স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/চতুর্থ অধ্যায়
জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা।
পৃথিবী-সুন্দরীর উজ্জ্বলতম এবং আশ্চর্য্যতম অলঙ্কারস্বরূপিণী কর্ডোভা নগরী স্বীয় গৌরবের দিনে জ্ঞানালোচনা এবং শিক্ষার কোলাহলে যেমন মুখরিত, তেমনি আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনার মহিমায় শীর্ষস্থানীয় ছিল। নগরীর সৌন্দর্য্য, পারিপাট্য, ঐশ্বর্য্য এবং বৈচিত্র্য যেমন আশ্চর্য্যজনক ছিল, ইহার শিক্ষানুরাগ এবং জ্ঞানচর্চ্চার বিপুল আয়োজন ও উপকরণ তদপেক্ষা কোনও অংশে ন্যূন ছিল না। বাস্তবিক পক্ষে জগতের সেই দুর্দ্দিনের উদ্ধারকারী ‘গৌরবের সন্তান’ মুসলমানগণের মধ্যে তৎকালে যে পৃথিবীগ্রাসিনী বিজয়-বাসন এবং বিশ্বশোষিকা জ্ঞান-পিপাসা পরিদৃষ্ট হইত; তাহা স্পেন সাম্রাজ্যে সম্যক্রূপে স্ফূর্ত্তি লাভ করিয়াছিল। বরং কর্ডোভার বিজয়-বাসনা সংযত হইবার পরে জ্ঞানালোচনার আগ্রহ এবং উদ্যম সম্যক্রূপে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। কর্ডোভা সমগ্র ইউরোপের জ্ঞান, বিদ্যা ও সভ্যতার কেন্দ্ররূপে পরিণত হইয়াছিল। ইউরোপের সমস্ত রাজ্য হইতে জ্ঞানপিপাসু সহস্ৰ সহস্র ছাত্র, ধীসমৃদ্ধ বিজ্ঞানবিশারদ অধ্যাপকমণ্ডলীর নিকট জ্ঞানাহরণার্থ সমবেত হইত। এখানে বিজ্ঞানের প্রত্যেক শাখার অধ্যাপনা এবং আলোচনা হইত। কর্ডোভার বিরাট বিজ্ঞানাগারে ছাত্রমণ্ডলীকে যন্ত্রসংযোগে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণ শিক্ষা দেওয়া হইত। সাধারণের পাঠের জন্য সপ্তদশটী বিরাট লাইব্রেরী এবং বহুসংখ্যক পাঠ-সম্মিলনী (ক্লাব) ছিল। এতদ্ব্যতীত প্রত্যেক স্কুল কলেজ এবং মস্জেদে ছাত্রমণ্ডলী এবং উপাসকদিগের পাঠের জন্য বিবিধ প্রয়োজনীয় গ্রন্থাদি রক্ষিত হইত। গৌরবের মাধ্যাহ্নিক কালে বত্রিশটী কলেজ এবং ৫০০ শত উচ্চশ্রেণীর সুপরিচালিত বিদ্যালয় কর্ডোভাতে বিদ্যমান ছিল। পাঠক মনে রাখিবেন, স্পেনের প্রত্যেক নগরেরই স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ ও পাঠশালা সমূহ বিদ্যমান ছিল। স্পেনের অন্যতম মহানগরী গ্রাণাডাতেও ২০টী সুপরিচালিত কলেজ এবং বহুসংখ্যক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। স্পেনের প্রত্যেক সোলতান এবং আমীর অল্পাধিক পরিমাণে বিদ্যোৎসাহী ও জ্ঞানচর্চ্চালিপ্সু ছিলেন বলিয়া স্পেনসাম্রাজ্য তখন জ্ঞান বিজ্ঞানের মধ্যাহ্ন-মিহির-করে উদ্ভাসিত এবং বিশ্বজগতে প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল। প্রত্যেক সোলতানই নূতন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিতেন। রাজ্যের সম্ভ্রান্তবর্গ এবং আমীরগণ সোলতানদিগের অনুসরণে বিরত ছিলেন না। শিক্ষার জন্য ধনাঢ্য ব্যক্তি হইতে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তিগণ পর্য্যস্ত স্ব স্ব সম্পত্তির অধিকাংশ ‘ওয়াক্ফ’ করিয়া যাইতেন। তৎকালে যে ব্যক্তি বাটীতে ছাত্র ‘জায়গীর’ এবং লাইব্রেরী না রাখিতেন, তিনি নিতান্ত অভদ্র এবং অশিক্ষিত বলিয়া সমাজে লাঞ্ছিত হইতেন। খলিফা হাকেমের সময় প্রায় তিন লক্ষ ছাত্র ও ছাত্রী কর্ডোভাতে অধ্যয়ন করিত। ভূগোল শিক্ষার জন্য গোলক (Globe) এবং মানচিত্র ব্যবহৃত হইত। কর্ডোভার ‘রসদখানায়’ (মানমন্দিরে) বহুসংখ্যক নূতন যন্ত্র সংগৃহীত এবং নির্ম্মিত হইয়া রক্ষিত হওয়ায় নানা দিগ্দেশ হইতে পণ্ডিতমণ্ডলী আগমন করিয়া জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা এবং নক্ষত্রাদির গতি নিৰ্দ্ধারণ করিতেন। বিদ্যোৎসাহী খলিফা হাকেম প্রভূত অর্থব্যয় করিয়া পৃথিবীর নানা রাজ্য এবং নানা রাজধানী হইতে বহু যত্নে শত শত লোক নিযুক্ত পূর্ব্বক প্রায় ছয় লক্ষ মূল্যবান এবং দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রহ করিয়াছিলেন। ইতিপূর্ব্বে পৃথিবীতে এরূপ বিরাট এবং মূল্যবান লাইব্রেরী আর কখনও স্থাপিত হইয়াছিল না।
ঘটিকা-যন্ত্রের দোলক এবং টেলিগ্রাফের উদ্ভাবন এখানেই সর্ব্বপ্রথমে আবিষ্কৃত হয়। এখানেই সর্ব্বপ্রথমে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রসংযোগে ৩২ ফুট ঊৰ্দ্ধ পর্য্যন্ত জলরাশি উত্তোলিত হয়। স্ত্রীশিক্ষা পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে এখানেই বিস্তৃতি এবং উন্নতি লাভ করে। মুরিস আরবগণ সন্তানের শিক্ষার অগ্রে সন্তানের মাতার শিক্ষার আবশ্যকতা পূর্ণভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। বালিকা এবং স্ত্রীলোকদিগের জন্য স্বতন্ত্র স্কুল এবং কলেজ বিদ্যমান ছিল। এখানেই মাতৃজাতির মধ্যে সর্বপ্রথমে ইউরোপে বোগ্দাদের ন্যায় কবি, চিকিৎসক, অধ্যাপিকা, আইন-ব্যাখ্যায়িত্রী, ঐতিহাসিক এবং ধাত্রী পরিদৃষ্ট হইত। এখানেই হামেদা, হাফেজা, রোকিয়া, জয়নব, মোরিয়া, সোফিয়া, ফজল প্রভৃতি বিদুষী এবং প্রতিভাশালিনী রমণীরত্ন জন্মগ্রহণ করিয়া স্পেনের জ্ঞানচর্চ্চার গৌরব উন্নত এবং মহান করিয়া তুলিয়াছিল। অতীতের এই গরীয়সী মহানগরী কর্ডোভাতেই সমগ্র ইউরোপের মধ্যে সর্ব্বপ্রথমে রমণীগণ জ্ঞানালোচনায় পুরুষদিগের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইয়াছিলেন। এখানেই একদিন বিজ্ঞানাগার এবং রসায়নশিক্ষার প্রক্রিয়া (Experiment) এবং বিশ্লেষণ লইয়া মুসলমান ছাত্র ও ছাত্রীগণের মধ্যে বাদানুবাদ হইত। হায়! বর্ত্তমানে এই মুসলমান-জগতে এ সকল সম্পূর্ণরূপে অপরিজ্ঞাত এবং অদৃষ্ট! সকালে উঠিয়া কর্ডোভার রাজপথগুলিতে দৃষ্টি করিলে দেখা যাইত যে, দলে দলে বালক বালিকা বিচিত্র বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া স্কুল এবং কলেজের দিকে ছুটিয়াছে, ভ্রাতা এবং ভগ্নীগণ, হাত ধরাধরি করিয়া, হাস্যমুখে পাঠ-ঘটিত নানা প্রকারের প্রশ্নোত্তর এবং তর্ক বিতর্ক করিতে করিতে পাঠশালায় চলিয়াছে। হায়! এই বিশ্বশোষিকা জ্ঞান-পিপাসার অপূর্ব্ব চিত্র আবার কবে মুসলমান-জগতে প্রতিভাসিত হইবে!
কর্ডোভাতে চিকিৎসা-বিদ্যা আশাতীত উন্নতি লাভ করে। জালিনুসের (Golen) পরে চিকিৎসা-শাস্ত্রের ভৈষজ্যতত্ত্ব, রোগনিদান এবং শারীরবিদ্যার বিবিধ অজ্ঞাত এবং দুর্জ্ঞেয় তত্ত্ব এখানে আবিষ্কৃত এবং স্পষ্টীকৃত হয়।
একাদশ শতাব্দীর সুপ্রসিদ্ধ ভিষক আবুল কাসেম (Albacacis) এখানেই তাঁহার অস্ত্রচিকিৎসার আশ্চর্য্য নৈপুণ্য দেখাইয়াছিলেন। তাহার অস্ত্র চিকিৎসার প্রণালী আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ছিল। ঐতিহাসিকগণ তাঁহার অস্ত্র-চিকিৎসার অনেক আশ্চর্য্য কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার কিছুদিন পরে জগদ্বিখ্যাত ভিষকাচার্য্য এবনে জোহর (Avenzoar) প্রাদুর্ভূত হন। তিনি বিবিধ প্রকারের ঔষধ এবং অস্ত্র প্রয়োগের অস্ত্রাদি আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন। প্রসিদ্ধ উদ্ভিদ্তত্ত্ববিদ এব্নে বত্হের এখানেই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি ঔষধসংক্রান্ত গাছগাছড়ার পরীক্ষার জন্য এসিয়া এবং আফিকার বহুদেশ পর্য্যটন করিয়াছিলেন। তিনি ভৈষজ্য ঔষধি সম্বন্ধীয় বিরাট গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছিলেন। সুপ্রসিদ্ধ ইহুদীবংশাবতংস চিকিৎসক হাসেদাইও এখানে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। ইনি আশ্চর্য্য চিকিৎসাকৌশলে নাভেরীর রাণী থিয়োডারীর অসাধারণ স্থূলত্বের লাঘবতা সাধন করেন। প্রসিদ্ধ পণ্ডিত এব্নে রোশদ (Avenrose) ইউরোপের গৌরবস্তম্ভ। তাঁহার ন্যায় দর্শনশাস্ত্রে প্রতিভা তৎকালে আর কাহারও পরিলক্ষিত হইত না। ইউরোপের আধুনিক দার্শনিকগণ সকলেই এব্নে রোশ্দের নিকট ঋণী। সক্রেটিস এবং অরিষ্টটলের দার্শনিক মতের ইনিই জ্ঞানগর্ভ বিস্তৃত সমালোচনা করিয়াছিলেন, ইনি অনেক অস্ফূট দার্শনিক তত্ত্ব পরিস্ফুট এবং জটিল তত্ত্ব সরল করেন। ইঁহার দার্শনিক মতের উচ্চতা এবং সূক্ষতার জন্য ধর্ম্মান্ধ গোঁড়াগণের মধ্যে অনেক কোলাহল উপস্থিত হইয়াছিল।
আরবী সাহিত্য এবং ইতিহাস এখানে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। শত শত পণ্ডিত জন্মগ্রহণ করিয়া অমৃতনিস্যন্দিনা আরবী ভাষায় সাহিত্য এবং ইতিহাস রচনা করিয়া অমরত্ব লাভ করিয়াছিলেন। আমরা বাহুল্যভয়ে ঐতিহাসিক এবং সাহিত্যবিদ্ পণ্ডিতদিগের আলোচনায় বিরত রহিলাম। মুসলমানগণ সর্ব্বত্রই ইতিহাসের চর্চ্চা এবং সেবা চিরকালই করিয়া আসিয়াছেন। অতি সামান্য সামান্য ঘটনা পর্য্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সমালোচিত এবং লিখিত হইত। স্পেনের একখানি ইতিহাস সুবৃহৎ ৭০ খণ্ডে রচিত হইয়াছিল। ভূমণ্ডলের একাল পর্য্যন্ত কোনও দেশে এমন বিরাট ইতিহাস বিরচিত হয় নাই।
সঙ্গীত এবং কবিতা কর্ডোভাতে সম্যক্রূপে পুষ্টি লাভ করিয়াছিল। পৃথিবীতে সঙ্গীত এবং কবিতার এমন হুড়াহুড়ি ইতিপূর্ব্বে আর কোথাও দেখিতে পাওয়া যায় নাই। ভৃত্য এবং কৃতদাসগণ পর্য্যন্ত কবিতার আলোচনা করিত। স্পেনের লোক, চমকিত সৌভাগ্যের সময় মধুবর্ষিণী আরব্য ভাষায় যে কবিত্ব তরঙ্গ উপস্থিত হইয়াছিল, তাহা পর্ব্বত ও সমুদ্র উল্লঙ্ঘন পুরঃসর ইউরোপের নানাদেশে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। কোনও কথা বা কোনও উপদেশ কবিতায় আবৃত্তি ব্যতীত শেষ হইত না। কর্ডোভার সর্ব্বত্রই অপরাহ্নে এবং রাত্রিতে সঙ্গীতের মনোমোহিনী রাগিণীর ঝঙ্কার শ্রুত হইত। বাদ্যযন্ত্রের মধুর নিক্কণে এবং সঙ্গীতের সুধাবর্ষণে কর্ডোভা পরীরাজ্য বলিয়া বোধ হইত। স্পেন, ইটালী এবং ফান্সের ব্যালাড্ (Ballads) কঞ্জোনেট (Conzonette) ট্রাবাজেয়র্স (Trw পান করিতেন; তিনি কদাপি আর কাহারও সঙ্গীত শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করিতেন না। জেরাব বীণাতে পঞ্চমতারের সংযোজনা এবং কাচের পানপাত্রের উদ্ভাবন এবং প্রচলন করেন। জেরাব প্রত্যহ নূতন ধরণের বসন ভূষণে সজ্জিত হইতেন; তৎকালে তাঁহার ন্যায় “ফ্যাসান দোরস্ত” ব্যক্তি সমগ্র স্পেনে আর একজনও পরিলক্ষিত হইত না। তাঁহার অমৃতময় সঙ্গীতাবলী তদানীন্তন জগতে দ্রুত বিস্তৃত হইয়া পড়িয়ছিল। ফলতঃ মহানগরী কর্ডোভার সঙ্গীত এবং কবিতা-চর্চ্চা অবর্ণনীয় এবং অপ্রমেয় ছিল।
স্থাপত্য এবং ভাস্কর্য্যের বিষয় আলোচনা করা অনাবশ্যক। কর্ডোভার রাজপ্রাসাদ এবং মস্জেদ মালার দৃঢ়তা এবং কারুকৌশল এখনও জগতের বিস্ময়ের বিষয় হইয়া রহিয়াছে। সমগ্র স্পেনে মুসলমানগণ স্থাপত্য শিল্পকৌশলের যে অপূর্ব্ব গরিমা প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা জগতের ইতিহাসে এক মহা রহস্যের বিষয়ীভূত হইয়া রহিয়াছে। ইউরোপীয়গণ এই বিজ্ঞানোন্নত যুগেও তাহার অনুসরণ করিতে অক্ষম রহিয়াছেন!
ব্যবহারিক শিল্পে ইউরোপ এখন অনেক উন্নতি করিলেও, সৌন্দর্য্য, স্থায়িত্ব এবং দৃঢ়তায় স্পেনের সারাসানিক শিল্পকে পরাস্ত করিতে পারে নাই। বস্ত্র-শিল্প এখানে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। রেশম বয়নে আন্দালুসিয়া (স্পেন) পৃথিবীকে বিমুগ্ধ করিয়াছিল। এখানে রেশমের নানা প্রকারের সূক্ষ্ম এবং মসৃণ বস্ত্র যাহা প্রস্তুত হইত, ইউরোপের খ্রীষ্টান রাজধানী সমূহে তাহার ব্যবহার হইত। পাঠক মনে করুন, এক কর্ডোভাতেই অন্যূন একলক্ষ ৩০ হাজার তাঁতি কৌষেয় বসন বয়নে নিযুক্ত ছিল। ভূমণ্ডলে রেশমী পরিচ্ছদের ব্যবহারে কর্ডোভা যাবতীয় নগরীকে পরাস্ত করিয়াছিল। আলমোরিয়া নগরে সর্ব্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট গালিচা এবং সূক্ষ্ম বস্ত্র প্রস্তুত হইত।
ধাতব এবং মৃন্ময় পাত্রাদি অপূর্ব্ব উন্নতি লাভ করিয়াছিল। তাম্র কাঁসা পিত্তল এবং মৃন্ময় বাসন-শিল্পে স্পেনীয় শিল্পিগণ অপূর্ব্ব কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়াছিল। মেজর্কা দ্বীপের মৃৎপাত্রগুলি ইউরোপ এবং আফিকার যাবতীয় বন্দরে এবং নগরে সাদরে বিক্রীত হইত। পরবর্ত্তী সময়ে এই মেজর্কাদ্বীপের মৃন্ময় বাসনশিল্প ইটালীতে গৃহীত এবং বিস্তৃত হইয়া ‘মেজলিকা’ নামে খ্যাতিলাভ করে। মৃৎপাত্র গুলি স্বর্ণ এবং রৌপ্যরঞ্জিত হইয়া সৌন্দর্য্য ও ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ করিত। আলমোরিয়াতে লৌহ, কাংস এবং কাচের অসংখ্য প্রকারের বিচিত্র পাত্রাদি নির্ম্মিত হইত। আলমোরিয়াতে কাচের একটী বিরাট কারখানা ছিল; এই কারখানায় উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বিবিধ প্রকারের ঝাড়, ফানুস, লণ্ঠন এবং জলপাত্রাদি প্রস্তুত হইত। হস্তীদন্তের খোদাই-শিল্প চমৎকার সৌন্দর্য্য এবং সূক্ষ্মতা লাভ করিয়াছিল। হস্তীদন্ত-নির্ম্মিত মণিমুক্তা খচিত আধার সমূহ ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের নিকট নিতান্ত প্রিয়বস্তু ছিল। খলিফা দ্বিতীয় হাকেমের নামে উৎসর্গীকৃত একট অতীব মনোজ্ঞ হস্তিদন্তরচিত পেটিকা জেরোনা নগরের খ্রীষ্টীয় ভজনাগারে সযত্নে রক্ষিত হইয়া দর্শকের মনাকর্ষণ করিতেছে। স্পেনের সোলতান এবং আমীরদিগের অত্যদ্ভুত শিল্পকৌশলসম্পন্ন তরবারির বাঁটসমূহ এখনও ইউরোপের বিভিন্ন যাদুঘরে রক্ষিত রহিয়াছে। ধাতুশিল্পে কর্ডোভার শিল্পিগণ আশ্চর্য্য নৈপুণ্য প্রকাশ করিতেন। সামান্য সামান্য চাবি এবং তালা গুলি পর্য্যন্ত কারুকার্য্যে শোভিত হইত। আল্মেরিয়া, সেভিল, টলিডো, মার্সিয়া এবং গ্রাণাডা যুদ্ধের অস্ত্র শস্ত্রাদির জন্য বিখ্যাত ছিল। টলিডোর তরবারি এবং ছুরিকা বহুমুল্যে বিক্রীত হইত। কাংসের ঢালাই কার্য্যে যথেষ্ট নৈপুণ্য পরিলক্ষিত হইত। বৃহৎ বৃহৎ কাংস-কপাট সমূহ, যাহা এখনও খ্রীষ্টানদিগের ভজনাগারের শোভা সম্পাদন করিতেছে, দর্শন করিলে বিস্মিত হইতে হয়। উজ্জ্বল কাংসনির্ম্মিত ফানুস এবং ঝাড় সমূহে আশ্চর্য্যরূপে খোদাই-কৌশল এবং চিত্রাঙ্কন পরিব্যক্ত হইয়াছে। গ্রাণাডার সোলতান তৃতীয় মোহাম্মদের জন্য নির্ম্মিত একটা মস্জিদের বিচিত্র-দর্শন আলোকাধার এখনও মাদ্রিদের মিউজিয়মে রক্ষিত আছে। অলঙ্কার এবং জরির কার্য্যের পারিপাট্য কায়রো এবং দামেস্ক অপেক্ষা কোনও অংশেই ন্যূন ছিল না। বস্তুতঃ কর্ডোভা মহানগরী যেমন জ্ঞানচর্চ্চায় এবং ঐশ্বর্য্যে, তেমনি শিল্প ও বাণিজ্যে পৃথিবীর মুকুটমণি স্বরূপ ছিল। যাবতীয় ঐতিহাসিকগণ কর্ডোভার লোক-চমকিত সৌভাগ্য এবং প্রতাপের বিশদ বর্ণনায় স্ব স্ব ইতিবৃত্ত অলঙ্কত করিয়াছেন। হায় স্পেন, তোমার সেই গৌরববাহিনী অতীত কাহিনী অধঃপতিত মুসলমানের প্রাণে কবে উন্নতির আকাঙ্ক্ষা পুনঃ প্রজ্বলিত করিবে?