স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/অষ্টম অধ্যায়
আল্হামরা প্রাসাদ।
গ্রাণাডা রাজ্যের সর্ব্বপ্রধান কীর্ত্তি ছিল—ইহার আল হাম্রা নামক বিরাট ও বিশাল প্রাসাদ। সমগ্র পৃথিবীতে এইরূপ মনোহর কারুকার্য্যখচিত এবং অতুল ঐশ্বর্য্য ও বিলাসবিভ্রম পরিপূর্ণ প্রাসাদ এ পর্য্যন্ত আর কখনও নির্ম্মিত হয় নাই। ৪০ হাজার লোক এই প্রাসাদে বাস করিত। আজও ইহার ধ্বংসাবশেষ দর্শন করিয়া সকলেই বিস্ময়সাগরে নিমগ্ন হইয়া থাকেন! কি বিপুল ঐশ্বর্য্য, অতুলনীয় ভাস্কর-কৌশল এবং অপরিসীম পরিশ্রম যে, এই মহা প্রাসাদের জন্য ব্যয় হইয়াছিল, তাহা ভাবিলেও স্তম্ভিত হইতে হয়। পৃথিবীতে এমন “এলাহি কারখানা” এমন বিরাট বিপুল বিচিত্র প্রাসাদ এবং শিল্পভাস্কর্য্য, ও বিলাসবিভ্রমের এ হেন বিশাল ভাণ্ডার আজ পর্য্যন্ত আর কখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। গ্রাণাডার পার্শ্ববর্ত্তী এক পর্ব্বতের বিশাল পৃষ্ঠদেশ সমতল করিয়া তদুপরি মহাযশাঃ সোলতান ইব্নে আলআহমর এই অদ্বিতীয় মহা প্রাসাদের ভিত্তি স্থাপন করেন। ইউরোপ এশিয়া ও আফ্রিকার নানাদেশ ও জনপদ হইতে বহু সহস্ৰ লোকের সাহায্যে এই প্রাসাদ নির্ম্মাণের জন্য নানাজাতীয় উপকরণ ও সাজ সজ্জা সংগৃহীত হইয়াছিল।
বিংশতি সহস্রেরও বেশী লোক ক্রমাগত পঁয়ত্রিশ বৎসর কাল পরিশ্রম করিয়া এই মহাসৌধের নির্ম্মাণকার্য্য শেষ করেন। রোমের পোপের সুবিখ্যাত ভাটিকান প্রাসাদের ন্যায় দশটী প্রাসাদ একত্র করিলে এই প্রাসাদের সমতুল্য হইতে পারে! এক্ষণে পাঠক পাঠক! চিন্তা করুন, “আল্ হামরা” কি বিরাট ও বিপুল কীর্ত্তি! স্পেন, পর্ত্তুগীজ, ফ্রেন্স এবং ইংলিশ ও ইটালীয়ান ভাষায় আল্ হামরা প্রাসাদ সম্বন্ধীয় ইতিহাস, উপন্যাস, কাব্য ও গল্প সংক্রান্ত অন্যূন ৬০০ শত গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। আল্ হামরার কাহিনী লিখিয়া কত ঐতিহাসিক ও কবি যে খ্যাতি লাভ করিয়াছেন, তাহা ভাবিলে অবাক হইতে হয়। এক্ষণেও প্রতি বৎসর সহস্ৰ সহস্র ভাস্কর ঐতিহাসিক কবি ও পর্য্যটক আল্ হামরার দৃশ্য দেখিতে আগমন করেন। আল্ হামরা আজও জগতের সর্ব্ব প্রধান কীর্ত্তি। তাজমহল অপেক্ষাও আল্ হামরার গৌরব অনেক বেশী। আল্ হামরার দেখিয়া লোকে প্রফুল্প এবং আনন্দিত হয়; কিন্তু আল্ হামরা দেখিয়া লোকে স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হইয়া পড়ে। তাজমহল পৃথিবীর বক্ষে ভাস্কর্য্য শিল্পের একটা বিরাট গোলাপ ফুল, কিন্তু আল্ হামরা জগতের বক্ষে বহু গোলাপের কমনীয় কুঞ্জ! বহু তাজের সৌন্দর্য্য একত্র মিশাইলে যাহা হয়, আল্ হামরা তাহাই; আল্ হামরা কবিত্বের বিরাট নন্দনকানন। তাহার কক্ষে কক্ষে বক্ষে বক্ষে অনন্ত সৌন্দর্য্য অনন্ত ঐশ্বর্য্য এবং অনন্ত কারুকৌশলের বিপুল পরিচয়! সে কাহিনী বর্ণনা করিতে মহা কবির লেখনীও অক্ষম। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল্ ম্যাকারী এবং ডনপাস্কল বলেন যে, “যিনি আলহামরা দেখেন নাই, তিনি মহাপণ্ডিত হইলেও মানবীয় চিন্তা ও কল্পনা, কি চিত্তবিনোদন সৌন্দর্য্যের, গাম্ভীর্য্যের এবং কারুকৌশলের মহিমা প্রকাশ করিতে পারে, তাহা কখনই সম্যক রূপে উপলব্ধি করিতে পারেন না।” বহু আরব ও খৃষ্টান কবি আল্ হামরা দেখিয়া বলিয়াছেন, “স্বর্গ ইহা অপেক্ষা আর অধিকতর সুন্দর ও মনোহর কিরূপে হইবে?”
বহুমূল্য রক্তপ্রস্তরে এই বিশাল প্রাসাদ নির্ম্মিত হইয়াছিল। ন্যূনাধিক পাঁচশত ক্ষুদ্র ও বৃহৎ হর্ম্ম্য, সৌধ, অট্টালিকা ও প্রাসাদের সমবায়ে আল্ হামরা গঠিত হইয়াছিল। রক্ত বর্ণ মর্ম্মরে গঠিত বলিয়া ইহার নাম রক্ত প্রাসাদ বা আল্ হামরা হইয়াছে।
প্রাসাদগুলির বিচিত্র কারুকার্য্য লতাপাতার অঙ্কন, দামেস্কায় তক্ষণ, আরবীয় প্রস্তর-সজ্জা, গ্রীসের খোদাই কার্য্য এবং পারসীক গথিক এবং রোমক ধরণের শিল্পকার্য্যজনিত বিচিত্র সৌন্দর্য্য যার পর নাই মনোহর ছিল।
ভিতরের দেওয়াল ও ছাদ, নানাবর্ণের প্রস্তরের চমৎকার সম্মিলন করিয়া প্রস্তুত করা হইয়াছিল। সুবর্ণ গলাইয়া সিংহ প্রাসাদের ছাদ ও দেওয়ালের অপূর্ব্ব সজ্জা রচিত হইয়াছিল। এই সমস্ত সুবর্ণের লতা ও পত্র পুষ্পের মঞ্জরীগুলি মণি-মুক্তা-খচিত ছিল। বিচিত্র কারুকার্য্যসমন্বিত কাশ্মিরী শাল এবং মূল্যবান বেনারসী শাটীর ন্যায় এই সমস্ত কারুকার্য্য যার পর নাই কৌশলপূর্ণ এবং মনোহর।
বেগম ও শাহজাদীগণের বাসগৃহগুলি শ্বেত মর্ম্মরপ্রস্তরে মণ্ডিত ও চমৎকার সাজসজ্জায় ও কারুকৌশলে মনোজ্ঞ ছিল।
প্রাসাদের স্তম্ভগুলি যার পর নাই মনোহর এবং উন্নত ছিল। জালানাগুলির নক্সা ও জাফরীর কার্য্য যেমনি মসৃণ তেমনি মনোহর এবং কৌশলপূর্ণ ছিল! লাল, নীল, সবুজ, পাটল, বেগুণে, শ্বেত বিবিধ বিচিত্র বর্ণের প্রস্তরখণ্ডের সহিত মণি মুক্তা বিখচিত করিয়া অতি অপূর্ব্ব জাঁকজমকে প্রমোদপ্রাসাদটী সজ্জিত করা হইয়াছিল। এই প্রাসাদের কারুকার্য্যের জন্য এক শত মণ স্বর্ণ, তিন হাজার মণ রৌপ্য এবং তের মণ মণি মুক্তা ব্যয়িত হইয়াছিল। ইহার সপ্ত সহস্ৰ দ্বার ও জানালায় কাংস্য লৌহ এবং মূল্যবান আবলুস কাষ্ঠের কপাট ছিল। সমস্ত কপাটই অতুলনীয় কারুকার্য্য খচিত ছিল।
প্রাসাদের সম্মুখস্থ বিরাট জলাশয় এবং প্রাঙ্গণমধ্যস্থিত কৃত্রিম হ্রদ ও ঝিলগুলি সম্পূর্ণ ভাবেই স্বভাবসুন্দর ছিল। নানা দেশীয় জলজ পুষ্পরাশিতে সকল সময়েই সরোবরগুলি প্রমোদিত থাকিত।
দরবার প্রাসাদে ৪টী সিংহের উপরে একটা অপূর্ব্ব সিংহাসন রক্ষিত ছিল। সিংহমুর্ত্তিগুলি যার পর নাই রমণীয় ছিল। এই প্রাসাদটী একশত আটাশটী অতি দীর্ঘ এবং চমৎকারগঠন স্তম্ভের উপর অবস্থিত ছিল। ইহার বিরাট কক্ষ সৌন্দর্য্য ও বিশালতায় অতুলনীয় ছিল! স্তম্ভাবলীর শীর্ষদেশে অতি মনোহর লতা কুঞ্জ খোদাই করা হইয়াছিল। আজ্ জোহরা প্রাসাদের দরবারগৃহ হইতে আল হাম্রার দরবার-গৃহ সাজসজ্জা জাঁকজমক এবং গঠন-সৌন্দর্য্যে কোনও অংশেই নূ্যন ছিল না। পণ্ডিতবর্গের সম্মিলন দিবসে কিম্বা কোনও রাজ্যের রাজা, রাজপুত্র কিম্বা রাজপ্রতিনিধির আগমনে বিশেষ আড়ম্বরে দরবারের অধিবেশন হইত।
আল হাম্রার অন্যান্য প্রাসাদ ও সৌধ গুলির অসংখ্য চূড়া মিনার কার্ণিস স্তম্ভের স্তবক সমস্তই কবি-চিত্ত-বিনোদন সৌন্দর্য্যের সাধার ছিল!
প্রমোদ প্রাসাদে স্বর্ণ রৌপ্য নির্ম্মিত এবং মণি মুক্তা খচিত কৃত্রিম ফলপুষ্প বৃক্ষলতার এক অতি চমৎকার উদ্যান ছিল! আল্-হামরা প্রাসাদের সঙ্গীত গৃহ অপূর্ব্ব বৈজ্ঞানিক কৌশলে প্রস্তুত করা হইয়াছিল। সঙ্গীতের স্বর লহরী ইহার গম্বুজ এবং প্রাচীরে প্রতিধ্বনিত হইয়া অতি সুস্পষ্ট ও সমূচ্চ হইয়া উঠিত। অতি ক্ষীণ কণ্ঠে গান করিলেও ইহার সমস্ত হলে তাহা প্রতিধ্বনিত হইত। সঙ্গীতের জন্য এমন উপযুক্ত প্রাসাদ আর কখনও নির্ম্মিত হইয়াছিল কি না সন্দেহ। হলের দ্বিতলের গ্যালারীতে স্ত্রীলোকদিগের বসিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট ছিল। স্ত্রীলোকদিগের আসনের সম্মুখে শ্বেত প্রস্তরের ঝালর এবং জাফরীযুক্ত এমন রমণীয় পর্দ্দা ছিল যে, ঈষদ্দূর হইতে তাহা রেশমী বস্ত্রনির্ম্মিত পর্দ্দা বলিয়া বোধ হইত। শ্বেত পাথরের উপরে এমন সূক্ষ মসৃণ কারুকার্য্য এবং লতাপাতার চমৎকার খোদাই আর কোথায়ও বা বুঝি বিকাশ প্রাপ্ত হইয়াছিল না। আল হাম্রা নির্ম্মাণে কেবল যে জলের মত অর্থব্যয় করিতে হইয়াছিল তাহা নহে, ইহার নির্ম্মাণ কল্পে তৎকালীন বৈজ্ঞানিক ভাস্কর এবং শিল্পিগণকে মস্তিষ্কের বিপুল চালনা করিতে হইয়াছিল। প্রাসাদের প্রত্যেক কক্ষেই জলের ধারা, নলসংযোগে নীত হইয়াছিল! দ্বিতল ত্রিতল কক্ষেও বৈজ্ঞানিক উপায়ে জল তোলা হইয়াছিল। দারো নদীর সুনির্ম্মল জলধারা অসংখ্য নহর, চৌবাচ্চা, এবং ফোয়ারায় উৎসারিত এবং প্রবাহিত করা হইয়াছিল। উদ্যানস্থ নহরের জলে চীনদেশীয় নানাবর্ণের মৎস্য আনিয়া প্রতিপালন করা হইয়াছিল! বেগম ও শাহ্জাদীদিগের আনন্দ বৰ্দ্ধনের জন্য বহু সংখ্যক মৎস্যের নাকে মতির নথ গাঁথিয়া দেওয়া হইয়াছিল। নহরের নির্ম্মলজলে এই সমস্ত মৎস্যের বাহার দেখিয়া সকলেই মুগ্ধ হইত! ফলতঃ মানবের মস্তিষ্ক, সুখ, শান্তি, আরাম, আয়েস, সৌন্দর্য্য, সুরুচি এবং ঐশ্বর্য্য ও বিলাসিতায় যতদূর কল্পনা করিতে পারে, আল হাম্রা তাহার চরম নিদর্শন স্বরূপ ছিল।
আল্ হামরার মসজিদ।
আল হাম্রা প্রাসাদস্থ মসজিদটীও বিরাট ও রমণীয় ছিল। ইহার বিরাট গম্বুজ ও মিণার চতুষ্টয় যেমন বৃহৎ তেমনি উচ্চ ছিল। গ্রাণাডার সোলতানগণের প্রায় সকলেই এক একটী মসজিদ ও কলেজ স্থাপন করিয়াছিলেন। সেই সমস্ত মসজিদের অধিকাংশই অতীব মনোহর ছিল।