সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/পেরিক্লিসের উপাখ্যান


R. D. SORNOKAR, ENGR
৩৭১

পেরিক্লিস্‌।

পেরিক্লিসের উপাখ্যান।


 টায়র নগরে পেরিক্লিস্ নামা এক নরপতি ছিলেন। একদা গ্রীশ দেশীয় সম্রাট্‌ দুরাচার কোপন স্বভাব আন্তিওকসের কোন রহস্য বিষয় প্রকাশ করিয়া অপরাধী হন। তাহাতে সম্রাট্ স্বভাব দোষে রোষ পরবশ হইয়া সমুচিত শাসন নিমিত্ত তাঁহার সর্ব্বনাশ করিতে প্রতিজ্ঞা করিলেন। পরাক্রান্ত লোকের দোষালোচনায় প্রায় অনিষ্ট ঘটিয়া থাকে। পেরিক্লিস্ ঐ বিষয়ের সংবাদ প্রাপ্তি মাত্রে সমাটের প্রবল প্রতাপে ভীত হইয়া স্বয়ং রাজ্যভোগ পরিত্যাগ পূর্ব্বক যাবৎ তাঁহার ক্রোধ শান্তি না হয় তাবৎ দূরবর্ত্তি দেশে অজ্ঞাত বাসের মানস করিলেন। অতএব আপনার রাজত্বের ভার কার্য্য কুশল ধর্ম্মপরায়ণ প্রভুভক্ত শচিব হেলিকেনসের হস্তে সমপর্ণ পূর্ব্বক অবিলম্বে পোতারূঢ় হইলেন।

 অর্ণব যানারোহণ সময়ে শ্রবণ করিলেন থার্সস্ নগরের লোকেরা দুর্ভিক্ষ নিমিত্ত সাতিশয় ক্লেশ সহ্য করিতেছে অতএব তাহাদের সাহায্য নিমিত্ত যথেষ্ট খাদ্য সামগ্রী সমভিব্যাহারে লইয়া প্রথমতঃ ঐ নগরের অভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়দ্দিন মধ্যে সেখানে উত্তীর্ণ হইয়া দেখিলেন তত্রত্য আপামর সাধারণ যৎপরোনান্তি কষ্ট পাইতেছে। সে দেশের অধিপতি তাঁহার আগমন সংবাদ শ্রবণে আহ্লাদিত হইয়া মনে করিলেন আমার রাজ্যের দুর্ভাগ্য দূরীভূত হইল পরমেশ্বর অত্রত্য মানব নিকরের উপর দয়া করিয়া ইহাঁকে প্রেরণ করিয়া থাকিবেন অতএব পাত্র মিত্র সমভিব্যাহারে তাঁহার অভ্যর্থনা করিতে গেলেন এবং যথেষ্ট সমাদর পূর্ব্বক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। পেরিক্লিস্ থার্সস্ নগরে অবস্থিতি করিয়া অত্যল্প কাল মধ্যে স্বীয় বিশ্বস্ত মন্ত্রির এক লিপি প্রাপ্ত হইলেন তাহাতে অমাত্য লিখিয়াছিলেন থার্সস নগরে অবস্থান তাঁহার পক্ষে শ্রেয়স্কর নহে, সম্রাট্ আন্তিওকস চর দ্বারা তাঁহার বাসস্থল নির্ণয় করত প্রাণে বিনষ্ট করিবার অভিসন্ধি করিয়াছেন। পেরিক্লিস স্বীয় মন্ত্রির এই পত্রী প্রাপ্ত হইয়া অবিলম্বে থার্সস নগর পরিত্যাগার্থ পোতারোহণ করিলেন। তাহাতে সেখানকার লোকেরা তাঁহার নিমিত্ত দুঃখিত হইয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও বিবিধ প্রকারে আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিল।

 পেরিক্লিস অর্ণবতরি আরোহণ করিয়া থার্সস হইতে কিয়দ্দূরে গমন করিয়াছেন ইতিমধ্যে দুর্দৈব বশতঃ হঠাৎ প্রবল ঝটিকা উত্থিতা হইল তাহাতে পোত ছিন্ন ভিন্ন হইয়া মগ্ন হওয়াতে সমুদায় আরোহি জলসাৎ হইয়াগেল কেবল তিনি সমুদ্রের প্রবল তরঙ্গাঘাতে বিবিধ ক্লেশ পাইয়া এক অপরিজ্ঞাত কূলে নিক্ষিপ্ত হইলেন। সাগরের ভয়ানক উর্ম্মি করণক নিতান্ত খিন্ন হইয়া কূলে বসিয়া আছেন এতদবসরে কতিপয় ধীবর নিকট দিয়া গমন করাতে তাঁহার দুরবস্থা দর্শনে দয়ার্দ্র হইল এবং তাঁহাকে আপনাদের সমভিব্যাহারে আলয়ে লইয়া গিয়া অশন বসন প্রদান করিল। পেরিক্লিস জালজীবিদের প্রমুখাৎ অবগত হইলেন ঐ দেশের নাম পেন্তাপোলিস, সেখানকার রাজা সাইমন্দিস প্রজাবাৎসল্য ও সুশীলতা পূর্ব্বক রাজ্য শাসন নিমিত্ত সাধু নামে বিখ্যাত। অপর সেই রাজার থৈসা নাম্নী পরম রূপবতী এক কন্যা আছেন আগামি দিবসে তদীয় বর্ষ বৃদ্ধির উপলক্ষে রাজসভা সন্নিধানে শস্ত্র ক্রীড়া হইবে। তৎকালে রাজকুমারীর মনোহরণ নিমিত্ত নানা দেশীয় সুকুমার রাজকুমার শৌর্য্য বীর্য্য ও রণ পাণ্ডিত্য প্রকাশ করিবেন তদর্থ অনেকের সমাগম হইয়াছে। এই সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া আপনার মনোমধ্যে যৎপরোনাস্তি বিষাদ করিতে লাগিলেন যেহেতু স্বীয় অভেদ্য বর্ম্ম সাগরের উর্ম্মিতে বিনষ্ট হওয়াতে সমরোৎসাহি রাজতনয় দিগের শ্রেণিভুক্ত হইতে পারিবেন না। পরন্তু সেই সময় এক জন ধীবর সাগর মধ্যে প্রাপ্ত একটা কবচ গ্রহণ পুরঃসর নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইল। পেরিক্লিস সেই বাণ বারণ হারাইয়াছিলেন, জালজীবির করে তাহা দেখিতে পাইয়া হর্ষ গদ্গদ স্বরে কহিতে লাগলেন হে অদৃষ্ট তোমাকে নমস্কার করি এতাবৎ দুঃখের পর অধুনা প্রতীকারের উপায় করিয়া দিলে। আমার পিতা পরলোক গমন কালে এই বর্ম্ম আমাকে প্রদান করিয়া যান এ নিমিত্ত ইহাকে পরম প্রিয় জ্ঞান করিয়া থাকি, সঙ্গে না লইয়া কুত্রাপি গমন করি না, প্রচণ্ড পবনোদ্ধূত সাগর তরঙ্গ ইহার সহিত আমার বিচ্ছেদ ঘটাইয়াছিলেন এক্ষণে করুণা হইয়া পুনর্বার প্রত্যর্পণ করিলেন অতএব সাগর চরণেও কোটি প্রণাম করি। আমি এক্ষণে পিত্র্য কবচ পুনঃ প্রাপ্ত হইলাম এখন পোত ভগ্ন ও সমুদ্রে নিমগ্ন হওয়াকে দুর্ভাগ্য বলিয়া গণনা করিব না।

 অনন্তর পরম সমাদর পুরঃসর সেই বর্ম্ম গ্রহণ করিলেন এবং পর দিবস তাহার দ্বারা শরীরাবরণ পুর্ব্বক শৌর্য্য প্রকাশ মানসে সাইমন্দিসের সভায় গমন করিলেন। রাজকুমারীর পাণিগ্রহণ নিমিত্ত ভূরি২ রণ পুঙ্গব ও বীর্য্যবান রাজকুমার তথায় উপস্থিত ছিলেন। কল্পিত সমর ক্ষেত্রে তাঁহাদের সহিত সংগ্রাম করিয়া অনুপম যুদ্ধ নৈপুণ্য ও সাতিশয় শোর্য্য বীর্য প্রকাশ পুরঃসর সকলকেই পরাস্ত করিলেন। তৎকালে রাজকন্যা দিগের পরিণয় বিষয়ে এই নিয়ম চলিত ছিল বিবাহার্থি ব্যক্তিদের মধ্যে বল বিক্রম প্রকটন পূর্ব্বক যিনি সর্ব্বজয়ী হইতেন তাঁহারই গলে বরমাল্য প্রদান হইত। সাইমন্দিস্ নৃপনন্দিনী ঐ নিয়মের অতিক্রম করিলেন না, সমাগত সমুদায় রাজতনয় দিগকে বিদায় দিয়া পেরিক্লিস্‌কে পাণিদান পূর্ব্বক তদীয় অঙ্কলক্ষ্মী হইতে প্রতিজ্ঞা করিলেন। পেরিক্লিসও রাজকুমারীর রূপ লাবণ্যে মোহিত হইয়া প্রাণ মনঃ সমপণ পূর্ব্বক সর্বান্তঃকরণে তাঁহার প্রণয় উৎপাদন করিতে চেষ্টা করিলেন।

 সর্ব্ব গুণাকর সকলবিদ্যাবিশারদ পেরিক্লিসের শৌর্য্য বীর্য্যে সাইমন্দিস্ নৃপতির বিশেষ সন্তোষ জন্মিল। পেরিক্লিস গ্রীশদেশীয় সমাটের ভয়ে আত্মগোপন পূর্ব্বক আপনাকে টায়র দেশের এক জন সাধারণ লোক বলিয়া পরিচয় দেওয়াতে সাইমন্দিস যদিও তাঁহার সম্ভ্রান্ত বংশ ও উচ্চ পদের বিষয় কিঞ্চিত্র অবগত হইতে পারিলেন না, তথাপি তদীয় গুণে মুগ্ধ হওয়াতে তাঁহাকে স্বীয় নন্দিনী সম্প্রদান করিতে কোন অংশে বিমত হইলেন না।

 পেরিক্লিস এই রূপে স্ত্রীরত্ন লাভ করিয়া অত্যল্প কাল মধ্যে সমাচার পাইলেন পরম শত্রু আন্তিওকস্ কালবশতঃ কৃতান্তের করাল দশনান্তর্গত হইয়াছে এবং টায়র দেশীয় প্রজা নিকর তাঁহার সুদীর্ঘকাল অনুপস্থিতি হেতু রাজদ্রোহী হইয়া শূন্য সিংহাসনে হেলিকেনসকে অভিষিক্ত করিবার উদ্‌যোগ করিতেছে। হেলিকেনস অতিশয় ধার্ম্মিক ও প্রভুভক্ত এ প্রযুক্ত প্রজাদের দত্ত ঐ প্রকার উচ্চ পদ গ্রহণ না করিয়া আপনি পেরিক্লিসের নিকট ঐ সংবাদ প্রেরণ পূর্ব্বক লিপিযোগে প্রার্থনা করিয়াছিলেন ত্বরায় স্বদেশে প্রত্যাগমন পুরঃসর আপনার যথার্থ স্বত্ব অধিকার করুন। পেরিক্লিস এই বার্তা প্রাপ্ত হওয়াতে এক্ষণে শ্বশুর সন্নিধানে আত্ম পরিচয় দিলেন এবং অবিলম্বে স্বদেশে যাত্রা নিমিত্ত বিদায় প্রার্থনা করিলেন। সাইমন্দিস্ যদিও অজ্ঞাত কুলশীল জামাতাকে অধুনা টায়র নগরের বিখ্যাত মহীপতি জানিয়া আহ্লাদ সাগরে মগ্ন হইলেন তথাপি জামাতা এক দেশের রাজা, স্বদেশে প্রত্যাগমন সময়ে অবশ্য সস্ত্রীক হইয়া যাইবেন, কন্যা অন্তরাপত্যা, কি রূপে সমুদ্র পথে তাহাকে প্রেরণ করিব এই ভাবনার উদয় হওয়াতে বিষাদেরও আবিভাব হইতে লাগিল। পেরিক্লিস শ্বশুরের অমত দেখিয়া সহধর্ম্মচারিণীকে কহিলেন প্রসব পর্য্যন্ত পিত্রালয়ে অবস্থিতি কর পরে লইয়া যাইব। কিন্তু তাঁহার বনিতা সঙ্গে গমনার্থ পুনঃ২ প্রার্থনা করিতে লাগিলেন সুতরাং তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইতে হইল। পরন্তু মনে আশা করিলেন প্রসব কালের পূর্ব্বে টায়র নগরে গিয়া উত্তীর্ণ হইতে পারিব।

 অর্ণব যাত্রা করিলেই দুরদৃষ্ট বশতঃ পেরিক্লিসের এক২টা দুর্ঘটনা ঘটে। পোতারোহণ পুর্ব্বক গমন করিয়া টায়র নগরে উত্তীর্ণ না হইতেই পথিমধ্যে প্রবল বাত্যা উথিতা হইল, অর্ণবতরি মহাতরঙ্গে সাতিশয় আন্দোলিত হইতে আরম্ভ হইল। থৈসা তরণীর এক কুঠরী মধ্যে ধাত্রীসহ অবস্থিতি করিতেছিলেন প্রচণ্ড সমীরণ বেগে জলধির প্রবল কল্লোল ও তদ্বারা জাহাজের উন্মজ্জন নিমজ্জন দেখিয়া ভয়ে যৎপরোনাস্তি পীড্যমানা হইলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে ধাত্রী সদ্যোজাতা একটি বালিকা ক্রোড়ে করিয়া রোদন করিতে২ পেরিক্লিসের কুঠরী মধ্যে প্রবেশ পূর্ব্বক নিবেদন করিল আপনার অন্তরাপত্যা পত্নী বাত্যার ভয়ে এই অপত্য প্রসব করিয়া প্রাণ ত্যাগ করিলেন। হে নরপুঙ্গব এই ক্ষুদ্র জীবটী আপনকার অপত্য, অবলোকন করুন। পেরিক্লিস প্রাণপ্রতিমা পত্নীর জীবন বিনাশের বার্ত্তা প্রাপ্ত হইয়া শোকে মূর্চ্ছিতা হইলেন। অনেক ক্ষণ পর্য্যন্ত সংজ্ঞা রহিল না, বহু বিলম্বে চৈতন্য ও বাক্য শক্তির উদয় হইলে বিলাপ পূর্ব্বক বলিতে লাগিলেন হাঃ বিধাতঃ প্রিয় বস্তু প্রদান করিয়া অবিলম্বে প্রত্যাহরণ কর। ধাত্রী শান্ত্বনা করত কহিল মহারাজ আপনি ধীর, কলত্র শোকে এরস্প্রকার অধীর হওয়া উচিত হয় না, ধৈর্য্যাবলম্বন করুন, মহিষী ইহলোক পরিত্যাগ করিলেন বটে এই কন্যাকে রাখিয়া গিয়াছেন ইহার বদনারবিন্দ অবলোকন করিয়া মনুষ্যত্ব করুন। পেরিক্লিস ধাত্রীর বচন শ্রবণ করিয়া নব কুমারীকে ক্রোড়ে লইলেন এবং তাহাকে সম্বোধিয়া বলিতে লাগিলেন বৎসে এতদৃক ভয়ঙ্কর কালে কখন কোন শিশুর জন্ম হয় নাই, তুমি এমন দুর্যোগ সময়ে ভূমিষ্ঠ হইলা, দেখিও তোমার জীবন যেন নম্রশীল হয়। রাজার অপত্য পৃথিবীতে জন্মিয়া কস্মিন্ কালে অসৎকৃত হয় না তুমি যেন আদরণীয়া হইতে পার, তোমার ভাগ্য যেন ভাল হয়। পঞ্চভূত একত্র হইয়া তোমার জন্ম স্থানকে সাধ্যানুসারে ভয়ানক করিয়াছে ভবিষ্যতে আর যেন ভয়ানক অবস্থায় না পড়িতে হয়। অয়ি দুর্দৈবোপহতে পৃথিবীতে পদাপর্ণ মাত্রে তোমার যে ক্ষতি হইল সমগ্র পার্থিব সুখেও তাহার পূরণ হইবেক না।

 অনন্তর বাত্যা ক্রমশঃ প্রবল হইতে লাগিল। নাবিক লোকদের ভ্রান্তিমূলক এই এক সংস্কার ছিল তরণী মধ্যে মৃত শরীর থাকিলে ঝটিকা নিবৃত্ত হয় না অতএব তাহারা মহিষীর শব পোত হইতে সলিলে নিক্ষেপ করিবার পরামর্শ দিতে পেরিক্লিসের সমীপে আগমন করিল। আদৌ এতাবন্মাত্র কহিল মহাশয় পরমেশ্বর আপনাকে রক্ষা করুন, সাহস হীন হইবেন না। পেরিক্লিস প্রতিবচন প্রদান করত কহিলেন আমার যথেষ্ট সাহস আছে, আমি ঝটিকাকে ভয় করি না, ইহাতে আমার যে ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা ছিল তাহা হইয়া গিয়াছে। কেবল এই নিরাশ্রয় শিশুটার নিমিত্ত ইচ্ছা করি ঝড় নিবৃত্ত হয়। পোতবাহিরা বলিল মহাশয় তবে রাজ্ঞীর মৃতদেহ পোত হইতে নীরে নিক্ষেপ করিতে আজ্ঞা হউক। বাত্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিশীল হইতেছে, পোত মধ্যে শব থাকিলে সামদ্রিক ঝঞ্‌ঝা বায়ু নিবৃত্ত হয় না। যাবৎ জাহাজে মৃত শরীর থাকিবে তাবৎ পর্য্যন্ত বাত্যা প্রবল থাকিবে। পেরিক্লিস যদিও বুঝিতে পারিলেন অর্ণবযানে শব থাকিলে ঝড় বাড়ে এ অমূলক ভ্রান্তি মাত্র, তথাপি অবস্থা বশতঃ নাবিকদের মতেই মত দিতে হইল। কহিলেন তোমাদের যাহা ইচ্ছা কর হতভাগ্যা রাণীর দেহ তরি হইতে অপসারিত হইলে যদি প্রচণ্ড পবন শান্ত হয়, কর। এই কথা বলিয়া প্রাণাধিক প্রিয়তমার সহিত চরম সাক্ষাৎ করিতে সেই কুঠরীমধ্যে গমন করিলেন এবং অশ্রু পূর্ণ নয়নে তদীয় কলেবর অবলোকন করত কহিতে লাগিলেন হায় তোমার কি কাল প্রসব কাল উপস্থিত হইয়াছিল, এ স্থান আলোক ও অনলে বর্জ্জিত, তদ্বারা যে কোন উপকার সম্ভাবনা ছিল তোমার ভাগ্যে তাহাও ঘটে নাই। আহা তোমার দেহের যথাবিধি সৎকার করিতেও আমার সাধ্য হইল না, বিনা সংস্কারে তোমার এই সুকোমল অঙ্গ সমুদ্রের সলিলে ফেলিয়া দিতে হইল। হাঃ বিধাতঃ, প্রিয়ার এ দেহ সমাধিস্থ হইয়া উপরি নির্ম্মিত সুশোভন স্তম্ভে সম্মানিত হইবার যোগ্য, এক্ষণে গভীর সাগর গর্ব্ভে শম্বূকাদির সহিত অবস্থিতি করিতে চলিল। তদনন্তর ধাত্রী লাইকোরিদাকে সম্বোধিয়া আদেশ করিলেন নেস্তরকে কাগজ কলম মসী গন্ধদ্রব্য এবং আমার সেই রত্ন পূর্ণ কৌটাটী আনিতে বল আর নিকান্দরকে সাটিনের বসনে কৃতাস্তরণ সিন্দুক আনয়নার্থি পাঠাও। শেষে লাইকোরিদাকে বলিলেন এই শিশুকে ধর, ইহার মস্তকে একটা ক্ষুদ্র উপাধান দিয়া এক বার শয়ন করাও, বিলম্ব করিও না, আমি প্রিয়তমার নিকট চিরকালের নিমিত্ত বিদায় লই।

 কিয়ৎক্ষণ পরে তাঁহার সন্নিধানে একটা সিন্দুক আনীত হইল এবং কাগজ কলম ইত্যাদি যাহা২ চাহিলেন তাহাও প্রস্তুত হইল অতএব প্রেয়সীর শরীর শাটিন নির্ম্মিত শবাচ্ছাদনে আচ্ছাদিত করিয়া রত্নাদি দ্বারা ভূষিত করত সিন্দুক মধ্যে স্থাপন করিলেন এবং এক পত্রীতে প্রিয়ার পরিচয় লিখিয়া এই প্রার্থনা লিপিবদ্ধ করত তন্মধ্যে রাখিয়া দিলেন যদি দৈবাৎ কেহ এই সিন্দুক প্রাপ্ত হন অনুগ্রহ করিয়া এই অবলার দেহ যেন সমাধি মধ্যে স্থাপন করেন। তৎপরে সিন্দুক বন্ধ করিয়া আপনার হস্ত দ্বারা সিন্ধুমধ্যে নিক্ষেপ করিলেন। সমনন্তর ঝটিকা ক্রমে২ নিবৃত্তা হইল এক্ষণে নারিকদিগকে কহিলেন টায়র নগর যাইতে অনেক বিলম্ব হইবে তাবৎ পর্য্যন্ত এই বালিকার প্রাণ রক্ষা সুকঠিন অতএব থার্সস নগরাভিমুখে জাহাজ লইয়া চল সেখানে শিশুটী রাখিয়া আসি, সাবধানে লালন পালন প্রাপ্ত হইবে।

 পেরিক্লিস্ যে নিশায় স্বীয় প্রেয়সীর শবাধার সাগর নীরে নিক্ষেপ করিলেন সেই রাত্রি প্রভাতা হইলে প্রত্যূযে এফিসস্ দেশীয় সেরিমন নামা একজন ভদ্র লোক একটী সুচিকিৎসক সমভিব্যাহারে জলধি কূলে ভ্রমণ করিতেছিলেন তদবসরে তাঁহার কতিপয় ভৃত্য একটা সিন্দুক লইয়া সমীপে আগমন পূর্ব্বক নিবেদন করিল সমুদ্রের ঊর্ম্মিতে এই সিন্দুক উৎক্ষিপ্ত হইয়া কূলে আসিয়া পড়িল। মহাশয় এতাদৃশ বৃহৎ তরঙ্গ কদাপি দৃষ্ট হয় নাই, কি আশ্চর্য্য, প্রকাণ্ড একটা সিন্দুক বীচিবেগে উপরে আসিয়া উঠিল। সেরিমন্ বিস্ময় প্রকাশ পুরঃসর কিঙ্করদিগকে আদেশ করিলেন এ সিন্দুক আমার আলয়ে লইয়া চল। সিন্দুক বাটীতে আনীত হইলে যখন তাহা উন্মুক্ত হইল তখন তন্মধ্যে এক পরমা সুন্দরী তরুণীর মনোহর কলেবর শয়ান দেখিয়া চমৎকৃত হইলেন। তত্রস্থ বিবিধ সুগন্ধি গন্ধদ্রব্যের সৌরভাঘ্রাণে এবং বহুমূল্য রত্নে পরিপূর্ণ কৌটা দর্শনে মনে২ অনুমান করিলেন ইনি কোন মহদ্ব্যক্তি হইবেন। অনন্তর সিন্দুকের মধ্যে চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত করাতে এক খান লিপি প্রাপ্ত হইলেন তাহা পাঠ করাতে জানিতে পারিলেন ঐ অবলা টায়র দেশীয় রাজা পেরিক্লিসের বনিতা। সেরিমন এই অদ্ভুত ঘটনায় সাতিশয় বিস্ময় প্রকাশ করিলেন। পরিশেষে পেরিক্লিসের দুর্ভাগ্যে খিন্ন হইয়া কহিতে লাগিলেন আহা পেরিক্লিস তুমি যদি জীবিত থাক তবে তোমার হৃদয় ইহার শোকে বিদীর্ণ হইতেছে সন্দেহ নাই। পরে সিন্দুক মধ্যে শয়ানা রমণীর বদনারবিন্দ মনোযোগ পূর্ব্বক অবলোকন করিতে গেলেন কিয়ৎ ক্ষণ এক দৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া বিবেচনা করিলেন ইহাঁর মুখে মৃতের চিহ্ণ প্রকাশ পায় না, অবিকৃত লাবণ্য দেখিতে পাই। অতএব তাঁহাকে গতাসু জ্ঞান না করিয়া জীবিতা বলিয়া অবধারিত করত কহিলেন ইহার বন্ধু বান্ধব ত্বরান্বিত হইয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। যাহা হউক, সত্বর শুশ্রূষা করিয়া চৈতন্য উৎপাদনের চেষ্টা দেখিতে হইল। পরে কিঙ্করদিগকে আশু ইন্ধন আনয়ন পূর্ব্বক অনল প্রজ্বলিত করিতে আদেশ করিয়া ধাতু পোষক ঔষধ গৃহ হইতে বাহির করিয়া আনিলেন এবং তাহার বদনে অর্পণ পুর্ব্বক রসনায় সংযোগ করিয়া দিলেন। চতুর্দিকে অগ্নির উত্তাপ এবং জিহ্বাযোগে ঔষধ গলাধঃকৃত হওয়াতে ক্রমে মোহাপসরণ পুরঃসর চৈতন্যোদয়ের উপক্রম হইল। এতদবলোকনে যৎকিঞ্চিৎ আশ্বাস পাইয়া বাদকদিগকে আহ্বান পূর্ব্বক ব্যাকুল চিত্তের স্থিরতা নিমিত্ত মৃদুভাবে মধুর বাদ্য ধ্বনি করিতে আদেশ করিলেন। এই আশ্চর্য ব্যাপার পরিজ্ঞানার্থ মহা জনতা হইল। সকলে সমুৎসুক চিত্তে চতুর্দিক বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। তাহাতে দয়ালু সেরিমন তাহাদিগকে সবিনয় বচনে বলিতে লাগিলেন তোমরা একবার কিঞ্চিৎ অন্তর হও, ইহাঁর গাত্রে বায়ু সংলগ্ন হউক, ইনি মরেন নাই, জীবিত আছেন, আমার অনুমান হয় চারি পাঁচ ঘটিকার অধিক কাল ইহাঁর এবম্প্রকার মোহ হয় নাই, ঐ দেখ প্রাণ বায়ুর সঞ্চার হইতেছে, বোধ হয় পুনর্জীবিতা হইলেন, কেমন নেত্রের পক্ষ্ম স্পন্দমান বোধ হইতেছে না? এখন তোমরা জনতা ভাঙ্গিয়া দাও, এই যুবতী কিঞ্চিৎ কাল পরেই সুস্থ হইয়া আপনার সমুদায় বিবরণ স্বয়ং বর্ণন করিবেন, বোধ করি তাহা আকর্ণন করিয়া আমরা নয়ন বারি ধারণ করিতে পারিব না। বস্তুতঃ তরুণীর প্রাণ বিয়োগ হয় নাই, আকস্মিক শঙ্কায় প্রসব করিয়া মোহবশতঃ সংজ্ঞা শূন্য হইয়াছিলেন। ধাত্রী তাঁহাকে প্রমীত জ্ঞান করিয়া তাঁহার স্বামি সন্নিধানে মৃত্যু সংবাদ দেয়। শোক বিহ্বলতা প্রযুক্ত তিনি বিশেষ অনুধাবন করেন নাই যথার্থ শব বোধে সাগর মধ্যে নিক্ষেপ করিয়াছিলেন। অধুনা করুণাকর সেরিমনের শুশ্রূষায় অবলার মূর্চ্ছা ভঙ্গ হইল, ক্রমে নয়নোন্মীলন পূর্ব্বক চতুর্দিকে দৃষ্টি করিয়া মৃদু স্বরে কহিলেন আমি কোথায় আসিয়াছি? আমার প্রভু পেরিক্লিস্ কোথায় গেলেন? এ আবার কোন জগৎ? সেরিমন তাঁহার এই বাক্য আকর্ণনানন্তর মৃদুস্বরে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত বর্ণন করিয়া শুনাইলেন। এবং তরুণীর দর্শন সামর্থ্য জন্মিয়াছে বোধ করিয়া কিঞ্চিৎ পরে পেরিক্লিসের লিখিত লিপি এবং রত্ন সকল তাঁহার করে সমপর্ণ করিলেন। যুবতী পত্রী নিরীক্ষণ করিয়া কহিলেন এ আমার স্বামির হস্তাক্ষর বটে কিন্তু আমি অর্ণব যানারোহণ করিয়াছিলাম এতাবত্র স্মরণ হয়, সন্তান প্রসব করিয়াছিলাম কি না দেবতা জানেন, মনে পড়ে না। এ কি? কোথায় আসিয়াছি? আর কি আমার স্বামির সহিত সাক্ষাৎ হইবে না? তোমরা আমাকে কেন বাঁচাইলে? এতদবস্থায় মৃত্যু যে শ্রেয়স্কর ছিল, যদি বাঁচিলাম যাবজ্জীবন ব্রহ্মচারিণী হই। সেরিমন্ অবলার বিলাপ শুনিয়া বলিলেন যাহা কহিতেছেন সত্য কিন্তু এক্ষণে কোন উপায় নাই যদি অভিলাষ হয় ঐ কর্ম্ম করুন, এ স্থানের কিয়দ্দূরে দিয়ানা দেবীর মন্দির আছে তথায় প্রবেশ পূর্ব্বক ব্রহ্মচর্য্য ব্রতেই কাল যাপন করুন, আপনার যদি ইচ্ছা হয় আমার একটী ভাগিনেয়ীকে নিকট থাকিয়া সেবা শুশ্রূষা করিতে বলিয়া দিব। থৈসা দেখিলেন অপরিচিত দেশে পড়িয়াছেন, সমুদ্রে জীবন নাশ হইল না, অগত্যা সেই দেবীর সদনেই জীবন যাপন করিতে সম্মত হইলেন এবং তদ্বিষয়ে সেরিমনের আনুকূল্য নিমিত্ত নানা প্রকারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিলেন। তদনন্তর সুস্থ হইয়া আদেশানুসারে মন্দিরে প্রবেশ পূর্ব্বক যাজিকাবস্থায় কাল হরণ করিতে প্রবৃত্তা হইলেন কিন্তু দৃঢ়তর পতিভক্তি থাকাতে বিরহে নিরন্তর মনোদুঃখের অতিশয্য হইতে লাগিল।

 এ দিকে পেরিক্লিস কলত্রশোকে কাতর হইয়া থার্সস নগরাভিমুখে গমন করিলেন। কন্যা সাগরের উপরি জন্মিল একারণ তাহার নাম সাগরিকা রাখিলেন। কিয়দ্দিন মধ্যে তনয়া সহ থার্সসে উত্তীর্ণ হওয়াতে তাঁহার আশা হইল অত্রত্য প্রজা পুঞ্জকে দুর্ভিক্ষ হইতে রক্ষা করিয়াছি এখানকার অধিপতি ক্লিওন ও তদীয়া মহিলা দিওনাইজা অবশ্য এই মাতৃহীন শিশুর প্রতি দয়া করিবেন। অনন্তর তাঁহাদের ভবনে গিয়া উপনীত হইলে ক্লিওন মহোপকারি মিত্রকে পুনরাগত দেখিয়া আহ্লাদিত হইলেন কিন্তু যখন তাঁহার প্রমুখৎ দুঃসহ শোকাবহ সাগরীয় ঘটনার কথা। শ্রবণ করিলেন তখন পরিতাপের পরিসীমা রহিল না। বিবিধ প্রকারে বিষাদ প্রকাশ করিয়া কহিলেন আহা যদি আপনার প্রিয়তমা মহিষীকে এখানে আনয়ন করিতেন তদীয় আকৃতি অবলোকন করিয়াও চরিতার্থ হইতাম। পেরিক্লিস উত্তর করিলেন মহাশয় দৈব অপ্রতিসমাধেয়, আমার অদৃষ্টে যাহা ছিল হইয়াছে, আমার প্রাণ সমা প্রিয়তমা সমুদ্রের গর্ব্ভে আছেন, এখন চীৎকার বা আর্ত্তরব করিলে কিছুই হইবেক না। ভবিতব্য কে খণ্ডিতে পারে, ভাবিয়া কি করিব। সংপ্রতি আপনার নিকট আমার সানুনয় নিবেদন এই মাতৃহীনা তনয়াটীকে আশ্রয় দান পুরঃসর প্রতিপালন করুন, এ কন্যা হতভাগ্য রাজার ঔরসে জন্মিয়াছে তাহাতে যদিও ভাগ্যবতী হইবে এমত সম্ভাবনা দেখি না তথাপি রাজকন্যাদের উপযুক্ত শিক্ষা লাভে যেন বঞ্চিত না হয়। তদনন্তর ক্লিওনের বনিতা দিওনাইজাকে সম্বোধন পুর্ব্বক কহিলেন আমি এই সন্ততিটী আপনকার হস্তে সমপর্ণ করিতেছি ইহার প্রতি মনোযোগ রাখিবেন যত্ন পূর্ব্বক ইহার লালন পালন করিলেই আমি সুখী হইব। দিওনাইজা বিনয় পুরঃসর নিবেদন করিলেন মহারাজ এ কি আজ্ঞা করিতেছেন আপনি আদেশ করিবেন তবে আমি আপনার কন্যার প্রতি যত্ন করিব? ইনি আমার গর্ব্ভজা দুহিতা অপেক্ষা স্নেহাস্পদ। ক্লিওনও সানুনয় বচনে বলিলেন মহারাজ আপনি আমার রাজ্যের যে উপকার করিয়াছেন অত্রত্য সামান্য লোকেও অদ্যাবধি তাহা বিস্মৃত হয় নাই। আপনকার অনুদান স্মরণ করিয়া নিরন্তর সকলে উর্দ্ধ মুখে মঙ্গল প্রার্থনা করিয়া থাকে। আপনকার তনয়ার বিষয়ে মনোযোগ করণার্থ আমাকে নিয়োগ করিতে হইবে না। যদি আমি ইহাঁর লালন পালনে অবহেলা করি আমার প্রজারাই আমাকে মনোযোগের নিমিত্ত উত্তেজনা করিবে। মহারাজ প্রজাদের কথাতেও যদি আমি ঐ বিষয়ে ত্রুটি করি যাবৎ চন্দ্র দিবাকর থাকেন দেবতারা যেন চিরদিন আমার প্রতি বৈর নির্যাতন পুরঃসর বিবিধ যন্ত্রণা দেন। পেরিক্লিস এবম্প্রকারে আশ্বাস পাইয়া তনয়াকে তাহাদের হস্তে সমপর্ণ পূর্ব্বক বিদায় হইলেন। যাত্রা কালে অঙ্গজার সেবা নিমিত্ত ধাত্রী লাইকোরিদাকে তাহার নিকট রাখিয়া গেলেন। সাগরিকা দুগ্ধপোষ্যা, জ্ঞানোদয় হয় নাই, কে পিতা জানিতে পারিলেন না কিন্তু ধাত্রী রোদন করিতে লাগিল। পেরিক্লিস তাহাকে শান্ত্বনা করত কহিলেন বৎসে ক্রন্দন করিও না, তোমার ক্ষুদ্র ঠাকুরাণীর প্রতি মনোযোগ রাখিও, যদি বাঁচিয়া থাকে ইহার অনুগ্রহে তোমার পরম সৌভাগ্য হইবেক।

 তদনন্তর স্বদেশাভিমুখে যাত্রা করিলেন এবং কিয়দ্দিন মধ্যে নির্বিঘ্নে আপনার রাজধানী টায়র নগরে উত্তীর্ণ হইয়া রাজ্যভার প্রত্যাদান পুরঃসর রাজত্ব করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। কল্পিতমরণা মহিষী থৈসা সিন্ধু কল্লোলে সিন্দুক সহিত কূলপ্রাপ্তা হইয়া এফিসস্ দেশে মনোদুঃখে কাল হরণ করিতে থাকিলেন। কন্যা সাগরিকা থার্সস নগরে পালিত হইতে লাগিল। থার্সসাধিপ ক্লিওন অতিশয় কৃতজ্ঞ ও পরম ধার্মিক এ প্রযুক্ত পেরিক্লিসের উপকার স্মরণ পূর্ব্বক তদীয় তনয়াকে বিবিধ গুণ শিক্ষা করাইতে যথেষ্ট চেষ্টা করিলেন তাহাতে সেই কন্যা চতুর্দশ বর্ষ বয়ঃক্রম কালে সর্ব্ব বিদ্যায় সুনিপুণা হইয়া উঠিলেন। নৃত্যগীতে ঈদৃশী দক্ষা হইলেন যে গান শ্রবণ এবং নৃত্য দর্শনে বোধ হইত যেন কোন বিদ্যাধরী অথবা দেবকন্যা শাপবশতঃ স্বর্গপুর চ্যুতা হইয়া মর্ত্যলোকে অবতীর্ণা হইয়াছেন। তিনি শিল্পজ্ঞান প্রকাশ নিমিত্ত সূচি দ্বারা যে সমস্ত পশু পক্ষি ফল পুষ্পের আকৃতি রচনা করিতেন তদ্দর্শনে বোধ হইত স্বভাবের অবিকল অনুকরণ করিয়াছেন। ফলতঃ সূচিদ্বারা পট্ট সূত্রযোগে যে কুসুম নির্ম্মাণ করিতেন তাহার নিকট যথার্থ সুরভি গোলাব পুষ্পও লজ্জা পাইত। তাহার বিদ্যা ও গুণের যশঃ ক্রমশঃ সর্ব্বত্র বিস্তীর্ণ হইল, সকলেই তাঁহার শিল্পাদি দেখিয়া সাশ্চর্য্য চিত্তে প্রশংসা করিতে লাগিল। এই সময়ে তিনি সর্ব সাধারণ লোকের পরম স্নেহ ভাজন হইলেন কিন্তু ক্লিওনের বনিতা দিওনাইজা স্বীয় দুহিতার তাদৃশ গুণ না থাকাতে ঈর্ষা প্রযুক্ত তাঁহার পরম রিপু হইয়া উঠিল। দিওনাইজার গর্ব্ভজা কন্যা এবং সাগরিকা উভয়ে সমান বয়স্কা এবং সমান যত্নে শিক্ষিতা হইয়াছিল কিন্তু সাগরিকা স্বীয় স্বাভাবিক বুদ্ধি প্রভাবে তদপেক্ষা অধিক গুণবতী হন। তজ্জন্য কেবল তাঁহারই সম্মান ও সুখ্যাতি হওয়াতে দিওনাইজা মনে২ বিবেচনা করিল যাবৎ সাগরিকা এ স্থান হইতে দূরীভূতা না হয় তাবৎ আমার তনয়ার যশঃ সম্ভাবনা নাই, আমার স্বামী ক্লিওন ইহাকে ভাল বাসেন তাড়াইয়া দিবার সুযোগ দেখি না অতএব কৌশল ক্রমে শমন সদনে প্রেরণের ষড়যন্ত্র করা যাউক। দিওনাইজার এই দ্বেষভাবের আবির্ভাব হইবার কিয়দ্দিন পরে সাগরিকার ধাত্রী লাইকোরিদা কাল বশতঃ লোকান্তর গমন করিল। দিওনাইজা দেখিল আপনার সংকল্প সিদ্ধির এই উপযুক্ত সময়, অতএব সাগরিকার প্রাণ সংহারার্থ লিওনাইন নামক এক ব্যক্তিকে নিযুক্ত করিল। একদা সাগরিকা ধাত্রীর নিমিত্ত রোদন করিতে ছিলেন নিষ্ঠুর দিওনাইজা সেই সময় লিওনাইনকে আদিষ্ট ব্যাপার সমাধানার্থ প্রবৃত্তি দিতে লাগিল। সে ব্যক্তি যদিও দুরাত্মা ও অধার্ম্মিক ছিল তথাপি সাগরিকার গুণ নিকর স্মরণ করিয়া সহসা তাঁহার সংহারে সাহস করিল না, রাজ্ঞীকে কহিল এই কুমারী পরম পবিত্রা। নির্দয়া দিওনাইজা এ কথায় উত্তর করিল তবে মর্ত্ত্য লোক পরিত্যাগ পূর্ব্বক সুরপুরে দেবতা সহ বাস করাই তাহার পক্ষে উচিত হয়। পরে কোপ প্রকাশ পুর্ব্বক কহিল অরে তুই আমার কথা শুনিবি, কি না, বল? ঐ দেখ, সাগরিকা ধাত্রীর নিমিত্ত ক্রন্দন করিতে২ এ দিকে আসিতেছে। লিওনাইন রাণীর ক্রোধ দর্শনে সভয় হইয়া কহিল আমি কিঙ্কর আপনকার আজ্ঞা শুনিব না? এই সংক্ষিপ্ত বচনেই গুণাকর সাগরিকার অচিরে চরম কাল উপস্থিত হইবার উপক্রম হইল। অনন্তর সাগরিকা বিবিধ পুষ্পে পরিপূর্ণ একটী পাত্র হস্তে লইয়া আগমন করিলেন এবং কুসুমগুলি ভূমির উপর বিকীর্ণ করত মৃতা ধাত্রীকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন হায় লাইকোরিদা কোথায় গেলে? আমি তোমার শ্মশান ভূমিতে প্রতিদিন এই রূপে পুষ্প বর্ষণ করিব। যাবৎ নিদাঘ কালের অবসান না হয় তাবৎ বাসন্তী কুসুম ও সুবর্ণ পুষ্পে শয্যা রচনা করিয়া দিব। হায় আমি কি দুর্ভাগ্যা, বন্ধু বান্ধব কেহ রহিল না, শুনিয়াছি অর্ণব মধ্যে প্রবল ঝটিকার সময় আমাকে প্রসব করিয়াই জননী পার্থিব লীলা সম্বরণ করেন। হে ধাত্রি তুমি কেবল আমার সহচরী ছিলে, কাল আমার কপালে প্রবল পবন স্বরূপ হইয়া তোমারও সহিত বিচ্ছেদ ঘটাইল। কুমারীর সকরুণ রোদন স্বকর্ণে আকর্ণন করিয়াও নির্দয়া দিওনাইজার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হইল না, কপটতা পূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধিয়া কহিল সাগরিকে ক্রন্দন করিতেছ কেন? আমার কন্যা কি তোমার সঙ্গে নাই? সে কোথায় গেল? লাইকোরিদা কাল বশতঃ ইহলোক ত্যাগ করিয়া গিয়াছে তাহার জন্য শোক করিলে কি হইবে? তোমার ভাবনা কি? আমি তোমার ধাত্রী স্বরূপা আছি। আহা অজস্র অস্রুপাতে বদন মলিন হইয়া গিয়াছে, রোদন করিও না, এ দিকে আইস, কুসুম গুলি আমাকে দাও, সাগর সম্বন্ধীয় সমীরণে শুষ্ক হইয়া যাইবে। যাও একবার লিওনাইনের সঙ্গে বেড়িয়া আইস। পরে পূর্ব্বোপদিষ্ট কিঙ্করকে কহিল অরে লিওনাইন এ দিকে আয়্, সাগরিকার কর ধারণ পূর্ব্বক ভ্রমণ করিয়া ইহাকে বায়ু সেবন করাইয়া আন্। সাগরিকা কহিল মা, তোমার সেবকে আমার প্রয়োজন নাই। পাপীয়সী দিওনাইজা লিওনাইনের সহিত তাঁহাকে বিরলে প্রেরণের মানস করাতে তাঁহার কথায় মনোযোগ করিল না। পুনর্ব্বার কপট স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক নিকটে ডাকিয়া কহিল আমি তোমাকে প্রাণ তুল্য ভাল বাসি এবং তোমার পিতার প্রতিও যথেষ্ট ভক্তি করিয়া থাকি প্রতি দিন প্রার্থনা করি এখানে তোমার জনকের আগমন হয়, যদি ইতিমধ্যে হঠাৎ আসিয়া উপস্থিত হন তোমার অনুপম শরীরের লাবণ্য বিবর্ণ দেখিয়া মনে করিবেন আমরা তোমার প্রতি যত্ন করি না। অতএব ধাত্রীর নিমিত্ত শোক পরিত্যাগ কর, যাও, ইহার সমভিব্যাহারে ভ্রমণ করিয়া আইস। একবার হাস্য কর দেখি, আহা তোমার শরীরের সৌন্দর্য্য সন্দর্শনে আবাল বৃদ্ধ সকলের অন্তঃকরণ হর্ষে প্রফুল হয়, এ কান্তির গ্লানি করিও না, বরং বৃদ্ধিশীল রাখিতে যত্ন কর। সাগরিকা পালিকা মাতার কাপট্য বুঝিতে পারিলেন না যথার্থ স্নেহবাক্য জ্ঞানে কহিলেন আমার ইচ্ছা নাই, আপনি যত্ন করিতেছেন, ভাল, ইহার সমভিব্যাহারে গমন করি। ঐ ক্রূরস্বভাবা দিওনাইজা অচিরে কৃতকার্য্য হইবার বাসনায় তাহাদের গমন কালে লিওনাইনকে পূর্ব্বোপদেশ স্মরণ করিয়া দিবার ছলে সঙ্কেত করিল দেখিস্ যেন ভুলিস্ না;

 পরে সাগরিকা লিওনাইনের সমভিব্যাহারে ভ্রমণ করিতে২ সাগরের কূলে গিয়া উপস্থিত হইলেন। আপনার জন্মস্থান জলনিধি জ্ঞানাবচ্ছেদে দেখেন নাই এক্ষণে সাক্ষাৎ নিরীক্ষণ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে সমুদ্রের উপর ভয়ানক শব্দে বায়ু বহিতে আরম্ভ হইল তাহাতে জিজ্ঞাসা করিলেন এ পবন কি পশ্চিম দিক্ হইতে প্রবহমান হইতেছে? লিওনাইন কহিল, না, এ সমীরণ নৈঋত কোণ হইতে আসিতেছে। সাগরিকা কহিলেন আমি শুনিয়াছি আমার জন্ম সময়ে উত্তর দিক্ হইতে বায়ু বহিয়াছিল। এই কথা কহিবা মাত্র তাঁহার অন্তঃকরণে তৎকালিক বাত্যার পরাক্রম, জনকের পরিতাপ, জননীর প্রাণ বিয়োগ, এই সমস্ত শ্রত বিষয়ের স্মরণ হওয়াতে শোকে ব্যাকুলা হইলেন। তদনন্তর সঙ্গিকে কহিতে লাগিলেন শুনিয়াছি আমার পিতা পয়োনিধির উপর প্রবল ঝটিকা দেখিলেও ভয় করিতেন না, পোত বাহিদিগকে কহিয়াছিলেন অরে আমার যথেষ্ট সাহস আছে। তিনি আপনার সুকোমল রাজকরে অর্ণবযান আকর্ষণ পূর্ব্বক আলিঙ্গন করত উত্তাল তরঙ্গ বেগ সহিষ্ণুতা করিয়াছিলেন। শ্রুত আছে সেই উর্ম্মির আঘাতে তরণী ভগ্ন প্রায় হইয়াছিল। লিওনাইন জিজ্ঞাসা করিল এ কত দিনের কথা? সাগরিকা উত্তর দিলেন আমার জন্ম কালে ঐ সকল ঘটনা হয়, বয়স দেখিয়া কাল নির্ণয় করতে পার। রত্নাকরের উপর সে প্রকার তরঙ্গ ও প্রচণ্ড পবনের বহা আর কখন হয় নাই। তদনন্তর বাত্যার বিবরণ পোত বাহকদের ব্যবহার এবং অর্ণবযানের দুর্গতি প্রভৃতির বৃত্তান্ত বর্ণন আরম্ভ করিলেন। সাগরিকার ধাত্রী বাল্যাবস্থায় তাঁহাকে সেই সমস্ত বিবরণ বারম্বার বর্ণন করিয়া শুনাইয়াছিল তাহাতে ঐ বিষয় সর্ব্বদা তাঁহার মনে জাগরূক ছিল। কিয়ৎক্ষণ পরে লিওনাইন তাঁহাকে কথা কহিতে বারণ করিয়া ঈশ্বরের নমোচ্চারণ করিতে কহিল। সাগরিকা যদিও এ কথার ভাব ঝটিতি বুঝিতে পারিলেন না তথাপি মনোমধ্যে আশঙ্কার উদয় হওয়াতে জিজ্ঞাসা করিলেন তোমার কোন মানস আছে না কি? লিওনাইন এতৎ প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দিল না, কহিল, যদি পরমেশ্বরের স্মরণ পূর্ব্বক আরাধনা নিমিত্ত কিঞ্চিৎ অবকাশ প্রার্থনা কর দিতেছি কিন্তু বৃথা সময় ক্ষেপ করিও না, দেবতাদের শ্রবণ করিতে বিলম্ব হয় না, আদিষ্ট কর্ম্ম সত্বর সম্পাদন করিতে প্রতিজ্ঞা করিয়া আসিয়াছি। কুমারী এক্ষণে তাহার অভিপ্রায় হৃদয়ঙ্গম করিয়া বিষাদ সাগরে মগ্ন হইলেন। লোচন দ্বয় হইতে অনর্গল জলধারা বহিতে লাগিল। জীবনের নিমিত্ত ব্যাকুল হইয়া বলিলেন তুমি কি এখনি আমাকে হত্যা করিবে? কেন? কি নিমিত্ত? লিওনাইন কহিল ঠাকুরাণীর সন্তোষ নিমিত্ত। সাগরিকা কহিলেন আমাকে বিনষ্ট করিতে কেন তাঁহার মানস হইল? আমি এ শরীরে কদাপি তাঁহার অনিষ্ট করি নাই, কখন একটা পরুষ বাক্য প্রয়োগ অথবা কোন জীবের হিংসা করি নাই, শপথ করিয়া বলিতে পারি জন্মাবচ্ছেদে একটা মূষিক কি মক্ষিকারও অপকার আমা হইতে হয় নাই। একবার একটা কৃমি দৈবাৎ আমার পদতলে পড়িয়া মর্দ্দিত হইয়াছিল তজ্জন্য ঠাকুরাণীর নিকটে অশেষ প্রকারে অনুতাপ করি। ইদানী কি অপরাধ করিলাম? নিষ্ঠুর লিওনাইন কুমারীর এবম্প্রকার সকরুণ বিনয়ান্বিত বচনে মনোযোগ করিল না, এতাবন্মাত্র কহিল আমি কার্য্যের ঔচিত্যানৌচিত্য বিচারার্থ নিযুক্ত হই নাই আজ্ঞা পালন নিমিত্ত আসিয়াছি। এই বলিয়া সংহারের উপক্রম করে ইত্যবসরে হঠাৎ কতিপয় সামুদ্রিক তস্কর সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল এবং বলদ্বারা সুকুমারী কুমারীকে আপনাদের পোতে আরোপণ পূর্ব্বক পলায়ন করিল।

 নৌতস্করের হতভাগ্যা সাগরিকাকে লুঠে পাইয়া মাইটিলিনি নাম্নী নগরীতে গেল এবং তত্রত্য এক জন গৃহস্থের নিকট তাঁহাকে দাসী স্বরূপে বিক্রয় করিল। সাগরিকা যদিও দাসী ভাবাপন্ন হওয়াতে ঐ স্থানে সাতিশয় জঘন্যাবস্থায় রহিলেন তথাপি তাঁহার অনুপম রূপ লাবণ্য ও অসামান্য গুণ নিচয় বহু দিন অমান্য হইয়া থাকিল না। ক্রেতা তাঁহার উপার্জ্জিত ধনে অনতিবিলম্বে ধনবান হইয়া উঠিলেন। সাগরিকা সেই নগরে তৌর্য্যত্রিক বিদ্যা ও সূচি কর্ম্মের শিক্ষা প্রদানে নিযুক্ত হইলেন। তদ্দ্বারা যে অর্থ উপার্জ্জিত হইত আপনার প্রভু এবং প্রভু পত্নীকে প্রদান করিতেন। সাগরিকার গুণনিচয়ের সুখ্যাতি ক্রমে২ মাইটিলিনি নগরীর অধিপতির শ্রুতিগোচর হইল। তাহাতে তদ্দেশাধীশ্বর লাইসিমাকস্ কৌতুকাবিষ্ট হইয়া স্বয়ং দেখিতে আসিলেন। কুমারীর সহিত প্রসঙ্গ সঙ্গতি ক্রমে কিয়ৎ ক্ষণ কথোপকথন হওয়াতে রাজার পরম পরিতোষ জন্মিল। নৃপতি লোক মুখে তাঁহার রূপ গুণের প্রশংসা শ্রবণ করিয়াছিলেন স্বচক্ষে নিরীক্ষণ ও আলাপ করিয়া তদ্বিষয়ের প্রমাণ পাইবেন ঈদৃশী প্রত্যাশা তদীয় মনোমধ্যে স্থান লাভ করে নাই। কিন্তু এক্ষণে দেখিয়া শুনিয়া রূপ গুণ বিদ্যা বুদ্ধির যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা করিলেন এবং বিদায় সময়ে এই উপদেশ করিয়া গেলেন এবার সৎ পরিশ্রম ও ধর্ম্মানুশীলনে নিয়ত রত থাকিও। যদি আমার প্রমুখাৎ তোমার বিষয়ের কোন কথা কখন শুনিতে পাও তাহাতে পরম শ্রেয়ঃ জ্ঞান করিও। সাগরিকার বুদ্ধি কৌশল ও পরমোৎকৃষ্ট গুণের পরিচয়ে এবং মধুরাকৃতি ও নম্রতা অবলোকনে নরপালের মনঃ মুগ্ধ হইয়াছিল। তাহাতে যদিও দাস্যাবস্থায় তাঁহার পরিচয় পাইলেন না তথাপি আকৃতি প্রকৃতিতে সদ্বংশজাতা বলিয়া বিশ্বাস করত পাণিগ্রহণের মানস করিলেন। সাগরিকা রাজনন্দিনী বটেন কিন্তু তাঁহার পরিচয় পাইবার সম্ভাবনা মাত্র ছিল না, যদি কেহ জনক জননীর কথা জিজ্ঞাসা করিত কিয়ৎ ক্ষণ নিঃস্তব্ধ হইয়া শেষে কেবল বিলাপ করিতেন।

 এ দিকে থার্সস নগরে সমুদ্রকূলে নাবিক তস্কর কর্ত্তৃক হঠাৎ সাগরিকা অপহৃতা হওয়াতে লিওনাইন মনোমধ্যে ক্ষুন্ন হইয়া কিয়ৎ ক্ষণ ভাবিতে লাগিল সাগরিকার প্রাণ সংহার হইল না দস্যুরা জীবন্ত ধরিয়া লইয়া গেল ঠাকুরাণী বা আমার উপর ক্রুদ্ধা হন্। পরে বিবেচনা পূর্ব্বক স্থির করিল তাঁহাকে গিয়া সাগরিকার মৃত্যু সংবাদ শুনাই, মলিমুচেরা কোথায় লইয়া গেল বোধ হয় আর কোন সন্ধান হইবেক না। এই স্থির করিয়া দিওনাইজার সন্নিধানে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক সমাচার দিল সাগরিকার পঞ্চত্ব প্রাপ্তি হইল। সে শ্রবণমাত্র মনোমধ্যে সাতিশয় হৃষ্ট ও কৃতার্থম্মন্য হইল এবং সমারোহ পূর্ব্বক অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সমাধা করিয়া শোক সূচক মৌখিক স্নেহ প্রকাশ নিমিত্ত একটি সুন্দর সমাধি নির্ম্মাণ করিয়া দিল। কিয়ৎ কালানন্তর পেরিক্লিস আপনার অঙ্গজাকে স্বদেশে আনয়ন করিবার মানসে ধার্ম্মিক মন্ত্রি হেলিকেনস্ সমভিব্যাহারে থার্সস নগরে যাত্রা করিলেন। কন্যাকে অতি শৈশব কালে বিদেশে ক্লিওন ও তাঁহার বনিতা দিওনাইজার হস্তে সমর্পণ করিয়া আসিয়াছিলেন তদবধি বহুকাল দেখিতে পান নাই পুনর্বার নিরীক্ষণ করিয়া চিত্তচকোর চরিতার্থ করিবেন এই আশয়ে মনোমধ্যে সাতিশয় উল্লাসিত হইয়াছিলেন অতএব থার্সসে উত্তীর্ণ হইয়া যখন শুনিলেন সাগরিকার লোকান্তর প্রাপ্তি হইয়াছে এবং স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিলেন স্মরণার্থ স্তম্ভ নির্মিত রহিয়াছে তখন মনস্তাপের পরিসীমা রহিল না। তাঁহার পরম প্রিয়তমা বনিতার একমাত্র চিহ্ণ থাসস নগরে ছিল তাহারও বিনাশ সংবাদ শ্রবণ করাতে শোকে ক্ষণকাল সেখানে তিষ্ঠিতে পারিলেন না, তৎক্ষণেই প্রস্থান পূর্ব্বক পোতে আসিয়া উঠিলেন। পোতারূঢ় হইলেও শোকে মনের এতাদৃশ বৈকল্য হইল যে সমভিব্যাহারি সঙ্গেও বাক্যালাপ ত্যাগ করিয়া কেবল বিলাপ করিতে লাগিলেন। চতুর্দিক্‌স্থ সমস্ত পদার্থে পরিপূর্ণ পৃথিবী একেবারে শূন্য বোধ হইল।

 তাঁহার অর্ণবযান থার্সস পরিত্যাগ পূর্ব্বক টায়রে প্রত্যাগমন করিবার কালে পথ ঘটিত মাইটিলিনি নগরের নিকট দিয়া যাইতেছিল। দৈবাৎ সে সময় ঐ নগরীর অধিপতি সাগর তীরে ভ্রমণ করিতে আগমন করিলেন। একখান বৃহৎ পোত দৃষ্টি গোচর হওয়াতে তাহাতে কোন ব্যক্তি আরোহণ করিয়া কোথায় যাইতেছে অবগত হইতে উৎসুক হইলেন। পরে কৌতুকাবিষ্ট হইয়া একখানি ক্ষুদ্র তরণী যোগে গমন পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন এ কোন দেশের তরি? পেরিক্লিসের অমাত্য হেলিকেনস্ যথোচিত অভ্যর্থনানন্তর পরিচয় দিলেন এই তরি টায়র নগরীয়, তথাকার অধিপতি পেরিক্লিস এই তরণীতে আছেন। আমাদের রাজা পরম স্নেহাস্পদ বনিতার ও দুহিতার বিয়োগে সাতিশয় ব্যাকুল, প্রায় মাসত্রয় গত হইল জলগ্রহণ ও কাহারও সহিত বাক্যালাপ করেন নাই, নিরন্তর বিলাপ করিয়া কেবল শোকের বৃদ্ধি করিতেছেন। মাইটিলিনির অধিপতি এতদ্বচন শ্রবণে সাতিশয় দয়াবিষ্ট হইলেন এবং শোকার্ত্ত নৃপতির সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন। মন্ত্রী তাঁহাকে রাজার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া দিলে দেখিলেন ভূপতির বদন অজস্র অস্রপাতে মলিন, শরীর নিরন্তর পরিতাপে শীর্ণ, এবং বর্ণ বিবর্ণ হইয়াছে, শোকাবেগে এক২ বার অচেতন হইতেছেন। মাইটিলিনিরাজ কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া সমুচিত সম্বোধন পুরঃসর কহিলেন কুশল হউক, পরে উচ্চস্বরে বলিলেন জগদীশ্বর কল্যাণ করুন, মহাশয় মঙ্গল হউক। কিন্তু তাঁহার চীৎকার বিফল হইল, যাঁহার প্রতি বাক্য প্রয়োগ করিলেন তিনি শূন্যহৃদয় হইয়া ছিলেন কে তাহাতে প্রতিবচন দিবে? ফলতঃ শোকাভিভব প্রযুক্ত পেরিক্লিসের বাহ্যজ্ঞান ছিল না, কে তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কথা কহিতেছে ইহাই জানিতে পারিলেন না মান্য ব্যক্তি দেখিয়া সমুচিত সমাদর কি করিবেন? মাইটিলিনিরাজ সম্ভ্রান্ত নরপতির শোক নিমিত্ত এবম্বিধ দুর্গতি দেখিয়া বিবেচনা করিলেন সাগরিকা অতি মধুরভাষিণী, তাঁহার কথা শুনিবামাত্র মনঃ আর্দ্র হয় অতএব তাঁহাকে আনয়ন করি তিনি মধুর বচন দ্বারা এই শোকাভিভূত ভূপতির দুঃখাবেগ নিবারণ পুরঃসর অবশ্য বাক্যস্ফূর্তি করাইতে পারিবেন। পরে সাগরিকার কথা হেলিকেনসকে কহিয়া উভয়ে পরামর্শ পূর্ব্বক তাঁহার আনয়ন নিমিত্ত লোক প্রেরণ করিলেন। দেশাধিপতির আদেশ শ্রবণ মাত্রে সাগরিকা সেই ব্যক্তির সমভিব্যাহারে তৎক্ষণাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পোতস্থ লোকেরা তাঁহার আকৃতি প্রকৃতি অবলোকন করিয়া প্রশংসা করত কহিল ইনি বিশেষ ক্ষমতাবতী হইবেন সন্দেহ কি? মাইটিলিনির অধিপতি তাহাদের প্রতিষ্ঠা বচনে সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন ইহাঁর গুণবত্তার কথা কি কহিব যদি বংশের পরিচয় পাইতাম পাণি গ্রহণ পূর্ব্বক দিব্যাঙ্গনা লাভ বোধে আপনার স্ত্রীভাগ্য প্রশংসিত করিতাম? অনন্তর শিষ্টভাষায় সেই যুবতীকে যথোচিত সম্বোধন করিয়া কহিলেন সুন্দরি এই তরি মধ্যে একজন সম্ভ্রান্ত নরপতি শোকাভিভূত হইয়া আছেন শোকহর সুখকর স্বকীয় মধুর বচন দ্বারা তাঁহার সন্তাপ হরণ কর। সাগরিকা সবিনয় বচনে নিবেদন করিলেন মহাশয় যদিস্যাৎ আমি এবং আমার সঙ্গিনী ভিন্ন অন্য কেহ তাঁহার নিকট না যায় তাহা হইলে আদেশ পালনার্থ সাধ্যানুসারে যত্ন করি।

 সাগরিকা রাজার ঔরসে জন্মিয়া দুর্ভাগ্য বশতঃ দাসীভাব প্রাপ্ত হওয়াতে মাইটিলিনি নগরী মধ্যে কাহার নিকট আত্ম পরিচয় প্রদান করেন নাই, অর্ণবোপরি পোতস্থ শোকাকুল ভূপালের শান্ত্বনার্থ নিযুক্ত হইয়া তাঁহার সমীপে আপনার দৈন্যাবস্থার ইতিহাস বর্ণন করিতে মনস্থ করিলেন। বিবেচনা করিলেন দুঃখার্ত্ত লোকে অন্যের দুঃখের কথা শুনিলে তুলনা করিয়া আপনার ব্যাকুল চিত্তে প্রবোধ জন্মাইয়া থাকে আমার দুরবস্থার বৃত্তান্ত শ্রবণে অবশ্য নৃপতির শোকশান্তি হইবেক। অতএব নিকট বর্ত্তিনী হইয়া যেন জনক সন্নিধানে দণ্ডায়মানা হইলেন এবম্প্রকার ভাবে আপনার দুঃখের বিষয় বর্ণন করিতে আরম্ভ করিলেন। বীণার তুল্য সুমধুর কণ্ঠস্বর এবং পীযূষ সন্নিভ বচন শ্রবণ বিবরে প্রবেশ মাত্রে শোকাভিভূত ভূপতির স্থিরতর নেত্র স্পন্দমান হইবার উপক্রম হইল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে নয়নোন্মীলন করাতে দেখিতে পাইলেন নবীনা তরুণীর আকার আপনার পরম প্রণয় ভাজন মৃত মহিষীর সমান, অতএব আর মৌনাবলম্বন করিয়া থাকিতে পারিলেন না আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন আমার বনিতার এই রূপ গঠন ছিল যদিস্যাৎ কন্যা জীবিত থাকিতেন অবিকল এইরূপ দেখিতে পাইতাম। আহা মৃতা রাজ্ঞীর অবয়ব ও স্বরের প্রতিচ্ছায়া সমুদায় ইহাতে অবলোকন করিতেছি। পরে সম্মুখস্থ কন্যাকে সস্নেহ বচনে সম্বোধন পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন বৎসে তুমি কোথায় থাক? তোমার পিতা মাতার নাম কি? এই মুহর্ত্তে কহিলে না দুর্ভাগ্যবশতঃ জঘন্য অবস্থায় পতিত হইয়াছ দৈবী দুর্ঘটনার বিষয় ব্যক্ত করিলে উভয়ের দুঃখ সমান হইবে? সাগরিকা কহিলেন আমার মনে যাহা উদিত হইল তাহাই নিবেদন করিলাম। পেরিক্লিস্ বলিলেন তোমার সমুদায় ইতিহাস আমার নিকট বর্ণনা করিয়া বল দেখি আদ্যোপান্ত বিবরণ শ্রবণ করিয়া যদি বুঝিতে পারি তুমি আমার ক্লেশের সহস্রাংশের একাংশ সহ্য করিয়াছ তাহা হইলে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিব তুমি ধীর পুরুষের ন্যায় গম্ভীর প্রকৃতি এবং আমি বালিকার ন্যায় অস্থির চিত্ত, দুঃখে অধৈর্য্য হইতেছি। এই কথা বলিয়া ঔৎসুক্য প্রযুক্ত তৎক্ষণেই পুনর্ব্বার জিজ্ঞাসা করিলেন বৎসে তোমার নাম কি? আপন বিবরণ বর্ণন করিয়া বলনা, এ দিকে আইস, আমার সমীপে আসন পরিগ্রহ পুরঃসর উপবেশন কর। পরে যখন শুনিলেন ঐ তরুণীর নাম সাগরিকা তখন তাঁহার বিস্ময়ের ইয়ত্তা রহিল না, সাশ্চর্য্য চিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন আমার সেই কন্যা সাগরোপরি উৎপন্ন হয় তদ্বিষয় চিরস্মরণ মানসে আমিই ঐ অসাধারণ নামের সৃষ্টি করি, এই তরুণী কিরূপে সেই আখ্যায় বিখ্যাতা হইলেন? ইনি বুঝি আমার সহিত পরিহাস করিতেছেন। পরে বিমাননার ক্লেশ প্রকাশ পুরঃসর বলিয়া উঠিলেন হা কপাল, তোমার নিকটেও উপহসিত হইলাম। প্রতিকূল দৈবের কি কোপ? অবনী মণ্ডলে আমাকে লোকের হাস্যাস্পদ করিবার নিমিত্ত তোমাকে প্রেরণ করিয়াছেন? সাগরিকা এই বিলাপ বচন আকর্ণনে ঈষদ্বিরাগ প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন মহারাজ ধৈর্য্যাবলম্বন করুন নচেৎ আমি আত্ম বৃত্তান্ত বর্ণনে নিরস্ত হই। পেরিক্লিস বলিলেন নিবৃত্ত হইও না, আমি ধীরভাবেই আছি। বৎসে তুমি সাগরিকা বলিয়া আপন সংজ্ঞার পরিচয় দেওয়াতে আমার যে রূপ আশ্চর্যয় জ্ঞান জন্মিল তুমি কি বুঝিবে? সাগরিকা বলিলেন সামান্য লোকে আমার এ নাম স্থির করে নাই নামকরণে যাঁহার অধিকার ছিল তিনিই এই নাম রাখিয়াছিলেন আমার জন্মদাতা পিতা নামকরণ করেন তিনি সামান্য ব্যক্তি নহেন এক দেশের রাজা। পেরিক্লিস এই কথা আকর্ণনান্তে সমধিক বিস্ময় প্রকাশ পূর্ব্বক বলিলেন তুমি কি রাজতনয়া? সাগরিকা তোমার নাম? তোমার এ শরীর কি শুক্রশোণিত সম্ভব? তুমি কি দেবকন্যা নহ? তবে বল দেখি কোন স্থানে তোমার জন্ম হইয়াছিল এবং কেন তোমার সংজ্ঞা সাগরিকা হইল? সাগরিকা এক্ষণে আপনার পরিচয় দিতে প্রবৃত্ত হইয়া নিবেদন করিলেন মহারাজ সাগরোপরি জন্ম হওয়াতে আমার নাম সাগরিকা হয়। আমার গর্ব্ভধারিণী এক রাজার দুহিতা ছিলেন। আমার ধাত্রী লাইকোরিদা নাম্নী এক প্রবীণ অঙ্গনা আমাকে প্রতিপালন করিবার সময় নিরন্তর পরিতাপ করত কহিত আমি ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র আমার জননীর মৃত্যু হয়। আমার পিতা আমাকে থার্সস নগরের রাজসদনে রাখিয়া যান্ থার্সসাধিপতি ও তদীয় মহিষী সাতিশয় যত্নে আমার লালন পালন করিয়া ছিলেন কিন্তু পরে রাজ্ঞী হঠাৎ বিদ্বেষিণী হইয়া আমার প্রাণ সংহার করিতে উদ্যত হন আমার পরমায়ুঃ আছে একারণ যে সময় সেই রাজমহিষীর কিঙ্কর অর্ণব তীরে আমার জীবন নাশের উদ্‌যোগ করে তৎকালে দৈবাৎ এক দল নাবিক তস্কর তথায় উপস্থিত হয় তাহারা আমাকে গ্রহণ পূর্ব্বক সমুদ্র পথে মাইটিলিনি নগরে দাসীরূপে বিক্রয় করিয়া গিয়াছে। মহারাজ অশ্রুপাত করেন কেন? আপনি কি আমাকে প্রতারিকা বোধ করিলেন? ধর্ম্মাবতার সমুদায় সত্য কহিলাম, মিথ্যা প্রবঞ্চনা জানি না, আমি পেরিক্লিসের কন্যা, যদি সেই সাধু রাজা জীবদ্দশায় থাকেন এখনও রাজকন্যা বলিয়া অভিমান করিতে পারি। পেরিক্লিস সাগরিকার কথার সত্যতা বিষয়ে যদিও সংশয় করিতে ছিলেন তথাপি এক্ষণে সে সংশয়কে আপনার মনোমধ্যে স্থান দান করিলেন না, অতর্কিতোপস্থিত আনন্দে গদ্গদ হইয়া উচ্চস্বরে অনুচর দিগকে আহ্বান করিলেন। তাহারা অনেক দিনের পর প্রভুর কথা শুনিয়া হর্ষে পুলকিত হইল এবং তৎক্ষণাৎ সকলেই নিকটে গিয়া দণ্ডায়মান হইল। পরে রাজা প্রিয় মন্ত্রি হেলিকেনসকে সম্বোধন পূর্ব্বক আহ্লাদে কহিতে লাগিলেন ওহে ওহে হেলিকেনস আমার শরীরে নির্দয় প্রহার কর, অঙ্গ সকল চূর্ণীকৃত হউক, নচেৎ হর্ষভরে এখনই পঞ্চত্ব হয়। বৎসে সাগরিকে এ দিকে আইস, আহা তুমি সাগরের উপর জন্মিয়া থার্সসে নিক্ষিপ্ত হইয়াছিলে পুনর্বার তোমাকে সাগরের উপর দেখিতে পাইলাম। ওহে হেলিকেনস দেবতাদের নিকট দণ্ডবৎ প্রণিপাত কর, এই আমার সেই সাগরিকা, পুনর্ব্বার লব্ধা হইলেন। হে পুত্রি তোমার মঙ্গল হউক। ওহে হেলিকেনস সেই নূতন পরিচ্ছদ আনিতে বল। আহা আমার সাগরিকাকে পাপীয়সী থার্সস্ রাজমহিষী বিনষ্ট করিতে চেষ্টা করিয়াছিল পরমেশ্বর ইহাকে রক্ষা করিয়াছেন। মন্ত্রি আমার তনয়ার সম্মান কর আমার সাক্ষাতে ইহাকে রাজনন্দিনী বলিয়া আহ্বান কর। ইহাঁর প্রমুখাৎ এখনি সমুদায় বৃত্তান্ত অবগত হইতে পারিবে। ইতিমধ্যে মাইটিলিনির অধিপতি লাইসিমেকসের প্রতি দৃষ্টিপাত হওয়াতে মৃদুভাবে মন্ত্রিকে জিজ্ঞাসা করিলেন ইনি কে? মন্ত্রী নিবেদন করিলেন মহারাজ ইনি এ স্থানের নিকটবর্ত্তি মাইটিলিনি দেশের রাজা, আপনকার শোক বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া দেখিতে আসিয়াছেন। পেরিক্লিস সাতিশয় সমাদর করিয়া কহিলেন মহাশয় নিকটে আগমন করুন আপনাকে আলিঙ্গন করি। আপনকার সন্দর্শনে পরমাপ্যায়িত হইলাম। অনন্তর আহ্লাদে পুনর্ব্বার প্রলাপবৎ বাক্য কহিতে লাগিলেন হে পরমেশ্বর আমার কন্যার কল্যাণ কর। ওহে তোমরা অবহিত হইয়া শ্রবণ কর কেমন মধুর বাদ্যধ্বনি হইতেছে। দেবতার প্রসন্নতায় যথার্থই হউক অথবা হর্ষাতিরেক হেতু মনঃ কল্পিতই হউক সে সময় তাঁহার বোধ হইতে লাগিল যেন বাদ্য নিনাদ হইতেছে। কিন্তু হেলিকেনস উত্তর দিলেন মহারাজ কোথায় কি? কিছুই শুনিতে পাই না। পেরিক্লিস বলিলেন সে কি? কোন শব্দ শ্রবণ গোচর হইল না? তবে বোধ হয় স্বর্গ হইতে দুন্দুভি বাদ্য হইল। মাইটিলিনিরাজ সম্মুখে দণ্ডায়মান ছিলেন কোন প্রকার বাদধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট না হওয়াতে বিবেচনা করিলেন হঠাৎ হর্ষোদয়ে ইহাঁর চিত্ত চঞ্চল হইয়াছে এক্ষণে বাগ্‌বিতণ্ডা করিয়া আনন্দানুভবে প্রতিবন্ধকতা করিবার প্রয়োজন নাই অতএব রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন মহাশয় সত্য বটে বাদ্যধ্বনি হইতেছে আমরাও শুনিতেছি। এ কথায় পেরিক্লিসের অন্তঃকরণ স্বস্থ হইল এবং নিদ্রা তাঁহার নেত্রদ্বয় আকর্ষণ করিল তাহাতে মাইটিলিনিরাজ তাঁহাকে পর্য্যঙ্কোপরি শয়ন করিতে কহিলেন। পেরিক্লিস পল্যঙ্কে আরোহণ পুরসর শয়ন করিবামাত্র অপরিমিত আনন্দ প্রভাবে অবিলম্বে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইলেন এবং সাগরিকা নীরব হইয়া তাঁহার সমীপে বসিয়া রহিলেন।

 পেরিক্লিস নিদ্রা যাইতে২ স্বপ্ন দেখিলেন যেন এফিসসস্থ দিয়ানা দেবী প্রত্যক্ষে দর্শন দিয়া আদেশ করিতেছেন এফিসস্ নগরে অচিরে গমন করিয়া আপনার সমুদায় দুর্ভাগ্যের বৃত্তান্ত দেবী সম্মুখে বর্ণন কর আমি স্বীয় করস্থ রৌপ্য ধনুঃ স্পর্শ পূর্ব্বক শপথ করিয়া বলিতেছি যদি আমার আজ্ঞা পালন কর অনুপম সুখ প্রাপ্ত হইবে। কিয়ৎক্ষণ পরে পেরিক্লিসের নিদ্রা ভঙ্গ হইল। গাত্রোত্থান পূর্ব্বক নিকটস্থ লোক দিগকে স্বপ্নের কথা শ্রবণ করাইয়া কহিলেন দিয়ানা দেবীর আজ্ঞা পালন নিমিত্ত এফিসে গমন করিতে হইবে।

 মাইটিলিনিরাজ এই প্রকারে পেরিক্লিসের শোকাপসরণান্তে আনন্দোদয় দেখিয়া কৃতার্থম্মন্য হইলেন এবং তীরে অবতরণ পুরঃসর নিকটবর্ত্তি নিজ নগরে প্রবেশ করিয়া অতিথি সৎকার গ্রহণ নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি যত্ন করিলেন। পেরিক্লিস তাঁহার অনুরোধে দুই এক দিবস তদীয় সদনে বিশ্রাম করিতে সম্মত হইলেন। অতএব মাইটিলিনির অধিপতি লাইসিমাকস্ স্বীয় পরম প্রেমাস্পদ সাগরিকার পিতৃ সম্মতিক্রমে পাণি গ্রহণ করণাশয়ে শ্বশুর ভাবে পেরিক্লিসের সাতিশয় সমাদর করিতে লাগিলেন। পেরিক্লিস আত্ম তনয়ার প্রতি তাঁহার করুণা দর্শনে মহা সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন সুতরাং তাঁহার আশয় বিদিত হইলে বিমর্ষ বা অমর্শ প্রকাশ করিলেন না বরং অনাথা কন্যার জঘন্যাবস্থায় তিনি যথেষ্ট সম্মান করিয়াছেন এবং দুহিতাও তাঁহার প্রতি অপ্রীত নহেন বিবেচনা করিয়া সম্মতি দিতে ইচ্ছা করিলেন। পরন্তু তদ্বিষয়ে আশু অভিপ্রায় প্রকাশ না করিয়া এই স্থির করিলেন আপাততঃ সকলে মিলিয়া দিয়ানা তীর্থে গমন করা যাউক তথা হইতে প্রত্যাগমনানন্তর যাহা কর্ত্তব্য করা যাইবেক। অতএব কতিপয় দিবস বিশ্রামের পর এফিসসে যাত্রা নিমিত্ত সাগরিকা এবং লাইসিমাকস সমভিব্যাহারে পোতারোহণ করিলেন এবং দিয়ানা দেবীর প্রভাবে কিয়দ্দিন মধ্যেই তথায় গিয়া উত্তীর্ণ হইলেন।

 পেরিক্লিস্ যৎকালে স্বগণ সমভিব্যাহারে দিয়ানা দেবীর ভবনে প্রবেশ করিলেন তখন তাঁহার বনিতার জীবনদাতা বৃদ্ধ সেরিমন এবং তাঁহার মহিষী যাজিকা থৈসা সে স্থানে বেদী সন্নিধানে দণ্ডায়মান ছিলেন। যদিও বহুকাল কলত্র বিচ্ছেদে পেরিক্লিসের পূর্ব্ববৎ শরীরের কান্তি পুষ্টি ছিল না, বিশ্রী হইয়াছিলেন, তথাপি থৈসা তাঁহাকে চিনিতে পারিলেন। অধিকন্তু পেরিক্লিস যখন বেদীর অদূরে আসিয়া কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন তখন অবিকল কণ্ঠস্বর কর্ণ কুহরে প্রবিষ্ট হওয়াতে থৈসার সংশয় মাত্র রহিল না। চমৎকৃত হইয়া সাশ্চর্য্য চিত্তে স্বামির বাক্য শ্রবণ করিতে লাগিলেন। পেরিক্লিস বেদী সমীপে দণ্ডায়মান হইয়া অঞ্জলি বন্ধন পুরঃসর স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন হে দেবি হে মাতঃ জয়যুক্তা হও আপনার আদেশ পালনার্থ আত্ম পরিচয় প্রদান করি, অবধান হউক, আমি টায়র নগরের অধিপতি, বৈরিভয়ে রাজ্য পরিত্যাগ পূর্ব্বক পেন্তাপোলিস নগরে পলায়ন করি সেই অবস্থায় থৈসা নাম্নী এক যুবতীর সহিত আমার পরিণয় হয়। আমার সহধর্ম্মিণী অর্ণবোপরি পোতমধ্যে এক কন্যা প্রসব করিয়া দুর্ভাগ্য বশতঃ কালের করল কবলে পতিতা হন। আমি থার্সস নগরে তত্রত্য রাজমহিষী দিওনাইজার হস্তে প্রতিপালনার্থ সেই তনয়াটীকে শৈশবকালে সমপর্ণ করি আমার দুহিতার নাম সাগরিকা। দিওনাইজা তাহার চতুর্দ্দশ বর্ষ বয়ঃক্রম সময়ে প্রাণ বিনাশার্থ উদ্যত হয় কিন্তু শুভগ্রহের আনুকূল্যে কন্যা মাইটিলিনি নগরে আনীত হইয়াছিলেন। আমি এ সকল ব্যাপার কিছুই জানিতে পারি নাই, ঐ নগরের নিকট দিয়া সমুদ্র পথে তরিযোগে গমন করিতেছিলাম দৈবাৎ সেই এই সাগরিকা আমার অর্ণবযানে আনীত হইয়া আপনার পরিচয় প্রদান করিলেন।

 থৈসা হৃদয় বল্লভের এই সমস্ত বাক্য আপন কর্ণে আকর্ণন করিয়া মনোমধ্যে সাতিশয় উল্লাসিতা হইতেছিলেন প্রিয় তমের কথাবসানে আপনার আনন্দ আর গোপন করিতে পারিলেন না, অধীর হইয়া গদ্গদ স্বরে কহিয়া উঠিলেন রাজন্ পেরিক্লিস্। এই বাক্য ব্যাহারের পরেই তাঁহার মূর্চ্ছা হইল। পেরিক্লিস্ দৃষ্টিক্ষেপ পূর্ব্বক কহিলেন এ অবলা কি বলিতেছে? এ কে? হঠাৎ ভূমিতে পড়িল কেন? মরে না কি? ও গো মহাশয় এ দিকে আসিয়া এ অঙ্গনাকে অবলোকন করুন। সেরিমন তাঁহার কথা প্রথমাবধি শ্রবণ করিতেছিলেন নিকটে গিয়া কহিলেন মহাশয় আপনি দেবীর বেদী সমীপে যে সমস্ত বাক্য কহিলেন যদি তাহা সত্য হয় তবে ইনি আপনকার পত্নী। পেরিক্লিস বিস্ময় প্রকাশ পুরঃসর প্রতিবচন দিলেন সে কি? আমি অতি দুর্ভাগ্য, পত্নীর মৃত্যু হইলে তাঁহার সৎকার করিতে পারি নাই, আপন হস্তদ্বারা তাঁহার শবাধার সাগরে নিক্ষেপ করিয়াছি। অনন্তর সেরিমন বিস্তার পূর্ব্বক সমুদায় ইতিবৃত্ত বর্ণন করিয়া শুনাইলেন। থৈসাও কিয়ৎ ক্ষণ পরে মোহাপগমে লব্ধসংজ্ঞা হইয়া কহিলেন হে ভ্রান্ত আপনি কি পেরিক্লিস নহেন? তাঁহার তুল্য আপনার স্বর শুনিতেছি এবং তদাকৃতি দৃষ্ট হইতেছেন। আপনি এই মুহূর্ত্ত সমুদ্রের উপরি কন্যা প্রসব এবং বনিতার মৃত্যুর কথা কহিলেন না? পেরিক্লিস সংশয়ারূঢ় হইয়া বিস্ময় প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন মৃতা থৈসার স্বরই যে শ্রুত হয়। থৈসা বিনয় প্রদর্শন পুরঃসর নিবেদন করিলেন মহাশয় আমিই সেই হতভাগ্যা থৈসা। আমাকেই গতাসু বোধ করিয়া গভীর নীরধি মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছিলেন। পেরিক্লিস এই সমস্ত অভীষ্ট লাভে দেব প্রসাদ বোধ করিলেন এবং পরম ভক্তি প্রকাশ পূর্ব্বক চীৎকার করিয়া বলিলেন দিয়ানা দেবি তুমিই সত্য। থৈসা তাঁহার কর শাখা অবলোকন করত কহিতে লাগিলেন মহারাজ এই যে আমার পিতৃ দত্ত সেই অঙ্গুরী এখনও আপনার অঙ্গুলী পর্ব্ব শোভিত করিতেছে আমরা যখন পেন্তাপোলিস হইতে যাত্রা করি পিতা বিদায় কালে এই অঙ্গুরী আপনাকে প্রসাদ দান করিয়াছিলেন মনে পড়ে না? পেরিক্লিস উর্দ্ধ মুখে দেবগণের প্রতি দৃষ্টি করিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন হে অমর নিকর আপনাদের করুণার ইয়ত্তা নাই আপনাদের দয়ায় ইদানী আমার পূর্ব্ব ক্লেশ কৌতুক স্বরূপ বোধ হইতেছে। পরে প্রেয়সীর প্রতি দৃষ্টিপাত করত কহিলেন থৈসা আইস একবার আলিঙ্গন করি পুনর্ব্বার আমার বাহু দ্বয়ের মধ্য শোভান্বিত কর।

 অনন্তর সাগরিকা কহিলেন পিতঃ মাতৃক্রোড়ে উপবেশ করিতে আমার বাসনা হইতেছে। পেরিক্লিস এতৎ শ্রবণে তনয়াকে অগ্রে করিয়া পত্নীকে বলিলেন থৈসা এই তোমার অঙ্গজা, সমুদ্রের উপর তোমার শরীরে ভার স্বরূপা হইয়াছিল, সাগর মধ্যে উৎপন্ন হওয়াতে ইহার নাম সাগরিকা রাখিয়াছি। থৈসা কন্যাকে ক্রোড়ার্পিত করিয়া আপনার ধন্যবাদ করিলেন এই সময়ে পেরিক্লিস দেবী সমীপে প্রণিপাত করিয়া কহিতে লাগিলেন দেবি আমার প্রতি স্বপ্নযোগে দর্শন দিয়া যে আদেশ করিয়াছিলেন তন্নিমিত্ত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি আমি সংকল্প করিলাম প্রতি নিশায় তোমার উদ্দেশে নৈবেদ্য উৎসর্গ করিব। তদনন্তর মহিষীর নিকট লাইসিমেকসের পরিচয় ও সাগরিকার প্রতি তাঁহার সদ্ব্যবহারের বৃত্তান্ত কহিলেন এবং সহধর্ম্মচারিণীর সম্মতি ক্রমে সেই দেবালয়েই জামাতা বলিয়া তাঁহার অভ্যর্থনা করিয়া কন্যা সম্প্রদান করিলেন।

 পেরিক্লিস থৈসা এবং সাগরিকা ইহাঁদিগের বৃত্তান্তে সপ্রমাণ হইল যে ধর্ম্মমার্গে প্রবর্ত্তন হওয়াতে যদিও ক্লেশের অনুভব হয় তথাপি পরিণামে মহা সুখ এবং পরম সৌভাগ্য হইয়া থাকে। অতএব ধর্ম্মার্থ দুঃখ বা দুর্গতি চিরকাল মনোমধ্যে পীড়াদায়ক হয় না, তিতিক্ষার শিক্ষার্থ উত্থাপিত বলিয়া পরিজ্ঞাত হইলে অবিলম্বে কৌতুকাবহ হইয়া উঠে। অপর ভৃতের পক্ষে বিশ্বস্ততা ও প্রভুভক্তি অতি অনির্ব্বচনীয় ধর্ম্ম। সেই ধর্ম্মেতেই তাহার ঐহিক পারত্রিক সমৃদ্ধি হইয়া থাকে। হেলিকেনসের চরিত্রে তাহার বিলক্ষণ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গেল। ঐ ব্যক্তি স্বীয় প্রভু বিদেশস্থ হইলে অনামাসে সিংহাসন অধিকার পূর্ব্বক রাজ্যেশ্বর হইতে পারিতেন কিন্তু বিশ্বস্ত ও প্রভু ভক্ত এপ্রযুক্ত তাহা স্বীকার করেন নাই, যথার্থ অধিকারির হস্তে প্রত্যর্পণ নিমিত্ত যৎপরোনাস্তি যত্ন করিয়াছিলেন সুতরাং তাঁহার ঐহিক সুখ্যাতির ন্যায় পরত্র পরম শ্রেয়ঃ সম্ভাবনা হয়। অপিচ মনুষ্যের মনোমধ্যে দয়া প্রবৃত্তি দেববৎ মান্যতার নিদান, কেননা সেই প্রবৃত্তির উদ্রেকে মনুষ্য যখন পরোপকারে প্রবৃত্ত হয় তখন সকলে মুক্তকণ্ঠে তাহার ধন্যবাদ করে। সেরিমনের আচরণে তাহার স্পষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হইল, এই মহাত্মা দয়ার আবির্ভাবে থৈসার জীবন রক্ষা করিয়া মানব মণ্ডলী মধ্যে স্বর্গীয় পুরুষ বলিয়া মান্য হইলেন। পরন্তু এস্থলে ইহাও সপ্রমাণ হইল যে অসৎ প্রবৃত্তির কদাপি সৎ পরিণাম হয় না, অধর্ম্মের সমুচিত ফল অবশ্যই হইয়া থাকে। দুষ্ট দিওনাইজা অনাথা সাগরিকার অকারণ প্রাণ দ্বেষিণী হইয়াছিল। সে আপনার সংকল্প দ্বিতীয় ব্যক্তির নিকট ব্যক্ত করে নাই বটে কিন্তু অধর্ম্ম কদাপি গোপনে ও প্রতিফল বিরহে থাকিতে পারে না এ কারণ অচিরে থার্সসের লোক সকল রাজ বিদ্রোহী হইয়া উঠিল এবং রাজমহিষীর দ্রোহ নিমিত্ত প্রাসাদে অনল যোজন পূর্ব্বক সপরিবারে নরপালকে ভস্মাবশেষ করিয়া ফেলিল। এই রাজবিদ্রোহে প্রজাজনের অপযশঃ বা পাপ স্পর্শ হইল না বরং নিরপরাধ বালিকার প্রতি অকারণ হত্যার সংকল্প সমুচিত দণ্ডে পর্য্যবসিত হইল ভাবিয়া মনুষ্য ও দেবগণ তাহাদের প্রতি সন্তুষ্ট হইলেন ইতি।