সে/৪
৪
স্বপ্ন দেখছি কি জেগে আছি বলতে পারিনে। জানিনে কত রাত। ঘর অন্ধকার, লণ্ঠনটা আছে বারান্দায়, দরজার বাইরে। একটা চামচিকে পোকার লোভে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্চে, গয়ায় পিণ্ডি-না-দেওয়া ভূতের মতো।
সে এসে হাঁক দিলে,—দাদা ঘুমচ না কি —ব’লেই ঘরে ঢুকে পড়ল। কালে কম্বলে সর্ব্বাঙ্গ মোড়া।
জিগেস করলেম, এ কেমন সজ্জা তোমার।
বললে, আমার বরসজ্জা।
বরসজ্জা! বুঝিয়ে বলো।
কনে দেখতে যাচ্চি।
জানিনে কেন আমার যেন ঘুমে-ঘোলা বুদ্ধিতে ঠেকল যে, ঠিক হয়েছে, এই সজ্জাই উচিত। উৎসাহ দিয়ে বললুম, সেজেছ ভালো। তোমার ওরিজিন্যালিটি দেখে খুসি হলুম। একেবারে ক্লাসিকাল সাজ।
কী রকম।
ভূতনাথ যখন তাঁর তপস্বিনী কনেকে বর দিতে এলেন, তাঁর গায়ে ছিল হাতির চামড়া। তোমার এটা যেন ভালুকের চামড়া। নারদ দেখলে খুসি হতেন।
দাদা সমজদার তুমি। এলেম এই জন্তেই তোমার কাছে এত রাত্তিরে।
কত রাত বলো দেখি।
দেড়টার বেশি হবে না।
কনে কি এখনি দেখা চাই।
হাঁ এখনি।
শুনেই বলে উঠলেম,ভারি চমৎকার।
কী কারণে বলো তো।
কেন যে এতদিন এই আইডিয়াটা মাথায় আসেনি তাই ভাবি। আপিসের বড়োসাহেবের মুখ-দেখা দিনের রোদ্দুরে, আর কনে দেখা মাঝরাত্তিরের অন্ধকারে।
দাদা, তোমার মুখের কথা যেন অমৃত সমান। একটা পৌরাণিক নজির দাও তো।
মহাদেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন মহাকালীর দিকে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে, এই কথাটা স্মরণ কোরো।
অহো, দাদা তোমার কথায় আমার গায়ে কাঁটা দিচ্চে। সাব্লাইম যাকে বলে। তাহোলে আর কথা নেই।
কনেটি কে এবং আছেন কোথায়।
আমার বৌদিদির ছোটো বোন, আছেন তারি বাড়িতে।
চেহারায় তোমার বৌদিদির সঙ্গে কি মেলে।
মেলে বই কি। সহোদরা বটে।
তাহোলে অন্ধকার রাতের দরকার আছে।
বৌদি স্বয়ং ব’লে দিয়েছেন—টর্চটা যেন সঙ্গে না আনি।
বৌদির ঠিকানাটা!
সাতাশ মাইল দূরে-চৌচাকলা গ্রামে, উনকুণ্ড পাড়ায়।
ভোজন আছে তো।
আছে বৈকি।
শুনে কোন্ মোহের ঘোরে যে মনটা পুলকিত হোলো বল্তে পারিনে। লিভরের দোষে ভুগে আসছি বারোবছর-খাবার নাম শুনলেই পিত্তি যায় বিগড়ে।
জিগেস করলেম, খাওয়াটা কী রকম হবে শুনি।
অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, অতি উত্তম, অতি উত্তম, অতি উত্তম। বৌদি আমসত্ত দিয়ে উচ্ছেসিদ্ধ চমৎকার রাঁধে, আর কুলের আঁটি ঢেঁকিতে কুটে তার সঙ্গে দোক্তার জল মিশিয়ে চাট্নি—
ব’লেই নাচ জুড়ে দিল বিলিতি চালে, টিটিটম্টম্, টিটিটম্টম্, টিটিটম্টম্।
জীবনে কোনদিন নাচিনি—হঠাৎ নাচ পেয়ে গেল, দুজনে হাত ধরাধরি ক’রে নাচতে শুরু ক’রে দিলুম, টিটিটম্টম্। মনে হলো আশ্চর্য্য আমার ক্ষমতা, যমুনা দিদি যদি দেখ্ত তবে বল্ত নাচ বটে।
শেষকালে হাঁপিয়ে উঠে ধপ্ ক’রে বসে পড়লুম। বললুম, আহারের ফর্দ্দ যা দিলে একেবারে খাঁটি ভিটামিন। লিভরের পক্ষে অমৃত। কনে দেখতে যাবে তো কনের পরীক্ষা তো চাই।
একদফা হয়ে গেছে আগেই।
কী রকম?
মনে করলুম মিলন হবার আগে মিলের পরীক্ষা চাই। ঠিক কিনা বলো।
ঠিক তো বটেই। পরীক্ষার প্রণালীটা কী।
জিগেস করা চাই শোলোক মেলাতে পারো কি না। দূত পাঠিয়েছিলুম ‘রংমশাল’-এর সহ-সম্পাদককে, তিনি আওড়ালেন
সুন্দরী, তুমি কালো কৃষ্টি,-
বললেন, মিল ক’রে এর জবাব দিতে হবে, পুরো মাপের মিল। কনেটি এক নিঃশেষে ব’লে দিলে
কানা তুমি, নেই ভালাে দৃষ্টি।
ব্রহ্মা লম্বা হাতে
তােমাকে গড়েছে রাতে
যবে শেষ হোলো আলো বৃষ্টি।
লম্বা হতে বলবার তাৎপর্য্য কী হোলো?
মেয়েটি ঢ্যাঙা আছে শুনেছি, তোমার চেয়ে ইঞ্চি দুই তিন বড়ো হবে। তাই শুনেই তো আমার উৎসাহ।
বলো কী?
একখানা মেয়ে বিয়ে করতে গিয়ে পাওয়া যাবে আধখানা ফাউ।
এ কথাটা আমার মাথায় ওঠেনি।
যা হোক দাদা, সহ-সম্পাদকের কাছে হার মেনে ও হার-মানার একটা কবুলতি দিয়ে দিয়েছে।
কী রকম!
মাছের আঁশের হার গেঁথে ওর গলায় পরিয়েছে, বলেছে যশঃসৌরভ তোমার সঙ্গে সঙ্গে ফিরবে।
আমি লাফ দিয়ে ব’লে উঠলুম-ধন্য! এবার দেখছি এক অসাধারণে সঙ্গে আর-এক অসাধারণের মিলন হবে, জগতে এমন কদাচিৎ ঘটে। তাহোলে আর কেন দিনক্ষণ দেখা।
কিন্তু মেয়েটির পণ, ওকে যে হারাতে পারবে তাকেই ও বিয়ে করবে।
রূপে?
না, কথার মিলে। ঠিকমতো যদি মেলাতে পারি তাহোলে ও নিজেকে দেবে জলাঞ্জলি। পারবে তো।
নিশ্চয়।
প্ল্যানটা কী শুনি।
বলব, চার লাইনে আমার চরিত্র বর্ণনা করে, তবে আমাকে খুসি ক’রে দাও। মিল হওয়া চাই ফষ্ট্ ক্লাস।
কনে দেখার যদি পেটেণ্ট নেওয়া চল্ত তুমি নিতে পারতে। বরের স্তব দিয়ে শুরু। অতি উত্তম। উমা তাতেই জিতেছিলেন।
প্রথম লাইনটা ওকে ধরিয়ে দিতে হবে, নইলে আমার চরিত্রের থই পাবে না—আমার বর্ণনার ধুয়োটি হচ্চে এইঃ—
তুমি দেখি মানুষটা একেবারে অদ্ভুত।
পুরো বহরের মিল দাবি করলে মেয়েটি বোধ হয় মাথায় হাত দিয়ে পড়বে। ওকে হার মানতেই হবে। আচ্ছা দাদা, তুমিই দাও দেখি ওর পরের লাইনটা যোগ ক’রে।—
আমি বললেম,—
স্কন্ধে তােমার বুঝি চাপিয়াছে বদ্ভূত।
এক্সেলেণ্ট্। কিন্তু আর দুটো লাইন না হোলে শ্লোক তো ভর্ত্তি হয় না। আমি বল্ছি, কনে তো কনে, কনের বাবার সাধ্যি হবে না ওর মিল বের করতে। দাদা তোমার মাথায় কিছু আসছে? ভাষায় হোক্ অভাষায় হোক্।
একেবারেই না।
তাহোলে শোনো-
ছাত থেকে লাফ দাও, পাক দেখে ঝাঁপ দাও
যখন তখন করাে যদ্ভূত তদ্ভূত।
ও আবার কী! ওটা কোন্ দিশি বুলি। দেবভাষা সংস্কৃত-কিম্ভূত শব্দের এক পর্য্যায়।
যদ্ভুত তদ্ভূত মানেটা কী হোলো?
ওর মানে, যা খুসি তাই। ওটা বঙ্গভাষায়—যাকে হাল আমলের পণ্ডিতেরা বলেছে, “অবদান।”
লোকটার ’পরে আমার ভক্তি কূল ছাপিয়ে উঠল। মনে হোলো অসাধারণ প্রতিভা। ওর পিঠ থাবড়িয়ে বললুম, স্তম্ভিত করেছ আমাকে।
সে বললে, স্তম্ভিত হোলে চলবে কেন? চলতে হবে। লগ্ন বয়ে যাচ্চে। ফস্ ক’রে ববকরণ পেরিয়ে যাবে কখন্, এসে পড়বে তৈতিলকরণ, বৈষ্কুম্ভ যোগ, তার পরেই হর্ষণ যোগ, বিষ্টিকরণ, শেষ রাত্তিরে অসৃক যোগ, ধনিষ্ঠানক্ষত্র—গোস্বামীমতে ব্যতীপাতযোগ বালবকরণ, পরিঘযোগে যখন গরকরণ এসে পড়বে তখন বিপদ হবে-ঘরকরণার পক্ষে গরকরণের মতো এত বড়ো বাধা আর নেই। সিদ্ধিযোগ ব্রহ্মযোগ ইন্দ্রযোগ শিবযোগ এই হপ্তার মধ্যে একদিনো পাওয়া যাবে না, বরীয়ান যোগের অল্প একটু আশা আছে যখন পুনর্ব্বসু নক্ষত্রের দৃষ্টি পড়বে।
কাজ নেই, কাজ নেই এখখনি বেরিয়ে পড়া যাক্। ডাক দাও পুত্তুলালকে মোটরখানা আনুক। সে এতক্ষণে চরকা কাটতে বসেছে। চরকা কাটতে কাটতে তবে সে ঘুমতে পারে, মোটর চালিয়ে চালিয়ে তার এই দশা হয়েছে।
গাড়িতে চড়ে বসলুম।
জঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলেছি, ঘোর অন্ধকার। পুকুরের ধারে আসসেওড়ার ঝোপ। হঠাৎ তার ভিতর থেকে খেঁকশিয়ালী উঠল ডেকে। তখন রাত সাড়ে তিনটে হবে। যেমনি ডাকা, পুত্তুলাল চমকে উঠে গাড়িসুদ্ধ গিয়ে পড়ল একগলা জলের মধ্যে। এদিকে তার পিঠের কাপড়ের ভিতরে একটা ব্যাঙ ঢুকে লাফালাফি করছে। আর পুতুলালের সে কী চেঁচানি! আমি
-পৃঃ ৩৪ ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, পুত্তুলাল, তোর পিঠে বাত আছে, ব্যাঙটাকে খুব কষে লাফাতে দে, বিনিপয়সায় অমন ভালো মালিষ আর পাবিনে। গাড়ির ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ডাক দিতে লাগলুম, বনমালী, বনমালী। ইষ্টুপিডের কোনো সাড়াশব্দ নেই। স্পষ্টই বোঝা গেল সে তখন বোলপুর ষ্টেশনের প্ল্যাটফরমে চাদরমুড়ি দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমচ্চে। ভারি রাগ হোলো। ইচ্ছে করল তার নাকের মধ্যে ফাউণ্টেন পেনের সুড়সুড়ি দিয়ে তাকে হাঁচিয়ে দিয়ে আসিগে। এদিকে পাঁকের জলে আমার চুলগুলো গেছে ভিজে। না আঁচড়ে নিয়ে ওর বৌদিদির ওখানে যাই কী ক’রে। গোলমাল শুনে পুকুরপাড়ে হাঁসগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে ডেকে উঠেছে। একলাফ দিয়ে পড়লুম তাদের মধ্যে; একটাকে চেপে ধরে তার ডানা দিয়ে ঘষে ঘষে চুলটা একরকম ঠিক ক’রে নিলুম। পুত্তুলাল বললে, ঠিক বলেছ দাদাবাবু। ব্যাঙের লাফে বড়ো আরাম বোধ হচ্চে। ঘুম আসছে।
যাওয়া গেল ওর বৌদিদির বাড়িতে। ক্ষিদের চোটে একেবারে ভুলে গেছি কনে দেখার কথা। বৌদিদিকে জিগেস করলেন, আমার সঙ্গে ছিল সে, তাকে দেখছিনে কেন?
তিন হাত দোপাট্টা কাপড়ের ঘোমটার ভিতর থেকে মিহিসুরে বৌদিদি বললে, সে কনে খুঁজতে গেছে।
কোন্ চুলোয়?
মজা দিঘির ধারে বাঁশতলায়।
কত দূর হবে?
তিন পহরের পথ।
দূর বেশি নয় বটে। কিন্তু ক্ষিধে পেয়েছে। তোমার সেই চাটনি বের করো দিকি।
বৌদিদি নাকিসুরে বল্লে, হায়রে, আমার পোড়াকপাল, এই গেল মঙ্গলবারের আগের মঙ্গলবারে ফাটা ফুটবল্ ভর্ত্তি ক’রে সমস্তটা পাঠিয়ে দিয়েছি বুজুদিদির ওখানে—সে ওটা খেতে ভালোবাসে ছোলার ছাতুর সঙ্গে শর্ষে তেল আর লঙ্কা দিয়ে মেখে।
মুখ শুকিয়ে গেল, বললুম, আমরা খাই কী।
বৌদিদি বললে, শুক্নো কুচো চিংড়িমাছের মোরব্বা আছে টাট্কা চিটেগুড়ে জমানো। বাছার খেয়ে নাও, নইলে পিত্তি পড়ে যাবে।
কিছু খেলেম, অনেকটাই রইল বাকি। পুত্তুলালকে জিগেস করলুম, খাবি? সে বললে ভাঁড়টা দাও, বাড়ি গিয়ে আহ্নিক ক’রে খাব। বাড়ি এলেম ফিরে। চটিজুতো ভিজে, গা-ময় কাদা।
বনমালীকে ডাক দিয়ে বললুম, বাঁদর, কী করছিলি।
সে হাউহাউ ক’রে কাঁদতে কাঁদতে বললে, বিছে কামড়েছিল, তাই ঘুমচ্ছিলুম।—ব’লেই সে চলে গেল ঘুমতে।
এমন সময় একটা গুণ্ডাগোছের মানুষ একেবারে ঘরের মধ্যে উপস্থিত। মস্ত লম্বা, ঘাড় মোটা, মোটা পিপের মতো গর্দ্দান, বনমালীর মতো রং কালো, ঝাঁকড়া চুল, খোঁচা খোঁচা গোঁফ, চোখ দুটো রাঙা, গায়ে ছিটের মেরজাই, কোমরে লালরঙের ডোরাকাটা লুঙির উপর হল্দে রঙের তিন-কোণা গামছা বঁধা, হাতে পিতলের কাঁটামারা লম্বা একটা বাঁশের লাঠি, গলার আওয়াজ যেন গদাইবাবুদের মোটর গাড়িটার শিঙের মতো। হঠাৎ সে সাড়ে তিন মোণ ওজনের গলায় ডেকে উঠল—“বাবুমশায়।”
চমকে উঠে কলমের খোঁচায় খানিকটা কাগজ ছিঁড়ে গেল।
বললুম, কী হয়েছে, কে তুমি।
সে বললে, আমার নাম পাল্লারাম, দিদির বাড়ি থেকে এসেছি, জানতে চাই তোমাদের ‘সে’ কোথায় গেল।
আমি বললুম-আমি কী জানি। পাল্লারাম চোখ পাকিয়ে হাঁক দিয়ে বললে, জানো না বটে! ঐ যে তার তালি-দেওয়া আঁশ-বের-করা সবুজ রঙের একপাটি পশমের মোজা কাদাসুদ্ধ শুকিয়ে গিয়ে মরা কাঠবেড়ালীর কাটা লেজের মতো তোমার বইয়ের শেলফে ঝুলছে ওটা ফেলে সে যাবে কোন্ প্রাণে।
আমি বললুম, লোকসান সইবে না, যেখানে থাকে ফিরে আসবেই। কিন্তু হয়েছে কী।
পাল্লারাম বলে, পর্শুদিন সন্ধ্যের সময় দিদি গিয়েছিল জঙ্গিলাটের বাড়ি-লাটগিন্নির সঙ্গে গঙ্গাজল পাতিয়েছে।—ফিরে এসে দেখে, একটা ঘটি একটা ছাতা, একজোড়া তাস, হারিকেন লণ্ঠন, আর একটা পাথুরে কয়লার ছালা নিয়ে কোথায় “সে” চ’লে গেছে; দিদি বাগান থেকে একঝুড়ি বাঁশের কোঁড়া, লাউডগা আর বেতোশাক তুলে রেখেছিল তাও খুঁজে পাওয়া যাচ্চে। দিদি ভারি রাগ করছে।
আমি বললুম- আমি কী করব!
পাল্লারাম বললে, তোমার এখানে কোথায় সে লুকিয়ে আছে, তাকে বের ক’রে দাও।
আমি বললুম, এখানে নেই, তুমি থানায় খবর দাও গে।
নিশ্চয় আছে।
আমি বললুম, ভালো মুস্কিলে ফেললে দেখছি—বলছি সে নেই।
নিশ্চয় আছে, নিশ্চয় আছে, নিশ্চয় আছে।বলতে বলতে পাল্লারাম আমার টেবিলের উপর দমাদ্দম তার বাঁশের লাঠির মুণ্ডটা ঠুকতে লাগল। পাশের বাড়িতে একটা পাগল ছিল সে শেয়াল ডাকের নকল ক’রে হাঁক দিল হুক্কাহুয়া। পাড়ার সব কুকুর চেঁচিয়ে উঠল। বনমালী আমার জন্যে একগ্লাস বেলের সরবৎ রেখে গিয়েছিল সেটা উল্টিয়ে বোতল ভেঙে বেগ্নি রঙের কালীর সঙ্গে মিশে রেশমের চাদর বেয়ে আমার জুতোর মধ্যে গিয়ে জমল। চীৎকার করতে লাগলুম, বনমালী, বনমালী। বনমালী ঘরে ঢুকেই পাল্লারামের চেহারা দেখে বাপ-রে মা-রে ব’লে চেঁচাতে চেঁচাতে দৌড় দিলে।
হঠাৎ মনে পড়ে গেল, বললেম, ‘সে’ গেছে কনের খোঁজ করতে।
কোথায়।
মজাদিঘির ধারে বাঁশতলায়। লোকটা বললে,—সেখানে যে আমারি বাড়ি।
তাহোলে ঠিক হয়েছে। তোমার মেয়ে আছে?
আছে।
এইবার তোমার মেয়ের পাত্র জুটল।
জুটল এখনো বলা যায় না। এই ডাণ্ডা নিয়ে ঘাড়ে ধরে তার বিয়ে দেব, তারপরে বুঝব কন্যাদায় ঘুচল।
তাহোলে আর দেরি কোরো না। কনে দেখার পরেই বরকে দেখা হয়তত সহজ হবে না।
সে বল্লে, ঠিক কথা।
একটা ভাঙা বালতি ছিল ঘরের বাইরে। সেটা ফস্ ক’রে তুলে নিলে। জিগেস করলেম, ওটা নিয়ে কী হবে?
ও বললে, বড়ো রোদ্দুর, টুপির মতো ক’রে পরব।
ও তো গেল। তখন কাক ডাকছে, ট্রামের শব্দ শুরু হয়েছে। বিছানা থেকে ধড়ফড় ক’রে উঠেই ডাক দিলেম বনমালীকে। জিগেস করলেম, ঘরে কে ঢুকেছিল।
ও চোখ রগড়ে বললে, দিদিমণির বেড়ালটা।
এই পর্যন্ত শুনে পুপেদিদি হতাশভাবে বললে, ও কী কথা দাদামশায়, তুমি যে বলছিলে, তুমি নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিলে, তারপরে তোমার ঘরে এসেছিল পাল্লারাম।পুপুদিদি বল্লে, দাদামশায়, ওদের দুজনের বিয়ে হেলো কি না বললে না তো কিছু।
বুঝলুম বিয়ে হওয়াটা জরুর দরকার। বল্লুম, বিয়ে না হয়ে কি রক্ষা আছে।
তারপরে তোমার সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে কি।
হয়েছে বৈ কি। তখন ভোর সাড়ে চারটে, রাস্তার গ্যাস নেবেনি। দেখলুম, নতুন বৌ তার বরকে ধরে নিয়ে চলেছে।
কোথায়।
নতুন বাজারে মানকচু কিন্তে।
মানকচু!
হাঁ, বর আপত্তি করেছিল।
কেন।
বলেছিল, অত্যন্ত দরকার হোলে বরঞ্চ কাঁঠাল কিনে আনতে পারি, মানকচু পারব না।
তারপরে কী হোলো।
আনতে হোলো মানকচু কাঁধে করে।
খুসি হোলো পুপু, বল্লে, খুব জব্দ!