সেক্সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/শীতকালের উপন্যাস
সেক্সপিয়র।
শীতকালের উপন্যাস।
শিশিলী উপদ্বীপের লিয়নিতিস্ নামা নরপতি স্বীয় ধর্ম্ম পরায়ণা মনোহর রূপ বরবর্ণিনী সহধর্ম্মিণী হারমিয়নী সহ পরম কৌতুকে কাল যাপন করিতেন এবং প্রণয়িনীর সঙ্গে প্রেম রঙ্গে অনির্ব্বচনীয় সুখানুভব হওয়াতে কৃতার্থম্মন্য হইয়া হৃদয়ঙ্গম মিত্রকে আপনার ভার্য্যা ভাগ্য প্রদর্শন পূর্ব্বক চিত্ত চকোর পরিতৃপ্ত করিবেন এতদর্থ সতত সমুৎসুক ছিলেন। অতএব আবালবন্ধু বোহিমিয়াধিরাজ, পলিক্সেনিস্কে আপন ভবনে আনয়ন নিমিত্ত বারম্বার আহ্বান করিতেন। শৈশবকালে তাঁহাদের এক সঙ্গে বিদ্যাভাস এবং সর্ব্বদা একত্র সহবাস থাকাতে উভয়ে পরস্পর স্নেহ সূত্রে দৃঢ়রূপে বদ্ধ ছিলেন কিন্তু তদনন্তর দুই জনেরই পিতৃ বিয়োগ হওয়াতে স্ব২ পৈতৃক রাজ্যে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক সিংহাসনাধিরূঢ় হন সুতরাং তদবধি বহুকাল যাবৎ অন্যোন্যের সাক্ষাৎ লাভ হয় নাই। লিপিযোগে ও দূতদ্বারা পরস্পর সমাচার গ্রহণ এবং সময়ে২ উপহার প্রেরণ করিতেন।
বোহিমিয়াধিপতি পলিক্সেনিস্ পরম সুহৃৎ লিয়নিতিসের বারম্বার অভ্যর্থনায় বাধ্য হইয়াছিলেন। বন্ধুর অনুরোধ রক্ষা না করা মূঢ়ত্বের চিহ্ন বিবেচনা করিয়া কিয়দ্দিনানন্তর তাহার সহিত সাক্ষাৎ করণার্থ স্বরাজ্য হইতে যাত্রা করত শিশিলীর রাজধানী নগরে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
পলিক্সেনিস্ শিশিলীর রাজধানীতে উপনীত হইবামাত্র লিয়নিতিস্ পরমসমাদর সহকারে তাহার প্রত্যুদ্গমন করিলেন এবং পরস্পর সাক্ষাৎকারলাভে সাতিশয় সন্তোষান্বিত ও মহা হর্ষিত হইলেন। পরে শিশিলীরাজ আপন প্রেয়সী মহিষীকে বন্ধুর অভ্যর্থনা করিতে অনুরোধ করিয়া মিত্রের আগমন নিমিত্ত আনন্দোৎসব করিলেন এবং উভয়ে একাসনে অধিবেশন পুরঃসর কথোপকথন করত অনির্বচনীয় সুখানুভব করিতে লাগিলেন। উভয়েই পাঠাবস্থার বৃত্তান্ত সকল বিশেষতঃ বাল্য কালের লীলা স্মরণ পুরঃসর কথোপকথন করিতে কৌতুকী হইলেন। লিয়নিতিস্ সে সমস্ত বিষয় আপন প্রিয়তমা হারমিয়নীর নিকট ইতিপূর্বে সবিশেষ বর্ণন করিলেও তিনি ঐ কথোপকথনের মধ্যে থাকিয়া হর্ষে পুলকিত হইতে লগিলেন।
বোহিমিয়াধিপতি পলিক্সেনিস্ মিত্রের সহিত পরমামোদে কিয়ৎ কাল শিশিলীতে অবস্থিতি করিয়া স্বদেশে প্রত্যাগমনের উদ্যোগ করিলেন। তাহাতে লিয়নিতিস্ এবং তাঁহার বনিতা বিমর্ষান্বিত হইলেন এবং উভয়ে একত্র হইয়া বয়স্যকে যথেষ্ট বিনয় সহকারে কহিতে লাগিলেন আরো কতক দিন অবস্থান করিলে অপর্যাপ্ত তৃপ্তি প্রাপ্ত হই।
কিন্তু অতঃপর নৃপাঙ্গনা হারমিয়নীর অকস্মাৎ অসৌভাগ্যোদয়ের উপক্রম হইল কেননা পলিক্সেনিস্ স্বদেশ গমনে সাতিশয় সমুৎসুক হইয়াছিলেন মিত্র বারম্বার অবস্থিতি করিতে অনুরোধ করিলেও জিগমিষা পরিত্যাগ করিলেন না কিন্তু যখন ঐ মহিলা সুমধুর ও প্ররোচক বচনে বিনয় পুরঃসর কিয়ৎকাল অবস্থিতি করিতে উপরোধ করিতে লাগিলেন তখন তদীয় সুশীলতা ও বিনয়ৌদার্য্যে বিশেষতঃ পরমার্য্য চরিত্রে সন্তুষ্ট থাকাতে তাঁহার কথায় স্বীয় যাত্রা রহিত করিলেন। লিয়নিতিস্ মিত্রের সচ্চরিত্র ও জিতেন্দ্রিয়তা যদিও উত্তমরূপে অবগত ছিলেন এবং আপন বনিতারও পাতিব্রাত্য ও ধর্ম্মনিষ্ঠার প্রমাণ সর্ব্বদা প্রাপ্ত হইতেন তথাপি এই ব্যাপারে তাঁহার অন্তঃকরণে উৎকট সন্দেহ ও দারুণ ঈর্ষার উদয় হইল। হারমিয়নী কেবল স্বামির সন্তোষ নিমিত্ত তদীয় সুহৃৎ পলিক্সেনিসের প্রতি বিশেষ যত্ন করিয়াছিলেন কিন্তু তাহাতে এক্ষণে বিপরীত ফল ফলিবার উপক্রম হইল। তাঁহার পরম প্রণয়ি পতির চিত্ত স্নেহশূন্য হইয়া ঈর্ষানলে দগ্ধ হইতে লাগিল। এবং অকৃত্রিম প্রণয়ানুরক্ত প্রিয় ভর্ত্তা নিতান্ত নির্দয় দুরাত্ম বৈরিবৎ ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইলেন কেননা তিনি কেমিলো নামক এক জন পারিষদের নিকট আপনার মনের সন্দেহ ব্যক্ত করত বিষ প্রদান দ্বারা পলিক্সেনিসের প্রাণ বিনাশ করিতে আজ্ঞা দিলেন।
কেমিলো অতি সাধু ও সদ্বিবেচক পুরুষ ছিলেন। পরিনাম দর্শিনী মনীষা দ্বারা বিবেচনা করিয়া নিশ্চয় করিলেন লিয়নিতিসের সন্দেহ সমূলক নহে। অতএব তাঁহার আজ্ঞাক্রমে পলিক্সেনিস্কে বিষপান করাইলেন না গোপনে রাজার জিঘাংসার মানস প্রকাশ করিয়া অবিলম্বে শিশিলী হইতে পলায়ন পরায়ণ হইতে পরামর্শ দিলেন এবং আপনিও তৎসমভিব্যাহারে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন। পলিক্সেনিস্ সন্দিগ্ধ চিত্ত মিত্রের এবম্প্রকার বৈর পারবশ্য বিদিত হইয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং প্রাণ ভয়ে ব্যাকুল হইয়া শশব্যস্ত হওত তৎক্ষণেই কেমিলো সমভিব্যাহারে প্রস্থান করিয়া কিয়দ্দিন মধ্যে আপনার রাজ্যে গিয়া উত্তীর্ণ হইলেন। কেমিলো বিদ্রোহি মিত্রের হস্ত হইতে রাজাকে রক্ষা করাতে রাজ সভার প্রধান পারিষদ ও নৃপতির পরম প্রণয় ভাজন বন্ধু হইয়া মহাসুখে সেই স্থানেই কাল যাপন করিতে লাগিলেন।
পলিক্সেনিস্ পলায়ন করিলে লিয়নিতিস্ তাহার সহিত অপিন বনিতার ব্যভিচার নিশ্চয় করিয়া ক্রোধে প্রজ্বলিত হইলেন এবং কোপ কম্পিত কলেবরে অন্তঃপুর প্রবেশ পূর্ব্বক মহিষীর আবাসে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন রাণী স্বতনয় মেমিলসের সঙ্গে একত্র উপবিষ্টা আছেন এবং কুমার আপন প্রসূতির প্রমোদ নিমিত্ত উপন্যাস কহিতেছে। তিনি অনিবার্য্য ক্রোধের বশম্বদ থাকাতে সন্তানকে স্থানান্তরে রাখিয়া হঠাৎ সহধর্মিণীর কেশাকর্ষণ পুরঃসর কারারূপ এক কুৎসিত অলিয়ে লইয়া গিয়া তাঁহাকে অবরুদ্ধ করিলেন।
মেমিলস্ যদিও অতি শিশু, তথাপি জননীর প্রতি সাতিশয় অনুরক্ত ও যথেষ্ট স্নেহবান থাকাতে সমক্ষে তাঁহাকে তদ্রূপে অপমানিত হইয়া কারাগারে প্রেরিত হইতে অবলোকন করিয়া মনোমধ্যে যৎপরোনাস্তি ব্যথিত হইল এবং অন্তঃকরণের অসুখে অহরহ তাহার শরীর শীর্ণ হইতে লাগিল আর তাহার ক্ষুধা তৃষ্ণা সকলই অন্তর্ধান হইল তাহাতে সকলে অনুমান করিতে লাগিল মাতৃ শোকে তাহার ঈদৃশী দশা হইয়াছে শেষে প্রাণ বিনাশের সম্ভাবনা।
লিয়নিতিস্ রাজা প্রেয়সী মহিষীকে ব্যভিচারাশঙ্কায় কারাবদ্ধ করণানন্তর এপলো দেবের মন্দিরস্থ বিখ্যাত বিজ্ঞ মহান্তের নিকট তদীয় পাতিব্রাত্য ও চরিত্রানুসন্ধান নিমিত্ত শিশিলী দেশের ক্লিয়মিনিস্ ও দাইয়ন্ নামক দুই জন মর্য্যাদাবান্ পুরুষকে দেল্ফস্ নগরে প্রেরণ করিলেন।
এদিকে হারমিয়নী রাণী বন্ধনালয়ে থাকিয়া কিয়ৎকাল গতে পরম রূপবতী এক কুমারী প্রসব করিলেন। বালিকার রূপ লাবণ্য অবলোকনে রাজ মহিষীর অকারণ ক্লেশ দুষিত চিত্তের যথেষ্ট শান্ত্বনা হইল। তিনি কন্যাকে সম্বোধন পুরঃসর সকরুণ বচনে কহিতে লাগিলেন অরে হতভাগ্য নন্দিনি তুমি যদৃিশ দোষ লেশের সম্পর্ক শূন্যা, আমিও তাদৃশী।
শিশলী নিবাসী আন্তিগোনসাভিধ এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির ললনা পালিনা নামিকা কোন দয়ালু অবলা হরমিয়নীর সখী ছিলেন। সেই রমণী দুঃখিনী রাণীর প্রসব সংবাদ প্রাপ্তি মাত্রে কারাগারে গমন পূর্বক রাজমহিষীর এমিলিয়া নাম্নী সহচরীকে কহিল। এমিলিয়া তুমি আমার নাম গ্রহণ পুরঃসর রাজ্ঞীকে জিজ্ঞাসা কর তাঁহার সদ্যঃ প্রসূতা সুতাটী আমাকে বিশ্বাস করিয়া অর্পণ করিতে পারেন কি না? আমার বাসনা এই যে কুমারীকে রাজ সাক্ষাৎকারে লইয়া যাই, নন্দিনী সন্দর্শনে নৃপতির আনন্দ সহকারে করুণোদয় হইবেক কি না নিশ্চয় কহিতে পারি না। কিন্তু বোধ হইতেছে অপত্য স্নেহ অবশ্যই তাঁহাকে আক্রমণ করিবে। রাণীর সহচরী এমিলিয়া এতৎ শ্রবণে হর্ষান্বিত হইয়া অতিমাত্র ব্যগ্রতা সহকারে উত্তর করিল আর্য্যে আপনকার এই আর্য্যাভিপ্রায় অধুনাই রাজ মহিষী সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক বিজ্ঞাপন করি, তিনি অদ্য কহিতেছিলেন তাঁহার কোন আত্মীয় স্বজন অথবা বন্ধু বান্ধব সাহস করিয়া যদিস্যাৎ বালিকাটী নৃপাল সমক্ষে লইয়া যায় তাহা হইলে ভাল হয়। পালিনা বলিলেন তবে রাণীকে বিজ্ঞাপন কর তাঁহার সতীত্বের প্রতি সংশয় করিয়া রাজা যে অলীক কলঙ্কারোপ করিয়াছেন তন্নিরাকরণ নিমিত্তও আমি নৃপতি সমক্ষে ভীতি পরিহার পুরঃসর বক্তৃতা করিব। এমিলিয়া কহিল ঠাকুরাণি আপনি রাণীর প্রতি করুণান্বিতা হইয়া এই প্রকারে যে স্নেহ প্রকাশ করিতেছেন এতজ্জন্য পুণ্য পুঞ্জে পরিতুষ্ট হইয়া পরমেশ্বর আপনার মঙ্গল করিবেন। তদনন্তর মহিষীর সদনে গমন পূর্ব্বক তদীয় অকপট সৌহার্দ্য সমন্বিত সখীর সমস্ত উক্তি ব্যক্ত করিল। তাহাতে রাণী আপন নন্দিনী দ্বারা দুর্ভাগ্য দমনাশয়ে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া পালিনাকে সম্বোধন পুরঃসর সানন্দ মনে কন্যাটী তাঁহার ক্রোড়ে সমর্পণ করিলেন। তিনি অব্যবহিত পূর্ব্ব ক্ষণে মনে করিতেছিলেন তাঁহার দুরদৃষ্ট বশতঃ কেহ ঐ বালিকাকে ভূপাল সাক্ষাৎকারে লইয়া যাইতে সাহস করিবে না।
পালিনা রাজ কুমারীকে অঙ্কে আরোপণ পূর্ব্বক নৃপ সমীপে গমনোদ্যতা হইলে তাহার স্বামী রাজার ক্রোধাবেগ আশঙ্কায় স্ত্রীকে নিষেধ করিলেন কিন্তু তিনি শুনিলেন না, রাজসম্মুখে উপস্থিত হইয়া দুগ্ধপোষ্যা কন্যাটীকে স্বক্রোড় হইতে অবতারণ পুরঃসর ভূপতির চরণতলে নিক্ষেপ করিলেন। পরে হারমিয়নীর নির্দোষিতা সুচক এক বক্তৃতা এবং নিষ্ঠুরতার নিমিত্ত রাজার অনুযোগ করিয়া অপত্য কলত্রের প্রতি দয়া প্রার্থনা করিলেন। পালিনার এরূপ সাহসিক আচরণে লিয়নিতিস্ রাজার ক্রোধ বৃদ্ধি হইল, ভূপতি ঐ অবলার পতি আন্তিগেনিসের প্রতি আদেশ করিলেন তোমার বনিতাকে আমার দৃষ্টি হইতে দূর করিয়া দাও।
পালিনা গমন কালে এই আশ্বাসে রাজার চরণতলে বালিকাটী রাখিয়া গেলেন যে রাজা নির্জন হইলে নির্দোষ নিরাশ্রয় শিশুর প্রতি দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক স্নেহান্বিত হইবেন।
কিন্তু সুশীলা পালিনার উক্ত প্রকার অশ্বাস পরিণামে কেবল ভ্রমময় বোধ হইল যেহেতু তিনি গমন করিবা মাত্র নির্দয় নৃপতি তৎপতি আন্তিগোনসের প্রতি আদেশ করিলেন এই বালিকাটাকে সমুদ্র পারে কোন অরণ্যানী মধ্যে নিক্ষেপ করিয়া আইস যেখানে অবিলম্বে গতাসু হইয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইতে পারে।
আন্তিগোনস্ রাজমন্ত্রি কেমিলোর তুল্য সদ্বিবেচক বা সচ্চরিত্র ছিল না সুতরাং রাজাজ্ঞা প্রাপ্তি মাত্রে অসংশয়ে তাহা পালন করিতে উদ্যত হইল এবং কন্যাটী গ্রহণ পুরঃসর অর্ণব তরি আরোহণ করিয়া সাগর পার স্থিত বিপিন মধ্যে নিক্ষেপ করিতে প্রস্থান করিল।
ভূপতির অন্তঃকরণে আপন বনিতা হারমিয়নীর অরোপিত ব্যভিচারাশঙ্কা বদ্ধমূল হওয়াতে তিনি ঈদৃশ বিদ্বেষ বশম্বদ হইলেন যে এপলো দেবের পরোক্ষদর্শি বিজ্ঞ মহান্তের সমীপে তদ্বিষয়ক অনুসন্ধান নিমিত্ত ক্লিয়মিনিস্ ও দাইয়ন্ নামক যে দুই ব্যক্তিকে প্রেরণ করেন তাহাদের প্রত্যাগমন প্রতীক্ষায় অসমর্থ হইয়া কন্যা বিয়োগে শোকাকুলা রাণীর সূতিকাবস্থাতেই তদীয় কল্পিত কলঙ্কের পরীক্ষা নিমিত্ত প্রাজ্ঞ ও মর্য্যাদাবন্ত পারিষদ গণকে অনুমতি করিলেন। অতএব বিচারক বর্গ ও রাজ্যের সমস্ত সম্ভ্রান্ত মানব নিকর রাজ্যাধিপতি মহিষীর দোষ বিচার নিমিত্ত সভা করিয়া অধ্যাসীন হইলে দুর্দৈবোপহতা রাণী কারাগার হইতে নীতা হইয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে তাঁহাদের সমক্ষে দণ্ডায়মান হইলেন। এতদবসরে এপলো দেবের মন্দির হইতে ক্লিয়মিনিস্ ও দাইয়ন্ মহান্তের লিপি হস্তে করিয়া প্রত্যাগমন পূর্ব্বক সেই সভায় আসিয়া উপস্থিত হইল এবং সানন্দ মনে নরনাথের হস্তে আনীত পত্রী প্রদান করিল। রাজা পত্রী প্রাপ্তে বিকসিত করিয়া উচ্চৈঃস্বরে পাঠ করিতে আদেশ করিলেন। সেই লিপি হইতে মহান্তের এই কথা ব্যক্ত হইল। যথা হারমিয়নী পরম পবিত্রা, তাহাতে দোষ লেশের সম্পর্কও নাই, পলিক্সেনিস্ সম্পূর্ণ নির্দোষ, কেমিলো অতি ধার্ম্মিক প্রজা, লিয়নিতিস্ অলীক শঙ্কা পিশাচীর পরবশ হইয়াছে। যাহা হউক স্বদোষে যাহা হারাইয়াছে তাহা পুনঃপ্রাপ্ত না হইলে উত্তরাধিকারি বিহীন হইবেক। কিন্তু মহীপতি মহান্তের এতাবদ্বচনে বিশ্বাস না করিয়া কহিলেন এ সমস্ত কল্পিত কথা, রাণীর সুহৃদ্বর্গ কৃত্রিমতা পূর্ব্বক এই লিপি বিরচিত করিয়া থাকিবেক। অতএব বিচারক গণকে পরীক্ষায় প্রবৃত্ত হইতে আজ্ঞা দিলেন। রাজা যৎকালে ঐ প্রকার উক্তি করিতেছিলেন তখন এক ব্যক্তি উপস্থিত হইয়া নিবেদন করিল ভূপালবালক মেমিলস্ জননীর পরীক্ষা সংবাদ শ্রবণে ত্রপা ও পরিতাপে সন্তাপিত হইয়া আত্মহত্যা পূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিলেন।
নৃপ রমণী হারমিয়নী পরম স্নেহাস্পদ প্রিয় তনয়ের শোকাবেগে প্রাণ বিয়োগের কথা কর্ণ কুহরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র ব্যাকুলা হইয়া ছিন্ন তরুর তুল্য ধরায় নিপতিতা ও মূর্চ্ছাপন্না হইলেন। রাজাও নন্দনের নিধন শ্রবণে হৃদয় মধ্যে শল্য বিদ্ধ প্রায় হইয়া সাতিশয় কাতর হইলেন। তদনস্তর রাণীর প্রতি করুণোদয় হওয়াতে পালিনা ও অন্যান্য সমভিব্যাহারিণী নারী দিগকে অনুমতি করিলেন স্থানান্তরে লইয়া রাজ্ঞীর শুশ্রূষা কর। কিন্তু পালিনা নৃপমহিলাকে বিরলে লইয়া অনতি বিলম্বে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক ভূপ সমীপে তাহার মৃত্যু সংবাদ জ্ঞাপন করিলেন।
নরপতি পত্নীর পঞ্চত্ব প্রাপ্তির সমাচার প্রাপ্ত হইলে ক্ষণকাল স্তব্ধ প্রায় হইয়া তাঁহার প্রতি নৃশংসাচরণ স্মরণ করত শোক পরীতান্তঃকরণে বিস্তর বিলাপ করিতে লাগিলেন এবং স্পষ্ট বাক্যে কহিলেন আমার নিপীড়নে রাণীর হৃদয় বিদীর্ণ হইয়াছিল অবশেষে অবশিষ্ট জীবন মাত্রের শেষ হইল। তদানীং রাণীর আচারে ব্যভিচারাশঙ্কা বিসর্জন পূর্ব্বক অসংশয় চিত্তে বলিতে লাগিলেন সেই বরবর্ণিনী রমণীর চরিত্রে দোষলেশের সম্পর্ক মাত্র নাই, মহান্তের লিপিগত সকল কথাই যথার্থ, পরোক্ষ দর্শী মহাপুরুষ আপনার দৈবী শক্তি দ্বারা অগ্রে অবগত হইয়া কহিয়াছিলেন হৃত বস্তু পুনঃ প্রাপ্ত না হইলে উত্তরাধিকারির অভাব হইবেক এক্ষণে সে কথার সত্যতা প্রত্যক্ষ হইল, যুবরাজ মেমিলসের অকালে মৃত্যু হইল, যদিস্যাৎ নির্বাসিতা রাজকুমারী পুনঃ প্রাপ্ত না হই সুতরাং বংশ লোপ হইবেক। রাজা এবম্প্রকার চিন্তা করত ব্যাকুলতা পূর্ব্বক বহু বিলাপ করিলেন এবং কন্যার অনুসন্ধান পুরঃসর পুনঃপ্রাপ্তি নিমিত্ত রাজ্য ত্যাগে উদ্যত হইলেন। পরন্তু আন্তিগোনস্ কোন্ দিক্ দিয়া তাঁহাকে বনবাস দিতে গিয়াছিল উদ্দেশ না পাওয়াতে শোকে উন্মত্ত প্রায় হইয়া নিরন্তর কেবল বিলাপ ও পরিতাপ করত মহা কষ্টে কাল যাপন করিতে লাগিলেন।
আন্তিগোনস্ রাজ পুত্রীকে গ্রহণ পুরঃসর যে তরি আরোহণে সাগর যাত্রা করে দৈবগত্যা সমুদ্র মধ্যে অকস্মাৎ ভয়ানক ঝটিকা উপস্থিত হওয়াতে সেই তরণী পবন বেগে পলিক্সেনিসের বোহিমিয়া রাজ্যের কূলে গিয় উপনীত হইয়াছিল। আন্তিগোনস্ সেই স্থানেই পোত হইতে তটে অবতরণ পুরঃসর বালিকাটীকে তত্রস্থ অরণ্যানী মধ্যে ফেলিয়া দেয়। কিন্তু শিশিলী রাজ লিয়নিতিস্ জানিতে পরিলেন না আন্তিগোনস্ কোন্ স্থানে নন্দিনীকে নিক্ষেপ করিয়াছিল যেহেতু সে ব্যক্তি সেই অব্রুবাণা বালিকাকে বিজন বনে পরিত্যাগ পূর্ব্বক অর্ণব পোতে যখন প্রত্যাগমন করিতেছিল তদবসরে এক ভয়ানক ভল্লুক বিপিন হইতে বহির্গত হইয়া আক্রমণ পুরঃসর প্রখর নখরাঘাতে তদীয় বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করে। সুতরাং বিবিধ যন্ত্রণা সহকারে তাহার প্রাণ প্রয়াণ হওয়াতে নিদারুণ নৃশংস রাজাজ্ঞা পালনের প্রতিফল সঙ্গে২ হইয়াছিল।
রাজকুমারী যদিও দুগ্ধপোষ্যা শিশু তথাপি তাঁহার অঙ্গে বহু মূল্য পরিচ্ছদ ও বিবিধ রত্নালঙ্কার ছিল যেহেতু রাজমহিষী তাঁহাকে নৃপতি সমক্ষে প্রেরণ করিবার নিমিত্ত নানা ভূষণে ভূষিত ও মহার্হ বসনে সুসজ্জিত করিয়াছিলেন। আন্তিগোনস্ যৎকালে তাঁহাকে বনবাস দিতে লইয়া যায় তখন তদীয় পরিচ্ছদের উপর ক্ষুদ্রাক্ষরে পরিদিতা এই নাম এবং মহাকুলে উৎপত্তি অথচ পরম দুর্ভাগ্যের কথা সঙ্কেতে লিখিয়া দিয়াছিল।
রাজকুমারী একাকিনী অরণ্য বাসিনী হইলে কোন মেষপালক ভ্রমণ করিতে২ হঠাৎ সমীপে উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে দেখিতে পাইল এবং দয়ালু স্বভাব বশতঃ তাদৃশী দুরবস্থা দর্শনে করুণার্দ্রচিত্ত হইয়া হস্ত দ্বারা উথাপন পুরঃসর তাঁহাকে ক্রোড়ে লইল। তদনন্তর স্বীয় গৃহে গমন পূর্ব্বক গৃহিণীকে আহ্বান করত তদীয় অঙ্কে সেই সুকুমারী কুমারী সমর্পণ করিল। তাহার বনিতা কন্যার অপরূপ রূপ লাবণ্য মহামূল্য বসন ভূষণ সন্দর্শনে সাতিশয় প্রীত হইল এবং পরম স্নেহে স্তন্য দান পুরঃসর পালন করিতে লাগিল। মেষজীবী অতিসুদীন এপ্রযুক্ত কষ্টে সংসার যাত্রা নির্বাহ করিত, কন্যার গাত্রে যথেষ্ট বহু মূল্য রত্নালঙ্কার প্রাপ্ত হওয়াতে আপনার অকস্মাৎ বিপুল বিত্তাগম গোপন মানসে বাসস্থলীর পরিবর্ত্তন পূর্ব্বক দেশের অন্য খণ্ডে গিয়া বসতি করিল। এবং রাজকুমারীর আভরণ বিক্রয় করিয়া ধন সঞ্চয় পূর্ব্বক বহু২ মেষ ক্রয় করত অবিলম্বে ধনবান্ মেষপালক হইল। পরন্তু পরিদিতার প্রতি আপন সন্তান নির্বিশেষে স্নেহ করত পরম যত্নে স্ত্রী পুরুষে প্রতি পালন করিতে লাগিল তাহাতে ঐ কন্যা চৈতন্যোদয়ে মেষপালক ভিন্ন অন্য কাহার দুহিতা কি না জানিতে পারিলেন না, অবিজীবিকেই আপন জনক বলিয়া নিশ্চয় করিলেন।
বালিকা পরিদিতা দিন২ শশিকলার তুল্য বর্দ্ধমানা হইতে লাগিলেন এবং তাঁহার স্বাভাবিক কান্তি স্বতঃ সমুদিত হওয়াতে পরম সৌন্দর্য্য হইল। কুমারী মেষজীবির তনয়াপেক্ষা যদিও সদুপদেশ প্রাপ্ত হইলেন না তথাপি জননী রাজমহিষীর বিনয়ৌদার্য্য ধৈর্য্য গাম্ভীর্য্যাদি গুণ নিকর স্বভাব বশে সংক্রান্ত হওয়াতে তাঁহার মানসিক সংস্কার এবম্প্রকার পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হইল যে তাঁহার আচরণ দর্শনে হঠাৎ কেহ মনে করিতে পারিতেন না তিনি রাজ সভায় সুশিক্ষা বা সদুপদেশ প্রাপ্ত হন নাই।
বোহিমিয়াধিরাজ পলিক্সেনিসের একটী পুত্র ছিল, তাঁহার নাম ফ্লোরাইজেল্। যুবরাজ এক দিবস মৃগয়ার্থ বহির্গত হইয়া অবিজীবির আবাসের সন্নিধানে উপস্থিত হইলে দৈবাৎ তাঁহার ও মেষপালক তনয়া পরিদিতার চারি চক্ষু একত্র হইল। রাজকুমার কামিনীর রূপ লাবণ্য অবলোকন মাত্রে মদন বাণাহত হইলেন। সেই নবীনা তরুণীর কেশ কলাপ সুদীর্ঘ ঘন তিমির চামরাপেক্ষাও অধিক চমৎকার, মুখশশী মেঘোন্মুক্ত শরন্নিশাকরবৎ পরম মনোহর, দশন পংক্তি সুমার্জ্জিত মুক্তাহার সমান, নয়ন যুগল এণ বিলোচনাপেক্ষা রমণীয় এবং কুচকুম্ভ করিকুম্ভ বিভ্রমকরী। এবম্বিধ সর্ব্বাবয়ব সৌষ্ঠব সহকারে বিনয়ৌদার্য্য গাম্ভীর্য্য সুশীলতাদি গুণ নিকর প্রকাশমান থাকাতে রাজকন্যার তুল্য প্রকৃতি দর্শনে নৃপনন্দন তদুপরি অত্যন্ত আসক্ত হইয়া পড়িলেন। এবং বেশ পরিবর্ত্তন পুরঃসর আপন নাম গোপন করিয়া দোরিক্লিস্ সংজ্ঞায় পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক সেই দিন হইতে মেষপালকের আলয়ে যাতায়াত করিতে আরম্ভ করিলেন।
নৃপনন্দন রাজসদনে অনুক্ষণ অদর্শন হইতে আরম্ভ করিলে বোহিমিয়াধিপতি পলিক্সেনিস্ সাতিশয় শঙ্কাকুল হইলেন এবং পুত্র প্রতি মুহূর্ত্ত কোথায় গমন করে সবিশেষ বিবরণ বিদিত হইবার নিমিত্ত চর দিগকে প্রহরি নিযুক্ত করিলেন। তাহাতে অনতি বিলম্বে প্রকাশ পাইল যুবরাজ অবিজীবির পরম রমণীয়া কুমারীর প্রণয় নিগড়ে পতিত হইয়া তদাসক্ত হইয়াছেন।
অনন্তর রাজা এক দিন লিয়নিতিসের অকারণ বিদ্বেষ জনিত রোষ হইতে জীবন রক্ষক পরম প্রত্যয় নিকেতন কেমিলো মন্ত্রি সমভিব্যাহারে সেই মেষপালকের নিলয়ে গমন করিলেন যাহার নন্দিনী নৃপনন্দনের মনে বিমোহন পুরঃসর তাঁহাকে আত্ম প্রেমের বশম্বদ করিয়াছিল।
ভূপাল এবং কেমিলো উভয়ে স্ব২ পরিচ্ছদ পরিবর্ত্তন পূর্ব্বক ছদ্মবেশে বৃদ্ধ অবিজীবির ভবনে উপস্থিত হইয়া অবলোকন করিলেন তথায় মেষমুণ্ডন নামক মহোৎসব প্রবর্ত্তমান। অতএব তাঁহারা যদিও অপরিচিত তথাপি সেই পর্ব্বে প্রত্যেক অভ্যাগত ব্যক্তির প্রতি যথোচিত সম্মান দান পুরঃসর অভ্যর্থনা করণের প্রথা থাকাতে পুরবাসিগণ পরম সমাদর পূর্ব্বক তাঁহাদিগকে সেই উৎসবে লিপ্ত হইতে নিমন্ত্রণ করিল।
মেষমুণ্ডন পর্ব্বে কেবল আমোদ প্রমোদ ভিন্ন অন্য কোন বিষয়ের প্রসঙ্গ হইত না সুতরাং ভবন সকল সুসজ্জিত ও তৌর্য্যত্রিকের আয়োজন হইতেছিল এবং সদনের সমীপবর্ত্তি দূর্ব্বাদল শ্যামল চত্বরে বালক বালিকাগণ পরম কৌতুকে নৃত্য করিতেছিল আর উৎসবোপলক্ষে স্থাপিত পণ্যবীথি মধ্যে প্রসারিত বিবিধ ক্রীড়ার দ্রব্য ও পট্ট বস্ত্র নির্ম্মিত কটি বন্ধনী এবং অঙ্গুলিত্রে শোভমান পুত্তলিকা সকল বিক্রীত হইতেছিল। যুবক বৃন্দ মহানন্দে সে সমস্ত ক্রয় করিতেছিলেন।
পরন্তু পর্ব্বোপলক্ষে আমোদ প্রমোদ নিমিত্ত এবম্বিধ বিবিধ সমারোহ হইলেও রাজনন্দন ফ্লোরাইজেল এবং মেষপালকের বালিকা পরিদিতা দুই জনে কোণে বসিয়া এক মনে কথোপকথন করিতেছিলেন তাঁহাদের পরস্পর বাক্যালাপে এতাদৃশ সন্তোষ জন্মিতেছিল যে চতুর্দ্দিকে নানা প্রকার ক্রীড়ার বস্তু এবং আমোদ প্রমোদের আয়োজন দর্শনে তাদৃশী তুষ্টি লাভের সম্ভাবনা বোধ হয় নাই কেননা তাঁহারা ঐ সমস্ত ব্যাপারে লিপ্ত হইতে এক বারও অভিলাষুক হইলেন না।
ভূপতি বেশ পরিবর্ত্তন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আপনার আকার গোপন করিয়াছিলেন সুতরাং তদীয় তনয় তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন না অতএব রাজা যুবক যুবতীর কথোপকথন শ্রবণ মানসে তাঁহাদের নিকট কিঞ্চিৎ সরিয়া বসিলেন। পরিদিতা মধুর স্বরে রাজপুত্রের প্রতি যে সমস্ত বচনোপন্যাস করিতে ছিলেন নৃপতির কর্ণ কুহরে প্রবিষ্ট হইলে আশ্চর্য্য বোধ হইল এবং মহীপতি তৎক্ষণাৎ কেমিলো মন্ত্রির প্রতি নেত্র পাত করিয়া মৃদুস্বরে কহিতে লাগিলেন মিত্র নীচ কুলে এতাদৃশ মনোহর রূপ লাবণ্য সম্পন্না ও আর্য্যগুণান্বিতা কামিনী কদাপি মদীয় দৃষ্টিপথ বর্ত্তিনী হয় নাই। এই যুবতীর বচন শ্রবণ ও বিনয় দর্শনে অনুমান করি ইহার রীতি প্রকৃতি এস্থানের যোগ্যা নহে।
কেমিলো উত্তর করিলেন মহারাজ আমার বোধে এই তরুণী দধি নবনীতোৎপন্না নৃপসুতার ন্যায় প্রকাশ পাইতেছেন।
অনন্তর মহীপাল মেষপালকে সম্বোধন পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে বন্ধো তোমার তনয়ার সহিত যে তরুণ পুরুষটী কথোপকথন করিতেছেন ইহাঁর কি নাম? অবিজীবী উত্তর করিল মহাশয় ইহাঁর নাম দোরিক্লিস্। আমার তনয়ার সৌন্দর্য্য দর্শনে তৎপ্রতি ইহাঁর সাতিশয় প্রীতি জন্মিয়াছে পরন্তু উভয়ে পরস্পর এতাদৃশ অনুরক্ত যে অন্যোন্যের চুম্বন অবলোকন করিয়া স্পষ্ট বুঝিতে পারি না কে অধিক অনুরাগী। যাহা হউক। যদিস্যাৎ এই যুবা আমার কন্যার পাণি গ্রহণ করেন তাহা হইলে অপর যে কি লাভ করিবেন তাহা স্বপ্নেও কখন অবলোকন করেন নাই। এ কথার তাৎপর্য্য এই যে মেষপাল পরিদিতার গাত্রাভরণের কিয়দংশ যদিও বিক্রয় দ্বারা আপনার অর্থ সঞ্চয় করিয়াছিল তথাপি তনয়ার পরিণয় নিমিত্ত অনেক ভাগ রক্ষা করিয়াছিল।
পরে পলিক্সেনিস্ পুত্রকে কহিলেন ওহে যুবক তোমার হৃদয় যেন কোন অপূর্ব্ব পদার্থে পরিপূর্ণ প্রায় বোধ হইতেছে কেননা এই মহোৎসবের আমোদে তোমার ঔৎসুক্য মাত্র দেখিতে পাই না। আমরাও তরুণ সময়ে প্রণয়িনী সমভিব্যাহারে বিহার রসে রসিক হইতাম তাহাতে নায়িকাকে অনেক২ দ্রব্য সামগ্রী প্রদান করিতে হইত এস্থলে এত ক্রীড়া সাধন পরম রমণীয় দ্রব্যজাত বিক্রয় হইতেছে তুমি আপন মনোমোহিনী বিলাসিনীর নিমিত্ত কিছুই ক্রয় করিলে না?
যুবরাজ কোন প্রকারে জানিতে পরেন নাই যে জনকের সহিত কথা কহিতেছেন অতএব অবাধে প্রতিবচন প্রদান করত কহিলেন হে বৃদ্ধ আমার প্রেয়সী সমান্য দ্রব্যের প্রয়াসিনী নহেন। ইনি আমার নিকট যে বস্তুর অভিলাষ করেন আমার হৃদয় মধ্যে তাহা জাগরূক হইতেছে। তদনন্তর পরিদিতার প্রতি নেত্রপাত করিয়া কহিলেন প্রিয়ে আমার বোধ হয় এই প্রাচীন প্রাজ্ঞ পুরুষ কোন সময় প্রেমরসে রসিক ছিলেন অতএব প্রণয়ের মর্ম্মজ্ঞ প্রযুক্ত ইহাঁকে সাক্ষি করিয়া মুক্তকণ্ঠে একটী কথা বলি শ্রবণ কর। তৎপরে পরিদিতার পাণি গ্রহণাঙ্গীকারে প্রত্যক্ষ সাক্ষী হইবার নিমিত্ত সম্মুখবর্ত্তি অপরিচিত পুরুষকে কহিলেন মহাশয় আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হইয়া অকপট বচনে অঙ্গীকার করিতেছি যথাবিধি পাণি গ্রহণ পুরঃসর এই সুন্দরীকে স্বীয় পরিণীতা বনিতা করিব আপনি স্বকর্ণে মদীয় অঙ্গীকার শ্রবণ পূর্ব্বক এতদ্বিষয়ে সাক্ষী হউন।
রাজা আত্ম তনয়ের এবম্বিধ নীচ প্রবৃত্তির কথা আকর্ণন মাত্রে রোষ পরীত হইয়া তৎক্ষণাৎ কল্পিত বেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাতিশয় সন্তাপ প্রকাশ করিতে২ কহিলেন অরে কুলাঙ্গার আমি যেন তোর এই কামিনী পরিত্যাগের প্রত্যক্ষদর্শী হই। তদনন্তর নিকৃষ্টবংশ জাতা কন্যার পরিণয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞতা নিমিত্ত পুত্রকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিতে লাগিলেন এবং পরিপেলবাঙ্গী পরিদিতাকে অবিপালিনী বলিয়া সাপমান বচনে আহ্বান পূর্ব্বক ভর্ৎসনা করত ভয় প্রদর্শন করিলেন যদিস্যাৎ বারান্তর যুব রাজকে স্বসন্নিধানে আগমন করিতে দাও তাহা হইলে তদ্দণ্ডে তোমার ও তোমার তাত প্রাচীন মেষপালকের প্রাণ দণ্ড করিব।
ভূপতি এতদ্রূপে নবানুরাগি তরুণ তরুণীর তিরস্কার করণানন্তর কোপ ভরেই নিজ মন্দিরে প্রত্যাগমন করিলেন কিন্তু সহচর কেমিলোকে আজ্ঞা করিয়া গেলেন তুমি এই নীচ প্রকৃতি ফ্লোরাইজেলকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আইস।
নৃপতির তিরস্কারে পরিদিতা ক্রোধ পূরিতান্তরা হইয়া অন্তঃস্ফীত হইতেছিলেন অতএব রাজা সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলে কোপভরে গভীর স্বরে কহিতে লাগিলেন যদিস্যাৎ আমাদের সকলের বিনাশ উপস্থিত হয় তথাপি আমি সাতিশয় ভীত হই না, এই নিমিত্ত একবার নয়, দুই বার বাক্য প্রয়োগ করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। আমি মহীপতিকে এই কথা বলিতে বাসনা করিয়াছিলাম মহারাজ দিবাকর তোমার প্রাসাদোপরি কর প্রদান করিয়া আমাদিগের দরিদ্র কুটীরে পরাঙ্মুখ হন না, উভয় স্থানই সমানরূপে অলোকময় করেন। তদনন্তর মহা বিষাদ প্রকাশ করত কহিতে লাগিলেন এখন আমার নিদ্রাবিগমে চৈতন্যোদয় হইল, আমি রাজমহিষীর স্বপ্ন আর সন্দর্শন করিব না। হে তরুণ পুরুষ তুমি আমাকে পরিত্যাগ কর। আমি ছাগীর দুগ্ধ দোহন করত রোদন করিব।
রাজসমভিব্যাহারী কেমিলো পরিদিতার এবম্প্রকার তেজস্বি বচন শ্রবণ ও মহৎ প্রকৃতি দর্শন করিয়া সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে বিবেচনা করিলেন যুবরাজ অনুরূপা প্রেয়সীর প্রেম নিগড়ে বদ্ধ হইয়াছেন। পিতার আদেশানুসারে এই মনোরমা রামা পরিত্যাগ পূর্ব্বক প্রণয় বন্ধন ছিন্ন করিতে সমর্থ হইবেন বোধ হয় না। অতএব নায়ক নায়িকার সঙ্গে সৌহৃদ্যাচরণ পুরঃসর আপনার অভিপ্রেত কৌশল দ্বারা তাঁহাদিগকে চরিতার্থ করিতে মনস্থ করিলেন।
কেমিলো ইতিপূর্ব্বে সংবাদ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন শিশিলীর মহারাজ অকারণ শঙ্কাপিশাচীর বশম্বদ হইয়া অকৃত্রিম প্রণয় পবিত্র মিত্রের প্রতি অকারণ যে বিদ্বেষ করেন তন্নিমিত্ত সাতিশয় অনুতাপান্বিত হইয়াছেন। অপর যদিও আপনি বোহিমিয়া দেশে পলিক্সেনিসের সহিত পলায়ন করিয়া আসিয়া রাজানুগ্রহে তদীয় পরম প্রিয়তম বয়স্য হইয়াছিলেন তথাপি স্বদেশে চির সেবিত পুরাতন প্রভুর দর্শন নিমিত্ত মধ্যে২ উৎকলিকাকুল হইতেন। অতএব নবপ্রণয়ি যুবক যুবতীর নিকট এই প্রসঙ্গ করিলেন তোমাদের পরস্পর বিজাতীয় অনুরাগ দেখিতেছি তোমরা রাজশাসনে এই প্রণয় প্রত্যাহরণ করিতে পার ঈদৃশী সম্ভাবনা দেখি না। অথচ পরিণয়ের কথায় রাজা খড়্গ হস্ত অতএব আমি এক উপায় বলি যদি তাহাতে সম্মত হইতে পার তবেই আশু পরিত্রাণ এবং পরে কৃতকার্য্য হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তোমরা আমার সমভিব্যাহারে শিশিলী রাজ্যে পলায়ন করিয়া চল তত্রত্য ভূপতি লিয়নিতিস্ অবশ্য তোমাদিগকে আশ্রয় প্রদান পূর্ব্বক রক্ষা করিবেন এবং তিনি মধ্যস্থতা করিলে অসংশয় পলিক্সেনিস্ রাজ সকাশাৎ ক্ষমা ও বিবাহের সম্মতি প্রাপ্ত হইতে পারিবে।
অভিনব প্রেমরসাভিষিক্ত রাজনন্দন ও তদীয় প্রণয়িনী এতৎ প্রস্তাবে পরমানন্দিত হইয়া তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন। পরে কেমিলো প্রস্থান দিনাবধারণ পুর্ব্বক প্রাচীন মেষপালককে সমভিব্যাহারী হইতে উপদেশ দিলেন।
মেষপালক পরিদিতাকে আশৈশব লালন পালন করাতে ঔরসী কন্যা নির্বিশেষে স্নেহ করিতেন অতএব তদণ্ডে তাঁহাদের সঙ্গী হইতে সম্মত হইয়া কুমারীর শৈশবকালের পরিচ্ছদ তৎসংলগ্ন ক্ষুদ্র লিপি এবং অবশিষ্ট রত্নালঙ্কার সমভিব্যাহারে লইলেন।
তদনন্তর ফ্লোরাইজেল্ পরিদিতা কেমিলো এবং বৃদ্ধ অবিজীবী এই চারি ব্যক্তি অর্ণবপোতারোহণ পুরঃসর সমুদ্র পথে যাত্রা করিয়া কিয়দ্দিন মধ্যে শিশিলী দ্বীপে লিয়নিতিস্ রাজার রাজধানীতে উত্তীর্ণ হইলেন। লিয়নিতিস্ মিত্রদ্রোহ ও পুত্র কলত্র শোকে সাতিশয় কাতর ছিলেন সখার সন্তান ও প্রাচীন কৃতজ্ঞ ভৃত্য রাজ্য মধ্যে আগমন করাতে পরম সমাদর পুরঃসর তাঁহাদের যথোচিত অভ্যর্থনা করিলেন। অনন্তর রাজকুমার সমভিব্যাহারিণী পরিদিতাকে আপনার বনিতা বলিয়া পরিচয় দিলে রাজা সেই সুলক্ষণা সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী বালিকার প্রতি নেত্রপাত করিবামাত্র মনোমধ্যে স্বাভাবিক সন্তান স্নেহের হঠাৎ উদ্রেক হওয়াতে সাতিশয় পরিতৃপ্ত হইলেন। তৎপরে তদীয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ও রূপ লাবণ্য বিশেষ নিরীক্ষণে অবয়ব সৌসাদৃশ্যে স্বীয় মহিষী হারমিয়নী স্মৃতিপথ বর্ত্তিনী হওয়াতে আক্ষেপ করত কহিতে লাগিলেন অহি আমি দুরাত্মতা পূর্ব্বক আত্ম তনয়ার জীবন বিনষ্ট না করিলে তিনিও ঈদৃশী সুরূপা হইতেন। তদনন্তর ফ্লোরাইজেল্কে কহিলেন হে যুবরাজ আমি আপন দোষে তোমার মহানুভব জনকের সৌহৃদ্যে বঞ্চিত হইয়া নিরন্তর অনুতাপ করিতেছি, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আমার অবিরত বাসনা হয়।
বৃদ্ধ মেষপালক পরিদিতার প্রতি নৃপতির অকস্মাৎ এবম্প্রকার স্বাভাবিক স্নেহ প্রবৃত্তি দর্শন এবং রাজ প্রমুখাৎ রাজকিশোরীর বনবাস বিবরণ শ্রবণ করিয়া ক্ষুদ্রা পরিদিতাকে যে সময় যে প্রকারে মহামূল্য রত্নালঙ্কার ও মহাধনাঢ্য বংশের পরিচ্ছদ সহকারে প্রাপ্ত হইয়াছিল তৎসমুদায়ের বৃত্তান্ত আপনার অন্তঃকরণ মধ্যে স্মরণ পুরঃসর অন্দোলন করত অসংশয় নির্ণয় করিল এই কুমারী এতন্মহীপতিরই নির্বাসিতা তনয়া।
তদনন্তর প্রাচীন অবিপালক সময়ক্রমে রাজপুত্র ফ্লোরাইজেল্ আপন তনয়া পরিদিতা এবং শিশিলী রাজের কৃতজ্ঞ ভৃত্য কেমিলো ও তদীয় মহিষীর প্রিয়সখী পালিনার সমক্ষে আপনি যে প্রকারে পরিদিতাকে শৈশব সময় প্রাপ্ত হয় ও ঐ কুমারীর নির্বাসন কারী আন্তিগোনস্ যদ্রূপে করাল নখর ঋক্ষ সম্মুখে পতিত হইয়া পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয় সমস্ত বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক ব্যক্ত করিল এবং রাজবালার ক্ষুদ্র লিপ্যঙ্কিত সেই বহু মূল্য বসন বহিষ্করণ পুরঃসর সকলকে দেখাইল। তাহাতে পালিনার মনে পড়িল নৃপরমণী হারমিয়নী সেই বসনে আপন নন্দিনীকে মণ্ডিত করিয়াছিলেন। অপর বৃদ্ধের প্রদর্শিত একটা রত্ন নিরীক্ষণে স্মরণ হইল রাণী তাহা কন্যার গলায় বন্ধন করিয়া দিয়াছিলেন। পরিশেষে পরিচ্ছদ সংলগ্ন ক্ষুদ্র লিপি পর্য্যালোচন করিতে২ আপনার স্বামির হস্তাক্ষর স্পষ্টরূপে দৃষ্টি গোচর হওয়াতে সন্দেহ নিরাসে নিশ্চয় বোধ হইল পরিদিতা লিয়নিতিস্ রাজার নির্বাসিত দুহিতা কিন্তু এই সময় পালিনার অন্তঃকরণ অনির্ব্বচনীয় হর্ষ বিষাদে সমাকুল হইতে লাগিল। তাঁহার পতি বিয়োগের অসহ্য শোক উদ্ভূত হইল এবং চির প্রনষ্টা নৃপনন্দিনীর পুনঃপ্রাপ্তি ও তদ্দ্বারা রাজবংশ রক্ষা বিষয়ক দেববাণী ফলিতা হওয়াতে বাক্পথাতীত আনন্দ জন্মিল সুতরাং ঐ অবলার মনোমধ্যে এই প্রবল হর্ষ বিষাদ স্ব২ পরিসর বিস্তার নিমিত্ত ক্ষণকাল তুমুল সংগ্রাম করাতে তদীয় হৃদয় বিক্ষিপ্ত প্রায় হইল। তদনন্তর রাজা লিয়নিতিস্ যখন শ্রবণ করিলেন পরিদিতা তাঁহার দুহিতা তখন তদীয় অন্তঃকরণে সাতিশয় করুণ রসের উদয় হইল এবং নন্দিনীকে সন্নিধানে আনয়ন পরঃসর খেদ করিতে কহিতে লাগিলেন হায়, হারমিয়নী জীবিত নাই, আপনার প্রনষ্ট নিধি পুনর্ব্বার নয়নগোচর করিতে পাইলেন না। এইরূপ বিলাপ পূর্ব্বক শোকে ক্ষণকাল নিস্তব্ধ হইয়া তনয়ার অধর ধারণ করত গদ্গদ বচনে বলিলেন হায় তোমার মাতা নাই, হায় তোমার মাতা নাই।
পালিনা মহারাজের নষ্ট নিধি লাভে পরমাহ্লাদের সময় এতাদৃশ বিষাদোদয় দর্শনে ক্ষুণ্ণান্তঃকরণে নৃপতিকে কহিলেন অধিরাজ আমি ইটালি দেশীয় জুলিও রোমানো নামা বিখ্যাত ভাস্কর দ্বারা মহারাণীর অবিকল প্রতিমূর্ত্তি নির্মাণ করাইয়াছি মহারাজ যদিস্যাৎ মদীয় ভবনে আগমন পুরঃসর অবলোকন করেন অসংশয় বোধ করিবেন রাজ্ঞী অক্ষত সর্ব্বাবয়বে জীবিত রহিয়াছেন। পালিনার এতদ্বচন শ্রবণে রাজা যৎপরোনাস্তি ব্যগ্র হইয়া তত্রস্থ সমস্ত জন সমভিব্যাহারে তদীয় সদনে গমন করিলেন। পরিদিতাও আপন জ্ঞানাবচ্ছেদে জননী নিরীক্ষণ না করাতে মাতার আকৃতি অবলোকন নিমিত্ত সাতিশয় উৎসুকা হইলেন।
অনন্তর পালিনা আপন নিকেতনে গিয়া প্রতিমূর্ত্তির আবরণ অপসরণ করিলে রাজা স্বীয় মহিষীর অবিকৃত আকৃতি ও অনপচিত রূপ লাবণ্য অবলোকন করত তদীয় শোকের পুনর্ব্বার আবির্ভাবে অভিভূত প্রায় হইয়া অনেক ক্ষণ নির্ব্বাক নিস্পন্দ হইয়া রহিলেন।
পালিনা রাজার ভাব বিলোকনে মনোমধ্যে হর্ষে প্রফুল্লা হইয়া নিবেদন করিলেন মহারাজ আপনকার এই বিস্ময় দর্শনে আমার অপরিসীম সন্তোষ জন্মিতেছে, অধিরাজ এই প্রতিমূর্ত্তি মহারাণীর অনুরূপ কি না?
পরে নরপতি লব্ধসংজ্ঞ হইয়া কল্পিত প্রতিমায় নেত্র পাত পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন আহা হারমিয়নী এই ভাবে দণ্ডায়মানা হইতেন। আমি প্রথমতঃ প্রেমাকাঙ্ক্ষায় যখন তাঁহার পশ্চাদ্গামী হইয়াছিলাম তখন তাঁহার অবিকল এই ভঙ্গি ছিল। তদনন্তর পালিনাকে বলিলেন এই মূর্ত্তির যত বয়ঃক্রম প্রকাশ পাইতেছে রাণীর তত বয়স হয় নাই। পালিনা উত্তর করিলেন মহারাজ ইহাতে ভাস্করের অধিক শিল্পনৈপুণ্য সপ্রমাণ হইল। মহারাণী জীবদ্দশায় থাকিলে এসময় তাঁহার এতাবৎ বয়ঃক্রম হইত। মহারাজ আজ্ঞা হউক, আবরণ দ্বারা প্রতিমূর্ত্তি পিধান করি অধিক ক্ষণ নিরীক্ষণ করিতে২ আপনকার এবম্প্রকার ভ্রম হইবে মূর্ত্তির চলৎ শক্তি আছে।
রাজা ভাবে গদ্গদ হইয়া সবিলাপ বচনে বলিলেন পালিনা প্রতিমা আবৃতা করিও না, বারম্বার নিরীক্ষণ করিয়াও আমার পর্য্যাপ্ত তৃপ্তি হইতেছে না। আহা আমি কেন মরি নাই। কেমিলো অবলোকন কর প্রতিমূর্ত্তি যেন সজীবা, এক্ষণে যেন শ্বাস বহিতেছিল ইহার নেত্রদ্বয় এই মুহূর্ত্তে যেন নিমেষোন্মেষ ক্রিয়া করিতেছিল। পালিনা সবিনয়ে নিবেদন করিলেন প্রভো অনুমতি করুন পূর্ব্ববৎ আবরণাবৃতা করি আপনাকে এতদ্দর্শনে উত্তরোত্তর প্রবল বিহ্বল দেখিতেছি এখনি আপনি ইহাকে সজীব কহিবেন। নৃপতি কহিলেন এখন কি? আরো বিংশতি বৎসর এই প্রতিমূর্ত্তি সজীবা জ্ঞান করিব। আমার বোধ হইতেছে ইহার শ্বাস বহিতেছে। যাহহউক ভাস্করের শিল্প নৈপুণ্য অতি চমৎকার। আহা এমন খুদিয়াছে যেন বায়ু অবিকল বহমান। ওহে তোমরা উপহাস করিও না আমি প্রতিমূর্ত্তিকে একবার চুম্বন করি। পালিনা এতচ্ছ্রবণে সাকূতান্তঃকরণ হইয়াও মৌখিক সাশঙ্ক বাক্যে কহিল মহারাজ এমন করিবেন না। প্রতিমূর্ত্তির বর্ণ এখনও আর্দ্র আছে মুখার্পণ করিলে আপনকার ওষ্ঠ তৈলাক্ত রঙ্গে অঙ্কিত হইবেক। অতএব আজ্ঞা হউক আচ্ছাদন করি। রাজা বলিলেন তাহা হইবে না, বিশ বৎসর এই রূপ করিয়া রাখ।
পরিদিতা পতিতজানু হইয়া উপবেশন পুর্ব্বক এতাবৎ ক্ষণ পর্য্যন্ত মনে২ প্রশংসা করত জননীর অপ্রতিম প্রতিমা নিরীক্ষণ করিতেছিলেন জনকের উক্তরূপ বাক্য কর্ণগোচর হইলে সাদর বচনে বলিলেন হাঁ পিতঃ তাবৎ পরিমিত কাল এই ভাবে প্রিয়তরা মাতার আকৃতি অবলোকন না করিলে আমারও নয়নের পরিতৃপ্তি হইবেক না।
তদনন্তর পালিনা সগর্ব্ব বচনে নরপতিকে বলিলেন মহারাজ হয় আপনি এই আনন্দ দমন করুন আমি প্রতিমা আবৃত করিয়া ক্ষান্ত হই, নচেৎ এতদপেক্ষা চমৎকার প্রদর্শন করি আজ্ঞা হউক। হে নরনাথ আমি এ প্রতিমূর্ত্তিতে গতিশক্তি প্রদান করিতে পারি। অনুমতি করুন এই দণ্ডে বেদী হইতে অবরোহণ পুরঃসর আপনকার কর গ্রহণ করাই। আপনি মনে করিতে পারেন কোন প্রকার দুষ্ট ক্ষমতা বা কুহক সহকারে ঐ কার্য্য সম্পন্ন করিব কিন্তু হে দেব আমি সেরূপ নারী নহি।
রাজা এ কথায় বাক্পথাতীত চমৎকারান্বিত হইয়া কহিলেন পালিনা তুমি প্রতিমাকে যাহা করাইতে পার তাহা প্রত্যক্ষ দেখিলে পরম পরিতোষ প্রাপ্ত হইব। যদি ইহাকে বাক্ শক্তি ও গতি শক্তি প্রদান পূর্ব্বক কথা কহাইতে ও চলাইতে পার তবে তদ্দর্শনে আমার আনন্দ ও সন্তোষের পরিসীমা থাকিবে না।
পালিনা পূর্ব্বাবধি বিবিধ বাদ্য যন্ত্র প্রস্তুত করিয়া রাখিয়া ছিলেন। অতএব রাজাদেশ সম্পাদন নিমিত্ত মৃদু গভীর ভাবে বাদ্যোদ্যমের ইঙ্গিত করিলে প্রতিমূর্ত্তি চলৎ শক্তি ধারণ পুরঃসর বেদি হইতে অবরোহণ করিল এবং তদীয় বাহুলতা লিয়নিতিসের গল দেশে সংলগ্ন হওত দৃঢ় ধারণে পীড়ন করিতে লাগিল অপর বাক্ শক্তি ধারণ পূর্ব্বক স্পষ্ট বাক্যে স্বামির প্রতি মঙ্গল প্রশ্ন এবং নবাধিগতা পরিদিতার প্রতি আশীর্বচন প্রয়োগ করিল। ইহাতে তত্রস্থ সমস্ত ব্যক্তি যৎপরোনাস্তি বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া সাশ্চর্য্য চিত্ত হইল।
পরন্তু ঐ মূর্ত্তির রাজগলে করার্পণ পূর্ব্বক আশ্লেষ করিয়া মঙ্গল প্রশ্ন ও সন্ততির প্রতি আশীঃপ্রয়োগ অসম্ভব বা বিচিত্র নয় কেননা সে প্রতিমা নহে মহারাণী হারমিয়নী জীবিত থাকাতে তাঁহার দ্বারাই এই নাট্যাভিনয় হইল।
পালিনা পূর্ব্বে রাজকন্যার বনবাস অবলোকনে মহারাণী হারমিয়নীর প্রতি নরপতির অনিবার্য্য ক্রোধ অনুমান করিয়া বিবেচনা করিয়াছিলেন রাজা রাণীরও প্রাণ সংহার করিবেন, গোপনে রক্ষণ ব্যতিরেকে তাঁহার প্রাণ রক্ষার উপায় নাই। অতএব ভূপতির নিকট মিথ্যা করিয়া মহিষীর মরণ সংবাদ জ্ঞাপন করেন। হারমিয়নীও তদবধি তদীয়ান্তঃপুরে আত্মগোপন পূর্ব্বক তাঁহার সহিত একত্র অবস্থিতি করিতেছিলেন আপনার কোন কথা নরপতির গোচর করেন নাই এক্ষণে নির্বাসিত কন্যা পুনর্ব্বার স্বদেশে আগতা হওয়াতে আপনাকে প্রকাশ করিলেন। রাজা তাহার প্রতি যে২ নৃশংসাচরণ করিয়াছিলেন পাতিব্রত্য পরতন্ত্রতা প্রযুক্ত তাহা তৎক্ষণে ক্ষমা করিয়াছিলেন কিন্তু অব্রুবাণা কন্যার উপর যে নৈষ্ঠুর্য্য হয় তজ্জন্য দুঃখ বিস্মরণে সমর্থ হন নাই।
রাজা লিয়নিতিস্ মৃতা প্রিয়তমা পুনর্জ্জীবিত ও হৃতা দুহিতাকে পুনঃ প্রাপ্ত হওয়াতে মনের বহুকালীন শোকশল্য উন্মোচন পুরঃসর অপার সুখসাগরে নিমগ্ন হইলেন।
এই সমস্ত ব্যাপার অবলোকনে সকলে পরমেশ্বরের ধন্যবাদ প্রদান পূর্ব্বক মহা২ আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিল। রাজা এবং রাজ্ঞী পরম হর্ষে পুলকিত হইয়া তনয়ার প্রতি দয়া বিস্তার পূর্ব্বক আশ্রয় দান ও লালন পালন নিমিত্ত বৃদ্ধ মেষপালকের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন এবং রাজকুমার ফ্লোরাইজেল্ তাঁহার প্রতি প্রণয়ী হওয়াতে তাঁহাকে যথোচিত অশীর্ব্বিধান করিলেন। পালিনা ও কেমিলো রাজার উপাসনায় নিবিষ্ট ছিলেন সুতরাং পরিণামে নৃপতির এই আনন্দ দর্শনে নিরতিশয় সন্তোষ প্রাপ্ত হইলেন।
তদনন্তর এই অদ্ভুত আনন্দ সর্ব্বাঙ্গ শুদ্ধরূপে পরিপূর্ণ করণ নিমিত্ত কোন বিষয়ের অভাব হইল না। বোহিমিয়াধিরাজ পলিক্সেনিস্ অচিরে স্বয়ং শিশিলী রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।
বোহিমিয়াধিপতি আপনার তনয় অদৃশ্য হইবার পূর্ব্বাবধি বিদিত ছিলেন প্রাণপ্রদ কেমিলো স্বদেশ প্রত্যাগমন নিমিত্ত নিতান্ত অভিলাষুক অতএব রাজ্যমধ্যে আত্মজের ও কেমিলোর অনুসন্ধান না পাওয়াতে অনুমান করিলেন সকলে শিশিলীতে পলায়ন করিয়াছে সুতরাং তাহাদের পশ্চাৎ২ ধাবমান হওয়াতে শিশিলী রাজ্যে লিয়নিতিসের এই সুখাবহ সময়ে অসিয়া উত্তীর্ণ হইলেন।
বোহিমিয়ারাজ শিশিলীতে উপস্থিত হইয়া আনন্দোৎসবে মিলিত হইলেন। তাঁহার চির মিত্র লিয়নিতিস্ অকারণ ঈর্ষা পরবশ হইয়া যে দ্রোহাচরণ করিয়াছিলেন তন্নিমিত্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন তাহাতে উভয়ের মনোমালিন্য দূর হইল এবং পুনর্ব্বার অকৃত্রিম মিত্রতা জন্মিল। এক্ষণে পলিক্সেনিস্ আপন নন্দন ফ্লোরাইজেলের পরিদিতার সহ পরিণয়ে প্রতি বন্ধক হইলেন না। এখন পরিদিতা মেষপালী নহে অধুনা শিশিলীয় সম্রাটের রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী সুতরাং যুবক যুবতীর শুভ বিবাহ অবিলম্বে পরমানন্দে সম্পন্ন হইল।
তদনন্তর সকলের দৃষ্টিগোচর হইল হারমিয়নী রাণী বহুকাল দুঃখশোকে সন্তপ্ত থাকিয়া ধৈর্য্যাবলম্বনের নিমিত্ত পরিণামে পুরস্কৃতা হইলেন এবং সুদীর্ঘ কাল স্বামি দুহিতৃ জামাতৃ সহ পরম সুখে লোক যাত্রা নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন ইতি।