সে/৭
৭
পুপে এসে জিগেস করলে, দাদামশায় তুমি যে বললে শনিবারে সে আসবে তোমার নেমন্তন্নে। কী হোলো।
সবই ঠিক হয়েছিল। হাজি মিঞা শিক্কাবাব বানিয়েছিল, তোফা হয়েছিল খেতে।
তারপরে।
তারপরে নিজে খেলুম তার বারো আনা আন্দাজ, আর পাড়ার কালু ছোঁড়াটাকে দিলুম বাকিটুকু। কালু বললে, দাদাবাবু, এযে আমাদের কাচকলার। বড়ার চেয়ে ভালো।
সে কিছু খেল না।
জো কী।
সে এল না।
সাধ্য কী তার।
তবে সে আছে কোথায়।
কোত্থাও না।
ঘরে।
না।
দেশে।
না। বিলেতে।
না।
তুমি যে বলছিলে, অণ্ডামানে যাওয়া ওর একরকম ঠিক হয়ে আছে। গেল না কি।
দরকার হোলা না।
তা হোলে কী হোলো আমাকে বলছ না কেন।
ভয় পাবে কিম্বা দুঃখ পাবে তাই বলিনে।
তা হোক বলতে হবে।
আচ্ছা তবে শোনো। সেদিন ক্লাস পড়াবার খাতিরে আমার পড়ে নেবার কথা ছিল ‘বিদগ্ধমুখমণ্ডন’। একসময় হঠাৎ দেখি, সেটা রয়েছে পড়ে, হাতে উঠে এসেছে “পাঁচুপাড়াশির পিস্শাশুড়ি”। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, রাত হবে তখন আড়াইটা। স্বপ্ন দেখছি, গরম তেল জ্বলে উঠে আমাদের কিনি বামনীর মুখ বেবাক্ গিয়েছে পুড়ে, সাত দিন সাত রাত্তির হত্যে দিয়ে তারকেশ্বরের প্রসাদ পেয়েছে দু’কৌটো লাহিড়ি কোম্পানীর মূনলাইট স্নো, তাই মাখছে মুখে ঘষে ঘষে। আমি বুঝিয়ে বললুম, ওতে হবে না গো, মোষের বাচ্ছার গালের চামড়া কেটে নিয়ে মুখে জুড়তে হবে নইলে রঙে মিলবে না। শুনেই আমার কাছে শওয়া তিনটাকা ধার নিয়ে সে ধর্ম্মতলার বাজারে মোষ কিনতে দৌড়েছে।
এমন সময় ঘরে একটা কী শব্দ শোনা গেল, কে যেন হাওয়ার তৈরি চটিজুতো হুস হুস ক’রে টানতে টানতে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্চে। ধড়ফড় ক’রে উঠলেম, উস্কে দিলেম লণ্ঠনটা। ঘরে একটা কিছু এসেছে দেখা গেল কিন্তু সে যে কে, সে যে কী, সে যে কেমন, বোঝা গেল না। বুক ধড়ফড় করছে তবু, জোর গলা ক’রে হেঁকে বললুম, কে হে তুমি, পুলিস ডাক্ব না কি।
আমি বললুম, বাজে কথা বলছ, এ কী চেহারা তোমার।
সে বললে, চেহারাখানা হারিয়ে ফেলেছি।
হারিয়ে ফেলেছ। মানে কী হোলো।
মানেটা বলি। পুপেদিদির ঘরে ভোজ, সকাল সকাল নাইতে গেলেম। বেলা তখন সবেমাত্র দেড়টা। তেলেনিপাড়ার ঘাটে বসে ঝামা দিয়ে ক’সে মুখ মাজ্ছিলুম; মাজার চোটে আরামে এমনি ঘুম এল যে, ঢুলতে ঢুলতে ঝুপ্ ক’রে পড়লুম জলে। তারপরে কী হোলে জানিনে। উপরে এসেছি, কি নিচে কি কোথায় আছি জানিনে, পষ্ট দেখা গেল, আমি নেই।
নেই।
তোমার গা ছুঁয়ে বলছি-
আরে আরে গা ছুঁতে হবে না, বলে যাও।
চুলকুনি ছিল গায়ে, চুলকতে গিয়ে দেখি, না আছে নখ, না আছে চুলকনি। ভয়ানক দুঃখ হোলো। হাউহাউ ক’রে কাঁদতে লাগলুম, কিন্তু ছেলেবেলা থেকে যে হাউহাউটা বিনামূল্যে পেয়েছিলুম, সে গেল কোথায়। যত চেঁচাই চেঁচানোও হয় না কান্নাও শোনা যায় না। ইচ্ছে হোলো মাথা ঠুকি বটগাছটাতে, মাথাটার টিকি খুঁজে পাইনে কোথাও। সব চেয়ে দুঃখ, বারোটা বাজল, ক্ষিদে কই ক্ষিদে কই ব’লে পুকুর ধারে পাক খেয়ে বেড়াই, ক্ষিদে বাঁদরটার চিহ্ন মেলে না।
কী বক্ছ তুমি, একটু থামো।
ও দাদা, দোহাই তোমার থামতে বোলো না। থামবার দুঃখ যে কী অ-থামা মানুষ সে তুমি কী বুঝবে। থামব না, আমি থামব না, কিছুতেই থামব না, যতক্ষণ পারি থামব না।
করছ কী তুমি।
দাদা, একেবারে বাদশাহী থামা থেমেছিলুম, আর কিছুতেই থামছিনে। মারধোর যদি করে সেও লাগবে ভালো। আস্ত কিলের যোগ্য পিঠ নেই যখন জানতে পারলুম, তখন সাতকড়ি পণ্ডিতমশায়ের কথা মনে ক’রে বুক ফেটে যেতে চাইল, কিন্তু বুক নেই তো ফাটবে কী। কই মাছের যদি এই দশা হোত তাহোলে বামুনঠাকুরের হাতে পায়ে ধরত তাকে একবার তপ্ত তেলে এপিঠ ওপিঠ ওলটাতে পালটাতে। আহা, যে পিঠখানা হারিয়েছে সেই পিঠে পণ্ডিতমশায়ের কত কীলই খেয়েছি, ইঁট দিয়ে তৈরি খইয়ের মেওয়াগুলোর মতো। আজ মনে হয় উঃ—দাদা, একবার কিলিয়ে দাও খুব ক’রে দমাদম। -বলে আমার কাছে এসে পিট দিলে পেতে।
আমি আঁৎকে উঠে বললুম, যাও যাও, সরে যাও।
ও বললে, কথাটা শেষ ক’রে নিই। একখানা গা খুঁজে খুঁজে বেড়ালুম গায়ে গায়ে। বেলা তখন তিন পহর। যতই রোদে বেড়াই কিছুতেই রোদে পুড়ে সারা হচ্চিনে, এই দুঃখটা যখন অসহ্য এমন সময় দেখি আমাদের পাতুখুড়ো মুচিখোলার বটগাছতলায় গাঁজা খেয়ে শিবনেত্র। মনে হোলো তার প্রাণপুরুষটা বিন্দু হয়ে ব্রহ্মতালুর চূড়োয় এসে জোনাক পোকার মতো মিট্মিট্ করছে। বুঝলুম হয়েছে সুযোগ, নাকের গর্ত্ত দিয়ে আত্মারামকে ঠেসে চালিয়ে দিলুম তার দেহের মধ্যে, নতুন নাগরা জুতোর ভিতরে যেমন করে পা-ট। ঠেসে গুজতে হয়। সে হাঁপিয়ে উঠে ভাঙা গলায় ব’লে উঠল, কে তুমি বাবা, ভিতরে জায়গা হবে না। তখন তার গলাটা পেয়েছি দখলে, বললুম, তোমার হবে না জায়গা, আমার হবে। বেরোও তুমি।
সে গোঁ গোঁ করতে করতে বললে, অনেকখানি বেরিয়েছি, একটু বাকি। ঠেলা মারে। দিলুম ঠেলা, হুস্ ক’রে গেল বেরিয়ে।কান জুড়িয়ে গেল। বললুম, বলো বলো আবার বলল, বড়ো মিষ্টি লাগছে, এমন ডাক যে আবার কোনোদিন শুনতে পাব এমন আশাই ছিল না।
বুড়ি ভাবলে ঠাট্টা করছি, ঝাঁটা আনতে গেল ঘরের মধ্যে। ভয় হোলো, পড়ে-পাওয়া দেহটা খোয়াই বুঝি। বাসায় এসে অয়নাতে মুখ দেখলুম, সমস্ত শরীর উঠল শিউরে। ইচ্ছে করল র্যাঁদা দিয়ে মুখটাকে ছুলে নিই।
গা-হারার গা এল কিন্তু চেহারাহারার চেহারাখানা সাত বাঁও জলের তলায়, তাকে ফিরে পাবার কী উপায়।
ঠিক এই সময়ে দীর্ঘবিচ্ছেদের পর খিদেটাকে পাওয়া গেল। একেবারে জঠর জুড়ে। সব ক’টা নাড়ী চোঁ চোঁ ক’রে উঠেছে এক সঙ্গে। চোখে দেখতে পাইনে পেটের জ্বালায়। যাকে পাই তাকে খাই গোছের অবস্থা। উঃ কী আনন্দ।
মনে পড়ল তোমার ঘরে পুপুদিদির নেমন্তন্ন। রেলভাড়ার পয়সা নেই। হেঁটে চলতে সুরু করলুম। চলার অসম্ভব মেহন্নতে কী যে আরাম সে আর কী বলব। স্ফুর্ত্তিতে একেবারে গলদ্ঘর্ম্ম। এক এক পা ফেলছি আর মনে মনে বলছি, থামছিনে, থামছিনে, চলছি তো চলছিই। এমন বেদম চলা জীবনে কখনো হয় নি। দাদা, পুরো একখানা গা নিয়ে বসে আছ কেদারায়, বুঝতেই পারো না কষ্টতে যে কী মজা। এই কষ্টে বুঝতে পারা যায় আছি বটে, খুব কষে আছি, ষোলো আনা পেরিয়ে গিয়ে আছি।
আমি বললুম, সব বুঝলুম, এখন কী করতে চাও বলো।
করবার দায় তোমারই, নেমন্তন্ন করেছিলে, খাওয়াতে হবে, সে কথা ভুললে চলবে না।
রাত এখন তিনটে সে কথা তুমিও ভুললে চলবে না।
তাহোলে চললুম পুপুদিদির কাছে।
খবরদার।
দাদা, ভয় দেখা মিছে, মরার বাড়া গাল নেই। চললুম।
কিছুতেই না।
সে বললে, যাবই।
আমি বললুম, কেমন যাও দেখব।
সে বলতে লাগল, যাবই, যাবই, যাবই।
আমার টেবিলের উপর চ’ড়ে নাচতে নাচতে বললে, যাবই, যাবই, যাবই। শেষকালে পাঁচালির সুর লাগিয়ে গাইতে লাগল যাবই, যাবই, যাবই।
আর থাকতে পারলুম না। ধরলুম ওর লম্বা চুলের ঝুঁটি। টানাটানিতে গা থেকে ঢিলে মোজার মতো, দেহটা সরসর ক’রে খ’সে ধপ্ করে পড়ে গেল।
সর্ব্বনাশ। গাঁজাখোরের আত্মাপুরুষকে খবর দিই কী ক’রে। চেঁচিয়ে বলে উঠলুম, আরে আরে, শোনো শোনো, ঢুকে পড়ে এই গা-টার মধ্যে, নিয়ে যাও এটাকে।
কেউ কোথাও নেই। ভাবছি “আনন্দ বাজারে” বিজ্ঞাপন দেব।
পুপেদিদি এতখানি চোখ ক’রে বললে, সত্যি কি দাদামশায়।
আমি বললুম, সত্যির চেয়ে অনেক বেশি—গল্প।