স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা/ষষ্ঠ অধ্যায়
কৃষি ও উদ্যান বিদ্যা।
কৃষি ও উদ্যান-নির্ম্মাণ বিদ্যা এখানে পরম উন্নতি লাভ করিয়াছিল। ভেগা, ডারো, জেনিল প্রভৃতি নদ নদী হইতে অসংখ্য খাল ও নহর কাটিয়া সমস্ত গ্রাণাডা রাজ্যকে সরস ও উর্ব্বর করা হইয়াছিল। গ্রীষ্মকালে সমস্ত রাজ্য একটী অখণ্ড বাসন্তী-উদ্যান বলিয়া প্রতিভাত হইত। তৎকাল-পরিজ্ঞাত বিভিন্ন দেশের প্রায় সর্ব্ব জাতীয় ফলফুল ও শস্যের চাষ এখানে হইত। গ্রাণাডার কোনও কোনও বাগান এত মনোহর ছিল যে, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে সহস্ৰ সহস্র ব্যক্তি উদ্যান-বিহারে লিপ্ত থাকিত। মিণারশূন্য মস্জেদ, বাগানশূন্য বাটী, তালাবশূন্য উদ্যান, নহরশুন্য ময়দান এবং উৎস শূন্য পার্ক কদাপি রচিত হইত না। রাজকীয় এবং বড় লোকদিগের বৃহৎ বৃহৎ উদ্যানে বিশ্রামের জন্য আরাম খানা নির্ম্মিত হইত। গ্রীষ্মকালে ভ্রমণকারীদিগের জন্য শরবৎ বিতরণের প্রথা ছিল।
গ্রীষ্মকালে বড়লোক এবং আমীরগণ ফল পাকিলে নিজেদের বৃক্ষবটিকা লুটাইয়া দিতেন। নির্দ্দিষ্ট দিবসে নির্দ্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রতিবাসী বালক-বালিকাদিগকে ফল পাড়িয়া লইবার জন্য সাদরে আহ্বান করা হইত। তখন সেই অসংখ্য বালক-বালিকার আনন্দ কোলাহলে ধাবন উল্লম্ফন ও বৃক্ষারোহণে যারপরনাই আমোদ বোধ হইত।
গ্রাণাডা নগর প্রস্তরনির্ম্মিত সুদৃঢ় প্রাচীরের দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। নগর প্রবেশের জন্য বিংশতিটী তোরণ ছিল। একহাজার ত্রিশটী সমুন্নত বুরুজ দ্বারা এই বিশাল প্রাচীর শোভিত হইয়াছিল। নগরের অধিকাংশ বাটী শ্বেতমর্ম্মর এবং রক্তপ্রস্তরে নির্ম্মিত ছিল। প্রত্যেক বাটীর সম্মুখেই সুচারু-দৃশ্য একটী করিয়া উদ্যান ছিল। নগরের রাস্তাগুলি ঋজু এবং প্রস্তরমণ্ডিত ছিল। প্রত্যেক রাস্তার পার্শ্বেই সুন্দর সুন্দর বহুসংখ্যক উৎস ছিল। অধিকাংশ বাটী অপূর্ব্ব ও অদ্ভূত কারুকার্য্যে শোভিত ছিল। নানা দেশীয় বিখ্যাত ভাস্করগণ আসিয়া গ্রাণাডার স্থানলাভ করিয়াছিলেন। তাহার ফলে গ্রাণডার গৃহ ও প্রাসাদাবলীর অঙ্গে অঙ্গে ভাস্করশিল্প ও কারুকৌশলের মহিমা অতি বিচিত্র ও বিপুলভাবে প্রকাশ পাইয়াছিল। বহু সংখ্যক মস্জিদের মিনার ও চূড়াগুলি উন্নতশিরে দণ্ডায়মান থাকিয়া বিপুল গাম্ভীর্য্য ও সৌন্দর্য্যে গ্রাণাডার গৌরব বৃদ্ধি করিয়াছিল। মস্জিদগুলি প্রায়শঃ রমণীয় উদ্যান কিংবা পুষ্করিণীর মধ্যদেশে স্থাপিত হইত। প্রত্যেক মসজিদের সংলগ্ন নিম্ন-বিদ্যালয় এবং পান্থশালা বিদ্যমান ছিল। কোনও কোনও পান্থশালা রাজপ্রাসাদ তুল্য রমণীয় এবং সর্ব্বপ্রকারে সুখকর ছিল।
গ্রাণাডার বক্ষ দিয়া কলনাদিনী দারো নদী প্রবাহিত থাকায় নগরের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য্য বিলক্ষণ বৃদ্ধি পাইয়াছিল। সমস্ত স্পেনের মধ্যে গ্রাণাডা সর্ব্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর নগরী ছিল।
গ্রাণাডার রাজপ্রাসাদ সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একট পরম রমণীয় দ্রষ্টব্য সৌধের মধ্যে গণ্য ছিল। জগতের নানা দেশীয় দুর্ল্লভ দ্রব্যসম্ভারে এই মহা প্রাসাদ সজ্জিত ছিল। বিশাল স্পেনসাম্রাজের ধ্বংস হওয়ায় নানা স্থানের শত শত মহাপণ্ডিত গ্রাণাডার এই রাজপ্রাসাদে স্থান প্রাপ্ত হইয়াছিলেন।
গ্রাণাডার সোলতানগণ সর্ব্বদাই জ্ঞানচর্চ্চায় লিপ্ত থাকিতেন। কোনও কোনও সোলতান প্রতি সপ্তাহেই পণ্ডিতমণ্ডলীকে একবার করিয়া ভোজ দিতেন। ভোজসভায় নানাবিষয়ের জ্ঞানগর্ভ সমালোচনা হইত।
ফলতঃ গ্রাণাডার রাজদরবার বিদ্যাচর্চ্চার বিপুলক্ষেত্র ও রাজপ্রাসাদ বিদ্বানমণ্ডলীর আশ্রয়স্থান ছিল। গ্রাণাডার যৌবন কালে ইহার লোকসংখ্যা যখন ৪ লক্ষের উপর ছিল, তখন বিভিন্ন বিষয়ে গ্রন্থরচনাকারী পণ্ডিতদিগের সংখ্যাই কেবল মাত্র গ্রাণাডাতেই এক সহস্রেরও অধিক ছিল। ইটালী, গ্রীস এবং ফ্রান্স ও কনষ্টাণ্টিনোপল হইতে খৃষ্টান ও ইহুদীদিগের জ্ঞানপিপাস্থ ছাত্রগণ কর্ডোভার ন্যায় এখানেও সমবেত হইতেন। নানা শ্রেণীর ধাতব শিল্প, বস্ত্র শিল্প, কার্য্যশিল্প এবং নৌ-গঠনপ্রণালী শিক্ষা করিবার জন্যও বহু বিজাতীয় যুবক গ্রাণাডায় আসিতেন। কার্ডোভার পতনের পরে গ্রাণাডায় জ্ঞান বিদ্যা এবং হেক্মতের যে অমৃতপ্রবাহ প্রবাহিত হইয়াছিল, সমগ্র ইউরোপ সেই প্রবাহ হইতেই আপনাদের পানপাত্র পূর্ণ করিয়া লইয়াছিল। ফলতঃ গ্রাণাডা এবং কর্ডোভা হইতে জ্ঞানবিদ্যার যে সঞ্জীবনী ধারা প্রবাহিত হইয়াছিল, ইউরোপে আজও সেই ধারাই শত শাখায় উচ্ছ্বসিত এবং উদ্বেলিত হইয়া খরতর ভাবে প্রবাহিত হইতেছে।