স্রোতের গতি/সপ্তম পরিচ্ছেদ

সপ্তম পরিচ্ছেদ

অবিচার

 দুপুর-বেলার অবসরে শোবার ঘরের মেঝের বিছানায় একখানি বই হাতে করিয়া মীনা শয়ন করিয়াছিল। বইখানি মাসখানেক পূর্ব্বে সে অমিয়ার কাছে উপহার পাইয়াছে। সময় ও আগ্রহ অভাবে এ পর্য্যন্ত সেখানির পাতা খুলিয়া দেখা হয় নাই। কার্য্যাভাবে আজ পড়িবার জন্য হাতে লইয়াছিল এবং কোনও এক সময় পড়াতেও মন লাগিয়াছিল। সাড়া দিয়া রণেন্দ্র দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মীনা চাহিয়া দেখিল, খোকা তাহার কোলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।

 “এস না ঠাকুরপো, দাঁড়ালে কেন? ওকে ঐ খাটের বিছানায় শুইয়ে দাও না ভাই”―বলিয়া সে পুনরায় পাঠে মন দিল। খোকাকে সন্তর্পণে বিছানায় শোয়াইয়া দিয়া রণেন্দ্র খাটে বসিয়া হাসিয়া কহিল―“পড়া? কি আশ্চর্য্য! বিদ্বানদের হাওয়া লেগে আপনিও যে বিদ্বান হ’য়ে উঠ্‌লেন দেখ্‌ছি?”

 মীনা বইখানির পাঠ্য-অংশটি চিহ্নিত করিবার জন্য সেই পৃষ্ঠাটির একটি কোণ মুড়িয়া রাখিয়া বইখানি পাশে রাখিয়া দিয়া হাসির সঙ্গে গাম্ভীর্য মাখাইয়া কহিল―“মিথ্যে অপবাদ দেবেন না বল্‌চি। জানেন, দুই ভাইয়ে পরীক্ষা নিয়ে তবে নিয়ে এয়েছেন।”

 “তা সত্যি―চারুপাঠ দ্বিতীয়ভাগ, পদ্যপাঠ, ভূগোলসার, সন্দর্ভহার, নীতিকথা, শিক্ষাসোপান, পদ্যসার, রয়েলরীডার, নবধারাপাত, কবিতাবলী―বাপ্‌, নিশ্বাস বন্ধ হ’য়ে আসে! কোথাও ত কমা, সেমিকোলন, ড্যাস্‌, ফুলষ্টপের বালাই নেই। নামাবলীটা মুখস্ত করেছিলেন কিন্তু খাসা! একটা লাইব্রেরী উজোড় বই!”―বলিয়া রণেন্দ্র হাসিতে লাগিল।

 মীনা মুখ ভার করিয়া কহিল―“শুধু নামই মুখস্থ করেছিলাম বৈকি। বইগুলো মুখস্থ কর্‌ত কে মশাই?― সে আপনাদের কলেজ নয় যে প্রক্‌সী দেবেন বা নোট পড়ে কায সার্‌বেন!―সে লোকনাথ পণ্ডিত মশায়ের কাছে পড়া, সেখানে ফাঁকি দিয়ে বিদ্যে হয় না গো!” বলিয়া গাম্ভীর্য্য ছাড়িয়া হাসিতে লাগিল।

 রণেন্দ্র ততক্ষণ মীনার পরিত্যক্ত পুস্তকখানি তুলিয়া লইয়া পাতা উল্‌টাইয়া এখানে সেখানে চোখ বুলাইয়া দেখিতেছিল। বইখানির নাম―“নারীর বিদ্রোহ,” লেখিকা― “অমিয়া”। গ্রন্থকর্ত্রী একস্থানে তাহার মোহনিদ্রাচ্ছন্ন ভগিনীগণকে জাগরিত হইবার জন্য আহ্বান করিয়া বলিতেছেন―“এস আমরা সমবেত শক্তি মিলিত হইয়া আমাদের চিরদিনের দাসত্ব-শৃঙ্খল, আমাদের অধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করিয়া একবার বাহির হই। আমাদের প্রতি অবিচারপরায়ণ হৃদয়হীন সুখবিলাসী পুরুষজাতিকে একবার দেখাইয়া দিই যে, দমনের যুগ আর নাই। এখন সাম্য―স্বাধীনতার দিন। আমাদের ন্যায্য অধিকার ফিরাইয়া পাইবার একমাত্র সরল ও সহজ পন্থা―চিরকৌমার্য্যব্রত গ্রহণ করা, সকল অবিবাহিতা ভগিনীগণকে এই মন্ত্রে দীক্ষিত করা। ভগিনীগণ! স্মরণ রাখিবেন, একতাই জাতীয়জীবন প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র, আত্মরক্ষার অমোঘ বর্ম্ম, শত্রু-দমনের বিজয়-অস্ত্র। এস আমরা একতা-বলে বলীয়ান্‌ হইয়া আমাদের প্রাপ্য দুর্গ দখল করি। স্বার্থ-সর্ব্বস্ব পুরুষজাতির স্বার্থের পথে বাধা জন্মাইতে, আত্মশক্তির প্রতিষ্ঠায় সম-অধিকার লাভে, ক্রীতদাসীত্বের শৃঙ্খল চূর্ণ করিতে, মহাশক্তির অংশরূপে আত্মশক্তির প্রকাশ করিতে এবার যেন আমরা সত্য সত্যই সক্ষম হই―যাচকের দীনতা হীনতা লইয়া নয়, স্বাবলম্বন-মন্ত্রের দীক্ষা লইয়া। যাঁহারা জাতীয় জীবনের নেত্রী, মানবশিশুর জননী, ধাত্রী, পালয়িত্রী, শিক্ষাদাত্রী, তাঁহারা তাঁহাদের হৃদয়হীন প্রভু-সম্প্রদায়ের নিকট পাইয়াছেন কি? সন্তানকে দিবার মত তাঁহাদের আছেই বা কি? ভগিনীগণ―দাসীপুত্র দাসই হয়! দাসত্বের বীজ যাহাদের অস্থিমজ্জার সহিত সংক্রামক রোগের কীটাণুর ন্যায় মিশ্রিত হইয়া গিয়াছে, তাহাদের দাসত্ব ছাড়া আর কি থাকিতে পারে? কিন্তু ঈশ্বরের রাজ্যে এত অবিচার চিরদিন চলিবে না! আঃ―কবে সেদিন আসিবে―কবে?”

 এই পর্যন্ত পড়িয়া রণেন্দ্র বইখানি মুড়িয়া রাখিয়া বিদ্রূপপূর্ণ হাস্যের সহিত কহিল―“আমি বল্‌চি―‘যেদিন আপনারা আরসুলা, ইঁদুর, টিকটিকি দেখিয়া ভয় পাইবেন না, আপনাদের ন্যায্য অধিকার সেইদিনই আপনারা ফিরাইয়া পাইবেন, তাহার একদিনও পূর্ব্বে নহে। আমি বলিব না যে ঘোড়া রাশ ছিঁড়িয়া লাফাইতে থাকিলে আপনাদিগকে তাহার মুখ ধরিয়া শান্ত করিতে হইবে, মুটে না মিলিলে দুই মণ বোঝা মাথায় তুলিতে হইবে, অথবা পালোয়ানের সহিত ঘুষাঘুষি’―”

 মীনা তাহার বলিবার ভঙ্গি দেখিয়া হাসিয়া লুটাইতেছিল। পাছে বেশী বাড়াবাড়ি হইয়া পড়ে, সেই ভয়ে বাধা দিয়া কহিল―“থামুন মশায়, থামুন, আপনার আর ব্যাখ্যায় দরকার নেই। আমরা নিজেরাই সে সব ভেবে নেব―আপনার সাহায্য চাইবও না।”

 “ভদ্রে, আপনার সাহস প্রশংসনীয়। কিন্তু আমার মনে হচ্চে, আজই যেন দাদার বইয়ের আলমারীটা সরিয়ে দেবার জন্যে অভাগা পুরুষমানুষদেরই সাহায্য করবার কথা ছিল। কিন্তু এখন দেখ্‌চি তার আর বোধ হয় দরকার হবে না, সেটা আপনাদের আত্মশক্তিতেই কুলিয়ে যাবে”―বলিয়া রণেন্দ্র পুনরায় হাসিয়া কহিল―“এই সব জ্যাঠামোগুলো দেখলে আমার কিন্তু ভারি বিরক্তি ধরে। পুরুষ-জ্যাঠা বরং সওয়া যায়, কিন্তু মেয়ে-জ্যাঠা একেবারেই সয় না! ওকি―মুখ অন্ধকার কল্লেন যে? দোহাই আপনার, আপনাকে গায়ে পেতে নিতে আমি কোন কথাই বলিনি। আমি বল্‌চি, যাঁরা নিজেদের শক্তিতে সমাজের ধারা বদ্‌লাতে চান, তাঁদের কথা। যাঁদের মাকড়সা দেখ্‌লে মূর্চ্ছা হয়, তাঁদের মুখে অত লম্বাই-চৌড়াই মানায় না। যাঁরা আমাদের সাহায্য চান, খুসী হ’য়ে আমরা তাঁদের সাহায্য কর্‌তে পারি। কিন্তু যাঁদের পদে পদে আমাদের সাহায্যের আবশ্যক, তাঁরা যদি মুখে বলেন―‘ডোণ্টকেয়ার’―তা হ’লে সহ্য করা বাস্তবিকই অসম্ভব হ’য়ে পড়ে। আচ্ছা, আমি তা হ’লে এখন আসি―কথাগুলো অবকাশমত ভেবে দেখ্‌বেন”―বলিয়া সে হাসিতে হাসিতে ঘরের বাহির হইয়া গেল।

 সকালের দিক হইতে ঝুপ্‌ঝুপ্‌ করিয়া অবিশ্রান্ত একঘেয়ে বৃষ্টি পড়িতেছিল। ভোরের সময় বৃষ্টি শুরু হইয়াছিল, বেলা তিনটা বাজে, এখনও তাহার ভাবের কোন পরিবর্ত্তন দেখা গেল না। একঘেয়ে বৃষ্টির শব্দে মনও যেন ভারাক্রান্ত হইয়া উঠে। বাগানে যাইবার উপায় নাই। খোকা তাহার কাকার ঘরে। মেঘলা দিনের আকাশের ন্যায় অন্ধকার মন লইয়া অমিয়া তাহার নিজের ঘরে বসিয়া কতকগুলি প্রুফ দেখিতেছিল। অনেকদিন এগুলি আসিয়া পড়িয়া আছে, ভাল লাগে না, তাই খুলিয়া দেখা হয় নাই। আজ নিতান্তই দিন কাটিতেছিল না, তাই অত্যন্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও সেগুলি বাহির করিয়া কাট্‌কুট্‌ করিতে বসিয়াছিল। তবু কাজের মধ্যেই মন তাহার উধাও হইয়া ক্ষণে ক্ষণে দূরে কোথায় চলিয়া যাইতেছিল। মনের মধ্যে একটা অভাব―ঠিক্‌ বোঝা যায় না। তবু কি একটা অজানা ভাব আজকাল যেন সারা মনটাই জুড়িয়া রাখে। এই নূতন অজ্ঞাত ভাবটিকে সে যেন ধরিতেও পারে না―ছাড়িতেও চাহে না।

 কিছুদিন পূর্ব্বে সে মনে মনে স্থির করিয়াছিল, মিস্ চৌধুরীর কথা রাখিবে―এখানকার এমন সব প্রাকৃতিক ইতিহাস সংগ্রহ করিয়া সে গ্রন্থ রচনা করিবে, যাহা জগতে সম্পূর্ণই নূতন “নারীর বিদ্রোহ” পুস্তকের চেয়ে তাহা কোন অংশে হীন হইবে না। আর এই উপাদেয় প্রবন্ধগুলি যখন মাসিকপত্রিকা “আরতি”র পৃষ্ঠা অলঙ্কৃত করিবে, তখন শুধুই নীরস সংস্কারক বলিয়া লোকসমাজে তাহার নাম আলোচিত হইবে না। অন্তঃসলিলা ফল্‌গু-স্রোতের ন্যায় তাহার অন্তঃপ্রবাহিত রসধারার শীতল স্পর্শে পাঠকগণ শুধু বিস্মিত নয়―মুগ্ধও হইয়া যাইবে।

 কল্পনা কিন্তু কল্পনাতেই রহিয়া গিয়াছে; এ পর্য্যন্ত তাহা কার্য্যে লাগাইবার কোন চেষ্টাই করা হয় নাই। গ্রন্থ লিখিবার উপযোগী সময় ও সরঞ্জামের অপ্রতুল ছিল না। চারিদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্য মনের মধ্যে যথেষ্ট কবিত্ব সঞ্চারও করিয়া থাকে। তবু সেগুলির সদ্‌ব্যবহার হইয়া উঠে না। চিন্তার ধারা সমস্তই যেন উল্‌টা-পথে বহিতে থাকে। এমন কি, তাহার চিরদিনের দৃঢ় বিশ্বাসের মূল কখন যে ধীরে ধীরে শিথিল হইয়া পুরুষজাতির প্রতি তীব্র ঘৃণার ভাবটি কমাইয়া দিতেছিল, তাহা সেও যেন ধরিতে পারিতেছিল না।

 প্রাণতোষবাবুর ন্যায় উচ্চ-শিক্ষিত মানুষ যে কেমন করিয়া এই সব নির্ব্বোধ চাষাভুষার দলে, তাহাদের সুখদুঃখে সহানুভূতিতে একচিত্ত হইয়া চিরদিনের বাসভবন বাঁধিয়া শান্ত নিরুদ্বেগ জীবন নির্ব্বাহ করিতে পারেন―সে যেন তাহা অনুমানও করিতে পারে না। কি অসাধারণ অধ্যবসায় ও অর্থব্যয়ে বিজ্ঞানের নব নব কৌশলে এবং দেশদেশান্তর হইতে নানা উপাদান সংগ্রহ করিয়া এই বন্যভূমিতে নন্দনের সৌন্দর্য্য―ও অব্যবহৃত জঙ্গলময় দেশের সংস্কার করিয়া দুর্ভিক্ষ-পীড়িত দেশবাসীর প্রচুর খাদ্যের সংস্থান করিয়া দিয়াছেন! অবৈতনিক নৈশ বিদ্যালয়ে নিজব্যয়ে দুইজন উৎসাহী যুবককে শিক্ষকরূপে রাখিয়া, ও নিজে সঙ্গী হইয়া নিরক্ষর বনবাসীদের অজ্ঞানান্ধকারা বৃত-চিত্তে জ্ঞানের আলোক ও আনন্দ বিতরণ করিতেছেন! এমন অক্লান্ত কর্ম্মী, এমন উচ্চ-হৃদয়―যদি শ্রদ্ধা পাইবার যোগ্য না হয়, তবে শ্রদ্ধার যে মূল্য থাকে না! মীনাকেও তিনি ভালবাসেন। ঠিক্ সম-অধিকারে কোদাল হাতে মীনা তাঁহার চাষের কাজে পাশে গিয়া না দাঁড়াক্‌, তবু তাহাকে ঠিক্ দাসী বলা যায় না।

 অমিয়ার মনে হইতেছিল, মীনার ভাগ্য ভাল―কাঁটাবনের মধ্যেও সে গন্ধরাজের আশ্রয় পাইয়াছে। জগতে সবাই যদি প্রাণতোষবাবু হইতেন, তবে আর দুঃখ ছিল কি? রণেন্দ্রেরে কথা অনিচ্ছাতেও বারবার তাহার মনে উদয় হইতেছিল, কিন্তু মনকে সে জোর করিয়া এ চিন্তা হইতে বিরত রাখিতে চাহিতেছিল। মনে মনে বলিতেছিল―“তাঁহার সংবাদে আমার প্রয়োজন কি”? আর বোধ করি কোন মেয়েরই কখন তাহা প্রয়োজন হইবে না।