সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/নিদাঘ নিশীথের স্বপ্ন

R. D. SORNOKAR, ENGR
৩৪৯

নিদাঘ নিশীথের স্বপ্ন।

সেক্‌সপিয়র।


নিদাঘ নিশীথের স্বপ্ন।


 এথেন্স নগরে কন্যাদান বিষয়ে এই নিয়ম প্রচলিত ছিল পিতা আপনার মতানুসারে পাত্র নির্দ্দিষ্ট করিয়া কন্যা সম্প্রদান করিতেন। কোন কুমারী যদিস্যাৎ জনকের মনোনীত বরকে কর প্রদানে অস্বীকার করিত তাহা হইলে ব্যবস্থানুসারে তাহার প্রাণদণ্ড হইতে পারিত। অপত্যস্নেহ স্বভাবতঃ প্রবল এ প্রযুক্ত কোন অঙ্গজা অবাধ্যা হইলেও পিতা প্রায় তাহার মৃত্যু বাঞ্ছা করেন না ইহাতে যদিও ঐ ব্যবস্থানুসারে দণ্ড বিধান প্রায় হইত না তথাপি জনকেরা ঐ ব্যবস্থার উল্লেখ করত সর্ব্বদা স্ব২ তনয়াদিগকে ভয় প্রদর্শন করিতেন।

 একদা ইজিয়স্‌ নামা এক বৃদ্ধ এথেন্সের ভূপতি থিসিয়স্‌ সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া বিনয় পুরঃসর আবেদন করিলেন মহারাজ হারমিয়া নাম্নী আমার এক তনুজা আছে। আমি কন্যাকে পাত্রসাৎ করিবার নিমিত্ত দেমিত্রিয়স নামক মহাকুলীন সম্ভ্রান্ত এক পাত্র স্থির করিয়া আজ্ঞা করিয়াছিলাম তাহার গলে বরমাল্য প্রদান কর। কিন্তু দুহিতা লাইসেন্দর সংজ্ঞক অপর এক যুবার প্রেমাসক্তা হওয়াতে আমার আজ্ঞা অবজ্ঞা করিয়াছে অতএব ধর্ম্মাবতার বিচার পূর্ব্বক দেশের নিয়মানুসারে অবাধ্যা পুত্রীর প্রাণদণ্ড বিধানে অনুমতি হউক।  অনন্তর হারমিয়া ধর্ম্মাধিকরণে আনীত হইলেন। তাঁহাকে পিত্রাজ্ঞা হেলনের কারণ জিজ্ঞাসা করতে কহিতে লাগিলেন মহারাজ জনকের আদেশ লঙ্ঘন করিবার হেতু আছে, পিতা আমার নিমিত্ত যে বর পাত্র মনোনীত করিয়াছিলেন আমার প্রিয়সখী হেলেনা তাহার প্রতি আসক্তা হইয়া বিরহে উন্মত্ত প্রায় হইয়াছেন অতএব সহচরীর অনুরোধে আমি পিতার নির্দ্দিষ্ট বরপাত্রকে বিবাহ করিতে অস্বীকার করিয়াছি। ধর্ম্মাবতার কেবল সখ্য ধর্ম্ম পরিপালনার্থ অজ্ঞা লঙ্ঘন হইয়াছে এতন্নিমিত্ত পিতাকে যৎপরোনাস্তি অনুনয় করিয়াছি তাঁহার চিত্তে কোন মতে দয়ার সঞ্চার হয় নাই।

 এথেন্সাধিপতি থিসিয়স্ যদিও সদয়ান্তঃকরণ ছিলেন তথাপি রাজ্যের নিয়মাতিক্রমে ক্ষমতা ছিল না। অতএব হারমিয়াকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন এতদ্দেশের আচার ও নিয়মানুসারে কন্যা সম্প্রদানে পিতার সম্পূর্ণ অধিকার, তোমার তাত যে বরপাত্র মনোনীত করিয়াছেন অবশ্য তাঁহার গলে বরমাল্য প্রদান করিতে হইবে, তোমাকে চারি দিবস অবকাশ দিলাম, বাটী গিয়া বিবেচনা কর, যদি পিতার নির্ণীত বরকে পতিত্বে বরণ করিতে একান্ত অস্বীকার কর ব্যবস্থানুসারে প্রাণদণ্ড হইবেক।

 হারমিয়া নৃপতির এতদ্বচন শ্রবণানন্তর বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক আপনার প্রণয়াস্পদ লাইসেন্দরের সন্নিধানে আগমন করিলেন এবং উপস্থিত বিপদের বিষয় বিজ্ঞাপন করত তাঁহাকে কহিলেন প্রিয়তম তোমাকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক দেমিত্রিয়স্‌কে পরিণয় অথবা বাসর চতুষ্টয়াবসানে প্রাণদণ্ড স্বীকার করিতে হয় এতদ্ব্যতীত গত্যন্তর নাই কর্ত্তব্য কি?

 লাইসেন্দর প্রণয়িনীর প্রমুখ উক্ত বার্ত্তা শুনিয়া দুঃখার্ণবে নিমগ্ন হইলেন এবং বিবিধ প্রকারে বিষাদ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর উপায় চিন্তনে প্রবৃত্ত হইলে স্মরণ হইল তাঁহার পিতৃব্য পত্নী কিয়দ্দূরবর্ত্তি এক স্থানে বসতি করিতেছেন এথেন্স নগরীয় নিয়ম সেখানে প্রচলিত নাই। বিবেচনা করিয়া দেখিলেন সে স্থানে প্রস্থান করিলে উপস্থিত বিপদ্ হইতে হারমিয়া পরিত্রাণ পাইতে পারেন অতএব প্রেয়সীকে কহিলেন অদ্য নিশাভাগে তুমি পিত্রালয় হইতে পলাইয়া আইস, আমার পিতৃব্য পত্নী এস্থান হইতে কিয়দ্দূরে বাস করেন সেখানে পরিণয়ের এ নিয়ম চলিত নাই, তাঁহার মন্দিরে প্রত্যুষে দুই জনে পলায়ন পূর্ব্বক তথায় তোমার পাণি গ্রহণ করিব। নগরের বহির্ভাগস্থ যে ক্রীড়া কাননে বসন্ত কালে হেলেনার সহিত ভ্রমণ করিতাম সেখানে থাকিয়া তোমার প্রতীক্ষা করিব তথায় আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিও।

 হারমিয়া এই পরামর্শে সাতিশয় আহ্লাদিত হইলেন, স্বীয় সহচরী হেলেনা ব্যতীত কাহার নিকটে ইহা প্রকাশ করিলেন না। কামিনীগণ প্রণয় পাশে নিবদ্ধ হইলে নায়কের নিমিত্ত উন্মত্ত প্রায় হয়, হেলেনা দেমিত্রিয়সের প্রেমে পড়িয়া তদ্রূপ হওয়াতে প্রিয়সখীর গুপ্ত কথা আপনার প্রিয় সন্নিধানে ব্যক্ত করিলেন। ইহাতে হেলেনার কোন প্রকার অভীষ্ট সম্ভাবনা ছিল না কেবল নায়কের আন্তরিক ভাবের পরীক্ষা নিমিত্ত সৌহৃদ্য ধর্ম্মের বিরুদ্ধাচরণ করিলেন কেননা মনে করিয়াছিলেন হারমিয়ার প্রতি দিমিত্রিয়সের আসক্তি থাকিলে এ সংবাদে অবশ্য তাঁহার পশ্চাদ্বর্ত্তী হইবেন।

 সে যাহা হউক লাইসেন্দর যে কাননে হারমিয়ার সহিত মিলিত হইবার কল্পনা করিলেন সেখানে দেবযোনি পরী জাতির সতত সমাগম হইত।

 পরীজাতির নৃপতি অবিরণ এবং তাঁহার মহিষী তিতেনিয়া আপনাদের অনুচর সমভিব্যাহারে নিশাযোগে সমাগমন পূর্ব্বক ঐ স্থানে আমোদ প্রমোদ করিতেন।

 এই সময়ে রাজ্ঞীর সহিত পরীরাজ অবিরণের একটা কলহ উপস্থিত হইয়াছিল। চন্দ্রিকোজ্জ্বল নিশায় কাননাভ্যন্তর বর্ত্তি সুশোভিত তরু পংক্তির অভ্যন্তরে পরস্পর সাক্ষাৎ হইলে বিবাদে মত্ত হইতেন তাহাতে অধীনস্থ পরী সকল ত্রাসে শস্যাদির ত্বক্ মধ্যে লুক্কায়িত হইয়া থাকিত।

 পরী দম্পতীর মধ্যে দ্বন্দ্ব ঘটিবার কারণ এই, তিতেনিয়া একটী বালক প্রাপ্ত হইয়াছিলেন তাহাকে রাজা অবিরণের করে সমপর্ণ করিতে স্বীকার করেন নাই। ঐ শিশু রাজমহিষীর সখীগর্ব্ভজ। বয়স্যা সন্তান প্রসব করিয়া লোকান্তর প্রাপ্ত হইলে বালক ধাত্রী কর্ত্তৃক পালিত হইতেছিল। রাজ্ঞী তাহাকে দেখিয়া দয়ার আর্বিভাব হওয়াতে ধাত্রীর ক্রোড়ে তাদৃশ অন্য একটী বালক স্থাপন পূর্ব্বক হরণ করিয়া আনেন এবং লালন পালন করত বনের মধ্যে রাখিয়াছিলেন।

 লাইসেন্দর হারমিয়ার সহিত পলায়ন নিমিত্ত যে সময় কাননে পরস্পর সম্মিলনের মন্ত্রণা করিয়াছিলেন তদবসরে পরীরাজের বনিতা তিতেনিয়া সহচরীগণ সমভিব্যাহারে বন বিহার করিতেছিলেন। সম্মুখে দেখিতে পাইলেন স্বামীও পাত্র মিত্র সহ তথায় অধিষ্ঠিত হইয়াছেন।

 তিতেনিয়া নয়নগোচর হইলে পরীরাজ বিবাদ স্মরণ করত তাঁহাকে কহিলেন আঃ দুর্ললিতা তিতেনিয়া পূর্ণ নিশাকর কিরণোজ্জ্বল এই শুভ বিভাবরীভাগে তোর সহিত আবার অশুভ সাক্ষাৎ হইল। তাঁহার মহিলাও ঐ ভাবে কহিলেন হে দ্রোহি অবিরণ, তুমি কি এখানে ভ্রমণ করিতেছ? পরে রাজাচরদিগকে বলিতে লাগিলেন ওহে তোমরা আশু এস্থান হইতে প্রস্থান কর, আমি শরীরার্দ্ধ জায়া, আমিও শপথ পূর্ব্বক ইহার সহ বাস ত্যাগ করিলাম পরীরাজ মহিষীর এতদ্বচনে রোষ প্রকাশ করিলেন না, শান্তভাবে বলিলেন অয়ি অবোধ মহিষি, শপথ কর কেন? আমি কি তোমার স্বামী নহি? কি নিমিত্ত ত্যাগ করিবে? হে প্রেয়সি তোমার সেই ক্ষুদ্র বালকটী আমাকে দাও তাহাকে সহচর করিয়া সর্ব্বদা আপনার সন্নিধানে রাখিব।

 রাজ্ঞী কহিলেন মহারাজ ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক সেই বালক প্রাপ্তির প্রয়াস পরিত্যাগ করুন সমুদায় রাজত্ব প্রদান করিলেও তাহাকে পাইতে পারিবেন না। ইহা কহিয়া রাজার রোষানল প্রদীপ্ত করত তাঁহার সম্মুখ হইতে গমন করিলেন। পরে পরীরাজ সরোষ বচনে কহিতে লাগিলেন ভাল এখন যাও, কিন্তু নিশাবসান না হইতে২ এই অবমাননার বিনিময়ে তোমার চিত্ত দাহ করিব।

 তদনন্তর রাজা আপনার প্রিয়পাত্র পক্ নামক প্রধান মন্ত্রিকে আহ্বান করিয়া পাঠাইলেন।

 ঐ মন্ত্রির অপর এক সংজ্ঞা রবিন্-গুড-ফেলো। সে অতি চতুর ধূর্ত্ত শিরোমণি দেবযোনি ছিল, নিকটস্থ গ্রাম সকলে গমন পূর্ব্বক সর্ব্বদা অদ্ভুত ও কৌতুক জনক ক্রীড়া করিত। কখন গোপদিগের গৃহে প্রবেশ পূর্ব্বক পাত্রস্থ দুগ্ধ অকস্মাৎ ফেণাবৃত করিত, কখন সুক্ষ্ম দেহ ধারণ পুরঃসর নবনীত পাত্র মধ্যে আপনার কল্পিতাকৃতি নিমগ্ন করত এবম্প্রকারে নৃত্য করিত যে গোপীগণের দধি মন্থন পূর্ব্বক নবনীতোদ্ধারের যত্ন বিফল হইয়া যাইত। গ্রামস্থ অন্যান্য লোকদিগের কর্ম্মেও এই রূপে সতত ব্যাঘাত করিত, কখন২ পানপাত্রের সহিত খেলা করিতে গিয়া সুরা নষ্ট করিয়া আসিত। অপর প্রতিবাসি লোকেরা অনেকে একত্র উপবেশন পুরঃসর আসব সেবনের উদ্‌যোগ করিলে দগ্ধ কর্কটাকার ধারণ পুরঃসর আসবাধার মধ্যে পতিত হইত, এবং কোন প্রাচীনা প্রমদা মদ্য পানার্থ উদ্যতা হইলে কুণ্ডলাকৃতি ধারণ পুরঃসর তাহার মদ্য পাত্রে পতিত হইয়া জিহ্বাগ্রে বাধা দিত তাহাতে মদ্য গলাধঃকৃত না হইয়া চিবুক দিয়া বিস্তৃত হইয়া পড়িত। অপর প্রবীণ স্ত্রীলোকে অঙ্গনাগণ মধ্যে উপবেশন পুরঃসর কোন বিষয় বর্ণন করিয়া গল্প করিতে আরম্ভ করিলে হঠাৎ উপস্থিত হইয়া তাহার আসন স্থানান্তরে লইয়া রাখিত তাহাতে সেই অবলা ভয়ে ভূতলে পতিত হইত। ইহাতে অন্যান্য প্রাচীন জল্পকেরা তাহার নিকট গমন পূর্ব্বক চতুর্দিগে বেষ্টন করিয়া হাস্য করিতে২ কহিত আর কোন সময় ঈদৃশ কৌতুকাবহ ঘটনা হয় নাই।

 সেই কৌতুকাসক্ত রসিক অমাত্য আসিয়া উপস্থিত হইলে পরীরাজ তাহাকে সমীপে আহ্বান পূর্ব্বক কহিলেন কুমারীগণ যাহাকে প্রেম কুসুম বলে সেই পুষ্প একটা আনিয়া দাও দেখি। সেই কুসুম অতি ক্ষুদ্র বার্ত্তাকু পুষ্পের তুল্য, তাহার রস সুপ্ত ব্যক্তির নয়নে প্রদান করিলে নিদ্রা ভঙ্গে যাহার দিকে নেত্র পাত করে তাহার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়, আমার মহিষী তিতেনিয়ার নিদ্রা সময়ে সেই কুসুমের রস তদীয় লোচনে প্রদান করিব তাহাতে তিনি সুপ্তোত্থিত হইয়া প্রথমতঃ যাহার প্রতি দৃষ্টি পাত করিবেন তাহারই প্রেমে আসক্ত হইবেন যদি নিদ্রাভঙ্গে দৈবাৎ সিংহ ভল্লুক অথবা চপল শাখামৃগের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন তাহার প্রতিই আসক্তা হইবেন। আমি অন্য এক দ্রব্যের দ্বারা তাঁহার নয়নেন্দ্রিয়ের এই মোহ নাশ করিতে পারি কিন্তু যাবৎ তাঁহার বালককে প্রাপ্ত না হইব তাবৎ পর্য্যন্ত করিব না সুতরাং অগত্যা বালক সমপর্ণ করিবেন।

 পক্ মন্ত্রী নিরন্তর পরাপকারে রত থাকিত সুতরাং প্রভুর কুমন্ত্রণার মতে পোষকতা করিয়া সর্বান্তঃকরণে তৎক্ষণাৎ কুসুমান্বেষণ করিতে গেল। এই সময়ে দেমিত্রিয়স হারমিয়ার উদ্দেশে কানন মধ্যে প্রবেশ করিলেন। হেলেনা পশ্চাদ্গামিনী হইয়া আসাতে দেমিত্রিয়স তাঁহাকে যে সকল কথা কহিয়া ভর্ৎসনা করিতেছিলেন সমুদায় পরীরাজের কর্ণগোচর হইল। অনন্তর দেমিত্রিয়স্ কামিনীকে নানা প্রকার নিষ্ঠুর বাক্য কহিলেন তরুণী তাহাতে প্রত্যুক্তি না করিয়া বিনীতি প্রদর্শন পুরঃসর কেবল আপনার প্রতি তাঁহার পূর্ব্ব প্রণয় ও তদর্থ সত্য বন্ধনের বিষয় স্মরণ করিয়া দিতে লাগিলেন কিন্তু তাহাতে নির্দয় দেমিত্রিয়সের হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল না অবলাকে বিপিনে হিংস্র শ্বাপদের মধ্যে পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনি সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। হেলেনা ভীষণ বনমধ্যে একাকিনী কোথায় কি আশ্রয় পাইবেন? নায়ক বিমুখতাবলম্বন পূর্ব্বক পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন পরায়ণ হইলে উর্দ্ধ শ্বাসে তাঁহার পশ্চাতে ধাবমান হইলেন।

 পরীরাজ প্রেমাসক্ত ব্যক্তি দিগকে ভাল বাসিতেন, হেলেনার দুঃখ দর্শনে সাতিশয় দয়ার্দ্র হইলেন। লাইসেন্দর তরুণীকে পূর্ব্বে কহিয়াছেন চন্দ্রিকোজ্জ্বল রজনীতে আনন্দ দায়ক কানন মধ্যে ভ্রমণ করিতেন এক্ষণে বোধ হয় দেমিত্রিয়স্ যখন হেলেনার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন সেই সুখের সময়ে কামিনী বন বিহার করিয়া থাকিবেন এবং তদবস্থায় পরীরাজ অবিরণের দৃষ্টিগোচর হইয়াছিলেন। যাহা হউক রাজা যুবতীর কাতরতা দেখিয়া যৎপরোনাস্তি খিন্ন হইলেন এবং কুসুমানয়নার্থ প্রেরিত মন্ত্রী কখন্ আইসে ব্যস্ত সমস্ত হইয়া প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে অমাত্য পুষ্প গ্রহণ পূর্ব্বক প্রত্যাগত হইলে তাহাকে কহিলেন মন্ত্রিন্ এই কুসুমের কিয়দংশ লইয়া সত্বর ঐ দিকে গমন কর এথেন্স নগর বাসিনী একটী কামিনী এই বিপিন মধ্যে একটা ঘৃণ্য নায়কের প্রেমে আসক্ত হইয়া ব্যাকুলা হইয়াছেন উক্ত পুরুষ নিদ্রাগত হইলে এই কুসুমের রস তাহার নয়নে নিক্ষেপ করিও কিন্তু যখন তাহার সন্নিধানে তৎ প্রেমানুরক্ত নায়িকা থাকে সে সময় ঐ কর্ম্ম করিও তাহা হইলে ঐ ব্যক্তি নিদ্রাপগমে গাত্রোত্থান পূর্ব্বক অবশ্য সেই কামিনীকে অবলোকন করিবে। সেই পুরুষের অঙ্গে এথেন্স দেশীয় পরিচ্ছদ আছে তুমি দেখিলেই চিনিতে পারিবা। অমাত্য রাজার বচন শ্রবণানন্তর নিবেদন করিল মহারাজ চতুরতা প্রকাশ পুরঃসর আপনার সমুদায় আদেশ অবিলম্বে সম্পন্ন করিয়া আসিতেছি। অনন্তর মন্ত্রী প্রস্থান করিলে রাজা সংগোপনে স্বীয় মহিষী তিতেনিয়ার আবাসে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন অতি মনোহর নিকুঞ্জ, জাতী যূতি মল্লিকা মালতী প্রভৃতি নানাবিধ লতায় সুরঞ্জিত, নিকটবর্ত্তি নদীর শীকর বাহি সমীরণের বিবিধ সুরভি কুসুম সঞ্চালন পুরঃসর মন্দ২ বহনে চতুর্দ্দিক্‌ আমোদিত হইয়াছে, মধু গন্ধে লুব্ধ মধুকর নিকর মধুরাব্যক্ত কলরব করত পুষ্পে২ ভ্রমণ করিতেছে। সেই কুঞ্জান্তর্ব্বর্ত্তি কুটীরে দুগ্ধফেণনিভ শয্যার উপরি সর্ব্বাঙ্গ সুন্দরী পরীশ্বরী শয়ানা। শয়মের আচ্ছাদন বসন ভুজঙ্গের বিচিত্র কঞ্চুকময়, সেই আস্তরের ঈদৃশী বিস্তার যে তাহাতে রাণীর কলেবর সম্যক্ প্রকারে আচ্ছাদিত হইবার সম্ভব।

 পরীরাজ অবিরণ রাণীর শয়ন সন্নিধানে দণ্ডায়মান হইয়া শ্রবণ করিলেন মহিষী নিদ্রার প্রাক্ কালে কর্ম্মকরীগণের মধ্যে কাহাকেও আজ্ঞা করিতেছেন গোলাপ পুষ্পের অভ্যন্তরবর্ত্তি কীট সকল বিনষ্ট করিও, কাহাকে কহিতেছেন অধীনস্থা পরীদিগের বেশ ভূষণ নিমিত্ত চর্ম্মচটিকার সহিত যুদ্ধ করিয়া পক্ষ আহরণ কর, কাহাকেও বলিতেছেন এখানে উপস্থিত থাকিয়া প্রহরিতা কর পেচক যেন নিশীথে নিকটে আসিয়া রব না করে। পরে সকলকে কহিলেন অগ্রে তোমরা নিকটে বসিয়া সংগীত করত আমার নিদ্রাকর্ষণ করাও পশ্চাৎ উপদিষ্ট স্ব২ কর্ত্তব্য সম্পাদন করিও ইহাতে সহচরীগণ সন্নিধানে উপবেশন পূর্ব্বক গান করিতে লাগিল। যথা।

দুই জিহ্বা ফণা ধারি ওহে অহি গণ।
গোধিক শল্লকী তথা হও অদর্শন॥
অহে অন্ধ কৃমি কীট না কর অনিষ্ট।
রাজ্ঞীর নিকটে কেহ না হও প্রবিষ্ট।
ওহে ফাইলোমেল তুমি কর সেই গান।
যোগ করি নিদ্রাকর সুললিত তান॥
নিদ্রা দেবি রাণী নেত্র কর আকর্ষণ।
কুহক কাপট্য মায়া যাও স্বভবন।
আসিও না পুনঃ কভু রাণী সন্নিধান।
আবির্ভব নিজে করি আমরা প্রস্থান॥

 সহচরীগণ এবম্প্রকার সুললিত সংগীত দ্বারা রাজ্ঞীকে নিদ্রামগ্ন করিয়া গাত্রোত্থান পুরঃসর স্ব২ কর্ম্ম সম্পাদন নিমিত্ত গমন করিল। পরে রাজা মহিষীর পার্শ্বে অধিষ্ঠান করিয়া নিম্ন লিখিত মন্ত্রোচ্চারণ পুরঃসর তদীয় নয়নে প্রণয় কুসুমের কিঞ্চিৎ রস নিক্ষেপ করিলেন।

নিদ্রাভঙ্গে যার প্রতি পড়িবে নয়ন।
প্রেমাসক্ত হয়্যে তাকে করিও গ্রহণ।

 ইদানী হারমিয়ার বৃত্তান্ত বর্ণনা করা যাইতেছে। হারমিয়া পিতৃ নির্দ্দিষ্ট সৎপাত্র দেমিত্রিয়সের গলে বরমাল্য দানে অস্বীকার করিয়া ব্যবস্থানুসারে প্রাণ দণ্ড হইবার আশঙ্কায় ভীত হইলেন এবং অবিলম্বে পিত্রালয় হইতে পলায়ন পুরঃসর নায়কের সঙ্কেতানুসারে বন মধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন প্রিয় লাইসেন্দর তৃষিত চাতক প্রায় তাঁহার পদবী অবলোকন করত অপেক্ষা করিতেছেন, মনে করিতেছেন প্রেয়সী আসিয়া উপস্থিত হইলেই তাঁহাকে লইয়া খুড়ীর আলয়ে গমন করি। অনন্তর তরুণী আসিয়া সম্মুখীন হইলে পরস্পর আনন্দ সাগরে নিমগ্ন হইলেন এবং মিলিত হইয়া যাত্রা করিলেন। কিন্তু অর্দ্ধেক বন উত্তীর্ণ না হইতে২ হারমিয়া অতিশয় ক্লান্তা হইয়া পড়িলেন আর পদবিক্ষেপে ক্ষমতা হইল না। হারমিয়া স্বীয় জীবন বিপদগ্রস্ত করিয়া লাইসেন্দরের প্রতি প্রণয় নিবন্ধন করিয়াছিলেন সুতরাং তাঁহার সুখস্বাচ্ছন্দ্য নিমিত্ত লাইসেন্দরও যৎপরোনাস্তি যত্ন করিতেন, সুকুমারী প্রেয়সীকে পথি শ্রান্তা দেখিয়া এক নদী তীরে লইয়া গেলেন এবং তথায় কোমল শৈবাল দ্বারা শয্যা রচনা করিয়া তদুপরি শয়ন পূর্ব্বক যামিনী যাপন করিতে অনুরোধ করিলেন। তরুণী অধ্ব শ্রান্তি হেতু নিতান্ত খিন্না থাকাতে তৎক্ষণাৎ শয়ন করিলে আপনিও নিকটে ভূমিশয্যায় শয়ান হইলেন, কিঞ্চিৎ বিলম্বে উভয়ের নিদ্রাকর্ষণ হইল। তদনন্তর পরীরাজের মন্ত্রী তথায় আগমন পূর্ব্বক অবলোকন করিলেন এথেন্স দেশীয় পরিচ্ছদ ধারী অতি মনোহর রূপবান্ এক পুরুষ, এবং তৎপার্শ্বে সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী এক রমণী ভূমিশয্যায় শয়ন করিয়া অচেতনে নিদ্রা যাইতেছেন। তাঁহাদের দুই জনকে দেখিয়া স্মরণ হইল পরীরাজ অবিরণ যে ঘৃণিত নায়ক ও তৎপ্রণয়সক্তা এথেন্স নগরী নিবাসিনী নায়িকার অন্বেষণ করিতে অনুজ্ঞা করিয়াছিলেন তাঁহারাই এই দম্পতী। অনন্তর বিবেচনা করিতে লাগিলেন এ স্থানে অন্য প্রাণির সমাগম সম্ভাবনা নাই, এ পুরুষ নিদ্রাভঙ্গে অবশ্য এই কামিনীরই মুখাবলোকন করিবে অতএব অধিপের আদেশানুসারে প্রেম কুসুমের রস ইহার নয়নে নিক্ষেপ করি। কিন্তু দৈবী বিড়ম্বনা কি বিচিত্র। পরীরাজের অমাত্য সেই প্রকার করিয়া প্রস্থান করিলে সে স্থানে হঠাৎ হেলেনা আসিয়া উপস্থিত হইলেন দৈবযোগে তৎকালে লাইসেন্দরের ও নিদ্রাভঙ্গ হইল সুতরাং তাঁহার লোচন হেলেনার প্রতি নিপতিতা হওয়াতে অদ্ভুত কুসুম রসের আশ্চর্য্য শক্তি দ্বারা হেলেনা তদীয় পরম প্রণয় ভাজন হইলেন, হারমিয়ার প্রতি যে প্রেম ছিল তাহা একেবারে অন্তর্দ্ধান হইয়া গেল।

 লাইসেন্দর শয়ন হইতে গাত্রোত্থানানন্তর নয়ন দ্বয় বিনিদ্র করিবার সময় অগ্রে যদিস্যাৎ হারমিয়ার প্রতি নেত্রপাত করিতেন তাহা হইলে পরীরাজের অমাত্য ভ্রমবশতঃ যে কুহক করিল তাহাতে বিশেষ ফল দর্শিত না কেননা লাইসেন্দর তাঁহার প্রতি পূর্ব্বাবধি অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু ইদানী মোহনীয় কুসুম রসযোগে জাগ্রৎ হইয়া হঠাৎ হেলানাকে অবলোকন করাতে তদাসক্ত হইলেন। একেবারে প্রেমের বশম্বদ হওয়াতে নিশীথে চির প্রণয়িনী সমভিবাহারিণী রমণীকে অরণ্য মধ্যে একাকিনী পরিত্যাগ পূর্বক নবানুরাগ ভাজন হেলেনার আনুগত্য করিতে উদ্যত হইলেন। সুতরাং হারমিয়া বিষম সঙ্কটে পড়িলেন, তাঁহার পরিতাপের পরিসীমা রহিল না।

 দেমিত্রিয়স্ যখন হেলেনার নিকট হইতে বেগে পলায়ন করেন তখন এই দুঃখিনী কামিনী তাঁহার সঙ্গ হারাইবার ভয়ে পশ্চাদ্ধাবমানা হইয়াছিলেন কিন্তু অবলা অপেক্ষা পুরুষ স্বভাবতঃ সবল এপ্রযুক্ত বহু ক্ষণ পশ্চাৎ২ দ্রুত গমন করিতে পারেন নাই। কিয়ৎ ক্ষণ পরে নায়ক অদৃশ্য হওয়াতে বিরহে ব্যাকুলা হইয়া একাকিনী ইতস্ততো ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। শেষে লাইসেন্দর যে কাননে আপন প্রিয়তমা সহিত নিদ্রায় নিশা যাপন করিতেছিলেন হঠাৎ সে স্থানে গিয়া উপস্থিত হওয়াতে পূর্ব্ব পরিচিত দেখিয়া চিনিতে পারিলেন এবং তাঁহার অবস্থায় করুণান্বিত হইয়া বিস্ময় প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন এ কি এখানে লাইসেন্দর যে ভূমিশয্যায় শয়ান, ইহাঁর কি প্রাণ বিয়োগ হইয়াছে? অথবা নিদ্রাভিভাবে পড়িয়া আছেন? তদনন্তর ধীরে২ স্বীয় করশাখা দ্বারা তদীয় অধর ধারণ পুরঃসর কহিলেন হে যুবা যদি জীবিত থাক নিদ্রা পরিত্যাগ পূর্ব্বক সচেতন হও। লাইসেন্দর কামিনীর করস্পর্শে বিনিদ্র হইলেন এবং নয়ন দ্বয় উন্মীলন করত আদৌ তাঁহার বদন অবলোকিত করাতে প্রণয় পাশে পড়িলেন। নেত্রগত মোহনীয় কুসুম রসের প্রভাবে একে বারে বশম্বদ হইয়া প্রণয়লাপ নিমিত্ত বাহুল্য রূপে তদীয় রূপ লাবণ্যের বর্ণনা করত কহিলেন অয়ি এণনয়না হেলেনা বায়সাপেক্ষা পারাবত যদ্রূপ অধিক সুরূপ, হারমিয়া অপেক্ষা তুমিও তদ্রূপ রূপে গুণে সহস্রগুণে শ্রেষ্ঠ। তোমার নিমিত্ত আমার অন্তঃকরণ মোহিত হইয়াছে তোমাকে প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত সর্ব্বপ্রকার কষ্ট স্বীকারে প্রস্তুত আছি। এবম্বিধ বিবিধ চাটুবচনে আনতি উৎপাদনের চেষ্টা করিতে লাগিলেন। হেলেনা আপনার প্রণয় ভাজন পরম প্রিয়তম হারমিয়ার প্রতি তাঁহার আসক্তি অবগতা ছিলেন যুবা তাঁহার পাণি গ্রহণ নিমিত্ত যে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন তাহাও তাঁহার অবিদিত ছিল না। অতএব এক্ষণে লাইসেন্দরের ঐ সমস্ত প্রেমের কথা শ্রবণে সন্তুষ্ট না হইয়া বরং বিরক্ত হইলেন অধিকন্তু তাঁহার আশঙ্কা হইল যুবা বুঝি তাঁহার সহিত ব্যঙ্গ করিতেছেন অতএব পরিতাপ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন হাঃ কপাল, লোকের অবজ্ঞা ও ঘৃণার ভাজন হইবার নিমিত্ত কি জন্মিয়া ছিলাম? ওহে তরুণ, আমার প্রেমাস্পদ দেমিত্রিয়স কদাপি আমাকে সপ্রণয় নয়নে অবলোকন করেন নাই কখন একটী মিষ্ট কথাও কহেন নাই, তন্নিমিত্ত সদা মনোদুঃখে কাল হরণ করিতেছি তুমি আবার ঈদৃশ ব্যঙ্গ বচনে ঘৃণা প্রকাশ করিয়া মৃত শরীরে খড়্‌গাঘাত কেন কর? ওহে আমি তোমাকে তদপেক্ষা সৎ ও সুশীল জ্ঞান করিতাম তাহার কি এই ফল? এতাবদুক্তি করিয়া কোপভরে সে স্থান হইতে প্রস্থান করিলেন। লাইসেন্দর কুহক বশতঃ প্রেম বাগুরায় পড়িয়াছেন প্রকৃত বচনও প্রণয়ের্ষার কথা বোধ করিতে লাগিলেন কামিনী পরাঙ্মুখী হইয়া গমন করিলে সহচরী হারমিয়াকে নিদ্রিতাবস্থায় অরণ্য মধ্যে পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহার পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন।

 অনন্তর হারমিয়ার নিদ্রাভঙ্গ হইল। নির্মনুষ্য অরণ্য মধ্যে আপনাকে একাকিনী দেখিয়া ব্যাকুলা হইলেন। প্রিয়তম লাইসেন্দর নিদ্রাবস্থায় পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গেলেন কাতর হইয়া বনের চতুর্দ্দিকে অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। কুত্রাপি দর্শন পাইলেন না এবং কোথায় গেলে উদ্দেশ হইবে তাহাও স্থির করিতে পারিলেন না। এ দিকে দেমিত্রিয়স্ হারমিয়ার সহিত লাইসেন্দরের পলায়ন সংবাদ শ্রবণাবধি সর্ব্বত্র তাঁহাদের অনুসন্ধান করিতেছিলেন কোন স্থানে দেখিতে পান নাই, অনর্থক পর্য্যটনে শ্রান্ত ও নৈরাশ্যে খিন্ন হইয়া বিপিনের এক প্রান্তে তরুমূলে শয়ন করিলেন ক্রমে নিদ্রাকর্ষণে অচেতন হইয়াছেন এতদবসরে পরীরাজ অবিরণ তাঁহাকে দেখিতে পাইলেন। রাজা মন্ত্রিকে প্রেম কুসুমের বিষয়ে প্রশ্ন করাতে অবগত হইয়াছিলেন ভ্রমবশতঃ অন্য পুরুষের নয়নে তাহা প্রদত্ত হইয়াছে। অতএব যে মনুষ্যকে মুগ্ধ করিবার মানস করেন এক্ষণে তাঁহাকে সম্মুখে প্রাপ্ত হওয়াতে তাঁহার লোচনে সেই কুসুম রস তৎক্ষণাৎ নিক্ষেপ করিলেন। হেলেনা লাইসেন্দরকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক ভ্রমণ করিতে২ দৈবাৎ ঐ সময়ে তথায় আসিয়া উপস্থিত হওয়াতে দেমিত্রিয়স্ নিদ্রাভঙ্গে নয়নোন্মীলনানন্তর তাঁহাকে অবলোকন করিলেন সুতরাং ইনিও এক্ষণে লাইসেন্দরের ন্যায় প্রেমাসক্ত হইয়া তরুণীর প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত বিবিধ চাটূক্তি করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে লাইসেন্দর এবং তৎপশ্চাৎ হারমিয়া সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন কিন্তু হারমিয়ার প্রতি এক্ষণে কোন নায়কের স্নেহ নাই যেহেতু পরীরাজের অমাত্যের ভ্রম বশতঃ তাঁহার মনোনীত নায়ক হেলেনার সহিত প্রণয়োৎপাদন নিমিত্ত মুগ্ধ হইয়াছেন, আর পরীরাজের বাসনায় দেমিত্রিয়সও হেলেনার নিমিত্ত সাতিশয় ব্যাকুল। দুই নায়ক অধুনা হেলেনার সহিত প্রণয়ালাপ করিতে লাগিলেন কেননা উভয়েই অপূর্ব্ব প্রণয় কুসুম রস প্রভাবে তদাসক্ত হইয়াছিলেন।

 হেলেনা দেখিলেন দুই নায়ক আমার প্রতি প্রেম প্রকাশ করিতেছেন পরম প্রিয়সখী হারমিয়া মৌনাবলম্বন পূর্ব্বক দণ্ডায়মান হইয়া কৌতুক দেখিতেছেন অতএব কিয়ৎ ক্ষণ বিস্ময়াপন্ন হইয়া থাকিয়া মনে করিলেন তিন জনে পরামর্শ করিয়া আমার প্রতি শ্লেষোক্তি করিতে আসিয়াছেন।

 হারমিয়াও হেলেনার ন্যায় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন যেহেতু তাঁহার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল লাইসেন্দর ও দেমিত্রিয়স্ উভয়ে তাঁহারই প্রেমাসক্ত, কিন্তু এক্ষণে দুই জনকে হেলেনার প্রতি সাতিশয় ব্যগ্রতা সহকারে প্রণয় প্রকাশ করিতে দেখিলেন। ফলতঃ তাঁহারা পূর্ব্বে হারমিয়ারই রূপ লাবণ্যের ভূরি২ প্রশংসা করিয়াছিলেন এবং হারমিয়াও তাহাতে কোন প্রকার শ্লেষ জ্ঞান করেন নাই এক্ষণে হঠাৎ উভয়ের এবম্প্রকার প্রীতির পরিবর্ত্তন হওয়াতে চমৎকৃত হইবেন বিচিত্র কি?

 হারমিয়া ও হেলেনার পরস্পর পরম সৌহৃদ্য ছিল কিন্তু এই ঘটনায় এক্ষণে বিজাতীয় বিদ্বেষ জন্মিল, উভয়ে উভয়ের প্রতি গ্লানি ও কটূক্তি করিতে আরম্ভ করিলেন।

 হেলেনা সকোপ বচনে কহিতে লাগিলেন প্রিয়সখি হারমিয়া তুমি কি একেবারে এত নির্দয় হইলে? উপহাস জনক প্রশংসা দ্বারা আমার অপমান করিতে লাইসেন্দরকে এবম্প্রকারে প্রবৃত্ত কর? তোমার প্রেমাস্পদ দেমিত্রিয়স নিরন্তর আমাকে ঘৃণা করিয়াছেন এক্ষণে ঈশ্বরী, অপ্‌সরা, কিন্নরী, দেবকন্যা, অমূল্য রত্ন, বলিয়া সম্বোধন করিলেন এ উপহাস কি তোমার মন্ত্রণা ব্যতীত সম্ভবে? তোমার ষড়যন্ত্র না থাকিলে আমার চির নিন্দক অকস্মাৎ কখন এরূপ প্রশংসা করিত না। যাহা হউক, আমি তোমাকে পরম সুহৃদ্ বলিয়া জানিতাম আমাকে দুঃখিনী দেখিয়া পুরুষের সহিত সম্মিলন পূর্ব্বক এ প্রকার অপমান করা উচিত হয় না। হারমিয়া তুমি কি বাল্যাবস্থায় পাঠশালার সৌহৃদ্য একেবারে বিস্মৃত হইয়াছ? মনে পড়ে না, দুই জনে একাসনে উপবেশ পর্ব্বক এক গীতের আলাপ করিতে২ বসনের উপর সূচি দ্বারা এক কুসুম নির্ম্মাণ করিতাম? উভয়ে সর্ব্বদা একত্র ভোজন শয়ন করিয়া এতদ্রূপ অভিন্ন ভাবে বর্দ্ধিত হইয়াছি যে কেহ হঠাৎ বুঝিতে পারে নাই আমরা পৃথক্ ব্যক্তি। এক্ষণে পুরুষের সহিত মিলিয়া হতভাগ্যা দেখিয়া সেই বয়স্যার প্রতি পরিহাস করিতেছ এ কি সৌহৃদ্য ধর্ম্ম?

 হারমিয়া এ সমস্ত বাক্য শ্রবণে বিস্ময় প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন হেলেনা তোমার কোপান্বিত কথায় আমার চমৎকার বোধ হইতেছে আমি তোমাকে ঘৃণা করি নাই বরং তুমি আমাকে অবজ্ঞা করিতেছ। ইহাতে হেলেনা সবিষাদ বচনে বলিলেন উপহাস করিয়া গম্ভীর আকৃতি ধারণ কর এ যে বিচিত্র ব্যাপার দেখি। আমি স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিলাম যখন বিমুখ হইলাম মুখভঙ্গি পূর্ব্বক পরস্পর নয়নেঙ্গিত দ্বারা ব্যঙ্গ করিলে, স্নেহ অথবা শীলতা থাকিলে কদাপি এবম্প্রকার ব্যবহার করিতে না।

 এ দিকে হেলেনা ও হারমিয়া উক্ত প্রকার বাক্য দ্বারা পরস্পরের ক্রোধানল প্রজ্বলিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ও দিকে দেমিত্রিয়স ও লাইসেন্দর উভয়ে একতরের পরাজয় পূর্ব্বক হেলেনা লাভার্থ পরস্পর সংগ্রাম করিতে রণ ক্ষেত্রে গেলেন।

 কামিনী দ্বয় কলহে নিমগ্ন থাকাতে তাঁহারা কখন গেলেন জানিতে পারেন নাই কিয়ৎক্ষণ পরে বিবাদে শ্রান্ত হইয়া দেখিলেন স্ব২ নায়ক নিকটে নাই অতএব পৃথক্ হইয়া আপন২ প্রিয়তমের অন্বেষণ নিমিত্ত অরণ্যের চতুর্দিকে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

 পরীরাজ এবং তদীয় মন্ত্রী তরুণী দ্বয়ের কলহ সমুদায় শ্রবণ করিয়াছিলেন। দুই জনে আপন২ নায়কের অনুসন্ধানার্থ গমন করিলে অমাত্যকে কহিলেন মন্ত্রিন তোমার অসাবধানতা হেতু কি এই উৎপাত ঘটিয়াছে কিম্বা তুমি স্বেচ্ছাপূর্ব্বক সেই কর্ম্ম করিয়াছিলে? মন্ত্রী নিবেদন করিল মহারাজ আমার ভ্রমবশতঃ সে ব্যাপার ঘটে। স্মরণ করিয়া দেখুন না, আমাকে কহিয়াছিলেন এথেন্স দেশীয় পরিচ্ছদ ধারির নয়নে কুসুম রস নিক্ষেপ করিও। কিন্তু হে পরীরাজ আমার ভ্রমবশতঃ যাহা ঘটিয়াছে তাহাতে দুঃখ বোধ হইতেছে না, দেখুন দেখি তাহাদের কলহে কেমন প্রমোদকর কৌতুক হইতেছে। পরীরাজ কহিলেন উৎপাতও ঘটিয়াছে। দেমিত্রিয়স ও লাইসেন্দর পরস্পরের পরাভব কারণ রণ ক্ষেত্রে সংগ্রাম করিতে গিয়াছেন অতএব এক্ষণে এক কর্ম্ম কর, এই রজনীকে ঘোরতর কুজ্‌ঝটিকায় আবৃত করণের চেষ্টা দেখ, রাত্রি নিবিড়ান্ধকারাচ্ছন্না হইলে বিরোধি যুবক দ্বয়ের দিক্ ভ্রম হইবেক, পরস্পরকে দেখিতে পাইবেন না। তুমি তাঁহাদের স্বরে কটুবাক্য প্রয়োগ পুরঃসর পরস্পরের অপমান করিও তাহা হইলে বৈরির বাক্যজ্ঞানে ক্রুদ্ধ হইয়া রোষবশতঃ শব্দানুসারে অন্যোন্যের অনুগমন করিবেন। যাবৎ চলিয়া২ শ্রান্ত না হন তাবৎ পর্য্যন্ত ক্রমাগত ঐ রূপ করিবে। পরে যখন দেখিবে দুই জনে ক্লান্ত হইয়া কোন স্থানে শয়ন পূর্ব্বক নিদ্রা গেলেন তখন লাইসেন্দরের নয়নে এই পুষ্পের রস প্রদান করিও তাহাতে তিনি নিদ্রা ভঙ্গের পর হেলেনার প্রণয় বিস্মরণ করিয়া হারমিয়ার পুরাতন প্রেমে আসক্ত হইবেন ইহা হইলেই এই দুই দুঃখিনী কামিনী স্ব২ নায়ক সহ সঙ্গতা হইয়া এ দুঃখের শেষ করত শেষে মহা সুখে কাল যাপন করিতে পারিবেন এবং এই সকল উৎপাত পরে তাঁহাদিগের স্বপ্নবৎ প্রতীয়মান হইবেক। অতএব মন্ত্রিবর সত্বর গমন পূর্ব্বক এই কার্য্যটী সমাধা করিয়া আইস। আমিও রাণী তিতেনিয়া সন্নিধানে প্রস্থান করিয়া দেখি তিনি কোন্ ব্যক্তিকে প্রণয় ভাজন পাইলেন।

 তিতেনিয়া এ পর্যন্ত স্বাপাবেশে ছিলেন। পরীরাজ অবিরণ নিকটে গিয়া অবলোকন করিলেন রাণীর নিকুঞ্জঃ সন্নিধানে অধ্বশ্রান্ত একটা মূঢ় পুরুষ শয়ন করিয়া রহিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া কহিলেন এই ব্যক্তিকে মদীয় গর্ব্বিণী বনিতার নায়ক করা যাউক। অনন্তর রাজা ঐ নিদ্রিত মূঢ়ের মস্তকোপরি একটা গর্দ্দভের মুণ্ড সংযোগ করিলেন। সেই মস্তক এতাদৃশ উপযুক্ত রূপে স্কন্ধ সংলগ্ন হইল যে স্পষ্ট বোধ হইতে লাগিল যেন স্কন্ধের উপর জন্মিয়াছে। যাহা হউক, যদিও পরীরাজ তাহা অতি ধীরে২ বসাইলেন তথাপি স্পর্শ মাত্রে সে ব্যক্তি জাগ্রৎ হইয়া গাত্রোত্থান করিল। কিন্তু পরীরাজ তাহার মুণ্ড কিরূপ করিয়াছেন বোধগম্য করিতে পারিল না, নিকুঞ্জের যে স্থলে রাজ মহিষী শয়ন করিয়াছিলেন তথায় গমন করিল।

 রাণীর নিদ্রাভঙ্গে নয়নোন্মীলন হইবামাত্র তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত হইল সুতরাং কুসুম রসের গুণ তৎক্ষণাৎ কার্য্য কারক হইল। রাজ্ঞী শয্যা হইতে গাত্রোত্থানানন্তর কহিতে লাগিলেন আহা মরি কি সুন্দর পরম সুশ্রী সুশোভন পুরুষ দর্শন করিলাম। ওহে চিত্ত হারক মনোমোহন তোমার যেমন রূপ লাবণ্য তেমনি কি বাক্যের লালিত্য, কতই পাণ্ডিত্য শিখিয়াছ।

 মূঢ় পুরুষ রাণীর এ সকল বাণীর তাৎপর্য্য বুঝিতে পারিল না এতাবন্মাত্র কহিল ওহে যুবতি যদিস্যাৎ এ বল হইতে বহির্গত হইবার পথ প্রাপ্ত হই তাহা হইলে কৃতার্থতা বোধ করি।

 পরীরাজ বনিতা কুহক বশতঃ প্রেমাসক্তা হইয়াছেন তাহার এই কথা শুনিয়া কহিলেন প্রাণনাথ অরণ্য হইতে নিষ্ক্রমণের বাসনা বিসর্জ্জন কর। আমি সামান্যা দেবযোনি নহি, তোমার প্রতি অনুরাগিণী হইয়াছি, কোথায় যাইবে? এখানে বসিয়া আমার সঙ্গে প্রেমালাপ কর তোমার সেবা নিমিত্ত দাস নিযুক্ত করিয়া দিব।

 অনন্তর রাণী চারি জন কিঙ্করকে আহ্বান করিলেন তাহাদের নাম পিস্‌বোসম, কবওএব, মথ, এবং মস্তার্দসিদ।

 ভূতেরা আসিয়া, সম্মুখীন হইলে রাজ্ঞী তাহাদিগকে আজ্ঞা করিলেন তোমরা এই সুন্দর পুরষের সেবায় নিযুক্ত হও সর্ব্বদা ইহাঁর সম্মুখে থাকিবে। ইনি যখন শয়ন করিবেন পদসেবা করিও। অপর ইহাঁর সম্মুখে নৃত্য করিয়া আমোদ করিও। আহার নিমিত্ত দ্রাক্ষাদি উত্তমোত্তম সুস্বাদু ফল আনিয়া দিও। যদি ইহাঁর মধু পানে ইচ্ছা হয় মধু মক্ষিকার নিকট হইতে মধুভাণ্ড আহরণ করিও। ভৃত্যদিগকে এই রূপ উপদেশ করিয়া পরে নায়কের প্রতি কহিলেন হে রূপনিধান, তোমার রাসভ মুণ্ড কি মনোহর, তুমি আমার পার্শ্বে আসিয়া উপবেশন কর, আমি তোমার লোমশ গণ্ডস্থলে হস্তার্পণ করিয়া ক্রীড়া করি। হে প্রমোদবর্দ্ধক, নিকটে আইস, তোমার সুশোভন দীর্ঘ শ্রবণ দ্বয় চুম্বন করি।

 কিন্তু গদ্দর্ভ মুণ্ড ধারী মূঢ় পরীরাজ্ঞীর এ সমস্ত প্রণয় বচনে মনোযোগ করিল না, সে আজ্ঞাবহ দাস চতুষ্টয় প্রাপ্ত হওয়াতে অভিমানী হইয়া একজন কিঙ্করকে আহ্বান করিল। অরে পিস্‌ব্লোসম কোথায়?

 পিসব্লোসম কহিল, এই যে আমি উপস্থিত আছি।

 গর্দ্দভমুণ্ড মূঢ় তাহাকে আজ্ঞা করিল আমার মস্তক কণ্ডূয়ন কর। কবওএব কোথায়?

 কব্‌ওএব নিকটে গিয়া কহিল মহাশয় এই আমি সম্মুখে দণ্ডায়মান, আজ্ঞা করুন। মূঢ় তাহাকে বলিল ওহে কবওএব ঐ দিকে কণ্টকময় গুল্মের উপর একটা লোহিত বর্ণ মক্ষিকা বসিয়া আছে তাহাকে বিনষ্ট করিয়া মধুচক্র আমার সন্নিধানে আনয়ন কর। এই ব্যাপার সাধনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করিও না, সাবধানে উপদিষ্ট কর্ম্ম করিও, মধুভাণ্ড যেন ভগ্ন না হয়, মধুভাণ্ড ভাঙ্গিলে তদ্বারা তোমার সর্ব্ব শরীর প্লাবিত হইয়া যাইবে। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে মস্তার্দসিদ কোথা গিয়াছে?

 মস্তার্দসিদ আপনার নামোল্লেখমাত্রে সম্মুখে গিয়া নিবেদন করিল মহাশয় দাস উপস্থিত, আদেশদ্বারা প্রসাদ করিতে আজ্ঞা হয়।

 মূঢ় কহিল তোমাকে এতাবন্মাত্র আজ্ঞা করি পিসব্লোসম আমার শিরঃ কণ্ডূয়ন করিতেছে ইহার সাহায্য কর। আমি একবার নাপিতালয়ে গমন করিব কেননা বোধ হইতেছে আস্যদেশে শ্মশ্রুগুলা সাতিশয় বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়াছে।

 অনন্তর পরীরাজ মহিষী মূঢ়কে কহিলেন ওহে মনোমোহন কি ভোজন করিতে ইচ্ছা হয়? আমার এক জন সাহসী দাস আছে তোমার নিমিত্ত বৃক্ষ মার্জ্জারের সঞ্চিত ভাণ্ডার হইতে উত্তমোত্তম ফল আনয়ন করিতে তাহাকে পাঠাইয়াছি।

 মূঢ় রাসভাস্য ধারণ করাতে খরের খাদ্যে সস্পৃহ হইয়া কহিল উত্তম ফলে কি প্রয়োজন? আমাকে একমুষ্টি শুষ্ক মটর দান করিও। কিন্তু এক্ষণে কিছুতেই কার্য্য নাই তোমাদিগকে বিনতি করি এখন আমাকে উত্ত্যক্ত করিও না। আমার নিদ্রাকর্ষণ হইতেছে।

 রাণী সপ্রণয় বচনে কহিলেন তবে তুমি নিদ্রা যাও আমি আপন বাহুলতা দ্বারা তোমাকে গাঢ় আলিঙ্গন করি। ওহে আমি তোমাকে অন্তঃকরণ সহিত ভাল বাসি, তুমি যে প্রকারে আমার চিত্তরঞ্জন করিতেছ বাক্য দ্বারা বর্ণনা করিয়া ব্যক্ত করা অসাধ্য।

 অনন্তর গর্দ্দভমুণ্ড মূঢ় রাণীর ক্রোড়ে শয়ন করিয়া নিদ্রাভিভূত হইলে পরীরাজ মহিষীর সম্মুখে প্রকাশমান হইয়া রাসভের প্রতি প্রণয় নিবন্ধন নিমিত্ত তাঁহাকে যৎপরোনাস্তি ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন।

 রাণী এ বিষয় গোপন করিতে পারিলেন না কেননা সেই মূঢ়ের গর্দ্দভমুণ্ডে কুসুমের মুকুট প্রদান পূর্ব্বক তাহা আপনার ক্রোড়ে অর্পিত করিয়া রাখিয়াছিলেন রাজা স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিলেন।

 পরীরাজ নানাপ্রকার তিরস্কার করিয়া শেষে কোপভরে তাঁহার সেই বালকটি যাচ্‌ঞা করিলেন। রাণীর অভিনব প্রণয়াস্পদ নায়ক স্বামির নিকট প্রকাশ পাইল ইহাতে সাতিশয় লজ্জিতা ও ভীতা হইলেন অতএব এক্ষণে আর বালকার্পণে অস্বীকার করিতে সাহস হইল না।

 অবিরণ বহুকালাবধি বাসনা করিতেন সেই ক্ষুদ্র বালকটীকে লইয়া আপনার দাস করিবেন এত কাল বনিতার নিকট হইতে লইতে পারেন নাই এক্ষণে কৌশলে মনোভীষ্ট সিদ্ধ হইলে আপনার প্রেয়সী মহিষীর লজ্জা ও ভয় দেখিয়া তৎপ্রতি সদয় হইলেন অতএব রাজ্ঞীর নয়নে অন্য কুসুমের রস নিক্ষেপ পূর্ব্বক তাঁহার মোহ দূর করিলেন। রাণী মোহান্তে আপনার নূতন প্রণয়ের বিষয় স্মরণ করত বিস্ময়াবিষ্টা হইলেন এবং রাসভাস্য মূঢকে দেখিয়া কহিলেন এ টা কে, ঘৃণিত রাক্ষস।

 অনন্তর পরীরাজ সে মূঢ়ের গর্দ্দভমুণ্ড তুলিয়া লইলেন তাহাতে সে স্বীয় স্কন্ধে আপনার নির্বোধের মুণ্ড ধারণ পুরঃসর নিদ্রা যাইতে লাগিল।

 অবিরণ আপনার মহিষীর সঙ্গে সম্মিলন হইলে তাঁহার নিকট উল্লেখিত নায়ক নায়িকাদের সমুদায় বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন এবং শেষে কি হইয়াছে দেখিবার নিমিত্ত রাণীকে সমভিব্যাহারে লইয়া তাঁহাদের সন্নিধানে গমন করিলেন।

 রাজা মহিষীর সহিত একত্র হইয়া প্রস্থান পূর্ব্বক কিয়দ্দূরে নিরীক্ষণ করিলেন সেই দুই নায়ক এবং তাঁহাদের নায়িকা দ্বয় পরস্পরের অদুরে ভূমি শয্যায় শয়ান রহিয়াছে। পক মন্ত্রী স্বীয় ভ্রান্তি শোধন নিমিত্ত বহু পরিশ্রমে তাহাদের অজ্ঞাত সারে সকলকে এক স্থানে উপনীত করিয়া নির্দেশানুসারে রাজদত্ত ওষধি রসে লাইসেন্দরের নয়ন হইতে মোহ বিমোচন করিয়াছে।

 অনন্তর হারমিয়ার নিদ্রাভঙ্গ হইল। নেত্রদ্বয় উন্মীলন পূর্ব্বক অবলোকন করিলেন নিকটে লাইসেন্দর শয়ান। তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া সাশ্চর্য্যচিত্তে কহিতে লাগিলেন এ কি লাইসেন্দর যে, যাহা হউক, ইহাঁর চরিত্র অতি চমৎকার। পরে লাইসেন্দর জাগ্রৎ হইয়া নয়ন দ্বয় বিনিদ্র করত তাঁহার প্রতি দৃষ্টি করিলেন তাহাতে মোহন গুণ রূপ ঘন তিমির বিধ্বংস করিয়া জ্ঞান শশাঙ্ক উদিত হইল এবং হৃদয়ে যুবতীর নিমিত্ত যে প্রেমাঙ্কুর জন্মে পুনর্ব্বার লতা পল্লবান্বিত হইয়া পরিপুষ্ট হইল। উভয়ে একত্র উপবেশন পূর্ব্বক প্রণয়ালাপ ও রাত্রির ঘটনা বিষয়ে কথোপকথন করিতে লাগিলেন দুইজনেরই সংশয় হইল যে সমস্ত ব্যাপার ঘটিল তাহা স্বপ্ন কি না।

 তদনন্তর দেমিত্রিয়স ও হেলেনার নিদ্রাভঙ্গ হইল। এই তরুণীর স্বীয় নায়ক প্রতি যে ক্রোধ ও বৈরক্তি জন্মে সুখসুপ্তির প্রভাবে তাহার শান্তি হইয়াছিল। সুপ্তোত্থিতা হইয়া সুস্থির চিত্তে আহ্লাদ পূর্ব্বক নায়কের সপ্রণয় বচন শ্রবণে অবহিতা হইলেন। অধুনা বিভাবরীভাগে ঘটনার বিষয় স্বপ্নবৎ প্রকাশমান হইল তদুপলক্ষে কথোপকথন করিয়া উভয়ে নানা কৌতুক ও আমোদ করিতে লাগিলেন।

 যুবতী দ্বয়ের স্ব২ মনোভীষ্ট নায়ক সহ এই রূপে পুনর্বার সম্মিলন হইলে পরস্পরের মনোমালিন্য দুরীভূত হইল অগ্রে যাদৃক্ সৌহৃদ্য ছিল পুনশ্চ তাহার আবির্ভাব হইতে লাগিল। উভয়ে পরস্পর কটূক্তি ও গ্লানি করণ নিমিত্ত ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। তদনন্তর দুইজনে পরামর্শ করিতে বসিলেন এক্ষণে আমাদের কি করা উচিত? বিবেচনা করিয়া দেখিলেন দেমিত্রিয়স্ এক্ষণে আর হারমিয়ার প্রেমাকাঙ্ক্ষী নহেন অতএব যুক্তি পূর্ব্বক এই স্থির করিলেন দেমিত্রিয়স তাঁহার পিতার নিকট গমন পূর্ব্বক তাঁহাকে সানুনয় বচনে জ্ঞাপন করুন আপনার কন্যাকে বিবাহ করণের মত পরিবর্ত্তন করিয়াছি অতএব তাঁহার প্রাণদণ্ডে ক্ষান্ত হউন। দেমিত্রিয়স তাঁহাদের পরামর্শ ক্রমে এথেন্স নগরে যাত্রা করিবেন ইতিমধ্যে দেখিতে পাইলেন হারমিয়ার পিতা ইজিয়স পলায়িতা দুহিতার তত্ত্বে কাননমধ্যে তাঁহাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত।

 ইজিয়স্ যখন শ্রবণ করিলেন দেমিত্রিয়স কন্যাকে গ্রহণ করিবেন না দুহিতা তদীয় মনোনীত পাত্রের সহিত পরিণয়ে সম্মাতা হইয়াছেন তখন তনয়ার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া তাহাতে সম্মতি দিলেন অতএব রাজাজ্ঞা ক্রমে যে দিবস হারমিয়ার প্রাণ দণ্ড অবধারিত হইয়াছিল সেই দিনে তাঁহার শুভবিবাহ সম্পাদন স্থিরীকৃত হইল। হেলেনাও সেই বাসরে স্বীয় প্রিয় নায়ক দেমিত্রিয়সকে পরিণয় করিতে সম্মতা হইলেন।

 উল্লেখিত নায়ক নায়িকা দিগের এই রূপে পুনর্ব্বার সম্প্রীতি কেবল পরীরাজ অবিরণের অনুকম্পায় সম্পাদিত হইল। রাজা স্বীয় মহিষী সহিত অলক্ষ্য রূপে তাঁহাদের এই সমস্ত কথোপকথন শ্রবণ করিয়া পরম প্রমুদিত হইলেন এবং আপনার রাজ্যমধ্যে তাঁহাদের পরিণয়োপলক্ষে সাতিশয় সমারোহ পূর্ব্বক উৎসব করিতে আজ্ঞা করিলেন।

 পরীজাতি এক প্রকার ভূতযোনি, তাহাদের উপন্যাস ও ক্রীড়া কৌতুক অলীক বোধে বিশ্বাস্য হইতে পারে না বটে কিন্তু উপস্থিত বৃত্তান্ত পাঠে এতাদৃশ অনুমান করা উচিত যে নিদ্রাবস্থার ঘটনা কিছুই অসম্ভব নহে, নিদাঘ নিশীথের নির্দোষ স্বপ্ন অসন্তোষকর না হইয়া বরং চিত্তের প্রমোদ জনক হইয়া থাকে অতএব এতৎপাঠে পাঠক বর্গের বৈরক্তির সম্ভাবনা বিরহ ইতি।