সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/রোমিও জুলিএতের উপাখ্যান


R. D. SORNOKAR, ENGR
৪০১

রোমিও এবং জুলিএত।

রোমিও জুলিএতের উপাখ্যান।


 বেরোনা নগরে ক্যাপিউলেত এবং মন্তেগ্ নামে দুই প্রধান বংশ ছিল। তাঁহাদিগের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হওয়াতে পরস্পর বৈর নির্যাতন নিমিত্ত অশেষ প্রকারে যত্ন করিতেন। তাহাতে উভয় পক্ষের সন্নিকৃষ্ট জ্ঞাতি কুটুম্ব এবং অনুগত লোক জন পর্য্যন্ত সকলকেই সর্ব্বদা উৎপাত সহ্য করিতে হইত। দুই গোষ্ঠীর কোন পরিজন পথিমধ্যে দৈবাৎ পরস্পর সাক্ষাৎ হইলে বাক্ কলহ আরম্ভ করিত শেষে দণ্ডপারুষ্যে প্রবৃত্ত হইয়া শোণিত দর্শন না হইলে ক্ষান্ত হইত না। এতদ্রূপে দুই পরিবারের মধ্যে নিরন্তর বিবাদ বিসম্বাদ আরম্ভ হওয়াতে বেরোনা নগর সর্ব্বদা সোপদ্রব হইল তজ্জন্য পথিক লোকেরা বিশেষ রূপে উত্ত্যক্ত হইতে লাগিল।

 একদা ক্যাপিউলেত দলাধিপতি আপন ভবনে সাতিশয় সমারোহ পূর্ব্বক নিশাভোজের আয়োজন করিলেন। তদুপলক্ষে সৎকুলীন ভদ্রসন্তান ও তরুণী গণের আমন্ত্রণ হইল। সেই ভোজে বেরোনা নগরীস্থ প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত পুরুষ এবং যাবতীয় বিখ্যাত সুন্দরী আগমন করিলেন কেবল মন্তেগ বংশীয় কোন ব্যক্তি আসিতে পাইল না। ক্যাপিউলেত বংশীয়েরা যথাকালে ভোজনোৎসব আরম্ভ করিলেন তখন রোজালাইন নাম্নী এক যুবতী তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন। মন্তেগ দলাধিপতির পুত্র রোমিও নামক যুবা কোন সময়ে ঐ তরুণীকে নয়ন গোচর করিয়া তাঁহার প্রতি অভিলাষী হন এবং নিরন্তর তদ্গত চিত্তে চিন্তা করত নিতান্ত অধীর হইয়া ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ঙ্গম সুহৎ বেন্‌বোলিও নামা এক ব্যক্তি তাঁহাকে ঐ তরুণীর প্রণয় হইতে নিবৃত্ত করিবার নিমিত্ত যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিলেন কোন প্রকারে সেই মহিলার প্রতি তাঁহার বিরাগ জন্মইয়া দিতে পারেন নাই। ক্যাপিউলেত দিগের ভোজের সময় নগরীয় সমস্ত সীমন্তিনীর সমাগম বার্ত্তা অবগত হইয়া রোমিওকে সংবাদ প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন মিত্র যদিও উক্ত ভোজের সমাজে মন্তেগ বংশীয় কোন ব্যক্তি গমন করিলে মহা বিরোধ ও উৎপাত হইবার সম্ভাবনা আছে তথাপি ছদ্মবেশে আত্মগোপন পূর্ব্বক সেই সভায় যাই চল, সেখানে সুরূপা সুন্দরী রমণী দিগকে নিরীক্ষণ করিয়া তাহাদের সহিত তুলনা করত হংসীর সহিত বায়সীর ন্যায় স্বীয় প্রেমাস্পদ প্রিয়তমা রোজালাইনকে নিঃসন্দেহ অপকৃষ্ট জানিতে পারিবে। রোমিও বন্ধুর এই বচনে যদিও মনোনীতা নায়িকার অপকৃষ্টতা বিশ্বাস করিলেন না তথাপি সেই সমাজে গমন করিলে প্রেয়সীর মনোহর রূপ নিরীক্ষণ করিয়া নয়ন দ্বয়ের চরিতার্থতা লাভ করিতে পারিব এই আশয়ে বয়স্য সমভিব্যাহারে গমন করিতে সম্মত হইলেন। রোজালাইনের প্রতি রোমিওর অকৃত্রিম প্রণয় জন্মে এজন্য আহার নিদ্রা বিসর্জ্জন করিয়া একান্ত চিত্তে কেবল তাঁহার চিন্তা করিতেন। কিন্তু রোজালাইন তাঁহাকে ভাল বাসিত না, অনুরাগের কোন চিহ্ণ কদাপি প্রকাশ করে নাই। এই কারণেই বেন্‌বোলিও বন্ধুকে নিঃস্নেহার প্রতি প্রীতি বন্ধন করিতে নিবারণ করিলেন। সে যাহা হউক রোমিও প্রেয়সী দর্শন মানসে ছদ্মবেশ পরিধান এবং মুখাবরণ ধারণ পুরঃসর আত্মগোপন করিয়া পরম সুহৃৎ বেন্‌বোলিও এবং মর্কুসিও সহিত ক্যাপিউলেত দিগের ভোজন স্থানে গমন করিলেন। ক্যাপিউলেত দলাধ্যক্ষ তাঁহাদিগকে মন্তেগ বংশীয় বলিয়া চিনিতে পারিলেন না, নিমন্ত্রিত জ্ঞানে যথোচিত অভ্যর্থনানন্তর কহিলেন আসন পরিগ্রহ পূর্ব্বক এই উৎসবের অবসান পর্যন্ত অবস্থিতি করুন আপনাদের সম্মুখে রূপবতী নর্ত্তকী রমণী সকল নৃত্য করিবে তাহাদের অপূর্ব্ব নৃত্যে অবশ্য আপনাদের চমৎকার বোধ হইবে। অনন্তর দলপতি তাঁহাদের মুখাবরণ দর্শন করিয়া কহিলেন আমি যৌবন দশায় তোমাদের ন্যায় এই রূপ বদনাচ্ছাদন ধারণ করিয়া কত শত যুবতীর কর্ণ সমীপে মুখ দিয়া গল্প করিয়াছি। তদনন্তর তৌর্য্যত্রিক আরম্ভ হইল। রোমিও নৃত্য কারিণী কোন কামিনীর অনুপম রূপ লাবণ্য অবলোকন করিয়া মুগ্ধ হইলেন। তাঁহার বোধ হইল তরুণীর শরীরের জ্যোতিঃ প্রদীপের প্রভা অপেক্ষা প্রকাশমান। নিশাসময়ে শ্যামবর্ণ পুরুষের গলদেশস্থ মহার্হ মণি ন্যায় রূপের ছটা বাহির হইতেছে। পরে আপনা আপনি কহিতে লাগিলেন বয়সী সংঘ সহিত কপোতিকা গমন করিলে সঙ্গিনীগণ অপেক্ষা তাহার যেমন শোভা প্রকাশ পায় এই রামা আপনার অনুপম কান্তিদ্বারা সেই রূপে সমস্ত সমভিব্যাহারিণী রমণীর রূপ লাবণ্য অভিভব করিয়া দীপ্তি পাইতেছেন। তাঁহার এই সমস্ত প্রশংসা বাক্য ক্যাপিউলেত দলপতির ভ্রাতৃপুত্র তাইবাল্‌ত শুনিতে পাইল এবং স্বর পরিচয়ে চিনিতে পারিল। তাইবাল্‌ত স্বভাবতঃ কোপন, ঐ কথা শুনিয়া মনে করিল বিপক্ষ পক্ষের এক ব্যক্তি ছদ্মবেশে আসিয়া উৎসব কালে পরিহাস করিতেছে। অতএব রোষ বশতঃ ভীষণ মূর্তি ধারণ পুরঃসর তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে শমন সদনে প্রেরণের উদ্যম করিল। সে তদণ্ডে স্বীয় সংকল্প সিদ্ধ করিতে পারিত, ক্যাপিউলেত দলপতি তাহাকে নিরস্ত করত কহিলেন এ সময় গোলযোগ উপস্থিত করিলে নিমন্ত্রিত লোকের বৈরক্তি জন্মিবে এবং এই যুবা রোমিও ভদ্রবেশে আসিয়াছে অধিকন্তু বেরোনাস্থ অপামর সাধারণ সকল লোকে মুক্তকণ্ঠে সুশীল ও ধার্ম্মিক বলিয়া ইহাঁর প্রতি প্রীতি করিয়া থাকে অতএব বিদ্রোহাচরণে ক্ষান্ত হও। তাইবাল্‌ত জ্যেষ্ঠ পিতৃব্যের অনুরোধে অগত্যা শান্ত মূর্ত্তি ধারণ পূর্ব্বক সেই অধ্যবসায় হইতে ক্ষান্ত হইল কিন্তু শপথ পূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা করিল সময়ান্তরে এ ব্যক্তিকে সমুচিত শাস্তি দিব।

 সে যাহা হউক, নৃত্য ভঙ্গ হইলে রোমিও আপনার মনোহারিণী সেই ভাবিনী যে স্থানে দণ্ডায়মানা ছিলেন আপনিও তথায় গিয়া দাঁড়াইলেন। মুখাবরণ গ্রহণে তাঁহার যে সাহস প্রকাশ হয় তজ্জন্য ত্রুটির ক্ষমা হওয়াতে শিষ্টতার সহিত কামিনীর কর ধারণ পূর্ব্বক কহিলেন হে সুন্দরি তোমার এই পাণিতল পবিত্র তীর্থ স্বরূপ। স্পর্শ করিয়া কি অপবিত্র করিলাম? আমার সংস্পর্শে যদিস্যাৎ অমেধ্য হইয়া থাকে তবে তো আমি অপরাধী হইলাম, পাপের প্রায়শ্চিত্ত নিমিত্ত ইহা কি চুম্বন করিব? যুবতী তাঁহার এই বাক্ কৌশলে সন্তুষ্ট হইয়া আপনিও বাগ্‌ভঙ্গি ক্রমে বলিলেন ওহে তোমার কথার দ্বারা বোধ হইল তুমি অচল ভক্তিমান কিন্তু তুমি কেমন তীর্থী? যাত্রিরা তীর্থ বাসি ঋষি গণের হস্ত স্পর্শ করিয়া থাকে কখন তো চুম্বন করে না? রোমিও কহিলেন তরুণি একটা কথা জিজ্ঞাসা করি ঋষি এবং যাত্রী উভয়ের কি ওষ্ঠাধর নাই? কামিনী কহিলেন থাকিবে না কেন? কিন্তু কেহ প্রার্থনা কালে ব্যবহার করে না। রোমিও কৌতুক করত কহিলেন তবে তুমি এ তীর্থের ঋষি সদৃশী, এক্ষণে আমার প্রার্থনা শুনিয়া বর দাও পশ্চাৎ যেন নিরাশ হইতে না হয়। দুই জনে এবম্প্রকারে রসিকতা প্রকাশ পুরঃসর বাগ্‌ভঙ্গি করিতেছেন ইতিমধ্যে তরুণীর জননী কন্যাকে নিকটে ডাকিলেন। রোমিও স্বীয় প্রেয়সীর প্রসূতির পরিচয় প্রাপ্ত হওয়াতে এক্ষণে জানিতে পারিলেন যাঁহার অসামান্য রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হইয়া প্রেমাকাঙ্ক্ষা করিতেছেন তিনি ক্যাপিউলেত পতির দুহিতা ও তদীয় উত্তরাধিকারিণী জুলিএত, বিপক্ষ পক্ষীয় একজন যুবার প্রতি প্রণয়িনী হইয়া তাঁহাকে আত্ম মনঃ সমপর্ণ করিয়াছেন। এই বৃত্তান্ত বিদিত হইলে যদিও তাঁহার মনোমধ্যে সাতিশয় ক্ষোভ জন্মিল তথাপি তরুণীর প্রতি প্রণয়ানুরাগ প্রকাশে পরাঙ্মুখ হইতে পারিলেন না। এদিকে জুলিএতও জানিতে পারিলেন যে পুরুষের সহিত বচন বৈদগ্ধী প্রকাশ পূর্ব্বক কথোপকথন করিয়া আসিলাম তিনি পিতার বিপক্ষ পক্ষ মন্তেগ বংশীয়। তখন নৈরাশ্য নীরধিতে নিমগ্না হইয়া নানা প্রকারে বিষাদ প্রকাশ করিতে লাগিলেন কেননা রোমিওর রূপ লাবণ্য ও অনুরাগ দর্শনে আপনি তাঁহার প্রণয় আকাঙ্ক্ষা করিতে ছিলেন কিন্তু তাহাতে কৃতকার্য্য হইতে পারিবেন না। অনন্তর যুবতী আপনার মনে ধিক্কার দিয়া কহিলেন আমি অতি নীচ প্রকৃতি, এবম্প্রকার প্রণয়াকাঙ্ক্ষাকে আপনার অন্তঃকরণে স্থান দান করি যে তাহাতে শক্রমিত্র জ্ঞান থাকিল না, যাহাকে পরম প্রেমের আস্পদ করিলাম বংশমর্য্যাদা সহকারে বিবেচনা করিলে সে ব্যক্তি ঘৃণার আধার হইতে পারে।

 জুলিএত জননীর আজ্ঞা পালনার্থ সত্বর প্রস্থান করিলে রোমিও নিশীথসময়ে বয়স্য সমভিব্যাহারে বহির্গত হইলেন কিন্তু তাঁহার মনোহারিণী যে স্থানে গমন করিলেন তাহা পরিত্যাগ পুরঃসর স্বালয়ে আসিতে সামর্থ্য হইল না। অতএব কৌশলে সমভিব্যাহারিদের সঙ্গ পরিহার পূর্ব্বক একটা প্রাচীরে লম্ফ প্রদান করিয়া প্রেয়সীর সদন সন্নিহিত উদ্যান মধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেই স্থানে গিয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করত চিত্তবিলাসিনীর চিন্তা করিতেছেন ইত্যবসরে উদ্যান সংলগ্ন প্রাসাদের উপরিস্থ গৃহের গবাক্ষদ্বার উদ্ঘাটিত হইল তাহাতে ঊর্দ্ধ দৃষ্টি হইয়া অবলোকন করিলেন পূর্ব্ব দিক্‌স্থ প্রাসাদোপরি হইতে প্রকাশ মান দিনমণির ন্যায় পরম শোভা বিস্তার করত প্রণয় ভাজন জলিএত সেখানে দণ্ডায়মানা। তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া নিশাকরের দিকে নয়ন নিক্ষেপ পুর্ব্বক কহিতে লাগিলেন এ কি! এই অদ্ভুত প্রভাকরের প্রদীপ্ত প্রভা প্রভাবে শশাঙ্ক নিষ্প্রভ হইলেন না কি? অনন্তর রমণী ভাবনা প্রযুক্ত করতলে গণ্ডস্থলাপর্ণ করিলে রোমিও সম্মিলনোৎসুক্য প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন হায়, বিধাতা আমাকে হস্তাবরণ করেন নাই কেন? তাহা হইলে এই চারুদর্শনার গণ্ডস্থল স্পর্শ করিয়া কৃতার্থ হইতাম। জুলিএত তাঁহাকে দেখিতে পান নাই এবং অন্যমনস্ক প্রযুক্ত তাঁহার কণ্ঠ শব্দও শুনিতে পাইলেন না, অদূরে কেহ নাই ভাবিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক আপনা আপনি কহিলেন হায় কি দুরদৃষ্ট। তরুণীর তন্মাত্র বচন রোমিওর শ্রবণ গোচর হওয়াতে সুখসাগরে মগ্ন হইয়া আহ্লাদ প্রকাশ পূর্ব্বক অনুচ্চস্বরে কহিলেন আহা কি মধুর স্বর। হে বিদ্যাধরি আর একটী কথা কহিয়া পুনর্বার অমৃত বর্ষণ কর। তুমি কি স্বর্গ হইতে অবতরণ পুরঃসর আমার সম্মুখস্থ এই প্রাসাদে দাঁড়াইলে। জুলিএতের অন্তঃকরণে সেই রজনী মধ্যেই সাতিশয় প্রণয়োদ্রেক হইয়াছিল নিকটে কেহ নাই বিবেচনা করিয়া অসঙ্কোচে নায়কের নাম গ্রহণ পুরঃসর স্বীয় মানস ব্যক্ত করিতে আরম্ভ করিলেন। মনের চাঞ্চল্য প্রযুক্ত চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলেন রোমিও২? আহা তুমি কেন রোমিও নাম গ্রহণ করিয়াছিলে? আমার নিমিত্ত আপনার এবং জনকের আখ্যা গোপন কর যদি তাহাতে অসম্মত হও বিনয় করি আমার নায়ক হইতে শপথ কর আমি এই দণ্ডে ক্যাপিউলেত বংশে জলাঞ্জলি দিব। রোমিও এবম্প্রকার আশ্বাস বচন স্বকর্ণে শ্রবণ করিয়া তৎক্ষণাৎ আত্মপ্রকাশ পুরঃসর উত্তর প্রদান করিতে পারিতেন, প্রেয়সীর সম্পূর্ণ মানস জিজ্ঞাসু হওয়াতে সবিশেষ বচন শ্রবণ করিতে বাসনা করিলেন। জুলিএত আপনাকে একাকিনী ভাবিয়া হৃদয়ের কপাট উদ্ঘাটন পুর্ব্বক মনোমধ্যে যে২ ভাবের আবির্ভাব হইয়াছিল স্পষ্ট বাক্যে সমুদায় প্রকাশ করিলেন। শেষে আপনার ভর্ৎসনা করত অধীরা হইয়া কহিলেন আমার অদৃষ্ট অতিশয় মন্দ, নচেৎ রোমিও কেন মন্তেগ বংশীয় হইলেন। আবার নায়ককে সম্বোধন করিয়া সস্নেহ বচনে বলিলেন হে প্রিয়তম তোমার রোমিও নামেই মহাসঙ্কট দেখি অতএব এ রোমিও সংজ্ঞাকে বিসর্জ্জন দাও তাহা হইলে মানস পূর্ণ করিতে পারিব। রোমিও প্রেয়সীর এই প্রেমামৃত বচনে প্রতিবচন না দিয়া থাকিতে পারিলেন না প্রসঙ্গ সঙ্গতি ক্রমে উত্তর প্রদান করিলেন তবে আমাকে মদন অথবা অন্য কোন সংজ্ঞা যাহা ইচ্ছা কর সেই অভিধানে আহ্বান কর। রোমিও নাম যদি তোমার অভীষ্ট সিদ্ধির প্রতিবন্ধক হয় আর আমি রোমিও নহি। জুলিএত উদ্যান মধ্য হইতে এবম্প্রকার মনুষ্য বাক্য শ্রবণ করিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন কোন্ ব্যক্তি নৈশ অন্ধকারের আশ্রয়ে থাকিয়া অন্তঃকরণের গুপ্ত কথা শ্রবণ করিল নির্ণয় করিতে অক্ষম হওয়াতে ভয়ে তাঁহার হৃৎকম্প হইতে লাগিল। কিন্তু প্রেমাসক্ত ব্যক্তির কি বিচিত্র স্মরণ শক্তি? যুবতী রোমিওর সহিত ভোজের সমাজে সাক্ষাৎ সময়ে যদিও তাঁহার বদন বিনির্গত শত কথাও শ্রবণ করেন নাই তথাপি এক্ষণে ঐ শব্দ শুনিয়া কিয়ৎক্ষণ অনুধাবনের পরে নিশ্চয় করিলেন এ আমার হৃদয়েশের স্বর, জীবিতেশ্বর এই স্থলে উপস্থিত আছেন সন্দেহ নাই। পরে তাঁহাকে নিকটে আহ্বান পূর্ব্বক আদৌ এই বলিয়া অনুযোগ করিতে লাগিলেন নিশীথ সময়ে প্রাচীর উল্লঙ্ঘন পূর্ব্বক এখানে প্রবেশ করিয়া আপনাকে এ কি বিষম সঙ্কটে নিক্ষেপ করিয়াছ? কোন ক্যাপিউলেত দেখিতে পাইলেই যে শমন সদনের আতিথ্য স্বীকার করাইবে। রোমিও কহিলেন প্রিয়ে আমি তাহাদের নেত্র পথে পতিত হইলে তাহারা আমার উপরি শস্ত্রাঘাত করিবে এইমাত্র বিপদ্ কিন্তু আমি তোমার নয়ন বাণে জর্জ্জরিত হৃদয় হইয়া তদপেক্ষা ঘোর বিপদে পতিত আছি, বিপন্নের বিপদে ভয় কি? এক্ষণে তুমি আমার প্রতি কৃপা কটাক্ষ নিক্ষেপ কর তাহাদের অস্ত্রাঘাতে ভয় করি না। তোমার প্রেম ব্যতিরেকে এই ঘৃণিত জীবন ধারণ করা অনুচিত, যদিস্যাৎ তাহারা আমাকে সংহার করে আমার পক্ষে তাহাই শ্রেয়ঃ। অনন্তর জুলিএত জিজ্ঞাসা করিলেন কি প্রকারে এ স্থানে আগমন করিলে? তােমার পথ প্রদর্শক কে? রােমিও উত্তর দিলেন সুন্দরি প্রেম আমার বর্ত্মোপদেশক, সে সামান্য ব্যক্তি নহে, যদিস্যাৎ তুমি সমুদ্র পারে থাকিতে তাহা হইলেও তােমার সহিত সঙ্গতি করিয়া দিতে পারিত। নায়কের সহিত পরিচয় হওয়াতে জুলিএত সাতিশয় লজ্জিত হইলেন মনে কহিতে লাগিলেন কি হইল অজ্ঞানতঃ আমার সমুদায় হৃদয়ের অভিপ্রায় বল্লভের নিকট প্রকাশ করিলাম। এই অপত্রপা জন্য তাঁহার বদন কিঞ্চিৎ ম্লান হইল কিন্তু রাত্রি প্রযুক্ত রােমিও লক্ষ্য করিতে পারিলেন না। লজ্জান্বিতা কামিনী দিগের রীতি এই যে প্রথমতঃ কর্কশ বচনে অভীপ্‌সিত নায়কের প্রার্থনা অগ্রাহ্য করে, দূরে থাকিয়া ত্রপা বশতঃ অনুরাগ সত্ত্বেও বিরাগ জানায় সুতরাং নায়কেরা প্রেয়সীর প্রতি প্রণয় বন্ধন কঠিন বােধে সাতিশয় যত্নবান হয়, যে বিষয় যাবৎ পরিমাণে আয়াস সাধ্য তাহার ততই গৌরব ও সমাদর হইয়া থাকে ইহাতে পরে প্রেম স্থাপন করিতে পারিলে একেবারে তদ্গত চিত্ত ও নিতান্ত বশম্বদ হইয়া পড়ে। জুলিএতও ঐ রীতির অতিক্রম করিতেন না কিন্তু এক্ষণে তাঁহার পক্ষে ঐ নিয়মের অনুবৃত্তি করা সুকঠিন হইল যেহেতু আপনার মুখে রোমিওর সমক্ষে তৎপ্রতি সাতিশয় প্রীতি ও তদর্থ ব্যাকুলতা প্রকাশ করিয়াছেন। অতএব নায়িকাদের সামান্য রীতির অনুবর্ত্তিনী হইতে পারিলেন না, নায়ক সাক্ষাতে তখনই সরলভাবে আপনার পূর্ব্ব বাক্য সকলের পুনরুক্তি করিতে হইল। অনন্তর নিরতিশয় প্রীতির প্রভাবে নায়কের উগ্র নাম স্নিগ্ধ করত রোমিওর পরিবর্ত্তে তাঁহাকে মন্তেগ বলিয়া সম্বোধন পূর্ব্বক কহিলেন নাথ আমি এতাদৃশী অধীরা হইয়া আপনাতে আত্মসমর্পণ করিয়াছি এ বিষয় কোন চপল স্বভাব ব্যক্তির নিকট যেন প্রকাশ না হয় তাহাতে কলঙ্ক সম্ভাবনা। মনোমধ্যে সর্ব্বদাই বিবিধ ভাবের আবির্ভাব হইয়া থাকে আমি নির্জন জানিয়া আপনা আপনি কহিতেছিলাম তাহাতে যদি তোমার প্রতি কোন প্রকার বিভাব অথবা কঠিনতা প্রকাশ হইয়া থাকে ক্ষমা করিও। হে প্রিয়তম কোন নায়িকা নায়কের প্রতি আদৌ প্রাতিকূল্য প্রকাশ করিয়া থাকে আমি তাহা করিলাম না ইহাতে কি অধিক বিশ্বাস পাত্রী হইতে পারি না?

 রোমিও মনোহারিণী ভাবিনীর নাম কলঙ্কিত করিবেন কখন মনেও করেন নাই, প্রেয়সীর প্রমুখাৎ তাদৃশ আশঙ্কার কথা শ্রবণে মর্ম্মান্তিক বেদনা প্রকাশ পুরঃসর শপথ করিতে উদ্যত হইলেন। যুবতী তাঁহাকে নিবারণ পূর্ব্বক কহিলেন আমি তোমার হস্তে জীবন সমপর্ণ করিয়াছি যাহা ইচ্ছা করিবে, দিব্য করিবার প্রয়োজন নাই, কিন্তু হে হৃদয় বল্লভ এই রাত্রিতেই সম্মিলনের সুখ অনুভব করিতে উৎসাহ হইতেছে না, কেননা বিশেষ বিবেচনা ও পরামর্শ ব্যতিরেকে সম্প্রীতি করা শ্রেয়স্কর নহে। রোমিও সেই নিশীথেই পরস্পর প্রণয় স্থাপন পূর্ব্বক মনস্কামনা পূর্ণ করতে সাতিশয় ব্যগ্র হইলেন তাহাতে তরুণী বিনীতি প্রদর্শন পূর্ব্বক মধুর বচনে কহিলেন, প্রিয়তম তোমার বাসনা পুর্ব্বেই পরিপূর্ণ হইয়াছে, বর্ণন করিবার আবশ্যক নাই, আমার মনের কথা স্বকর্ণে শুনিয়াছ। পূর্ব্বে প্রাণ সমর্পণ করিয়াছি এখনও অপর্ণ করিতে স্বীকার করিতেছি। ফলতঃ তাঁহার দানশক্তি সাগর তুল্য অপার, এবং প্রেমেরও পরিচ্ছদ ছিল না। নায়ক নায়িকা এই প্রকারে কথোপকথন করিতেছেন ইত্যবসরে জুলিএতের ধাত্রী তাঁহাকে আহ্বান করিল। সে বৃদ্ধা একত্র শয়ন করিত শয্যায় আরোহণের সময় উপস্থিত হওয়াতে ডাকিল। জুলিএত শয়নার্থ সঙ্গিনীর আহ্বানে জানিতে পারিলেন প্রভাতের অধিক বিলম্ব নাই অতএব প্রিয়তমকে ত্বরায় বিদায় করণার্থ সংক্ষেপে এই কথা কহিলেন আমার প্রণয়ে, যদি তোমার সম্মান বোধ হয় এবং পাণিগ্রহণের অভিপ্রায় থাকে বল তাহা হইলে আগামি দিবস দূতী প্রেরণ পূর্ব্বক কাল অবধারিত করি আমি আত্ম ভাগ্য আপনার চরণে সমর্পণ পূর্ব্বক যাবজ্জীবন অনুগামিনী হইব। তাঁহাদের এই কথোপকথনের সময়ে ধাত্রী বারম্বার ডাকিতে লাগিল এবং ক্রমেই নিকটে আসিবার উপক্রম করিল। এ দিকে রোমিওর প্রণয় বচন রূপ রজ্জু দ্বারা তাঁহার মনঃ আকৃষ্ট হইতে ছিল সুতরাং কামিনী বিষম সঙ্কটে পড়িলেন। পরিশেষে বিচ্ছেদ ভয়ে উভয়ের হৃদয় ব্যাকুল হইলেও সেই রাত্রির জন্য পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইয়া বিশ্রামার্থ স্ব২ স্থানে প্রস্থান করিলেন।

 জুলিএত শয়নার্থ গমন করিলে রোমিও অরুণোদয়ের কিয়ৎ মুহূর্ত পূর্ব্বে উদ্যান হইতে নির্গত হইলেন কিন্তু গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন না, প্রাণসমা প্রিয়তমার সহিত পরম সুখাবহ যে সাক্ষাৎকার হইল এতদ্বিষয়ের চিন্তা করিতে২ লরেন্স নামক এক সন্ন্যাসির মঠে গিয়া উপস্থিত হইলেন। সুশীল ধর্ম্মিষ্ঠ লরেন্স সে সময় প্রাতঃকালীন উপাসনা করিতেছিলেন নিত্যক্রিয়া সমাপন করিয়া ইতস্ততো দৃষ্টি নিক্ষেপ করাতে দেখিলেন রোমিও আসিয়াছেন। তাঁহার চক্ষুর্দ্বয় নিরীক্ষণ করিয়া অনুমান করিলেন এ ব্যক্তি সমস্ত নিশা শয্যা স্পর্শ করে নাই, যৌবনের কোন কার্য্যে অর্থাৎ কামিনী সহ সমাগমে রজনী জাগরণ করিয়া আসিল। লরেন্সের বিদিত ছিল রোজালাইনের প্রতি রোমিও সস্পৃহ আছেন, আশঙ্কা করিলেন সেই কামিনীর সহিত সমাগমই বুঝি ইহার অনিদ্রার কারণ। কিন্তু অবিলম্বে রোমিও যখন জুলিএতের সঙ্গে নূতন প্রণয়ের বৃত্তান্ত জ্ঞাপন পূর্ব্বক ঐ দিবসে উভয়ের পরিণয় সম্পাদন নিমিত্ত তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন তখন হঠাৎ প্রীতি পরিবর্ত্তের ব্যাপারে চমৎকৃত হইলেন। অনেক ক্ষণ হস্ত ও নয়নের ভঙ্গি করত তর্ক বিতর্ক পূর্ব্বক আপনা আপনি যেন কিছু কহিতে লাগিলেন। অনন্তর ব্যক্ত করিয়া বলিলেন তরুণদিগের প্রণয় হৃদয়ে থাকে না, নয়নদ্বয় তাহার আধার, ওহে রোমিও তুমি আপনিই রোজালাইনের প্রতি সাতিশয় অনুরাগের কথা কহিতে না? রোমিও প্রতিবচন প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন আমিই তাহার সহিত প্রণয়াকাঙ্ক্ষায় সাতিশয় স্নেহ করিতাম সে আমার প্রতি অনুরাগ মাত্র প্রদর্শন করে নাই, তজ্জন্য আপনিই কত বার ধিক্কার দিয়াছেন মনে পড়ে না? কিন্তু জুলিএত স্বয়ং আমার প্রতি প্রণয় স্থাপন করিয়াছেন এবং আমিও তাঁহার রূপ গুণে পরম প্রীত হইয়াছি অতএব এ বিষয়ে পরস্পরের প্রতি বৃদ্ধির অসম্ভাবনা মাত্র নাই। লরেন্স এ কথা শুনিয়া সন্তুষ্ট হইলেন এবং তাঁহার প্রার্থনা অগ্রাহ্য করিলেন না। এই সন্ন্যাসী ক্যাপিউলেত এবং মন্তেগ দুই পরিবারের হিতাকাঙ্ক্ষী, দুই বংশের পরস্পর অপ্রীতি দেখিয়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন। মধ্যস্থ হইয়া তাঁহাদের বিবাদ ভঞ্জন নিমিত্ত কত বার যত্ন করিয়াছিলেন। এক্ষণে রোমিও ও জুলিএতের মনে পরস্পর প্রণয় সঞ্চারের বৃত্তান্ত অবগত হইয়া মনে করিলেন ইহাদের পরিণয় হইলে ঐ দুই পরিবারের বিরোধ ভঞ্জন পুরঃসর সম্প্রীতি হইতে পারিবে। অতএব কৌশলক্রমে জুলিএতের সহিত রোমিওর বিবাহ নির্বাহ করিয়া দিতে স্বীকার করিলেন।

 অনন্তর জুলিএত দূতী দ্বারা নায়কের অভিপ্রায় অবগত হইয়া অবিলম্বে সেই সন্ন্যাসির আশ্রমে আগমন করিলেন তাহাতে ঐ স্থানে তাঁহাদের পরিণয় সম্পন্ন হইল। রোমিও পরম প্রণয় ভাজন প্রেয়সী লাভে কৃতার্থম্মন্য হইয়া আপনাকে মহা সুখী বোধ করিলেন। সুশীল সন্ন্যাসী বিবাহাব সানে দেবগণের সন্নিধানে প্রার্থনা করিলেন হে অমর নিকর প্রসন্ন হউন, আপনাদের প্রসাদে এই ব্যাপারোপলক্ষে ক্যাপিউলেত এবং মন্তেগ উভয় পরিবারের চির বিরোধ যেন দূরীভূত হয়।

 পরিণয় সমাধা হইলে জুলিএত আপনার ভবনে প্রত্যাগমন করিলেন এবং পূর্ব্ব নিশায় যে স্থানে সাক্ষাৎ হয় প্রিয়তম রোমিও সে দিন সায়ং সময়ে সেখানে গিয়া মিলিত হইবেন প্রতিজ্ঞা করাতে অধীর হইয়া দিবাবসানের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। বালক যেমন উৎসবের উপলক্ষে পুর্ব্বাহ্ণে ইচ্ছানুরূপ বসন ভূষণ পাইয়া পর দিন প্রাতঃকাল পর্য্যন্ত তাহা পরিধান করিতে না পারিলে উৎকণ্ঠায় অধীর হয় জুলিএতও নায়কের নিমিত্ত তদ্রূপ অস্থির হইলেন।

 সেই দিবস বেলা দুই প্রহরের সময় রোমিওর মিত্র বেন্‌বোলিও এবং মর্কুসিও এই দুই জন বেরোনার বর্ত্ম দিয়া গমন করিতেছিলেন, ক্যাপিউলেত বংশীয় কতিপয় ব্যক্তির সহিত তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইল। কোপন প্রকৃতি যে তাইবাল্‌ত ক্যাপিউলেত দলাধিপতির ভোজ সমাজে রোমিওকে নিরীক্ষণ করিয়া জাতক্রোধ হয় এবং বৈর নির্যাতন নিমিত্ত তাঁহাকে শমন সদনে প্রেরণের প্রতিজ্ঞা করে সে ব্যক্তিও ঐ কএক জনের মধ্যে ছিল। তাইবাল্ত মর্কুসিওকে ডাকিয়া নানা প্রকার কটূক্তি দ্বারা ভর্ৎসনা করিতে লাগিল এবং আক্রোশ পূর্ব্বক কহিল অরে তুই না মন্তেগ বংশীয় রোমিওর বন্ধু? দাঁড়া, তোকে কিছু, শিক্ষা দি। মর্কুসিও বলিষ্ঠ, এবং তাইবাল্ত অপেক্ষা তাহার সাহস অল্প ছিল না, সুতরাং সমুচিত উত্তর প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন। বেন্‌বোলিও তাহাদের এই বাক্ পারুষ্যে ক্রমে দণ্ডপারুষ্য উৎপন্ন হইবার ভয়ে উভয়কে শান্ত করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন, ইত্যবসরে রোমিও সেই পথ দিয়া যাইতে২ তথায় উপস্থিত হইলেন। কোপাবিষ্ট তাইবাল্‌ত দেখিবামাত্র মর্কুসিওকে পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহার প্রতি কটূক্তি করিয়া বিবাদের উপক্রম করিল। রোমিও তাহাকে আপন প্রিয়তমা জুলিএতের জ্ঞাতি এবং স্নেহ পাত্র জানিয়া তাহার কুবাক্যে রোষ পরবশ হইলেন না বরং কলহ নিবারণের চেষ্টা করিলেন। তাঁহার স্বাভবিক ধীরতা প্রযুক্ত বিবাদ বিসম্বাদে সহসা প্রবৃত্তিই হইত না, এক্ষণে প্রণয়িনী ক্যাপিউলেত বংশীয়া হওয়াতে যদিও কোন কারণ বশতঃ ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইত তথাপি ক্যাপিউলেতের নাম শ্রবণ গোচর হইলে তাহা নির্বাণ হইয়া যাইত। অতএব তাইবাল্‌তের তিরস্কারে রাগ করিলেন না বরং তাহার বংশের নাম শ্রবণেও আপনি পরম পরিতুষ্ট হন এবম্বিধ ভাব প্রকাশ পূর্ব্বক ভদ্র বলিয়া সম্বোধন করত উপদেশ বাক্যে শান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাইবাল্‌ত মন্তেগ দিগকে নরকি তুল্য জ্ঞান করিয়া যৎপরোনাস্তি ঘৃণা করিত, রোমিওর কথায় কর্ণপাত না করিয়া তাঁহার প্রাণ সংহারার্থ রোষে কোষ হইতে করবাল বাহির করিল। মর্কুসিও রোমিওর কথা শুনিয়া মনে করিলেন বন্ধু তাইবাল্‌তের বলে ভীত হইয়া ইহার সহিত সম্প্রীতির চেষ্টা করিতেছেন অতএব মন্তেগ বংশের অসম্মান ভাবিয়া স্বয়ং ভীষণ মূর্তি ধারণ পুরঃসর তাইবাল্‌তের প্রতি বিজাতীয় আক্রোশ প্রকাশ করিতে লাগিলেন তাহাতে মর্কুসিওর সঙ্গেই বাহাবাহবি আরম্ভ হইল এবং তাইবাল্‌ত অবিলম্বে তরবারি প্রহারে তাঁহার শিরশ্ছেদন করিল। রোমিও এত ক্ষণ পর্য্যন্ত ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক বেন্‌বোলিও মিত্রের সহিত তাহাদিগকে শান্ত করিতে চেষ্টা করিতেছিলেন মর্কুসিওর প্রাণ সংহার দেখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। কোপ প্রজ্বলিত হইয়া তাইবাল্‌তের প্রতি ধূর্ত নরাধম ইত্যাদি দুর্বাক্য প্রয়োগ পূর্ব্বক বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন এবং মহাক্রোধে শৌর্য্য প্রকাশ পুরঃসর অবিলম্বে তাহাকে পরাস্ত করিয়া সমরশায়ি করিলেন। বেরোনার রাজবর্ত্মে দিবা দ্বিতীয় প্রহরের সময় এই সংগ্রাম হওয়াতে মহা জনতা হইল। মন্তেগ এবং ক্যাপিউলেত দুই দলের অধ্যক্ষেরা সংবাদ পাইয়া সপরিবারে দেখিতে আসিলেন। অনতি বিলম্বে দেশাধিপতির কর্ণ গোচর হওয়াতে স্বয়ং তিনিও আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজা বেরোনা নগরী মধ্যে সর্ব্বদা বিবাদ বিসম্বাদ নিমিত্ত পূর্ব্বাবধি সাতিশয় উত্ত্যক্ত ছিলেন এক্ষণে তদুপলক্ষে জ্ঞাতি মর্কুসিওকে নিহত দেখিলেন সুতরাং তাঁহার কোপের পরিসীমা রহিল না। অপরাধিদিগের প্রতি সমুচিত দণ্ড করিতে দৃঢ়তর প্রতিজ্ঞা করিলেন। বেন্‌বোলিও এই ব্যাপার প্রথমাবধি সমুদায় অবলোকন করাতে তাঁহাকে বৃত্তান্ত কহিতে আজ্ঞা দিলেন। বেন্‌বোলিও কৌশল ক্রমে এরূপ করিয়া ঐ বিষয় বর্ণনা করিলেন যে সত্য কথা বলা হইল অথচ রোমিও কিম্বা তাঁহার সপক্ষ গণের কোন প্রকার দোষ প্রমাণ হইল না। ক্যাপিউলেত দলাধিপতির বনিতা তাইবাল্‌তের মৃত্যুতে মহা শোকার্ত্তা হইয়া বৈর প্রতিক্রিয়ার মানসে অতিশয় বিনয় ও ব্যগ্রতা পূর্ব্বক এই বিষয়ে যথার্থ বিচার করিতে পুনঃ২ অনুরোধ করিলেন এবং কহিলেন মহারাজ বেন্‌বোলিওর বাক্যে বিশ্বাস করিবেন না, সে স্বয়ং মন্তেগ বংশীয় এবং রোমিওর পরম সুহৃৎ, পক্ষপাত করিয়া মিথ্যা কহিতেছে। এই রূপে ঐ মহিলা আপনার জামাতার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিতে লাগিলেন কিন্তু স্বয়ং জানেন না যে রোমিও তাঁহার দুহিতার পতি। পক্ষান্তরে মন্তেগ দলপতির গৃহিণী আত্ম তনয়ের প্রাণ রক্ষার্থ কাতরতা প্রকাশ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন মহারাজ ব্যবস্থানুসারে রোমিওর প্রতি দণ্ড বিধান অর্হে না, তাইবাল্‌ত মর্কুসিওকে বিনষ্ট করিয়া রোমিওর উপর আততায়ী হইয়াছিল, বধোদ্যতের বধে অপরাধ নাই। এই রূপে দুই দলের অবলাদ্বয় মহা গণ্ডগোল উপস্থিত করিলেন কিন্তু রাজা তাহাতে মনোযোগ করিলেন না বিশেষ বিবেচনা পূর্ব্বক রোমিওকে নির্বাসিত করিতে আজ্ঞা দিলেন।

 জুলিএত কিয়দ্ঘটিকামাত্র পূর্ব্বে রোমিওর গলে ররমাল্য প্রদান করিয়া আসিয়াছিলেন। তাঁহার প্রতি নির্বাসন দণ্ড বিধানের বিষয় বিদিত হইলে চিরকালের নিমিত্ত বিচ্ছেদ হইল ভাবিয়া বিষাদ সাগরে মগ্নী হইলেন। পিতৃব্যতনয় তাইবাল্‌তের হত্যা শ্রবণ করিয়া আদৌ কামিনীর মহা কোপ হইয়াছিল তন্নিমিত্ত হত্যাকারি রোমিওকে শ্রীমান্ দুরাত্মা, দেবরূপী দৈত্য, দ্রোণ কাকোপম কপোত, বৃকের প্রকৃতিধারি মৃদু মেষ, কুসুমবৎ কোমল শরীর অথচ সর্পবৎ ক্রূর হৃদয় ইত্যাদি কোমল কটু ভাষায় তিরস্কার করেন কিন্তু সেই হত্যার নিমিত্ত প্রাণ প্রতিম রোমিও নির্বাসিত হইবেন এতদ্বিষয় অবগত হইলে তজ্জন্য শোক কোপকে পরাভূত করিয়া প্রবল হইয়া উঠিল। ভ্রাতৃবিয়োগ হেতু তাঁহার নয়নদ্বয় হইতে অনর্গল করুণাশ্রু নির্গত হইতেছিল এক্ষণে যখন প্রিয়তমের বিষয় চিন্তা করিলেন তখন নিধন সম্ভাবনা সত্ত্বেও তাঁহার জীবন রক্ষা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া আহ্লাদিত হওয়াতে তাহাই আনন্দাশ্রু স্বরূপ হইল। পরন্তু দণ্ডের কথা পুনর্বার মনে হওয়াতে পতি শোকেই অধীর হইলেন এবং শত সহস্র তাইবাল্‌তের মৃত্যু অপেক্ষা স্বামির নির্বাসন মহা ক্লেশদায়ক বোধ করিতে লাগিলেন।

 রোমিও পথিমধ্যে এই ভয়ানক বিবাদ করিয়া সমরাবসানে লরেন্স সন্ন্যাসির আবাসে গিয়া আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে বসিয়া শুনিলেন তাঁহার প্রতি দেশান্তরি হইবার আদেশ হইয়াছে অতএব তাঁহার মানসিক ক্লেশের পরিসীমা রহিল না, মৃত্যু অপেক্ষা নির্বাসনের দুঃখ গুরুতর বোধ করিলেন। জন্মাবচ্ছেদে কখন বেরোনা নগরের বহির্ভাগে গমন করেন নাই নগরের বাহিরে পৃথিবী আছে কি না ইহাও জানিতেন না। এক্ষণে দেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক কোথা যাইতে হইবে ভাবনায় অস্থির হইলেন। অধিকন্তু মনে করিলেন অন্যত্র জুলিএতের চন্দ্রানন দেখিতে পাইব না অতএব যদিও বাঁচিয়া থাকি তথাপি বৃথা জীবন হইবে। যে স্থানে জুলিএত সেই স্বর্গ, তিনি যেখানে নাই তাহা নরকাপেক্ষাও ক্লেশকর। লরেন্স বিবিধ প্রবোধ বাক্যে তাঁহাকে শান্ত্বনা করিতে লাগিলেন কিন্তু রোমিওর তাহাতে শোক শান্তি হইল না বরং শোকাবেগ ক্রমে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইয়া তাঁহাকে অধীর করিল। উন্মত্তবৎ হইয়া উচ্চ স্বরে হাহাকার ও শিরে করাঘাত এবং কেশ ছিন্ন করিতে আরম্ভ করিলেন। অপর ভূমি শয্যায় শয়ান হইয়া হস্ত পদাদি বিস্তার পূর্ব্বক বারম্বার কহিতে লাগিলেন দেখি আমার সমাধি স্থান দীর্ঘ প্রস্থে কত হইবেক। রোমিও শোকাভিভূত হইয়া এবম্প্রকারে ব্যাকুলতা প্রকাশ করিতেছেন ইত্যবসরে তদীয় প্রিয়তমা সমীপ হইতে কোন সমাচার আসিল তাহাতে যৎকিঞ্চিৎ ধৈর্য্যাবলম্বন করিলেন। সেই অবকাশে তাঁহার পরম সুহৃৎ লরেন্স সন্ন্যাসী নানা প্রকার প্রবোধ দিয়া কহিলেন তুমি তাইবাল্‌তকে সমরে নিহত করিলে আবার কি আপনার ও আপন প্রিয়তমা পত্নীর প্রাণ নাশ করিবে? শোকে অধীর হইলে শৌর্য্য গাম্ভীর্য কিছুই থাকে না, স্থির হও, কেন ব্যাকুল হইতেছ? দেশের ব্যবস্থায় তোমার পক্ষে বরং অনুগ্রহ প্রকাশ হইয়াছে, তুমি তাইবাল্‌তকে প্রাণে সংহার করিলে, তাইবাল্‌ত তো তোমার প্রাণ বিনাশ করিতে পারে নাই এবং দণ্ড ব্যবস্থাতেও তাদৃশ বিধান হইল না, তবে কেন কাতর হইতেছ? জীবন রক্ষা হইল ইহাতে সৌভাগ্য জ্ঞান করা উচিত হয়। তোমার প্রেয়সী জুলিএত স্বেচ্ছা পূর্ব্বক তোমাকে পতিরূপে বরণ করিয়াছেন তাঁহার জীবনে কোন ব্যাঘাত হয় নাই ইহাও কি তোমার সুখের বিষয় নহে? লরেন্স এবম্বিধ বিবিধ প্রবোধ বাক্যে যত বুঝাইলেন কিছুতেই রোমিও ধৈর্য্যাবলম্বন করিতে পারিলেন না, মানিনী কামিনীদের ন্যায় তদুক্ত সকল কথা অগ্রাহ্য করিলেন। শেষে সন্ন্যাসী কহিলেন বৎস নৈরাশ্য পরম অনিষ্টের কারণ, আশাকে বিসর্জ্জন করিয়া অনেক ব্যক্তি ঘৃণিতরূপে কৃতান্তের করাল দশনে পতিত হইয়াছে, আশ্বস্ত হও। ইহাতে কিয়ৎ পরিমাণে শান্ত চিত্ত হইলে তাঁহাকে পরামর্শ দিলেন অদ্য রজনীযোগে জুলিএতের আলয়ে গমন পূর্ব্বক তাঁহার নিকট বিদায় লইয়া মান্তুয়া গ্রামে যাত্রা কর। কিয়ৎ কাল ঐ স্থানে অবস্থান করিলে পরে আমি সুযোগক্রমে তোমাদের বিবাহের কথা প্রচার করিয়া দিয়া উভয় পরিবারের মধ্যে পরস্পর প্রীতি স্থাপন করিয়া দিব। কালাতিক্রমে দেশাধিপেরও ক্রোধ শান্তি হইবে তখন তোমার প্রতি অনুকম্পা প্রকাশ পুরঃসর ক্ষমা করিলেও করিতে পারিবেন অতএব এক্ষণে তুমি যে প্রকার শোকের সহিত নির্বাসিত হইতেছ এতদপেক্ষা বিংশতিগুণ আনন্দ সহ পুনর্ব্বার এই বেরোনা নগরে প্রত্যাগমন করিতে পারিবে। রোমিও শোকাবেগ কিয়ৎ পরিমাণে শান্ত হওয়াতে হিতৈষি সন্ন্যাসির ঐ সকল উপদেশ বাক্য মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করিলেন। তদনুসারে কার্য্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়া স্থির করিলেন সায়ংকালে প্রিয়তমার সমীপে বিদায়ার্থ গমন করিব। অদ্যকার নিশা তাঁহার সহিত যাপন করিয়া প্রত্যুষে একাকী মান্তুয়ায় প্রস্থান করিতে পারিব। রোমিওর মনঃ স্থির হইলে সন্ন্যাসী অঙ্গীকার করিলেন সময়ে২ লিপি যোগে স্বদেশের সমস্ত সংবাদ প্রেরণ করিব।

 সায়ংকাল উপস্থিত হইলে রোমিও জুলিএতের নিকট যাত্রা করিলেন। পূর্ব্ব দিবস নিশাভাগে যে উদ্যানে বসিয়া প্রেয়সীর সহিত কথোপকথন করিয়াছিলেন তাহা অতিক্রম করিয়া সে দিন একেবারে শয়ন মন্দিরে গিয় উপস্থিত হইলেন। জুলিএত তাঁহাকে অবলোকন করিয়া সমাদর পূর্ব্বক গ্রহণ করিলেন কিন্তু পূর্ব্বরাত্রে যে প্রকার পরস্পর কথোপকথনে আনন্দানুভব করেন এ রাত্রি উভয়ের সহবাসেও তাদৃশ সুখোদয় হইল না। দিবসের ভয়ানক ঘটনা এবং ভাবি দিনে অবশ্যম্ভাবি বিচ্ছেদ স্মরণ করিয়া দুই জনে সশোক চিত্তে সেই যামিনী যাপন করিলেন। অশুভ দিন আশু আসিয়া উপস্থিত হয়, কথা যোগেই নিশার অবসান হইল এবং চাতকের প্রাতঃকালীন কূজন নায়ক নায়িকার শ্রবণ বিবরে প্রবিষ্ট হইতে আরম্ভ হইল। জুলিএত প্রথমতঃ সেই রবকে নিশীথ বিহারি শ্যামা পক্ষির কণ্ঠধ্বনি জ্ঞান করিয়া আমোদ করিতে ছিলেন কিন্তু পরে যখন বোধ হইল চাতকেরাই গান করিতেছে তখন প্রভাত নিকটবর্ত্তী এবম্প্রকার বোধ হওয়াতে বৈরক্তি ও অসুখ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পূর্ব্বদিকে দৃষ্টিপাত হওয়াতে যখন নিরীক্ষণ করিলেন অরুণের কিরণ ক্রমশঃ প্রকাশমান তখন বিচ্ছেদের সময় উপস্থিত হইল ভাবিয়া নিতান্ত খিন্না হইলেন। রোমিও ম্লানবদনে প্রণয়িনীর সন্নিধানে বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক অঙ্গীকার করিলেন মান্তুয়া গ্রামে অবস্থিতি করিব বটে কিন্তু লিপি যোগে প্রতিদণ্ডে তোমার নিকট সংবাদ প্রেরণ করিব। এই বলিয়া বাতায়ন দ্বার দিয়া নিম্নে অবরোহণ করিলেন। জুলিএত অনিমেষ নয়নে তাঁহার আকৃতি নিরীক্ষণ করিতেছিলেন শোক ব্যাকুলতা প্রযুক্ত বোধ করিতে লাগিলেন যেন সমাধি মন্দিরের তলে একটী নির্জীব দেহ রহিয়াছে। রোমিওরও অন্তঃকরণে কাতর্য্য বশতঃ তাদৃশ ভাবের আবির্ভাব হইল কিন্তু এক্ষণে বিলম্ব করিতে পারিলেন না কেননা সূর্য্য প্রকাশ হইলে যদিস্যাৎ বেরোনার সীমামধ্যে কাহারও নয়নপথে পতিত হন তৎক্ষণাৎ শমন সদনের আতিথ্য স্বীকার করিতে হইবে।

 রোমিও বেরোনা নগর হইতে প্রস্থান করিলে কিয়দ্দিন পরে ক্যাপিউলেত দলাধিপতি আপন তনয়া জুলিএতের বিবাহের কথা উথাপন করিলেন, রোমিও কর্ত্তৃক কন্যা পরিণীতা হইয়াছে স্বপ্নেও জানিতে পারেন নাই, পাত্রসাৎ করণার্থ কৌন্ত পেরিস নামক সৎকুলীন এক যুবাকে বরপাত্র স্থির করিলেন। জুলিএত যদিস্যাৎ রোমিওর রূপ লাবণ্য অবলোকন না করিতেন তাহা হইলে কৌন্ত তাঁহার অযোগ্য হইতেন না।

 জুলিএত বিবাহের উদ্‌যোগ দেখিয়া সাতিশয় উদ্বিগ্না হইলেন এবং জনক সন্নিধানে গিয়া আপনার অসম্মতি প্রকাশ পূর্ব্বক কহিলেন পিতঃ এ পরিণয়ের উপযুক্ত সময় নহে, সে দিন আমার পরম স্নেহাস্পদ ভ্রাতা তাইবাল্‌তের মৃত্যু হইয়াছে এখনও শোক শান্তি হয় নাই, ইতিমধ্যে কি প্রকারে স্বামি সহ সাক্ষাৎ করিতে চিত্তে আনন্দোদয় হইবে? অধিকন্তু একটা মহাবিষাদকর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া এই সেদিন সম্পন্ন হইল অবিলম্বে বিবাহোৎসব করিলে লোকেই বা কি কহিবে? যুবতীর ঐ বিষয়ে অসম্মতি প্রকাশের প্রকৃত কারণ এই যে বিবাহিতা হইয়াছেন পুনর্বার আবার পরিণয় কি? কিন্তু এ কথা প্রকাশ করিলেন না। তাঁহার পিতা ঐ আপত্তি গ্রাহ্য করিলেন না, প্রতিবচন পাঠাইয়া দিলেন কন্যাকে প্রস্তুত হইতে কহ সমুদায় আয়োজন হইয়াছে আগামি গুরু বাসরে কৌন্ত পেরিসের সহিত বিবাহ হইবেক। অধিকন্তু কহিলেন ধনবান রূপবান সৎকুলীন পাত্র পাইয়াছি বেরোনা নগরীয়া সুরূপা সুন্দরীরা তাদৃশ বর লাভে চরিতার্থতা বোধ করিতে পারেন, কন্যার কৃত্রিম অপত্রপা জন্য কি তাদৃশ সৎপাত্র পরিত্যাগ করিব? হতভাগ্যার ভাগ্যে সুখসম্পত্তি নাই না কি? এ কি? আপনার সৌভাগ্যে আপনি কেন প্রতিবন্ধক হয়?

 জুলিএত বিষম সঙ্কটে পতিতা হইলেন। উপস্থিত বিপদের সমস্ত বৃত্তান্ত বন্ধু লরেন্সের সুগোচর কবিয়া পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। সন্ন্যাসী তাঁহার পরম হিতৈষী, চিন্তাযোগে উপায়াবধারণ পূর্ব্বক কহিলেন তুমি একটা উগ্রতর ঔষধ সেবন করিতে পারিবে কি না? জুলিএত প্রতিবচন প্রদান করত বলিলেন ঔষধ সেবন তো ক্ষুদ্র কথা, যে ব্যাপার উপস্থিত তাহাতে জীবদ্দশায় সমাধি মন্দিরে প্রেরণ করিলেও সম্মত আছি, এ কি সামান্য বিপদ্ আমার পরম প্রেমাস্পদ পাণিগ্রাহ পতি রোমিও জীবিত রহিলেন কৌন্ত পেরিসকে বিবাহ করিতে হইবে? লরেন্স কহিলেন তবে এক কর্ম্ম কর, গৃহে গিয়া পিতার আদেশ ক্রমে তাঁহার নির্দ্দিষ্ট পাত্রকে বরণ করিতে সম্মত হও, আমি এই এক ঔষধ প্রদান করিতেছি গ্রহণ পূর্ব্বক নিকটে রাখ, পরিণয়ের পূর্ব্ব রাত্রে ইহা সেবন করিও, এই অগদের গুণে দ্বিচত্বারিংশৎ ঘটিকা কাল মৃতবৎ অচেতন হইয়া থাকিবে সুতরাং প্রাতঃ কালে লোকেরা বিবাহ সমাজে গমন নিমিত্ত আহ্বান করিতে আসিয়া তদবস্থান্বিত দেখিলে আকস্মিক মৃত্যু নিশ্চয় করিবে। পরে এতদ্দেশের আচারানুসারে বিনা আচ্ছাদনে তোমাকে শ্মশান ভূমিতে নিক্ষেপ নিমিত্ত নির্হার করিয়া লইয়া যাইবেক সন্দেহ নাই। যদিস্যাৎ স্ত্রীস্বভাবোত্থ স্বাভাবিক ভয় পরিত্যাগ পূর্ব্বক সাহসে নির্ভর করিয়া এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইতে পার ৪২ ঘণ্টার পর সুপ্তোথিতের ন্যায় পুনর্বার জাগ্রৎ হইয়া নয়নোন্মীলন পূর্ব্বক দেখিবে পিতা মাতা জ্ঞাতি বান্ধব হইতে বিরহিত হইয়া একাকী নগর প্রান্তে পড়িয়া আছ। তখন তোমার প্রিয় সমাগম বিষয়েও কোন প্রকার প্রতিবন্ধক থাকিবে না। আমি তোমার চৈতন্যোদয়ের পূর্ব্বে এই ব্যাপার রোমিওর সুগোচর করিব। তাহাতে তিনি সেই নিশায় আগমন পূর্ব্বক তোমাকে গোপনে মান্তুয়া গ্রামে লইয়া যাইবেন। জুলিএত পতিবিচ্ছেদে সতত মনস্তাপিনী এবং পেরিসকে পরিণয় করিবার ভয়ে ব্যাকুলা ছিলেন সন্ন্যাসির পরামর্শ গ্রহণ করিলে দুই বিষয়ে প্রতীকার দর্শিবে বিবেচনা করিয়া ঐ ভয়ানক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইতে স্বীকার করত তাঁহার নিকট হইতে ঔষধ গ্রহণ করিলেন।

 জুলিএত সন্ন্যাসির মঠ হইতে বহির্গত হইয়া আপনার আলয়াভিমুখে গমন করিতেছেন ইত্যবসরে বর্ত্মমধ্যে কৌন্ত পেরিসের সহিত সাক্ষাৎ হইল। পেরিস তাঁহাকে অবলোকন করিয়া বিবাহের কথা উত্থাপন করাতে যুবতী সলজ্জ মুখে তাঁহার সহধর্ম্মিণী হইতে স্বীকার করিলেন। ক্যাপিউলেত দলাধিপতি এবং তদীয় গৃহিণী এই সংবাদ প্রাপ্ত হইয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন। তরুণী প্রস্তাবিত পরিণয়ে অসম্মতি প্রকাশ করতে যে পিতার বিষদৃষ্টিতে পড়িয়াছিলেন এক্ষণে সেই পিতা তাঁহার প্রতি সাতিশয় স্নেহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন কেননা তনয়া আজ্ঞানুবর্ত্তিনী হইল। অবিলম্বে বিবাহোৎসব নিমিত্ত বিবিধ আয়েজন করিয়া এবম্বিধ সমারোহ করিলেন যে বেরোনা নগরীতে কস্মিন কালেও তাদৃশ ঘটনা হয় নাই।

 পরিণয়ের অগ্রিম নিশায় জুলিএত সেবন করিবার নিমিত্ত সন্ন্যাসির প্রদত্ত ঔষধ বাহির করিলেন। ওষধি হস্তে করিলে তাঁহার মনে বিবিধ সংশয়ের উদয় হইল, প্রথমতঃ মনে করিলেন লরেন্স রোমিওর সহিত আমার উদ্বাহ সম্পন্ন করিয়া দিয়াছেন আপনার দোষ গোপন নিমিত্ত আমার প্রাণ বিলাশ মানসে কালকূট তো প্রদান করেন নাই। কিঞ্চিৎ চিন্তা করিয়া পর ক্ষণে আবার আপনিই কহিলেন, না, তিনি অতিশয় ধর্ম্মনিষ্ঠ, তাঁহার ঈদৃশ মানস হইতে পারে না। অনন্তর ভয় প্রকাশ পূর্ব্বক ভাবিতে লাগিলেন প্রিয়তম রোমিও প্রেতভূমিতে আমার সন্নিধানে আসিয়া উপস্থিত হইবার পূর্ব্বে যদি আমার চৈতন্য হয় তাহা হইলে যেখানে শোণিতাক্ত চিতাবস্ত্রে আচ্ছাদিত তাইবাল্‌তের শব পতিত রহিয়াছে সে স্থানে ভয়ানক বিভাবরী ভাগে একাকিনী কি প্রকারে অবস্থিতি করিব। এই সময়ে শৈশব কালের উপন্যাস স্মরণ হইল প্রেতভূমি ভূত প্রেত পিশাচাদির আশ্রয়স্থান এপ্রযুক্ত সর্ব্ব প্রাণির ভয়ঙ্কর। অতএব ত্রাসে হৃৎকম্প হইতে লাগিল। কিন্তু পরিশেষে রোমিওর প্রতি উৎপন্ন প্রণয় এবং পেরিসের উপরে সংজত ঘৃণা প্রবল হইয়া সংশয় ও ভয়কে দূরীভূত করিয়া দিল সুতরাং অকুতোভয়ে ঔষধ সেবন করিলেন এবং তৎক্ষণাৎ সংজ্ঞাপগমে মৃতবৎ পতিতা হইয়া রহিলেন।

 প্রভাতে কৌন্ত পেরিস সানন্দচিত্তে মহা সমারোহ পূর্ব্বক পাণিগ্রহণার্থ আগমন করিলেন কিন্তু কন্যার সদনে প্রবেশ করিয়া বিবাহার্থ সুসজ্জিত ভার্য্যার সহিত সাক্ষাৎ করত আনন্দের বৃদ্ধি করিবেন, না, তদীয় মৃত দেহ ভূমির উপর পতিত দেখিতে পাইলেন। পেরিস শব অবলোকন করিয়া শোক মোহে কিয়ৎ ক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। আশা লতার বিপরীত ফল স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করাতে তাঁহার বিষাদের পরিসীমা রহিল না। বিলাপ পূর্ব্বক কহিলেন হায়, নির্দয় অন্তক করস্পর্শের সুখও অনুভব করিতে দিল না, সকল দিকে বঞ্চনা করিল। এখানে বাটীর মধ্যে জুলিএতের মৃত্যু সংবাদ উপস্থিত হওয়াতে আর্ত্তনাদে মহা গোলযোগ হইল। ক্যাপিউলেত দলাধিপতি ও তদীয় গৃহিণী শোকে অস্থির হইলেন। ঐ জুলিএত তাঁহাদের একমাত্র সন্ততি, তাঁহারই চন্দ্রানন নিরন্তর নিরীক্ষণ করিয়া মনে প্রবোধ দিতেন, তাঁহাকে পাত্রসাৎ করণ পূর্ব্বক আপনাদিগকে আহ্লাদিত করিবার উদ্যোগ করিতেছিলেন, এ সময় নিষ্ঠুর কৃতান্ত ক্রোড় হইতে সেই সন্ততি অপহরণ করিয়া লইল ইহাতে তাহাদের মনস্তাপের কথা বক্তব্য কি? ফলতঃ বিবাহের আয়োজন অন্ত্যেষ্টি কার্য্যে পর্য্যবসান হইল ইহা যখন স্বচক্ষে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন তখন বিষাদে একেবারে মৃতকল্প হইয়া পড়িলেন। আনন্দ জনক উৎসবের সমস্ত আয়োজন শোকাবহ ব্যাপারে বিনিযুক্ত হইল, পরিণয়োৎসবের খাদ্য সামগ্রী ঔর্দ্ধদৈহিক ক্রিয়ার ভোজে ব্যয় হইল। আমোদ প্রমোদের সঙ্গীত হইবে, না, বিষাদের গান চতুর্দিক হইতে শ্রুতি গোচর হইতে লাগিল। ইতি পূর্ব্বে আনন্দজনক বিবিধ বাদ্য ধ্বনি হইতেছিল এক্ষণে করুণারস প্রকাশক ঘণ্টা নিনাদ হইতে আরম্ভ হইল। উপযমের পর কন্যার শুভ যাত্রা সময় পথে পুষ্পাবকিরণ নিমিত্ত যে সকল কুসুম সঞ্চয় হইয়াছিল লোকেরা সাশ্রু লোচনে তাহা তদীয় মৃত দেহে বিকীর্ণ করিল। এখন বিবাহের মন্ত্র পাঠনার্থ পুরোহিতের প্রয়োজন হইল না, অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সমাধা নিমিত্ত ঋত্বিক্ আনিতে হইল। বাহকেরা কুমারীকে ধর্ম্মশালায় লইয়া গেল বটে কিন্তু তাহাতে জীবিত লোকদের আনন্দোদয় হইল না কেবল মৃত মনুষ্যের একটা সংখ্যা বৃদ্ধি করিল।

 অনন্তর লরেন্স এক ব্যক্তিকে রোমিওর সন্নিধানে এই উপদেশ দিয়া প্রেরণ করিলেন রোমিওকে এতদ্বিষয় অবগত করাইয়া কহিও ভ্রম বশতঃ জুলিএতের সৎকারের আয়োজন হইয়াছে বস্তুতঃ তাঁহার দেহ জীব সঞ্চারে শূন্য হয় নাই, কিয়ৎ কাল মাত্র প্রেতভূমি মধ্যে পতিত থাকিবেন, তৎপরে পুনর্বার চৈতন্যোদয়ে সুপ্তোত্থিতের ন্যায় গাত্রোত্থান করিবেন অতএব ত্বরায় আসিয়া তাঁহাকে সেই ভয়ঙ্কর স্থান হইতে উদ্ধার কর। কিন্তু শুভ সমাচার অপেক্ষা দুঃসংবাদ শীঘ্র প্রচারিত হয় সন্ন্যাসির প্রেষিত দূত মান্তুয়া গ্রামে পঁহুছিবার অগ্রেই রোমিও প্রিয়তমার প্রাণ বিয়োগের সংবাদ প্রাপ্ত হইলেন। প্রেয়সীর নিধন শ্রবণে তাঁহার শোক সমুদ্র উথলিয়া উঠিল। কিয়ৎ ক্ষণ পূর্ব্বে গত নিশার স্বপ্নের বিষয় চিন্তা করিয়া মনোেমধ্যে আনন্দানুভব করিতেছিলেন। পূর্ব্ব বিভাবরী ভাগে নিদ্রাবস্থায় এই বিষয়ের অনুভব হয় যেন তাঁহার আপনার মৃত্যু হইয়াছিল প্রণয়িনী মৃতদেহ দেখিতে আসিয়া ওষ্ঠাধর চুম্বন করিলেন কিয়ৎ কাল মধ্যে মুখমারুত যোগে দেহাভ্যন্তরে পুনর্বার প্রাণ বায়ুর প্রবেশ হইল তাহাতে জীবিত হইয়া সম্রাট তুল্য মহা সুখী হইলেন। চিন্তাযোগে ঐ আনন্দানুভবের সময় বেরোনা হইতে এক জন দূতকে আসিতে দেখিলেন তাহাতে মনে করিলেন স্বপ্নানুসারে বুঝি কোন সুসংবাদ আসিতেছে কিন্তু বিপরীত ঘটনার সমাচার প্রাপ্ত হইলেন, অর্থাৎ প্রেয়সীর মৃত্যু হইয়াছে, তাঁহাকে চুম্বন করিয়া জীবিত করিতে পারিবেন না। অতএব তাঁহার চিন্তাজন্য আনন্দ সাতিশয় নিরানন্দে পরিণত হইল। শোক ব্যাকুলতা প্রযুক্ত প্রিয়তমার দেহ দর্শন মানসে অশ্ব সজ্জা করিতে আদেশ দিয়া অবিলম্বে বেরোনা নগরে যাত্রার উদ্‌যোগ করিলেন। নৈরাশ্যে পতিত হইলে অনিষ্টকর বিষয়ের শীঘ্র স্মরণ হয় একারণ এক জন জঘন্য গন্ধবণিকের বিপণির বিষয় তাঁহার স্মৃতিপথে উদিত হইল। কিয়দ্দিন পূর্ব্বে সেই বণিকের দোকান সমীপ দিয়া গমন করিতে২ আপনা আপনি কহিয়াছিলেন এ দেশে বিষ বিক্রয়ের আদেশ নাই বরঞ্চ কেহ ঐ জঘন্য ব্যবসা করিলে ব্যবস্থানুসারে বধ দণ্ডার্হ হয় কিন্তু এই পণ্যজীবির আপণের দশা দেখিয়া বোধ হয় এ দুর্ভাগার নিকট তাহা প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে। এখন সেই বিষয় স্মরণ হওয়াতে অনুসন্ধান পূর্ব্বক সেই বণিকের নিকট গিয়া মুদ্রার লোভ দেখাইয়া কিঞ্চিৎ কালকূট প্রার্থনা করিলেন। সে ব্যক্তি গরল বিক্রয়ে প্রথমতঃ অমত প্রকাশ করিল। কিন্তু রোমিও প্রচুর লাভের আশ্বাস দেওয়াতে লোভ সম্বরণে অসমর্থ হইয়া পরিশেষে বিক্রয় করিল এবং সেই বিষের প্রশংসা করত কহিল যদিস্যাৎ বিংশতি ব্যক্তির বল ধারণ কর তাহা হইলেও পানমাত্রে প্রাণ বিয়োগ হইবেক।

 রোমিও কালকূট সঙ্গে লইয়া প্রিয়ার দেহ দর্শনার্থ যাত্রা করত মনে২ কহিতে লাগিলেন অগ্রে রূপ লাবণ্যাকর তদীয় কলেবর অবলোকন পূর্ব্বক নয়ন দ্বয়ের চরিতার্থতা সম্পাদন করিব পশ্চাৎ এই গরল পান করিয়া তাঁহার সমীপে শয়ন পুরঃসর আপনিও মহা নিদ্রায় অভিভূত হইব। অনন্তর মধ্যরাত্র সময়ে বেরোনা নগরে উত্তীর্ণ হইয়া শ্মশান ভূমির দিগে গমন করিলেন। প্রেত ভূমির মধ্য ভাগে ক্যাপিউলেত দিগের সমাধি মন্দির সকল ছিল। রোমিও আপনার সঙ্গে একটা দীপ একখান কুদ্দাল ও খনিত্র লইয়াছিলেন আলোক যোগে অবলোকন পূর্ব্বক মন্দির খনন করিতে প্রবৃত্ত হন ইত্যবসরে একটা শব্দ শ্রুতিগোচর হইল যথা অরে দুষ্ট মন্তেগ, ও কি অবিহিত কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলি? এ কৌন্ত পেরিসের কণ্ঠোদ্ভব শব্দ। তিনি নিশা সময়ে জুলিএতের সমাধি স্থানে কুসুমাবকিরণ এবং অশ্রুপাত পুরঃসর শোক প্রকাশ নিমিত্ত আগমন করিয়া তৎকালে সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন। মন্দির খননে কোন লাভ নাই অধিকন্তু যিনি খুঁড়িতেছেন তিনি মন্তেগ বংশীয়, অতএব ক্যাপিউলেত দিগের বৈরি জ্ঞান করিয়া মনে করিলেন এ ব্যক্তি মৃত দেহ সকলের প্রতি অসদ্ব্যবহার করিতে আসিয়াছে সন্দেহ নাই তন্নিমিত্ত নিবৃত্ত করিতে ক্রোধভরে ঐ প্রকার উক্তি করিলেন। পরে তাহাকে চিনিতে পারিয়া কহিলেন অরে তোর প্রতি দণ্ড বিধান হইয়া রহিয়াছে বেরোনার সীমামধ্যে দৃষ্ট হইলে প্রাণে নিহত হইবি এখনই তোকে ধরিয়া যমালয়ে প্রেরণ করিতে পারি তাহাতে কাজ নাই শীঘ প্রস্থান পূর্ব্বক আপন জীবন রক্ষা কর্। রোমিও কহিলেন আমাকে বিরক্ত করিস্ না, এই দেখ তাইবাল তের দেহ পড়িয়া রহিয়াছে, তুই আবার তাহার দশা পাইবি না কি? নীরব হ, আমার ক্রোধ কেন প্রজ্বলিত করিস্? আবার কি তোর প্রাণ সংহার করিয়া আর এক পাপ ভার বহন করিব? পেরিস ঘৃণা প্রকাশ পূর্ব্বক তাঁহার এ সকল কথা অগ্রাহ্য করিলেন এবং অপরাধি বোধে ধৃত করিতে গেলেন। রোমিও তাঁহাকে নিবৃত্ত করিতে চেষ্টা করিলেন তাহাতে বাহু যুদ্ধ উপস্থিত হওয়াতে অবিলম্বে পেরিস নিহত হইলেন। অনন্তর রোমিও আলোক লইয়া দেখিলেন যিনি সমর শায়ী হইলেন তাঁহার সহিত জুলিএতের পরিণয় সম্বন্ধ হয় অতএব পেরিসের কলেবর স্বীয় করে ধারণ পূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন এক্ষণে তোমাকে জয়যুক্ত করিব, আইস, তোমার দেহ প্রিয়তমার সমাধি সন্নিধানে স্থাপন করি। পরে সমাধি মন্দিরের দ্বার উদ্ঘাটন করিলেন সেখানে জুলিএতের শরীর নিহিত ছিল। প্রিয়তমার প্রতি নেত্রপাত পুরঃসর কহিলেন নিষ্কৃপ কৃতান্ত সুন্দরীর প্রাণ হরণ করিয়াছে বটে কিন্তু রূপ লাবণ্য বিকৃত করিতে সমর্থ হয় নাই অথবা সেই নিষ্ঠুর কামাসক্ত হইয়া আপনার চিত্তের সন্তোষ নিমিত্ত কামিনীর এই মনোহর কলেবর রক্ষণ করিয়াছে। ফলতঃ শ্মশান ভূমিতে নীত হইলেও জুলিএতের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিশ্রী হয় নাই বরং অধিক উজ্জ্বল হইতেছিল। তাঁহার পার্শ্বে তাইবাল্‌তের শব প্রেতাচ্ছাদনে আবৃত হইয়া স্থাপিত ছিল। রোমিও সেই দেহ সন্নিধানে দণ্ডায়মান হইয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন এবং প্রেয়সীর সম্পর্কে স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক সম্বোধন করিয়া কহিলেন ভ্রাতঃ এক্ষণে তোমার বৈরি বিনাশ করিয়াই একটি হিত সাধন করি। তৎপরে প্রিয়ার ওষ্ঠদ্বয় চুম্বন করত তাঁহার নিকট বিদায় লইলেন এবং অপার শোক সাগর হইতে নিস্তার নিমিত্ত সঙ্গে আনীত কালকূট পান করিলেন। সেই বিষ সাক্ষাৎ কৃতান্ত, জিহ্বা স্পর্শ মাত্রে একেবারে অচেতন হইয়া পড়িলেন। তাঁহার প্রেয়সী সন্ন্যাসির ঔষধ গুণে কপট মৃত্যুর অধীন হইয়াছিলেন রোমিও গরল পানে বাস্তবিক গতাসু হইলেন। এই সময়ে জুলিএতের ঔষধের গুণ শেষ হইবার উপক্রম হইল কিন্তু এখন তিনি জাগ্রৎ হইয়া কোথায় অনুযোগ করিবেন প্রিয়তম ত্বরায় আইসেন নাই, না, তাঁহাকে দেখিয়া বিলাপ করিবার সূত্র হইল।

 এ দিকে লরেন্স যে সময় ঔষধের গুণ নির্বাণে জুলিএতকে জাগ্রৎ হইবার কথা কহিয়াছিলেন সেই সময় উপস্থিত হইবার কিঞ্চিদগ্রে শুনিলেন মান্তুয়া গ্রামে যে ব্যক্তিকে রোমিওর সন্নিধানে প্রেরণ করেন সে দুর্ভাগ্যক্রমে পঁহুছিতে পারে নাই। অতএব শ্মশান ভূমিতে অবলার বিপদ্ ভাবিয়া স্বয়ং একখান খনিত্র ও একটা প্রদীপ করে ধারণ পূর্ব্বক তাঁহাকে মুক্ত করিতে প্রেত ভূমির অভিমুখে যাত্রা করিলেন। সেখানে উপনীত হইয়া দেখেন ক্যাপিউলেত দিগের সমাধি সন্নিধানে একটা আলোক আর একখান করবাল রহিয়াছে। ইতস্ততো দৃষ্টি নিক্ষেপ করাতে আবার দেখিতে পাইলেন রোমিও এবং পেরিস এই দুই জন অচেতনাবস্থায় ভূমি শয্যায় শয়ান। এই সকল অবলোকনে তাঁহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না।

 এই ভয়ানক অদ্ভুত ব্যাপার কি রূপে ঘটিল অনুমান করিতে প্রবৃত্ত হন ইতিমধ্যে জুলিএত ঔষধের প্রতাপোপশমে জাগিয়া উঠিলেন। অদূরে উদাসীন লরেন্সকে অবলোকন করাতে পুর্ব্ব বিবরণ স্মরণ হইল আপনি কোথায় আছেন, ও সন্ন্যাসী কি নিমিত্ত আসিয়াছেন জানিতে পারিলেন। পরে উদাসীনকে সমুচিত সম্বোধন পূর্ব্বক সমীপে আহ্বান করিয়া রোমিওর কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। লরেন্স সেই সময় বহির্ভাগে লোকের কোলাহল শুনিতে পাইলেন অতএব যে শক্তির প্রতিকূল্যাচরণে ক্ষমতা আছে তদপেক্ষা গুরুতর পরাক্রমে পাছে আপনাদের অভিলাষ সিদ্ধির বিষয়ে কোন প্রকার ব্যাঘাত হয় এই ভয়ে তরুণীর ঐ প্রশ্নে মনোযোগ না করিয়া তাঁহাকে অস্বাভাবিক নিদ্রা পরিহার পূর্ব্বক শীঘ্র সমাধি মন্দির হইতে বাহিরে আসিতে কহিলেন। ক্ষণ কাল মধ্যে কলরব নিকটবর্ত্তী হওয়াতে সন্ন্যাসির সাতিশয় সন্ত্রাস জন্মিল আর অবলার অপেক্ষা করিতে পারিলেন না, আত্ম প্রাণ লইয়া পলায়ন পরায়ণ হইলেন। জুলিএত গাত্রোত্থান করিয়া দেখিলেন প্রিয় পতি রোমিও নিকটে গতাসু হইয়া ভূমিতে পড়িয়া আছেন হস্তে একটা পাত্র রহিয়াছে। তাহাতে অনুমান করিলেন প্রিয়তম অভাগিনীর অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছিলেন আমাকে অচেতন দেখিয়া মৃত জ্ঞান করত কালকূট পানে আপনার জীবন বিসর্জ্জন করিয়াছেন। অনেক ক্ষণ শোক প্রকাশ পূর্ব্বক নানা প্রকার বিলাপ করিলেন। অবশেষে আত্মহত্যা দ্বারা প্রাণাধিক প্রিয়তমের অনুগমন করিতে সংকল্প করিয়া রোমিওর হস্ত সংলগ্ন পাত্রে অবশিষ্ট কিছু বিষ আছে কি না দেখিতে লাগিলেন এবং স্বামির মুখে যদিস্যাৎ অবশেষে কিছু থাকে এই ভাবিয়া বদন চুম্বন ও অধর পান করিলেন, এই সময়ে কোলাহলকারি সেই সকল লোক অধিক নিকটবর্ত্তী হইল অতএব আর কাল বিলম্ব করিতে পারিলেন না আপনার গলে তীক্ষ্ণধার করবাল প্রহার করিয়া পতিপার্শ্বে পতিতা হইলেন।

 অনন্তর নগরের শান্তি রক্ষক সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। রোমিও সমাধি স্থানে আসিয়া কৌন্ত পেরিসের সহিত যৎকালে ঘোরতর রণ করেন সে সময় পেরিসের এক জন ভৃত্য দ্রুতগতি নগরে গিয়া ঐ ভয়ানক ব্যাপারের সংবাদ দেয় তাহাতেই নগর বাসি লোকেরা ভীত হইয়া কোলাহল আরম্ভ করে এবং বেরোনা নগরীর চতুদিক্‌স্থ সমস্ত রাজবর্ত্মে ভ্রমণ করত কেবল পেরিস, রোমিও, জুলিএত, এই বাক্য বারম্বার উচ্চ স্বরে উচ্চারণ করিতে ছিল। তাহাদের কোলাহলে মন্তেগ বংশাধ্যক্ষ এবং ক্যাপিউলেত দলপতির নিদ্রাভঙ্গ হইল। দেশাধিপতিও গাত্রোত্থান করিয়া শয্যা পরিত্যাগ পূর্ব্বক বাহিরে আসিলেন এবং ভৃত্যবর্গকে নগর মধ্যে কলরবের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। লরেন্স প্রেতভূমি হইতে বহির্গত হইয়া ভয়ে কাঁপিতে২ যাইতেছিলেন শান্তিরক্ষকেরা তাঁহাকে দেখিতে পাইল এবং সন্দেহ করিয়া বল পূর্ব্বক ধৃত করিয়া রাখিল। ক্যাপিউলেত দিগের শ্মশান ভূমিতে লোকারণ্য হওয়াতে দেশাধিপতি স্বয়ং আগমন করিলেন এবং ঐ সমস্ত অদ্ভুত ঘটনার বিষয় লরেন্সকে জিজ্ঞাসা করিলেন।

 এক্ষণে লরেন্স জনতা সন্নিধানে মন্তের্গ এবং ক্যাপিউলেত দুই পরিবারের অধিপতিদ্বয় সমক্ষে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত অবিকল কহিতে আরম্ভ করিলেন। পরস্পর বিদ্বেষি দুই বংশের তনয় তনয়া যে প্রকার প্রণয় পাশে বদ্ধ হয় এবং দুই পরিবারের চির বিরোধ ভঞ্জন নিমিত্ত যে রূপে আপনি সঙ্গোপনে তাঁহাদের পরিণয় সম্পাদন করিয়া দেন সমস্ত কহিলেন। অনন্তর জুলিএতের অন্য বিবাহের কথা ও তদীয় পরামর্শানুসারে পাপ ভয়ে যুবতীর ঔষধ সেবনে অচেতন হইবার বৃত্তান্ত বর্ণনা করিলেন কেবল অজ্ঞাত প্রযুক্ত মধ্যের বিবরণ বলিতে পারিলেন না। রোমিওর ভৃত্য সেখানে উপস্থিত থাকাতে সে ব্যক্তি তাহা কহিয়া সম্পূর্ণ করিয়া দিল। রোমিও আপনার প্রাণ ত্যাগ সংকল্প করিয়া পিতার নামে একখান লিপি লিখিয়া সেই ভৃত্যের হস্তে সমপর্ণ করিয়াছিলেন তাহাতেও সমস্ত বিষয়ের বিশেষ বিবরণ ছিল সুতরাং সন্ন্যাসির কথায় কাহারও সংশয় হইল না। অতএব উদাসীন লরেন্স আদৌ এই সমস্ত দুর্ঘটনার নিদান বলিয়া ধৃত হইলেও এক্ষণে তাঁহার নির্দোষতা সপ্রমাণ হইল।

 নরপতি এই সমস্ত বিবরণ অবগত হইয়া মন্তেগ ক্যাপিউলেত দুই পরিবারের অধ্যক্ষ দিগকে ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন এবং কহিলেন তোমাদের জ্ঞাতিবিরোধ জন্য অধর্ম্মের এই প্রতিফল হইল, আহা তোমাদের তনয় তনয়া পরস্পর প্রণয় করিয়া এই দুর্দশায় পড়িল? চির বিরোধি ঐ দুই বংশ দেশাধিপতির তিরস্কারে অপত্রপান্বিত হইলেন এবং পরস্পর বৈরিভাব বিসর্জ্জন করিলেন। ক্যাপিউলেত বংশাধিপতি মন্তেগ দলাধ্যক্ষের হস্ত ধারণ পূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে ভ্রাতা বলিয়া সম্ভাষণ করত কহিলেন রোমিও এবং জুলিএতের বিবাহ দ্বারা আমাদের উভয় পরিবারের বিবাদ নিবৃত্ত হউক। ক্যাপিউলেত দলাধ্যক্ষ কহিলেন কন্যার যৌতুকার্থ বৈবাহিকের নিকট কেবল কর প্রার্থনা করি। মন্তেগপতি বলিলেন মিত্র হস্ত কি, তদপেক্ষা উৎকৃষ্ট দ্রব্য দানের মানস করিতেছি অবিলম্বে জুলিএতের স্বর্ণময় প্রতিমা নির্মাণ করিব। সুবিজ্ঞ দক্ষ শিল্পকরের শিল্পনৈপুণ্যে তাঁহার খ্যাতি প্রচারের চেষ্টা পাইব তাহাতে বেরোনা নগরে তাঁহার নাম কেহ কখন বিস্মৃত হইবেন না। ক্যাপিউলেত দলাধ্যক্ষ কহিলেন আমিও রোমিওর প্রতিকৃতি নির্ম্মাণ পূর্ব্বক তাঁহাকে চিরস্মরণীয় করিব। এই রূপে পরস্পরের শত্রুতা পরম স্নেহ ভাজন তনয় তনয়ার প্রাণ হানি করিয়া নিবৃত্ত হইল ইতি।