স্বপ্নলব্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস/অষ্টম পরিচ্ছেদ
ভারতবর্ষের বাণিজ্য চিরকালই অতি বিস্তৃত। পুরাবিদ্ ডাইওনিসিয়স্ বলিয়া গিয়াছেন, “ভারতবর্ষের পরম সুন্দর ও সুখসেব্য শিল্প এবং কৃষিজাত দ্রব্য সমূহের লোভে পৃথিবীর সকল জাতীয় লোকেই ভারত রাজ্যে বাণিজ্য করিতে ধাবমান হয়। এরূপ হওয়াতে সকল দেশের ধনরত্নই ঐ দেশে যাইয়া পড়ে এবং ভারতরাজ্য প্রকৃত রত্নাকর হইয়া উঠিয়াছে।” এক্ষণে আবার ঐ ভাব হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সিন্ধুমুখ হইতে কর্ণফুলির মুখ পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের যে সুবিস্তৃত সমুদ্রোপকূল, তাহার সর্ব্বস্থল বণিক্-পোতে সমাকীর্ণ। বণিক্ পোতের মধ্যে দশ আনা দেশীয় মহাজন দিগের, ছয় আনা মাত্র বিদেশীয়দিগের। কত টাকার আমদানি রপ্তানি হইতেছে তাহা এই বলিলেই বোধ হইবে যে, চীনীয়েরা এখান হইতে শুদ্ধ আফিম লইতেছে না, চা, এবং রেশমও লইয়া যাইতেছে। ইংরাজেরা এখান হইতে চীনে, ইজরি প্রভৃতি মোটা এবং ঢাকা প্রসূত সরু কাপড় সকল লইয়া যাইতেছে; ফরাসীরা লক্ষ্ণৌয়ের ছিট মহা যত্ন করিয়া স্বদেশে লইয়া যাইতেছে। অন্যান্য দ্রব্য যে কি পরিমাণে কত যাইতেছে তাহার ইয়ত্তা নাই। একবার একটী গোলযোগের উপক্রম হইয়া ছিল। তাহার উল্লেখ করিলে সাম্রাজ্যের বাণিজিকী ব্যবস্থা কিরূপ, তাহা কতক উপলব্ধ হইবে বলিয়া তাহার উল্লেখ করা যাইতেছে। ইংলণ্ড দেশে এক বার সূত্র প্রস্তুত করিবার এবং বস্ত্র বয়ন করিবার কলের উৎকর্ষ সাধন হইয়া গেলে, এক বৎসর ইংরাজ বণিকেরা কয়েকখানি জাহাজ বোঝাই করিয়া কার্পাস সূত্র এবং কাপড় পাঠাইয়া ছিল। ঐ সূত্র এবং বস্ত্র এখানে কিছু সস্তাদরে বিক্রীত হইয়া গেল। এই ব্যাপার ঘটিলে এখানকার তন্তুবায় সম্প্রদায় সম্রাটের নিকট এই বলিয়া আবেদন করে যে, বর্ষ কয়েকের নিমিত্ত ইংরাজি সুতা এবং কাপড়ের উপর অধিক পরিমাণে শুল্ক গৃহীত হউক, নচেৎ আমাদের ব্যবসায় মারা যায়। সম্রাট্ আজ্ঞা দিলেন যে, তিন বৎসর মাত্র শুল্ক গৃহীত হইবে। ইংরাজেরা ইহাতে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইল, এবং স্বাধীন বাণিজ্য প্রণালী যে যুক্তি সঙ্গত তাহা বিচার করিয়া বুঝাইবার নিমিত্ত সম্রাটের নিকট আপনাদিগের রাজদূত পাঠাইল।
বিচারে এই অবধারিত হইল যে, বার্ত্তা শাস্ত্রের নিয়ম সকল সমস্ত পৃথিবীকে একটী মহা সাম্রাজ্যরূপে জ্ঞান করিয়াই আবিষ্কৃত হইয়াছে। অতএব যতদিন পৃথিবীতে রাজ্যভেদ থাকিবে, ততদিন সম্পূর্ণরূপে ঐ সকল নিয়ম সর্ব্বত্র খাটিতে পারে না। তদ্ভিন্ন, ইতিহাস পর্য্যালোচনার দ্বারা ইহাও সপ্রমাণ হইল যে, যখন যে জাতির শিল্পদ্রব্য উৎকৃষ্ট এবং সুলভ মূল্যে প্রস্তুত হয়, তখনই সেই জাতি স্বার্থসিদ্ধি করিবার অভিপ্রায়ে ঐ শিল্পজাতের স্বাধীন বাণিজ্যের আকাঙ্ক্ষা করিয়া থাকে। অতএব স্বাধীন বাণিজ্যের নিয়মটী এমন নিয়ম নয় যে, দেশকালাদির অপ্রভেদে প্রচলিত থাকিতে পারে।
যাহা হউক ইংরাজী সূত্র বস্ত্রাদির উপর প্রথম বর্ষে যে শুল্ক নিরূপিত হইয়াছিল, দ্বিতীয় বর্ষে তাহার অৰ্দ্ধেক মাত্র রহিল, এবং তৃতীয় বর্ষে এখানকার তন্তুবায় সম্প্রদায় স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়াই শুল্ক উঠাইয়া দিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিল। তখন শুল্ক উঠিয়া গেলেও আর ইংরাজি সূত্র বস্ত্রাদি আমদানি হইতে পারিল না। তন্তুবায়েরা কল বসাইয়া এত সুলভ মূল্যে প্রস্তুত করিতেছে যে ইংরাজী বস্ত্র তাহা অপেক্ষা অধিক সুলভ মূল্যে বিক্রীত হইতে পারে না।
ফলতঃ সাম্রাজ্যের বাণিজিকী ব্যবস্থা এই মূল নিয়ম অবলম্বন করিয়া চলিতে লাগিল। শিল্পপ্রসূত যে সকল দ্রব্য এদেশে জন্মিতে পারে, তাহা ভিন্নরাজ্য হইতে আসিলেই প্রথম দুই এক বর্ষ তাহার উপর শুল্ক নিরূপিত হয়; অনন্তর ঐ দ্রব্য এখানে সুলভ মূল্যে প্রস্তুত হইলেই অমনি শুল্ক উঠাইয়া দিয়া বাণিজ্য স্বাধীন করিয়া দেওয়া হয়। মার্কিনেরা ভারতবর্ষের দৃষ্টান্তানুগামী হইয়া কোন কোন স্থলে আপনাদিগের শিল্প জাত সম্বৰ্দ্ধিত করিয়া লইতে পারিয়াছে।
বাণিজ্যের স্থূল নিয়ম এই। কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধান করিয়া দেখিলে বোধ হয়, যেন ভারত সম্রাট্ বাণিজ্য বিস্তার বিষয়ে তেমন ব্যগ্র নহেন। তাঁহার প্রধান মন্ত্রী একদিন সবিশেষ চিন্তাকুলিত হইয়াই বলিয়াছিলেন যে, যন্ত্রাদি যোগে শিল্প কার্য্যের বাহুল্য সাধন করায় যেমন উপকার হয়, তেমনি অপকারও হইয়া থাকে। দেশের মধ্যে কতকগুলি লোক আঢ্য হইয়া উঠে, কিন্তু অপর সকলে অন্নাভাবে হাহাকার করিতে থাকে। অতএব শিল্পকার্য্যের আধিক্য এবং উৎকর্ষ সাধন যেমন এক পক্ষে উপকারক, তেমনি পক্ষান্তরে প্রজাব্যুহের মধ্যে অর্থ সম্বন্ধীয় বিজাতীয় বৈসাদৃশ্য জন্মাইয়া দিয়া অপকারক হয়। এদেশে যদিও বংশমর্য্যাদানুযায়ী বর্ণভেদের প্রথা প্রচলিত থাকাতে এবং অত্যুদার আর্য্য শাস্ত্রের বিধিপালনে অভ্যাস বশতঃ জনগণ নিতান্ত পর দুঃখে কাতর হওয়াতে ঐ দোষ সম্যক্ অনিষ্ট সাধন করিতে পায় না, তথাপি অর্থ সম্বন্ধীয় তাদৃশ বৈসাদৃশ্য অনেক ভাবি অনিষ্টের হেতু হইতে পারে। মন্ত্রিবর এ কথাও বলেন যে, উপনিবেশ স্থাপনের দ্বারা কিয়ৎ পরিমাণে ঐ দোষের নিবারণ করা যাইতে পারে। কিন্তু তাহা বলিয়া যেখানে সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করিতে গিয়া পর জাতির লোকের প্রতি অত্যাচার করাও ত বিধেয় নহে।
যাহা হউক, মন্ত্রিবরের পরামর্শানুসারে সম্প্রতি এই ব্যবস্থা হইয়া গিয়াছে যে, ভারতবর্ষীয়েরা পরদেশে বাণিজ্য করিতে গিয়া সেই সেই দেশে কদাপি ভূম্যধিকার গ্রহণের চেষ্টা করিবে না। যে যে দেশে ধনস্পৃহা বশতঃ বাণিজ্য করিতে যাইবে, সেই দেশের ব্যবস্থার বশীভূত হইয়া চলিবে,—আর যে দ্বীপাদিতে মনুষ্যের বাস নাই অথবা নিতান্ত অল্প মনুষ্যের বাস সেই সেই দ্বীপ ভিন্ন অপর কোন স্থানে উপনিবেশ সংস্থাপন করিবে না। যদি উপনিবেশিত দ্বীপাদিতে ভিন্ন জাতীয় লোক থাকে, তবে তাহাদিগকে সংস্কারপূত করা এবং তাহাদিগের সহিত অনুলোম ক্রমে বৈবাহিক সম্বন্ধে সম্বদ্ধ হইয়া দেশটীকে সর্ব্বতোভাবে ভারতভূমির অনুরূপ করাই ঔপনিবেশিকদিগের পক্ষে বিধেয়। এখনও ভারতীয় উপনিবেশ অধিক নাই। আন্দামান, নিকোবর এবং মল্ল দ্বীপ পুঞ্জ উপনিবেশিত হইয়া গিয়াছে। সুমাত্রা, যব, বালি এবং সুখতর দ্বীপেও উপনিবেশের সঞ্চার আরম্ভ হইয়াছে।
ঔপনিবেশিকদিগের সম্রাটের নিকট কর দিতে হয় না, কিন্তু তাহাদিগের রক্ষার নিমিত্ত যে কয়েকখানি রণপোত থাকে, তাহার সম্পূর্ণ ব্যয় নির্ব্বাহ করিতে হয়।
ভারতবর্ষীয় ঔপনিবেশিকেরা চিরকাল ভারতভূমিকে মাতৃভূমি বলিয়া জানিবে। পশু শাবকের ন্যায় স্তন্য ত্যাগ করলেই প্রসূতিকে বিস্মৃত হইবে না।