সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/যাদৃক্‌ অভিরুচি

R. D. SORNOKAR, ENGR
৪৭৫

যাদৃক্‌ অভিরুচি

যাদৃক্ অভিরুচি।


 ফ্রান্স দেশ কোন সময়ে পৃথক২ খণ্ডে বিভক্ত ছিল। এক প্রদেশের জনেক অন্যায়ী দুরাত্মা তথাকার প্রকৃত অধিপতি আপন অগ্রজ সোদরকে সিংহাসন চ্যুত করিয়া বনবাসে প্রেষণ পূর্ব্বক স্বয়ং রাজাধিকারী হইল।

 পূর্ব্বাধিকারী পদভ্রষ্ট হইয়া নিবাস নিমিত্ত আর্দেন নামক দুর্গম বিপিনে গমন করিলে তদীয় কতিপয় সুস্নিগ্ধ মিত্র স্ব২ ঐশ্বর্য্য সম্পত্তি রাজ্য মধ্যে স্বয়ং বিসর্জন পূর্ব্বক সমভিব্যাহারী হইলেন। রাজ্যাপহারী দুরাত্মা তাহাদিগকে বারণ করিল না, বরং প্রস্থান করিবামাত্র তাঁহাদেরও বিষয় বিভব আপনি অধিকার করিয়া লইল। নৃপতি নির্ব্বাসিত হইয়াও সমভিব্যাহারে বন্ধুবর্গ প্রাপ্ত হওয়াতে মনের সুখে বনবাস করিতে লাগিলেন। ধৈর্য্য গাম্ভীর্য্য সহকারে আরণ্য বিষয় ভোগ করাতে ক্রমে তাঁহাদের সকলেরই বোধ হইল নগরীয় আড়ম্বরান্বিত বিভব অপেক্ষা বন্য বিষয় পরম নির্বৃতি কর। ফলতঃ ইংলন্দীয় প্রাচীন রবিন হুদের ন্যায় এই কানন নিবাসে তাঁহারা স্ব২ স্বান্তমধ্যে যৎপরোনাস্তি প্রীতি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। নিদাঘ কালে শীতলচ্ছায় বিশাল ছায়াতরু তলে সকলে একত্র উপবেশন পূর্ব্বক কুরঙ্গ গণের লীলা রঙ্গ দর্শন করিতেন। মৃগ কদম্ব তাঁহাদিগের ঈদৃশ করুণাস্পদ হইল যে আপনাদের স্বাভাবিক আহার নিমিত্ত দুই একটার প্রাণ বিনাশ করিতে হইলেও শোকে ব্যাকুল হইতেন। শিশির সময়ে হৃদয় বিদারক নীহার সহকারে পবন বহমান হইয়া দারুণ দুঃখের উদয় করিয়া দিত কিন্তু রাজা ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক তাহা সহিষ্ণুতা করিতেন। তজ্জন্য কোন প্রকার উদ্বেগ প্রকাশ না করিয়া বরং এই বাক্য কহিতেন এ উগ্র সমীরণ আমার অমিত্র নহে, যথার্থ উপদেশক বন্ধু, বোধ হয়, আমার অনর্থক সন্তোষ জন্মাইতে বাসনা করে না, উপস্থিত অবস্থা অবগত করাইয়া দিতেছে। যদিও নির্দয় আঘাত করিতেছে তথাপি কৃতঘ্ন নহে সুতরাং ইহার যাতনা অসহ্য বোধ হইতেছে না। মানবজাতি ইহার প্রাদুর্ভাব দেখিলে আপনাদের দুর্ভাগ্যের কথা কহিয়া থাকে বটে কিন্তু ইহা হইতে ভূরি২ সদুপদেশ গ্রহণ করিতে পারা যায়, ভেকের মস্তকস্থ বিষাক্ত মণি যেমন ঔষধ বিষয়ে মহোপযোগী হয় এই সমীরণে সেই রূপ আমাদেরও অবশ্য কোন প্রকার প্রয়োজন সিদ্ধির সম্ভাবনা আছে। নরপতি এবম্প্রকারে তৎকালিক দুঃখাবহ যাবতীয় বিষয় বিবেচনা করিয়া সে সমস্ত হইতে কিঞ্চিৎ২ সদুপদেশ সংগ্রহ করিতেন। এই অবস্থায় তিনি আপনার নীতিগ্রাহিতা শক্তির গুণে তরুকে রসনা, বেগবতী স্রোতস্বতীকে গ্রন্থ এবং প্রস্তর সকলকে ধর্ম্মোপদেশক জ্ঞান করাতে সে সকল হইতেও বিবিধ উপদেশ লাভ করেন; ফলতঃ স্বাভাবিক সমস্ত পদার্থের তত্ত্বান্বেষণে প্রীতি প্রাপ্ত হওয়াতেই বনবাসেও অক্ষিণ্ণমনা ছিলেন।

 দুরাত্মা সহোদরের অন্যায়ে যে রাজা বনবাসী হইলেন তাঁহার রোজালিন্দ নাম্নী এক তনয়া ছিল। রাজ্যাপহারী ফ্রেদ্রিক অগ্রজকে নির্বাসিত করিয়া সেই কন্যাটীকে স্বীয় দুহিতা সেলিয়ার সহচরী করিয়া রাখিল। যদিও ঐ দুই কুমারীর জনকদিগের পরস্পর মহা অমিত্রতা ছিল তথাপি তাহাদের স্ব২ অন্তঃকরণে অন্যোন্যের প্রতি সাতিশয় প্রণয় জন্মিল। বিশেষতঃ সেলিয়া পিতৃব্যের প্রতি আপনার পিতার অন্যায়াচরণের বিনিময় স্বরূপে সহচরীকে যথেষ্ট স্নেহ করিতে লাগিলেন। যখন রোজালিন্দ জনকের দুঃখ এবং আপনার দুরবস্থা স্মরণ করিয়া শোকাকুল হইতেন তখন বিবিধ প্রবোধ বচনে তাঁহাকে শান্ত্বনা করিতেন।

 এক দিন সেলিয়া সহচরীর সহিত একত্র উপবেশন পূর্ব্বক তাঁহাকে বিষণ্ণ দেখিয়া সদয় বচনে কহিতেছেন ভগিনি সর্ব্বদা শোক করিলে কি হইবে? ধৈর্য্যাবলম্বন কর, আহ্লাদ আমোদে মন দেও। এতদবসরে এক জন বার্ত্তাবহ সমাগত হইয়া সংবাদ দিল রাজসভা সন্নিধানে একটা মল্লযুদ্ধ হইবে যদিস্যাৎ কৌতুক দর্শনার্থ কৌতূহল থাকে শীঘ্র তথায় গিয়া অধিষ্ঠান করিবেন। সেলিয়া মনোমধ্যে বিবেচনা করিলেন রোজালিন্দ অনুদিন নিরানন্দ হইতেছেন মল্লক্রীড়া স্থলে লইয়া গেলে কৌতুক দেখিয়া অবশ্য কিয়ৎ ক্ষণ সানন্দ থাকিবেন অতএব দুতকে এই প্রতিবচন প্রদান পূর্ব্বক বিদায় করিলেন সহচরী সমভিব্যাহারে এখনই গমন করিতেছি।

 বর্ত্তমান কালে পল্লীগ্রামে সামান্য জনগণের মধ্যে মল্লক্রীড়া হইয়া থাকে কিন্তু পূর্ব্বে রাজসভা ও সম্ভ্রান্ত কুলবালাগণের সম্মুখে মল্লযুদ্ধ হইবার প্রথা ছিল। অতএব তদ্দর্শনার্থ সেলিয়ার আহ্বান হয় এবং তিনিও সঙ্গিনীকে সঙ্গে লইয়া সেই রঙ্গ অবলোকনার্থ রঙ্গভূমি সন্নিধানে গমন করেন। কিন্তু সেখানে উপস্থিত হইলে তাঁহাদের অনুমান হইল এই মল্লযুদ্ধে কৌতুক হইবে না বরং একটা শোকাবহ ব্যাপার ঘটিবার সম্ভাবনা, কেননা সমক্ষে নিরীক্ষণ করিলেন এক জন দৃঢ়কলেবর বলবান্ নিপুণ মল্লের বিরুদ্ধে একটি অনিপুণ তরুণ বাহ্বাস্ফোটন পুরঃসর যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইতেছিল। দর্শকেরা দুই মল্লের আকৃতি প্রকৃতি দেখিয়া কহিতেছিল এই যুবা কদাপি ইহার সহিত প্রতিযোগিতা করিতে পারিবে না অসমসাহসিক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইবার ফল অবিলম্বে প্রাপ্ত হইবে।

 সেলিয়া স্বীয় সহচরী সহিত সভা সমীপে উপস্থিত হইলে রাজা তাঁহাদিগকে সমাদর পূর্ব্বক অভ্যর্থনা করিল এবং দুই জনকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসিল তোমরা কি মল্লযুদ্ধ দেখিতে আসিয়াছ? এ মল্লক্রীড়ায় কৌতুক হইবে না, এই নবীন ব্যক্তির প্রতি আমার অতিশয় দয়া হইতেছে আমি ইচ্ছা করি এই দুঃসাহসিক ব্যাপার হইতে এ যুবা নিরস্ত হয়। তোমরা ইহাকে বুঝাইয়া বল দেখি যদি নিবৃত্ত করিতে পার।

 রাজকন্যারা অতিশয় প্রীতিযুক্ত হইয়া তাঁহার সহিত কথোপকথন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রথমতঃ সেলিয়া যুবাকে এই অসমসাহসিক ব্যাপার হইতে বিরত হইতে অনুরোধ করিলেন। পরে রোজালিন্দ সানুক্রোশ বচনে কহিতে লাগিলেন ওহে তরুণ তুমি আপন ইচ্ছায় কেন বিপদে পদক্ষেপ করিতেছ? কিন্তু সেই যুবা তাঁহাদের কথায় সংকল্পিত বিষয়ে নিবৃত্ত হইলেন না, তাঁহাদিগের সমক্ষে আপনার দুর্দ্ধর্ষ বিক্রম প্রকাশ করিতে মানস করিলেন। অগ্রে সুকোমল বচন প্রয়োগ পুরঃসর বিনয় করিয়া কহিলেন আমি তোমাদের এই অনুরোধ রক্ষা করিতে সক্ষম হইব না। তাহার বিনয়ৌদার্য্যে রাজনন্দিনী দ্বয়ের পরম সন্তোষ জন্মিল সুতরাং প্রার্থনা ভঙ্গে বিরক্ত না হইয়া বরং সাতিশয় প্রীতি যুক্ত হইলেন। সেই তরুণ হিতৈষিণী রাজনন্দিনীদিগের প্রতি শেষে এই কথা কহিলেন আপনাদিগের অনুরোধ রক্ষা করণে অক্ষম হওয়াতে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইতেছি। পরন্তু আপনারা আমার হিতাকাঙ্ক্ষা করেন, এতন্নিমিত্ত কৃতজ্ঞতা স্বীকার পূর্ব্বক প্রার্থনা করি। স্বচক্ষে আমার এই পরীক্ষা নিরীক্ষণ করুন। আমি যদিস্যাৎ এই যুদ্ধে পরাস্ত হই তবে নিশ্চয় জানিবেন এবম্বিধ এক ব্যক্তি লজ্জিত হইল যে কস্মিন্ কালে দৃষ্ট হয় নাই। আর যদি এই রণে আমার মরণ হয় তাহাতেও জানিতে পারিবেন স্বেচ্ছাপূর্ব্বক নিধন যাতনা সহ্য করণে প্রস্তুত এক ব্যক্তি কাল গ্রাসে পড়িল। অপর আমি সমরশায়ী হইলে কাহারো কিছু অপকার হইবে না, আমার নিমিত্ত শোক করে সংসারমধ্যে এতাদৃশ এক প্রাণীও নাই। অধিকন্তু আমার মৃত্যুতে পৃথিবীরও হানি সম্ভাবনা বিরহ, কেননা অবনীর সহিত কোন সম্পর্ক রাখি না, বরং আমার বিনাশে পৃথিবীর উপকার আছে আমি ধরার যে স্থান ব্যাপিয়া রহিয়াছি অন্যের শুভাগমনের দ্বারা তাহা পূরিত হইতে পারিবে।

 অনন্তর যুদ্ধারম্ভ হইল। সেলিয়া মনে২ প্রার্থনা করিতে লাগিলেন যুবা যেন কোন প্রকারে আহত না হন। রোজালিন্দও তদর্থ মর্ম্মান্তিক বেদনা প্রকাশ করিলেন এবং মনোমধ্যে এই বিবেচনা করিয়া দুঃখিত হইলেন আহা এ ব্যক্তি আমারই ন্যায় দুর্ভাগ্য, বন্ধু বান্ধব কেহই নাই, স্বতঃ মৃত্যু ক্লেশ স্বীকারে প্রবৃত্ত হইল। এই রূপে যৎকালে তাঁহার উপস্থিত বিপত্তি নিমিত্ত স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক শোক করিতে লাগিলেন সেই সময়েই তদীয় প্রণয় নিগড়ে পতিত হইলেন এমত অনুভব হইল।

 সে যাহা হউক, কিন্তু যুবা মান্যা মহিলাদিগের এবস্প্রকার করুণায় মহা সাহসী ও দ্বিগুণ বলান্বিত হইলেন এবং আশ্চর্য্য রূপে শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ করিতে লাগিলেন তাহাতে তাঁহার বিপক্ষ পক্ষ পরাভূত হইল এবং ঘোরতর প্রহারে কিয়ৎ ক্ষণ অচেতন অস্পন্দ হইয়া রণক্ষেত্রে পড়িয়া রহিল।

 রাজা এই তরুণের অসাধারণ সাহস এবং যুদ্ধ নৈপুণ্য অবলোকন করিয়া সাতিশয় প্রীত হইল এবং আশ্রয় প্রদান মানসে তাঁহার পরিচয় জিজ্ঞাসা করিল।

 যুবা কহিতে লাগিলেন আমি স্যর রোলান্দ-দি-বএজের কনীয়ান সন্তান, আমার নাম অর্লান্দো।

 স্যর রোলান্দ-দি-বএজ সে সময় পরলোক প্রবাসী হইয়াছিলেন কিন্তু জীবদ্দশায় সিংহাসন চ্যুত রাজার এক জন প্রিয় বন্ধু ছিলেন একারণ ফ্রেদ্রিক যখন শুনিল সমর বিজয়ী তরুণ অর্লান্দো তদীয় তনয়, তখন যুবার শৌর্য্য দর্শনে তৎপ্রতি তাহার যে অনুরাগ জন্মিয়াছিল তাহা বিরাগে পরিণত হইল, তৎক্ষণাৎ বৈরক্তি ভাব ব্যক্ত করত গাত্রোত্থান পূর্ব্বক সে স্থান হইতে প্রস্থান করিল। কিন্তু যদিও ভ্রাতৃদ্বেষ প্রযুক্ত তদ্বন্ধুবর্গের পর্য্যন্ত নাম শ্রবণে বিরক্ত হইত তথাপি অর্লান্দোর অনুপম বলবীর্য্যে চিত্ত সন্তোষ জন্মিবাতে গমন করিতে২ কহিতে লাগিল সেই যুবা অন্য কোন লোকের নন্দন হইলে মহা আনন্দের বিষয় হইত।

 রোজালিন্দ যখন শ্রবণ করিলেন ঐ যুবা তাঁহার জনকের মিত্রতনয়, তখন তদীয় পরিতোষের পরিসীমা রহিল না। সেলিয়াকে সম্বোধন পুরঃসর কহিতে লাগিলেন স্যর রোলান্দ-দি-বএজ আমার পিতার পরম প্রিয়পাত্র ছিলেন এই নবীন পুরুষ তাঁহার ঔরসজাত, যদি অগ্রে বিদিত থাকিত তাঁহাকে রণে প্রবৃত্ত হইতে নিররণ করিবার সময় অবশ্য আমার নেত্রদ্বয় অশ্রু প্রবাহে কলুষিত হইত।

 অনন্তর তাঁহারা দুই জনে অর্লান্দোর সন্নিধানে গমন করিলেন। সেখানে গিয়া অবলোকন করিলেন ফ্রেদ্রিকের হঠাৎ বৈরক্তি দেখিয়া অর্লান্দো লজ্জায় অধোবদন হইয়া রহিয়াছেন উভয়ে সুধাভিষিক্ত বচন প্রয়োেগ পুরঃসর নানা প্রকারে তাঁহাকে আশ্বাস দিলেন এবং বিদায়বসরে রোজালিন্দ স্বীয় গলদেশ হইতে এক মহার্হ মণিময় মালা উন্মোচন পূর্ব্বক প্রদান করত কহিলেন প্রিয়তম আমার নিমিত্ত এই ভূষণে আপনার কণ্ঠ ভূষণ করিও, আমি দুরদৃষ্ট বশতঃ দুরবস্থায় পতিত হইয়াছি নচেৎ এতদপেক্ষা অধিক মূল্যবৎ উপায়ন প্রদান করিতাম।

 পরে দুই জনে বিদায় গ্রহণ পুরঃসর আপনাদের নিভৃত নিকেতনে গমন করিলেন। রোজালিন্দের বদন হইতে তদবধি কেবল অর্লান্দোর প্রশংসাবাদ বিনির্গত হইতে লাগিল। সেলিয়া বিবেচনা করিলেন ভগিনী সেই তরুণের অসামান্য রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হইয়া প্রণয় বাগুরায় পতিত হইয়াছেন অতএব ঈষদ্বৈরক্তি প্রকাশ পূর্ব্বক জিজ্ঞাসা করিলেন কাহারও প্রতি হঠাৎ এরূপ প্রীতিযুক্তা হওয়া কি উচিত হয়? রোজালিন্দ উত্তর করিলেন আমার পিতা অর্লান্দোর জনককে ভাল বাসিতেন। সেলিয়া বলিলেন তজ্জন্য কি তুমি তদীয় নন্দনকে আপন নয়নের আনন্দ বর্দ্ধন জ্ঞান করিবে? তবে তো আমি তাহাকে ঘৃণা করিতে পারি? কেননা আমার পিতা তাঁহার জনককে ঘৃণা করিতেন, কিন্তু অর্লান্দোর উপরে আমার বিরাগ মাত্র হয় নাই।

 ফ্রেদ্রিক অর্লান্দোর পরিচয় প্রাপ্তি অবধি তাড়িত সোদরের বন্ধু বান্ধব দিগকে স্মরণ করিয়া ক্রোধের্ষায় পূর্ণ হইল। সে ভ্রাতৃতনয়াকে আশ্রয় প্রদান পূর্ব্বক আপন অঙ্গজার সঙ্গে প্রতিপালন করিত বটে কিন্তু অন্তঃকরণ সহিত স্নেহ করিত না, রাজ্যস্থ জনগণ সেই সুশীলা বালার বিনয়ৌদার্য্য দর্শনে সন্তুষ্ট হইয়া তদীয় জনকের প্রতিষ্ঠা করাতে বরং তৎপ্রতি বিরক্ত ছিল। তাহার দ্বেষ এবং কোপ অনতিবিলম্বে প্রবল হইয়া উঠিল অতএব সে রোজালিন্দের অনিষ্ট চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইল। এক দিন সেই কুমারী প্রিয়সখী সেলিয়ার সহিত একত্র উপবেশন পূর্ব্বক অর্লান্দোর প্রসঙ্গ করিয়া কথোপকথন করিতেছিলেন হঠাৎ সেই সময়ে তাঁহাদের নিকট উপস্থিত হওয়াতে ঐ সকল কথা তাহার কর্ণগোচর হইল। ইহাতে ক্রোধান্ধ হইয়া আজ্ঞা করিল রোজালিন্দ, তুই এই দণ্ডে আমার ভবন হইতে দূরীভূত হ। এত বড় আস্পর্ধা, আমার প্রতিদ্বন্দ্বির পক্ষকে স্বপক্ষ জ্ঞান করিস্? তাহার কথা কহিয়া আমোদ করিতেছিস্? পরে আপনার দুহিতাকে কহিল এ অতি দুষ্টা, কেবল তোমার সন্তোষের নিমিত্ত ইহাকে এত দিন এখানে থাকিতে দিয়া ছিলাম। সেলিয়া সহচরীর নিমিত্ত দুঃখিত হইয়া জনক সন্নিধানে বলিতে লাগিলেন পিতঃ অগ্রে আমি স্বনিকটে রোজালিন্দের অবস্থান নিমিত্ত আপনার সমীপে কাতরতা বা বিনয় করি নাই কারণ তখন শৈশব প্রযুক্ত গুণাগুণ বিবেচনা করিতে পারিতাম না কিন্তু ইদানী ইহার সৌজন্যে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হইয়াছি কত দিন অবধি একত্র শয়নােপবেশন শিক্ষা ক্রীড়া ও ভােজনাদি করিয়াছি এখন ইহার বিয়ােগ সহ্য করিতে পারিব না। অতএব ক্ষমা করুন। ফ্রেদ্রিক কিঞ্চিদন্তরে তনয়াকে লইয়া গিয়া বুঝাইতে লাগিল সেলিয়া বলি শুন ও কণ্টকটা এখানে থাকিলে তােমার পক্ষেও শ্রেয়ঃ সম্ভাবনা নাই, লােকে তদীয় বিনয়ৌদার্য্য দর্শনে তুষ্ট হইয়া তাহারই অনুরাগ করে তন্নিমিত্ত অদ্যাবধি তােমার প্রতিষ্ঠা বা সদ্‌গুণের খ্যাতি প্রচার হইল না, তুমি আবার তদর্থ অনুরােধ কর তুমি তো বড় নির্বোধ। আশু এখন হইতে দূর হইলে তােমার খ্যাতি প্রচার হইবে এ কি বুঝিতে পার না? সাবধান, উহার পক্ষ হইয়া আর একটী কথাও কহিও না, আমি যাহা অনুমতি করিলাম তাহার অন্যথা হইবে না।

 সেলিয়া যখন দেখিলেন অনুরােধ করিয়া রােজালিন্দের প্রতি পিতার কোপ শান্তি করা দুরূহ, তখন আপনিও তাঁহার সমভিব্যাহারে রাজভবন পরিত্যাগ করিতে প্রতিজ্ঞা করিলেন। অতএব সেই নিশাভাগেই উভয়ে প্রস্থানের আয়ােজন করিতে লাগিলেন।

 সেলিয়া পিত্রালয় হইতে যাত্রা করিবার পুর্ব্বে বিবেচনা করিলেন বহুমূল্য বসন ভূষণ পরিধান পূর্ব্বক ভ্রমণে প্রবৃত্ত হওয়া শুভদ নহে অতএব সহচরীকে কহিলেন ভগিনি, আইস, আমরা পল্লীগ্রামস্থ গৃহস্থ লােকের কন্যাবৎ সামান্য পরিচ্ছদ পরিধান করি। রােজালিন্দ বলিলেন আমরা দুই জনই অবলা, অন্য ব্যক্তি সহায় নাই, এক জন পুরুষের বেশ ধারণ করিলে ভাল হয় না? তৎপরে স্থির হইল রোজালিন্দ কিঞ্চিৎ দীর্ঘাকৃতি অতএব তিনি পুরুষের বেশে গমন করিবেন এবং সেলিয়া পল্লীগ্রাম নিবাসিনী কুলবালার পরিচ্ছদ পরিধান পূর্ব্বক সহগামিনী হইবেন অপর উভয়ের ভ্রাতৃ ভগিনী সম্বন্ধ হইবেক। অতএব রােজালিন্দ পুরুষের সজ্জা ধারণ করিয়া আপনার নাম গ্যানিমেদি রাখিলেন এবং সেলিয়া সামান্য অবলার বেশ গ্রহণ পুরঃসর এলিএনা নামের প্রণয়ন করিলেন।

 রাজকন্যা দ্বয় এবম্প্রকারে বেশ পরিবর্ত্তন পুরঃসর আপনাদের অলঙ্কার সকল পাথেয় স্বরূপে সমভিব্যাহারে লইয়া দীর্ঘকাল দেশ পর্য্যটনে প্রবৃত্ত হইলেন। রোজালিন্দের পিতা আর্দেন নামে যে কাননে বাস করিতেছিলেন তাহা ফ্রেদ্রিকের রাজ্যের সীমার বহির্ভূত ছিল।

 রােজালিন্দ (এই সময় অবধি গ্যানিমেদি নামে প্রসিদ্ধ হইলেন) পুরুষের পরিচ্ছদ পরিধান করাতে পুরুষবৎ সাহস প্রকাশ করিতে লাগিলেন এবং সেলিয়া এলিএনা নাম্নী পল্লিগ্রাম নিবাসিনী সামান্য যােষার বেশ ধারণ পূর্ব্বক তাঁহার সমভিব্যাহারিণী হইয়া দূর দেশ গমনে প্রবৃত্ত হওয়াতে যে দৃঢ়প্রণয়ের নিদর্শন প্রদর্শন করিলেন তজ্জন্য যথার্থই যেন তদীয় বিক্রমশালী ভ্রাতা এবম্বিধ ভাবে সর্ব্বতােভাবে তাঁহার সন্তোষ জন্মাইবার চেষ্টায় রহিলেন।

 তাঁহারা গমন করিতে পথিমধ্যে পান্থশালা এবং উপযুক্ত ভক্ষ্য পেয় প্রাপ্ত হইয়াছিলেন কিন্তু আর্দেন কাননে প্রবেশাবধি কিছু ই লব্ধ হইল না। গ্যানিমেদি সমস্ত বর্ত্ম ভগিনীর সহিত চলিতে২ বিবিধ মধুর বচনােপন্যাস পূর্ব্বক তাঁহার চিত্ত পরিতৃপ্ত করিতেছিলেন এক্ষণে বিশ্রাম ও পানাশন বিরহে খিন্ন হইয়া স্বসৃ সন্নিধানে কহিতে লাগিলেন ভগিনি পুরুষের বেশ গ্রহণ করিয়াও বুঝি শেষে আমাকে অবলা তুল্য রােদন করিতে হইল। এলিএনা কহিলেন আমার আর পদবিক্ষেপের ক্ষমতা নাই চলিতে পারি না। গ্যানিমেদি এ কথায় উদ্বিগ্ন চিত্ত হইলেন কিন্তু ধৈর্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক স্মরণ করিলেন আমি পুমানের প্রকৃতি ধারণ করিয়াছি, নৈরাশ্যে পতিত যােষাগণকে সাহস প্রদান করা পুরুষের কর্ত্তব্য কর্ম্ম, অতএব ভগিনীকে আশ্বাস দিয়া কহিলেন প্রিয়ে এলিএনা আমাদের ভ্রমণের প্রায় শেষ হইয়াছে, আর্দেন কাননে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। কিন্তু কল্পিত সাহস ও পৌরুষ কত ক্ষণ সাহায্য করিবে? যদিও তাঁহারা আর্দেন অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন তথাপি কোন্ স্থানে রাজার অবস্থিতি, জানিতেন না সুতরাং অবিলম্বে পুনর্ব্বার নৈরাশ্যের আবির্ভাব হইল। অধিকন্তু তাঁহারা পথ ভুলিয়া গেলেন এবং খাদ্য সামগ্রী কিছুই প্রাপ্ত হইলেন না ইহাতে অত্যন্ত ক্লেশের সহিত কালের করাল গ্রাসে পতিত হইবার সম্ভাবনা হইল। যখন তাঁহারা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হইয়া একটা তৃণবনের নিকট উপবিষ্ট হইলেন তখন পল্লীগ্রামস্থ এক জন মানুষ দৈবাৎ ঐ পথ দিয়া যাইতেছিল। অতএব গ্যানিমেদি আর একবার পুরুষের সাহস অবলম্বন করত ঐ ব্যক্তিকে সম্বােধিয়া কহিলেন হে ভ্রাতঃ এই নির্জন বনের কোন্ স্থানে খাদ্য সামগ্রী পাওয়া যায় বলিতে পার? যদিস্যাৎ করুণা প্রকাশ অথবা অর্থ গ্রহণ করিয়া আমাদিগকে কিঞ্চিৎ আহরীয় দ্রব্য আনিয়া দাও তাহা হইলে রক্ষা পাই, আমার এই ভগিনীটী অধিক পথ পর্য্যটনে শ্রান্ত এবং পানাশন বিরহে মৃতকল্পা হইয়া পড়িয়াছেন।

 পান্থ কহিল আমি এক জন মেষ পালকের ভৃত্য, আমার প্রভুর নিকেতন এ স্থান হইতে অধিক দূর নয়, অদ্য স্বামির ভবন বিক্রীত হইবে সুতরাং তথায় উত্তমরূপ খাদ্য সামগ্রী মিলে কি না সন্দেহ স্থল, কিন্তু তােমরা যদিস্যাৎ আমার সঙ্গে আগমন কর অবশ্য কিঞ্চিৎ প্রাপ্ত হইতে পারিবে। খাদ্য প্রাপ্তির কথা শ্রবণে গ্যানিমেদি এবং এলিএনার যেন বলাধান হইল, তাঁহারা সত্বর উত্থান পূর্ব্বক সেই পথিকের পশ্চাৎ২ গমন করিলেন এবং সেখানে উপস্থিত হইয়া ভক্ষ্য পেয় লাভে কিঞ্চিৎ সুস্থ হইলেন। পরে যখন মেষ পালকের আলয় ও সম্পত্তি বিক্রীত হইল তখন আপনারাই সমভিব্যাহারে আনীত মুদ্রা দিয়া তাহা ক্রয় করিয়া লইলেন এবং সেই ভৃত্যকে আপনাদের কিঙ্করত্বে নিযুক্ত করিলেন। অতএব অরণ্য মধ্যেও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এক ক্ষুদ্র নিকেতন ও বিবিধ দ্রব্য সামগ্রীর অধিকারিণী হইয়া এই স্থির করিলেন এই অরণ্যানীর কোন্ অংশে রাজা অবস্থিতি করিতেছেন যাবৎ পরিজ্ঞাত না হয় তাবৎ পর্য্যন্ত এই স্থানে অবস্থান করিব।

 এক্ষণে ভ্রমণের পরিশ্রম হইতে বিশ্রাম প্রাপ্ত হওয়াতে অবিপালন দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহেও সন্তুষ্ট হইলেন যদিও তাঁহারা আপনাদিগকে মেষ রক্ষক ও গড ডলিকার পালিকা জ্ঞান করিয়াও সুখী হইতে লাগিলেন তথাপি এক২বার গ্যানিমেদির স্মরণ হইত আমি সেই রোজালিন্দ, এক সময়ে স্যর রোলান্দের প্রবল পরাক্রম পুত্রের প্রতি বদ্ধানুরাগ হইয়া তাঁহাকে প্রাণতুল্য প্রিয় জ্ঞান করিতাম। তিনি অনুমান করিতেন প্রিয়তম অর্লান্দো অতি দূরে রহিয়াছেন কিন্তু অনতিবিলম্বে একটা ঘটনায় প্রকাশ হইল যে সেই কাননেই উপস্থিত হইয়াছেন। সেই ঘটনার বিবরণ নিম্নে প্রকাশ হইবেক।

 অর্লান্দোর পিতা স্যর রোলান্দ কালবশতঃ লোকান্তর গমন কালে জ্যেষ্ঠতনয় ওলিবরের করে কনিষ্ঠ সন্তান সমপর্ণ পূর্ব্বক কহিয়া যান অর্লান্দো অপোগণ্ড বালক, বিদ্যা শিক্ষা হইল না, ইহার প্রতি আমার তুল্য স্নেহ করিয়া লিখন পঠন ও বিবিধ জ্ঞানে সম্পন্ন করত বংশের মর্য্যাদা রাখিও, দেখিও যেন মূর্খ হইয়া পরিবারের কলঙ্ক করে না। কিন্তু ওলিবর উপযুক্ত সহোদর ছিল না, জনকের নির্দেশানুসারে অনুজকে কোন বিদ্যায় শিক্ষা প্রদান করে নাই কেবল বাটীর মধ্যে থাকিতে কহিত সুতরাং অর্লান্দো জ্ঞানালোকে বিহীন হন। শুদ্ধ তাঁহার সৎ স্বভাব ও নৈসর্গিক মহৎ গুণ সকল তাঁহাকে মূর্খতার যন্ত্রণায় পতিত হইতে দেয় নাই। তিনি তদ্‌যোগে বিনা শিক্ষাতে পণ্ডিত বলিয়া গণ্য হইতেন। ওলিবর সহোদরের শরীর শোভা ও প্রকৃতির উৎকর্ষ জন্য লোক সমাজে প্রতিষ্ঠা দেখিয়া ঈর্ষান্বিত হয় পরে মাৎসর্য্য দোষে পরাহত বিবেক হইয়া তাঁহাকে বিনষ্ট করিবার চেষ্টা করে। সেই ব্যক্তিই ষড়যন্ত্র করিয়া ভূরি২ যোদ্ধার প্রাণ হন্তা এবং বিখ্যাত মল্লের সহিত সমর করণার্থ ভ্রাতাকে প্রবৃত্ত করিয়াছিল। অপর অর্লান্দোও যে রণ করিয়া প্রাণ ত্যাগ করিতে ইচ্ছা করেন অগ্রজ ওলিবর সকাশে বিবিধ অনাদর প্রাপ্তিই তাহার প্রধান কারণ।

 কিন্তু অর্লান্দো যখন অসাধারণ বল বিক্রম প্রকাশ পূর্ব্বক বিখ্যাত মল্লের পরাভব করিলেন এবং তাঁহার যশঃ সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হইল তখন দুরাত্মা ওলিবর হিংসায় অধৈর্য্য হইতে লাগিল এবং শপথ পূর্ব্বক প্রতিজ্ঞা করিল অর্লান্দো যে গৃহে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইবে তাহাতে অগ্নি প্রদান পূর্বক দগ্ধ করিয়া মারিব। আদম নামা এক জন প্রাচীন রাজকিঙ্কর অর্লান্দোর প্রতি সাতিশয় স্নেহবান ছিল। সে প্রকারান্তরে ওলিবরের ঐ প্রতিজ্ঞার বিষয় অবগত হইল অতএব অর্লান্দো মল্লযুদ্ধে জয়লাভ পুরঃসর প্রফুল্লচিত্তে প্রত্যাগমন করিতেছেন ইত্যবসরে অগ্রসর হইয়া ঐ বিষয় জ্ঞাপন মানসে পথিমধ্যে তাঁহাকে অবলোকন করিয়া ব্যাকুলান্তঃকরণে কহিতে লাগিল ওগো মহাশয়, ও মহাশয়, ওগো স্যর রোলান্দের বংশধর, আহা আপনি কেন ধার্ম্মিক হইয়াছিলেন? কেনই বা সুশীল বলশালী বীর্য্যবান হইয়াছিলেন? সেই প্রসিদ্ধ মল্লকেই বা কেন পরাভব করিলেন? আপনি সদনে প্রত্যাগমনের অগ্রে আপনার খ্যাতি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। অর্লান্দো বৃদ্ধ ভৃত্যের অকস্মাৎ এত দ্রূপ উক্তি শ্রবণে বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কি কহিতেছ কিছুই যে বুঝিতে পারি না? অনন্তর প্রাচীন সমুদায় বিবরণ ব্যক্ত করিয়া কহিতে আরম্ভ করিল, মহাশয়, আপনি সর্ব্বলোকের প্রিয়পাত্র বলিয়া আপনকার পূর্ব্বজ পূর্ব্বাবধি ঈর্ষান্বিত ছিল সংপ্রতিকার জয় সংবাদে সেই ঈর্ষায় অধীর হইয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছে গৃহে অনল প্রদান পূর্ব্বক আপনাকে দগ্ধ করিয়া মারিবে। অতএব বাটী যাইবেন না, পলায়ন পরায়ণ হইয়া প্রাণ রক্ষা করুন। সেই প্রাচীন অর্লান্দোকে নির্ধন জানিয়া আপনার সঞ্চিত যৎকিঞ্চিৎ যাহা ছিল সমভিব্যাহারে আনয়ন করিয়া ছিল, উক্ত বাক্য কথনানন্তর অর্লান্দোর হস্তে তাহা সমপর্ণ করিয়া কহিল মহাশয় আমি এই পঞ্চ শত স্বর্ণমুদ্রা ভবদীয় জনকের সেবা করিয়া সঞ্চয় করি। মনে করিয়াছিলাম যে সময় জরা জীর্ণতা প্রযুক্ত অক্ষম হইব তৎকালে ব্যয় করিব, তাহাতে আর কাজ নাই, আপনি গ্রহণ করিয়া আপাততঃ আত্ম প্রাণ রক্ষা করুন, পরমেশ্বর কীট পতঙ্গ প্রভৃতি সকল জীবের আহার যোগাইয়া থাকেন আমি অনাহারে মরিব না। আমি স্বেচ্ছা পূর্ব্বক আপনাকে এই মুদ্রা দিতেছি, এ বিষয়ে সঙ্কুচিত হইবার প্রয়োজন নাই। আপনি আমাকে ভৃত্যতায় নিযুক্ত করুন, আমাকে জরাগ্রস্ত দেখাইতেছে বটে কিন্তু এখনও অশক্ত হই নাই, যুবা পুরুষের ন্যায় আপনার পরিচর্য্যা করিতে পারিব। অর্লান্দো বৃদ্ধের এতাবৎ বচন শ্রবণে চমৎকৃত হইলেন এবং ক্ষণকাল বিলম্বে স্থবিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন ওহে সুশীলে প্রাচীন কালের অনির্ব্বচনীয় নির্ম্মল আচরণ তোমাতে আশ্চর্য্য রূপে প্রকাশ পাইল। যাহা হউক, তুমি এ কালের মনুষ্য নহ, চল, দুই জনে প্রস্থান করি। তোমার তরুণবস্থার সঞ্চিত সম্পত্তি ব্যয় না হইতে২ অনুমান করি আমরা জীবিকার উপায় করিতে পারিব।

 অনন্তর সেই বিশ্বস্ত প্রভুভক্ত ভৃত্য সমভিব্যাহারে এক দিকে প্রস্থান করিলেন এবং উভয়ে অজ্ঞাত পথে পর্য্যটন করিতে২ আর্দেন নামক বনে গিয়া উপস্থিত হইলেন। কিয়দ্দিন পূর্ব্বে গ্যানিমেদি এবং এলিএনা ঐ কাননে উপনীত হইয়া অশন পান বিরহে যদ্রূপ কাতর হন ইহাঁদেরও তাদৃশী দশা হইল। জনস্থান অন্বেষণ করিতে২ ক্ষুধা ও পিপাসায় অবসন্ন হইলেন। আদম বয়োবাহুল্য হেতু শক্তি হ্রাস হওয়াতে বুভুক্ষার যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া কহিল মহাশয় ক্ষুধায় প্রাণ বিয়োগ হয় বুঝি এই স্থানই আমার সমাধি স্থান হইল, এই কথা বলিয়া জন্মের মত বিদায় গ্রহণ পূর্ব্বক সেই স্থলে শয়ন করিল। অর্লান্দো তাহার দৌর্বল্য দর্শনে বিষাদ করিতে লাগিলেন এবং স্বীয় বাহুদ্বয় প্রসারণ পূর্ব্বক অবলম্বন করিয়া এক মহীরুহ মূলে লইয়া গিয়া কহিলেন এই সুশীতল তরু ছায়ায় কিয়ৎ ক্ষণ আশ্বস্ত হইয়া বিশ্রাম কর, জীবন বিনাশের আশঙ্কা করিও না, আমি অশনীয় বস্তু অন্বেষণ করিয়া অনিতেছি।

 তিনি আহারাহরণে প্রবৃত্ত হইয়া ইতস্ততো ভ্রমণ করিতেই দৈবাৎ অরণ্যানীর যে স্থানে রাজা বাস করিতেছিলেন তথায় গিয়া উপস্থিত হইলেন। সে সময় ভূপতি ভূরুহতলে তৃণাসন অধ্যাসন পুরঃসর সুহৃদ্বর্গের সহিত ভোজন করিতেছিলেন। অর্লান্দো চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিপাত পূর্ব্বক গমন করাতে দেখিতে পাইলেন।

 অর্লান্দো তাঁহাদের নিকট আহারীয় সামগ্রী অবলোকন করিয়া বলপূর্ব্বক গ্রহণ করিতে মানস করিলেন এবং কোষ হইতে সুতীক্ষ্ণ তরবারি নিষ্কাসন পুরঃসর হঠাৎ তর্জ্জন করত কহিতে লাগিলেন অরে তোদের মুখের হাত মুখে থাকুক আমি এই খাদ্য সকল গ্রহণ করিব। রাজা আগন্তুকের অকস্মাৎ এই অবিনয়ের কথা শুনিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে। কোন প্রকার ক্লেশ কি তোমাকে এবম্প্রকার সাহসী করিয়াছে? না, মূর্খতা প্রযুক্ত স্বভাবতঃ সদ্ব্যবহারে ঘৃণা করিয়া থাক? অর্লান্দো এতদ্বাক্যে বিনম্র হইয়া কহিলেন মহাশয় বুভুক্ষায় প্রাণ বিয়োগ হয়। নৃপতি কহিলেন তবে এ স্থানে উপবেশন কর, আইস একত্র আহার করা যাউক। অর্লান্দো এই সানুক্রোশ বচনে আস্তে২ হস্ত হইতে তরবারি ফেলিয়া দিলেন এবং আপনার মূঢ়তাচরণ নিমিত্ত লজ্জায় অধোবদন হইয়া কহিতে লাগিলেন মহাশয় ক্ষমা করুন আমি অত্রত্য সকল লোককে বর্ব্বর বোধ করিয়াছিলাম তন্নিমিত্ত হঠাৎ এবম্প্রকার ধৃষ্টতা প্রকাশ করি। আপনারা কে? এই মহীরুহমূলে অবস্থান পূর্ব্বক দিনপাত করিতেছেন, আমি জানিতে পারিলাম না। যে প্রকার মনুষ্য হউন, যদি কোন কালে শুভ দিন দেখিয়া থাকেন, যেখানে ধর্ম্মমন্দিরের ঘণ্টা নিনাদিত হয় সেস্থানে যদি কদাচিৎ আপনাদের অবস্থান হইয়া থাকে, কখন যদি ভদ্রলোকের ভবনে ভোজের সময় উপস্থিত হইয়া থাকেন, যদি কদাচিৎ অশ্রুধারা আপনাদের নয়নে আস্পদ করিয়া থাকে, এবং অনুগ্রহ বিতরণ ও অনুগ্রহ গ্রহণ কি রূপ ব্যাপার যদি আপনাদের সুবিদিত থাকে, তাহা হইলে আমার প্রতি কৃপা প্রকাশ করিতে পারেন। রাজা প্রতিবচন প্রদান করিলেন আমরা এক সময়ে শুভদিন দর্শন করিয়াছি যদিও এক্ষণে অরণ্য বাসী তথাপি কোন কালে নগরে অথবা রাজধানীতে আমদের অবস্থিতি হইয়াছে, ধর্ম্মশালার পবিত্র ঘণ্টা রব অস্মদাদির শ্রুতিগোচর আছে, ভদ্রজনের সদনে ভোজনের সময়ে আমোদ প্রমোদ করিয়াছি, কোন সময়ে করুণা রস সঞ্চারে আমাদের নয়ন হইতে বারিধারা বিগলিত হইয়াছে অতএব তোমার আশঙ্কা নাই, এখানে উপবেশন পূর্ব্বক ইচ্ছানুরূপ অশন পান করিয়া ক্ষুধা তৃষ্ণার শান্তি কর। অর্লান্দো বিনীতি প্রদর্শন পুরঃসর নিবেদন করিলেন মহাশয় একটা প্রাচীন আমার সঙ্গে আছে। সে স্নেহসূত্রে সমাকৃষ্ট হইয়া বহু দূর হইতে আমার সমভিব্যাহারে আগমন করিয়াছে, সে ব্যক্তি সংপ্রতি মহা বিপদে পতিত, বার্দ্ধক্য ও বুভুক্ষায় ক্লান্ত হইয়া এখান হইতে কিয়দ্দূরে পড়িয়া আছে, তাহার আহার না হইলে আমি এক গ্রাসও গ্রহণ করিতে পারি না। নরপতি বলিলেন তবে এখনই গিয়া তাহাকে এ স্থানে আনয়ন কর, আমরা তোমাদের অপেক্ষায় রহিলাম। অর্লান্দো এতৎ শ্রবণে তৎক্ষণাৎ গমন করিলেন এবং হস্তাবলম্বন পূর্ব্বক আদমকে ভোজন স্থানে আনিয়া উপস্থিত করিলেন। রাজা বলিলেন তোমরা দুই জনে আহারার্থ উপবেশন কর, উভয়েই সৎকারার্হ। পরে স্থবিরকে অত্যন্ত ক্লান্ত দেখিয়া সকলেই তাহাকে বিশেষ রূপে পানাশন দান ও শান্ত্বনা করিয়া সুস্থ করিলেন।

 অনন্তর নরপতি অর্লান্দোর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিয়া যখন অবগত হইলেন তিনি পরমমিত্র স্যর রোলান্দ-দি-বএজের আত্মজ, তখন মহা সন্তোষ প্রকাশ পূর্ব্বক অতি স্নেহে আশ্রয় প্রদান করিলেন। ইহাতে অর্লান্দো পিতৃ সুহৃৎ নৃপতি সমীপে বৃদ্ধ ভৃত্যের সহিত সেই বিপিনমধ্যে বাস করিতে লাগিলেন।

 অতএব গ্যানিমেদি এবং এলিএনা উক্ত অরণ্যের এক প্রান্তে মেষরক্ষকের সম্পত্তি শুদ্ধ ক্ষুদ্র সদন ক্রয় করিবার অনতিবিলম্বে অর্লান্দোরও বনবাস হইল।

 একদা গ্যানিমেদি এবং এলিএনা কানন ভ্রমণ করিতে২ অবলোকন করিলেন স্থানে২ অনেক মহীরুহের স্কন্ধে রোজালিন্দের নাম অঙ্কিত, এবং তন্নিম্নে সেই মহিলার প্রতি উক্তি স্বরূপ প্রেম বিষয়ক বিবিধ পদাবলি লিখিত রহিয়াছে। ঐ সকল অক্ষর নিরীক্ষণ মাত্রে তাঁহারদের যৎপরোনাস্তি বিস্ময় জন্মিল। দুই জনে আশ্চর্য্য প্রকাশ পুরঃসর তৎ প্রসঙ্গে কথোপকথন করিতেছেন ইতিমধ্যে দৈবযোগে সেই স্থানেই অর্লান্দো আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রোজালিন্দের প্রদত্ত রত্নময় হার তাঁহার কণ্ঠদেশে থাকাতে পরিচয় প্রাপ্তি কঠিন হইল না।

 কিন্তু অর্লান্দো তাঁহাদিগকে চিনিতে পারিলেন না, কেননা যাঁহার প্রণয় পাশে পতিত হইয়া উন্মত্ত হইয়াছেন, এবং প্রত্যেক তরুস্কন্ধে যাঁহার নাম অঙ্কন পুরঃসর প্রেম প্রকাশ করিয়া ভ্রমণ করিতেছেন সেই রমণী যে গ্যানিমেদির বেশ ধারণ পূর্ব্বক অরণ্যে আসিয়া দর্শন দিবেন, ঈদৃশী আশা কখন মনোমধ্যেও স্থান লাভ করে নাই। তথাচ সেই মেষ রক্ষকের শরীর সৌন্দর্য্য এবং বচন মাধুর্য্যে যথেষ্ট পরিতৃপ্ত হইলেন এবং সানন্দ মনে কথোপকথন আরম্ভ করিলেন। তাঁহার এক২বার বোধ হইতে লাগিল গ্যানিমেদি রোজালিন্দের অনুরূপ, কিন্তু মধ্যে২ এমত বিবেচনাও করিলেন সেই ভাবিনীর তুল্য ইহাঁর হাব ভাব দেখিতে পাই না। গ্যানিমেদি যুবা পুরুষের ন্যায় হাস্য পরিহাস কাব্য কৌতুক করিতে পারিতেন অর্লান্দোর কথান্তে চতুরতা ও রসিকতার সহিত ইঙ্গিতে তদীয় প্রণয় ও অনুরাগের বিষয় ব্যক্ত করিয়া কহিলেন যে ব্যক্তি এই কাননে সদা রোজালিন্দ২ বলিয়া পর্য্যটন করে এবং বনস্পতি সকলের স্কন্ধোপরি তাহার নাম অঙ্কিত করত অভিনব পাদপ সকলের সমূলোচ্ছেদন করে, অপর কণ্টকি বৃক্ষে রোজালিন্দের সম্বোধন পূর্ব্বক কবিতা লিখিয়া দেয় আর শোক সুচক সঙ্গীত রচনা করত বৃক্ষোপরি লম্বিত করিয়া বেড়ায় যদিস্যাৎ এ স্থানে তাহার দেখা পাই, উপদেশ ও শিক্ষা দিয়া অনর্থক প্রেম বাসনা হইতে নিবৃত্ত করিতে পারি।

 অর্লান্দো আত্ম পরিচয় প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন আমিই সেই প্রেমাভিলাষী, কই কি উপদেশ দিবে বল দেখি শ্রবণ করি? গ্যানিমেদি বলিলেন তুমি যদিস্যাৎ রোজালিন্দের নিমিত্ত ঈদৃশ ব্যাকুল হইয়া থাক এক কর্ম্ম কর, প্রত্যহ আমাদের নিকেতনে আসিও, আমি সেই যুবতীর রূপ ধারণ করিব তুমি আমাকেই প্রণয়াস্পদ প্রেয়সী জ্ঞান করিয়া উপাসনা করিও। কোন২ নায়িকা অসম্ভব অভিলাষ করিয়া নায়কের সহিত যেরূপ ব্যবহার করে আমিও তদ্রূপ আচরণ পুরঃসর তোমাকে লজ্জিত করিতে পারি। ওহে তরুণ এবম্প্রকার করিলে তুমি অবশ্য এই চিত্ত বৈকল্য হইতে আরোগ্য লাভ করিতে পারিবে সন্দেহ নাই। যদিও এ বিষয়ে অর্লান্দোর বিশেষ উপকার প্রত্যাশা হইল না তথাপি গ্যানিমেদির পরামর্শানুসরণ করিতে স্বীকার করিলেন এবং প্রতিদিন তদীয় ভবনে গমন পূর্ব্বক তাঁহাকে রোজালিন্দ বলিয়া সম্বোধন ও তাঁহার সঙ্গে রহস্যালাপ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন, অধিকন্তু প্রেমাকাঙ্ক্ষায় তরুণ নায়ক গণ স্ব২ নায়িকার চিত্ত রঞ্জনার্থ যদ্রূপ করিয়া থাকে অব্যাজে তদ্রূপ স্তুতি বিনীতি করিতে লাগিলেন। গ্যানিমেদিও নানা প্রকারে হাব ভাব প্রকাশ পুরঃসর তদীয় মনে নূতন প্রণয় স্থাপনার্থ যত্ন করিলেন। কিন্তু রোজালিন্দের প্রেম তাঁহার অন্তর হইতে কোন ক্রমে অন্তর হইল না।

 পরন্তু অর্লান্দো যদিও কেবল ক্রীড়া কৌতুক বোধ করিয়া যুবতীর সহিত ঐ সমস্ত ব্যবহার করিতেছিলেন, কেননা গ্যানিমেদি যে তাঁহার প্রণয় ভাজন রোজালিন্দ, তিনি ইহা স্বপ্নেও জানিতে পারেন নাই, তথাপি আপনার মনের কথা সমুদায় প্রকাশ করিয়া কহিতে লাগিলেন সুতরাং তাঁহাদের উভয়েরই সুমহৎ সুখোদয় হইতেছিল, বিশেষতঃ গ্যানিমেদি স্বয়ং রোজালিন্দ এপ্রযুক্ত অর্লান্দোর প্রেমালাপ স্বকর্ণে শুনিয়া আপনার নিমিত্ত তদীয় কাতর্য্য দেখিয়া হর্ষে পুলকিত হইতেন।

 এইরূপ সুখে কতিপয় দিবস গত হইল। এলিএনা অতিশয় সুলীলা, গ্যানিমেদিকে সুখী দেখিয়া ঈর্ষান্বিত হইলেন না বরং তাহাতে পরম সন্তোষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। গ্যানিমেদি অর্লান্দোর প্রমুখাৎ জনকের বাসস্থলীর নিদর্শন পাইয়া তথায় গমন পূর্ব্বক পিতার সহিত সাক্ষাৎ করিবার পরামর্শ করিয়াছিলেন কিন্তু অর্লান্দোর সহিত ঐ প্রকারে কৌতুকামোদে প্রবৃত্ত হওয়াতে তাহা বিস্মৃত হইলেন এলিএনাও তাঁহাদের সুখ ভঙ্গ ভয়ে স্মরণ করিয়া দিলেন না। কিয়ৎ কাল গতে এক দিন বনবাসি ভূপতির সহিত গ্যানিমেদির সাক্ষাৎ এবং কথোপকথন হইল। রাজা আত্মজকে চিনিতে পারিলেন না, কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন বৎস তুমি কোন বংশে উৎপন্ন? গ্যানিমেদি উত্তর প্রদান করিলেন আপনার তুল্য সদ্বংশে আমার জন্ম! নৃপতি এ কথায় ঈষদ্ধাস্য করিলেন যেহেতু মেষপালক বালকের রাজকুল হইতে উদ্ভব সর্ব্বথা অসম্ভব। গ্যানিমেদি পিতাকে স্বস্থ দেখাতে তৎকালে ঐ বিষয়ে আর কোন কথা কহিলেন না।

 এক দিবস প্রত্যুষে অর্লান্দো গ্যানিমেদির সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে আগমন করিতেছেন ইত্যবসরে পথিমধ্যে অবলোকন করিলেন কিয়দ্দূরে একটা মনুষ্য ভূমি শয্যায় শয়ান এবং তাহার গ্রীবাদেশে একটা বৃহৎ বিষধর কুণ্ডলাকৃতি হইয়া বসিয়া আছে। তিনি নিকটে গমন করিলে সেই ভুজঙ্গ সাশঙ্ক মনে পলায়ন পরায়ণ হইয়া অরণ্যের দিকে গমন করিল। অনন্তর অধিক নিকটস্থ হইলে তাহার দৃষ্টি গোচর হইল একটা সিংহ ঐ সুপ্ত মনুয্যের প্রাণ বিনাশ নিমিত্ত একান্তে সতর্ক হইয়া উপবেশন পূর্ব্বক নিদ্রাপগমের প্রতীক্ষা করিতেছে। সিংহজাতি মৃত বা অচেতন প্রাণি ভক্ষণ করে না, এ কারণ স্বপ্নাবস্থায় শীকার করে নাই। অর্লান্দো তাহার প্রাণ রক্ষার্থ যেন দৈব প্রেরিত হইয়া আসিলেন। সেই শয়ান পুরুষের অদূরবর্ত্তী হওত যখন তাহার বদন নিরীক্ষণ করিলেন তখন অবগতি হইল যে নির্দয় সহোদর নিষ্ঠুরতা পূর্ব্বক তাঁহাকে গৃহদাহে দগ্ধ করিয়া বিনষ্ট করিবার সংকল্প করে সেই ব্যক্তি ঐ বিপদে আপতিত। ইহাতে তাহার নৃশংসতা স্মরণ পূর্ব্বক একবার মনে করিলেন বুভুক্ষু কেশরির করাল কবলে পতিত রাখিয়া প্রস্থান করি কিন্তু তৎক্ষণেই আবার স্বাভাবিক সোদর স্নেহের আবির্ভাব হইল অতএব তীক্ষ্ণ তরবারি নিষ্কাসন পূর্ব্বক তদাঘাতে পঞ্চাস্যের অসু বিনাশ করিলেন। সিংহ তদীয় বিক্রমে পরাজিত হইল বটে কিন্তু তাঁহার একটি হস্তে অতিশয় আঘাত করিল।

 অর্লান্দো যে সময় কেশরির সহিত সংগ্রাম করেন তখন তদীয়াগ্রজ ওলিবর নিদ্রাপগমে জাগ্রৎ হইলেন। যে সহোদরের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করিয়াছিলেন তাঁহার আপনার জীবন রক্ষা নিমিত্ত স্বীয় প্রাণ বিপন্ন করত ভীষণ মূর্ত্তি কেশরির সহিত তাঁহাকে রণ করিতে দেখিয়া যুগপৎ লজ্জা ও শোকে আচ্ছন্ন হইলেন। অনত্তর সিংহ পরাজিত হইয়া বিনষ্ট হইলে ভ্রাতার নিকট আগমন পূর্ব্বক অশ্রুপূর্ণ নয়নে ক্ষমা প্রার্থনা করিলেন। অর্লান্দো অতি সদাশয়, অগ্রজকে খিদ্যমান দেখিয়া দোষ বিস্মরণ পূর্ব্বক আলিঙ্গন করিলেন। ওলিবর যদিও তাঁহার প্রাণ হিংসার সংকল্প করিয়া বনে আগমন করেন তথাপি সে সময় হইতে দ্বেষভাব পরিত্যাগ করিলেন এবং তাঁহার প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

 অর্লান্দো পঞ্চাস্যের সহিত সংগ্রাম কালে তৎ কর্ত্তৃক বাহুদেশে দষ্ট হওয়াতে অধিক পরিমাণে শোণিত বিনির্গমে দুর্ব্বল হইয়াছিলেন এ কারণ গ্যানিমেদির সহিত সাক্ষাৎ করণার্থ গমনে অশক্ত হইয়া অগ্রজকে কহিলেন এই স্থানের অদূরে দুইটী নবীন মেষপালকের বাটী আছে, আপনি তথায় গমনানন্তর গ্যানিমেদি নাম গ্রহণ পূর্ব্বক সম্বোধন করিয়া আহ্বান করত তাহাকে এই বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করিয়া আইসুন। আমি পরিহাস করিয়া গ্যানিমেদিকে রোজালিন্দ বলিয়া থাকি, তাহা বলিলেও হয়।

 ওলিবর অনুজের অনুরোধে সেই স্থানে গমন করিলেন তথায় উপস্থিত হইয়া গ্যানিমেদি ও এলিএনাকে আহ্বান পূর্ব্বক সহোদরের অনুপস্থিতির কারণ বিজ্ঞাপন করত যে প্রকারে আপনার প্রাণ রক্ষা হইয়াছে এবং অনুজ যে রূপ শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ পুরঃসর মৃগেন্দ্র সহিত সমর করিয়া তাহাকে বিনষ্ট করিয়াছে সমুদয় বর্ণন করিলেন। পরিশেষে আপনার অমনুষ্যত্বের বিষয় ব্যক্ত করিয়া কহিলেন আমি নৃশংসতাচরণ পূর্ব্বক অগ্রে অনেক অসদ্ব্যবহার করিয়াছিলাম সংপ্রতি ভ্রাতার সহিত সম্প্রীতি হইয়াছে।

 ওলিবর আত্মমুখে আপনার নির্দয়তার আচরণ প্রকটন পুরঃসর অনুতাপ করিলে তাঁহার কথা শুনিয়া সদয়া এলিএনার চিত্ত দ্রবীভূত হইল এবং যুবতী হঠাৎ তাঁহার প্রেমপাশে আবদ্ধ হইলেন। ওলিবরও সেই বরবর্ণিনীর রূপ গুণ বিশেষতঃ সকরুণ অন্তঃকরণ অবগত হইয়া তদীয় প্রণয় লাভ নিমিত্ত মনোমধ্যে সাতিশয় সমুৎসুক হইলেন। তাঁহারা দুই জনে যে সময় এই রূপে পরস্পর অনুরাগ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন সেই সময় অর্লান্দোর বিপদ্ বার্ত্তা শ্রবণে গ্যানিমেদির মনঃ শোকাকুল হইল। তরুণী ক্ষণকাল তদেক চিত্ত হইয়া চিন্তা করত মোহে মূর্চ্ছিতা হইয়া ভূমে পড়িলেন। কিয়দ্বিলম্বে ধৈর্য্যাবলম্বন পুরঃসর আপনিই আপনার মূর্চ্ছা ভঙ্গ করিলেন এবং ছল করিয়া কহিলেন কৌতুক রসে রসিক হইয়া রোজালিন্দ স্বরূপ হওয়াতে কল্পিত মূর্চ্ছা হইয়াছিল পরে ওলিবরকে বলিলেন দেখ তোমার ভ্রাতার নিকট গিয়া এই সমাচার তাঁহার সুগোচর করিও। কিন্তু ওলিবর সেই সুরূপার আকৃতি বৈবর্ণ্য অবলোকনে বুঝিতে পারিলেন তাঁহার মূর্চ্ছা কল্পিত নহে, বস্তুতই মোহপরায়ণ হইয়াছিলেন। অতএব পরিহাস করত তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন যদি তোমার কৃত্রিম মোহ হইয়াছিল তবে এখনও সুস্থির চিত্ত দেখি না কেন? প্রকৃতিস্থ হও দেখি। গ্যানিমেদি কহিলেন এইতো প্রকৃতিস্থই আছি, যখন মূর্চ্ছিত হইয়াছিলাম তখন রমণী হইলে ভাল হইত।

 ওলিবর এই রূপে নানাপ্রকার কথোপকথন করিয়া অনেক ক্ষণ বিলম্বে তাঁহাদের সংবাদ গ্রহণ পুরঃসর অনুজ সন্নিধানে প্রত্যাগমন করিলেন। সেখানে যাহা ঘটিয়াছিল এবং এলিএনার প্রতি হঠাৎ আপনার যে প্রকার প্রণয় বাসনা হয় সমুদয় বিবরণ করিয়া ব্যক্ত করত কহিলেন ভ্রাতঃ সেই সুন্দরীতে আমার মনঃ নিমগ্ন হইয়াছে আমি নিতান্ত পক্ষে মেষরক্ষক স্বরূপ হইয়াও তাঁহার আলয়ে থাকিব। তুমি ভবনে গমন করিয়া বিষয় বিভব উপভোগ করহ।

 অর্লান্দো বলিলেন যদিস্যাৎ সেই যুবতী আপনার প্রতি অনুরক্ত হইয়া থাকেন তবে আমার এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সম্মতি আছে, কল্যই তাঁহার সহিত আপনার পরিণয় সমাধা হউক, এস্থানে নৃপতি সুহৃদ্বর্গ সমভিব্যাহারে অবস্থিতি করিতেছেন তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিতে হইবে, আপনি পুনর্ব্বার সেই মহিলার আলয়ে গমন করিয়া তাঁহাকে সম্মতা করিয়া আইসুন, এখন তাঁহার সহিত উত্তম রূপে কথা বার্ত্তা হইতে পারিবে, ঐ দেখুন তদীয় ভ্রাতা গ্যানিমেদি এখানে আসিতেছেন অতএব তিনি একাকিনী আছেন। ওলিবর সোদরের পরামর্শানুসারে এলিএনার সন্নিধানে পুনশ্চ গমন করিলেন। এ দিকে গ্যানিমেদি অর্লান্দোর নিকট উপনীত হইয়া সস্নেহ বচনে ক্ষত জন্য পীড়ার শান্তি হইয়াছে কি না জিজ্ঞাসা করিলেন।

 এক্ষণে গ্যানিমেদির সহিত অর্লান্দোর এবং এলিএনার সঙ্গে ওলিবরের প্রণয় বিষয়ক বিশ্রম্ভালাপ হইতে লাগিল। অর্লান্দো কথোপকথনান্তে গ্যানিমেদিকে কহিলেন আমার অগ্রজ এলিএনার প্রেমে মুগ্ধ হইয়াছেন অতএব অপরেদ্যুঃ পাণিপীড়ন স্থির করণার্থ তাঁহাকে সে স্থানে প্রেরণ করিয়াছি, মদীয় সোদরের প্রতি সেই তরুণীর অনুরাগ জন্মিয়াছে অনুমান করি সম্মত হইবেন। আহা যদি ঐ দিবসে আমিও রোজালিন্দকে পরিণয় করিতে পাইতাম তাহা হইলে আমার চিরকালের আশা লতা ফলবতী হইত।

 গ্যানিমেদি প্রিয়তমের এই বাসনা পূর্ণ করিতে মনে সম্মত হইয়া কহিলেন, তুমি রোজালিন্দের প্রতি মুখে যে প্রকার প্রীতি প্রকাশ করিতেছ অন্তঃকরণ মধ্যে যদিস্যাৎ তাদৃশ প্রণয় সঞ্চার হইয়া থাকে তোমার অভিলাষ সিদ্ধ হইবে আমি তাহাকে আনয়ন পুরঃসর সম্মত করিয়া তোমার অঙ্কলক্ষ্মী করিয়া দিব।

 রোজালিন্দই গ্যানিমেদি নামে বিখ্যাত, তিনিই অর্লান্দোর সহিত কথোপকথন করিতেছিলেন, ইহাতে তাঁহার এই প্রতিজ্ঞা সহজে সম্পন্ন হইবে বিচিত্র কি? কিন্তু যুবতী তখনও আত্ম পরিচয় দিলেন না, কপটতা পূর্ব্বক কহিলেন আমি ঐন্দ্রজালিক বিদ্যার প্রভাবে এই কর্ম্ম সম্পন্ন করিব, আমার পিতৃব্য প্রসিদ্ধ মায়াবী ছিলেন তাঁহার নিকট ঐ বিদ্যার বিবিধ প্রকরণ শিক্ষা করিয়াছি।

 গ্যানিমেদির এই কথায় অর্লান্দোর সম্পূর্ণ বিশ্বাস হইল না, কোন২ অংশে সন্দিহান হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন তুমি কি সত্য কহিতেছ? গ্যানিমেদি প্রতিবচন প্রদান করত কহিলেন আপনার দিব্য, যথার্থ কহিতেছি, তুমি উত্তম পরিচ্ছদ ধারণ করিয়া থাকিও এবং অত্রস্থ ভূপতি ও তোমার বন্ধু বান্ধবদিগকে নিমন্ত্রণ করিও, যদি আগামি দিবসে রোজালিন্দের পাণিগ্রহণ করিতে বাঞ্ছা কর কল্যই তিনি এ স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইবেন।

 অনন্তর ওলিবর এলিএনাকে সম্মত করিয়া প্রত্যাগমন করিলেন অতএব পর দিবস প্রত্যূষে দুই জনে রাজ সমীপে গমন পূর্ব্বক ভূপতিকে এবং তদীয় বন্ধু বর্গকে আপনাদের বিবাহোপলক্ষে নিমন্ত্রণ করিয়া আসিলেন। সকলে এলিএনাকে অবলা বলিয়া জানিতেন, ওলিবর ও অর্লান্দো দুই জনের বিবাহ এক কন্যার সহিত কিরূপে সম্পন্ন হইবে, এই ভাবিয়া সবিস্ময় মনে কৌতুকাবিষ্ট হইয়া নিমন্ত্রণে আসিতে লাগিলেন। তাবতেরই বোধ হইল গ্যানিমেদি অর্লান্দোর সহিত পরিহাস করিবেন।

 পরে পরম্পরায় নৃপতির কর্ণগোচর হইল তাঁহারই তনয় আশ্চর্য্য প্রকারে আনীতা হইয়া অর্লান্দোর সহিত পরিণীতা হইবেন, অতএব অর্লান্দোকে জিজ্ঞাসা করিলেন ওহে মেষপালবালকের প্রতিজ্ঞাত বিষয়ে তোমার কি বিশ্বাস জন্মিয়াছে? অর্লান্দো সবিনয়ে নিবেদন করিলেন মহাশয় আমি কিছু বুঝিতে পারি নাই। ইতিমধ্যে গ্যানিমেদি তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং নৃপতি সন্নিধানে নিবেদন করিলেন মহাশয় একটা জিজ্ঞাস্য আছে, যদি আপনকার নন্দিনীকে এখানে আনয়ন করিয়া থাকি তাহা হইলে আপনি এই অর্লান্দোর সহিত তাঁহার বিবাহ দিবেন? রাজা কহিলেন কেবল কন্যা নয়, আমার রাজ্য থাকিলে তাহাও তৎসঙ্গে ইহাঁকে সমপর্ণ করিতে পারি। পরে অর্লান্দোকে জিজ্ঞাসা করিলেন কেমন্ তুমি কি বল। যদি তাঁহাকে এস্থানে আনয়ন করি পাণিপীড়ন করিবে। অর্লান্দো উত্তর প্রদান করিলেন এ বিষয় আবার জিজ্ঞাসা করিতেছ? যদিস্যাৎ ভূরি ভূমির অধিপতি ও রাজ্যেশ্বর হই তথাপি অস্বীকার করিব না।

 অনন্তর গ্যানিমেদি এলিএনার সহিত আপনাদের গৃহে প্রত্যাগমন করিলেন। পুরুষের বেশ পরিত্যাগ পূর্ব্বক স্বাভাবিক স্ত্রীরূপ ধারণ করাতে ঐন্দ্রজালিক বিদ্যার আশ্রয় ব্যতিরেকেও তাঁহাতে অবিকল রোজালিন্দোর ভাণ হইল। অপর এলিএনা পল্লীগ্রাম নিবাসিনীর পরিচ্ছদ পরিহার পূর্ব্বক বহুমূল্য বসন ভূষণ পরিধান করিয়া সহজে সেলিয়া হইলেন।

 তাঁহারা আপনাদের আলয়ে প্রত্যাগমন করিলে ভূপাল অর্লান্দোর নিকট কহিতেছিলেন গ্যানিমেদি নামক যে মেষপালবালক তাহাতে রোজালিন্দরে অবিকল অবয়ব সাদৃশ্য প্রকাশ পায়। অর্লান্দো কহিলেন সত্য বটে আমিও প্রায় সর্ব্বাংশে সৌসাদৃশ্য দর্শন করিয়াছি।

 সকলে একত্র উপবেশন পূর্ব্বক এই বিষয় বিবেচনা করিতেছেন ইত্যবসরে রোজালিন্দ এবং সেলিয়া স্ব২ বেশে তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রোজালিন্দ এক্ষণে আর ঐন্দ্রিজালিক মায়ার অপদেশ না করিয়া পিতৃ চরণ সন্নিধানে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত পূর্ব্বক প্রার্থনা করিলেন তাত আশীর্ব্বাদ করুন। তত্রস্থ সমস্ত মানব এতদবলােকনে সাতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইলেন, সকলেরই কিয়ৎ ক্ষণ ঐন্দ্রজালিক বলিয়া বােধ হইল। কিন্তু তিনি জনক সন্নিধানে আর আত্মগোপন করিতে বাসনা করিলেন না, পিতৃব্য কর্ত্তৃক নির্বাসন অবধি যাহা২ ঘটে সমুদায় বর্ণন করিলেন।

 অনন্তর রাজার প্রতিজ্ঞানুসারে এক কালেই রােজালিন্দের সহিত অর্লান্দোর এবং সেলিয়ার সঙ্গে ওলিবরের বিবাহ সম্পন্ন হইল। যদিও অরণ্যানী মধ্যে নিবাস হেতু পরিণয়ের উপযুক্ত সমারােহ হইবার সম্ভাবনা ছিল না তথাপি উদ্বাহ বাসর পরম সুখকর আমােদ প্রমােদে যাপিত হইল। পরে তাঁহারা যে সময় বিশাল তরুতলে সুস্নিগ্ধ ছায়ায় উপবেশন পূর্ব্বক বিবাহােপলক্ষে ভােজনােৎসব করিতেছিলেন এবং যৎকালে সকলে প্রশংসা পূর্ব্বক কহিতেছিলেন সুশীল মহীপালের এবং অভিনব বিবাহিত প্রণয়ি চতুষ্টয়ের সুখ সন্তোষ সম্পাদন নিমিত্ত কোন বিষয়ের অভাব হইবেক না তৎকালে এই শুভ সংবাদ আসিল নৃপতি স্বীয় রাজত্ব পুনঃ প্রাপ্ত হইবেন।

 রাজ্যাপহারী ফ্রেদিক্‌ আত্ম তনয়ার পলায়ন বিশেষতঃ বনবাসি রাজ্যভ্রষ্ট সহােদরের নিকট অধিকারস্থ মান্য সম্ভ্রান্ত লােকদের গমনাগমনে ক্রোধের্ষায় প্রজ্বলিত হইয়া ভূরি২ সেনা সংগ্রহ পুরঃসর অরণ্যস্থ ভূপতি এবং তদীয় সুহৃদ্বর্গের প্রাণ বিনাশ মানসে সেই আর্দেন নামক কাননে আগমন করিতেছিলেন ইতিমধ্যে পরমেশ্বরেচ্ছায় একটী আশ্চর্য ঘটনা হওয়াতে ভ্রাতৃদ্বেষ হইতে হঠাৎ তাঁহার চিত্ত নিবৃত্ত হইল। যখন বিপিন মধ্যে প্রবেশ করেন তৎকালে একটী স্থবির বানপ্রস্থের সহিত সাক্ষাৎ হওয়াতে পরস্পর অনেক ক্ষণ কথােপকথন করিলেন। তাহাতে আরণ্যক মুনির সদুপদেশ ও বিবিধ ধর্ম্ম কথায় তাঁহার অন্তঃকরণে বৈরাগ্যের আবির্ভাব হইল। অতএব পরম পূজ্য অগ্রজের প্রতি পাপাচরণ নিমিত্ত অনুতাপ করিতে লাগিলেন এবং অন্যায়ে পরিগৃহীত রাজসিংহাসন স্বয়ং পরিত্যাগ পূর্ব্বক জীবনের অবশিষ্ট কাল ধর্ম্ম মন্দিরে অবস্থান করিয়া পরমার্থ চিন্তনে যাপন করিতে মনস্থ করিলেন। এই মানস প্রবল হওয়াতে প্রথমতঃ বনমধ্যে সহোদর সন্নিধানে দূত প্রেরণ পুরঃসর সবিনয়ে নিবেদন করিতে কহিলেন আমি এতকাল অন্যায়তঃ আপনার রাজ্য এবং ভবদীয় সুহৃদ্বর্গের সম্পত্তি ভােগ করিয়াছি এক্ষণে অকপটে সমুদায় প্রত্যর্পণ করিব ত্বরায় আগমন করুন।

 এই শুভ সংবাদ ঘটনাক্রমে রাজপুত্রীদ্বয়ের পরিণয়োপলক্ষে উৎসবের সময় উপস্থিত হওয়াতে মহা আনন্দ ও ভূরি সমারােহে ঐ ব্যাপার সম্পন্ন হইল। রােজালিন্দের পিতৃ সৌভাগ্য পুনরুদিত হইবার বার্ত্তা শ্রবণে যদিও সেলিয়ার উত্তর কালে রাজ্যাধিকার প্রত্যাশা অপগত হইল তথাপি ভগিনীর তৎ প্রাপ্তি সম্ভাবনায় অকপটে আহ্লাদ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। ফলতঃ তাঁহাদের দুই জনের মনে অকৃত্রিম প্রণয় চিরকালাবধি বিরাজমান ছিল, ঈর্ষা অথবা হিংসা কদাপি তাহাতে স্ব২ প্রসর লাভ করিতে পারে নাই।

 মহারাজ এক্ষণে নির্বাসনের সমভিব্যাহারি অকৃত্রিম মিত্র বৃন্দের যথােচিত পুরস্কার করিবার সুযােগ প্রাপ্ত হইলেন। অতএব যে মহানুভব অনুচরগণ স্ব২ বিত্ত বিভব বিসর্জ্জন পুরঃসর অন্যের দুর্ভাগ্যে খিন্ন হইয়া বনবাস করিতেছিলেন অধুনা তাঁহারা সদনুষ্ঠানের বিনিময়ে মহা২ সৌভাগ্য সম্পন্ন হইয়া প্রত্যাগমন পুরঃসর ন্যায়কারি নৃপতির রাজত্বে পরম সুখে বসতি করিতে লাগিলেন ইতি।

সম্পূর্ণ।


RAJKRISHNA GHOSE, PRINTER AND PUBLISHER, 12 OMRATOLOH ST.