সেক্‌সপিয়র কৃত গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত অপূর্ব্বোপাখ্যান/ম্যাক্‌বেথের উপাখ্যান


R. D. SORNOKAR, ENGR
৪৫৫

ম্যাক্‌বেথ্‌

ম্যাকবেথের উপাখ্যান।


 স্কত্‌লন্দ দেশে দন্‌কেন নামক নরপতির অধিকার কালে ম্যাকবেথ নামা এক জন সম্ভ্রান্ত মনুষ্য বাস করিতেন। নৃপতির সহিত নৈকট্য সম্বন্ধ এবং শৌর্য্য বীর্য্যের খ্যাতি থাকাতে রাজসভায় তাঁহার যথেষ্ট সম্মান ছিল। অপর নরওএ দেশের সংগ্রামে রণ পাণ্ডিত্য প্রকাশ পুরঃসর বিপক্ষ পক্ষের পরাভব করাতে মহা যশস্বী হন।

 নরওএর সমর সমাপ্ত হইলে ম্যাক্‌বেথ বেন্‌কো নামক স্কত্‌লন্দীয় সেনানী সমভিব্যাহারে একটা প্রান্তর উত্তীর্ণ হইয়া স্বদেশে প্রত্যাগমন করিতেছিলেন ইত্যবসরে তিনটা স্ত্রী মূর্ত্তি সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাঁহাদের বর্ত্মাবরোধ করিল। উক্ত আকৃতি ত্রয়ের অস্নিগ্ধ বর্ণ এবং অসভ্য পরিচ্ছদে বোধ হইল তাহারা অবনীমণ্ডলের কোন প্রকার জীব নহে। ম্যাক্‌বেথ সম্ভাষণ নিমিত্ত প্রথমতঃ তাহাদিগকে সম্বোধন করিলেন তাহাতে তাহারা বৈরক্তি ভাব ব্যক্ত করত প্রত্যেকে স্ব২ ওষ্ঠে সচ্ছিদ্র অঙ্গুলী অর্পণ পূর্ব্বক সঙ্কেতে মৌনাবলম্বন করিতে কহিল। পরে অগ্রবর্ত্তিনী স্ত্রীপ্রকৃতি ম্যাক্‌বেথকে গ্লামিস দেশাধিপ বলিয়া অভ্যর্থনা করত অভিবাদন করিল। সেনাপতি ম্যাক্‌বেথ এই সম্বোধনে ঐ অদ্ভুত স্ত্রীজাতির নিকট আপনি কি প্রকারে পরিচিত হইলেন ভাবিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিতে লাগিলেন, বিশেষতঃ দ্বিতীয় আকৃতি যখন তাঁহাকে কাদরাধীশ বলিয়া এবং তৃতীয়া মূর্ত্তি ভাবি মহারাজ শব্দ প্রয়োগ পূর্ব্বক সম্ভাষণ করিল তখন তাঁহার বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না, ফলতঃ রাজা সপুত্রে বর্ত্তমান থাকাতে সিংহাসনাধিরোহণের সর্ব্বথা অসম্ভাবনা ছিল। তদনন্তর উক্ত মূর্তিত্রয় একবাক্যে বেনকোর প্রতি ভঙ্গিক্রমে কহিতে লাগিল আপনি ম্যাক্‌বেথাপেক্ষা ক্ষুদ্র ও প্রধান দুই প্রকার হইতে পারেন, তদপেক্ষা সুখী নহেন বটে কিন্তু অধিক সৌভাগ্যান্বিত বোধ করিলেও করিতে পারিবেন। এতদুক্তির তাৎপর্য্য এই যে তিনি স্বয়ং রাজা হইবেন না বটে কিন্তু তাঁহার সন্তানেরা তদবসানে স্কতলন্দের সিংহাসনারোহণ করিবেন। এতাবন্মাত্র উক্তি করিয়া তাহারা তাঁহাদের সমক্ষেই অন্তর্ধান হইল। অতএব সেনাপতিরা নিশ্চয় করিলেন ইহারা দেবযোনি ডাকিনী, কোন সন্দেহ নাই।

 সেনাপতি দ্বয় এই অদ্ভুত ঘটনায় বিস্ময়ান্বিত হইয়া সেই স্থানে দণ্ডায়মান হওত চিন্তা করিতেছেন ইতিমধ্যে কতিপয় রাজ দূত তথায় আসিয়া সংবাদ দিল সম্রাট ম্যাক্‌বেথের প্রতি কাদর দেশের আধিপত্য প্রদান করিয়াছেন। তাঁহাকে কাদরাধিপতি বলিয়া সম্ভাষা করিতে আমাদিগকে প্রেরণ করিলেন। এই ব্যাপারে ডাকিনী ত্রয়ের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রত্যক্ষ ফল দৃষ্ট হওয়াতে ম্যাকবেথের বিস্ময়ের পরিচ্ছেদ রহিল না। তিনি কিয়ৎ ক্ষণ বিমুগ্ধ প্রায় হওয়াতে দূতদিগকে প্রতি বচন প্রদানে অক্ষম হইলেন। মনোমধ্যে এই আশা প্রবলা হইয়া উঠিল তবে তৃতীয় ডাকিনীর ভবিষ্যদ্বাণীও সফলা হইতে পারে, কোন্ দিন বা স্কতলন্দ দেশের সম্রাট হইয়া পড়ি।

 অনন্তর বেনকোকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন মিত্র দেবযোনিরা যাহা২ কহিয়া গেল তাহার একটা যে এখনই পূর্ণ হইল অতএব তোমার পুত্রগণ রাজা হইবে এ আশা তোমার অন্তঃকরণে স্থান লাভ না করে কেন? বেনকো উত্তর করিলেন তুমি সিংহাসনের প্রতি লক্ষ্য করিয়া থাক ইহাতে ঐ প্রকার আশয়ে তোমার মন উৎসাহান্বিত হইতে পারে, আমার তাদৃশ বিষয়ে বিশ্বাস হয় না। সখে আমার বোধ হয় ঐ কুহকিনীরা কোন গুরুতর বিষয়ে আমাদিগকে বঞ্চনা করিবার নিমিত্ত দুই একটা সামান্য বিষয়ে সত্য বাক্য কহিয়া গেল।

 কিন্তু ম্যাকবেথের মনে ডাকিনীদের প্রদত্ত আশা বদ্ধমূল হইল। সুবিজ্ঞ বেনকো ঐ দুরাশা পরিত্যাগ করাইবার নিমিত্ত তাঁহাকে বিস্তর প্রবোধ ও সৎপরামর্শ দিলেন কিন্তু তিনি কিছুই শুনিলেন না, কি রূপে স্কতলন্দ দেশের রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হইবেন অহর্নিশ তদুপায় চিন্তায় নিমগ্ন রহিলেন।

 পরে গৃহে প্রত্যাগমন করিয়া বনিতার নিকট ডাকিনীদের ভবিষ্যদ্বাণীর বিষয় ব্যক্ত করিলেন এবং সহাস্য বদনে সংবাদ দিলেন প্রিয়ে এই দৈব বাক্যের কিয়দংশ ইতিমধ্যে পূর্ণ হইয়াছে। তাঁহার মহিলা দঃশীলা এবং ধনলুব্ধা, স্বামির উচ্চ পদাভিষিক্ত হইবার কথা শ্রবণাবধি তদর্থ যে কোন উপায় সম্ভাব্য চিন্তা করিতে প্রবৃত্তা হইল। অতএব ম্যাকবেথ যখন সম্রাটের প্রাণনাশের বিষয় ভাবিয়া তর্ক বিতর্ক করিতে লাগিল তৎকালে ঐ নিষ্ঠুর অঙ্গনা নানাপ্রকারে পতির প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দিয়া কহিল প্রশংসনীয় ভবিষ্যদ্বাণীর পূরণার্থ মহারাজের জীবন বিনষ্ট করা নিতান্ত আবশ্যক।

 সম্রাট স্বীয় নম্রতা ও কৃপালু স্বভাব প্রযুক্ত সর্ব্বদা সম্ভ্রান্ত সভাসদ্গণের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন। অতএব সেনানী ম্যাক্‌বেথ সমর বিজয়ানন্তর প্রত্যাগমন করিলে তাহার অভ্যর্থনা নিমিত্ত মাল্‌কম ও দোনালবেন নামক দুই রাজকুমার এবং বহু সংখ্যক মান্য লোক সমভিব্যাহারে তদীয় আলয়ে গমন করিলেন।

 ম্যাকবেথের নিকেতন অতি সুরম্য স্থানে স্থাপিত ছিল। অট্টালিকার চতুর্দিকের প্রান্তভাগে যে২ স্থল উৎকৃষ্ট, তথায় চাতক বিহঙ্গ সকল নীড় নির্মাণ পূর্ব্বক অবস্থিতি করিত। যেখানে পক্ষি সকল উৎপন্ন হয় এবং সতত গমনাগমন করে সেখানকার সমীরণ অতি নির্ম্মল ও সুখস্পর্শ হইয়া থাকে। অতএব সেনানীর ভবন অতি নির্বৃতিকর ছিল। মহারাজ স্বগণ সমভিব্যাহারে সেই সদনে প্রবেশ করিলে সেনাপতির মহিলা অবলোকন করিয়া তাঁহার যথার্থ অভ্যর্থনা করিল। সম্রাট স্বীয় সদাশয়তা প্রযুক্ত ঐ দুর্ললিতা ললনার দুরাশয়ের বিষয় বিতর্ক করিলেন না, মৌখিক মধুর বচনেই যথেষ্ট সন্তুষ্ট হইলেন। ফলতঃ তাহার মানস তর্ক করা সুকঠিন ব্যাপার ছিল, সে সহাস্য আস্যে আপন বিশ্বাস ঘাতকতার মানস গোপন করিতে পারিত সুতরাং অন্তঃকরণে বিষধরের তুল্য খলতা দেদীপ্যমান থাকিলেও দৃশ্যে নির্দোষ কুসুমের ন্যায় স্বচ্ছাশয়তা প্রকাশ করিত।

 অনন্তর নিশা সমাগত হইলে সমাট অধ্বশ্রান্ততা হেতু অনতিবিলম্বে শয়নার্থ শয্যারোহণ করিলেন। রাজনিয়মানুসারে দুই জন ভৃত্য তাঁহার রক্ষণাবেক্ষণ নিমিত্ত শয়নাগারের এক পার্শ্বে শয়ান রহিল। মহারাজ সেনানীর আতিথ্যে যথেষ্ট সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন, নিদ্রার্থ গমন করিবার পূর্ব্বে তাহার পুরস্কার নিমিত্ত বহুমূল্য বসন ভূষণ প্রসাদ দান করিয়া অন্যান্য সম্ভ্রান্ত জনগণকে যথোচিত পারিতোষিক প্রদান করিয়াছিলেন। অপর সেনাপতির বনিতাকে বহুমূল্যের একখান চমৎকার হীরক প্রদান পূর্ব্বক তদীয় সচ্চরিত্র ও আতিথেয়তার বিশেষ প্রশংসা করেন।

 নৃপতি পর্য্যঙ্কোপরি শয়নানন্তর নিদ্রিত হইলে যখন রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর হইল, যে সময় জগতের জীবজন্তু নিদ্রাগমে অচেতন হইয়া মৃত প্রায় হয়, সুপ্ত মানবগণের মনে অধম স্বপের আবির্ভাব হইতে থাকে, এবং ব্যাঘ্র ও হিংস্র ব্যতীত অন্য প্রাণী গৃহ হইতে নির্গত হয় না, সেই কালে ম্যাকবেথের গৃহিণী নিদ্রা পরিহার পূর্ব্বক গাত্রোত্থান করিল এবং কি রূপে ভূপতির প্রাণ বধ করিবে উপায় চিন্তা করিতে লাগিল। স্ত্রীজাতির পক্ষে ঈদৃশ ভয়ঙ্কর ঘৃণা জনক জঘন্য কর্ম্ম অসম্ভাবনা বটে কিন্তু সে আপনার পতির সদয় স্বভাব বিবেচনা করত মনে করিল এতাদৃশ ভয়ানক ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইতে স্বামির উৎসাহ হইবে না, তিনি অতিশয় লোভী বটেন কিন্তু অত্যন্ত সন্দিগ্ধচিত্ত, নরপতির প্রাণ বিনাশ পূর্ব্বক সাম্রাজ্য গ্রহণ মহা সাহসের কর্ম্ম, তাঁহা হইতে এ কার্য্য সমাধা হওয়া সুকঠিন অতএব আমাকেই এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতে হইল। সেনানীর নির্দয়া দয়িতা ঐ বিষয়ে পতিকেই প্রবৃত্ত হইতে অনেক প্রকারে প্রবৃত্তি দিয়াছিল তাহাতে স্বামী এক প্রকার সম্মতিও প্রকাশ করে কিন্তু তাহার স্থির প্রতিজ্ঞার বিষয়ে সন্দেহাপগম হয় নাই সুতরাং আপনি একখান তীক্ষ্ণধার খড়্‌গ ধারণ পূর্ব্বক সমাটের শয্যা সন্নিকটে গিয়া উপস্থিত হইল। সে এই নিষ্ঠুর ব্যাপার বিনা বাধায় সম্পন্ন করিবার অগ্রে রাজকিঙ্করদিগকে অতিরিক্ত মদ্যপান করাইয়াছিল। সুতরাং তাহারা অচেতন হইয়া স্ব২ কর্ত্তব্য বিস্মরণ পূর্ব্বক ভয়ানক নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিল। পথশ্রান্তি হেতু শয়নানন্তর নৃপতিরও সংজ্ঞা ছিল না। ম্যাকবেথপত্নী সমীপবর্ত্তিনী হইয়া অগ্রে নৃপতির বদন নিরীক্ষণ করিতে লাগিল তাহাতে ভূপালের মুখমণ্ডলে তাহার জনকের আস্য সাদৃশ্য প্রকাশ হইল অতএব খড়্‌গোদ্যম করিলেও সহসা তাঁহার অসু বিনাশে সেই দুষ্টা যোষার সাহস হইল না।

 সে স্বামির সহিত কথোপকথন পূর্ব্বক ঐ বিষয়ের পরামর্শ নিমিত্ত আপন শয়নাগারে প্রত্যাগমন করিল কিন্তু এক্ষণে তাহার পতিও ঐ কল্পনা জঘন্য বলিয়া সন্দেহ করিতে লাগিল। পরিশেষে বিবেচনানন্তর স্থির করিল সম্রাটের প্রাণ হিংসা করা অনুচিত কর্ম্ম, আমি রাজার এক জন প্রজা এবং আমার সহিত তাঁহার সৌহৃদ্য আছে, বিশেষতঃ অদ্য তাঁহার প্রতি অতিথি সৎকার করিয়াছি, অন্য ব্যক্তি অতিথির উপর হিংসা করিতে আসিলে তাহা হইতে রক্ষা করিতে হয়, আতিথেয় স্বয়ং কি প্রকারে তাহার প্রাণ সংহার করিবে? অপর এই মহারাজ অতিশয় দয়াবান, যাবতীয় প্রজাজনের অনুরাগ ভাজন। সম্ভ্রান্ত সমস্ত সভাসদকে বিশেষতঃ আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করিয়া থাকেন। আমি অধুনা সাম্রাজ্য লোভের পরতন্ত্র হইয়া যদিও কৃতঘ্নতা পূর্ব্বক সেই স্নেহ বিস্মরণ করি তথাপি আমাকর্ত্তৃক রাজা নিহত হইলে রাজ্যের সমুদায় লোক আমার প্রতিহিংসা করিবে। অতএব মহীপতির প্রাণ বিনষ্ট করিলেই বা কি সুখোৎপত্তি? কিছুই দেখিতে পাই না, এক্ষণে নৃপালের অনুগ্রহ হেতু সর্ব্ব সন্নিধানে সম্মান আছে, ঐ ঘৃণিত ব্যাপারে প্রবৃত্ত হইলে তাহা দূরীভূত এবং রাজবিদ্রোহে আপনার বংশ ক্ষয় মাত্র হইবে।

 ম্যাকবেথের নির্দয়া দয়িতা যখন দেখিল স্বামী অকস্মাৎ চিন্তামগ্ন হইল এবং তাহার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হওয়াতে প্রস্তাবিত মন্ত্রণায় উৎসাহ নিবৃত্তি পাইল তখন পতিকে নানা প্রকারে বুঝাইতে লাগিল এবং বাক্ কৌশলে পুনর্ব্বার তাহার প্রবৃত্তি জন্মাইয়া দিবার চেষ্টা করিল। ভর্ত্তাকে কহিল যে কল্পনা করিলে তাহা হইতে কেন ক্ষান্ত হইতেছ? তোমার অদৃষ্টে রাজ্যলাভ আছে, অবিলম্বে অতি সহজে সম্পন্ন হইতে পারে, কেন বিমুখ হইয়া কাল বিলম্ব করিবে? এক রাত্রির যৎকিঞ্চিৎ পরিশ্রমে রাজপদ ও রাজকীয় ক্ষমতা প্রাপ্ত হওয়া যায় ইহাতেও নিরুৎসাহ হইতেছ? সেই দুঃশীলা এই সমস্ত প্রবোধ বাক্যে স্বামির মত পরিবর্ত্তন না দেখাতে মনে করিল এ রূপে কিছু হইল না এক্ষণে কোপোৎপাদন দ্বারা সংকল্পিত ব্যাপারে প্রবৃত্ত করিবার পন্থা দেখি। এই বিবেচনা করিয়া শেষে অতি ভীরু ও নিরুৎসাহ বলিয়া ঘৃণা করত কহিতে লাগিল তুমি এবিষয়ের নিমিত্ত যে প্রকার শপথ করিয়াছ আমি অবলা-আত্ম তনয়ের হত্যা নিমিত্ত যদি তদ্রূপ দিব্য করিতাম তাহা হইলে প্রতিজ্ঞা পালন নিমিত্ত দুগ্ধপোষ্য সন্তানকেও ক্রোড়ে লইয়া স্তন্যপান করাইতে২ তাহার মস্তক ভাঙ্গিয়া ফেলিতাম, ক্রোড়স্থ শিশুর প্রতি মাতার মহৎ স্নেহ হইয়াথাকে, প্রতিজ্ঞা রক্ষার অনুরোধে তাহার অপেক্ষা করিতাম না। ছি, তুমি পুরুষ হইয়া শপথ ভঙ্গে প্রবৃত্ত হইতেছ? তুমি এ বিষয়ে পরাঙ্মুখ কেন হও? রাজার প্রাণ সংহার করিলে তোমার অপবাদ হইবার সম্ভাবনা মাত্র নাই, ভূপতির কএক জন ভৃত্য শয়নাগারে সুপ্ত রহিয়াছে প্রভাতে তাহাদের উপরে অনায়াসে অপবাদারোপ হইতে পারিবে। এবম্বিধ বিবিধ বচন প্রয়োগ পুরঃসর সেই দুষ্টা বক্তৃতা করাতে ম্যাকবেথের পুনর্বার ঐ ভয়ঙ্কর ব্যাপারে প্রবৃত্তি হইল।

 ম্যাকবেথ এক খান ক্ষুদ্র তরবারি ধারণ পূর্ব্বক নিদ্রাগত নৃপতির নিকট ধীরে২ গমন করিল। তথায় উপস্থিত হইলে দৃষ্টিগোচর হইল যেন আর একটা করবাল তাহার উপরি প্রহারার্থ আকাশ হইতে আসিতেছে সেই শস্ত্রের প্রান্তভাগে শোণিত কণিকা অঙ্কিতা রহিয়াছে। অবলোকন মাত্রে ধরিতে চেষ্টা করিল তাহাতে প্রকাশ পাইল বস্তুতঃ অস্ত্র নহে আপনার দুস্ক্রিয়া প্রবৃত্তি দ্বারা অন্তঃকরণ বিচলিত হওয়াতে তাদৃশ দর্শন হইয়াছিল।

 অনন্তর নৃপতির পার্শ্বে গিয়া উপস্থিত হইল এবং ভয় ও সংশয় পরিহার পূর্ব্বক তরবারি প্রহারে নর পালের প্রাণ বিনাশ করিল। সেই সময় দৈবাৎ সেস্থানে সুপ্ত এক জন রাজকিঙ্কর স্বপ্নযোগে হাস্য করিয়া উঠিল এবং অপর এক ব্যক্তি হঠাৎ হত্যা এই শব্দ উচ্চস্বরে উচ্চারণ করিল। পরে দুই জনেই জাগ্রৎ হইয়া শয্যার উপরে উঠিয়া বসিল। এক ব্যক্তি বলিল পরমেশ্বর যেন মঙ্গল করেন, অন্য জন তথাস্তু বলিয়া প্রতিবচন প্রদান করিল। কিয়ৎ ক্ষণ পরে পুনর্ব্বার দুই জনে নিদ্রা গেল। ম্যাকবেথ অদূরে দণ্ডায়মান থাকিয়া মনোযোগ পূর্ব্বক তাহাদের বাক্য শ্রবণ করিতেছিল, যৎকালে একজন কিঙ্কর পরমেশ্বর যেন মঙ্গল করেন এই কথাটী কহে তখন স্বয়ং তথাস্তু বলিয়া প্রতিবচন প্রদানের উদ্যম করিয়াছিল, যদিও তাহার পক্ষে আশীর্ব্বাদ প্রার্থনা আবশ্যক বটে তথাপি বাক্‌রোধ হওয়াতে বদন হইতে ঐ বাক্য বিনির্গত করিতে পারে নাই

 তৎপরে এই অলক্ষ্য বাণী ম্যাকবেথের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল, যথা, আর নিদ্রা যাইও না, যে নিদ্রা জীবের প্রতিপালক, ম্যাকবেথ তাহাকে নিহত করিয়াছে। অনন্তর ভবনস্থ সমস্ত ব্যক্তির প্রতি যেন এই বাক্য উদীরিত হুইল নিদ্রাকে বিসর্জ্জন দাও, গ্লামিস্‌ তাহার বিনাশ করিল, সুতরাং কাদর আর স্বাপাবেশে থাকিবে না, ম্যাকবেথও আর সুপ্তি প্রাপ্ত হইবেক না।

 ম্যাকবেথ এই সমস্ত অলক্ষ্য বাক্য শ্রবণে সভয় হইয়া স্বীয় শয়নাগারে বনিতা সন্নিধানে প্রত্যাগমন করিল। পতির প্রত্যাগমনে তাহার ললনা সন্দিহানা হইয়া মনে করিল বুঝি কার্য্য সফল হয় নাই কোন একটা ব্যাঘাত হইয়াছে। পরে স্বামির হস্তে শোণিতের চিত্ন অবলোকন করাতে মুখ্য কর্ম্মের সংসিদ্ধি জানিতে পারিল কিন্তু পতির চিত্ত বৈকল্য দেখিয়া যথোচিত ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। অনন্তর ভর্ত্তাকে ক্ষত চিহ্ণ প্রক্ষালন করিতে কহিয়া স্বয়ং সেই ক্ষুদ্র খড়্‌গ ধারণ পূর্ব্বক রাজার শয়নমন্দিরে গমন করিল এবং নৃপ কিঙ্করদিগের উপর হত্যাপবাদ আরোপ করিবার মানসে তাহাদের বদন শোণিত কণিকায় অঙ্কিত করিয়া আসিল।

 রজনী প্রভাতা হইলে হত্যার ব্যাপার প্রকাশ পাইল। যদিও ম্যাকবেথ এবং তাহার গৃহিণী কপট স্নেহ প্রকাশ পূর্ব্বক মুক্তকণ্ঠে শোক সন্তাপ সূচক বাক্য কহিতে লাগিল এবং কিঙ্করদিগের উপরে হত্যাপবাদ আরোপ পূর্ব্বক তাহাদের গাত্রে শোণিত চিহ্ণ দেখাইয়া দিয়া অপরাধী বলিয়া সপ্রমাণ করিবার উদ্‌যোগ করিল তথাপি পুরবাসি লোকেরা ম্যাকবেথের উপরই সন্দেহ করিলেন কেননা দীন ভৃত্যদের অপেক্ষা তাহারই ঐ বিষয়ে প্রবৃত্তির অধিক সম্ভাবনা। সে যাহা হউক নৃপতির তনয় দ্বয় এই ভয়ানক ঘটনায় ভীত হইয়া প্রাতঃকালে তথাহইতে পলায়ন করিলেন। জ্যেষ্ঠ রাজকুমার মালকম সত্বর প্রস্থান করিয়া ইংলন্দরাজের শরণাপন্ন হইলেন এবং কনিষ্ঠ দোলানবেন আয়রলন্দ দ্বীপে গমন করিলেন

 রাজার যথার্থ উত্তরাধিকারী দুই কুমার এই রূপে প্রস্থান করিলে ম্যাকবেথ শূন্য সিংহাসনে অভিষিক্ত হইলেন সুতরাং ডাকিনী গণের ভবিষ্যদ্বাণী সম্পূর্ণ রূপে সিদ্ধ হইল।

 ম্যাকবেথ এই উচ্চ পদ প্রাপ্ত হইল বটে কিন্তু তাহার এবং তদীয় মহিলার অন্তঃকরণে ডাকিনী গণের সেই বাণী জাগরূক রহিল অর্থাৎ ম্যাকবেথ রাজা হইবে কিন্তু তদীয় তনয়েরা তৎপদ প্রাপ্ত হইতে পারিবে না, তাহার পরে বেনকোর সন্তানেরা সিংহাসনাভিষিক্ত হইবেন। অতএব তাহারা স্ত্রী পুরুষে এক্ষণে নিরন্তর কেবল এই বলিয়া বিলাপ করিতে লাগিল হায় আমরা কি তাদৃশ গুরুতর অধর্ম্ম করিয়া বেনকোর সন্তানের নিমিত্ত এই রাজত্ব গ্রহণ করিলাম। পরে উপায় চিন্তনে প্রবৃত্ত হইয়া ভাবিয়া এই স্থির করিল বেনকো এবং তাহার পুত্রকে বিনষ্ট করিতে পারিলেই ডাকিনীদের ভবিষ্যদ্বাণীর খণ্ডন হইতে পারে অতএব তাহার পন্থা দেখা যাউক।

 এই সংকল্প সিদ্ধির মানসে এক রাত্রি আপনাদের ভবনে ভোজর আয়োজন করিয়া পুরবাসি সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগকে নিমন্ত্রণ করিল এবং বেনকো ও তদীয় তনয় ফ্লিয়ান্সকে যত্ন পূর্ব্বক আহ্বান করিয়া পাঠাইল। বেনকো যে পথ দিয়া পুত্রসহ রজনীযোগে ভোজনার্থ রাজবাটী আসিবেন সেই বর্ত্মের এক প্রান্তে কতিপয় ঘাতুক নিযুক্ত ছিল। অতএব তাঁহারা পিতা পুত্রে আপনাদের নিকেতন হইতে বহির্গত হইয়া অধ্বমধ্যে উপস্থিত হইবামাত্র ঘাতুকেরা অক্রমণ পূর্ব্বক বেনকোর প্রাণ সংহার করিল। তাঁহার পুত্র ফ্লিয়ান্স পশ্চাৎ২ আসিতেছিলেন, পিতার উপর দস্যুদলের আক্রমণ দেখিয়া গোলযোগের সময় প্রাণপণে পলায়ন করিলেন। এই ফ্লিয়ান্স হইতে রাজবংশের সৃষ্টি হয় এবং পরে ইহাঁর সন্তানেরা পুরুষানুক্রমে ক্রমাগত স্কতলন্দের রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। এই রাজবংশের শেষ পুরুষ স্কতলন্দের ষষ্ঠ রাজা, তিনি ইংলন্দেরও প্রথম ভূপতি হন, অর্থাৎ তাহার সময়েতেই ঐ দুই রাজ্য মিলিত হইয়াছিল।

 সে যাহা হউক। এখানে ম্যাকবেথের পত্নী ভোজের সময় সদাশয়তা প্রকাশ পুরঃসর সমাগত নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদিগের এবম্প্রকার আদর অভ্যর্থনা এবং স্তুতি বিনীতি করিতে লাগিল যে সকলেই তাহার প্রতি যথেষ্ট সন্তুষ্ট হইল। অপর ম্যাকবেথ মর্য্যাদাবন্ত লোকদিগের সহিত শিষ্টালাপ করত কহিল আমার সমস্ত রাজ্যের যে পরমোৎকৃষ্ট, সকলই ভাগ্যক্রমে অদ্য মদীয় আলয়ে উপস্থিত, কেবল পরম প্রিয়তম বন্ধু বেনকোকে অবর্ত্তমান দেখিতেছি। পরমেশ্বর সন্নিধানে প্রার্থনা করি তাঁহার যেন কোন বিপদ্ না ঘটিয়া থাকে, নিমন্ত্রণ রক্ষা না করণ জন্য যেন তাঁহার প্রতি অনুযোগ করিতে না হয়। এই কথা কহিয়া আপনার আসনে উপবেশন করিতে যায় ইত্যবসরে বর্ত্মমধ্যে নিহত বেনকোর আত্মা নৃপ নিকেতনে প্রবেশ পূর্ব্বক তদুপরি উপবিষ্ট হইল। ম্যাকবেথের যদিও সাহস এবং ভূতদিগের সম্মুখবর্তী হইবার ক্ষমতা ছিল তথাপি এই ঘটনায় চিত্ত অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইল, এবং ভয়ে মুখ শুষ্ক ও পাণ্ডর বর্ণ হইয়া গেল। চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় নিস্পন্দ দণ্ডায়মান হইয়া বেনকোর আত্মার দিকে স্থির দৃষ্টি করিয়া রহিল। রাণী এবং সমাগত জনগণ অন্য কিছু দেখিতে পাইল না, এই মাত্র অবলোকন করিল রাজা নিস্তব্ধ হইয়া শূন্য সিংহাসনের প্রতি এক দৃষ্টে চাহিয়া রহিয়াছে। সকলে বিতর্ক করিতে লাগিল অকস্মাৎ ইহার উন্মাদ সঞ্চার হইল না কি? কিন্তু তাহার বনিতা বুঝিতে পারিয়া ভর্ৎসনা করত কর্ণকুহরে কহিল ও কি? কি দেখিতেছ? উহা কিছুই নয়, সম্রাট দনকেনকে হত্যা করিবার সময় যেমন শূন্যোপরি দোলায়মান খড়্‌গ নিরীক্ষণ করিয়াছিল এক্ষণেও সেই রূপ দেখিল, ফলতঃ যাহা দৃষ্টিগোচর হইতেছিল তাহা মনের উদ্বেগে কল্পিত মাত্র। ম্যাকবেথ দয়িতার ঐ সকল কথা কিছুই শুনিল না, অনিমিষ নয়নে সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ক্রমে বিহ্বল হইল পরে মুক্ত কণ্ঠে চীকার করিয়া উঠিল। তাহার ভার্য্যা ভীতি বিহ্বলতা প্রযুক্ত স্বামির বদন হইতে রহস্য বাক্য সকল অনর্গল উদীরিত দেখিয়া গুপ্ত বিষয় ব্যক্ত হইবার আশঙ্কায় উপস্থিত লোকদিগকে কহিল রাজার পূর্ব্বাবধি একটা মহৎ রোগ আছে মধ্যে২ তাহার প্রাদুর্ভাব হইয়া থাকে বোধ হয় ক্ষীণতা প্রযুক্ত হঠাৎ সে টা উপস্থিত হইল এক্ষণে শুশ্রূষা করিতে হইবে। ছল পূর্ব্বক এতাবৎ কহিয়া নিমন্ত্রিত লোকদিগকে বিদায় করিয়া দিল।

 পরন্তু ম্যাকবেথ উৎকলিকায় ব্যাকুল হইয়া রহিল। সমস্ত রাত্রি স্ত্রীপুরুষের নিদ্রা হইল না। এক বার তন্দ্রার আবির্ভাব হইয়াছিল তাহাতে কেবল ভয়ানক স্বপ্ন সন্দর্শন করিতে লাগিল। অনন্তর যখন সংবাদ পাইল বেনকোর পুত্র ফ্লিয়ান্স পলায়ন পরায়ণ হইয়া আত্মজীবন রক্ষা করিয়াছেন তখন তাহাদের পরিতাপের পরিসীমা রহিল না, কেননা তাহা হইতে রাজবংশের উৎপত্তি এবং আপনাদের সন্তানের সিংহাসন চ্যুতির সম্ভাবনা। তাহারা পতিপত্নীতে এই ভাবনায় অধীর হইয়া পড়িল, রাজ্য প্রাপ্ত হইয়াও কোন প্রকার সুখানুভব করিতে পারিল না। বিশেষতঃ ম্যাকবেথ আপনার অদৃষ্টে কি ঘটিবে এতদ্বিষয় বিদিত হইবার নিমিত্ত সাতিশয় উৎকণ্ঠিত হইল অতএব সেই ডাকিনীগণের সহিত সাক্ষাৎ করণাশয়ে তাহাদের অন্বেষণে বহির্ভূত হইল।

 অনন্তর অনুসন্ধান করিতে২ পূর্ব্বোক্ত ক্ষেত্রের নিকটবর্ত্তি এক গহ্বরে সেই দেবযোনিদের দর্শন পাইল। তাহারা ম্যাকবেথের আগমনের অভিপ্রায় অগ্রে জানিতে পারিয়া তন্ত্র মন্ত্র বলে ভূতগণের দ্বারা ভাবি তাবদ্বিষয় অবগত হইবার নিমিত্ত তাহাদিগকে চালনা করিয়াছিল। অপর মোহিনী করিবার নিমিত্ত এই২ সামগ্রী সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল, যথা, শব্দায়মান ক্ষুদ্র ভেক, চর্ম্মচটিকা, ভুজঙ্গ, জলগোধিকার চক্ষু, কুকুর জিহ্বা, কুকলাসের পদনলী, কৃষ্ণ পেচকের পক্ষ, পক্ষ বিশিষ্ট সর্পের শল্‌ক, লবণোদধিস্থিত হাঙ্গরের উদরবর্ত্তি পাকস্থলী, বৃহদ্ব্যাঘের দশন, ডাকিনীর নিক্ষিপ্ত সুগন্ধি রস, বিষাক্ত বৃক্ষের মূল, ছাগীর পিত্ত, ইহুদীর হৃদয়, তাহার সমাধি স্থানে উৎপন্ন ক্ষুদ্র ঝাউগাছ, এবং মৃত বালকের অঙ্গুলী। এই সকল দ্রব্য একটা প্রকাণ্ড কটাহের মধ্যে নিক্ষেপ পূর্ব্বক একত্র সিদ্ধ করিল পরে বানরের শোণিত দিয়া উষ্ণতাপনোদন পুরঃসর তন্মধ্যে একটা শূকর শাবকের রক্ত ঢালিয়া দিল। এবম্বিধ মোহিনীয় বস্তুর গুণেই ডাকিনী গণ ভূতদিগকে আপনাদের প্রশ্নের উত্তর প্রদান করাইত।

 ডাকিনীরা ম্যাকবেথকে অবলোকন করিয়া জিজ্ঞাসা করিল হে রাজন্ তুমি কি আপনার সন্দেহ আমাদের অথবা আমাদের কর্ত্তা ভূতদিগের দ্বারা ভঞ্জন করিতে চাহ? ম্যাকবেথ তাহাদের উক্ত প্রকার আয়োজন দর্শনে এবং ভূতের কথা শ্রবণে শঙ্কিত হইল না, সাহস পূর্ব্বক উত্তর করিল কই ভূতেরা কোথায়? আমাকে দেখাও দেখি। ডাকিনীরা তাহার এতদ্বচনে তিনটা বেতালকে তৎক্ষণাৎ নিকটে আহ্বান করিল। তাহাদের প্রথমটার সশস্ত্র মস্তক, সে উপস্থিত হইয়া ম্যাকবেথকে সম্বোধন করত কহিল ওহে তুমি সম্ভ্রান্ত ফাইফের অধিপতি হইতে সতত সাবধানে থাকিও। ঐ মর্য্যাদাবন্ত ব্যক্তির সহিত ম্যাকবেথের দ্বেষভাব ছিল কিন্তু তাহাকে গণ্য করিত না, শত্রুর উপেক্ষা অবিধেয় এ বিষয়ে এক্ষণে প্রবোধ পাওয়াতে ম্যাকবেথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পুরঃসর সেই উপদেবকে নমস্কার করিল

 তদনন্তর দ্বিতীয় ভূত রক্তাক্ত বালকের আকার ধারণ পুর্ব্বক ম্যাকবেথের দৃষ্টি পথের অতিথি হইল, এবং তাহাকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিতে লাগিল ভীত হইয়াছ কেন? পরে মানব জাতির প্রতি ঘৃণা করত কহিল মনুষ্যেরা অতি দুর্ব্বল, অহে, স্ত্রীলোকের গর্ব্ভাজাত কোন ব্যক্তি কদাপি তোমাকে আঘাত করিতে সমর্থ হইবে না অতএব তুমি সাহসাবলম্বন কর এবং স্থির প্রকৃতি হও। ম্যাকবেথ এতৎশ্রবণে সহর্ষ হইয়া উচ্চস্বরে কহিল তবে সে থাকুক না কেন, আর আমি ভয় করিব না, মলিন প্রকৃতি প্রযুক্ত আমারদিগকে শঙ্কা আক্রমণ করিয়াছিল এক্ষণে ঘোরতর মেঘ নিনাদেও ভয় না করিয়া সুখে নিদ্রা যাইব।

 দ্বিতীয় উপদের বিদায় হইলে তৃতীয় ভূত একটী শিশু রূপী হইয়া মস্তকে দুই মুকুট এবং করে এক তরু ধারণ পুরঃসর আবির্ভূত হইল। সে ম্যাকবেথের নয়ন পথের পথিক হইয়া তাহাকে সম্বোধন পূর্ব্বক কহিতে লাগিল হে রাজন্ কোন কুন্ত্রণায় তোমাকে পরাভূত করিতে পারিবে না। যাবৎ পর্য্যন্ত বরনামের জঙ্গল দনসিনেন পর্ব্বতে তোমার বিরুদ্ধে আগমন না করিবে তাবৎ তোমার কোন শঙ্কা নাই। ম্যাকবেথ এতৎ শ্রবণে সানন্দ চিত্ত হইল এবং কহিল কোন্ ব্যক্তি মূল উৎপাটন পূর্ব্বক বন্য তরু সকলকে সঞ্চারিত করিতে পারে? মনুষ্য স্বভাবতঃ যত কাল জীবিত থাকে তত কাল নির্বিঘ্নে জীবন ধারণ করিতে পারিব অকাল মৃত্যু অথবা অত্যাচারে আমার প্রাণ বিনাশ সম্ভাবনা নাই। পরন্তু আমাকে একটা বিষয় অবগত হইতে হইবেক হে উপদেব যদিস্যাৎ তোমার বিদিত থাকে বল দেখি বেনকোর সন্তান কখন আমার রাজ্যে রাজত্ব করিবে কি না? এই সময়ে ডাকিনীদের যাদুকারি সেই কটাহ মৃত্তিকা মধ্যে মগ্ন হওয়াতে বাদ্য ধ্বনি হইল এবং রাজ পরিচ্ছদ ধারি অষ্ট মূর্ত্তি ম্যাকবেথের নিকট দিয়া গমন করিতে লাগিল, তাহাদিগের পশ্চাৎ বেনকোর প্রতিমূর্ত্তিও দৃষ্ট হইল, উহার হস্তে এক খানি দপর্ণ ছিল। তদনন্তর অন্য কতিপয় আকৃতি প্রকাশ পাইল। বেনকো শোণিতাক্ত দেহে হাস্য করত ম্যাকবেথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করত ঐ সকল ব্যক্তিকে দেখাইয়া দিল। এক্ষণে ম্যাকবেথের নিশ্চয় জ্ঞান হইল বেনকোর সন্তানেরা পরে নিঃসন্দেহ স্কতলন্দে রাজত্ব করিবে। অনন্তর ডাকিনীরা বাদ্যোদ্যম এবং নৃত্য করত ম্যাকবেথকে বিদায় দিল। অতএব তাহার মনের উদ্বেগ নিবারিত না হইয়া বরং আরো ভয়ানক হইয়া উঠিল।

 সে ডাকিনীদের নিবাস ভূমি হইতে নির্গত হইবামাত্র শ্রবণ করিল ফাইফ দেশীয় সম্ভ্রান্ত মেক্‌দফ স্বদেশ পরিত্যাগ পুরঃসর ইংলন্দে গমন করিয়াছেন। ফলতঃ মৃত মহারাজ দনকেনের জ্যেষ্ঠ তনয় এবং তদীয় যথার্থ উত্তরধিকারী মালকমকে পৈতৃক সিংহাসনে অভিষিক্ত করিবার নিমিত্ত যে এক দল সেনা আসিতেছিল মেক্‌দফ তাহাদের সহিত মিলিত হইয়াছিলেন। ম্যাকবেথ এতৎ বার্ত্তা শ্রবণে কোপে প্রজ্বলিত হইল, তৎক্ষণাৎ মেকদফের পুরী অক্রমণ পূর্ব্বক তাহার পুত্র কলত্র প্রভৃতি সন্নিকৃষ্ট জ্ঞাতি কুটুম্ব এবং বন্ধু বান্ধব পর্য্যন্ত সকলকে প্রাণে বিনষ্ট করিল।

 ম্যাকবেথের এই দৌরাত্ম্য এবং অন্যান্য বিবিধ বিদ্রোহে রাজ্যস্থ সমস্ত সম্ভ্রান্ত জনগণ মহা ভীত হইল। কাহার মনে তাহার প্রতি স্নেহ ভাব রহিল না। কতিপয় ব্যক্তি পলায়ন দ্বারা স্ব২ প্রাণ রক্ষা করিল এবং মালকম ও মেকদফ যে সেনাদল সংকলন পুরঃসর ম্যাকবেথের পরাভব নিমিত্ত ইংলন্দ হইতে যাত্রা করিতেছিলেন তাঁহাদের সহিত গিয়া মিলিত হইল। মর্য্যাদাবন্ত মনুষ্যেরা যদিও ভীতি বশতঃ প্রকাশ্য রূপে ম্যাকবেথের প্রতিকূল্যাচরণ করিতে পারিলেন না, তথাপি মালকম ও মেকদফের যুদ্ধার্থ আগমন সংবাদ প্রাপ্তে মনোমধ্যে সকলেই প্রার্থনা করিতে লাগিলেন তাঁহারা যেন জয়ী হইয়া এই দুরাত্মার দমন করেন। ম্যাকবেথের পুরাতন অনীকিনী ছিল না, অভিনব সংগৃহীত সেনাগণ তৎকালে যুদ্ধ অভ্যাস করিতেছিল। তাহারাও তদীয় অত্যাচার হেতু স্নেহ হীন হইয়া তাহাকে অমান্য করিত। অতএব ম্যাকবেথ সমস্ত রাজ্যাঙ্গকে আপনার প্রতিকূল দেখাতে মহা বিষণ্ণ হইল এবং মনের অসুখে এক বার কহিতে লাগিল আমার বোধ হয় নিহত দনকেন এক্ষণে আমা অপেক্ষা স্বস্থাবস্থায় আছেন, আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তাঁহাকে প্রাণে বিনষ্ট করিয়াছি বটে কিন্তু এখন তিনি মৃত্তিকার অভ্যন্তরে নিরুদ্বেগে মহা নিদ্রায় সুখ সুপ্ত আছেন। আমি জীবদ্দশায় প্রখর শর এবং পুরস্থ জনসমাজের ঈর্ষা ও বৈরিবৃন্দের বিরুদ্ধাচারে যে যন্ত্রণা পাইতেছি বোধ করি এ সকল সেখানে কিছুই নাই।

 যকালে রাজ্যমধ্যে এই সমস্ত দুর্ঘটনা হইতেছিল সেই সময় ম্যাকবেথের ঐ সকল দুষ্ক্রিয়ার প্রবর্ত্তিকা সেই পাপীয়সী গৃহিণী আপনার দুষ্প্রবৃত্তি জন্য সন্তাপ ও লোকনিন্দা সহিষ্ণুতা করণে অসমর্থা হইয়া স্বহস্তে আত্ম হত্যা করিল। ম্যাকবেথ বিভাবরী ভাগে শয়নগত হইয়াও দুঃস্বপ্ন দর্শনে বিবিধ যন্ত্রণা পাইত, সে সময় মহিষীর সহিত আলাপে নিদ্রার বিরাম হইলে ক্ষণকাল সে ক্লেশ নিবারণ হইতে পারিত এক্ষণে পত্নী আত্মঘাতিনী হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করাতে তাহাতেও বঞ্চিত হইল। এখন স্নেহ করে এমত এক প্রাণীও রহিল না। অধিকন্তু বন্ধু বান্ধব কেহ থাকিল না যে তাহার নিকট আপনার যন্ত্রণার কথা কহিয়া আশ্বস্ত হইতে পারে।

 ম্যাকবেথ এক্ষণে জীবনের সহচরীতেও বিরহিত হওয়াতে নৈরাশ্যে আপনার প্রতি হেয় জ্ঞান করত কেবল দেহপতি কামনা করিতে লাগিল কিন্তু অবিলম্বে যখন মালকমের সেনাগণ রাজ্য গ্রহণের মানসে সসজ্জ হইয়া আসিয়া উপস্থিত হইল তখন রোষবশতঃ তাহার প্রাক্তন সাহসের পুনর্ব্বার আবির্ভাব হইল। অতএব ভীত না হইয়া কবচ ও অস্ত্র শস্ত্র ধারণ পূর্ব্বক স্থির হইয়া রহিল এবং সমর ক্ষেত্রে শৌর্য্য প্রকাশ পুরসর প্রাণ ত্যাগ শ্রেয়স্কর জ্ঞান করিল। তাহার মনোমধ্যে এক২ বার ডাকিনীগণের উক্তি কল্পিত বোধ হইল। অপর ভূতেরদের সেই বাক্যও স্মৃতিপথে উদিত হইল যথা নারীগর্ভ হইতে নিঃসৃত কোন ব্যক্তি যন্ত্রণা দিতে পারিবে না। অধিকন্তু যাবৎ বরনাম বন দনসিনেন শৈলোপরি না আসিবে তাবৎ কদাপি তাহার পরাজয় নাই এ কথাও তাহার মনে পড়িল ইহাতে বনের আগমন সর্ব্বথা অসম্ভব ভাবিয়া বরং কখন২ আশ্বস্ত হইতে লাগিল। যাহা হউক, সে মালকমের আগমন প্রতীক্ষা করত স্বীয় দুর্গমধ্যে অবস্থিতি করিল। এক দিবস এক জন দূত ভয়ে কম্পিত কলেবর হইয়া সমীপে আগমন পূর্ব্বক নিবেদন করিল মহারাজ পর্ব্বতোপরি প্রহরিতা করিতে২ বরনাম বনের দিকে দৃষ্টি পাত হওয়াতে নিরীক্ষণ করিলাম সেই কানন যেন স্বস্থান ত্যাগ পূর্ব্বক গমনোপক্রম করিয়া আন্দোলিত হইল। ম্যাকবেথ এ বিষয় অসম্ভব বোধ করিয়া তাহার উপর রাগিয়া উঠিল এবং তর্জ্জন করত কহিল কি, আমার সাক্ষাতে অসত্য কহিস্? পরে রোষ বশতঃ প্রতিজ্ঞা করিল তোকে এ বিষয় সপ্রমাণ করিতে হইবে যদি তোর বাক্য অলীক হয় সেই অরণ্য মধ্যবর্ত্তি তরু শাখায় তোকে লম্বিত করিয়া রাখিব অশন পান বিরহে স্বতই মরিয়া যাবি কিন্তু যদিস্যাৎ সত্য বলিয়া থাকিস্, এবং তোর উল্লেখিত বিষয় যথার্থ হয়, স্বীকার করিতেছি আমাকে ঐ রূপ যন্ত্রণা দিলে আমিও তাহা সহ্য করিব। যাবৎ বরনাম বন দনসিনেনে না আইসে তাবৎ তাহার কোন ভয় সম্ভাবনা ছিল না বটে কিন্তু এক্ষণে মনোমধ্যে ভাবনার আবির্ভাব হওয়াতে ক্রমশঃ ভূতদের সেই বাক্যে সন্দেহ হইতে লাগিল এবং আপনার যে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল তাহারও শৈথিল্য হইবার উপক্রম হইল। এখন দুর্ভাবনা বশতঃ আপন চক্ষে যেন সেই অরণ্যানীর গতিশক্তি দেখিতে পাইল, অধিকন্তু অন্তঃকরণ মধ্যে ঐ সমস্ত বিষয়ের আন্দোলন করিতে লাগিল অবশেষে আপনা আপনি কহিল দূতের বাক্য সত্য হউক আর না হউক সজ্জীভূত হইয়া দুর্গের বাহিরে যাওয়াই কর্ত্তব্য, এক্ষণে এ স্থানে অবস্থানে অথবা পলায়ন পূর্ব্বক প্রস্থানে শ্রেয়ঃ সম্ভাবনা নাই। বহুকাল পৃথিবীতে আছি আর অবনীমণ্ডলে সজীবন হইয়া থাকিতে বাসনা হয় না এখন আশু অসুবিগম হইলেই মঙ্গল। এই সময়ে বিপক্ষ পক্ষের অনীকিনীগণ দুর্গের অদূরে আসিয়া উপস্থিত হইল সেও তৎক্ষণে বহির্গমন পুরঃসর সাহসে নির্ভর করিয়া তাহাদের প্রতিকূলে সমর সজ্জা করিল।

 দূত পুর্ব্বে কহিয়াছিল বরনাম বন আগমন করিতেছে সে সময় ম্যাকবেথ তাহার কথায় অপ্রত্যয় করে কিন্তু এক্ষণে সেই উক্তি সটীক বলিয়া মান্য করিতে হইল। মালকনের সেনাগণ ঐ বিপিনের মধ্য দিয়া আগমন করিতেছিল, রাজপুত্র বিজ্ঞ বহু দর্শি সেনানীর ন্যায় কৌশল করিয়া স্বীয় সৈন্য সংখ্যা দূর হইতে কেহ গণনা দ্বারা স্থির করিতে না পারে এতদভিপ্রায়ে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সেই অরণ্যানী হইতে একটা তরু শাখা ছেদন পূর্ব্বক করে ধারণ করিয়া যাইতে অনুমতি করেন। অতএব ব্যূহীকৃত ভূরি সেনা ঐ রূপে আগমন করাতে দূত দূর হইতে বনেরই চলন মনে করিয়াছিল। বিপক্ষের যোদ্ধৃবর্গ ঐ রূপে আসিয়া ম্যাকবেথের নয়নপথবর্ত্তী হওয়াতে এক্ষণে বনের সঞ্চার প্রত্যক্ষ হইল। অধুনা তাহার সমুদায় আশা দুরে প্রস্থান করিল এবং স্বয়ং সর্ব্বতোভাবে সাহস হীন হইল।

 অনন্তর সেনাগণ অগ্রসর হইলে সংগ্রাম আরম্ভ হইল। যদিও ম্যাকবেথের প্রজাজন ও বন্ধু বান্ধব তাহার পক্ষে মৌখিক যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করিল তথাপি সেই দুরাত্মার প্রতি সাতিশয় ঘৃণা থাকাতে মালকম এবং মেকদফের পক্ষ হইয়াই রণ করিল। কিন্তু ম্যাকবেথ স্বয়ং শৌর্য্য বীর্য্য প্রকাশ পুরঃসর মহা সাহসে যুদ্ধ করিতে লাগিল। যে ব্যক্তি তাহার উপরে আক্রমণ করিয়াছিল স্বীয় শানিত শস্ত্র প্রহারে তাহাদের সকলেরই শিরশ্ছেদ করত মেকদফের সম্মুখে গিয়া উপস্থিত হইল। সেই ব্যক্তিকে অবলোকন করিয়া আক্রমণের উপক্রম করে ইতিমধ্যে ভূতেরদের কথা স্মরণ পথে উদিত হইল, ভূতেরা তাহাকে কহিয়াছিল মেকদফ ভিন্ন সকলের সহিত যুদ্ধ করিও অতএব অন্যত্র গমনের মানস করিল। পরন্তু মেকদফ এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত কেবল তাহারই অন্বেষণ করিতেছিলেন ঐ দুরাত্মা তদীয় পুত্র কলত্রের প্রাণ বিনাশ করে ইহাতে পূর্ব্বাবধি জাতক্রোধ হইয়াছিলেন সাক্ষাৎ পাইবামাত্র কোপপ্রজ্বলিত হইয়া কতকগুলা ভর্ৎসনা করিলেন। ম্যাকবেথ তদীয় পরিজনের শোণিতে আপনার পিপাসা নিবৃত্তি করে এতদর্থ সমর করিতে বিমুখ ছিল কিন্তু তিনি ক্রোধে অত্যাচারী, কুক্কুর ও প্রবঞ্চক বলিয়া ভূরি২ কটুক্তি করত তাহাকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইতে বাধ্য করিলেন।

 অনন্তর ম্যাকবেথের স্মরণ হইল ভূত আমাকে কহিয়াছিল স্ত্রীলোকের গর্ব্ভ হইতে ভূমিষ্ট কোন ব্যক্তি যন্ত্রণা দিতে সমর্থ হইবে না, সেই বাক্যে দৃঢ় বিশ্বাস থাকাতে সহাস্য মুখে মেকদফকে বলিল আর বৃথা কেন পরিশ্রম করিবি তোর অস্ত্র যদিস্যাৎ বায়ুকে আঘাত করিতে পারে তবে আমাকেও বিনষ্ট করিবে। অরে আমার জীবন মোহনী প্রভাবে দৃঢ়ীভূত আছে নারী গর্ব্ভজ হইতে আমার বিনাশাশঙ্কা নাই।

 মেকদফ রোষ প্রকাশ পূরঃসর প্রতিবচন প্রদান করিলেন এক্ষণে মোহনীর আশাকে বিসর্জ্জন দিতে হইবে। তুই মিথ্যাবাদি ভূতের কথায় প্রত্যয় করিয়া দাসত্ব স্বীকার করিয়াছিস্ হয় তো এখন তোকে সেই ভূতই বলিবেক মেকদফকে কোন অবলা প্রসব করে নাই। বস্তুতঃ মানব গণ যে রূপে মাতৃ গর্ব্ভ হইতে ভূমিষ্ঠ হইয়া থাকে মেকদফ সে প্রকারে জন্মেন নাই, অকালে জননী জঠর হইতে নিঃসৃত হইয়াছিলেন।

 ম্যাকবেথ মেকদফের সাহস, দর্শনে নিরাস হইল এবং মুক্তকণ্ঠে কহিতে লাগিল যাহারা আমাকে ঐ রূপ কহিয়াছিল তাহাদিগের প্রতি আমার আর শ্রদ্ধা হয় না। আমি সকলকে কহিব কোন মানব যেন কখন ভূতের কথায় বিশ্বাস না করে। ঐ ব্যক্তিরা কেবল প্রতারণা করণার্থ দ্ব্যর্থ শব্দ প্রয়োগ পূর্ব্বক বাক্য বিন্যাস করে তাহাতে তাহাদের অঙ্গীকার প্রকারান্তরে সিদ্ধ হয় বটে কিন্তু যে মনুষ্য স্পষ্টার্থ গ্রহণ পুরঃসর কোন বিষয়ে আশা করে তাহাকে নৈরাশ্যে পড়িতে হয়। যাহা হউক ওহে মেকদফ আমি আর তোমার সহিত সংগ্রাম করিব না।

 মেকদফ তাহার এ কথায় মনোযোগ করিলেন না, ক্রোধে তর্জ্জন করত কহিলেন অরে তুই থাক, লোকে রাক্ষস দিগকে যে ভাবে দর্শন করে আমরাও তোকে সেই রূপে অবলোকন করিব। এখনই তোকে পিঞ্জর বদ্ধ করণ পূর্ব্বক এই ঘোষণা ফলকারূঢ় করিয়া প্রকাশ্য স্থানে লম্বিত করিয়া দিব যথা অমুক স্থানে অত্যাচারী মানব দেখিতে পাওয়া যায়।

 ম্যাকবেথ যদিও শুভাশায় সর্ব্বতোভাবে নিরাশ হইল তথাপি তাহার সহস সহসা বিনষ্ট হইল না, তখনও সাহঙ্কার বচনে বলিতে লাগিল ইহা কখন হইতে পারিবে না। আমি কি যুবা মাকলমের সম্মুখস্থ ভূমি চুম্বন এবং অধম লোকের ঘৃণা বাক্য শ্রবণ নিমিত্ত জীবন ধারণ করিব? তুই স্ত্রীলোকের গর্ব্ভ হইতে যথা কালে উৎপন্ন নহিস্ এ কারণ আমার উপর আক্রমণ করিয়াছিস্ তথাচ আমি রণে ভঙ্গ দিব না, শেষ পর্য্যন্ত দেখিব। এই বাক্য কহিয়া বাহ্বাস্ফোটন পূর্ব্বক মেকদফের উপর গিয়া পতিত হইল এবং কিয়ৎ ক্ষণ সাতিশয় দৃঢ়তা সহকারে যুদ্ধ করিল। কিন্তু মেকদফ কিঞ্চিদ্বিলম্বে পরাভব করত কোপে তদীয় মস্তক চ্ছেদন করিয়া মালকমের নিকট উপঢৌকন স্বরূপে পাঠাইয়া দিলেন। অতএব স্কতলন্দের রাজসিংহাসন এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত উপদ্রবকারির অধীন থাকিয়া অবশেষে রাজ্যের যথার্থ অধিকারি মালকমের হস্তগত হইল এবং রাজ্যস্থ আপামর সাধারণ জনগণ পরামানন্দ সহকারে প্রাচীন রাজা দনকেনের পদে তাঁহাকে অভিষিক্ত করিল ইতি।