তি লজ্জিত হইতেছি, কি ঘৃণার বিষয়, ঈদৃশী অযোগ্যা ঘোষার সহিত প্রিয় বয়স্যের পরিণয় নিমিত্ত যত্ন করিয়াছিলাম। ওহে লিয়নেত যথার্থ কহিতেছি গত রাত্রিতে আমি আমার বৈমাত্রেয় এবং ক্লাদিও এই তিন জন আপন নয়নে অবলোকন করিয়াছি। কামিনী স্বীয় শয়নাগারের গবাক্ষ দ্বার হইতে একটা যুবা পুরুষের সহিত প্রণয়ালাপ করিতেছিলেন স্ব কর্ণে শুনিয়াছি।

 বেনিদিক্‌ এতদ্বচনে সাতিশয় চমৎকার প্রকাশ করত কহিলেন এ পরিণয়ের আচার নয়।

 হীরো এ সমস্ত কথা শ্রবণে বিস্ময়ে সংজ্ঞা শূন্য হইলেন কিঞ্চিচ্চৈতন্যোদয় হইলে মনঃপীড়া প্রকাশ পুরঃসর কহিলেন সত্য কি, হা পরমেশ্বর। কিন্তু এই শব্দটী বদন হইতে বিনির্গত হইবামাত্র মূর্চ্ছান্বিত হইয়া ভূমিতে পড়িলেন ও তাঁহার প্রাণ বিনির্গমনানন্তর মৃত্যু হইল এমত বোধ হইল। রাজনন্দন এবং ক্লাদিও ঘৃণায় সাতিশয় বিরক্ত হইয়াছিলেন এবং তাঁহাদের চিত্ত সুকঠিন হইয়াছিল অতএব অবলার মূর্চ্ছা ভঙ্গ দর্শনের অপেক্ষা না করিয়া তৎক্ষণাৎ সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন সুতরাং লিয়নেত অপার বিষাদার্ণবে নিমগ্ন হইলেন।

 বিয়েত্রিশ্‌ ব্যস্ত সমস্ত হইয়া হীরোর মূর্চ্ছাপনয়ন করিতে লাগিলেন। বেনিদিক্‌ তাঁহার সাহায্য করিয়া কিয়ৎ ক্ষণ পরে জিজ্ঞাসা করিলেন সুকুমারী কুমারী কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন কি না? বিয়েত্রিশ্‌ ভগিনীর প্রতি অত্যন্ত স্নেহান্বিতা ছিলেন অতএব, বিষণ্ণ বদনে উত্তর দিলেন এখনও স্পন্দ হইল না, বোধ হয় প্রাণ বিয়োগ হইয়াছে। ভগিনীর সৎপ্রকৃতি এবং সুশীলতা তাহার বিলক্ষণরূপে বিদিত ছিল সুতরাং এই অলীক কলঙ্কারোপে কোন প্রকারে বিশ্বাস করিলেন না কিন্তু বৃদ্ধ লিয়নেত কন্যার কুৎসাকর কথা কর্ণগোচর করিয়া তাহাঁতে জাতপ্রত্যয় হইয়াছিলেন অতএব সম্মুখে দুহিতা মৃতপ্রায় হইয়া মূর্চ্ছায় ধূল্যবলুণ্ঠিত হইলে অপত্যস্নেহ বশতঃ বিলাপ করিতে লাগিলেন বটে কিন্তু লোকলজ্জা ভয়ে মনে২ তাঁহার এই প্রার্থনা হইল তনয়া যেন আর নয়নোন্মীলন না করে।

 সভাস্থ প্রাচীন পুরোহিত অতিশয় প্রাজ্ঞ, স্বীয় সদ্বিবেক বলে মানব জাতির বাহ্যাকৃতি নিরীক্ষণ করিয়া রীতি প্রকৃতি নির্ণয় করিতে পারিতেন। কামিনীর প্রতি যৎকালে কলঙ্কারোপ হয় তদবধি মনোনিবেশ পূর্ব্বক তদীয় চন্দ্রানন অবলোকন করিতেছিলেন তাহাতে তাঁহার বোধ হইল অবলার বদনে লজ্জার লোহিত লক্ষ্ম প্রকাশানন্তর শোকের শ্বেতচ্ছবি করণক যেন আচ্ছাদিত হইল। অপর সুলোচনার লোচন দ্বয় হইতে কোপানল তুল্য যে জ্যোতিঃ নির্গত হইল তাহা যেন এই ব্যক্ত করিল যে রাজপুত্র তদীয় কৌমার ভ্রংশে অমূলক অপবাদ দিতেছেন অতএব ঋত্বিক্‌ শোকাকুল হইয়া লিয়নেতকে কহিতে লাগিলেন মহাশয় আপনকার এই সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী দুহিতা দোষলেশের সম্পর্কমাত্র শূন্যা, ইহাঁর চরিত্র সাতিশয় পবিত্র, কেবল নিদারুণ ভ্রান্তি বশতঃ ঈদৃশী দুর্দশায় পতিত হইয়াছেন, দেখিবেন শেষে আমার এই কথা সর্ব্বাংশে সপ্রমাণ হইবেক যদি না হয় আমাকে নির্ব্বোধ কহিবেন আমার যে বিদ্যা ও মানব প্রকৃতি পরিজ্ঞানে পাণ্ডিত্য আছে তাহাতে বিশ্বাস করিবেন না, অপর স্থবিরতা ও সদ্ব্যবসায় নিমিত্ত যে গৌরব ধারণ করি তাহাও রহিত করিয়া দিবেন।

 অনন্তর হীরোর মূর্চ্ছা ভঙ্গ হইলে পুরোহিত সস্নেহ বচনে, সম্বোধন করত জিজ্ঞাসা করিলেন বৎসে কোন্ পুরুষের নামে এই অপবাদ রটিয়াছে তোমার বিদিত আছে? হীরো ভগ্নচিত্তে উত্তর করিলেন যাহারা কলঙ্ক কল্পনা করিল তাহারাই জানে, আমি কিঞ্চিন্মাত্র অবগতা নহি। তৎপরে তাত লিয়নেতের প্রতি কহিলেন পিতঃ আমি অসময়ে পর পুরুষের সহিত কথোপকথন করিয়া থাকি এবং গত নিশাতে কাহারো সহিত বাক্যালাপ করিয়াছি যদি সপ্রমাণ হয় এই মুহূর্ত্তে আমাকে পরিত্যাগ করুন, অথবা যথেচ্ছ ভর্ৎসনার সহিত ঘৃণা করিয়া জ্বলন্ত হুতাশনে নিক্ষেপ পূর্ব্বক বিবিধ যন্ত্রণা দিয়া আমার প্রাণ দণ্ড করুন।

 অনন্তর পুরোহিত কহিলেন রাজকুমার ও ক্লাদিও উভয়েই অদ্ভুত ভ্রমে পতিত হইয়াছেন সন্দেহ নাই। পরে লিয়নেতকে পরামর্শ দিলেন মহারাজ আপনি প্রচার করুন যে সুকুমারী কুমারী কলঙ্কের বার্ত্তা আকর্ণনে মূর্চ্ছাগতা হইয়া অচেতনাবস্থায় পঞ্চত্ব প্রাপ্তা হইলেন এবং স্বয়ং শোক বসন পরিধান পূর্ব্বক অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার আয়োজন করুন। হে রাজন্ ক্লাদিও এবং নৃপনন্দন স্ব২ নয়নে ললনার মৃত্যু তুল্য মোহ নিরীক্ষণ করিয়া গিয়াছেন এই জনপ্রবাদে বিনা অনুসন্ধানে অসংশয় জাতপ্রত্যয় হইবেন। লিয়নেত বলিলেন এবম্প্রকার করিলে কি ফল দর্শিবে? পুরোহিত কহিলেন হীরোর মরণের কথা প্রচার হইলে আরোপিত কলঙ্ক লীন এবং তাঁহার প্রতি সকলের করুণোদয় হইবার সম্ভাবনা। এতদ্ব্যতীত অপর একটা গুরুতর শ্রেয়ঃ হইতে পারিবেক, ক্লাদিওর যখন কর্ণগোচর হইবেক তদীয় নিদারুণ অপবাদ বচনে সুতনু তনু ত্যাগ করিয়াছেন তখন তাঁহার মনোমধ্যে নায়িকার জীবদ্দশার ভাব অবশ্য আবির্ভূত হইবেক তাহাতে যদিস্যাৎ তাঁহার অন্তঃকরণে প্রণয়াঙ্কুর উৎপন্ন হইয়া থাকে তবে অবলার প্রতি যে অপবাদারোপ করিয়াছেন তাহার অলীকতায় জাতপ্রত্যয় হইয়া অনুতাপ করিবেন হায় কেন তাদৃশ নিষ্ঠুর বচন প্রয়োগ করিয়াছিলাম।

 বেনিদিক্‌ও ঋত্বিকের সহিত একবাক্য হইয়া কহিলেন মহারাজ এ অতি সৎ পরামর্শ বটে আপনি গ্রহণ করুন। আপনকার বিদিত আছে ক্লাদিও এবং রাজকুমার আমার পরম প্রিয়মিত্র কিন্তু আমি সত্য করিয়া কহিতেছি এ রহস্য তাঁহাদিগের নিকট কদাপি ব্যক্ত করিব না।

 লিয়নেত এবম্বিধ প্ররোচক বচনে পরিশেষে ঐ পরামর্শানুরূপ করিতে সম্মত হইলেন কিন্তু পরম স্নেহাস্পদ কন্যার কলঙ্কে সাতিশয় কাতর থাকাতে ব্যাকুলতা প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন আমি যৎপরোনাস্তি সন্তাপিত ও নৈরাশ্য নীরধির গভীর নীরে পতিত হইয়াছি, কোন উপায় দেখি না যে তদবলম্বনে আশ্বাসান্বিত হই। হীরোও তদ্রূপে বিষাদ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। অতএব দয়াশীল যাজক শান্ত্বনা করণার্থ তাঁহাদের দুই জনকে স্বালয়ে লইয়া গেলেন। সকলে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলে বিয়েত্রিশ্‌ ও বেনিদিক্‌ এই দুই জনের বিরলে পরস্পর আলাপ হইতে লাগিল। কিন্তু ইহাঁদের উভয়ের প্রথম সম্মিলনে আত্মীয় স্বজন যে আমোদ বা কৌতুকের আশা করিয়াছিলেন তাহা তৎ কালের আকস্মিক বিষাদে আচ্ছন্ন হইয়া গেল। ফলতঃ কান্ত কামিনীর মনোমধ্যে যদিও পরস্পর প্রণয় সঞ্চার হইয়াছিল তথাপি তাঁহাদের চিত্ত অতিশয় দুঃখে নিমগ্ন থাকাতে তদানীং তাহাতে প্রমোদ চিন্তা হইল না।

 বেনিদিক্‌ কোমল সম্বোধন পূর্ব্বক বিয়েত্রিশের প্রতি প্রশ্ন করিলেন সুন্দরি তুমি কি এখন পর্যন্ত রোদন করিবে? বিয়েত্রিশ্‌ উত্তর করিলেন আমার অশ্রু নিবারিত হয় না, হাঃ চিরকাল ক্রন্দন করিতে হইবেক। বেনিদিক্‌ বলিলেন অয়ি মুগ্ধে আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে তোমার ভগিনী নিতান্ত অনপরাধিনী। বিয়েত্রিশ্‌ সবিষাদ বচনে বলিলেন অয়ি ভগিনীর প্রতি আরোপিত অপবাদ বিমোচন করিতে সক্ষম এতাদৃশ কি কোন ব্যক্তি আছেন? যদি কেহ অপরাধ ভঞ্জন করিতে পারেন আমি তাঁহার নিকট চিরক্রীতা হইয়া থাকি। বেনিদিক্‌ এতদ্বাক্য শ্রবণে প্রীতি প্রদর্শন পূর্ব্বক ঈষদ্ধাস্য করত কহিলেন হে কোমলাঙ্গি এ কি অঙ্গীকার করিলে? এতদ্ভূমণ্ডল মধ্যে তোমা অপেক্ষা আমার প্রিয়তর কোন বস্তু নাই আমি যদিস্যাৎ এ কর্ম্ম করিতে পারি তবে কি আমারও ক্রীত স্বরূপ হইবে? কি আশ্চর্য্য। বিয়েত্রিশ্‌ তাঁহার প্রণয় সঞ্চার বুঝিয়া ভঙ্গি দ্বারা স্বীয় প্রেম প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন ত্রিভুবন মধ্যে তোমা অপেক্ষা আমারও প্রিয় সামগ্রী নাই, হে তরুণ আমি মিথ্যা কহিতেছি না, কিন্তু আমার এ কথায় ত্বরায় প্রত্যয় করিও না ফলতঃ সংপ্রতি আমি কোন বিষয় স্বীকার বা অস্বীকার করিতেছি না, ইদানী ভগিনীর নিমিত্ত সন্তাপিতা আছি। বেনিদিক্‌ কামিনীর এই কথা শ্রবণমাত্রে হর্ষোৎফুল্ল হইয়া মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করিলেন প্রেয়সি তুমি যাদৃশ আমার প্রতি অনুরাগিণী আমিও তদ্রূপ তোমার সহিত প্রণয়াকাঙ্ক্ষী। যাহা আজ্ঞা করিবে সর্ব্বান্তঃকরণে সম্পন্ন করিতে প্রস্তুত আছি। বিয়েত্রিশ্‌ বলিলেন তবে ক্লাদিওর প্রাণ সংহার করিয়া আইস দেখি। বেনিদিক্‌ এতদাদেশে বিমর্ষ প্রকাশ পুরঃসর সবিনয় বচনে কহিলেন সুন্দরি ক্লাদিও আমার সুস্নিগ্ধ বন্ধু, দ্বিতীয় জীবন স্বরূপ, যদি ত্রিভুবনাধিপত্য লভ্য হয় তথাপি আমি তাঁহাকে বধ করিতে পারিব না। বিশেষতঃ তাঁহার অপরাধ নাই, আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে কেবল ভ্রমে পতিত হইয়া সুশীলা হীরোর প্রতি কলঙ্কারোপ করিয়াছেন। বিয়েত্রিশ্‌ কোপে কম্পিত কলেবরা হইয়া কহিলেন আঃ ক্লাদিও অতি দুরাত্মা, সে আমার প্রিয়তমা ভগিনীর পরম পবিত্র চরিত্রে কৃত্রিম কলঙ্ক অঙ্কন পুরঃসর তাঁহার মর্মান্তিক অপমান করিয়াছে। হাঃ বিধাতঃ আমাকে কেন পুরুষ করিয়া সৃষ্টি কর নাই, এই দণ্ডে গমন করিয়া সে পাপাত্মার প্রাণ সংহার করিতাম। বেনিদিক্‌ শান্ত্বনা করত কহিতে লাগিলেন প্রেয়সি আমার কথা শ্রবণ কর। কিন্তু কামিনী তাঁহাকে ক্লাদিওর পক্ষপাতি বোধ করিয়া তদুক্ত বাক্যে কর্ণপাত করিলেন না, ভগিনীর প্রতি আরোপিত অপবাদের প্রতিক্রিয়া নিমিত্ত পুনঃ২ অনুরোধ করিতে লাগিলেন অবশেষে অধীরা হইয়া পরিতাপ করত কহিলেন গবাক্ষ দ্বার হইতে পুরুষের সহিত আলাপ করিয়াছেন, এ কথা কি সত্য? হা প্রিয়তমা হীরো, বিনা দোষে মনঃপীড়া পাইলে, তোমার চরিত্রে বৃথা কলঙ্কারোপ হইল। আঃ ক্লাদিওর নিমিত্ত আমি কেন পুরুষ হই নাই? আহা এক জন পুরুষও আমার সুহৃদ্‌ নাই। মনুষ্যজাতির শৌর্য্য শীলতায় গলিত হয়, ইচ্ছা মাত্রে পুরুষ হইতে পারি না, অতএব অবলার তুল্য শোকে বিকল হইয়া প্রাণত্যাগ করিতে হইল। বেনিদিক্‌ বিবিধ প্রকারে প্রবোধ প্রদান পুরঃসর বলিতে লাগিলেন অয়ি কোমলাঙ্গি ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক শোকাবেগ কিঞ্চিৎ সহিষ্ণুতা কর। এই কর প্রসারণ করত শপথ করিয়া কহিতেছি আমি তোমার পরম সুহৃদ্‌ এবং আপনার প্রাণ তুল্য তোমাকে ভাল বাসি। বিয়েত্রিশ্‌ বলিলেন হে প্রিয় তবে এই দোর্দণ্ডকে দিব্য করণে নিয়োগ না করিয়া আ মরি প্রণয়ানুরোধে মদাদেশিত ব্যাপারে প্রয়োগ কর দেখি। বেনিদিক্‌ জিজ্ঞাসা করিলেন হে সুলোচনে তোমার কি নিশ্চয় প্রত্যয় হইয়াছে ক্লাদিও বিনা ভ্রমে দুরাত্মতা পূর্ব্বক হীরোর চরিত্রে কলঙ্কারোপ করিয়াছেন? বিয়েত্রিশ্‌ উত্তর করিলেন আমার জীবাত্মা ও চিন্তাশক্তির সত্তায় যদ্রূপ সংশয় নাই এতদ্বিষয়েও তদ্রূপ সন্দেহমাত্র হয় না। বেনিদিক্‌ বলিলেন তবে আমি তোমার অভীষ্ট সাধনে প্রবৃত্ত হইলাম এই মুহূর্তে ক্লাদিওর সমীপে গমন পুরঃসর যুদ্ধ যাচ্ঞা করিতেছি। তোমার এই কর চুম্বন পূর্ব্বক যাত্রা করি অবিলম্বে আপনার দোর্দণ্ড দ্বারা প্রতিফল প্রদান পুরঃসর দৌরাত্ম্যের পরিশোধ লইয়া আসিব। প্রিয়ে এক্ষণে আমার প্রমুখাৎ যদ্রূপ শ্রবণ করিতেছ প্রত্যাগমন করিলে তদ্রূপ কর্ম্ম সমাধা প্রত্যক্ষ করিবে, যাও, অধুনা প্রবোধ প্রদান করিয়া প্রিয়া ভগিনীর শোক সান্ত্বনা কর।

 যৎকালে বিয়েত্রিশ্‌ সরোষ বচনে বাদানুবাদ করত বেনিদিকের বীরত্ব স্বভাব উষ্মান্বিত করিলেন এবং হীরোর পক্ষ হইয়া ক্লাদিওর সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইতে তাঁহার প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দিলেন সেই সময় লিয়নেত কন্যার কলঙ্কে ক্রুদ্ধ হইয়া রাজকুমার ও ক্লাদিওর নিকট গমন পূর্ব্বক তাঁহাদের সহিত অসি যুদ্ধ যাচ্ঞা করিতেছিলেন এবং কোপে কহিতেছিলেন তোমাদের আরোপিত অপবাদে আমার নির্দোষ দুহিতা প্রাণ ত্যাগ করিয়াছেন। নৃপনন্দন এবং ক্লাদিও বৃদ্ধের শোকে সাতিশয় ক্ষোভ প্রকাশ করিতেছিলেন এবং সম্মান প্রদর্শন পুরঃসর মৃদুস্বরে বলিতেছিলেন হে বর্ষিষ্ঠ আর কেন অনর্থক কলহ উত্থাপন করেন? ইত্যবসরে বেনিদিক্‌ তথায় গিয়া উপস্থিত হইলেন এবং হীরোর প্রতি অহিতাচরণ নিমিত্ত ক্লাদিওর নিকট সমর প্রার্থনা করিলেন। রাজতনয় এবং ক্লাদিও আপনাদের বন্ধু বেনিদিক্‌কে অকস্মাৎ এবম্প্রকার বিপক্ষ দেখিয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন বিয়েত্রিশের বচনে বেনিদিক্‌ ঈদৃগ্‌ভাবাপন্ন হইয়াছেন সন্দেহ নাই। তদনন্তর ক্লাদিও বেনিদিকের প্রার্থনায় সম্মত হইয়া সমরে প্রবৃত্ত হন্‌ ইতিমধ্যে ধর্ম্মের সূক্ষ্মা গতি দ্বারা হীরোর সতীত্ব হঠাৎ সপ্রমাণ হইল সুতরাং বাদি প্রতিবাদি উভয়ের মধ্যে কাহাকেও রণের অনিশ্চিত সৌভাগ্যের উপর নির্ভর করিতে হইল না।

 নৃপকুমার এবং ক্লাদিও যে সময় আপনাদের পরম প্রণয় ভাজন বন্ধু বেনিদিকের যুদ্ধ যাচ্ঞায় বিস্ময় প্রকাশ পূর্ব্বক কথোপকথন করিতেছিলেন দৈবাৎ তৎকালে এক জন বিচারপতি বোরাকিওকে ধারণ করিয়া নৃপতনয়ের সন্নিধানে আনয়ন করিলেন। ঐ ব্যক্তি দঞ্জনের নিয়োগে উৎপাত উথাপন করিয়া তদ্বিষয়ে এক জন সঙ্গির সহিত কথোপকথন করিতেছিল বিচারক তাহা স্বকর্ণে আকর্ণন করিয়াছিলেন।

 বোরাকিও রাজকুমারের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া অকপটে ব্যক্ত করিল মার্গেরেত্‌ নাম্নী হীরোর সহচরী ঠাকুরাণীর পরিচ্ছদ পরিধান পূর্ব্বক তাঁহার শয়নাগারের গবাক্ষ দ্বার হইতে সেই নিশাভাগে আমার সহিত প্রণয়ালাপ করিতে ছিল আপনারা তদবলোকনে ভ্রান্ত হন এবং সেই অমূলক ভ্রমবশতঃ নির্দোষা হীরোর সতীত্বে সন্দেহ করেন। ক্লাদিও সমনস্ক শ্রবণেন্দ্রিয় সংযোগ পূর্ব্বক তাঁহার কথা শ্রবণ করিতেছিলেন দঞ্জনের অধম ব্যবহারে আপনাদের মতিভ্রম জানিতে পারিলেন। দুরাত্মা দঞ্জন এই রহস্য প্রকাশ হইবামাত্র বৃদ্ধ ও বেনিদিকের কোপ হইতে পরিত্রাণ নিমিত্ত মেসিনা নগর হইতে পলায়ন করিল অতএব হীরোর চরিত্রে সকলের মনে যে সংশয় জন্মিয়াছিল তাহা একেবারে দূরীভূত হইল।

 ক্লাদিও যখন জানিতে পারিলেন নিরপরাধ হীরোর পবিত্র চরিত্রে অলীকাপবাদ আরোপ করিয়াছেন তখন অনুতাপে ব্যাকুল হইলেন এবং শোকে তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ হইতে লাগিল। মনে করিলেন সুলোচনা আমার নিষ্ঠুর বচন বাণে বিদারিত হৃদয়া হইয়া জীবন বিসর্জ্জন করিয়াছেন। অপর সেই বরবর্ণিনীর অপরূপ রূপ লাবণ্য তাঁহার স্মৃতিপথে প্রকাশমান হইল তাহাতে বিষমশরের প্রখর শরে অন্তঃকরণ মধ্যে জর্জ্জরিত হইতে লাগিলেন। রাজনন্দন বোরাকিওর বাক্য শ্রবণাবধি আপনাদের অসদ্ব্যবহারের বিষয় ভাবিতেছিলেন, ক্লাদিওকে জিজ্ঞাসা করিলেন সখে যে কথা কর্ণগোচর হইল তাহাতে কি তোমার হৃদয় শল্য বিদ্ধ তুল্য হইল না? ক্লাদিও উত্তর দিলেন মহারাজ বর্বর বোরাকিও যখন কথা কহিতেছিল তৎকালে আমার বোধ হইল যেন স্বহস্তে কালকূট পান করিয়াছি।

 তৎপরে ক্লাদিও পশ্চাত্তাপ করিতে২ লিয়নেতের নিকট পুনর্ব্বার গমন করিলেন এবং তাঁহার তনয়ার প্রতি অকারণে অলীক কলঙ্কারোপ নিমিত্ত আপন অপরাধের মার্জ্জনা প্রার্থনা করত কহিলেন মহাশয় আমি পত্নীর প্রতি অসত্য অপবাদ আরোপ করিয়া মহাপরাধ করিয়াছি আপনি আমার উপর যে দণ্ডাজ্ঞা করিবেন প্রেয়সীর নিমিত্ত এই দণ্ডে তাহা গ্রহণ করিতে প্রস্তুত আছি।

 লিয়নেত তাঁহার অনুতাপে দয়ার্দ্র হইলেন এবং তাঁহার উপর উত্থিত বৈর বিস্মরণ পূর্ব্বক এই স্নেহান্বিত বচন কহিলেন ক্লাদিও আমি তোমার এই দণ্ড করিতে চাহি হীরোর অনুরূপ একটী অনুজা আছে, এক্ষণে সেই কুমারী আমার উত্তরাধিকারিণী, তুমি কল্য প্রাতঃকালে তাহার পাণিগ্রহণ কর। ক্লদিও এই কথায় আপনাকে অনুগৃহীত বোধ করিয়া সত্য করত অঙ্গীকার করিলেন মহাশয় সেই রমণী আমার পরিচিতা নহে কিন্তু যদি কুৎসিত ও নির্গুণ হয় তথাপি আপনকার আদেশে বিনা আপত্তিতে তাহার কর গ্রহণ করিব। এই কথা বলিয়া স্বীয় মনো মধ্যে হীরোর নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি বিষাদ করিতে লাগিলেন এবং সেই দিন নিশাভাগে শ্মশান স্থানে গমন পূর্ব্বক প্রেয়সীর চিতার নিকট উপবেশন করত সজল নয়নে সমস্ত বিভাবরী বিলাপ করিলেন।

 তদনন্তর রজনী প্রভাতা হইলে ক্লাদিও রাজকুমার সমভিব্যাহারে পরিণয়ের সভায় প্রবেশ পূর্ব্বক অবলোকন করিলেন সুবিজ্ঞ পুরোহিত লিয়নেত এবং তদীয় ভ্রাতৃতনয়া শুভ কর্ম্ম সম্পাদন নিমিত্ত উপস্থিত আছেন। পরে লিয়নেত সভাস্থ সকলের সমক্ষে যথা বিধি কন্যা সম্প্রদান করিলেন এবং ক্লাদিও অঙ্গীকারানুসারে কুমারীর কর গ্রহণে সত্বর হইলেন। কিন্তু কামিনী কপট বেশ ধারণ পূর্ব্বক আপনার প্রকৃত আকার গোপন করিয়া রাখাতে তদীয় বদন সুধাকর অকলোকন করিতে পাইলেন না। অতএব সন্দিগ্ধচিত্তে তাঁহার প্রতি কহিলেন এই ধর্ম্মিষ্ঠ যাজকের সাক্ষাৎ আমাকে কর প্রদান পুরঃসর বিবাহ করিতেছ অদ্যাবধি আমি তোমার পতি এবং তুমি আমার পত্নী হইলে। কন্যা অবগুণ্ঠন মধ্যে থাকিয়া উত্তর করিলেন জীবিতাবস্থায় আমি তোমার প্রথমা ভার্য্যা ছিলাম এই কহিয়া বদনাবরণ উন্মোচন করিলে প্রকাশ হইল তিনি লিয়নেতের ভ্রাতৃতনয়া নহেন তাঁহারই হীরো নাম্নী কন্যা। অতএব ক্লাদিও সাতিশয় চমৎকৃত হইয়া চিত্ত মধ্যে পরমাপ্যায়িত হইলেন কেননা নিশ্চয় বোধ হইয়াছিল হৃদয়বল্লভা বনিতা বচন বাণে বিদ্ধা হইয়া জীবন বিসর্জ্জন করিয়াছেন সুতরাং জীবিতেশ্বরীকে পুনর্জীবিতা প্রাপ্ত হওয়াতে আনন্দে গদ্গদ হইয়া নয়নের অবিকৃত কার্য্যে ক্ষণকাল অপ্রত্যয় করিতে লাগিলেন এবং মনে২ কহিলেন ইনি কি সেই হীরো? নৃপনন্দনও এই ব্যাপার অবলোকনে বন্ধুর ন্যায় বিস্ময়াকুল হইলেন পরে সংশয় প্রকাশ করত জিজ্ঞাসা করিলেন এই যুবতী কি কালধর্ম্মগতা সেই হীরো নহে? লিয়নেত উত্তর করিলেন হে রাজকুমার যাবৎ তাঁহার কলঙ্ক ছিল তাবৎ পর্য্যন্ত মৃতাবস্থায় ছিলেন। পরে পুরোহিত কহিলেন শুভকর্ম্ম সম্পাদনান্তে এই আশ্চর্য্য বিষয়ের বিবরণ ব্যক্ত করা যাইবেক সংপ্রতি পরিণয়ের ইতিকর্ত্তব্যতার সমাধা হউক, এই বলিয়া তৎকার্য্য নির্ব্বাহে প্রবৃত্ত হন্‌ ইত্যবসরে বেনিদিক্‌ বাধক স্বরূপ হইয়া কহিলেন হে বিজ্ঞ পুরোহিত বিয়েত্রিশের সহিত আমার বিবাহ দিয়া দুই কর্ম্ম এককালীন সমাধা করিতে আজ্ঞা হউক। পরে বিয়েত্রিশকে পাণি দানে বিলম্ব করিতে দেখিয়া স্পর্দ্ধা করত কহিলেন প্রিয়ে আমি সবিশেষ শুনিয়াছি তুমি আমার প্রণয়াকাঙ্ক্ষিণী, তবে আর কেন কালক্ষেপ কর? তাঁহার এই কথায় এক্ষণে অনুসন্ধানের প্রয়োজন হইল এবং প্রকাশ পাইল যে উভয়ে অন্যের আরোপিত প্রণয়ে পরস্পর বদ্ধপ্রেম হইয়াছেন বস্তুতঃ আদৌ কাহারো মনে স্নেহ সঞ্চার হয় নাই অপরে কৌতুক করিবার আশয়ে উভয়ের যে প্রণয় কল্পনা করেন তাহাতেই অন্যোন্যানুরাগ জন্মিয়াছিল এবং তদ্বারা ক্রমে স্নেহপ্রবৃত্তি হওয়াতে সেই আরোপিত প্রেমই বদ্ধমূল হইয়াছিল সুতরাং পরে অনুসন্ধান দ্বারা কৃত্রিমতা প্রকাশ হইলেও তাহার উন্মূলন হইল না। অনন্তর বেনিদিক্‌ আপন প্রণয়িনীর পাণিগ্রহণে উদ্যত হইয়া মুক্তকণ্ঠে কহিলেন ইদানী যদিস্যাৎ অবনীমণ্ডলস্থ সমস্ত মানব এই পরিণয়ের অন্যায়তা স্থাপন পূর্ব্বক আপত্তি করেন তথাপি তাহা গ্রাহ্য করিব না পরে অপরাপর কৌতুকে কিয়ৎক্ষণ যাপন করিয়া বলিলেন আমি আন্তরিক স্নেহ পরবশ হইয়া বিয়েত্রিশের পাণি গ্রহণ করিতেছি যেহেতু শ্রবণ করিয়াছিলাম প্রেয়সী প্রেমের নিমিত্ত মৃতকল্প হইয়া ছিলেন। বিয়েত্রিশও অকপট বচনে বলিতে লাগিলেন আমার কর্ণগোচর হইয়াছিল বেনিদিক্‌ মৎ প্রতি বদ্ধানুরাগতা হেতু ক্ষিপ্ত ও মৃত প্রায় হইয়া বহু ক্লেশ পাইয়াছেন, তাঁহার প্রাণ রক্ষা নিমিত্ত স্নেহান্বিত হইয়া পাণি দানে প্রবৃত্ত হইতেছি। অতএব ক্লাদিওর সহিত তদীয় হৃদয় বল্লভ হীরোর পরিণয় সমাধা হইলে বেনিদিকের সহিত তাঁহার প্রণয়িনী বিয়েত্রিশের বিবাহ সম্পন্ন হইল এবং রসিক রসিকা পূর্ব্ব ভাব বিস্মরণ পূর্ব্বক প্রণয়ে কাল হরণ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। পরে হীরোর প্রতি ক্লাদিওর অনুরাগ দর্শনে অসহিষ্ণু হইয়া তাহার উন্মূলন নিমিত্ত দঞ্জন্‌ নামা যে দুরাত্মা ষড়যন্ত্র করিয়াছিল সে পথিমধ্যে ধৃত হইয়া মেসিনা নগরে আনীত হইল এবং তাহার মাৎসর্য্যের এই প্রতিফল হইল যে রাজসদনে হীরোর সহিত ক্লাদিওর সম্মিলন নিমিত্ত মহামহোৎসব তাহাকে স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিতে হইল ইতি।