(পৃ. ৫১-৬৫)
◄  
  ►

 সার্কাস দেখে আসার পর থেকে পুপুদিদির মনটা যেন বাঘের বাসা হয়ে উঠল। বাঘের সঙ্গে বাঘেব মাসিব সঙ্গে সর্ব্বদা তার আলাপ চলছে। আমরা কেউ যখন থাকিনে তখনি ওদের মজলিস জমে। আমার কাছে নাপিতের খবর নিচ্ছিল—আমি বললুম, নাপিতের কী দরকার। পুপু জানালে, বাঘ ওকে অত্যন্ত ধরে পড়েছে; খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠেছে ওর গোঁফ, ও কামাতে চায়।

 আমি জিগেস করলেম, গোঁফ কামানোর কথা ওর মনে এল কী ক’রে।

 পুপু বললে, চা খেয়ে বাবার পেয়ালায় তলানি যেটুকু বাকি থাকে আমি বাঘকে খেতে দিই। সেদিন তাই খেতে এসে ও দেখতে পেয়েছিল পাঁচু বাবুকে; ওর বিশ্বাস, গোঁফ কামালে ওর মুখখানা দেখাবে ঠিক পাঁচু বাবুরই মতো।

 আমি বললুম, সেটা নিতান্ত অন্যায় ভাবেনি। কিন্তু একটু মুস্কিল আছে। কামানোর সুরুতেই নাপিতকে যদি শেষ করে দেয় তাহোলে কামানো শেষ হবেই না।

 শুনেই ফস্ করে পুপের মাথায় বুদ্ধি এল, ব’লে ফেললে, জানো দাদামশায়, বাঘরা কখ্‌খনো নাপিতকে খায় না।

 আমি বললুম, বলো কী। কেন বলো দেখি।

 খেলে ওদের পাপ হয়।

 ওঃ তাহোলে কোনো ভয় নেই। এক কাজ করা যাবে, চৌরঙ্গীতে সাহেব-নাপিতের দোকানে নিয়ে যাওয়া যাবে।

 পুপে হাততালি দিয়ে বলে উঠল, হাঁ হাঁ ভারি মজা হবে। সাহেবের মাংস নিশ্চয় খাবে না, ঘেন্না করবে।  খেলে গঙ্গাস্নান করতে হবে। খাওয়া-ছোঁওয়ায় বাঘের এত বাছবিচার আছে, তুমি জানলে কী করে দিদি।

 পুপু খুব সেয়ানার মতো মুখ টিপে হেসে বললে, আমি সব জানি।


—পৃঃ ৫১
 আর, আমি বুঝি জানিনে।

 কী জানো, বলো তো।

 ওরা কখনো চাষী কৈবর্ত্তর মাংস খায় না; বিশেষত যারা গঙ্গার পশ্চিমপারে থাকে। শাস্ত্রে বারণ।

 আর, যার পূব পারে থাকে?

 তারা যদি জেলে কৈবর্ত্ত হয় তো সেটা অতি পবিত্র মাংস। সেটা খাবার নিয়ম বাঁ থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে।

 বাঁ থাবা কেন।

 ঐটে হচ্চে শুদ্ধরীতি। ওদের পণ্ডিতরা ডান থাবাকে নোংরা বলে। একটি কথা জেনে রাখো দিদি, নাপতিনীদের পরে ওদের ঘেন্না। নাপতিনীরা যে মেয়েদের পায়ে আল্‌তা লাগায়।

 তা লাগালেই বা।

 সাধু বাঘেরা বলে, আলতাটা রক্তের ভান-ওটা আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে বের করা রক্ত নয়-ওটা মিথ্যাচার। এ রকম কপটাচরণকে ওরা অত্যন্ত নিন্দে করে। একবার একটা বাঘ ঢুকেছিল পাগড়িওয়ালার ঘরেসেখানে ম্যাজেণ্টা গোলা ছিল গামলায়। রক্ত মনে ক’রে মহা খুসি হয়ে মুখ ডুবলে তার মধ্যে। সে একেবারে পাকা রং। বাঘের দাড়ি গোঁফ তার দুই গাল লাল টক্‌টকে হয়ে উঠল। নিবিড় বনে যেখানে বাঘেদের পুরুতপাড়া মোষমারা গ্রামে,—সেইখানে আসতেই ওদের আঁচাড়ি শিরোমণি বলে উঠল,এ কী কাণ্ড, তোমার সমস্ত মুখ লাল কেন। ও লজ্জায় প’ড়ে মিথ্যে ক’রে বললে,—গণ্ডার মেরে তার রক্ত খেয়ে এসেছি। ধরা পড়ে গেল মিথ্যে। পণ্ডিতজি বললে, নখে তো রক্তের চিহ্ন দেখিনে, মুখ শুঁকে বললে, মুখে তো রক্তের গন্ধ নেই।সবাই ব’লে উঠল, ছি ছি! এ তে রক্তও নয়, পিত্তও নয়, মগজও নয় মজ্জাও নয় নিশ্চয় মানুষের পাড়ায় গিয়ে এমন একটা রক্ত খেয়েছে যা নিরামিষ রক্তযা অশুচি। পঞ্চায়েৎ বসে গেল। কামড়-বিশারদ মশায় হুঙ্কার দিয়ে বললে, প্রায়শ্চিত্ত করা চাই। করতেই হোলো।

 যদি না করত।

 সর্ব্বনাশ। ও যে পাঁচ-পাঁচটা মেয়ের বাপ; বড়ো বড়ো খর-নখিনীর গৌরীদানের বয়স হয়ে এসেছে। পেটের নিচে ল্যাজ গুটিয়ে সাত গণ্ডা মোষ পণ দিতে চাইলেও বর জুটবে না। এব চেয়েও ভয়ঙ্কব শাস্তি আছে।

 কী রকম।

 ম’লে শ্রাদ্ধ করবার জন্যে পুরুত পাওয়া যাবে না, শেষ কালে হয়তো বেত-জঙ্গল গা থেকে নেকড়ে বেঘো পুকৎ আনাতে হবে সে ভারি লজ্জা - সাত পুরুষের মাথা হেঁট।

 শ্রাদ্ধ নাইবা হোলো।

 শোনো একবার। বাঘের ভূত যে না খেয়ে মরবে।

 সে তো মরেইছে, আবার মরবে কী ক’বে।

 সেই ত আরো বিপদ। না খেয়ে মবা ভালো কিন্তু ম’রে না খেয়ে বেঁচে থাকা যে বিষম দুগ্রর্হ।

 পুপুদিদিকে ভাবিয়ে দিলে। খানিকক্ষণ বাদে ভুরু কুঁচকিয়ে বললে, ইংরেজের ভূত তাহোল খেতে পায় কী ক’বে।

 তারা বেঁচে থাকতে যা খেয়েছে তাতেই তাদের সাতজন্ম অমনি চ’লে যায়। আমরা যা খাই তাতে বৈতরণী পার হবার অনেক আগেই পেট চোঁ চোঁ করতে থাকে।

 সন্দেহ মীমাংসা হোতেই পুপে জিগেস করলে, প্রায়শ্চিত্ত কী রকম হোলো।

 আমি বললুম, হাঁকবিষ্ঠাবাচস্পতি বিধান দিলে যে বাঘাচণ্ডীতলার দক্ষিণপশ্চিম কোণে কৃষ্ণপঞ্চমী তিথি থেকে শুরু ক’রে অমাবস্যার আড়াই
-পৃঃ ৫৬
পহর রাত পর্য্যন্ত ওকে কেবল খ্যাঁকশেয়ালির ঘাড়ের মাংস খেয়ে থাকতে হবে, তা-ও, হয় ওর পিসতুতো বোন কিম্বা মাসতুতো শ্যালার মেজো ছেলে ছাড়া আর কেউ শিকার করলে হবে না, আর ওকে খেতে হবে পিছনের ডানদিকের থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে। এত বড়ো শাস্তির হুকুম শুনেই বাঘের গা বমি-বমি ক’রে এল; চার পায়ে হাত জোড় ক’রে হাউ হাউ করতে লাগল।

 কেন, কী এমন শাস্তি।

 বলো কী, খ্যাঁকশিয়ালীর মাংস!—যতদূর অশুচি হোতে হয়। বাঘটা দোহাই পেড়ে বললে, আমাকে বরঞ্চ নেউলের ল্যাজ খেতে বলল সেও রাজি, কিন্তু খ্যাঁকশেয়ালির ঘাড়ের মাংস!

 শেষকালে কি খেতে হোলো।

 হোলা বই কী।

 দাদামশায়, বাঘেরা তাহোলে খুব ধার্ম্মিক।

 ধার্ম্মিক না হোলে কি এত নিয়ম বাঁচিয়ে চলে। সেইজন্যেই তো শেয়ালরা ওদের ভারি ভক্তি করে। বাঘের এটো প্রসাদ পেলে ওরা বর্ত্তিয়ে যায়। মাঘের ত্রয়োদশীতে যদি মঙ্গলবার পড়ে তাহোলে সেদিন ভোর রাত্তিরে ঠিক দেড় প্রহর থাকতে বুড়ো বাঘের পা চেটে আসা শেয়ালদের ভারি পুণ্যকর্ম্ম। কত শেয়াল প্রাণ দিয়েছে এই পুণ্যের জন্যে।

 পুপুর বিষম খট্‌কা লাগল। বললে, বাঘরা এতই যদি ধার্ম্মিক হবে তাহোলে জীব হত্যে ক’রে কাঁচা মাংস খায় কী ক’রে।

 সে বুঝি যে-সে মাংস। ওযে মন্ত্র দিয়ে শোধন করা।

 কী রকম মন্ত্র।

 ওদের সনাতন হালুম মন্ত্র। সেই মন্ত্র প’ড়ে তবে ওরা হত্যা করে। তাকে কি হত্যা বলে।

 যদি হালুম মন্ত্র বলতে ভুলে যায়।  বাঘপুঙ্গব-পণ্ডিতের মতে তাহোলে ওবা বিনামন্ত্রে যে জীবকে মারে পরজন্মে সেই জীব হয়েই জন্মায়। ওদের ভাবি ভয় পাছে মানুষ হয়ে জন্মাতে

 কেন।

 ওরা বলে, মানুষের সর্বাঙ্গ টাক-পড়া, কী কুশ্রী! তার পরে, সামান্য একটা লেজ, তাও নেই মানুষের দেহে। পিঠের মাছি তাড়াবার জন্যেই ওদের বিয়ে করতে হয়। আবার দেখো না, ওরা খাড়া দাঁড়িয়ে সঙের মতো দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে—দেখে আমরা হেসে মরি। আধুনিক বাঘেব মধ্যে সব চেয়ে বড়ো জ্ঞানী শার্দ্দৌল্যতত্ত্বর বলেন, জীবসৃষ্টির শেষের পালায় বিশ্বকর্মার মালমসলা যখন সমস্তই কাবার হয়ে গেল তখনি মানুষ গড়তে তার হঠাৎ সখ হেলো।—তাই বেচারাদের পায়ের তলার জন্যে থাবা দূরে থাক্‌ কয়েক টুকরো খুরের জোগাড় করতে পারলেন না, জুতো পরে তবে ওরা পায়ের লজ্জা নিবারণ করতে পারে—আর গায়ের লজ্জা ঢাকে ওরা কাপড়ে জড়িয়ে। সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ওরাই হোলো লজ্জিত জীব। এত লজ্জা জীবলোকে আব কোথাও নেই।

 বাঘেদের বুঝি ভারি অহঙ্কার।

 ভয়ঙ্কর। সেইজন্যেই তো ওরা এত ক’বে জাত বাঁচিয়ে চলে। জাতের দোহাই পেড়ে একটা বাঘের খাওয়া বন্ধ করেছিল একজন মানুষের মেয়ে,—তাই নিয়ে আমাদের সে একটা ছড়া বানিয়েছে।

 তোমার মতো সে আবার ছড়া বানাতে পাবে না কি।

 তার নিজের বিশ্বাস সে পারে,এই তর্ক নিয়ে তো পুলিস ডাকা যায় না।

 আচ্ছা শোনাও না।

 তবে শোনো।

এক ছিল মােটা কেঁদো বাঘ,
গায়ে তার কালাে কালাে দাগ।

বেহাবাকে খেতে ঘবে ঢুকে
আয়নাটা পড়েছে সমুখে।
এক ছুটে পালালো বেহাবা,
বাঘ দেখে আপন চেহাব।
গাঁ গাঁ কবে ডেকে ওঠে বাগে,
দেহ কেন ভবা কালো দাগে।
ঢেঁকিশালে পুঁটু ধান ভানে,
বাঘ এসে দাঁড়াল সেখানে।
ফুলিয়ে ভীষণ দুই গোঁফ,
বলে—চাই গ্লিসেবিন সােপ।-
পুঁটু বলে- ও কথাটা কী যে
জন্মেও জানিনে তা নিজে।
ইংবেজি টি,বেজি কিছু
শিখিনিতো, জাতে আমি নীচু।-
বাঘ বলে—কথা বলে ঝুঁটো,
নেই কি আমার চোখ দুটো?
গাযে কিসে দাগ হােলো লােপ
মাখিলে গ্লিসেবিন সােপ?
পুঁটু বলে—আমি কালো কৃষ্টি,
কখনে’ মাখিনি ও জিনিষটি।
কথা শুনে পায় মােব হাসি,
নই মেম সাহেবেব মাসি।-
বাঘ বলে-নেই ভােব লজ্জা?
খাব তােব হাড় মাস মজ্জা।-
পুটু বলে—ছি ছি ওবে বাপ,
মুখেও আনিলে হবে পাপ।

জানাে না কি আমি অস্পৃশ্য,
মহাত্মা গাঁধিজির শিষ্য?
আমার মাংস যদি খাও।
জাত যাবে জানাে নাকি তাও?
পাযে ধরি করিও না রাগ!
—ছুঁস্‌নে ছুঁস্‌নে—বলে বাঘ।-
—আরে ছি ছি, আবে রাম রাম,
বাঘ্‌না-পাড়ায বদনাম
রটে যাবে, ঘরে মেয়ে ঠাসা,
ঘুচে যাবে বিবাহের আশা
দেবী বাঘা চণ্ডীর কোপে।
কাজ নেই গ্লিসেবিন সােপে।-

 জানো পুপুদিদি, আধুনিক বাঘেদের মধ্যে ভাবি একটা কাণ্ড চলছে— যাকে বলে প্রগতি, প্রচেষ্টা। ওদের প্রগতিওয়ালা প্রচারকেরা বাঘ-সমাজে ব’লে বেড়াচ্চে যে, অস্পৃশ্য ব’লে খাদ্য বিচার করা পবিত্র জন্তু-আত্মার প্রতি অবমাননা। ওরা বলছে, আজ থেকে আমরা যাকে পাব তাকেই খাব, বাঁ থাবা দিয়ে খাব, ডান থাবা দিয়ে খাব, পিছনের থাবা দিয়েও খাব, হালুমমন্ত্র প’ড়েও খাব,না পড়েও খাব,—এমন কি বৃহস্পতিবারেও আমরা আচড়ে খাব,শনিবারেও আমরা কামড়ে খাব। এত ঔদার্য্য। এই বাঘেরা যুক্তিবাদী এবং সর্ব্বজীবে এদের সম্মানবোধ অত্যন্ত ফলাও। এমন কি এরা পশ্চিমপারের চাষী কৈবর্ত্তদেরও খেতে চায় এতই এদের উদার মন। ঘোরতর দলাদলি বেধে গেছে— প্রাচীনরা নব্য সম্প্রদায়কে নাম দিয়েছে চাষী-কৈবর্ত্ত-খেগো—এই নিয়ে মহা হাসাহাসি পড়েছে।

 পুপু বললে, আচ্ছা দাদামশায়, তুমি কখনো বাঘের উপর কবিতা লিখেছ?  হার মানতে মন গেল না। বল্‌লুম, হাঁ লিখেছি।

 শোনাও না।

 গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করে গেলুম —

তােমার সৃষ্টিতে কভু শক্তিরে করাে না অপমান,
হে বিধাতা, হিংসারেও করেছ প্রবল হস্তে দান
আশ্চর্য্য মহিমা এ কী। প্রখর-নখব বিভীষিকা,
সৌন্দর্য্য দিযেছ তারে দেহধারী যেন বজ্রশিখা,
যেন ধূর্জ্জটির ক্রোব। তােমার সৃষ্টিবভাঙে বাঁধ
ঝঞ্চা উচ্ছৃঙ্খল, করে তােমার দয়ার প্রতিবাদ,
বনেব যে দস্যু সিংহ, ফেন-জিহ্ব ক্ষুব্ধ সমুদ্রের
যে উদ্ধত উর্দ্ধ-ফণা, ভূমিগর্ভে দানব যুদ্ধের।
ডমরুনিঃস্বনী স্পর্দ্ধা, গিরিবক্ষভেদী বহ্নিশিখা
যে আঁকে দিগন্তপটে আপন জলন্ত জযটিকা,
প্রলয়নর্ত্তিনী বন্যা, বিনাশের মদিরবিহ্বল
নির্লজ্জ নিষ্ঠুর - এই যত বিশ্ববিপ্লবীর দল
প্রচণ্ড সুন্দর। জীবলোকে যে দুর্দ্দান্ত আনে ত্রাস
হীনতালানে সে তত পায় না তােমাব পরিহাস।

 চুপ করে রইল পুপু। আমি বললুম,—কী দিদি, ভালো লাগল না বুঝি।

 ও কুষ্টিত হয়ে বললে, না না, ভালো লাগবে না কেন। কিন্তু এর মধ্যে বাঘটা কোথায়।

 আমি বললুম, যেমন সে থাকে ঝোপের মধ্যে, দেখা যায় না তবু আছে ভয়ঙ্কর গোপনে।

 পুপু বললে, অনেকদিন আগে গ্লিসেরিন-সোপ-খোঁজা বাঘের কথা আমাকে বলেছিলে। তার খবরটা কোথা থেকে পেলে সে।  আমার কথা ও করে চুরি, নিজের মুখে সেটা দেয় বসিয়ে।

 কিন্তু-

 “কিন্তু” না তো কী। লিখেছে ভালোই।

 কিন্তু-

 হাঁ, ঠিক কথা। আমি অমন করে লিখিনে, হয়তো লিখতে পারিনে। আমার মালটা ও চুরি করে, তারপরে যখন পালিস ক'রে দেয়, তখন চেনা শক্ত হয়—এমন ঢের দেখেছি। ঠিক ঐ রকম আর একটি ছড়া বানিয়েছেঃ-

 শোনাও না।

 আচ্ছা শোনো তবে।

  সুঁদর বনের কেঁদো বাঘ,
  সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ।
 যথাকালে ভােজনের   কম হােলে ওজনের
  হােত তার ঘােরতর রাগ।
  একদিন ডাক দিল গাঁ গাঁ,
  বলে—তাের গিন্নিকে জাগা।
 শােন্ বটুরাম ন্যাড়া   পাঁচ জোড়া চাই ভ্যাড়া,
  এখনি ভােজের পাত লাগা।-
  বটু বলে-এ কেমন কথা,
  শিখেছ কি এই ভদ্রতা।
 এত রাতে হাঁকাহাঁকি   ভালাে না, জানো না তা কি,
  আদবের এ যে অন্যথা।
  মাের ঘর নেহাৎ জঘন্য,
  মহাপশু, হেথায় কী জন্য।
 ঘরেতে বাঘিনীমাসি   পথ চেয়ে উপবাসী
  তুমি খেলে মুখে দেবে অন্ন।

 সেথা আছে গােসাপের ঠ্যাং।
 আছে তাে শুট্‌কে তােলা ব্যাং।
আছে বাসি খরগােষ,   গন্ধে পাইবে তােষ,
 চলে যাও নেচে ড্যাং ড্যাং।
 নইলে কাগজে প্যারাগ্রাফ
 রটিবে, ঘটিবে পরিতাপ।
বাঘ বলে—রামাে রামাে,   বাক্যবাগীশ থামো
 বকুনির চোটে ধরে হাঁপ।
 তুমি ন্যাড়া, আস্ত পাগল,
 বেরােও তো, খােলো তাে আগল।
ভালাে যদি চাও তবে   আমারে দেখাতে হবে
 কোন ঘরে পুষেছ ছাগল।-
 বটু কহে,এ কী অকরণ,
 ধরি তব চতুশ্চরণ,
জীব বধ মহাপাপ   তারো বেশি লাগে শাপ
 পরধন করিলে হরণ।-
 বাঘ শুনে বলে,-হরি হরি,
 না খেয়ে আমিই যদি মরি,
জীবেরই নিধন তাহা,   সহমরণেতে আহা
 মরিবে যে বাঘী সুন্দরী।
 অতএব ছাগলটা চাই,
 না হােলে তুমিই আছ ভাই।-
এত বলি তােলে থাবা,   বটুরাম বলে,-বাবা,
 চলো ছাগলেরই ঘরে যাই।
 দ্বার খুলে বলে,—পড়ো ঢুকে,
 ছাগল চিবিয়ে খাও সুখে।-

বাঘ সে ঢুকিল যেই   দ্বিতীয় কথাটি নেই
 বাহিরে শিকল দিল রুখে।
 বাঘ বলে—এ তাে বােঝা ভার,
 তামাসার এ নহে আকার।
পাঁঠার দেখিনে টিকি,   ল্যাজের শিকির শিকি
 নেই তাে, শুনি নে ভ্যাভ্যাকার।
 ওরে হিংসুক সয়তান,
 জীবের বধিতে চাস্ প্রাণ,
ওরে ক্রূর, পেলে তােরে   থাবায় চাপিয়া ধ'রে
 রক্ত শুষিয়া করি পান।
 ঘরটাও ভীষণ ময়লা।-
 বটু বলে,—মহেশ গয়লা
ও ঘরে থাকিত,—আজ   থাকে তাের যমরাজ
 আর থাকে পাথুরে কয়লা।-
 গোঁফ ফুলে ওঠে যেন ঝাঁটা,
 বাঘ বলে,—গেল কোথা পাঁঠা!
বটুরাম বলে নেচে,-   এই পেটে তলিয়েছে,
 খুজিলে পাবে না সারা গাঁ-টা।—


 ভালো লাগল?

 তা যা-ই বলল দাদামশায়, কিন্তু বাঘের ছড়া খুব ভালো লিখেছে।

 আমি বললুম, তা হবে, হয় তো ভালোই লিখেছে। কিন্তু ও ভালো লেখে কি আমি ভালো লিখি সে সম্বন্ধে শেষ অভিমতটা দেবার জন্যে অন্তত আরো দশটা বছর অপেক্ষা কোরো।

 পুপু বললে, আমার বাঘ কিন্তু আমাকে খেতে আসে না।
-পৃঃ ৬৫
 সে তো তোমাকে প্রত্যক্ষ দেখেই বুঝতে পারছি। তোমার বাঘ কী করে?

 রাত্তিরে যখন শুয়ে থাকি বাইরে থেকে ও জানলা আঁচড়ায়। খুলে দিলেই হাসে।

 তা হোতে পারে, ওরা খুব হাসিয়ে জাত। ইংরেজিতে যাকে বলে হিউমরাস্‌। কথায় কথায় দাঁত বের করে।