সে/৫
সকালে বসে চা খাচ্চি এমন সময় সে এসে উপস্থিত।
জিগেস করলুম, কিছু বলবার আছে।
ও বললে, আছে।
চট্ ক’রে বলে ফেলো, আমাকে এখনি বেরতে হবে।
কোথায়।
লাটসাহেবের বাড়ি।
লাটসাহেব তোমাকে ডাকেন না কি।
না, ডাকেন না, ডাকলে ভালো করতেন।
ভালো কিসের।
জানতে পারতেন, ওঁরা যাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে থাকেন আমি তাদের চেয়েও খবর বানাতে ওস্তাদ। কোনো রায় বাহাদুর আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, সে কথা তুমি জানো।
জানি কিন্তু আমাকে নিয়ে আজকাল তুমি যা-তা বলছ।
অসম্ভব গল্পেরই যে ফরমাস।
হোক না অসম্ভব তারা তো একটা বাঁধুনি থাকা চাই। এলোমেলো অসম্ভব তো যে-সে বানাতে পারে।
তোমার অসম্ভবের একটা নমুনা দাও।
আচ্ছা বলি শোনো:—বদরুদ্দিন মিঞা সেনেটহলে বসে জুতো সেলাই করছিল, সে হাঁ হাঁ ক’রে ছুটে এল। বললে- আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে এত বড় জিনিষটাকে এঁটো করে দিলেন।” ‘তোবা তোবা’ বলে তিনবার মন্যুমেণ্টের গায়ে থুথু ফেলে মি সাহেব দৌড়ে গেল ষ্টে্টম্যান্ আপিসে খবর দিতে।
স্মৃতিরত্নমশায়ের হঠাৎ চৈতন্য হোলো মুখটা তাঁর অশুদ্ধ হয়েছে। গেলেন ম্যুজিয়মের দরোয়ানের কাছে। বললেন, পাঁড়েজি, তুমিও ব্রাহ্মণ আমিও ব্রাহ্মণ, একটা অনুরোধ রাখতে হবে।
পাঁড়েজি দাড়ি চুমরিয়ে নিয়ে সেলাম ক’বে বললে, কোমা ভূ পোর্ত্তে ভূ সি ভূ প্লে।
পণ্ডিতমশায় একটু চিন্তা ক’বে বললেন, বড়ো শক্ত প্রশ্ন, সাংখ্যকারিকা মিলিয়ে দেখে কাল জবাব দিয়ে যাব। বিশেষ অজি আমার মুখ অশুদ্ধ, আমি মন্যুমেণ্ট চেটেছি।
পাঁড়েজি দেশালাই দিয়ে বর্ম্মা চুরুট ধরাল। দুটান টেনে বললে, তাহেলে এক্ষুনি খুলুন ওয়েবষ্টার ডিক্সনারী, দেখুন বিধান কী।
স্মৃতিরত্ন বললেন, তাহোলে তো ভাটপাড়ায় যেতে হয়। সে পবে হবে, আপাতত তোমার ঐ পিতলে বাঁধানো ডাণ্ডাখানা চাই।
পাঁড়ে বললে, কেন কী করবেন, চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়েছে বুঝি?
স্মৃতিরত্ন বললেন, তুমি খবর পেলে কেমন ক’রে? সে তো পড়েছিল পশু দিন। ছুটতে হোলো উল্টোডিঙিতে যকৃত-বিকৃতির বড়ো ডাক্তার ম্যাকার্টনিপাঁড়েজি বললে, তবে ডাণ্ডায় তোমার কী প্রয়োজন।
পণ্ডিতমশায় বললেন, দাঁতন করতে হবে।
পাঁড়েজি বললে, ওঃ তাই বলল, আমি বলি নাকে কাঠি দিয়ে হাঁচবে। বুঝি, তাহোলে আবার গঙ্গাজল দিয়ে শোধন করতে হোত।
এই পর্যন্ত ব’লে গুড়গুড়িটা কাছে নিয়ে দুটান টেনে “সে বললে, দেখে দাদা, এই রকম তোমার বানিয়ে বলবার ধরণ। এ যেন আঙুল দিয়ে লিখে গণেশের শুঁড় দিয়ে লম্বা চালে বাড়িয়ে লেখা। যেটাকে যেরকম জানি সেটাকে অন্যরকম করে দেওয়া। অত্যন্ত সহজ কাজ, যদি বলো লাটসাহেব কলুর ব্যবসা ধ’রে বাগবাজারে শুটকি মাছের দোকান খুলেছেন তবে এমন শস্তা ঠাট্টায় যারা হাসে তাদের হাসির দাম কিসের।
চটেছ ব’লে বোধ হচ্চে।
কারণ আছে। আমাকে নিয়ে পুপুদিদিকে সেদিন যাচ্ছে-তাই কতকগুলো বাজে কথা বলেছিলে। নিতান্ত ছেলেমানুষ ব’লেই দিদি হাঁ করে সব শুনেছিল। কিন্তু অদ্ভুত কথা যদি বলতেই হয় তবে তারমধ্যে কারিগরি চাই তো।
সেটা ছিল না বুঝি?
না ছিল না। চুপ করে থাকতুম যদি আমাকে সুদ্ধ না জড়াতে। যদি বলতে, তোমার অতিথিকে তুমি জিরাফের মুড়িঘণ্ট খাইয়েছ, শর্ষে-বাঁটা দিয়ে তিমিমাছ ভাজা আর পোলাওয়ের সঙ্গে পাঁকের থেকে টাট্কা ধরে-আনা জলহস্তী। আর তার সঙ্গে তালের গুঁড়ির ডাঁটা-চচ্চড়ি, তাহোলে আমি বলতুম ওটা হোলো স্থূল। ও রকম লেখা সহজ।
আচ্ছা, তুমি হেলে কী রকম লিখতে।আমি হাঁপিয়ে উঠে বললুম, থামো, থামো, কিন্তু জিগেস করি, তুমি যে কাহিনীটা আওড়ালে তার বিশেষ গুণটা কী।
ওর গুণটা এই, এটা কুলের আঁঠির চাটনি নয়। যা কিছুই জানিনে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবার সখ মেটালে কোনো নালিশের কারণ থাকে। কিন্তু এতেও যে আছে উঁচুদরের হাসি তা আমি বলিনে। বিশ্বাস করবার অতীত যা তাকেও বিশ্বাস করবার যোগ্য করতে পারো যদি তাহোলেই অদ্ভুত রসের গল্প জমে। নেহাৎ বাজারে-চল্তি ছেলে-ভোলাবার শস্তা অত্যুক্তি যদি তুমি বানাতে থাকো তাহোলে তোমার অপযশ হবে এই আমি ব’লে রাখলুম।
আমি বললেম, আচ্ছা এমন ক’রে গল্প বলব, যাতে পুপুদিদির বিশ্বাস ভাঙতে ওঝা ডাকতে হবে।
ভালো কথা, কিন্তু লাটসাহেবের বাড়িতে যাওয়া বলতে কী বোঝায়।
বোঝায়, তুমি বিদায় নিলেই ছুটি পাই। একবার বসলে উঠতে চাও না, তাই “তুমি যাও” অনুরোধটা সামান্য একটু ঘুরিয়ে বলতে হোলো।
বুঝেছি, আচ্ছা তবে চললুম।