(পৃ. চিত্র-১৪)
◄  
  ►

 এর মধ্যে পুপেদিদি গেছে দার্জ্জিলিঙে। “সে” রইল মাথাঘষা গলিতে একলা আমার জিন্মায়। তার ভালো লাগছে না। আমিও জ্বালাতন হয়েছি। বলে, আমাকে দার্জ্জিলিং পাঠাও। আমি বললুম, কেন?

 সে বললে—পুরুষ মানুষ বেকার বসে আছি, আত্মীয়-স্বজন ভারি নিন্দে করছে।

 কী কাজ করবে, বলো।

 পুপেদিদির খেলার রান্নার জন্যে খবরের কাগজ কুচিকুচি করে দেব।

 এত মেহন্নত সইবে না। একটু চুপ করো দেখি। আমি এখন হুঁহাউ দ্বীপের ইতিহাস লিখছি।

 হুঁহাউ নামটা শোনাচ্চে ভালো দাদা। ওটা তোমার চেয়ে আমার কলমেই মানাত ঠিক। বিষয়টার একটু আমেজ দিতে পারো কি?

 ঠাট্টা নয়, বিষয়টা গম্ভীর, কলেজে পাঠ্য হবার আশা রাখি। একদল বৈজ্ঞানিক ঐ শূন্য দ্বীপে বস্‌তি বেঁধেছেন। খুব কঠিন পরীক্ষায় প্রবৃত্ত।

 একটুখানি বুঝিয়ে বলে—কী করছেন তাঁরা? হাল নিয়মে চাষবাস করছেন?

 একেবারে উল্টো, চাষের সম্পর্ক নেই।

 আহারের কী ব্যবস্থা?

 একেবারেই বন্ধ।

 প্রাণটা?  সেই চিন্তাটাই সবচেয়ে তুচ্ছ। পাক যন্ত্রের বিরুদ্ধে ওঁদের সত্যাগ্রহ। বলছেন, ঐ জঠর যন্ত্রটার মতো প্যাঁচাও জিনিষ আর নেই। যত রোগ যত যুদ্ধবিগ্রহ যত চুরি ডাকাতির মূল কারণ তার নাড়ীতে নাড়ীতে।

 দাদা, কথাটা সত্য হোলেও হজম করা শক্ত।

 তোমার পক্ষে শক্ত। কিন্তু ওঁরা হলেন বৈজ্ঞানিক। পাকযন্ত্রটা উপড়ে ফেলেছেন, পেট গেছে চুপ্‌সে, আহার বন্ধ, নস্য নিচ্চেন কেবলি। নাক দিয়ে পোষ্টাই নিচ্চেন হাওয়ায় শুষে। কিছু পৌঁছচ্চে ভিতরে, কিছু হাঁচতে হাঁচতে বেরিয়ে যাচ্চে। দুই কাজ একসঙ্গেই চলছে, দেহটা সাফও হচ্চে, ভর্ত্তিও হচ্চে।

 আশ্চর্য্য কৌশল! কলের জাত বসিয়েছেন বুঝি। হাঁস মুরগি পাঁটা ভেড়া আলু পটল একসঙ্গে পিযে শুকিয়ে ভর্ত্তি করছেন ডিবের মধ্যে।

 না। পাকযন্ত্র, কসাইখানা, দুটোই সংসার থেকে লোপ করা চাই। পেটের দায়, বিল-চোকানোর ল্যাঠা একসঙ্গে মেটাবেন। চিরকালের মতো জগতে শান্তি-স্থাপনার উপায় চিন্তা করছেন।

 নস্যটা তবে শস্য নিয়েও নয়, কেননা সেটাতেও কেনাবেচার মামলা।

 বুঝিয়ে বলি। জীবলোকে উদ্ভিদের সবুজ অংশটাই প্রাণের গোড়াকার পদার্থ সেটা তো জানো।

 পাপমুখে কেমন করে বলব যে জানি, কিন্তু বুদ্ধিমানেরা নিতান্ত যদি জেদ করেন তাহোলে মেনে নেব।

 দ্বৈপায়ন পণ্ডিতের দল ঘাসের থেকে সবুজ সার বের করে নিয়ে সূর্ষ্যের বেগ্‌নি-পেরোনে আলোয় শুকিয়ে মুঠো মুঠো নাকে ঠুসছেন। সকালবেলায় ডান নাকে, মধ্যাহ্নে বাঁ নাকে, সায়াহ্নে দুই নাকে একসঙ্গে, সেইটেই বড়ো ভোজ। ওঁদের সমবেত হাঁচির শব্দে চমকে উঠে পশুপক্ষীরা সাঁৎরিয়ে সমুদ্র পার হয়ে গেছে।  শোনাচ্চে ভালো। অনেকদিন বেকবি আছি দাদা, পাকযন্ত্রটা হন্যে হয়ে উঠেছে—তোমাদের ঐ নস্যটার দালালি করতে পারি যদি নিয়ুমার্কেটে, তাহোলে—

 অল্প একটু বাধা পড়েছে সে কথা পবে বলব। তাঁদেব আব একটা মত আছে। তাঁরা বলেন, মানুষ দু পায়ে খাড়া হয়ে চলে ব’লে তাদের হৃদযন্ত্র পাকযন্ত্র ঝুলে ঝুলে মরছে, অস্বাভাবিক অত্যাচার ঘটেছে লাখো লাখে বৎসর ধ’রে। তার জবিমানা দিতে হচ্চে আয়ুক্ষয় করে। দোলায়মান হৃদয়টা নিয়ে মরছে নরনারী। চতুষ্পদের কোনো বালাই নেই।

 বুঝলুম, কিন্তু উপায়?

 ওঁরা বলছেন, প্রকৃতিব মূল মৎলবটা শিশুদের কাছ থেকে শিখে নিতে হবে। সেই দ্বীপেব সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে শিলালিপিতে অধ্যাপক খুদে রেখেছেন—সবাই মিলে হামাগুড়ি দাও, ফিরে এসে চতুষ্পদী চালে, যদি দীর্ঘকাল ধরণীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাও।

 সাবাস। আরো কিছু বাকি আছে বোধ হয়।

 আছে। ওঁরা বলেন, কথা কওয়াটা মানুষের বানানো। ওটা প্রকৃতিদত্ত নয়। ওতে প্রতিদিন শ্বাসেব ক্ষয় হোতে থাকে, সেই শ্বাসক্ষয়েই আয়ুক্ষয়। স্বাভাবিক প্রতিভায় এ কথাটা গোড়াতেই আবিষ্কার কবেছে বানর। ত্রেতাযুগেব হনুমান আজো আছে বেঁচে। আজ ওরা নিরালায় বসে সেই বিশুদ্ধ আদিম বুদ্ধির অনুসরণ করছেন। মাটির দিকে মুখ ক’বে সবাই একেবারে চুপ। সমস্ত দ্বীপটাতে কেবল নাকের থেকে হাঁচির শব্দ বেবয়, মুখের থেকে কোনো শব্দই নেই।

 পরস্পর বোঝাপড় চলে কী ক’রে?

 অত্যাশ্চর্য্য ইসারার ভাষা উদ্ভাবিত।—কখনো ঢেঁকি-কোটার ভঙ্গীতে, কখনো হাতপাখা-চালানোর চালে, কখনো ঝোড়ো সুপুরি গাছের নকলে ডাইনে বাঁয়ে উপরে নিচে ঘাড় দুলিয়ে বাঁকিয়ে নাড়িয়ে কাঁপিয়ে হেলিয়ে ঝাঁকিয়ে। এমন কি সেই ভাষার সঙ্গে ভুরু-বাঁকানি চোখ-টেপানি যোগ ক’রে ওঁদের কবিতার কাজও চলে। দেখা গেছে তাতে দর্শকের চোখে জল আসে, নস্যির জায়গাটা বদ্ধ হয়ে পড়ে।

 কিছু টাকা আমাকে ধার দাও, দোহাই তোমার। ঐ হুঁহাউ দ্বীপেই যেতে হচ্চে আমাকে। এত বড়ো নতুন মজাটা—  নতুন আর পুরোনো হোতে পেল কই। হাঁচতে হাঁচতে বস্‌তিটা বেবাক ফাঁক হয়ে গেছে। পড়ে আছে জালা জালা সবুজ নস্যি। ব্যবহার করবার যোগ্য নাক বাকি নেই একটাও।

 এ তোমার আগাগোড়াই বানানো। বিজ্ঞানের ঠাট্টার পক্ষেও এটা বাড়াবাড়ি শোনাচ্চে। এই হুঁহাউ দ্বীপের ইতিহাস বানিয়ে তুমি পুপেদিদিকে তাক লাগিয়ে দিতে চাও। ঠিক করেছিলে তোমার এই অভাগ। “সে”-নাম-ওয়ালাকেই বৈজ্ঞানিক সাজিয়ে সারা দ্বীপময় হাঁচিয়ে হাঁচিয়ে মারবে। বর্ণনা করবে, আমি ঘাড়-নাড়ানাড়ির ঘটা ক’রে ঘটোৎকচ বধ পাঁচালির আসর জমাচ্চি কী ক’রে। হয়তো কোন্‌ হামাগুড়িওয়ালি মনোহর ঘাড়-নাড়ানির সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে বসবে, ঘাড়-নাড়ামন্ত্রে কনে নাড়বে মাথা বাঁদিক থেকে ডানদিকে, আর আমি নাড়ব ডান দিক থেকে বা দিকে। সপ্তপদীগমন হয়ে উঠবে চতুর্দ্দশপদী। ওদের সেনেটহলে ঘাড়-নাড়া ভাষায় যখন ওরা সারে সারে পরীক্ষা দিতে বসেছে, তার মধ্যে আমাকেও বসাবে এক কোণে। আমার উপর তোমার দয়ামায়া নেই, দেবে ফেল করিয়ে। কিন্তু ওদের স্পোর্টিংক্লাবে হামাগুড়ি-রেসে আমাকেই পাওয়াবে ফাষ্ট্‌ প্রাইজ। ব’লে দিচ্চি, পুপেদিদিকে এমন ক’রে হাসাতে পারবে মনেও কোরো না।

 বেশি বোকো না। চাণক্য পণ্ডিত শ্রেণীবিশেষের আয়ু-বৃদ্ধির জন্যে বলেছেন,

তাবচ্চ বাঁচতে মূর্খ যাবৎ ন বক্‌বকায়তে।

 তুমি তো সংস্কৃত কিছু শিখেছিলে?

 যতটা শিখেছিলেম, ভুলেছি তার দেড়গুণ ওজনে। নয়া-চাণক্য জগতের হিতের জন্য যে উপদেশ দিয়েছেন সেটাও তোমার জানা দরকার, দাদা, ছন্দ মিলিয়েই লেখাঃ—

তখন্‌ হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচি যখন পণ্ডিৎ চুপায়তে।
 চললুম, আমার শেষ পরামর্শ এই, বৈজ্ঞানিক রসিকতা ছেড়ে দিয়ে ছেলেমামুষি করো যতটা পারো।


 এই কাহিনীটা পুপেদিদির কাছে একটুও পছন্দসই হয়নি। কপাল কুঁচকে বল্‌লে, এ কখনো হয়? নস্যি নিয়ে পেট ভরে?

 আমি বললেম, গোড়াতে পেটটাকেই যে সরিয়ে দিয়েছে।

 পুপুদিদি আশ্বস্ত হয়ে বল্‌লে, ওঃ তাই বুঝি।

 শেষ পর্য্যন্ত ওর গিয়ে ঠেকল কথা না বলাতে। ওর প্রশ্ন, কথা না ব’লে কি বাঁচা যায়।

 আমি বল্‌লুম, ওদের সব চেয়ে বড়ো পণ্ডিত ভূর্জ্জপাতায় লিখে লিখে দ্বীপময় প্রচার করেছেন, কথা ব’লেই মানুষ মরে। তিনি সংখ্যা গণনায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, যারা কথা বল্‌ত সবাই মরেছে।

 হঠাৎ পুপুদিদির বুদ্ধিতে প্রশ্ন উঠল—আচ্ছা বোবারা?

 আমি বল্‌লেম, তারা কথা ব’লে মরেনি, তারা মরেছে কেউবা পেটের অসুখে, কেউবা কাশিসর্দ্দিতে।

 শুনে পুপুদিদির মনে হোলো, কথাটা যুক্তিসঙ্গত।

 আচ্ছা দাদামশায় তোমার কী মত?

 আমি বল্‌লুম, কেউবা মরে কথা ব’লে, কেউবা মরে না ব’লে।

 আচ্ছা তুমি কী চাও?

 আমি ভাবছি, হুঁহাউ দ্বীপে গিয়ে বাস করব, জম্বুদ্বীপে বকিয়ে মারল আমাকে, আর পেরে উঠছিনে।