স্রোতের গতি/ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
মাসীমার চিঠি
বাগানের অপর অংশে পাশাপাশি তিনখানি ঘর। এ ঘরগুলি বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত কখনো ব্যবহৃত হয় না। নির্জ্জনতা-প্রিয় রণেন্দ্রের সুবিধা বুঝিয়া মীনা এই ঘরগুলি ঝাড়িয়া মুছিয়া তাহার ব্যবহারের উপযোগী করিয়া তুলিয়াছিল। সাম্নের বড় ঘরখানি টেবিল চেয়ার দিয়া বসিবার জন্য নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল, পাশের ছোট দুইখানি শয়নের ও পরিচ্ছদাদি রাখিবার জন্য যথাযোগ্যভাবে সাজান হইয়াছিল। ইহাতে রণেন্দ্রর সুবিধা হইলেও, অমিয়ার পক্ষে বিশেষ অসুবিধা ঘটিল। ঘরের সম্মুখেই বাগান, এই বাগানে খোকার সহিত খেলা করিয়া, গাছে-টাঙ্গান দড়ির দোলায় শুইয়া বই পড়িয়া, কত সময় অকারণ ঘুরিয়া বেড়াইয়া তাহার দিবসের তৃতীয়াংশ কাল আনন্দেই কাটিয়া গিয়াছে; ইহাকে বাদ দিতে হইলে এখানকার সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয়-অংশটুকুই তাহার বাদ পড়িয়া যায়। রণেন্দ্রের বসিবার ঘরের যে বড় জানালা দু’টি বাগানের দিকে মুখ রাখিয়া তাহাদের বক্ষ-কবাট্ মুক্ত রাখিতে বাধ্য হয়, আর সেই দ্বারপথে সময় সময় যে নারীদ্বেষী যুবকের বিরক্ত দৃষ্টি অনিচ্ছাতেও এদিকে পতিত হয়, তাহার লক্ষ্য হইতে কোন নারীরই বোধ করি কখন প্রবৃত্তি থাকে না? প্রথম যেদিন অমিয়ার আবির্ভাবে খোলা জানালাটি তাহাকে সচকিত করিয়া সশব্দে বন্ধ হইয়া গেল, সেদিন অপ্রিয় দৃষ্টির বিষয়ীভূত না হওয়ার আনন্দলাভের পরিবর্ত্তে কেনই যে অপমানের তীব্র ব্যথায় অমিয়ার সারা চিত্ত ব্যথিত হইয়া উঠিল, তাহা সেও বলিতে পারিত না।
পর্দ্দা না রাখিয়া একবাড়ীতে বাস করিতে হইলে বাড়ীর সব কয়টি লোকের সঙ্গে চোখোচাখি হইয়াই থাকে। খোকার উপলক্ষে রণেন্দ্রের সহিত দু’চারটি কথাও সে কহিয়াছে। এই লোকটির সম্বন্ধে সে যে কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল, বাস্তবের সহিত তাহার কোন মিল দেখা না যাওয়ায় নিজের ভুল-ধারণার জন্য সে যেন মনে মনে একটুখানি লজ্জিতই হইয়াছিল। লোকটিকে দেখিয়া চক্ষুপীড়াউৎপাদক বলিয়া তাহার মনে হয় নাই। তাহার হাবভাব চালচলন কথা কহিবার পদ্ধতি―সবই সংযত সুভদ্র বলিয়াই সে মানিয়া লইয়াছিল। তবু মীনার সহিত কথা কহিবার সময় তাঁহার মনের বিষ সময় সময় এমন তীব্র ও তীক্ষ্ণ মন্তব্যরূপে ঠোঁটের বাহিরে আসিয়া পড়িত, যাহা কোন নারীর পক্ষেই বীণাধ্বনিবৎ প্রতীয়মান হইতে পারে না অন্ততঃ অমিয়ার ত হয় নাই।
পুরুষের প্রতি স্বাভাবিক তাচ্ছিল্যে সে কখনও কোন পুরুষের স্তুতি-নিন্দার প্রতি লক্ষ্য রাখে নাই সত্য, কে তাহাকে কি ভাবে দেখিতেছে ইহা জানিবার ইচ্ছা বা আগ্রহও তাহার কোনদিন জন্মে নাই। কিন্তু সে যে সুন্দরী, এ খবর তাহার নিজের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। সৌন্দর্য্যের পূজা পাইবার যে স্বাভাবিক ইচ্ছা বা দাবী এতদিন তাহার মনের নিভৃত প্রদেশে গোপনে লুকাইয়াছিল, তাহাকে প্রশ্রয় না দিলেও, আশ্রয় দিতে সে অনিচ্ছুক ছিল না। সখী-সঙ্গিনীদের মুখে নিজ রূপের প্রশংসা সে চিরদিনই শুনিয়া আসিতেছে―এ স্তুতি সে তাহার অবশ্যপ্রাপ্য হিসাবে অবহেলাতেই গ্রহণ করিয়া থাকে। তাই রণেন্দ্রের এই তীব্র তাচ্ছিল্য তাহাকে শুধু অপমানিত নয়, পীড়িতও করিল। মনে হইল, সে কি এতই কুরূপা যে চোখে দেখাও সহা যায় না? এমন তীব্র বিদ্বেষ সেও ত কৈ কোন সম্প্রদায়-বিশেষের প্রতি পোষণ করে না। অভিমানে আঘাত লাগায় নিজকে সে ভুল বুঝাইল। রণেন্দ্র যদি ঠিক্ এমন ব্যবহার না করিয়া অন্য কোনরূপ কিছু করিত, তবে সেই হয়ত তাহাকে অভদ্র আখ্যানে আখ্যাত করিতে ছাড়িত না। অন্যায় যে কোথায় তাহা ধরা পড়িতেছিল না বলিয়াই বিরক্তি বাড়িতেছিল। মনে হইতেছিল, এই লোকটিকে হার মানানই যেন তাহার এখনকার অবশ্য কর্ত্তব্য।
নারী যে সত্যই ঘৃণা বা অবজ্ঞার পাত্রী নহে, ঐ রণেন্দ্রই একদিন স্বেচ্ছায় ইহা স্বীকার করিবে―তবে তাহার অপমানের শোধ যাইবে। কিন্তু ঐ লোকটির ঘৃণা বা প্রশংসালাভে তাহার যে কি ক্ষতি বৃদ্ধি হইতে পারে, এইটুকুই কেবল তাহার মনে পড়িতেছিল না।
আজকাল রণেন্দ্রকে উপেক্ষা করিয়া চলা, তাহার সম্বন্ধে নিজকে সম্পূর্ণ অনাসক্ত উদাসীন দেখান―ইহাই যেন তাহার সর্ব্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় কর্ম্ম হইয়া উঠিয়াছিল। সারাদিন নানা উপায়ে নানা ছন্দে সে কেবল তাহাকে আঘাত দিতেই ভালবাসিত। কিন্তু আঘাত ঠিক্ লক্ষ্য স্থলে পৌঁছাইতেছে কি না, সময় সময় মনে এমন সন্দেহও জাগিত। রণেন্দ্রের তীব্র ঔদাস্যের বর্ম্মে ঠেকিয়া অনেক সময় তাহার তাচ্ছিল্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তীরগুলি ফিরিয়া তাহারই বক্ষে আসিয়া বিঁধিত।
বাড়ী যাইবার জন্য মনের কাছেও সে ত্বরা অনুভব করিতেছিল। খোকাও তাহার নিকট হইতে ক্রমে দূরে চলিয়া যাইতেছে, তবে আর এখানে তাহার কিসের প্রয়োজন? আজকাল করিয়া মীনা কিন্তু নিত্যই তাহার যাত্রার দিন পিছাইয়া দিতেছিল। এমন সময় সত্যবতীর একখানা পত্র আসায় কিছুদিনের মতই অমিয়াকে বাধ্য হইয়া বাড়ী ফিরিবার সংকল্প ত্যাগ করিতে হইল। সত্যবতী লিখিয়াছেন, তাঁহার এক বাল্যসখীর সঙ্গ-সুযোগে তিনি একবার কাশী যাইতেছেন, ইচ্ছা আছে আরও কোথাও কোথাও ঘুরিয়া আসেন। ফিরিতে মাসখানেক বিলম্ব হওয়াই সম্ভব। অমিয়া যেন এখন বাড়ী না ফিরে ইহাই তাঁহার আদেশ, কারণ তাহাকে একা ফেলিয়া তিনি ত কোথাও যাইতে পারিবেন না।
চিঠি পড়িয়া মনঃক্ষুণ্ণ হওয়ায় অমিয়ার প্রথমটায় মাসীমার উপর অভিমান হইল, পরে ভাবিয়া দেখিল এ রাগ করা তাহার অন্যায়। পিতৃপরিত্যক্তা এই জঞ্জালকে কণ্ঠহার করিয়াই যে মাসীমা তাঁহার ইহ পরকাল সবই ত্যাগ করিয়াছেন। শুধু তাহার সুখ দুঃখ অভাব অভিযোগ মিটানই তাঁহার জীবনের জপমালা হইয়া উঠিয়াছে। আজ যদি কোনরূপে বাহিরে যাইবার সুযোগ তাঁহার মিলিয়াছে, তবে নিতান্ত স্বার্থপরের মত তাহাতে প্রতিবন্ধক হওয়া তাহার অনুচিত হইবে। সে সঙ্গী হইলে তাহার ইচ্ছামত যেখানে সেখানে বেড়ান বা থাকার অসুবিধা ঘটিতে পারে। তা ছাড়া হয় ত এই সুযোগে মাসীমার চিরদিনের রুগ্ন দেহ কিছু সারিতেও পারে। সে কেবল নিজের সুবিধার দিকটাই দেখিতে শিখিয়াছে, তাঁহার সুখ-দুঃখ আরাম-বিরামের কথা মনেই করে না।
পত্রোত্তরে মাসীমাকে সে লিখিয়া দিল,―তাঁহার ইচ্ছানুসারে সে এখন কিছুদিন এখানেই থাকিয়া যাইবে, কিন্তু এই থাকাটা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থপরতা নহে, ইহার পরিবর্ত্তে মাসীমা যদি যথেষ্ট শারীরিক উন্নতি করিয়া না আসিতে পারেন, তবে সে ভারী অনর্থ বাঁধাইবে।
খবর শুনিয়া মীনা আনন্দে অমিয়াকে জড়াইয়া হাসিয়া কহিল―“বেশ হল ভাই। আমার এমন আহ্লাদ হচ্ছে তা কি বল্ব! তুমি চলে যাবে এখন আমার মনে কর্তেও যেন ভয় হয়।”
অমিয়া খোকাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া হাসিয়া কহিল—“সত্যি বল্চ মীনা, আমি চলে গেলেও আমায় মনে রাখ্বে? খোকামণি, তুমি কিন্তু আমায় ভুলে যাবে―এ আমি জোর ক’রে বল্তে পারি। তোমাদের জাতটা
আলাদা কিনা?” বলিয়া সস্নেহে তাহাকে চুম্বন করিল। সে “কাকা কাকা” বলিয়া বন্ধনমুক্তির আশায় হাত পা ছুড়িতে আরম্ভ করায়―“নিমকহারামটার কাণ্ড দেখেচ” বলিয়া অমিয়া তাহাকে মাটিতে নামাইয়া দিল। ছাড়ান পাইয়া হামা দিয়া একটু দূরে সরিয়া গিয়া, সে একটা ভূপতিত বোতাম কুড়াইয়া লইয়া মুখে পূরিয়া, যেন মস্ত একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছে, এমনি ভাবে হাসিতে লাগিল।অমিয়া মীনার পানে চাহিয়া বিদ্রূপের স্বরে কহিল―“ছেলেটিকে যে একেবারে নিঃস্ব হ’য়ে দান করেচ, একবার চোখের দেখাও দেখ্বার উপায় নেই―গরীব বেচারী আমার উপর এ জুলুম কেন বল দেখি? ওকে বাদ দিলে তোমার এখানে এমন কি আছে বল দেখি, যার লোভে থাকা যায়?”
“তাই নাকি? মন ভোলাবার মন্ত্র বুঝি কেবল খোকাই শিখেচে?” বলিয়া মীনা মুখ টিপিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে লাগিল। তাহার হাসির তলে এমন একটি প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপের সুর ধ্বনিত হইল, যাহাতে কোন কারণ না থাকিলেও অমিয়ার মুখখানা অকারণে রাঙা হইয়া উঠিল। মীনার কথার জবাবে সে কেবল মৃদুস্বরে কহিল—“নিশ্চয়! খোকার মার যে সে মন্ত্র জানা নেই, তা বোধ হয় তিনি নিজেই এখন বুঝ্তে পার্ছেন।”