(পৃ. ৪২-৫০)
◄  
  ►

 সকালে বসে চা খাচ্চি এমন সময় সে এসে উপস্থিত।

 জিগেস করলুম, কিছু বলবার আছে।

 ও বললে, আছে।

 চট্‌ ক’রে বলে ফেলো, আমাকে এখনি বেরতে হবে।

 কোথায়।

 লাটসাহেবের বাড়ি।

 লাটসাহেব তোমাকে ডাকেন না কি।

 না, ডাকেন না, ডাকলে ভালো করতেন।

 ভালো কিসের।

 জানতে পারতেন, ওঁরা যাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে থাকেন আমি তাদের চেয়েও খবর বানাতে ওস্তাদ। কোনো রায় বাহাদুর আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না, সে কথা তুমি জানো।

 জানি কিন্তু আমাকে নিয়ে আজকাল তুমি যা-তা বলছ।

 অসম্ভব গল্পেরই যে ফরমাস।

 হোক না অসম্ভব তারা তো একটা বাঁধুনি থাকা চাই। এলোমেলো অসম্ভব তো যে-সে বানাতে পারে।

 তোমার অসম্ভবের একটা নমুনা দাও।

 আচ্ছা বলি শোনো:—
-পৃঃ ৪৪
 স্মৃতিরত্নমশায় মোহনবাগানের গোল-কীপারি ক’রে ক্যালকাটার কাছ থেকে একে একে পাঁচ গোল খেলেন। খেয়ে ক্ষিদে গেল না,উল্টো হোলো, পেট চোঁ চোঁ করতে লাগল। সামনে পেলেন অক্‌টর্লনি মন্যুমেণ্ট। নিচে থেকে চাটতে চাটতে চূড়া পর্য্যন্ত দিলেন চেটে।

 বদরুদ্দিন মিঞা সেনেটহলে বসে জুতো সেলাই করছিল, সে হাঁ হাঁ ক’রে ছুটে এল। বললে- আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে এত বড় জিনিষটাকে এঁটো করে দিলেন।” ‘তোবা তোবা’ বলে তিনবার মন্যুমেণ্টের গায়ে থুথু ফেলে মি সাহেব দৌড়ে গেল ষ্টে্‌টম্যান্ আপিসে খবর দিতে।

 স্মৃতিরত্নমশায়ের হঠাৎ চৈতন্য হোলো মুখটা তাঁর অশুদ্ধ হয়েছে। গেলেন ম্যুজিয়মের দরোয়ানের কাছে। বললেন, পাঁড়েজি, তুমিও ব্রাহ্মণ আমিও ব্রাহ্মণ, একটা অনুরোধ রাখতে হবে।

 পাঁড়েজি দাড়ি চুমরিয়ে নিয়ে সেলাম ক’বে বললে, কোমা ভূ পোর্ত্তে ভূ সি ভূ প্লে।

 পণ্ডিতমশায় একটু চিন্তা ক’বে বললেন, বড়ো শক্ত প্রশ্ন, সাংখ্যকারিকা মিলিয়ে দেখে কাল জবাব দিয়ে যাব। বিশেষ অজি আমার মুখ অশুদ্ধ, আমি মন্যুমেণ্ট চেটেছি।

 পাঁড়েজি দেশালাই দিয়ে বর্ম্মা চুরুট ধরাল। দুটান টেনে বললে, তাহেলে এক্ষুনি খুলুন ওয়েবষ্টার ডিক্‌সনারী, দেখুন বিধান কী।

 স্মৃতিরত্ন বললেন, তাহোলে তো ভাটপাড়ায় যেতে হয়। সে পবে হবে, আপাতত তোমার ঐ পিতলে বাঁধানো ডাণ্ডাখানা চাই।

 পাঁড়ে বললে, কেন কী করবেন, চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়েছে বুঝি?

 স্মৃতিরত্ন বললেন, তুমি খবর পেলে কেমন ক’রে? সে তো পড়েছিল পশু দিন। ছুটতে হোলো উল্টোডিঙিতে যকৃত-বিকৃতির বড়ো ডাক্তার ম্যাকার্টনি
-পৃঃ ৪৪
সাহেবের কাছে। তিনি নারকেলডাঙা থেকে সাবল আনিয়ে সাফ করে দিলেন।

 পাঁড়েজি বললে, তবে ডাণ্ডায় তোমার কী প্রয়োজন।

 পণ্ডিতমশায় বললেন, দাঁতন করতে হবে।

 পাঁড়েজি বললে, ওঃ তাই বলল, আমি বলি নাকে কাঠি দিয়ে হাঁচবে। বুঝি, তাহোলে আবার গঙ্গাজল দিয়ে শোধন করতে হোত।

 এই পর্যন্ত ব’লে গুড়গুড়িটা কাছে নিয়ে দুটান টেনে “সে বললে, দেখে দাদা, এই রকম তোমার বানিয়ে বলবার ধরণ। এ যেন আঙুল দিয়ে লিখে গণেশের শুঁড় দিয়ে লম্বা চালে বাড়িয়ে লেখা। যেটাকে যেরকম জানি সেটাকে অন্যরকম করে দেওয়া। অত্যন্ত সহজ কাজ, যদি বলো লাটসাহেব কলুর ব্যবসা ধ’রে বাগবাজারে শুটকি মাছের দোকান খুলেছেন তবে এমন শস্তা ঠাট্টায় যারা হাসে তাদের হাসির দাম কিসের।

 চটেছ ব’লে বোধ হচ্চে।

 কারণ আছে। আমাকে নিয়ে পুপুদিদিকে সেদিন যাচ্ছে-তাই কতকগুলো বাজে কথা বলেছিলে। নিতান্ত ছেলেমানুষ ব’লেই দিদি হাঁ করে সব শুনেছিল। কিন্তু অদ্ভুত কথা যদি বলতেই হয় তবে তারমধ্যে কারিগরি চাই তো।

 সেটা ছিল না বুঝি?

 না ছিল না। চুপ করে থাকতুম যদি আমাকে সুদ্ধ না জড়াতে। যদি বলতে, তোমার অতিথিকে তুমি জিরাফের মুড়িঘণ্ট খাইয়েছ, শর্ষে-বাঁটা দিয়ে তিমিমাছ ভাজা আর পোলাওয়ের সঙ্গে পাঁকের থেকে টাট্‌কা ধরে-আনা জলহস্তী। আর তার সঙ্গে তালের গুঁড়ির ডাঁটা-চচ্চড়ি, তাহোলে আমি বলতুম ওটা হোলো স্থূল। ও রকম লেখা সহজ।

 আচ্ছা, তুমি হেলে কী রকম লিখতে।
-পৃঃ ৪৮
 বলি, রাগ করবে না! দাদা, তোমার চেয়ে আমার কেরামতি যে বেশি তা নয়। কম ব’লেই সুবিধে। আমি হোলে বলতুম, তাসমানিয়াতে তাসখেলার নেমতন্ন ছিল, যাকে বলে, দেখা-বিন্‌তি। সেখানে কোজুমাচুকূ ছিলেন বাড়ির কর্ত্তা, আর গিন্নির নাম ছিল, শ্রীমতী হাঁচিয়েন্দানি কোরুংকুনা। তাঁদের বড় মেয়ের নাম পামকুনি দেবি, স্বহস্তে রেঁধেছিলেন কিণ্টিনাবুর মেরিউনাথু, তার গন্ধ যায় সাত পাড়া পেরিয়ে। গন্ধে শেয়ালগুলো পর্য্যন্ত দিনের বেলা হাঁক ছেড়ে ডাকতে আরম্ভ করে নির্ভয়ে, লোভে কি ক্ষোভে জানিনে; কাকগুলো জমির উপর ঠোঁট গুঁজে দিয়ে মরিয়া হয়ে পাখা ঝাপটায় তিনঘণ্টা ধরে। এ তো গেল তরকারী। আর জালা জালা ভর্ত্তি ছিল কাঙ্‌চুটোর সাঙ্‌চানি। সেদেশের পাকা পাকা আঁকসুটো ফলের ছোবড়া-চোঁয়ানো। এই সঙ্গে মিষ্টান্ন ছিল ইক্‌টিকুটির ভিক্‌টিমাই, ঝুড়িভর্ত্তি। প্রথমে ওদের পোষা হাতি এসে পা দিয়ে সেগুলো দ’লে দিল, তারপরে ওদের দেশের সব চেয়ে বড়ো জানোয়ার, মানুষে গোরুতে সিঙ্গিতে মিশোল তাকে ওরা বলে গাণ্ডিসাঙ্‌ড়ুং, তার কঁটাওয়ালা জিব দিয়ে চেটে চেটে কতকটা নরম করে আনলে। তারপরে, তিনশো লোকের পাতের সামনে দমাদম হামানদিস্তার শব্দ উঠতে লাগল। ওরা বলে, এই ভীষণ শব্দ শুনলেই ওদের জিবে জল আসে; দূর পাড়া থেকে শুনতে পেয়ে ভিখারি আসে দলে দলে। খেতে খেতে যাদের দাঁত ভেঙে যায় তারা সেই ভাঙা দাঁত দান ক’রে যায় বাড়ির কর্ত্তাকে। তিনি সেই ভাঙা দাঁত ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেন জমা করে রাখতে, উইল করে দিয়ে যান ছেলেদের। যার তবিলে যত দাত তার তত নাম। অনেকে লুকিয়ে অন্যের সঞ্চিত দাঁত কিনে নিয়ে নিজের ব’লে চালিয়ে দেয়। এই নিয়ে বড়ো বড়ো মকদ্দমা হয়ে গেছে। হাজারদাঁতীরা পঞ্চাশদাঁতীর ঘরে মেয়ে দেয় না। একজন সামান্য পনেরো দাঁতী ওদের কেট্‌কু নাড়ু খেতে গিয়ে হঠাৎ দম আটকিয়ে মারা গেল, হাজারদাঁতীর পাড়ায় তাকে পোড়াবার লোক পাওয়াই গেল না।
-পৃঃ ৪৮
তাকে লুকিয়ে ভাসিয়ে দিলে চৌচঙ্গি নদীর জলে। তাই নিয়ে নদীর দুই ধারের লোকেরা খেসারতের দাবি ক’রে নালিশ করেছিল, লড়েছিল প্রিভিকৌন্সিল পর্য্যন্ত।

 আমি হাঁপিয়ে উঠে বললুম, থামো, থামো, কিন্তু জিগেস করি, তুমি যে কাহিনীটা আওড়ালে তার বিশেষ গুণটা কী।

 ওর গুণটা এই, এটা কুলের আঁঠির চাটনি নয়। যা কিছুই জানিনে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবার সখ মেটালে কোনো নালিশের কারণ থাকে। কিন্তু এতেও যে আছে উঁচুদরের হাসি তা আমি বলিনে। বিশ্বাস করবার অতীত যা তাকেও বিশ্বাস করবার যোগ্য করতে পারো যদি তাহোলেই অদ্ভুত রসের গল্প জমে। নেহাৎ বাজারে-চল্‌তি ছেলে-ভোলাবার শস্তা অত্যুক্তি যদি তুমি বানাতে থাকো তাহোলে তোমার অপযশ হবে এই আমি ব’লে রাখলুম।

 আমি বললেম, আচ্ছা এমন ক’রে গল্প বলব, যাতে পুপুদিদির বিশ্বাস ভাঙতে ওঝা ডাকতে হবে।

 ভালো কথা, কিন্তু লাটসাহেবের বাড়িতে যাওয়া বলতে কী বোঝায়।

 বোঝায়, তুমি বিদায় নিলেই ছুটি পাই। একবার বসলে উঠতে চাও না, তাই “তুমি যাও” অনুরোধটা সামান্য একটু ঘুরিয়ে বলতে হোলো।

 বুঝেছি, আচ্ছা তবে চললুম।