(পৃ. ১৫-২৮)
◄  
  ►

 শিবাশোধনসমিতির একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছে আমাদের সে। পুপুদিদির আসরে আজ সন্ধেবেলায় সেইটে পাঠ হবে।

রিপোর্ট

 সন্ধেবেলায় মাঠে বসে গায়ে হাওয়া লাগাচ্চি এমন সময় শেয়াল এসে বল্‌লে, দাদা, তুমি নিজের কাচ্চাবাচ্চাদের মানুষ করতে লেগেছ, আমি কী দোষ করেছি?

 জিজ্ঞাসা করলেম, কী করতে হবে শুনি।

 শেয়াল বললে, না হয় হলুম পশু, তাই ব’লে কি উদ্ধার নেই? পণ করেছি, তোমার হাতে মানুষ হব।

 শুনে মনে ভাবলুম, সৎকার্য্য বটে।

 জিজ্ঞাসা করলুম, তোমার এমন মৎলব হোলো কেন?

 সে বল্‌লে, যদি মানুষ হোতে পারি তাহোলে শেয়াল-সমাজে আমার নাম হবে, আমাকে পূজো করবে ওরা।

 আমি বল্‌লুম, বেশ কথা।

 বন্ধুদের খবর দেওয়া গেল। তারা খুব খুসি। বল্‌লে, একটা কাজের মতে কাজ বটে। পৃথিবীর উপকার হবে। ক’জনে মিলে একটা সভা করলুম, তার নাম দেওয়া গেল, শিবা-শোধন-সমিতি।

 পাড়ায় আছে অনেক কালের একটা পোড়ো চণ্ডীমণ্ডপ। সেখানে রোজ রাত্তির নটার পরে শেয়াল-মানুষ-করার পুণ্যকর্ম্মে লাগা গেল।  জিজ্ঞাসা করলুম, বৎস, তোমাকে জ্ঞাতিরা কী নামে ডাকে? শেয়াল বল্‌লে, “হৌ-হৌ”।

 আমরা বললুম, ছি ছি, এ তো চলবে না। মানুষ হোতে চাও তো প্রথমে নাম বদলাতে হবে, তার পরে রূপ। আজ থেকে তোমার নাম হোলো শিবুরাম।

 সে বললে, আচ্ছা। কিন্তু মুখ দেখে বোঝা গেল, হৌ-হৌ নামটা তার যে-রকম মিষ্টি লাগে শিবুরাম তেমন লাগল না। উপায় নেই, মানুষ হোতেই হবে।

 প্রথম কাজ হোলো তাকে দু’পায়ে দাঁড় করানো। অনেক দিন লাগল। বহুকষ্টে নড়বড় করতে করতে চলে, থেকে থেকে পড়ে পড়ে যায়। ছ-মাস গেল দেহটাকে কোনো মতে খাড়া রাখতে। থাবাগুলো ঢাকবার জন্য পরানো হোলো জুতো মোজা দস্তান।

 অবশেষে আমাদের সভাপতি গৌর গোঁসাই বললেন, শিবুরাম, এইবার আয়নায় তোমার দ্বিপদী ছন্দের মূর্ত্তিটা দেখো দেখি, পছন্দ হয় কিনা।

 আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ফিরে ঘাড় বেঁকিয়ে, শিবুরাম অনেকক্ষণ ধরে দেখলে। শেষকালে বল্‌লে, গোঁসাইজি এখনো তোমার সঙ্গে তো চেহারার মিল হচ্চে না।

 গোঁসাইজি বললেন, শিবু, সোজা হোলেই কি হোলো? মানুষ হওয়া এত সোজা নয়, বলি ল্যাজটা যাবে কোথায়, ওটার মায়া কি ত্যাগ করতে পারো?

 শিবুরামের মুখ গেল শুকিয়ে। শেয়ালপাড়ায় দশবিশ গাঁয়ের মধ্যে ওর ল্যাজ ছিল বিখ্যাত।

 সাধারণ শেয়ালরা ওর নাম দিয়েছিল, “খাসা-লেজুড়ি”। যারা শেয়ালি-সংস্কৃত জানত তারা সেই ভাষায় ওকে বলত, “সুলোমলাঙ্গুলী”। দুদিন 
—পৃঃ ১৮
গেল ওর ভাবতে, তিনরাত্রি ওর ঘুম হোলো না। শেষকালে বৃহস্পতিবারে এসে বললে, রাজি।

 পাট্‌কিলে রঙের ঝাঁকড়া রোঁয়াওয়ালা ল্যাজটা গেল কাটা, একেবারে গোড়া ঘেঁষে।

 সভ্যেরা সকলে বলে উঠল, আহে, পশুর এ কী মুক্তি! ল্যাজবন্ধনের মায়া ওর এতদিনে কেটে গেল! ধন্য!

 শিবুরাম একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। চোখের জল সামলিয়ে নিয়ে সেও অতি করুণমুরে বললে, ধন্য।

 সেদিন ওর আহারে রুচি রইল না—সমস্ত রাত সেই কাটা ল্যাজের স্বপ্ন দেখলে।

 পরদিন শিবুরাম সভায় এসে হাজির। গোঁসাইজি বললেন, কেমন হে শিবু, দেহটা হালকা বোধ হচ্চে তো?

 শিবুরাম বললে, আজ্ঞে, খুবই হালকা। কিন্তু মন বলছে, ল্যাজ গেল তবু মানুষের সঙ্গে বর্ণভেদ তো ঘুচল না।

 গোঁসাই বললেন, রং মিলিয়ে সবর্ণ হোতে চাও যদি, তবে রোঁয়া ঘুচিয়ে ফেলো।

 তিনু নাপিত এল।

 পাঁচদিন লাগ্‌ল খুর বুলিয়ে বুলিয়ে লোমগুলো চেঁচে ফেলতে। রূপ যেটা ফুটে উঠল তা দেখে সভ্যরা সবাই চুপ করে গেল।

 শিবুরাম উদ্বিগ্ন হয়ে বললে, মশায়, আপনার কোনো কথা বলেন ন। কেন?

 সভ্যরা বললে, আমরা নিজের কীর্ত্তিতে অবাক।

 শিবুরাম মনে শান্তি পেল। কাটা ল্যাজ ও চাঁচা রোঁয়ার শোক ভুলে গেল।

 সভ্যরা দুই চক্ষু বুজে বল্‌লেন, শিবুরাম আর নয়। সভা বন্ধ হোলো।

 শিবু বল্‌লে, এখন আমার কাজ হবে শেয়াল সমাজকে অবাক করা।

 এদিকে শিবুরামের পিসি খেঁকিনী কেঁদে কেঁদে মরে। গাঁয়ের মোড়ল হুকুইকে গিয়ে বল্‌লে, মোড়ল মশায়, আজ এক বছরের উপর হয়ে গেল আমার হৌ-হৌকে দেখিনে কেন। বাঘ-ভালুকের হাতে পড়ল না তো?

 মোড়ল বললে, বাঘ ভালুককে ভয় কিসের? ভয় ঐ মানুষ জানোয়ারটাকে, হয়তো তাদের ফাঁদে পড়েছে।

 খোঁজ পড়ে গেল। ঘুরতে ঘুরতে ভলণ্টিয়ারের দল এল সেই চণ্ডীমণ্ডপের বাঁশবনে। ডাক দিলে ছক্কা হুয়া।

 শিবুরামের বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে উঠল—একবার গলা ছেড়ে ঐ একতান মন্ত্রে যোগ দিতে ইচ্ছা হোলো। বহুকষ্টে চেপে গেল।

 দ্বিতীয় প্রহরে বাশবনে আবার ডাক উঠ্‌ল—হুক্কা হুয়া। এবার শিবুরামের চাপা গলায় কান্নার মতো একটুখানি রব উঠল। তবু থেমে গেল।

 তৃতীয় প্রহরে ওরা আবার যখন ডাক ছাড়লে শিবুরাম আর থাকতে পারলে না, ডেকে উঠল—হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া।

 হুকুই বল্‌লে, ঐ তো হৌ-হৌ-এর গলা শুনি। একবার হাঁক দাও তো।

 ডাক পড়ল—হৌ-হৌ।

 সভাপতি বিছানা ছেড়ে এসে বল্‌লেন, শিবুরাম।

 বাইরে থেকে আবার ডাক পড়ল, হৌ-হৌ! গোঁসাইজি আবার সতর্ক করে দিলেন, শিবুরাম।

 তৃতীয়বার ডাকে শিবুরাম ছুটে বেরিয়ে আসতেই শেয়ালরা দিল দৌড়। হুক্কুই, হৈয়ো, হূ হূ প্রভূতি বড়ো বড়ো শেয়াল-বীর আপন আপন গর্ত্তের ভিতর গিয়ে ঢুক্‌ল।


—পৃঃ ২১
 সমস্ত শেয়াল সমাজ স্তম্ভিত।

 তারপর ছ মাস গেল।

 শেষ খবর পাওয়া গেছে। শিবুরাম সারারাত হেঁকে হেঁকে বেড়াচ্চে, আমার ল্যাজ কই আমার ল্যাজ কই।

 গোঁসাইয়ের শোবার ঘরের সামনের রোয়াকে ব’সে উর্দ্ধদিকে মুখ তুলে প্রহরে প্রহরে কোকিয়ে উঠে’ বলে, আমার ল্যাজ ফিরে দাও।

 গোঁসাই দরজা খুলতে সাহস করে না—ভয় পায় পাছে তাকে ক্ষ্যাপা শেয়ালে কামড়ায়।

 শেয়াঁঁলকাঁটার বনে যেখানে শিবুরামের বাড়ি সেখানে ওর যাওয়া বন্ধ। জ্ঞাতিরা ওকে দূর থেকে দেখলে, হয় পালায়, নয় খোঁকিয়ে কামড়াতে আসে। ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপেই থাকে, সেখানে একজোড়া প্যাঁচা ছাড়া আর অন্য প্রাণী নেই। খাঁদু, গোবর, বেঁচি, ঢেঁড়ি প্রভৃতি বড়ো বড়ো ডানপিটে ছেলেরাও ভূতের ভয়ে সেখানকার জঙ্গল থেকে করমচা পাড়তে যায় না।

 শেয়ালি ভাষায় শেয়াল একটা ছড়া লিখেছে, তার আরম্ভটা এই রকম:—

ওরে ল্যাজ, হারা ল্যাজ, চক্ষে দেখি ধুঁয়া।
বক্ষ মোর গেল ফেটে হুক্কা হুযা হুয়া ৷

 পুপে ব’লে উঠল, কী অন্যায়, ভারি অন্যায়। আচ্ছা দাদামশায়, ওর মাসিও ওকে নেবে না ঘরে?

 আমি বললুম, তুমি ভেবো না; ওর গায়ের রোঁয়াগুলো আবার উঠুক, তখন ওকে চিন্‌তে পার্‌বে।

 কিন্তু ওর ল্যাজ?

 হয়তো লাঙ্গুলাদ্য ঘৃত পাওয়া যেতে পারে কবিরাজ মশায়ের ঘরে। আমি খোঁজ নেব।

 “সে” আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললে, রাগ কোরো না, দাদা, হক্‌ কথা বলব, তোমারো শোধনের দরকার হয়েছে।

 বে-আদব কোথাকার, কিসের শোধন আমার?

 তোমার ঐ বুড়োমির শোধন। বয়স তো কম হয়নি তবু ছেলেমানুষিতে পাকা হোতে পারলে না।

 প্রমাণ পেলে কিসে?

 এই যে রিপোর্টটা পড়ে শোনালে, ওটা তো আগাগোড়া ব্যঙ্গ, প্রবীণ বয়সের জ্যাঠামি। দেখলে না পুপুদিদির মুখ, কী রকম গম্ভীর। বোধ হয় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। ভাবছিল, রোঁয়া-চাঁচা শেয়ালটা এখনি এল বুঝি তার কাছে নালিশ করতে। বুদ্ধির মাত্রাটা একটু কমাতে যদি না পারো তাহোলে গল্প-বলা ছেড়ে দাও।

 ওটা কমানো আমার পক্ষে শক্ত। তুমি বুঝবে কী ক’রে, তোমাকে তে চেষ্টাই করতে হয় না, বিধাতা আছেন তোমার সহায়।

 দাদা, রাগ করছ বটে, কিন্তু আমি ব’লে দিলুম, বুদ্ধির ঝাঁজে তোমার রস যাচ্চে শুকিয়ে। মজা করছ মনে করো কিন্তু তোমার ঠাট্টা গায়ে ঠেকলে ঝামার মতো লাগে। এর আগে তোমাকে অনেকবার সতর্ক করে দিয়েছি— হাসতে গিয়ে হাসাতে গিয়ে পরকাল খুইয়ো না। ল্যাজকাটা শেয়ালের কথা শুনে পুপুদিদির চোখ জলে ভরে এসেছিল দেখতে পাওনি বুঝি। বলে তো আজই তাকে আমি একটুখানি হাসিয়ে দিইগে-বিশুদ্ধ হাসি, তাতে বুদ্ধির ভ্যাজাল নেই।

 লেখা তৈরি আছে না কি?

 আছে। নাটকি চালের আলাপ। বললেই হবে, আমাদের পাড়ার উধো গোবরা আর পঞ্চুতে মিলে কথা হচ্চে। ওদের সবাইকে দিদি চেনে।

 আচ্ছা, বেশ দেখা যাক্‌।

গেছো বাবা


 উধো। কী রে সন্ধান পেলি?

 গোবরা। আরে ভাই, তোমার কথা শুনে আজ মাসখানেক ধ’রে বনেবাদাড়ে ঘুরে ঘুরে, হাড় মাটি হোলো, টিকিও দেখতে পেলুম না।

 পঞ্চু। কার সন্ধান করছিস্ রে?

 গোবরা। গেছো বাবার।

 পঞ্চু। গেছো বাবা? সে আবার কে রে?

 উধো। জানিস্‌ নে? বিশ্বযুদ্ধ লোক তাকে জানে।

 পঞ্চু। তা গেছো বাবার ব্যাপারটা কী শুনি?

 উধো। বাবা যে-গাছে চ’ড়ে বসবে সেই গাছই হবে কল্পতরু। তলায় দাঁড়িয়ে হাত পাতলেই যা চাইবি তাই পাবি রে।

 পঞ্চু। খবর পেলি কার কাছ থেকে?

 উধো। ধোকড় গাঁয়ের ভেকু সর্দ্দারের কাছ থেকে। বাবা সেদিন ডুমুর গাছে চ’ড়ে ব’সে পা দোলাচ্ছিল, ভেকু জানে না, তলা দিয়ে যাচ্চে, মাথায় ছিল এক হাঁড়ি চিটেগুড়, তামাক তৈরি করবে। বাবার পায়ে ঠেকে তার হাঁড়ি গেল ট’লে,—চিটেগুড়ে তার মুখ চোখ গেল বুজে। বাবার দয়ার শরীর, বললে ভেকু, তোর মনের কামনা কী, খুলে বল্‌। ভেকুটা বোকা, বললে—বাবা, একখানা ট্যানা দাও মুখটা মুছে ফেলি। যেমনি বলা অমনি গাছ থেকে খসে পড়ল একখানা গামছা। মুখ চোখ মুছে উপরে যখন তাকালো তখন আর কারো দেখা নেই। যা চাইবে কেবল একবার। বাস্‌, তারপরে কেঁদে আকাশ ফাটালেও সাড়া মিলবে না।

 পঞ্চু। হায়রে হায়, শাল নয় দোশালা নয় শুধু একখানা গামছা! ভেকুর আর বুদ্ধি কত হবে।

—পৃঃ ২৩
 উধো। তা হোক্‌ নেপু। ঐ গামছা নিয়েই তার দিব্যি চলে যাচ্চে—দেখিস্‌নি রথতলার কাছে অত বড়ে আটচালা বানিয়েছে। গামছা হোক, বাবার গামছা তো।

 পঞ্চু। কী ক’রে হোলো? ভেল্‌কি নাকি?

 উধো। হোঁদলপাড়ার মেলায় ভেকু সেদিন বাবার গামছা পেতে বসল। হাজারে হাজারে লোক এসে জুটল। বাবার নামে টাকাটা শিকেটা আলুটা মুলোটা চারদিক থেকে গামছার উপর পড়তে লাগল। মেয়েরা কেউ বা এসে বলে, ও ভেকুদাদা, আমার ছেলেটার মাথায় বাবার গামছা একটু ঠেকিয়ে দে, আজ তিনমাস ধ’রে জ্বরে ভুগছে। ওর নিয়ম হচ্চে নৈবিদ্যি চাই পাঁচশিকে, পাঁচটা সুপুরি, পাঁচ কুন্‌কে চাল, পাঁচ ছটাক ঘি।

 পঞ্চু। নৈবিদ্যি তো দিচ্চে, ফল পাচ্চে কিছু?

 উধো। পাচ্চে বৈ কি? গাজন পাল গামছা ভ’রে পনেরো দিন ধ’রে ধান ঢেলেছে, তার পরে ঐ গামছার কোণে দড়ি লাগিয়ে একটা পাঁঠাও দিলে বেঁধে, ঐ পাঠার ডাকে চারদিক থেকে লোক এসে জমল। কী বলব ভাই, মাস এগারে পরেই গাজনের চাক্‌রি জুটে গেল। আমাদের রাজবাড়ির কোতোয়ালের সিদ্ধি ঘোঁটে, তার দাড়ি চুমরিয়ে দেয়।

 পঞ্চু। সত্যি বলছিস্?

 উধো। সত্যি না তো কী? গাজন যে আমার মামাতো ভাইয়ের ভায়রা ভাই হয়।

 পঞ্চু। আচ্ছা ভাই উধো, গামছাটা তুই দেখেছিস?

 উধো। দেখেছি বৈ কি। হটুগঞ্জের তাঁতে দেড়গজ ওসাড়ের যে গামছা বুনুনি হয়, চাঁপার বরণ জমি, লাল পাড়, এক্কেবারে বেমালুম তাই!

 পঞ্চু বলিস্‌ কী? তা সে গাছের উপর থেকে পড়ল কী ক’রে?

 উধো। ঐ তো মজা। বাবার দয়া!  পঞ্চু। চল্‌ ভাই চল্‌, খোঁজ করতে বেরই। কিন্তু চিনব কী ক’রে?

 উধো। সেই তো মুস্কিল। কেউ তো তাকে দেখেনি। আবার হবি তো হ’, ভেকু বেটার চোখ গেল চিটেগুড়ে বুজে’।

 পঞ্চু। তবে উপায়?

 উধো। আমি তো হাটে ঘাটে যাকে দেখছি তাকেই জোড়হাত ক’রে জিগেস করছি, দয়া ক’রে জানাও, তুমিই কি গেছো বাবা? শুনে তারা তেড়ে মারতে আসে। একজন তো দিল আমার মাথায় হুঁকোর জল ঢেলে।

 গোবরা। তা দিক্‌ গে। ছাড়া হবে না। খুঁজে বের করবই। যা থাকে কপালে।

 পঞ্চু। ভেকু বলে, গাছে চড়লেই তবে বাবার চেহারা ধরা পড়ে, যখন নিচে থাকেন চেনবারই জো নেই।

 উধো। গাছে চড়িয়ে চড়িয়ে মানুষকে পরখ করব কী ক’রে ভাই? আমি এক বুদ্ধি করেছি,আমার আমড়া গাছ আমড়ায় ভরে গেছে, যাকে দেখছি তাকেই বলছি, আমড়া পেড়ে নাও—গাছটা প্রায় খালি হয়ে এল, ডালগুলোও ভেঙেছে।

 পঞ্চু। আর দেরি নয়রে চল্। কপালের জোর যদি থাকে তবে দর্শন লাভ হবেই। একবার গলা ছেড়ে ডাক দে না ভাই! গেছো বাবা, ও বাবা, দয়াল বাবা, পারুল বনে কোথাও যদি থাকো লুকিয়ে একবার অভাগাদের দর্শন দাও।

 গোবরা। ওরে হয়েছে রে, দয়া হোলো বুঝি!

 পঞ্চু। কই রে কই।

 গোবরা। ঐ যে চালতা গাছে।

 পঞ্চু। কী রে চালতা গাছে কী, দেখছিনে তো কিছু!

 গোবরা। ঐ যে দুলছে!  পঞ্চু। কী দুলছে। ও তো ল্যাজ রে।

 উধো। তোর কেমন বুদ্ধি গোবরা, ও বাবার ল্যাজ নয়রে, হনুমানের ল্যাজ। দেখছিসনে মুখ ভ্যাঙাচ্চে।

 গোবরা। ঘোর কলি যে! বাবা ঐ কপিরূপ ধরেছেন—আমাদের ভোলাবার জন্যে।

 পঞ্চ। ভুলছিনে বাবা, কালামুখ দেখিয়ে ভোলাতে পারবে না। যত পায়রা মুখ ভ্যাঙাও, নড়ছিনেতোমার ঐ শ্রীল্যাজের শরণ নিলুম।

 গোবর। ওরে, বাবা যে লম্বা লাফ দিয়ে পালাতে শুরু করল রে।

 পঞ্চু। পালাবে কোথায়? আমাদের ভক্তির দৌড়ের সঙ্গে পারবে কেন?

 গোবরা। ঐ বসেছে কয়েৎবেল গাছের ডগায়।

 উপধা। পঞ্চু, উঠে পড়, না গাছে!

 পঞ্চ। আরে তুই ওঠ না!

 উপধা। আরে তুই ওঠ।

 পঞ্চ। অত উচ্চে উঠতে পারব না বাবা, কৃপা করে নেমে এসো।

 উধা। বাবা, তোমার ঐ শ্রীল্যাজ গলায় বেঁধে অন্তিমে যেন চক্ষু মুদতে পারি এই আশীর্বাদ করো।

(প্রস্থান)

 * * * * *

 ওহে কমবুদ্ধি, হাসাতে পারলে?

 না। যে-মানুষ সবই বিনাবিচারে বিশ্বাস করতে পারে তাকে হাসানো সোজা নয়।

 ভয় হচ্ছে পুপেদিদি পাছে গেছোবাবার সন্ধান করতে আমাকে পাঠায়। মুখ দেখে আমারও তাই বোধ হচ্চে। গেছোবাবার পরে ওর টান পড়েছে। আচ্ছা কাল পরীক্ষা ক’রে দেখব বিশ্বাস না করিয়েও মজা লাগাতে পারা যায় কিনা।

 কিছুক্ষণ বাদে পুপু এসে বললে, আচ্ছা দাদামশায়, গেছোবাবার কাছে তুমি হোলে কী চাইতে।

 আমি বললেম, পুপুদিদির জন্যে এমন একটা কলম চাইতেম যা নিয়ে লিখতে বসলে অঙ্ক কষতে একটা ভুলও হোত না।

 পুপুদিদি হাততালি দিয়ে বলে উঠ্ল, আঃ সে কী মজাই হোত!

 অঙ্কে দিদি এবার একশোর মধ্যে সাড়ে তেরো মার্কা পেয়েছে।