স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/অমরনাথ

দশম পরিচ্ছেদ

অমরনাথ

 সময়: ১৮৯৮ খ্রীষ্টাব্দের ২৯শে জুলাই হইতে ৮ই আগষ্ট পর্য্যন্ত।

 স্থান: কাশ্মীর।

 ২৯শে জুলাই। এই সময় হইতে আমরা স্বামিজীকে খুব কমই দেখিতে পাইয়াছিলাম। তিনি তীর্থযাত্রা সম্বন্ধে খুব উৎসাহান্বিত ছিলেন, বেশীর ভাগ একাহারী হইয়া থাকিতেন এবং সাধুসঙ্গ ভিন্ন অন্য সঙ্গ বড় একটা চাহিতেন না। কোথাও তাঁবু খাটান হইলে কখনও কখনও তিনি মালাহস্তে তথায় আসিতেন। আজ রাত্রিতে আমাদের মধ্যে দুইজন বওয়ানের চতুর্দ্দিক ঘুরিয়া দেখিতে লাগিলেন। বওয়ান জায়গাটী একটী পল্লীগ্রামের মেলার মত—সমস্তটীর উপর একটি ধর্ম্মভাবের ছাপ রহিয়াছে, আর পুণ্য কুণ্ডগুলি ঐ ধর্ম্মভাবের কেন্দ্রস্বরূপ। ইহার পর আমরা ধীরা মাতার সহিত তাঁবুর দ্বারের নিকট গিয়া যে বহুসংখ্যক হিন্দীভাষী সাধু স্বামিজীকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিতেছিলেন, তাঁহাদের কথাবার্তা শুনিতে সক্ষম হইয়াছিলাম।

 বৃহস্পতিবারে আমরা পহলগামে পৌঁছিলাম; উপত্যকাটীর নিম্নপ্রান্তে আমাদের ছাউনী পড়িল। দেখিলাম যে, আমাদিগকে আদৌ ঢুকিতে দেওয়া হইবে কিনা তদ্বিষয়ে স্বামিজীকে গুরুতর আপত্তিসমূহ নিরাকরণ করিতে হইতেছে। নাগা সাধুগণ তাঁহাকে সমর্থন করিতেছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে একজন বলিলেন, “স্বামিজী, ইহা সত্য যে আপনার এই শক্তি আছে, কিন্তু আপনার ইহা প্রকাশ করা উচিত নহে!” বলিবামাত্র স্বামিজী চুপ করিয়া গেলেন। যাহা হউক, সেইদিন অপরাহ্ণে তিনি তাঁহার কন্যাকে আশীৰ্ব্বাদলাভে ধন্য হইবার জন্য ছাউনীর চারিধারে ঘুরাইয়া আনিলেন—প্রকৃতপক্ষে উহা ভিক্ষাবিতরণ ভিন্ন আর কিছুই ছিল না। আর, লোকে তাঁহাকে ধনী ঠাওরাইয়াছিল, বলিয়াই হউক অথবা তাঁহাকে শক্তিমান বলিয়া বুঝিয়া লইয়াছিল বলিয়াই হউক, পরদিবস আমাদের তাঁবুটী ছাউনীর পুরোভাগে একটী মনোহর পাহাড়ের উপর সরাইয়া লইয়া যাওয়া হইয়াছিল। সেখানে আমাদের ঠিক সম্মুখে খরস্রোতা লিডার নদী ও অপরতীরে পাইনু বৃক্ষাচ্ছাদিত পর্বতমালা বর্ত্তমান ছিল এবং খুব উচ্চে একটী রন্ধ্রের অপর পারে একটী তুষারবর্ত্ম স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। এই গোপগণের গ্রামে আমরা একাদশী করিবার জন্য পুরা একদিবস অবস্থান করিলাম। পরদিন প্রত্যূষে যাত্রিগণ রওয়ানা হইল।

 ৩০শে জুলাই। প্রাতে ছয়টার সময় আমরা প্রাতরাশ সমাপ্ত করিয়া যাত্রা করিলাম। কখন ছাউনীটী স্থানান্তরিত হইতে আরম্ভ করিয়াছিল তাহা আমরা অনুমান করিতে পারিলাম না। কারণ আমরা যখন খুব প্রত্যূষে জলযোগ করি তখনই অতি অল্পসংখ্যক যাত্রী বা তাঁবু অবশিষ্ট ছিল। কল্য যে স্থানে সহস্র লোক এবং তাহাদের পটনিবাস ব্যিমান ছিল, সেখানে গতপ্রাণ অগ্নিসমূহের ভন্মরাশি মাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে।

 পরবর্তী বিশ্রামস্থান চন্দনবাড়ী যাইবার রাস্তাটা কি সুন্দর! চন্দনবাড়ীর আমরা একটা গভীর গিরিবর্ত্মের কিনারায় ছাউনী ফেলিলাম। সমস্ত বৈকালবেলা ধরিয়া বৃষ্টি হইয়াছে এবং স্বামিজী মাত্র পাঁচ মিনিটের কথাবার্ত্তার জন্য আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছিলেন। কিন্তু আমি ভৃত্যগণের এবং অন্যান্য যাত্রিগণের নিকট হইতে অনেক ছোটখাট বিষয়ে যে অশেষ সদয় ব্যবহার পাইয়াছিলাম, তাহা বড়ই মৰ্ম্মস্পর্শী; দুই পশলা বৃষ্টির মধ্যের অবকাশটিতে আমি গাছপালা-সংগ্রহের চেষ্টায় বাহির হইলাম এবং সতি আট রকমের Myesotis দেখিতে পাইলাম; তাহাদের মধ্যে দুইটি আমার নিকট নূতন। তৎপরে আমি আমার ফার গাছটির ছায়ায় ভিরিয়া যাইলাম, উহা হইতে তখনও বারিকণা টপ্‌, টপ্‌, করিয়া পড়িতেছে।

 দ্বিতীয় চটির রাস্তাটি অন্য সব চটির রাস্তা অপেক্ষা কঠিন ছিল। মনে হইতেছিল বুঝি উহা অফুরন্ত। চন্দনবাড়ীর সন্নিকটে স্বামিজী জেদ করিলেন যে, “ইহাই আমার প্রথম তুষারবর্ত্ম বলিয়া আমাকে উহা খালি পায় অতিক্রম করিতে হইবে।” জ্ঞাতব্য প্রত্যেক খুঁটিনাটীটির উল্লেখ করিতে তিনি ভুলিলেন না। ইহার পরেই এক বহুসহস্রফিটব্যাপী বিকট চড়াই আমাদের ভাগ্যে পড়িল। তারপর এক সরু পথ, পাহাড়ের পর পাহাড় ঘুরিয়া আঁকিয়া বাকিয়া চলিয়াছে; সেই দীর্ঘ পথ ধরিয়া চলিলাম; এবং সর্ব্বশেষে আর একটি খাড়া চড়াই। প্রথম পর্ব্বতটির উপরিভাগের জমিটিকে একজাতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাস (Edelweiss) ঠিক যেন গালিচা দিয়া মুড়িয়া রাখিয়াছে। তৎপরে রাস্তাটি শেষনাগ হইতে পাঁচশত ফিট উচ্চ দিয়া চলিয়াছে। শেষনাগের জল গতিহীন। অবশেষে আমরা তুষারমণ্ডিত শিখরগুলির মধ্যে ১৮০০০ ফিট উচ্চে এক ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে জায়গায় ছাউনী ফেলিলাম। ফার্‌গাছগুলি বহু নিম্নে ছিল, সুতরাং সারা বৈকাল ও সন্ধ্যাবেলা কুলিরা চারিদিক হইতে জুনিপার গাছ সংগ্রহ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। স্থানীয় তহসীলদারের, স্বামিজীর এবং আমার তাঁবুগুলি খুব কাছাকাছি ছিল এবং সন্ধ্যাবেলায় সম্মুখভাগে এক বৃহৎ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হইল। কিন্তু উহা ভাল জ্বলিল না, আবার তুষারবর্ত্মটিও বহু ফিট নিম্নেবিদ্যমান ছিল। আমাদের ছাউনী পড়িবার পর আমি আর স্বামিজীকে দেখি নাই।

 পাঁচটি তটিনীর সম্মিলনস্থল পঞ্চতরণী যাইবার রাস্তা এতটা দীর্ঘ ছিল না। অধিকন্তু ইহা শেষনাগ অপেক্ষা নীচু ছিল এবং এখানকার ঠাণ্ডাও বেশ শুষ্ক ও প্রীতিপ্রদ ছিল। ছাউনির সম্মুখে এক কঙ্করময় শুষ্ক নদীগর্ভ, উহার মধ্য দিয়া পাঁচটি তটিনী চলিয়াছে। ইহাদের সকলগুলিতেই একটির পর অপরটিতে ভিজা কাপড়ে হাঁটিয়া গিয়া যাত্রিগণের স্নান করার বিধি। সম্পূর্ণরূপে লোকের নজর এড়াইয়া স্বামিজী কিন্তু এবিষয়ক আইনটি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়াছিলেন।

 আহা, কি সুন্দর সুন্দর ফুল! পূর্ব্ব রজনীতে, (না অদ্যকার রাত্রে?) বড় বড় নীল ও সাদা Anemone ফুল আমার তাঁবুতে বিছানার নীচে জন্মিয়াছে এবং এখানে অপরাহ্রে নিকট হইতে তুষারাবর্ত্ম দেখিবার জন্য বেড়াইতে বেড়াইতে দূরে চলিয়া গিয়া আমি Gentian, Sedum, Saxifrage এবং ক্ষুদ্র শ্বেতবর্ণ সলোম পত্রবিশিষ্ট এক নূতন রকমের ফর্‌গেট-মি-নট্‌ ফুল দেখিলাম, ঘন-সন্নিবিষ্ট পাতাগুলি রাশীকৃত মখমলের মত দেখাইতেছিল। এমন কি জুনিপারও এস্থানে অতি বিরল ছিল।

 এই সকল উচ্চ অংশে আমরা প্রায়ই দেখিতাম যে, আমরা তুষার-শৃঙ্গরাজির মহান্ পরিধিসমূহের মধ্যে রহিয়াছি—এই নির্ব্বাক বিপুলায়তন পৰ্ব্বতগুলিই হিন্দুমনে ভস্মানুলিপ্ত ভগবান শঙ্করের ভাব উদ্রেক করিয়া দিয়াছে।

 ২রা আগষ্ট। ২রা আগষ্ট মঙ্গলবারে অমরনাথের সেই মহোৎসব দিনে প্রথম যাত্রিদল নিশ্চয়ই রাত্রি দুইটার সময় ছাউনী হইতে যাত্রা করিয়া থাকিবে। আমরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নালোকে যাত্রা করিলাম। সঙ্কীর্ণ উপত্যকাটিতে পৌঁছিলে সূর্য্যোদয় হইল। রাস্তার এই অংশটিতে গতারাত যে খুব নিরাপদ ছিল, তা নয়। কিন্তু যখন আমরা ডাণ্ডি ছাড়িয়া চড়াই করিতে আরম্ভ করিলাম, তখনই প্রকৃত বিপদের সূত্রপাত হইল। অজাযূথের গতিবিধি-পথের মত একটী ‘পগ্, ডাণ্ডী’ প্রায় খাড়া পাহাড়ের গা দিয়া উঠিয়া অপর পার্শ্বে—উতারের অংশে—শ শষ্পাচ্ছাদিত জমির উপর একটী ক্ষুদ্র সোপানপরম্পরায় পরিণত হইয়াছিল। প্রত্যেক দু'চার পা অন্তর কমনীয় কলাম্বাইন, মাইকেলমাস ডেজি এবং বন্য গোলাপ ফুটিয়া রহিয়াছিল এবং ভয় হইতেছিল পাছে লোকে উহাদিগকে সংগ্রহ করিবার লোভে হাত পা ভাঙ্গে বা প্রাণ খোয়াইয়া বসে! পরে কোনমতে ওপারের উতারটীর তলদেশে পৌঁছিয়া আমাদিগকে অমরনাথের গুহা পর্য্যন্ত ক্রোশের পর ক্রোশ তুষারবর্ত্মের উপর দিয়া বহুকষ্টে যাইতে হইয়াছিল। আমাদের গন্তব্যস্থানের মাইল খানেক আগে বরফ শেষ হইল এবং উহা হইতে যে জলধারা প্রবাহিত হইয়াছিল তাহাতে যাত্রিগণকে স্নান করিতে হইয়াছিল। এমন কি, যখন আমরা প্রায় পৌঁছিয়া গিয়াছি বলিয়াই বোধ হইতেছিল তখনও পর্যন্ত আমাদের পাথরের উপর দিয়া আরও একটী বেশ কঠিন চড়াই করিতে বাকি ছিল!

 স্বামিজী ক্লান্ত হইয়া ইতোমধ্যে পিছনে পড়িয়াছিলেন, কিন্তু আমি, তিনি যে পীড়িত হইতে পারেন তাহা মনে থাকায়, কঙ্করস্তূপগুলির অধোভাগে তাঁহার আগমন-প্রতীক্ষায় বসিয়া রহিলাম। অনেক বিলম্বে তিনি আসিয়া পৌঁছিলেন এবং “স্নান করিতে যাইতেছি” মাত্র এই কথা বলিয়া আমাকে অগ্রসর হইতে বলিলেন। অর্দ্ধঘণ্টা পরে তিনি গুহামধ্যে প্রবেশ করিলেন। সস্মিতবদনে তিনি প্রথমে অর্দ্ধবৃত্তটীর এক প্রান্তে, পরে অপর প্রান্তটীতে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিলেন। স্থানটী বিশাল ছিল, এত বড় যে তথায় একটা গির্জা ধরিতে পারে এবং বৃহৎ তুষারময় শিবলিঙ্গটী প্রগাঢ়চ্ছায় এক গহ্বরে অবস্থিত থাকায় যেন নিজ সিংহাসনেই অধিরূঢ় বলিয়া মনে হইতেছিল। কয়েক মিনিট কাটিয়া যাইবার পর তিনি গুহা ত্যাগ করিবার উদ্যোগ করিলেন।

 তাঁহার চক্ষে যেন স্বর্গের দ্বারসমূহ উদঘাটিত হইয়াছে! তিনি সদাশিবের শ্রীপাদপদ্ম স্পর্শ করিয়াছেন। তিনি পরে বলিয়াছিলেন যে, পাছে তিনি ‘মূর্ছিত হইয়া পড়েন’ এইজন্য নিজেকে কসিয়া ধরিয়া রাখিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহার দৈহিক ক্লান্তি এত অধিক হইয়াছিল যে, জনৈক ডাক্তার পরে বলিয়াছিলেন তাঁহার হৃৎপিণ্ডের গতিরোধ হইবার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু তৎপরিবর্ত্তে উহা চিরদিনের মত বৰ্দ্ধিতায়তন হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার গুরুদেবের সেই কথাগুলি কি অদ্ভুতভাবে পূর্ণপ্রায় হইয়াছিল—“ও যখন নিজেকে জান্‌তে পার্‌বে, তখন আর এ শরীর রাখ্‌বে না।”

 আধঘণ্টা পরে নদীর ধারে একখানি পাথরের উপর বসিয়া সেই সদয়হৃদয় নাগা সন্ন্যাসী এবং আমার সহিত জলযোগ করিতে করিতে স্বামিজী বলিলেন, “আমি কি আনন্দই উপভোগ করিয়াছি! আমার মনে হইতেছিল যে তুষারলিঙ্গটা সাক্ষাৎ শিব। আর তথায় কোন বিত্তাপহারী ব্রাহ্মণ ছিল না, কোন ব্যবসায় ছিল না, কোন কিছু খারাপ ছিল না। সেখানে কেবল নিরবচ্ছিন্ন পূজার ভারই ছিল। আর কোন তীর্থক্ষেত্রেই আমি এত আনন্দ উপভোগ করি নাই!”

 পরে তিনি প্রায়ই আমাদিগকে তাঁহার সেই চিত্তবিহ্বলকারী দর্শনের কথা বলিতেন; উহা যেন তাঁহাকে একেবারে স্বীয় ঘূর্ণাবর্ত্তের মধ্যে টানিয়া লইবে বলিয়া বোধ হইয়াছিল। তিনি শ্বেত তুষারলিঙ্গটির কবিত্বের বর্ণনা করিতেন এবং তিনিই ইঙ্গিত করিলেন, একদল মেষপালকই উক্ত স্থানটি প্রথম আবিষ্কার করিয়াছে। তাহারা কোন এক নিদাঘ দিবসে নিজ নিজ মেষযূথের সন্ধানে বহুদূর গিয়া পড়িয়াছিল ও এই গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিয়াছিল যে তাহারা অদ্রতুষাররূপী সাক্ষাৎ শ্রীভগবানের সান্নিধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। তিনি সর্ব্বদা ইহাও বলিতেন, “সেইখানেই অমরনাথ আমাকে ইচ্ছামৃত্যু বর দিয়াছেন।” আর আমাকে তিনি বলিলেন, “তুমি এক্ষণে বুঝিতেছ না। কিন্তু তোমার তীর্থযাত্রাটি সম্পন্ন হইয়াছে এবং ইহার ফলকে ফলিতেই হইবে। কারণ থাকিলেই কাৰ্য্য হইবে নিশ্চিত। তুমি পরে আরও ভাল করিয়া বুঝিতে পারিবে। ফল অবশ্যম্ভাবী।

 পরদিন প্রাতঃকালে আমরা যে রাস্তা দিয়া পহলগামে প্রত্যাবর্ত্তন করিলাম উহা কি সুন্দর রাস্তা! সেই রজনীতে তাঁবুতে ফিরিয়া আমরা তাঁবু উঠাইলাম এবং অনেক পরে পুরা এক চটিভর রাস্তা চলিয়া একটি তুষারময় গিরিসঙ্কটে রাত্রির জন্য ছাউনী ফেলিলাম। এইখানে আমরা একজন কুলীকে কয়েক আনা পয়সা দিয়া একখানি চিঠি লইয়া আগে পাঠাইয়া দিয়াছিলাম, কিন্তু পরদিন মধ্যাহ্নে পৌঁছিয়া দেখিলাম যে ইহার কোনই প্রয়োজন ছিল না। কারণ সমস্ত প্রাতঃকাল ধরিয়া যাত্রিগণ দলে দলে আমাদের তাঁবুর নিকট দিয়া যাইবার সময় নিতান্ত বন্ধুভাবে, অপর সকলকে আমাদের সংবাদ দিবার জন্য এবং আমরা যে খুব শীঘ্রই আসিতেছি এই কথা জানাইবার জন্য আমাদের তত্ত্ব লইয়া যাইতেছিল। প্রাতঃকালে সূর্য্যোদয়ের বহু পূর্ব্বেই আমরা গাত্রোত্থান করিয়া পথ চলিতে আরম্ভ করিলাম। সম্মুখে সূর্য্য উদিত হইতেছেন এবং পশ্চাতে চন্দ্র অস্ত যাইতেছেন, এমন সময়ে আমরা হতিয়ার তলাও (Lake of Death) নামক হ্রদের উপরিভাগের রাস্তা দিয়া চলিতে লাগিলাম। এই সেই হ্রদ—যাহাতে এক বৎসর প্রায় চল্লিশ জন যাত্রী তাহাদেরই স্তোত্রপাঠের কম্পনে স্থানচ্যুত একটি তুষার প্রবাহ (avalanche) কর্তৃক সবেগে নিক্ষিপ্ত হইয়া নিধনপ্রাপ্ত হইয়াছিল! একটি ক্ষুদ্র পাগ্‌ডাণ্ডী খাড়া পাহাড়ের গা দিয়া নীচে নামিয়াছে। অতঃপর আমরা তথায় উপস্থিত হইলাম এবং ঐপথে চলিয়া দূরত্বের যথেষ্ট লাঘব করিতে সমর্থ হইরাছিলাম। ইহা এক প্রকার হামাগুড়ি দিয়া যাওয়ারই কাছাকাছি ছিল এবং সকলকেই উহা পায়ে হাঁটিয়া অতিক্রম করিতে হইয়াছিল। উহার তলদেশে গ্রামবাসিগণ প্রাতে জলযোগের মতন একটা কিছু প্রস্তুত রাখিয়াছিল। স্থানে স্থানে অগ্নি প্রজ্বলিত হইয়াছিল, চাপাটি সেঁকা হইতেছিল এবং চা-ও প্রস্তুত ছিল, শুধু ঢালিলেই হইল। এখন হইতে যেখানে যেখানে রাস্তা পৃথক্‌ হইয়া গিয়াছে সেইখানেই যাত্রিগণ দলে দলে মুখ্য দল হইতে পৃথক্‌ হইয়া যাইতে লাগিল এবং এই সারা পথ ধরিয়া আমাদের মধ্যেযে একটি একত্বের ভাব জন্মিয়াছিল তাহা ক্রমশঃ অল্প হইতেঅল্পতর হইতে লাগিল।

 সেই দিন সন্ধ্যার সময় পহলগামের উপরিভাগে আমরা এক গোল পাহাড়ের উপর পাইন্‌ কাঠের এক বৃহৎ অগ্নি প্রজ্বালিত করিয়া এবং সতরঞ্জি বিছাইয়া গল্প করিতে লাগিলাম। আমাদের বন্ধু সেই নাগা সন্ন্যাসীটি আমাদের সহিত যোগ দিলেন এবংযথেষ্ট কৌতুকপরিহাসাদি চলিতে লাগিল। কিন্তু শীঘ্রই আমাদের ক্ষুদ্র দলটি ব্যতীত আর সকলে চলিয়া গেল। আর আমরা বসিয়া—উপরে চন্দ্রদেব হাসিতেছেন, তুষারশৃঙ্গগুলি মাথা তুলিয়াদাঁড়াইয়া, নদী খরবেগে প্রবাহিত এবং চারিদিকে অসংখ্য পাৰ্ব্বত্য পাইন্‌ বৃক্ষ—এই সব দৃশ্য উপভোগ করিতে লাগিলাম।

 ৮ই আগষ্ট। পরদিন আমরা ইসলামাবাদ যাত্রা করিলাম এবং সোমবার প্রভাতে প্রাতঃকালীন জলযোগে বসিয়াছি, এমন সময়ে মাঝিরা গুণ টানিয়া নৌকাগুলি নিরাপদে শ্রীনগরে আনিয়া লাগাইয়া দিল।