সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/ওথেলোর উপাখ্যান

ওথেলো

R. D. SORNOKAR, ENGR
৫১

সেক্‌সপিয়র।


ওথেলোর উপাখ্যান।


 বেনিস্‌ দেশের বিচার সংক্রান্ত মহাসভার সভ্য মহাধন সম্পন্ন ব্রাবান্‌সিও নামা কোন ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার দেস্‌দেমনা নাম্নী পরম সুন্দরী এক কুমারী হয়। সেই কন্যার বয়োধর্ম্মক্রমে ক্রমশঃ প্রবর্ত্তমান অনুপম রূপ লাবণ্য, কোমল নির্ম্মল প্রকৃতি, এবং প্রচুর অর্থ সম্পত্তি অবলোকনে লালসান্বিত হইয়া ভূরি২ সুরূপ সুশ্রী যুবক পাণি গ্রহণ নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি যত্ন করিতে লাগিল। কিন্তু সর্ব্বাঙ্গ শোভনা দেস্‌দেমনা স্বদেশীয় অথবা শারীরিক সৌন্দর্য্য রমণীয় কোন ব্যক্তির গলে বর মাল্য দান পূর্ব্বক তদীয় অঙ্ক লক্ষ্মী হইতে অভিলাষিণী হইলেন না, স্বামি বরণ বিষয়ে এবম্বিধ অপূর্ব্ব বর্ত্ম অবলম্বন করিলেন যাহার প্রশংসা ব্যতীত অনুকরণ করিতে কেহই সমর্থ হয় না। সেই গুণবতী যুবতীর চিত্ত মানব জাতির বাহ্য সৌষ্ঠবাপেক্ষা আন্তরিক গুণ রত্নে সমধিক অনুরক্ত হইত। অতএব এক জন কুৎসিত কুরূপ কাফ্‌রির বরেণ্য গুণে বিমুগ্ধা হইয়া সাতিশয় প্রণয়ানুবন্ধন পূর্ব্বক তাহাকেই স্বকীয় নায়ক রূপে গ্রহণ করিবার মানস করিলেন। তরুণীর পিতা ঐ কাফ্‌রির যথেষ্ট আদর করিতেন সুতরাং তাঁহাদিগের নিকেতনে ঐ ব্যক্তির সর্ব্বদা গতিবিধি ছিল।

 দেস্‌দেমনা কুরূপ পাত্রকে স্বয়ং বরণ পূর্ব্বক পতিত্বে পরিগ্রহ করিতে স্বীকার করিলেন বটে কিন্তু ইহাতে লোকতঃ নিতান্ত নিন্দনীয়া হইলেন না, যেহেতু তাঁহার প্রেমাধিকারী কাফ্‌রি প্রসিদ্ধ ওথেলো বিশ্রী ও বিকটাকার হইলেও আন্তরিক সুমহদ্গুণ বহুল পরিমাণে ধারণ করিতেন, সুতরাং গুণাভিলাষিণী বরবর্ণিনী কামিনীর কমনীয় কান্ত হইবার একান্ত অযোগ্য নহেন। মহাবীর ওথেলো সমরপ্রিয় এবং অসম সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, বেনিস্‌ দেশের প্রধান সেনানী হইয়া কত শত বার তুরকী দিগের সহিত তুমুল সংগ্রাম করেন। অপর রাজ্যস্থ সমস্ত লোকের সম্মান ভাজন এবং পরম বিশ্বাস ভূমি ছিলেন।

 ওথেলো বহু২ দেশ পর্য্যটন এবং ভূরি২ ঘটনা দর্শন করাতে আপন প্রণয়িনী সহ একত্র উপবেশন পূর্ব্বক সময়ে২ তত্তাবতের বিবরণ উপন্যাস রূপে বর্ণন করিতেন, এবং তাঁহার প্রেমাভিলাষিণীও কামিনীদিগের রীত্যনুসারে সাতিশয় তৃষিত চিত্তে অবহিতা হইয়া সহর্ষে সে সমস্ত শ্রবণ করিতেন। তিনি শৈশবাবস্থার বিচিত্র জীবন বৃত্তান্ত, যৌবন সময়ের রণ পাণ্ডিত্য, জলপথে ও স্থলবর্ত্মে উৎপন্ন বিপৎ পুঞ্জ, আগ্নেয়াস্ত্র কৃত দুর্গান্তর্গত দুর্বিগাহ গর্ত্ত রূপ মৃত্যুদ্বারে নিপাতানন্তর কৌশলে নিস্তার, বিপক্ষ পক্ষ কর্ত্তৃক বন্দী রূপে আত্ম বন্ধন ও দাসত্বে বিক্রয়, এবং আপনার তাদৃশী দুরবস্থা বিমোচন, এ সকল বিষয়ের কথা প্রেয়সীর সমীপে কহিতেন। অপর দেশ বিদেশ পর্য্যটন কালে যে সকল ভীম পরাক্রম ভীষণ শরীর সিংহ শার্দ্দুলাধিষ্ঠিত নিবিড় অরণ্য, মনোহর ধরাধর কন্দর, গগণ স্পর্শি গিরি শেখর, বিস্ময়কর রত্নাকর প্রভৃতি অবলোকন করেন এবং যে সমস্ত অসভ্য বর্ব্বর নরজাতি, মনুষ্য ভক্ষক রাক্ষস, আর আফ্রিকাস্থ বিপরীত কন্ধর জন্তু নয়ন গোচর হয় তৎসমুদায়ের বৃত্তান্ত গল্প চ্ছলে চমৎকার রূপে বর্ণন করিতেন সুতরাং তরুণীর মন তাহাতে সাতিশয় আকৃষ্ট হইয়াছিল। ফলতঃ সেই কামিনী আপন প্রণয়ির জীবন চরিত শ্রবণে এতাদৃশ অনুরাগিণী হন যে উপন্যাস কথন সময়ে যদিস্যাৎ প্রয়োজন বশতঃ গৃহ কর্ম্ম সাধনে বাধ্য হইতেন সত্বর সমাপন পূর্ব্বক পুনর্ব্বার আসিয়া দ্বিগুণ শুশ্রূষা সহকারে শুনিতে বসিতেন। দেস্‌দেমনা এবম্প্রকারে মনোনীত নায়কের জীবন বিবরণ পৃথক্‌২ শ্রবণ করিয়া এক দিন শুভক্ষণে সবিনয় বচনে নিবেদন করিলেন প্রিয়তম আমি যে সমস্ত উপন্যাস ভিন্ন২ সময়ে শ্রবণ করিলাম এক কালে তদখিল বর্ণন করিলে আনুপূর্ব্বিক আকর্ণন করিয়া কর্ণদ্বয়ের কৃতার্থতা সম্পাদন করিতে পারি। ওথেলো তদীয় রূপ লাবণ্য দর্শনাবধি কন্দর্প পীড়িত হৃদয় প্রযুক্ত সাতিশয় বশম্বদ হইয়াছিলেন তৎক্ষণাৎ প্রেয়সীর প্রার্থনায় সম্মত হইলেন এবং যথাক্রমে বর্ণন পুরঃসর বলিতে লাগিলেন। কিন্তু যখন আপনার যৌবন দশার দারুণ দুঃখময় বিবরণ বলিতে প্রবৃত্ত হইলেন তখন তাহার প্রণয়িনীর নয়ন দ্বিতয় হইতে অজস্র করুণাশ্রূ বিনিঃসৃত হইতে লাগিল।

 প্রেম ভাজন প্রিয়তম আত্ম অতীত বৃত্তান্ত উপন্যাস রূপে আনুপূর্ব্বিক কহিয়া সমাপন করিলেও কামিনী বারম্বার দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন এবং প্রিয় সম্ভাষণ পুরঃসর বলিলেন এ গল্পের অধিকাংশ অদ্ভুত ও করুণ রসে পূর্ণ। অনন্তর দয়ার্দ্র হৃদয় হইয়া মুক্তকণ্ঠে সবিষাদ বচনে আক্ষেপ পূর্ব্বক কহিলেন ঈদৃশী উপকথা না শুনিলে ভাল হইত। পরন্তু পরক্ষণে পরমাকূত সহকারে আপনার আন্তরিক বাসনা এই উক্তি করিয়া ব্যক্ত করিলেন আহা পরমেশ্বর আমাকে এতাদৃশ মানব করিয়া সৃজন করিলে কৃতার্থ হইতাম। অবশেষে কমনীয় কান্তকে কর শিরোযোগে নমস্কার করত সেঙ্গিত বাক্যে কহিতে লাগিলেন হে রসিক নাগর যদি তোমার কোন মিত্র আমার প্রীতিপাত্র হইতে অভিলাষুক হয় সে কেবল ভবদীয় বাগ্‌ভঙ্গি অভ্যাস করুক তাহা হইলেই আমাকে অনায়াসে প্রেমপাশে বন্ধন করিতে পারিবে। নবযৌবন রমণীয়া দেস্‌দেমনা হাব ভাব প্রকাশ পূর্ব্বক ঈষৎ লজ্জা সহযোগে এরূপ ইঙ্গিত করিলে ওথেলো তাঁহার অভিপ্রায় বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ মহোৎসুকতা সহকারে আপনার প্রণয়ানুরাগ ব্যক্ত করিলেন তাহাতে চারু দশনা দেস্‌দেমনা শুভক্ষণে তাঁহাকে হৃদয়েশ বলিয়া স্বীকার করিলেন।

 ওথেলোর শারীরিক সৌন্দর্য্য অথবা অর্থ সম্পত্তি ঈদৃশী ছিল না যে দেস্‌দেমনার পিতা ব্রাবান্‌সিও তাঁহাকে জামাতৃত্বে বরণ করিতে পারেন। এই ধনাঢ্য সভ্য স্বীয় তনয়াকে স্বাধীনাবস্থায় রক্ষা করিয়া সম্পূর্ণ প্রত্যাশা করিতেন কুমারী আপনার রূপ লাবণ্য ও কুল মর্য্যাদার অনুরূপ ধন্য মান্য বংশের কোন সুশ্রী সুরূপ পুরুষকে পতিত্বে বরণ করিবেন। কিন্তু তাঁহার সে আশা বিফল হইল কেননা রুচিরবর্ণা কন্যা কৃষ্ণবর্ণ কাফ্‌রির প্রতি প্রণয়িনী হইলেন এবং তদীয় শৌর্য বীর্য্যাদি আর্য্য গুণেই আপন প্রাণ মনঃ তাঁহাতে সমপর্ণ করিলেন। ফলতঃ সুন্দরী কাফ্‌রির ভাবে এতাদৃশ অভিভূত হইলেন যে তাঁহার শরীরের বর্ণ আত্ম সুবর্ণ বর্ণ তুলনায় সাতিশয় ঘৃণাস্পদ হইতে পারে কিন্তু তাহাও স্বদেশীয় সম্ভ্রান্ত বংশ জাত রূপ গুণান্বিত যুবক বর্গের বর্ণ অপেক্ষা মনোহর ও পরমোৎকৃষ্ট বলিয়া গণ্য করিতে লাগিলেন।

 তাঁহাদের পরিণয় ব্যাপার যদিও গোপনে সম্পন্ন হইল তথাপি অধিক কাল অপ্রকাশ রহিল না। বৃদ্ধ ব্রাবান্‌সিও এতদ্বিষয় বিদিত হইলে রোষ পরবশ হইয়া উঠিলেন এবং বিচারাগারে প্রবেশ পুর্ব্বক ওথেলোর নামে এই অভিযোগ উপস্থিত করিলেন কাফ্‌রি আমার সম্মতি বিনা কুহক যোগে কৃতঘ্নতা পূর্ব্বক সুকুমারী কুমারীর পাণি পীড়ন করিয়াছে।

 এই সময়ে দৈব ঘটনাক্রমে বেনিস্ রাজ্য মধ্যে ওথেলোর সাহায্য নিতান্ত অপেক্ষণীয় হইয়াছিল যেহেতুক রণ কুশল তুরকী জাতীয়েরা অসংখ্য সেনা সংগ্রহ পুরঃসর সমুদ্র পথে বেনিস্ দেশাধিপের অধিকারস্থ সাইপ্রস্ দ্বীপ অধিকার করিতে আসিতেছিল। এই বিপদ্‌ অবলোকনে রাজসভা রাজ্য রক্ষা নিমিত্ত ওথেলোকে লক্ষ্য করিতেছিলেন কেননা তদানীং ঐ বীর ব্যতিরেকে তুরকীদের পরাভব করণে অপর কেহই পারক ছিল না। অতএব ওথেলো বিচার সভায় আনীত হইয়া এককালীন দুইটী গুরুতর দায়ে পতিত হইলেন অর্থাৎ সুমহৎ রাজকার্য্যের ভার গ্রহণ এবং ব্রাবান্‌সিওর অভিযোগানুসারে মহা অপরাধী হওন নিমিত্ত দণ্ডায়মান হইলেন।

 ব্রাবান্‌সিও অতি প্রাচীন এবং সম্ভ্রান্ত পদস্থ ছিলেন, এতৎ প্রযুক্ত বিচারক মণ্ডলী বিশেষ অবধান পুরঃসর ধীরতা সহকারে তদীয় আবেদন শ্রবণ করিতে লাগিলেন। বৃদ্ধ ক্রোধান্ধতা প্রযুক্ত এরূপ দুষ্টতা করত স্বপক্ষ পোষক প্রমাণ প্রয়োগ করিলেন যে ওথেলো স্বীয় অপবাদ নিরাকরণ নিমিত্ত আহূত হইয়া প্রণয় ঘটনার একটী সরল উপন্যাস ব্যতীত অন্য কোন প্রত্যুক্তি করিতে পারিলেন না। তিনি সকলের সম্মুখে মুক্ত কণ্ঠে দেস্‌দেমনাকে প্রেমপাশে বদ্ধ করিবার প্রাগুক্ত ইতিহাস অকৃত্রিম বাক্‌পটুতার সহিত এবম্প্রকারে বর্ণন করিলেন এবং তাহার সঙ্গে সুশীলতা প্রদর্শন পুরঃসর এতাদৃশী বক্তৃতা করিতে লাগিলেন যে বিচারক বর্গকে তদ্দণ্ডে আত্মমুখে স্বীকার করিতে হইল অভিযোক্তার দুহিতা উপন্যাস শ্রবণ প্রভাবে স্বয়ং প্রীতি শৃঙ্খলে বদ্ধা হইয়াছেন। অতএব অভিযুক্ত কুহক যোগে কন্যা হরণের আরোপিত অপবাদ হইতে মুক্ত হইলেন। এই বিচারে স্পষ্ট প্রকাশিত হইল যে প্রেমার্থি লোকের অব্যাজ স্তুতি করণক নায়িকার গুণপ্রবণ চিত্ত যদ্রূপে হৃত হয় ওথেলো তদ্রূপে দেস্‌দেমনার মনোহরণ করিয়াছেন।

 ওথেলো বিচারস্থলী মধ্যে আপনার অপবাদ বিমোচন নিমিত্ত যাহা কহিলেন দেস্‌দেমনার সাক্ষ্যদ্বারা তাহা সপ্রমাণ হইল। ঐ সুধীরা রমণী ধর্ম্মাধিকরণে উপস্থিত হইয়া অকপট বাক্যে কহিলেন জন্ম দান ও পরম স্নেহে আজন্ম লালন পালন নিমিত্ত জনক সন্নিধানে চির বাধ্যতা স্বীকার করিব কিন্তু জননী যেমন আপন পিতাকে পরিত্যাগ করিয়া পতির আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন আমিও তদ্রূপে ওথেলোর অনুগত হইয়াছি।

 বৃদ্ধ ব্রাবান্‌সিও স্বপক্ষ রক্ষণে অক্ষম হইয়া সাতিশয় ক্ষুব্ধ হইলেন এবং অসন্তুষ্ট চিত্তে অগত্যা ওথেলোকে কন্যা সম্প্রদান করিলেন। কিন্তু সকলের সম্মুখে স্পষ্ট রূপে কহিতে লাগিলেন ব্যবস্থানুসারে আপন তনয়াকে নিষেধ করিয়া রাখিবার ক্ষমতা থাকিলে এতাদৃশ কুরূপ পাত্রে কদাপি কন্যা সমর্পণ করিতাম না। পরে নন্দিনীকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন বৎসে আমার পরম সৌভাগ্য যে অন্য সন্তান সন্ততি নাই, অপর অপত্য বর্ত্তমান থাকিলে তোমার এই আচরণে নির্দয় হৃদয় হইয়া তাহাদিগের প্রতি কতই অত্যাচার করিতাম।

 মহাবল পরাক্রম ওথেলো এই উৎপাত হইতে উত্তীর্ণ হইয়া সাইপ্রস্‌ দ্বীপে যুদ্ধ করিতে অনুরুদ্ধ হইলেন এবং কিয়দ্দিন মধ্যে রণতরি সুসজ্জিত করিয়া যাত্রা করিলেন। তাঁহার অভিনব পরিণীতা বনিতা অন্যান্য রমণীদিগের ন্যায় আবাসে বসিয়া স্বামিসহ বিহারাভিলাষিণী ছিলেন না সুতরাং পতির সমর নিমিত্ত প্রস্থানে কোন প্রকার প্রতিবন্ধকতা করিলেন না, হর্ষোৎফুল্ল চিত্তে আপনিও তাঁহার সমভিব্যাহারিণী হইতে প্রস্তুত হইলেন।

 ওথেলো যুদ্ধযাত্রা করিয়া সহধর্ম্মিণী সহিত সাইপ্রস্ দ্বীপে অবতীর্ণ হইবামাত্র শ্রবণ করিলেন প্রবল পবন বেগে অরাতি দিগের রণতরি সাগর মধ্যে ভগ্ন হওয়াতে অনীকিনী গণ উৎসন্ন প্রোৎসন্ন হইয়া গিয়াছে, বিপক্ষ পক্ষ সহসা তদ্দ্বীপআক্রমণে সাহস করিতে সক্ষম হইবেক না। অতএব তাঁহাকে সমরের আয়াস গ্রহণ করিতে হইল না কিন্তু অচিরে অপর একটা ঘোরতর নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করিবার সূত্র হইল। তিনি অকারণ শঙ্কাপিশাচীর প্রাদুর্ভাবে আপন অন্তঃকরণবর্ত্তি যে সকল রিপুর বশম্বদ হইয়া স্বীয় প্রেয়সীর বিদ্বেষী হইয়া উঠিলেন তাহারা বিদেশীয় বৈরি তুরকীদিগের অপেক্ষা ভয়ানক হইয়া পরিণামে সংহারক রূপে প্রকাশমান হইতে লাগিল।

 সেনাপতি যাবতীয় বন্ধুবর্গ মধ্যে ফ্লোরেন্স দেশীয় মাইকেল ক্যাশিও নামা এক ব্যক্তিকে অতিশয় বিশ্বাস করিতেন। সেই যুবা অতি সুশ্রী, সুরূপ, বাক্‌পটু, সদাশয়, এবং সুরসিক ছিলেন। তাঁহার বাগ্‌মাধুর্য্য এবং রসিকতায় অনাআসে রমণী গণের মনোহরণ হইতে পারিত। যুবজানি সেনানীর মনে যদিস্যাৎ স্বীয় যুবতী যোষার ব্যভিচারাশঙ্কা আবির্ভূতা হইত তবে তাদৃশ পুরুষের প্রতিই সন্দেহ হইবার সম্পর্ণ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেনাধ্যক্ষ যদ্রূপ উদার স্বভাব, তদ্রূপ অসন্দিগ্ধ চিত্ত ছিলেন এবং স্বয়ং যেমন নীচ কর্ম্ম করিতে পারিতেন না, অন্যেরও তাদৃশ জঘন্য প্রবৃত্তির সন্দেহ করিতেন না। তিনি দেস্‌দেমনার সহিত প্রণয় সাধন ব্যাপারে ঐ বিশ্বস্ত মিত্রকে মধ্যস্থরূপে নিযুক্ত করিয়াছিলেন কেননা স্বয়ং মহিলার মনোহারি ললিত মৃদু ভাষা ব্যবহার করিতে পারিতেন না সুতরাং অনুনয় নিমিত্ত বনিতার নিকট সর্ব্বদা তাঁহাকে প্রেরণ করিতেন। অতএব তাঁহাদিগের দম্পতীর পরস্পর প্রীতি সমাধানে ক্যাশিও এক প্রকার মধ্যস্থতা অবলম্বন করেন। মহাবল বিক্রমান্বিত কাফ্‌রির এবম্প্রকার সারল্য ব্যবহারে তদীয় মহোদার চরিত্র কলঙ্কাঙ্কিত না হইয়া বরং গৌরবান্বিত হইয়াছিল। অপর তাঁহার সুশীলা ললনা এই ঘটনায় ক্যাশিওকে ক্রমাগত চিরকাল অন্তঃকরণ সহিত ভাল বাসিতেন ইহা অসম্ভব বা আশ্চর্য্য নহে। ফলতঃ যুবক যুবতীর বিবাহ নির্ব্বাহ হইলে ঐ ব্যক্তির প্রতি তাহাদের উভয়ের মনোভাব ভিন্ন ভাব প্রাপ্ত হয় নাই ইহাতে তিনি নিরন্তর তাঁহাদিগের সদনে গমনাগমন করিতেন এবং গল্প উপন্যাসাদি কহিয়া আমোদ প্রমোদ করিতেন। সেনাপতি গম্ভীর প্রকৃতি প্রযুক্ত কদাপি তাহাতে বিরক্ত হইতেন না বরং আমোদিত হইতেন। অপর আপনার প্রিয়তমা পরিণয়ের পূর্ব্বে ঐ ব্যক্তির সহিত যে প্রকার হাস্য পরিহাস করিতেন পাণি গ্রহণের পরেও তদ্রূপ রহস্য কৌতুক করিতেন তাহাতেও কোন প্রকার দোষ বোধ করিতেন না।

 এই সময়ে ওথেলো প্রধান সেনানীর সহকারিত্ব পদে বিশ্বাসপাত্র প্রিয় মিত্র ঐ ব্যক্তিকে স্থাপিত করিলেন তাহাতে ইয়াগো নামা এক জন প্রাচীন সেনাপতি সাতিশয় রোষান্বিত হইল কেননা সে ব্যক্তি আপনাকে ঐ পদ প্রাপ্ত হইবার উপযুক্ত বোধ করিত, অতএব ঈর্ষা পরবশ হইয়া বিবিধ ব্যঙ্গোক্তি পূর্ব্বক ক্যাশিওকে উপহাস করত সর্ব্বত্র কহিতে লাগিল ক্যাশিও কেবল কামিনী কুলের সঙ্গে কৌতুক করণে কুশল, সেনানীর কার্য্য কি জানে, যুদ্ধ বিগ্রহ অথবা ব্যূহরচনা ইত্যাদি ব্যাপারে অব্রুবাণ বালকাপেক্ষা তাহার অধিক বোধ নাই। বিদূষক বৃদ্ধ ইয়াগো যত্র তত্র এই প্রকারে কুৎসা করত ক্যাশিওকে ঘৃণা করিতে লাগিল এবং ওথেলো ক্যাশিওকে ভাল বাসেন বলিয়া তাঁহারও নিন্দায় প্রবৃত্ত হইল। অবশেষে আপন প্রণয়িনী এমিলিয়ার সহিত সেনানীর আসক্তি আছে এমত অপবাদ উত্থাপন করিয়া তাহাকে ঘৃণাস্পদ করিবার চেষ্টা করিতে আরম্ভ করিল। অপিচ ঐ করাত্মা শোক রোষাবহ এই সমস্ত বিষয়ের কল্পনা করিয়া বৈর নির্যাতনের এবম্প্রকার ভয়ঙ্কর ষড়্‌যন্ত্র করিল যে তাহাতে ক্যাশিও ওথেলো এবং দেস্‌দেমনার সর্বনাশ সম্ভাবনা হইল।

 দুরাত্মা ইয়াগো মানব প্রকৃতি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানাপন্ন প্রযুক্ত নিশ্চয় জানিত দৈহিক যাতনাপেক্ষা মানসিক ক্লেশ শত গুণ প্রবল, এবং রমণীর ব্যভিচারাশঙ্কা মর্মান্তিক যন্ত্রণাদায়ক অতএব মনে২ মন্ত্রণা করিতে লাগিল ক্যাশিওর প্রতি যদিস্যাৎ ওথেলোর জায়া জারাশঙ্কা জন্মাইয়া দিতে পারি তবে কৌশলে বৈর প্রতীকার হইবে অর্থাৎ তাহা হইলে বিপক্ষ ও বিপক্ষপক্ষ উভয়ের পরস্পর রোষ বশে স্বতো বিনাশ সম্ভাবনা।

 এই সময়ে সাইপ্রস্ উপদ্বীপে সপত্নীক সেনাপতির অধিষ্ঠান এবং সাগরোপরি প্রবলতর তরঙ্গে অরিদিগের রণতরি ভগ্ন হইয়া জলমগ্ন হইবার সংবাদ প্রযুক্ত মহা মহোৎসব আরম্ভ হইল তাহাতে আপামর সাধারণ সকলে পান ভোজনের আমোদ করিতে লাগিল এবং কৃষ্ণবর্ণ সেনানীও তাঁহার গৌরাঙ্গী প্রেয়সীর স্বাস্থ্য জনিত আনন্দে অপর্য্যাপ্ত সুরা পান করিলেন।

 এই উৎসবের নিশামুখে সেনাধ্যক্ষ আপনার সহকারি ক্যাশিওকে শান্তি রক্ষার কার্যে নিযুক্ত করিয়া আদেশ করিলেন সেনাগণ যেন অপরিমিত মদ্য পান দ্বারা মত্ত হইয়া কোলাহল উপস্থিত করণ পুরঃসর দ্বীপবাসিদিগের উপর উপদ্রব বা ভয়োৎপাদন না করে। সেনানীর এই নিদেশ দুরাত্মা ইয়াগোর শ্রুতি গোচর হইলে সে সেই নিশাভাগেই আপনার দুষ্ট সঙ্কল্প সাধনের সূত্রপাত করিতে প্রবৃত্ত হইল। সে প্রতারণা পূর্ব্বক সেনাপতির প্রতি কপট ভক্তি প্রকাশ করিয়া ক্যাশিওকে সমধিক সুরাপানে প্রবৃত্তি দিতে লাগিল অথচ শান্তি রক্ষকদিগের অপর্যাপ্ত পানই মহৎ দোষ। ক্যাশিও প্রথমতঃ অনিষ্ট সম্ভাবনা মনে করিয়া তাহার কথানুসারে পানামোদী হইতে স্বীকার করিলেন না। কিন্তু ঐ ধূর্ত্ত বারম্বার সাহস দান পুরঃসর প্ররোচক বাক্য বলিতে আরম্ভ করিলে বাগ্‌জালে মুগ্ধ হইয়া পান পাত্র গ্রহণ করিলেন এবং কিঞ্চিন্মত্ততা জন্মিলে শেষে দুরাত্মা যত উৎসাহ দিতে থাকিল ততই পুনঃ২ পান পাত্র সুরা পূর্ণ করণ পূর্ব্বক পান করিতে লাগিলেন আর দেস্‌দেমনার গুণানুবাদ করিতে২ কহিলেন ঐ যুবতীর তুল্য গুণবতী ও রূপবতী রমণী ভূমণ্ডলে অবলোকন করি নাই। পরন্তু অপর্য্যাপ্ত পান দ্বারা অনতিবিলম্বে তাঁহার সাতিশয় মত্ততা জন্মিবাতে চিত্ত বিক্ষিপ্ত হইল। অনন্তর শঠাগ্রণী ইয়াগো তাঁহার তদবস্থায় ক্রোধোৎপাদন দ্বারা কলহ উপস্থিত করিবার অভিপ্রায়ে কোন ব্যক্তিকে ভর্ৎসনার্থ প্রেরণ করিল। সে আসিয়া সেনাপতিকে তিরস্কার করিবামাত্র সুরাপানে সোষ্ম ক্যাশিও কোপে প্রজ্বলিত হইলেন এবং তৎক্ষণাৎ শিরশ্ছেদোদ্যত হইয়া করে করবাল ধারণ করিলেন সুতরাং সেনামধ্যে মহা কলরব উপস্থিত হইল। মণ্টানো নামা এক জন সম্ভ্রান্ত কর্মচারী গোলযোগ নিবারণ নিমিত্ত আগমন করিয়া অস্ত্রাহত হইলেন এবং ক্রমে বাগ্‌যুদ্ধে বিবাদের নিষ্পত্তি না হওয়াতে বাহু যুদ্ধের সূত্র হইল। দুরাত্মা ইয়াগো স্বয়ং এই উৎপাত উত্থাপন করিয়া অবশেষে প্রধান সেনানীর সুগোচর নিমিত্ত স্বয়ং ভয়ধ্বনি প্রচারার্থ ঘণ্টানিনাদ করিতে লাগিল। তাহাতে সকলের বোধ হইল যেন কোন ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটিয়াছে। ওথেলো অকালে ঘণ্টারব শ্রবণমাত্রে সচকিত হইয়া ত্বরায় পরিচ্ছদ পরিধান পুরঃসর কোলাহল স্থলে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং ব্যস্ত সমস্ত হইয়া ক্যাশিওকে কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। সেনানীকে অবলোকন করিবামাত্র ত্রাসে ক্যাশিওর মত্ততার কিঞ্চিৎ হ্রাস হইল এবং চৈতন্যোদয়ে সাতিশয় লজ্জিত হইলেন সুতরাং কিছই উত্তর দিতে পারিলেন না তাহাতে ধূর্ত্ত ইয়াগো গোলযোগের নিদান আপন দোষ গোপন পুরঃসর সেনাপতিকে কৌশলক্রমে এরূপ ভঙ্গিতে সমুদায় বৃত্তান্ত বিজ্ঞাপন করিল যেন ক্যাশিওর কুৎসা কথনে তাহার ইচ্ছা নাই কেবল সেনানী কলহের হেতু জিজ্ঞাসু হইলেন তন্নিমিত্ত ব্যক্ত করিতেছে। অপিচ ঐ বঞ্চক ক্যাশিওর যে অপরাধ অল্প বলিয়া বর্ণনা করিল বাগ্‌ভঙ্গি দ্বারা তাহা বস্তুতঃ ঘোরতর ও অতি গুরুভাবে প্রকাশ পাইল। ক্যাশিও তৎকালীন ইয়াগোর দোষবার্ত্তা প্রকাশে অক্ষম ছিলেন অতএব এবিষয়ের শেষ নিষ্পত্তি এই হইল যে কঠিন দণ্ড বিধায়ক সেনানী তৎক্ষণাৎ ক্যাশিওকে পদচ্যুত করিলেন।

 ধূর্ত্ত ইয়াগো এবম্প্রকারে আপনার প্রথম কামনা পূর্ণ করিল অর্থাৎ কৌশলে বৈর নির্যাতন পূর্ব্বক বিপক্ষ ক্যাশিওকে অপদস্থ করিয়া তাহার মহাপকার করিল। পরন্তু এই কাল রাত্রির ব্যাপার সকল ভবিষ্যতে ঐ দুরাত্মার অন্যান্য মানস সিদ্ধির বিষয়েও সম্যক্‌ উপযোগী হইবার উপক্রম হইল।

 হতভাগ্য ক্যাশিও অপমানিত ও পদভ্রষ্ট হইয়া শোকাকুলান্তঃকরণে আপনার কপট মিত্র ইয়াগোর সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক সবিষাদ বচনে বলিতে লাগিলেন আমি অতি নির্ব্বোধ, আত্ম কুবুদ্ধিতে পশুবৎ কার্য্য করিয়া স্বীয় মহা সম্ভ্রম নষ্ট করিলাম। হায় আমি একেবারে উৎসন্ন হইলাম, আর কি কখন পদস্থ হইবার নিমিত্ত সেনানীর নিকট প্রার্থনা করিতে পারিব? আমি সমীপস্থ হইলেই সেনানায়ক কোপে কহিবেন এই মদিরা মত্ত আইল। এবম্প্রকারে আপনাকে ধিক্কার প্রদান পূর্ব্বক সাতিশয় পরিতাপ করিলে নির্দয় ইয়াগো তদুপরি দুর্দশা উত্থাপনের অভিপ্রায়ে কপট স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিল ওহে তুমি মদ্য পান করিয়াছিলে এতাবন্মাত্র তোমার দোষ। কিন্তু সময় বিশেষে যদি আসব নিষেবন করাযায় তাহাতে ক্ষতি কি? যাহা হউক, তোমার অদৃষ্টে যাহা ছিল হইয়াছে এক্ষণে তাহা হইতে পরিত্রাণ পাইবার চেষ্টা করা উচিত। অনন্তর তাহাকে এই পরামর্শ দিল সম্প্রতি সেনাপতি বনিতার বশম্বদ হওয়াতে দেস্‌দেমনাই কর্ত্রী স্বরূপা হইয়াছেন। তিনি যাহা কহিবেন সেনানী তাহাই করিবেন অতএব তুমি দেস্‌দেমনার নিকট গিয়া প্রার্থনা কর। ঐ দয়ালু মহিলা করুণা বিনম্র হইয়া অবশ্য স্বামির সমীপে তোমার নিমিত্ত অনুরোধ করিবেন। আমার বোধ হয় তিনি যত্ন করিলে তোমার প্রতি সেনাপতির পূর্ব্বাপেক্ষা অধিক স্নেহ উৎপাদন করিতে সমর্থা হইবেন। দুরাত্মা ইয়াগো যদিস্যাৎ দুষ্টাভিসন্ধি পরাঙ্মুখ হইয়া এই পরামর্শ প্রদান করিত তাহা হইলে ক্যাশিওর উপকার দর্শিতে পারিত, কিন্তু তাহার মনঃ দুশ্চিকীর্ষায় আচ্ছন্ন ছিল এবং তাহা সিদ্ধ করিবার অভিপ্রায়ে সত্বর হইল সুতরাং তাহাতে অধিক অনিষ্ট ঘটিল, পশ্চাৎ তাহা বিদিত হইবেক।

 ক্যাশিও কপট মিত্রের মন্ত্রণানুসারে দেস্‌দেমনার সদনে গমন পূর্ব্বক আপনার দুর্দশার বিষয় নিবেদন করিলে ঐ সুশীল অবলা করুণার্দ্র হইয়া অঙ্গীকার করিলেন তোমার নিমিত্ত প্রাণ পণ করিয়া আপন পতি সেনাপতির সমীপে প্রার্থনা করিব। পরে ধর্ম্মপরায়ণা সুচরিত্রা রমণী স্বামির সহিত সাক্ষাৎ করণ পুরঃসর ক্যাশিওকে পুনর্ব্বার পদস্থ করিবার নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি ব্যগ্রতার সহিত অনুরোধ করিলেন তাহাতে ওথেলো কহিলেন এবম্প্রকার অপরাধিকে কিরূপে আশু মার্জ্জনা করা যাইতে পারে? দেস্‌দেমনা তাহার কথায় কর্ণপাত না করিয়া কাতরতা প্রকাশ পূর্ব্বক পুনর্ব্বার উপরোধ করত কহিতে লাগিলেন আগামি নিশাতে অথবা পরশ্বঃ প্রাতে কবে ক্ষমা করিবেন কহুন্‌? পরিশেষে নিবেদন করিলেন ক্যাশিও দুষ্কর্ম্ম করিয়া অনুতাপান্বিত ও বিনীত হইয়াছে অধিকন্তু লঘু পাপে গুরু দণ্ড কর্ত্তব্য হয় না। ওথেলো এ কথাতেও পুনঃ২ অস্বীকার করিলে ঐ অঙ্গনা মহা বিষণ্ণা হইয়া কহিলেন আহা মহাশয় ক্যাশিও যখন আপনার প্রতিনিধি হইয়া আমার নিকট গমনাগমন করিত তখন আমি আপনার নিন্দা করিলে আপনকার পক্ষ হইয়া আমার সঙ্গে কতই বচসা করিত, এক্ষণে তাহার নিমিত্ত আপনার নিকট আমাকে এত কহিতে হইল? যাহা হউক অধুনা আমি আপনার সমীপে এই সামান্য বিষয়ের প্রার্থনা করিলাম কিন্তু যখন আপনকার অনুরাগ পরীক্ষা করিব তখন এতদপেক্ষা গুরুতর প্রার্থনা করিব। ওথেলো প্রেয়সীর এতাদৃশ অনুযোগে সলজ্জ হইয়া তাহার প্রার্থনায় পুনঃ২ অস্বীকার করিতে পারিলেন না, অগত্যা কহিলেন উপযুক্ত সময় বুঝিয়া ক্যাশিওর প্রতি অনুগ্রহ চিহ্ন প্রকাশ করা যাইবেক।

 অনন্তর এই ঘটনা হইল, ক্যাশিও দেস্‌দেমনার সন্নিধানে আগমন পূর্ব্বক অনুগ্রহ বিতরণ নিমিত্ত অনুনয় করিয়া যখন বহির্গত হয় তৎকালে হঠাৎ ওথেলো এবং ইয়াগো আসিয়া উপস্থিত হইল। দুরাশয় ইয়াগো স্বীয় দুরভিসন্ধির সূত্র করণার্থ ব্যগ্র ছিল। ক্যাশিওকে অবলোকন করিয়া ঈষদ্বিরক্তি প্রকাশ পূর্ব্বক সেনাপতির কর্ণগোচর হয় এমত স্বরে আপনাআপনি মৃদুভাবে এই উক্তি করিতে লাগিল এ সকল ব্যবহার আমার ভাল লাগে না। সেনানীর তৎকালে ঐ কথায় বিশেষ মনোযোগ হইল না কেননা তিনি বনিতার বেশ্মে প্রবেশ করিয়া তাঁহার সহিত ক্যাশিওর বিষয়েই কথোপকথন করিতেছিলেন। সুতরাং ইয়াগোর ইঙ্গিত বাক্য শ্রবণ গোচর হইলেও বিস্মৃত হইলেন কিন্তু অনতি বিলম্বে আপনা হইতে তাহা স্মরণ করিতে হইল। দেস্‌দেমনা স্থানান্তরে প্রস্থান করিলে দুরাত্মা ইয়াগো বৃত্তান্ত শ্রবণৌৎসুক্য প্রকাশ পুরঃসর ওথেলোকে জিজ্ঞাসা করিল আপনকার দার পরিগ্রহের অগ্রে আপনি যখন ঠাকুরাণী সমীপে গমনাগমন করিতেন তখন কি ক্যাশিও আপনকার প্রীতির বিষয় অবগত ছিল? ওথেলো উত্তর করিলেন হাঁ ক্যাশিওই মধ্যস্থ হইয়া আমাদের পরস্পর প্রণয় বন্ধনের ব্যাপার নির্ব্বাহ করিয়া দেয়। ইয়াগো এত শ্রবণে আত্ম মনোমধ্যস্থ আশঙ্কা যেন সপ্রমাণ হইল এতদ্রূপ ভঙ্গি করিল এবং সাতিশয় বিস্ময় প্রকাশ পুরঃসর ভ্রূকুটী করিয়া কহিল তজ্জন্যই বটে। দুরাত্মার এই ভাব ভঙ্গি দর্শন ও বাক্য শ্রবণে সেনানীর মনে সংশয় স্পর্শ হইল এবং মহিলার আলয় প্রবেশ কালে সে ক্যাশিওকে কান্তার সহিত কথা কহিতে দেখিয়া আপনাআপনি যাহা কহিয়াছিল তাহাও স্মৃতিপথে আসিয়া উদিত হইল। অতএব বিবেচনা করিতে লাগিলেন ইয়াগো অতি সজ্জন, দুষ্ট নয়, সুতরাং তদ্দ্বারা ছলনা সম্ভাব্যা নহে, বোধ হয় তাহার মনে কোন গুরুতর দোষাবহ অকথ্য বিষয় উদিত হইয়া থাকিবে সুশীলতা বশতঃ প্রকাশ করিতে পারে নাই। পরে প্রকাশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার অন্তঃকরণে কি কোন অসদ্ভাবের উদয় হইল? দুরাত্মা সবিষাদ বচনে বলিল মহাশয় কোন দুর্ভাবনা যদ্যপি আমার অন্তঃকরণে আবির্ভূত হইয়া থাকে তাহা বলিয়া কি করিব, অপবিত্র ব্যাপারে নিতান্ত নিঃসংশ্রব এতাদৃশ রাজগৃহ অবনীমণ্ডলে কোথায় আছে? তৎপরে কপট সাধুতা প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিল আমি যাহা সম্পূর্ণরূপে অবগত নহি তাহা শুনিলে মহাশয়ের মনে অসুখ জন্মিতে পারে অতএব শুনিবার আবশ্যক নাই, ক্ষমা করুন। আমার দুর্ভাবনার বিষয় বিদিত হইলে আপনার আনন্দ বা মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই অপর সামান্য সংশয় দ্বারা যশশ্চন্দ্র কলঙ্কাঙ্কিত হয় না। এই সকল ইঙ্গিত বাক্যে ওথেলোর অন্তঃকরণ সন্দেহ পূর্ণ ও সাতিশয় ক্ষুব্ধ হওয়াতে যখন বিজাতীয় ক্রোধ ও শোকের আবেগ প্রকাশ হইতে লাগিল তখন দুরাত্মা তাহার শান্ত্বনা নিমিত্ত কপট ভাবে কহিল আমার এ সমস্ত বাক্যে সন্দিহান হইবেন না। পরে এরূপ চাতুর্য্য সহকারে সংশয় নিরাকরণ নিমিত্ত কথা কহিতে লাগিল যে তাহাতে উত্তরোত্তর অধিক সন্দেহ উৎপন্ন হইল। অতএব ওথেলো সন্দেহাকুলিত চিত্তে কহিলেন আমি জানি আমার রমণী পরমা সুন্দরী, লোক সংসর্গ এবং আমোদ প্রমোদ ভাল বাসে, স্বাতন্ত্র্যাবলম্বন পূর্ব্বক সকলের সঙ্গে কথা কহে, এবং নৃত্য গীত ক্রীড়াতে অনুরাগিণী। আন্তরিক ধর্ম্ম জ্ঞান থাকিলেই এই সমস্ত গুণ বলিয়া গণ্য হয় নচেৎ এ সকল অনিষ্টের আলয়। যাহাহউক বনিতার ব্যভিচার অবধারণ করিবার অগ্রে অবশ্য প্রমাণ অনুসন্ধান করিব। ইয়াগো ওথেলোর প্রমাণের কথায়, মৌখিক আহ্লাদ প্রকাশ করিয়া কহিল বস্তুতঃ এতদ্বিষয়ের কোন নিদর্শন নাই তবে আপনি স্বীয় সহধর্ম্মিণীর চরিত্র পরীক্ষা করিতে পারেন, যদি তাহা করেন ক্যাশিও যখন তাহার নিকটে থাকে তখন করিবেন। কিন্তু আমি একটা সার কথা কহিয়া রাখি আপনি স্ত্রীলোকের বিষয়ে নিতান্ত সন্দিগ্ধ চিত্ত হইবেন না এবং একান্ত নিশ্চিন্তও থাকিবেন না। আমি স্বদেশীয় অঙ্গনাগণের রীতি প্রকৃতির বিষয় আপনা অপেক্ষা ভাল জানি। বেনিস্‌দেশীয় সীমন্তিনীরা ভূরি২ ক্রীড়া স্বামিকে দর্শাইতে অসমর্থা কিন্তু পরমেশ্বরকে নির্ভয়ে দর্শাইয়া থাকে। মহাশয় মনে করুন্ দেখি দেস্‌দেমনা জনককে কিরূপ প্রবঞ্চনা করিয়া আপনাকে বর মাল্য দান করিয়াছিলেন। এবম্প্রকার গোপনে পরিণয় সমাধা করেন যে তাহাতে তদীয় প্রাচীন পিতা আপনাকে মায়াবী বলিয়া নিশ্চয় করিলেন। এই সকল বাক্যে ওথেলোর চিত্ত একেবারে বিকৃত হইয়া উঠিল এবং তিনি ক্রোধমূর্চ্ছিত হইয়া প্রগাঢ় সন্দেহান্বিত হইলেন। শেষে মুক্তকণ্ঠে কহিলেন আমার বনিতা স্বীয় পিতাকে প্রতারণা করিয়াছে একথা যথার্থ অতএব পতিকে প্রবঞ্চিত করিবে অসম্ভব নয়।

 ইয়াগো অন্তর্হৃষ্ট হইয়া বাহ্য বিষাদ প্রদর্শন পুরঃসর কহিল আমি আপনার ক্রোধের হেতু হইলাম আমাকে ক্ষমা করুন্‌। তাহার বাক্যে ওথেলো যদিও মনোমধ্যে মহা সন্তাপ প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন তথাপি আকৃতি বিকৃতি দ্বারা সে ভাব প্রকাশ না করিয়া কহিলেন এতদ্বিষয় সংক্রান্ত অন্য কোন বিবরণ যদি জ্ঞাত থাক বর্ণনা করিয়া বল! ইয়াগো স্বীয় বয়স্য ক্যাশিওর কুৎসা করিতে যেন কোন প্রকারেই ইচ্ছুক নহে এতাদৃশ ভাব প্রদর্শন পূর্ব্বক তাহার দোষ খণ্ডনের অনেক কথা কহিয়া ওথেলোর স্মরণ করিয়া দিল দেস্‌দেমনা কেমন প্রাগল্‌ভ্যাবলম্বন পূর্ব্বক স্বদেশীয় সুরূপ পুরুষ দিগকে অবজ্ঞা করত আপনাকে (কাফ্রিকে) পরিণয় করিল। ঐ অবলার মনে সদসদ্বিবেচনার বল থাকিলে কি এরূপ হইতে পারিত? গুণাগুণ বিবেচনা থাকিলে কদাপি আপন দেশের মনোহর রূপ লাবণ্য সম্পন্ন যুবকগণকে আপনকার সঙ্গে তুলনা করিয়া অগ্রাহ্য করিতে পারিতেন না। খল ইয়াগো এতৎ কথনাবসানে সেনানীকে এই মন্ত্রণা দিল আপনি ক্যাশিওর প্রতি অনুগ্রহ করিতে স্বীকার করিয়াছেন, কিয়ৎ কাল বিলম্ব করুন, তাহা হইলে দেখিতে পাইবেন দেস্‌দেমনা তাহার নিমিত্ত কিপ্রকার আগ্রহ সহকারে আপনকার নিকট প্রার্থনা করেন এবং তাহাতেই উল্লেখিত বিষয় সপ্রমাণ হইবেক। অনন্তর ঐ দুরাত্মা ক্যাশিওর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া স্বীয় অভিসন্ধি সিদ্ধির আশয়ে পরামর্শ দিল তুমি আপনার প্রার্থনা সুসিদ্ধি নিমিত্ত দেস্‌দেমনার শরণাপন্ন হও। তিনি সর্ব্বদা তোমার প্রশংসা করত বিশেষ যত্ন করিলে সেনাপতি সানুকূল হইয়া ত্বরায় তোমার প্রতি অনুগ্রহ বিতরণ করিবেন। কিন্তু ঐ পাপাত্মা সুশীলা দেস্‌দেমনার এই মধ্যস্থতাতেই দোষারোপণ দ্বারা আত্ম সংকল্প সাধনের এরূপ ষড়যন্ত্র করিল যে ঐ মহানুভবা মহিলার কারুণ্য প্রকৃতি তাঁহার কলঙ্কের নিদান ও মহদ্গুণ সকল বিনাশের হেতু হইল।

 ইয়াগো ক্যাশিওকে উক্তরূপ পরামর্শ প্রদানানন্তর ওথেলোর সান্নিধানে গিয়া কহিল মহাশয় তখন যে বিষয়ে কথোপকথন হইতেছিল সে বিষয়ের যাবৎ প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত না হন তাবৎ পর্য্যন্ত স্বীয় প্রেয়সীকে নির্দোষা বিবেচনা করা উচিত। ওথেলো তাহার উপদেশানুসারে ধৈর্য্যাবলম্বন স্বীকার করিলেন কিন্তু সাতিশয় বিক্ষুব্ধচিত্ততা প্রযুক্ত অন্তঃসন্তাপে জর্জ্জরিত হইতে লাগিলেন কোন প্রকারে কিঞ্চিন্মাত্র শান্তি লাভ করিতে পারিলেন না। পূর্ব্বে প্রিয়া সমভিব্যাহারে পানীয় মাত্র পানে যেরূপ আপ্যায়িত হইতেন এক্ষণে পীয়ূষ নিষেবণ, রাকা নিশাকর সন্দর্শনেও তাদৃশ আনন্দ বোধ হইল না। অপিচ বৈষয়িক ব্যাপার নির্ব্বাহেও তাঁহার বৈরক্তি হইতে লাগিল। অগ্রে অস্ত্র শস্ত্র নয়ন গোচর হইলে উল্লাসিত হইতেন ইদানীং ধনু ধারণ করিয়াও বিমনস্কতা বশতঃ আমোদিত হইলেন না। অপর ব্যূহী কৃত সেনা ও প্রোড্‌ডীয়মানা জয়পতাকা সন্দর্শনে এবং রণ তুরীর নিনাদ ও সমর তুরঙ্গমের হ্রেষারব শ্রবণে চিত্ত প্রফুল্লতা জন্মিয়া তাঁহার কতই উৎসাহ হইত এক্ষণে সমুদায় নির্ব্বাণ প্রাপ্ত হইয়া গেল। ফলতঃ সর্ব্বপ্রকার বিষয়ে ঔৎসুক্য অপগত হওয়াতে তিনি ক্ষিপ্ত প্রায় হইলেন। কখন বনিতাকে পতিতা বলিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন কদাচিৎ বা ব্যভিচারিণী বোধে ঘৃণা করিলেন। কোন সময়ে ইয়াগোকে সরল বিবেচনা করিলেন কখনবা খল বলিয়া তাহার উত্থাপিত বিষয়ের অলীকতা সন্দেহ করিতে লাগিলেন। কদাচিৎ মনে২ বিবেচনা করিলেন তাদৃশী কথাকে কর্ণ কুহরে স্থান দান না করিলেই ভাল হইত, কদাচিৎ বা আপনা আপনি মীমাংসা করিলেন যাবৎ বিশিষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত না হওয়া যায় তাবৎ দেস্‌দেমনা যে আমা অপেক্ষা ক্যাশিওর প্রতি সাতিশয় সন্তুষ্ট এমত অনুমান করা অযুক্ত। মহানুভব সেনাপতি অন্তঃকরণের বৈকল্য বশতঃ এই রূপ ব্যাকুল হইয়া কালক্ষেপ করিতে লাগিলেন। এক দিন ইয়াগোকে আহ্বান করিয়া প্রীতি প্রদর্শন নিমিত্ত তাহার গলে হস্তার্পণ পূর্ব্বক পদ বিহার করিতে২ জিজ্ঞাসা করিলেন দেস্‌দেমনার দোষ বিষয়ে কি২ প্রমাণ আছে কহ দেখি। পরে প্রণয়িনীর প্রণয় স্মরণ হওয়াতে কহিলেন যদি মিথ্যা হয় তবে তৎক্ষণাৎ তোমাকে শমন সদনের অতিথি করিব। এই কথায় ইয়াগো কৃত্রিম কোপ প্রকাশ পূর্ব্বক ধূর্ত্ততা করিয়া বলিল আমি সততা করিয়া দোষী হইলাম, আপনি কখন স্বীয় রমণীর করে একখান বিচিত্র করবসন অবলোকন করিয়াছেন কি না? ওথেলো বলিলেন আমিই একখণ্ড সুরঙ্গ রুমাল গৃহিণীকে প্রদান করি এবং তাহাই আমার প্রণয় বন্ধনের আদ্য উপায়ন। ইয়াগো বলিল মহাশয় সেই রুমাল দিয়া ক্যাশিওকে মুখ মার্জ্জনা করিতে দেখিয়াছি। ওথেলো কহিলেন তোমার একথা যদি সত্য হয় তবে তাহাদের পরস্পর আসক্তি স্পষ্ট প্রকাশ হইবে পরন্তু এরূপ হইলে সেই দুরাচার ও দুরাচারিণী দুই জনের বিশেষ দণ্ড না করিয়া ক্ষান্ত হইব না। প্রথমতঃ তিন দিনের মধ্যেই ক্যাশিওকে কৃতান্তের করাল দশনে নিক্ষেপ করিব। পরে সেই নীচ প্রকৃতি পাপীয়সীর মৃত্যু সাধনার্থ উপায় করিব।

 বনিতার পাতিব্রত্যে সন্দেহ জন্মিলে চিত্ত সর্ব্বদা শঙ্কাকুল হয় এবং যৎসামান্য বিষয়কেও উপনিষদের তুল্য বলবৎ প্রমাণ করিয়া বোধ করে। পত্নীর এক খান করবসন ক্যাশিওর করে দেখিয়াছে এতাবন্মাত্র শ্রবণেই ওথেলো তাহাকে জায়ার জার নিশ্চয় করিয়া তদীয় অসু বিনাশে উদ্যত হইলেন। সে ব্যক্তি তাঁহার পরম সুহৃদ্‌, কিপ্রকারে তাহা পাইল, একবার জিজ্ঞাসা করিবারও অপেক্ষা করিলেন না। ফলতঃ পতি পরায়ণা দেস্‌দেমনা স্বামির প্রণয় বন্ধনের নিদর্শন রূপ করবসন ক্যাশিওকে কেন প্রদান করিবেন? ভ্রষ্টতা ব্যতীত তদ্রূপে পতির বিপ্রিয় করণেচ্ছা হয় না। তিনি এবং ক্যাশিও উভয়ে নির্দোষ ছিলেন কাহারো মনে কদাপি কুভাবের আবির্ভাব হয় নাই। দুরাত্মা ইয়াগো আপনার কথা সপ্রমাণ করিয়া কৃতকার্য হইবার আশয়ে ষড়যন্ত্র করিয়া স্বীয় বনিতাকে দেস্‌দেমনার নিকট প্রেরণ করে এবং তাহাকে এই বলিয়া দেয় তুমি সেনানীর রমণীর সন্নিধানে গমন পূর্ব্বক প্রার্থনা কর আপনার সেই অপূর্ব্ব রুমালের চিত্র দেখিয়া এক খান করবসন প্রস্তুত করিতে বাসনা করিয়াছি। অতএব কিয়ৎ দিনের নিমিত্ত প্রদান করুন। সরলা দেস্‌দেমনা তাহার হস্তে সেই রুমাল প্রদান করিলে গোপনে অপহরণ পুরঃসর ধূর্ত্ত ইয়াগো ক্যাশিওর আবাসে তাহা স্থাপন করিয়াছিল ঐ ব্যক্তি অজ্ঞানতঃ তাহা গ্রহণ করাতে দুরাত্মার বাক্য পাকতঃ সপ্রমাণ হইল।

 ওথেলো করবসনের কথা শ্রবণানন্তর পত্নীর নিকট গমন পূর্ব্বক শিরঃপীড়ার ব্যপদেশে কহিলেন আমি মস্তকের বেদনায় অস্থির হইয়াছি সেই রুমাল খান আন দেখি তদ্বারা শিরোবন্ধন করি। দেস্‌দেমনা পতির পীড়ার কথা শ্রবণে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ একখান রুমাল আনিয়া দিলে তিনি কহিলেন এ নয়, আমি তোমাকে যে খানা দিয়াছিলাম সেই খানা দাও। কিন্তু দেস্‌দেমনা সে রুমাল কোথায় পাইবেন হস্তান্তর করিয়া তাহা হারাইয়া ছিলেন, সবিনয় বচনে তদ্বিবরণ নিবেদন করিলেন। ইহাতে ওথেলো জাত ক্রোধ হইয়া কহিলেন সে কি? তবে তুমি গুরুতর অপরাধ করিয়াছ। সে রুমাল সামান্য বসন নয়, মিসর দেশীয়া এক ডাকিনী আমার জননীকে তাহা প্রদান করিয়াছিল। সেই স্ত্রী মনুষ্যের মনের কথা কহিতে পারিত, আমার মাতাকে রুমাল দিয়া বলিয়াছিল যাবৎ যত্ন পূর্ব্বক রক্ষা করিবে তাবৎ তোমার স্বামী তোমাকে ভাল বাসিবেন কিন্তু রুমাল নষ্ট অথবা কাহাকেও বিতরণ করিলে ব্যতিক্রম জন্মিবে অর্থাৎ পূর্ব্বে যত অনুরাগ করিবেন পরে ততই বিরাগ দর্শাইবেন। জননী ঐ অদ্ভুত কর বসন মৃত্যুকালে আমার করে সমর্পণ করিয়া আজ্ঞা করিয়া যান যদি কখন দার পরিগ্রহ কর স্বীয় প্রমদাকে এই রুমাল প্রদান করিও। আমি মাতার অনুমতি ক্রমে পরম যত্নে সেই বস্ত্র খণ্ড নয়ন তুল্য অমূল্য নিধি বোধে রক্ষা করিয়াছিলাম এখন তুমি তাহা হারাইলে আপনিই ইহার ফল অনুভব করিবে। দেস্‌দেমনা এতদ্বচন শ্রবণ করিয়া ভয়ে কম্পিত কলেবরা হইলেন এবং বিস্ময় ও বিষাদ প্রকাশ পুরঃসর জিজ্ঞাসা করিলেন নাথ এ কথা কি সত্য? ওথেলো কোপাবেশে উত্তর দিলেন আমি কি অলীকামোদ করিতেছি? অবনি মণ্ডলে এক ভবিষ্যদ্বক্ত্রী আবির্ভূত হইয়া দ্বিশত বর্ষ জীবিতা ছিলেন। তিনি নানাবিধ দুরূহ দৈব কর্ম্মের অনুষ্ঠান পূর্ব্বক ঐ মায়াময় রুমাল নির্ম্মাণ করেন। দেস্‌দেমনা এ সমস্ত শ্রবণে ভয়ে কম্পান্বিতা হইলেন এবং সেই অদ্ভুত রুমাল হৃত হওয়াতে মনে করিলেন বুঝি করবসনের সঙ্গে স্বামির স্নেহও হারাইলাম। ওথেলো রুমালের বৃত্তান্ত বর্ণনানন্তর কোপে কম্পান্বিত হইয়া তাহার নিমিত্ত বনিতাকে পুনশ্চ উত্তেজনা করিতে লাগিলেন এবং অপহৃত হওয়ার কথায় অবিশ্বাস করত বাহির করিয়া আনিতে বারম্বার বলিলেন। দেস্‌দেমনা কান্তের কোপ শান্তি করণাশয়ে নানা প্রকার স্তবস্তুতি ও প্রবোধ বাক্য কহিলেন তৎপরে পরিহাস ও আমোদ দ্বারা চিত্ত প্রসন্নতা সাধনের মানসে সহাস্য বদনে বলিলেন নাথ ক্যাশিওর প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ নিমিত্ত আমি বারম্বার ব্যগ্রতা করিয়া থাকি তাহাতে আপনার আন্তরিক ইচ্ছা নাই তন্নিমিত্ত কি এই বিভীষিকা ও ভর্ৎসনা হইতেছে। ইহা কহিয়া ক্যাশিওর প্রতি প্রসন্নতা সাধনার্থ তাহার প্রশংসা করিতে লাগিলেন। ওথেলো ঐ ব্যক্তিতে জাতাশঙ্ক হইয়াছিলেন তাহারই গুণানুবাদ বনিতার বদন হইতে অনর্গল বিনির্গত শুনিয়া ক্রোধে প্রজ্বলিত হওত সমুচিত বিরাগ প্রদর্শন পুরঃসর তৎক্ষণাৎ গৃহ হইতে বহির্গত হইলেন। তখন দেস্‌দেমনা মনে করিলেন স্বামী আমার প্রতি সন্দিহান অথবা বিরক্ত হইয়াছেন সংশয় নাই।

 কিন্তু তিনি ওথেলোর নিকট কি নিমিত্ত অপরাধিনী হইলেন বিবেচনা করিয়া স্থির করিতে পারিলেন না। তৎপরে মনে করিলেন আমি স্বীয় অন্তঃকরণ মধ্যে একবার পতি নিন্দার সঙ্কল্প করিয়াছিলাম তাহারই বুঝি এই ফল হইল। তদনন্তর বিতর্ক করিতে লাগিলেন বোধ হয় বেনিস্ হইতে কোন কুসংবাদ আসিয়া থাকিবে অথবা রাজ সংক্রান্ত কোন বিপদ ঘটিয়া থাকিবে কেননা স্বামিকে সাতিশয় চিন্তাকুল দেখিতেছি, ইহাঁতে পূর্ব্বকার মাধুর্য্য ভাবের লেশ মাত্র নাই। আর বার বিবেচনা করিলেন মনুষ্যদের ভাব দেববৎ চিরকাল সমান থাকে না, বিবাহের অগ্রে যেরূপ সমাদর ও ভাব ভক্তি দেখায় পরিণয় সম্পন্ন হইলে তাহার অন্তর্ধান হয় তাহাই বুঝি হইল পরন্তু স্বামির নির্দয়তা দর্শনে আপনাকে অভিশপ্ত জ্ঞান করিলেন।

 ওথেলো পুনর্ব্বার পত্নীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া তিরস্কার করত স্পষ্টরূপে কহিলেন তুই পাপীয়সী অতি কৃতঘ্না, পর পুরুষে প্রণয়িনী হইয়াছিস্‌। এই রূপ ভর্ৎসনানন্তর স্বয়ং বিলাপ করিতে লাগিলেন। কিন্তু পরপুরুষ কে? তাহার নাম গ্রহণ করিলেন না। দেস্‌দেমনা স্বামির কর্কশ বচন শ্রবণ ও কার্য্য অবলোকন করিয়া বলিলেন এ কি অদ্ভুত কাণ্ড আপনি কেন বিলাপ করেন? ওথেলো কহিলেন অরে দুশ্চারিণি আমার মহতী সহিষ্ণুতা, আমি সেই শক্তিতে সর্ব্ব প্রকার রোগ দরিদ্রতা অপমান সহ্য করিতে পারি কিন্তু তোর বিশ্বাসঘাতকতায় চিত্ত একেবারে ভগ্ন হইয়াছে। অরে কলঙ্কিনি তরুর মনোহর প্রসূন সন্দর্শনে ও তদীয় সৌরভ আঘ্রাণেই লোকে লালসান্বিত হইয়া থাকে তুইও কি তদ্রূপ লোভনীয় হইলি, তোর জন্ম না হইলে যে শ্রেয়ঃ সম্ভাবনা ছিল। এবম্প্রকারে ঘৃণা করিয়া ক্রোধভরে স্থানান্তর গমন করিলে দেস্‌দেমনা চমৎকৃতা ও অপমানে ম্রিয়মাণ হইলেন। স্বামির এই অমূলক সন্দেহ এবং তন্নিমিত্ত বিমাননায় কি করিবেন কিছুই স্থির করিতে না পারিয়া গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হইলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে দুর্ভাবনা বশতঃ নিদ্রা তাঁহার নেত্রদ্বয় আকর্ষণ করিলে সহচরীদিগকে শয্যা প্রস্তুত করিতে কহিয়া তদুপরি আপনার বিবাহের বসন বিস্তীর্ণ করিতে অনুমতি করিলেন আর এই বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিলেন লোকে বালকদিগের শিক্ষা নিমিত্ত উৎকৃষ্ট উপায় অবলম্বন পূর্ব্বক ভর্ৎসনা করিয়া থাকে ওথেলো আমাকে তদ্রূপে তিরস্কার করিলে ভাল হইত কেননা এ পক্ষে আমি বালিকা ব্যতীত প্রবীণ নহি।

 দেস্‌দেমনার শয়ন করিবার তাৎপর্য্য এই যে তিনি শয্যাগতা হইলে ওথেলোও শয়ন করিবেন কিন্তু সেনাপতির মনে প্রণয়ের সঞ্চার মাত্র ছিল না, কেন পুনর্ব্বার তাঁহার সংস্পর্শে যাইবেন? অতএব ঐ অবলা বহু ক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া চিত্তের ব্যাকুলতা নিমিত্ত ক্রমে নিদ্রাভিভূত হইলেন। পরে ওথেলো বনিতার ব্যভিচারের প্রতিফল প্রদানাশয়ে জিঘাংসায় গৃহ মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন ভার্য্যা গভীর নিদ্রায় অচেতন হইয়া শয়ানা রহিয়াছে ইহাতে তদবস্থায় করবালাঘাত দ্বারা শোণিতোৎপাদন অথবা সুবর্ণ বর্ণ শরীর বিক্ষত করিতে ইচ্ছা হইল না কিন্তু তাঁহার এই ক্ষণিক করুণোদয়েও দ্রঢ়ীয়সী প্রতিজ্ঞা ভগ্না হইল না যেহেতু কহিতে লাগিলেন যদিস্যাৎ বিনষ্ট না করিয়া পরিত্যাগ করি তাহা হইলে আমার ন্যায় অন্যের প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করিবে। পরে জন্মের মত দয়িতার আশ্লেষ সমাপন মানসে তদীয় নির্ম্মল বদন চুম্বন করিলেন। তাহাতে মাধুর্য্য রসের আস্বাদ হওয়াতে পুনঃ২ চুম্বন আরম্ভ করিলেন অবশেষে শোকাভিভূত হইয়া রোদন করিতে২ কহিলেন প্রিয়ে এ আমার প্রেমাশ্রু নহে।

 ওথেলোর বারম্বার চুম্বনে দেস্‌দেমনার নিদ্রাভঙ্গ হইল। তিনি জাগরিত হইয়া চক্ষুরুন্মীলন পূর্ব্বক অবলোকন করিলেন স্বামী সম্মুখে বিকট দশনে স্বীয়াধর দংশন এবং লোহিত নয়ন ঘূর্ণায়মান করত করাল কাল প্রায় দণ্ডায়মান। পতির এবম্প্রকার ভয়ানক আকার নিরীক্ষণ মাত্রে নিশ্চয় করিলেন এই আমার সংহারক মূর্ত্তি। তদনন্তর ওথেলো গভীর স্বরে গর্জ্জন করিতে২ কহিলেন অরে পাপীয়সি মরণার্থ প্রস্তুত হইয়া পরমেশ্বরের নাম গ্রহণ কর, এখনি তরবারি প্রহারে তোর প্রাণ সংহার করি। ইহাতে পতিপ্রাণা দেস্‌দেমনা প্রাণ ভয়ে সাতিশয় কাতরতা পুরঃসর অনুগ্রহ প্রার্থনা করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন কি অপরাধে প্রাণ দণ্ড কর। জিঘাংসু সেনানী উত্তর করিলেন এক্ষণে ক্যাশিও তোর প্রণয় ভাজন হইল, আমার প্রদত্ত রুমাল প্রেম বশতঃ তাহাকে প্রদান করিয়াছিস্‌। দেস্‌দেমনা এতৎ শ্রবণে বিস্ময় প্রকাশ পূর্ব্বক আত্ম অনপরাধ সপ্রমাণ করিতে উদ্যম করিতেছেন ইত্যবসরে ওথেলো শয্যা বসন দ্বারা তদীয় বদন বন্ধন পূর্ব্বক শ্বাসাবরোধ করিয়া গ্রাণ সংহার করিলেন।

 অনন্তর ক্যাশিও আঘাত প্রাপ্ত হইয়া শোণিতাক্ত শরীরে ওথেলোর সন্নিধানে ঐ ভবন মধ্যে আনীত হইলেন। দুরাত্মা ইয়াগো তাহার জীবন বিনাশ নিমিত্ত এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিয়াছিল। সে জীবন সংহার বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারে নাই অস্ত্রাঘাতে ক্যাশিওর শরীর ক্ষত বিক্ষত করিয়া শেষে শান্তিরক্ষকদিগের ভয়ে আপনার নিযোক্তা কর্ত্তৃক স্বয়ং নিহত হয়। ঐ ব্যক্তির অঙ্গবস্ত্র হইতে একখান লিপি বহির্গত হওয়াতে তদ্দ্বারা পরে প্রকাশ হইল ক্যাশিও নিতান্ত নির্দোষ, দুরাত্মা ইয়াগোর দুর্মন্ত্রণা বশতঃ সেনানীর অলীক আশঙ্কা ও নানা দুর্ঘটনা ঘটিল। সে যাহা হউক। ক্যাশিও শোণিতাক্ত দেহে ওথেলোর সমীপে আনীত হইলে আদৌ প্রাণ পরিক্ষণ নিমিত্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া পরে জিজ্ঞাসা করিলেন আমি কি অপরাধ করিলাম যে আমার প্রাণদণ্ড নিমিত্ত ইয়াগো আদিষ্ট হইয়াছিলেন।

 অনন্তর দুরাত্মা ইয়াগোর ষড়যন্ত্র প্রকাশিত হইলে ওথেলোর হৃদয় অকস্মাৎ বজ্রাঘাত তুল্য অনুতাপের আবেগে বিদীর্ণ হইতে লাগিল। তখন স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন বিনা অপরাধে ধর্ম্মপরায়ণা পতিব্রতা পত্নী হত্যা করিয়া মহা পাপী হইলাম। এবং পরম প্রেয়সীর পরিগ্রহাবধি সদ্ভাব ও প্রণয় স্মরণ পথে আবির্ভূত হওয়াতে দারুণ শোকানলে দগ্ধ হইতে লাগিলেন। পরিশেষে প্রাণ ধারণে অসহিষ্ণু হইয়া প্রিয়তমার মৃত শরীরের উপরি শয়ান হইলেন এবং স্বহস্তে আত্ম গ্রীবায় তীক্ষ্ণ তরবারি আঘাত করত ক্লেশের শেষ করিলেন।

 নিকটস্থ লোকেরা এই সমস্ত ভয়ানক ব্যাপার নিরীক্ষণ করিয়া ভয়ে কম্পান্বিত এবং বিস্ময়ে ব্যাকুল হইল কেননা যে ওথেলোর সুখ্যাতি পৃথিবী মণ্ডল ব্যাপিয়াছিল তাঁহার এই দুর্দশা ঘটিল। ফলতঃ ঐ মহাবীর সেনাপতি স্বীয় সারল্য স্বভাব প্রযুক্ত ধূর্ত্তের আচরণ অনুসন্ধান করেন নাই। যাবৎ শঠের প্রবঞ্চনা জালে বদ্ধ না হইয়াছিলেন তাবৎ তাঁহার পরম প্রেমাস্পদ বনিতা ও অকৃত্রিম প্রণয় পবিত্র মিত্র ক্যাশিওর প্রতি স্নেহ এবং অনুরাগ সম্পূর্ণ ছিল কিন্তু সমীক্ষ্য কারিতা না থাকাতে হঠাৎ শঠের শঠতায় পড়িয়া তাহা বিনষ্ট করিয়া শেষে আত্মহত্যা করিলেন। পরন্তু তাঁহার যে বীর্য্যবৎ নয়ন হইতে জন্মাবধি কদাপি অশ্রুবিন্দু বিনির্গত হয় নাই ভ্রান্তি প্রতীত হইলে তাহা হইতে অনর্গল বারি ধারা নিঃসৃত হইয়াছিল। যাহা হউক এবম্প্রকারে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেও তাহার শৌর্য বীর্য্যাদি গুণ নিকর লোক মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং যে পাপাত্মার দুর্মন্ত্রণা প্রভাবে এই দুর্ঘটনা ঘটে সে ব্যক্তিও বিনা দণ্ডে নিষ্কৃতি পায় নাই। সেনানীর উত্তরাধিকারী ব্যবস্থানুসারে বিবিধ যন্ত্রণা দিয়া তাহার প্রাণ দণ্ড করত সমুচিত প্রতিফল দেন, অনন্তর বেনিস্ রাজ্যে মহানুভব সেনাপতির পরিদেবনীয় মৃত্যু সংবাদ প্রেরণ করেন ইতি।