স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/পঞ্চম অধ্যায়
মহানগরী গ্রাণাডা।
প্রিয় পাঠক পাঠিকা! স্পেন সাম্রাজ্যের অন্যতম মহানগরী গ্রাণাডার অসাধারণ সৌন্দর্য্য ও অতুলনীয় গৌরব ও সম্পদ কর্ডোভা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ ন্যূন হইলেও জগতের অন্য কোন প্রসিদ্ধ নগরী অপেক্ষা নিশ্চয়ই হ্রস্ব ছিল না। স্পেনের খলিফাদিগের দিগ্বিজয়ের প্রতাপ মন্দ হইয়া আসিলে, এবং বিপুল সাম্রাজ্যের নানা অংশ খৃষ্টানদিগের করতলগত হইয়া হতশ্রী ও হুতমান হইয়া উঠিলে, গ্রাণাডা, ঐশ্বর্য্য-সম্পদ, বাণিজ্য ব্যবসায় এবং জ্ঞান ও শিল্প চর্চায় ক্রমশঃ যৌবন লাভ করিতে থাকে।
গ্রাণাডা, কর্ডোভার ন্যায় বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল না। ইহা স্পেনের একটী ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী মাত্র ছিল। এই রাজ্য দৈৰ্ঘ্য ও বিস্তারে কখনও ২৬০ মাইল এবং ৮৮ মাইল হইতে বৃহৎ ছিল না। কিন্তু এই ক্ষুদ্র রাজ্য কৃষি শিল্পে সমৃদ্ধ এবং খনিজ পদার্থ, গৃহনির্ম্মাণের উপযোগী নানাবিধ মূল্যবান্ প্রস্তর, নানাজাতীয় কাষ্ঠের বনে পরিপূর্ণ থাকায়, ইহা ধনসম্পদ ও শক্তিসামর্থ্যে একট সমৃদ্ধ সাম্রাজ্যের সমতুল্য ছিল, ভূমধ্য সাগরের তটবর্ত্তী থাকায় বাণিজ্যও বিশেষ প্রসার লাভ করিয়াছিল। এই ক্ষুদ্র রাজ্যটী বসন্তকালীন অসংখ্য পুষ্পপুঞ্জমণ্ডিত রমণীয় উদ্যানের ন্যায় এবং ইহার রাজধানী সেই পুষ্পবাটিকা মধ্যস্থ নানা আলঙ্কার বিভূষিতা দিব্যবস্ত্রশোভিত অলোকসাধারণ সুন্দরী রাজরাণীর ন্যায় প্রতিভাত হইত!
গ্রাণাডার রাজা ও আমীরগণ মক্ষিকার ন্যায় নিবিষ্টচিত্তে প্রাণপণ যত্নে শিক্ষা ও সভ্যতার মধুচক্র স্বরূপ এই মহানগরীকে যারপরনাই শোভনীয়, লোভনীয় এবং মোহনীয় করিয়া তুলিয়াছিলেন।
গ্রাণাডায় বহুসংখ্যক প্রতিভাশালী পণ্ডিত বৈজ্ঞানিক দার্শনিক ও কবি জন্মগ্রহণ করিয়া স্বৰ্গীয় জ্ঞানের অমৃতধারা প্রবাহিত করিয়াছিলেন। মৃতপ্রায় ইউরোপে এখান হইতে নবজীবনের বারি, ভূরিপরিমাণে প্রবাহিত হইয়াছিল।
নারীদিগের মধ্যেও এখানে সাহিত্যিক, দার্শনিক এবং বহু কবি জন্মগ্রহণ করিয়া পুরুষ-প্রতিভার সহিত প্রতিযোগিতা করিয়াছিলেন। সঙ্গীত ও কবিতা চর্চ্চায় শিল্পনৈপুণ্য ও চিত্র অঙ্কনে এখানে নারী-প্রতিভার যে গৌরব ফুটিয়া উঠিয়াছিল, তাহাতে ইহা তৎকালের প্যারিস বলিয়া অভিহিত হইবার উপযুক্ত।
এখানেই রমণীকুল-শিরোভূষণ জ্ঞান ও বিদ্যার মন্দাকিনী-ধারা-স্বরূপিণী জগদ্বিখ্যাত নাজাহান, জয়নব এবং হামেদ, সোফিয়া ভবয়দা এবং কালাইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। গ্রাণাডায় এমন কোনও পল্লী ছিল না, যেখানে ২।৪ জন বিদূষী ও প্রতিভাশালিনী মহিলা জন্মগ্রহণ না করিয়াছিলেন। প্রতিবৎসর এখানের বিভিন্ন বিষয়ের সভা সমিতির যে সমস্ত বার্ষিক বা বিশেষ অধিবেশন হইত, রমণীরা তাহাতে সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে যোগদান করিতেন। অনেক সময় রমণীদিগের বক্ততা, মন্তব্য ও উপদেশ শুনিয়া এবং গবেষণা দেখিয়া পণ্ডিতদিগকে স্তম্ভিত হইতে হইত!
এই ক্ষুদ্র রাজ্যে ত্রিশটী শহর এবং আশীটী দুর্গবদ্ধ নগর ছিল। ফলতঃ গ্রাণাড রাজ্যটীকে নগরের দেশ বলিলে অত্যুক্তি হইত না।
গ্রাণাডার পল্লীবাসিগণও তৎকালীন রোম ও এথেন্স এবং কনষ্টাণ্টিনোপলবাসী খ্রীষ্টানদিগের অপেক্ষা মার্জ্জিত রুচিবিশিষ্ট, সংস্কৃতবেশধারী এবং ভদ্র ও সভ্য ছিল। প্রত্যেক গ্রামেই সাধারণ পুষ্পোদ্যান, জল-প্রণালী, ক্রীড়া-প্রান্তর, লাইব্রেরী, বিদ্যালয় এবং অতিথিশালা ছিল।
সঙ্গীত চর্চ্চা এবং অশ্বারোহণ ও পলো ক্রীড়ায় গ্রাম্য কৃষকগণ পর্য্যন্ত পটু ছিল। পোষাক পরিচ্ছদের পারিপাট্য এবং বাহুল্যের দরুণ সূচীশিল্প এবং সল্মা চুমকী ও জরীর কার্য্য এখানে চরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। গ্রাণাডার অধিবাসিগণ সত্যবাদিতা ও প্রতিজ্ঞা পালনের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। সৌজন্য এবং আতিথেয়তা তাঁহদের স্বভাবগত গুণ ছিল।
বোগ্দাদ ও কর্ডোভার ন্যায় এখানেও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগের গৃহে মধ্যে মধ্যে পণ্ডিতদিগের নৈশ সম্মিলন হইত। এই সম্মিলনে ভোজের আয়োজন অনিবার্য্য ছিল। এই সমস্ত সম্মিলনে সঙ্গীত হইতে আরম্ভ করিয়া সর্ব্বপ্রকার জ্ঞান ও বিদ্যার সমালোচনা হইত। কখনও কখনও এই সমস্ত সমালোচনায় ও তর্ক বিতর্কে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইত। স্ত্রীলোকেরাও স্বতন্ত্র থাকিয়া এই সমালোচনায় যোগ দিতে পারিতেন!
সভ্যতার অন্যতম অঙ্গ বিলাসিতাও এখানে ষোল কলায় ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সুগন্ধিদ্রব্য সাবান এবং ফুলের ব্যবহারে এখানে যুগান্তর উপস্থিত হইয়াছিল। পুষ্পেদ্যানশূন্য বাটী কলঙ্ক ও লজ্জার কারণ বলিয়া বিবেচিত হইত। দরিদ্রতম এবং হীনতম ব্যক্তিও মলিন পোষাকে কদাপি গৃহের বাহির হইতে চাহিত না! দীন দরিদ্রও সাবান না মাখিয়া স্নান করিত না এবং আতর না মাখিয়া মস্জেদে বা জমাতে যাইত না।