স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে/পূর্ব্বভাষ

স্বামিজীর সহিত হিমালয়ে

পূর্ব্বভাষ

ব্যক্তিগণ— শ্রীমৎ স্বামী বিবেকানন্দ, তদীয় গুরুভ্রাতৃবৃন্দ এবং শিষ্যমণ্ডলী। কতিপয় পাশ্চাত্য অভ্যাগত এবং শিষ্য-ধীরা মাতা, জয়া নাম্নী এক মহিলা ও নিবেদিতা তাঁহাদের অন্যতম।
স্থান—ভারতের বিভিন্ন অংশ।
সময়—সন ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দ।

 এ বৎসর দিনগুলি কি সুন্দর ভাবেই না কাটিয়াছে! এই দিনেই যে আদর্শ বাস্তবে পরিণত হইয়াছে! প্রথমে নদীতীরে বেলুড়ের কুটীরে, তারপর হিমালয়-বক্ষে নৈনীতাল ও আলমোড়ায়, পরিশেষে কাশ্মীরে নানা স্থানে পরিভ্রমণকালে—সর্ব্বত্রই এমন সব সময় আসিয়াছিল যাহা কখনো ভুলিবার নয়, এমন সব কথা শুনিয়াছি যাহা আমাদের সারা জীবন ধরিয়া প্রতিধ্বনিত হইতে থাকিবে। আর অন্ততঃ জাগরূক থাকিবে বারেকের লব্ধ ও সেই চকিত দিব্য দর্শন!

 সে সবই যেন একটা খেলা!

 এমন এক প্রেমের বিকাশ আমরা দেখিয়াছি যে প্রেম ক্ষুদ্র হইতে ক্ষুদ্রকেও, অজ্ঞান হইতে অজ্ঞানকেও আলিঙ্গন করিয়া এক হইয়া যায় এবং তাহারই দৃষ্টিতে তখন সমস্ত জগৎকে দেখে, যেন তাহাতে কোনরূপ প্রতিবাদ করিবার কিছুই নাই।

 বিরাট প্রতিভার বিশাল খেয়ালে আমরা কৌতুক করিয়াছি, বীরত্বের উচ্ছ্বাসে উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছি—এ সমস্ত দিব্য লীলায় মনে হয় যেন বালরূপী ভগবান তাঁহার শিশুশয্যা হইতে জাগিতেছেন, আর আমরা দাঁড়াইয়া সাক্ষিস্বরূপ নিরীক্ষণ করিয়াছি!

 কিন্তু ইহাতে কোনরূপ মানসিক উগ্রতা বা কঠোর গাম্ভীর্ঘ্যের ভাব ছিল না। দুঃখ আমাদের সকলেরই কাছ ঘেঁসিয়া গিয়াছে। অতীতের কত শোকস্মৃতি আসিয়া চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু সে দুঃখও ঊর্দ্ধশিখ হইয়া হেম-জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হইত, দীপ্তিতে মণ্ডিত হইত, তাহাতে কোনরূপ দাহ থাকিত না।

 যদি সে ক্ষমতা আমার থাকিত, মহা উল্লাসে আমি সে ভ্রমণ-কাহিনী বর্ণন করিতাম। তবু আজ সে কথা লিখিতে লিখিতে যেন দেখিতেছি বারামুল্লায় সেই প্রস্ফুটিত প্রফুল্ল আইরিস কুসুম-সকল; দেখিতেছি ইস্‌লামাবাদে সফেদ্‌ (poplar)-তরুতলে তরুণ চারা ধানগাছগুলি; দেখিতেছি নক্ষত্রালোকিত হিমাচল-অরণ্যানীর দৃশ্যাবলী; আর দেখিতেছি দিল্লী এবং তাজের রাজভোগ্য সৌন্দর্য্যরাশি। স্মৃতির এই সকল নিদর্শন বর্ণনা করিতে কাহার না আগ্রহ হয়! কিন্তু বর্ণনায় উহা বিবর্ণ হইয়া উঠিবে—কেন না সে যে অসম্ভব! তাই স্মৃতির আলেখ্যে নয়, স্মৃতির আলোকেই তাহাদের অক্ষয় পুণ্যপ্রতিষ্ঠা। আর সেই প্রতিষ্ঠায় চিরসংযুক্ত হইয়া বিদ্যমান থাকিবে তথাকার কোমল হৃদয় শান্তপ্রকৃতি অধিবাসিবৃন্দ, যাহাদের আনন্দ, মনে হয়, আমাদের আগমনে আমাদের সংশ্রবে আসিবার ফলে আরও ঘনীভূত হইয়া বিরাজ করিবে।

 কিরূপ মানসিক অবস্থায় নুতন নুতন ধর্ম-বিশ্বাস প্রসূত হয় এবং কীদৃশ মহাপুরুষেরা এইরূপ ধর্ম্ম-বিশ্বাস সঞ্চারিত করেন―আমরা সে বিষয় কতকটা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। কারণ আমরা এরূপ এক মহাপুরুষের সঙ্গলাভ করিয়াছি। তিনি সকল রকম লোককেই নিজের কাছে আকর্ষণ করিতেন, সকলের বক্তব্য শুনিতেন, প্রত্যেকের সঙ্গে সহানুভূতি করিতেন, কাহাকেও প্রত্যা খ্যান করেন নাই। যে দীনতার কাছে সকল দৈন্য দূরীভূত হয়, যে ত্যাগ অত্যাচারীর প্রতি প্রচণ্ড ধিক্কারে এবং উৎপীড়িতের জন্য অসীম করুণায় আত্মবলিদানে উন্মুখ, যে প্রেম তীব্র উৎপীড়ন এবং মৃত্যুর আসন্ন পদসঞ্চারকেও আশিস্-বচনে স্বাগত-সম্ভাষণ করে—সে দীনতা, সে ত্যাগ, সে প্রেম আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। যিনি নয়নজলে শ্রীভগবানের চরণযুগল অভিষিক্ত করিয়াছিলেন এবং স্বীয় কেশদামে সেই অভিষিক্ত চরণ আবার মুছাইয়া দিয়াছিলেন, সেই সৌভাগ্যবতীর[] পুণ্যব্রতের আমরাও অনুষ্ঠান করিয়াছি। এই অবসর আমরা পাইয়াছিলাম সত্য, কিন্তু তাঁহার সেই ভাব-বিহ্বল আত্মবিস্মৃতি কোথায় পাইব!

 মৃত বাদশাহগণের উদ্যানের এক বৃক্ষতলে বসিয়া আমরা যেন দেখিতে পাইলাম―মর্ত্যের মূল্যবান যাবতীয় চমৎকার দ্রব্য- সম্ভার অনাহূত আসিয়া অধ্যাত্মবীরের স্মৃতিমন্দিরের উপাদানে পরিণত হইবার জন্য আপনাদিগকে উৎসর্গ করিতেছে। গীর্জার আলেখ্যাকারে আখ্যানচিত্রিত বাতায়ন, রাজন্যবর্গের মণিময় সিংহাসন, বীর যোদ্ধৃবৃন্দের ধ্বজপতাকা, যাজকগণের বিচিত্র অঙ্গাভরণ, নগরীর বিপুল সাজসজ্জা এবং প্রমত্ত দাম্ভিককুলের হর্ম্মাবলী—একে একে সকলেই আসিল, সকলেই প্রত্যাখ্যাত হইল।

 বিদেশীর উপহাসস্থল কিন্তু দেশবাসীর পূজাম্পদ ভিক্ষুকের বেশে তাঁহাকে আমরা দেখিয়াছি; তাই মনে হয়, শ্রমলব্ধ জীবিকা, সামান্য কুটীরে বাস এবং শস্যক্ষেত্রবাহী সাধারণ পথ—কেবল এই সমস্ত পারিপার্শ্বিক দৃশ্যপটের মধ্যেই এমন জীবনের প্রকৃত শোভা ফুটিতে পারে।

 তাঁহার স্বদেশবাসী বিদ্বান, রাষ্ট্রনীতি-বিশারদ পণ্ডিতমণ্ডলী তাঁহাকে যেমন ভালবাসিতেন, নিরক্ষর অজ্ঞেরাও তাঁহাকে তেমনি ভালবাসিত। তাঁহার নৌকার মাঝি-মাল্লারা, কতক্ষণে তিনি আবার নৌকায় ফিরিয়া আসিবেন, পথ চাহিয়া থাকিত। যে গৃহে তিনি অতিথি হইতেন, সেই গৃহের পরিচারক ভৃত্যদের মধ্যে কে আগে তাঁহার সেবা করিবে, কাড়াকাড়ি পড়িয়া যাইত। আর এই সকল ব্যাপার সর্ব্বদাই যেন একটা খেলার আবরণে জড়িত থাকিত। ‘তাহারা যে ভগবানের খেলার সঙ্গী’—এই ভাব তাহাদের মনে স্বতঃই জাগরূক থাকিত।

 যাহারা এরূপ শুভমুহূর্ত্তের আস্বাদ পাইয়াছেন, জীবন তাঁহাদের নিকট অধিকতর মূল্যবান, অধিকতর মধুময়। দীর্ঘ নিরানন্দ রজনীর তালবন-সঞ্চারী বায়ুও উদ্বেগ ও আশঙ্কার পরিবর্ত্তে তাঁহাদের কর্ণে শান্তিময় ‘শিব! শিব!’ বাণী ধ্বনিত করিয়া তোলে।

  1. Mary Magdalene