হারামণি/পল্লীগানে বাঙ্গালী সভ্যতার ছাপ

একাধিক লেখক
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন সম্পাদিত
(পৃ. -৩২)

পল্লীগানে বাঙ্গালী সভ্যতার ছাপ

 পল্লীগান বাঙ্গালা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ, বাঙ্গালীর প্রাণের কথা। বাঙ্গালীর যখন স্বাস্থ্য ছিল, বাঙ্গালী যখন কেরাণীগিরির প্রলোভনে হা অন্ন! হা অন্ন! করিয়া ছুটিয়া বেড়াইত না, বাঙ্গালীর অন্তর-আকাশ যখন আনন্দের বিকাশে ও নির্ম্মলতায় পূর্ণ ছিল তখনকার এই সম্পদ, ওই আনন্দের দান, এই স্বতঃস্ফূর্ত্ত গান নানাবিধ কষ্টের মধ্য দিয়া অতি যত্নসহকারে সংগ্রহ করিয়াছি, এবং বাঙ্গালী সভ্যতার বিকাশের উপর ইহার যে কত ছাপ রহিয়াছে তাহাই দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি। কতদূর সফলতা লাভ করিয়াছি তাহা সুধী পাঠক বিচার করিবেন। মানুষের মন যখন ভয়-ভাবনা হীন থাকে, যখনই অন্য কোন প্রকার চিন্তাকীট দ্বারা তার হৃদয়পল্লব জর্জ্জরিত হয় না, যখনই তার মন আনন্দে বসরা গোলাপের মত বিকশিত হয় তখনই তার সুঘ্রাণ, তার মাধুর্য্য রূপ ধ’রে আমাদের সম্মুখে আসে অর্থাৎ কবি ও শিল্পীর অতুল তুলির পরশলাভ করিয়া ধন্য হয়। সত্যই জনৈক বিখ্যাত সমালোচক বলিয়াছেন “Poetry is the most intense expression of the dominant emotions and the higher ideals of age” এবং আরও নজির-স্বরূপ Blair-এর কথায় বলা যাইতে পারে “Poetry is the language of emotions” (এই রকম অনেকেই অনেক কথা বলিয়াছেন। সুতরাং নজিরের ভারে আসল জিনিষের কথা চাপিয়া রাখিতে চাই না।) মানুষের মন যখনই আনন্দের বেদনায় মুহ্যমান হয় তখনই সে আনন্দদায়ক নব সৃষ্টি করে; আর আনন্দের বিকাশ বলিয়াই উহা চিরন্তন হইবার দাবী রাখে

(২)

 বাঙ্গালী সভ্যতা (দ্রাবীড়, মঙ্গোলী,) হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও ইংরেজ সভ্যতার সংমিশ্রণে এক অপূর্ব্ব সৃষ্টি। বাঙ্গালী সভ্যতার মধ্যে এই সব সভ্যতার ছাপ আছে, একথা অস্বীকার করিলে চলিবে না। আর এই ছাপ সাহিত্যে বিশেষতঃ পল্লীগানে বিশেষ করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। হিন্দু সভ্যতা এই বাঙ্গালী সভ্যতার মূল, বৌদ্ধ সভ্যতা ইহার কাণ্ড, মুসলমান সভ্যতা ইহার শাখাপ্রশাখা এবং ইংরেজ সভ্যতা ইহার পত্র-পুষ্প-বিকাশ।

 মুসলমান সভ্যতার ছাপ যে এই পল্লীগানে লাগিয়া রহিয়াছে তাহা দৃষ্টিমাত্রেই বুঝা যাইবে। আরবী এবং পারশী শব্দ সমূহই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ, আর তা ছাড়াও ভাবের রাজ্যেও ইহার প্রতিপত্তি দেখা যায়। উদাহরণ স্বরূপ একটি গানের দুই চারি ছত্র উদ্ধৃত করা যাউক।

“আল্লার কুদরতের পর খেয়াল কর মন॥
একতনে হয় পাঞ্জা‘তন’
কোন তনে আছেন আল্লা নিরাঞ্জন॥
কোন তনে হয় মাতা পিতা,
কোন তনে হয় মুরশিদ ধন?
আল্লার কুদরতের ’পর খেয়াল কর মন॥”

 এই গানের ভাব ও ভাষা সম্পূর্ণ মুসলমানী। ‘তন’ পারশী শব্দ, অর্থ শরীর। মুসলমানের traditionএর সাথে পরিচয় না থাকিলে ইহা সহজে বোধগম্য হওয়া কঠিন এবং ইহার expressive কবিত্ব শক্তি ও association উপলব্ধি করা যায় না।

 যাঁহারা এই সমস্ত গান রচনা করিয়াছিলেন তাঁহাদের অন্তরের মাধুর্য্য ও সুর ইহাতে রূপ পাইয়াছে। একটি গান পারশ্য কবি-কুল-প্রদীপ মওলন। জামী (রহমতুল্লা আলায় হে)র একটী কবিতার সহিত হুবহু মিলিয়া যায়। যথা:—

“মরার আগে ম’লে শমন জ্বালা ঘুচে যায়।
জান গে সে মরা কেমন, মুরশিদ ধরে জানতে হয়॥
যে জন জেন্দা লয় খেলকা কাফন
দিয়ে তার তাজ তহবন,
ভেক সাজায়॥
মরার আগে ম’লে শমন জ্বালা ঘুচে যায়॥”

জামী

“মানতুজে খাকেম্ ও খাক আজ জামিন,
হামা বেহ‍্ কে খাকী বুওয়াদ আদমী”

 আমি এবং তুমি মাটি হইতে সৃষ্ট, যদি মাটির মত হও তাহা হইলেই তোমার মনুষ্যত্ব বিকাশ পাইবে। এইভাব লইয়া পারশ্য কবি-কুল-তিলক ঋষি হজরত মওলনা সা’দী (রহমতুল্লা আলায় হে) অনেক কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন। তা ছাড়া বিভিন্নদেশীয় অনেক নামজাদা কবির ভাবের সহিত এই সমুদয় অখ্যাত নামা ও অজ্ঞাত কবিদের রচনার ভাব একেবারে মিলিয়া যায়।

 এই ত গেল ইহার সোজা দিকটা। এখন ইহার জটিল আধ্যাত্মিক দিকটার সামান্য একটু আলোচনা করা যাউক। এই আলোচনা বিশদ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ হইবার আশা যাঁরা করেন, তাঁরা নিতান্তই নিরাশ হইবেন। এই কথা বলিলে বোধ হয় অন্যায় হইবে না যে এই গূঢ় আধ্যাত্মিক দেশের কথা মৌলবী সাহেবেরা যাকে তাকে শিখান না এবং যে সে শিখিবার উপযুক্ত পাত্রও নহে, তবু কেমন করিয়া এই ‘অক্ষর’-জ্ঞানহীন ফকির সম্প্রদায়ের মধ্যে ইহা প্রবেশ করিয়াছিল তাহা জানিতে স্বতঃই কৌতুহল জন্মে। এই স্থানে একটি গান তুলিয়া দিতেছি।

জপরে তার নামের মালা না হয় যেন ভুল
গাঁথ ঐ নাম আপন গলায়।
দূরে যারে দুঃখ জ্বালা
অন্ধকার হবে উজলা,
এই দুনিয়ার মূল
তুমি লায়লাহা ইল্লাল্লা বল,
ঐ আঁধার কাটে চক্ষু মেল,
এই ভবের হাটে ভুলনারে মহম্মদ রসুল।
নুহ্ অল ইস‍্‌বাত নফুয়াল নবি,
ও তোমার ফানা ফাল্লা যখন হবি,
মেছের শা কয় তবে হবি,
আল্লার মকবুল॥”[১]

 বন্ধুবর মৌলবী রজব আলী সাহেব প্রদত্ত পাদটীকা হইতে ইহার সোজা মানে বোঝা যাইবে। সত্য উপলব্ধি করিলে যে ভাব মানস মন্দিরে জাগে, ঠিক সেই ভাব লইয়া ইহা লিখিত। ‘ঐ আঁধার কাটে চক্ষু মেল’—সেই উপলব্ধির উজ্জ্বল বর্ণনা আমাদের সামনে আনিয়া দেয়। সাধকের সাধনা সফল হইল—তিনি গভীর অন্ধকার রজনীর অবসান দেখিতেছেন—পূর্ব্ব আকাশে জ্যোতিঃ প্রকাশের পূর্ব্ব আভাষ পাইতেছেন। এই গানটি পল্লী সঙ্গীতের অত্যুজ্জ্বল মধ্যমণি।

আরও একটি গান পাঠকের সামনে নজির দেওয়া যাউক।

“নবি দিনের রছুল, আল্লার নাম যায় না যেন ভুল।
ভূলে গেলে মন পড়বি ফেরে হারাবি দুকুল॥
আওয়ালে আল্লার নূর  দুইয়ামে তোবার ফুল,
ছিয়ামে ময়নার গলার হার
চৌঠা ছেতায়, পঞ্চমে ময়ূর॥
আব, আতস, খাক বাতাসের ঘরে
গড়েছেন সেই মালেক মোক্তার, চারচিজে।
চার চিজে একমতন করে, দুনিয়াই করেছে স্থূল॥”

 এই ভণিতাহীন কবিতায় মুসলমানী ভাবেরই সমাবেশ। ইহার পরিভাষা (Technicalitis) না বুঝিতে পারিলে অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নহে।

 এইখানে আর একটি গান উদ্ধৃত করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিলাম না। এই গানে সৃষ্টির কথা আছে। হিন্দুর যেম “শব্দব্রহ্ম” ও ইংরাজের যেমন “Let there be light” বলার সাথে সাথে এই সৃষ্টি, মুসলমানের ও তেমনি “কুন্” (অর্থ হও বা কর) শব্দ হইতে সৃষ্টি। (পয়গম্বর কাহিনী—মৌলবী ফজলুর রহিম চৌধুরী এম, এ, দ্রষ্টব্য) এবং সেই কথাই এখানে বলা হইতেছে।

“আমি ডুব দিয়া রূপ দেখিলাম প্রেম নদীতে।
আল্লা, মোহাম্মদ, আদম, তিন জনা এক নূরেতে নূরেতে॥
সে সাগর, অকূল আদি, অন্ত নাই তার নিরবধি
নিঃশব্দ ছিল সিন্ধু আদিতে॥
শব্দ হইল কুন্ জান তার বিবরণ
হুয়াল আছমা কারিগিরিতে॥”

 এই সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে অন্য একটি গান উদ্ধৃত করিয়া দেখাইতেছি পাঠক একটু লক্ষ্য করিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবেন হিন্দু এবং মুসলমানের মিলনের সুর গানে পর্য্যন্ত পৌঁছিয়াছিল, অন্যত্র ত দূরের কথা। বাঙ্গালা সমাজতত্ত্বের ইতিহাস লিখিত হইলে এই সব বুঝিবার আরও সহজ পন্থা উদ্ভাবিত হইবে। হিন্দু ও মুসলমানের প্রাণের মিলন কতটুকু হইয়াছিল তাহা এই গান হইতেই বুঝিতে পারিবেন; হিন্দু ও মুসলমান tradition এর সংমিশ্রণে এক অপূর্ব্ব সম্পদ সৃষ্ট হইয়াছিল।

“মাবুদ আল্লার খবর না জানি।
আছেন নির্জ্জনে সাঁইনিরঞ্জন মণি,
সেথা নাই দিবা রজনী॥
অন্ধকারে হিমান্ত বায় ছিলে আপনি
সেই বাতাসে গৈবী আওয়াজ হ’ল তখনি।
ডিম্ব ভেঙ্গে আসমান জমিন গড়লেন রব্বানি॥
ডিম্ব রক্ষে আলে, ডিম্বের খেলা আদমে খেলে
অধীন আলেক বলে না ডুবিলে কি রতন মিলে?
ডুবিলে হবে ধনী॥ ”

 ইংরেজ সভ্যতার ছাপ “শিক্ষিত সাহিত্যে” যত লাগিয়াছে পল্লী সাহিত্যে তত লাগে নাই। আর পল্লী সাহিত্যে যতটুকু লাগিয়াছে তাহা ইহার বাহিরের জিনিষ—অর্থাৎ সভ্যতার কলকব্জা আসবাব পত্রের কথা। আমাদের প্রাচীন বাঙ্গালী সভ্যতায় কলকব্জার আমদানী বেশী ছিল না, কাজেই ইংরেজ সভ্যতার বাহিরের দিকটাই পল্লীগানে বেশী দাগ কাটিয়াছে। আমাদের প্রাচীন সভ্যতার বাহিরের আসবাব-পত্র নৌকা, চরকা, প্রভৃতি ছিল সুতরাং এই সব লইয়া সুন্দর সুন্দর গান দেখিতে পাওয়া যায়।

 আমাদের ঘরের জিনিষ চরকা লইয়া সাধক কি আত্মতত্ত্বে উপস্থিত হইয়াছেন দেখা যাউক। সাধারণ নিজের মনকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন।

“যা যা তেল দিগে যা আপন চরকাতে।
ভোলা মন তুলিস্ না তুই কথাতে।
চরকার অষ্ট পাখী,
দুই ধারে দুই প্রধান খুটি,
মাঝখানে দুই চাকী
কত কালে ঘুরছে (রে মন)
চরকা ঘুরে কেবল মালের জোরেতে॥”

 এই চরকার সাথে বাঙ্গালীর কত সুখ দুঃখের কথাই না জড়িত রহিয়াছে!

 বাঙ্গালী সভ্যতার অন্যতম গৌরবের জিনিষ বিশ্ব বিখ্যাত ঢাকাই মসলিন যাহাতে তৈয়ারী হইত সেই তাঁত হইতেই বা সাধক কি আত্ম-তত্ত্ব লাভ করিয়াছেন, দেখা যাউক। মনকে সম্বোধন করিয়া কি বলিতেছেন শুনুন;

“মন তাঁতি কি বুনতে এলি তাঁত।
এসে প্রথমেই হারালি আত॥
ও-তোর শানায় সুতো মানায় না তোরে,
পোড়া পোড়েন হ’ল না জাত॥
করে আনাগোনা তানা কাড়ালি,
হায়, তুল্লি কি খেই হায়
ঘুচলো না খেই কোচ‍্কা পড়ালি॥
যত আনাগোনা যায় না গোনারে
হলো সকল তোর ভস্মসাৎ॥
পেয়ে এমন তানা জানলি আপন কিসে
তাই ভাবিরে, ভাবিরে মনের হুতাশন॥
এই যে বটনা টানা আর খাটে না রে;
যে তোর পাছ লেগেছে হয় বজ্জাৎ॥
যত আশা করি তুলতে গেলি ঝাপ
দিলি, এককালে চিরকালে, পাপ সলিলে ঝাপ।
ভেবেছিস্ এবার উঠবি আবার রে;
ক্রমে ক্রমে হল অধঃপাত॥
হাতে গলে সুতা জড়ালি কেবল।
এলে রবিসুত এ সব সুতো কোথায় রবে বল॥
ভক্ত নন্দসুত কই আশু ভোরে,
যদি খাবি দীন বাউলের ভাত॥”

 এই সমস্ত গানের মাধুর্য্য উপলব্ধি করিবার। গানের প্রভাব যে মানব মনের উপর কত বেশী তাহা না বলিলেও চলে। যখন এই সমস্ত গান গীত হয় তখন শ্রোতৃগণের মন সংসারের নীচতা হইতে বহুউর্দ্ধে উঠিয়া যায়। এই সমস্ত গানের জন্যই বাঙ্গালী সাধারণের Moral Standard এখনও অনেক উচ্চে আছে।

 এখন বাঙ্গালীর তরী সম্বন্ধে সাধকের রূপক গান দেখা যাউক। বাঙ্গালী যে বাণিজ্যপ্রিয় জাতি ছিল তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ শ্রীমন্ত সওদাগর, চাঁদ সওদাগর ও এই সমস্ত পল্লীগান। ‘মহাজনের’ ‘মাল’ লইয়া বিদেশে বাণিজ্য করিতে আসিয়াছেন এই ভাবটা অনেক পল্লীগানেই অ ছে। ছয়জন ‘বোম্বেটে’ সেই সমস্ত কাড়িয়া লইয়া যায়। (এই বোম্বেটের তুলনা কি পর্তুগীজ বোম্বেটেদের কার্য্যকলাপ হইতে গৃহীত? “বোম্বেটে” শব্দ কতদিন হইল আমাদের সাহিত্যে প্রচলিত হইয়াছে?)

 তরী সম্বন্ধে অনেক গান আছে। তুলনামূলক সমালোচনার জন্য কয়েকটি তুলিয়া দিতেছি।

(ক)

“গড়েছে কোন সুতারে এমন তরী জল ছেড়ে ডাঙ্গাতে
চলে।
ধন্য তার কারিগিরি বুঝতে নারি এ কৌশল সে
কোথায় পেলে।
দেখি না কেবা মাঝি কোথায় বসে হাওয়ায় আসে
হাওয়ায় চলে,
তরীটি পরিপাটী মাস্তুলটি মাঝখানে তার বাদাম ঝোলে॥

লাগেনা হাওয়ার বল এমনি সে কল সকল দিকে সমান
চলে।
তরীতে আছে আটা মণি কোঠা জ্বল্‌ছে বাতি রংমহালে,
যেখানে মনের মানুষ বিরাজ করে মন পবনে তরী চলে।
সখিন কয় হলে ঝড়ি তুফান ভারি উঠবেরে ঢেউ মন
সলিলে,
যেদিন ভাঙ্গবেরে কল হবে অচল চলবে না আর জলে
স্থলে।”

(খ)

“দিনের দিন বসেরে গুনি।
কোন দিন যেন টলিয়ে পড়ে আমার সাধের তরণী॥ 
কোন জোয়ারে ভরলেম্ ভরা
সে জোয়ার গিয়ছে মারা,
শেষ জোয়ারের ভাটায় পড়ে করছি টানাটানি॥ 
সে জোয়ার কোন দিন পাবো,
সাধের তরণী জলে ভাসাব,
ব’লে জয় রাধার নাম ধ্বনি॥
একে আমার জীর্ণ তরী
তাতে মাল্লারা ‘কল্লা’ ভারী।
মুখে বলে হরি হরি অন্তরে শয়তানী॥
দাঁড়ি মাল্লা যুক্তি করে
সাধের নৌকায় দ্যায় কুড়াল মেরে,
পার হব কেমনে ত্রিবেণী॥

তক্তার “বা’ন” ছুটেছে,
সাধের তরণী “খোঁচে” বসেছে,[২]
কোনখানে কারিগর আছে ঠিকানা না জানি। 
গোঁসাই নলিন চাঁদ বলে,
কারিগর আছে নিরালে,
খুজলে পরে মিলবেরে অখনি।৷”

(গ)

“আজব তরী দেখে মরি গড়েছে কোন মিস্তিরী
এ তরী বোঝাই নেয় ভারী তিন বেলাতে বোঝাই করি
তবু বোঝাই হয় না ভারী মন ব্যাপারী।
তরীর ভাব দেখে সদাই আমি ভাব্যা মরি।
তরীর মাল্লা আছে ছ’জনা,
তিন জনে খাটায় তরীর কল,
আর তিন জন আছে বসে তরীর পর।
আমি যে দিক টানতে কই সে দিক টানে না
তারা সদাই করে জঞ্জাল, বাধায় গোল মাল,
কোন দিন যেন সাধের তরী শুকনাতে হয় তল।
ছয় জনাতে ঐক্য মিলে তরী যাও বইয়ে,

তবু তার পাড়ি নাহি জমে যে দিন ‘বান’ চুয়ায়ে
উঠবে পানি।
যে দিন তরী মন রসনা নৌকা ছেড়ে পালায়ে যাবে
মাল্লা ছয় জনাই॥

(ঘ)

“কোন কারিকর গড়েছে তরী।
ও তার গুণের (মন রে)
ও তার গুণের যাই বলিহারি॥
তরী দমের গুণে, ভোলা মন
তরী দমের গুণে, জলে আগুনে
চলতেছে অনিবারে।
সদাই দুইটি চাকা দুইদিকে ঘোরে॥
আবার, মাঝ খানে তার নড়ছে তার
দেখ সে কল ঘুরে॥
কিবা হাল ধরেছে (ভোলা মন) দিবারেতে
বসে আছেন কাণ্ডারী॥
বসে এক খালাসী মাপ‍্ছে নদীর জল।
দু’জন তার দুধারে দূরবীণ ধরে
হায় কি মজার কল॥

আবার দুজন কেবল কয়লা আর জল
যোগায় জল বরাবরি।
কিবা, দুইটি নলে সদাই দম চলে।
কয়লা জল বদলাবার নালা আবার রয়েছে তলে
তীর উপর পানে কেউ না জানে
লাট সাহেবের কুঠুরী।
এখন কলের বলে যাচ্ছে ঢেউ ঠেলে।
যখন আড়াবে কল, তলিয়ে সকল, যাবে এক কালে।
ডেকে কোটাল, সে বিষম কাল,
আর ক্ষণকাল নাই দেরী॥
মিছে এ তরীর ভরসা করা।
এমন কত শত অবিরত, পড়ছে মারা।
এ দীন বাউলের কয় (ও ভোলা মন)
তার কিরে ভয় সদয় যার শ্রীহরি॥”

 [এই গানটি যে আধুনিক রচনা তাহা ইহার ভাব ও ভাষা হইতেই অনায়াসে বুঝা যায়]

 তরী সম্বন্ধে আরও অনেক গান আছে। আমি দুই চারিটি মাত্র সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছি। পাঠকের বিরক্তির ভয়ে আর উদ্ধৃত করিলাম না।

 ব্যবসা বাণিজ্য সম্বধে আরো সুন্দর সুন্দর গান আছে। মহাজনী ব্যবসা বিষয়ে বেশ একটি সুন্দর গান পাঠকের সামনে হাজির করিতেছি। এই গানে বাঙ্গালীর ব্যবসায় প্রবণতার ছবি আমাদের সামনে ফুটিয়া উঠে। বাঙ্গালীর এখন ষে ব্যবসার নামে মনে আতঙ্ক উঠে পূর্ব্বে তাহা মোটেই ছিল ना।

“কও মন তুমি কিসের মহাজন।
করলে এতো দিন কি উপার্জ্জন।
যত বিলাত বাকী, মজুত বাকি করেছ কি নিরূপণ॥
আপন পাওনাটি বেশ বেশ দেখেছো হিসাবে।
কিন্তু দেনার বেলায়, পড়বে ঘোলায়
জ্বালায় প্রাণ যাবে॥
যে দিন হবে নিকেশ, রবে কোথায় এ ধন জন॥
ও কি বাঁকী সদায় করতেছো আদায়,
আসছে হাল তাগদায়, কাল পেয়াদায়,
ভাব্‌ছো‌ না সে দায়॥
তারে গোঁজা দিযে প্রবোধিয়ে,
পারবে কি ভোলাতে
ওরে বস্তা ভরে করছো কিরে মাপ।
পরের ওজন কমি, ধরছো তুমি,
লয়ে দু’জন মুটে, লুটে পুটে,
সারলো সে মোকাম॥
যবে আর কি ছিল মাল, সব দিয়েছো বিসর্জ্জন।
ছি ছি মহাজনী কর্ম্ম নয় এমন।
এদীন বাউল তার কি টলে, তুচ্ছ লোভে মন॥
ভবে সেই মহাজন করে যে জন শ্রীহরির চরণ ভজন॥

 বাউলের এক তারার সাথে খোলা মিঠে গলায় কি সুন্দর সুর শোনা যায় তা অনুভব করিবার, বুঝাইবার নহে। সুর ছাড়া গান, প্রাণ ছাড়া দেহ।

 বাঙ্গালী যে ঘরে থাকে সে ঘর সম্বন্ধে কিছু বলা হয় নাই। এইখানে সেই ধরণের একটী গান তুলিয়া দিতেছি।

“চার পোতায় এক ঘর বেঁধেছে ঘরামির নাম সৃষ্টিধর।
আড়ে ‘দীঘে’ একই প্রমাণ ঠিক সমান সে ঘর॥
ঢাকা ঘরের মধ্যস্থল, মুর্শিদাবাদ সদর মোকাম,
কত গলি শোন বলি, চোষট্টি গলি চার বাজার॥
কানা কালা বোবারই কারবার, দেখে শঙ্কা হয় আমার
চার বাজারে চার দোকানদার করতেছে কারবার এসে॥
দোকান মাথায় লয়ে চলে যায় কানা দেখে হাসে।[৩]
কানার জিনিষ কিনে বোবা ডাকে মালের মূল্য নিসে॥
কানা কালা খেলেছে খেলা, খেলছে নিশি দিবসে,
সংসারে অসার তারাই রসে আমি ভাব্যা পাইনা দিশে॥
সেই ঘরে বসত করে জনমভরা একজনা,
চক্ষু নাই মুখ আছে কর্ণ দুটি কালা
নাকে না শোঁকে, চোখে না দেখে কানে না শোনে ক্ষ্যামতা
আমি অবিশ্বাসী ঈছ, সাধু জানে তা।
ছিল ঘরের আজ্ঞাকারী, “পিরভুয়ারী সবে মাখা” (?)

ভাল মন্দ লাগে ধন্দ গন্ধ মালুম হয় যথা
মাতালে কি বুঝতে পারে তা অপার মুখে কয় কথা॥

 বাগান সম্বন্ধে সাধকের গান দেখা যাউক। বাগান হইতে যে রূপক গ্রহণ করা হইতেছে তাহা অতীব মনোমুগ্ধকর।

“মন তুমি কি ছার বাগান করছো বাগান
আপন বাগান ছাপ রাখনা।
করে নিড়ানী হাতে দিনে রেতে
করছো বাগান মনের কাণা॥
দেখ তোর ফুল বাগানে জঙ্গল হলো
নয়ন তুলে তাও দেখলে না।
বৃথা গাছ করে রোপণ জল সিঞ্চন
করে কি হবে বলোনা॥
দেখ তোর কল্পতরু শুখাইল
সে তরুতে জল ঢালনা।
বাগানে কুড়িয়ে মাটি হলি মাটি
মাটি কবলি সব সাধনা॥
ছাড়বে ভবের বাগান মনরে পাষাণ
আনন্দ-বাগানে চলনা।
সখিনচাঁদ মনের তুখে ৰল্‌ছে
যদি বাগান করতে হয় বাসনা।

দেখ তোর মন বাগাতে ফুল ফুটিল
গুরু পদ ঠিক রাখনা॥”

 বাঙ্গালীর স্নানের ঘাট সম্বন্ধেও কবির মনভোলান গান শোনা যাউক। সাধক বলিতেছেন

“সাম‍্লে ঘাটে নামিস্ আমার মন।
ঘাটেতে কাঁটা গোজা কত আছে,
হোস‍্নারে তাতে পতন॥
ঘাটেতে শেওলা ভারী পা টিপে চল‍্তে নারি,
কেমন করে নামবি তাতে তার উপায় করনা॥”

 ঘাটের কথা ত শুনিলেন এখন “আঘাটা”র সম্বন্ধে শুনুন, ঘাট এবং আঘাটের তুলনায় পরস্পরের ছবি পরিস্ফুট হইবে।

“স্নান ক’রোনা আঘাটায়।
আরে পা পিছলে গেলে উঠা দায়॥
মরবি খেয়ে হাবুডুবু তখন করবি কি উপায়,
যদি নেয়ে উঠিস্ বেঁচে পড়বি কেঁচে পুনরায়॥
ভব নদীর কোথায় কেমন সহজে কি জানা যায়।
কোথাও গড়ে হাঁটু পানি কোথাও হাতী তলিয়ে যায়॥
নাব‍্লে পরে বাঁধা ঘাটে, আছে কত মজা তায়,
কত সাধু শান্ত হয়ে ভ্রান্ত, “বেটক্কোরে” মারা যায়॥
সে জানা বলে ঘোলা জলে, ঘাট কি অঘাট চেনা যায়?
জেনে শুনে নাব‍্লে পরে নাইক ক্ষতি তায়॥”

 এতক্ষণ বাঙ্গালীর গৌরবের কথা বলিয়াছি, এক্ষণে ইংরেজ সভ্যতার ও বাঙ্গালীর অধঃপতনের কথাই বলিব। ইংরেজের কল কব্জার সমাগমেই কবি বলিতেছেন।

“রসিক চিনে ডুবরে আমার মন।
রস ছাড়া রসিক বাঁচেনা, জল ছাড়া মীনের মরণ॥
যে ঘাটে ভরিব জল
সেই ঘাটে ইংরেজের কল,
ও সে কলসের মুখে ‘ছাকনা’ দিয়ে জল ভরে রসিক জন॥”

ইংরেজ সভ্যতার প্রথম জিনিষ আফিস—ব্যবসার আফিস।

“কও হে কি কাজ করছো আফিসে।
আফিস ‘ফেল্’ হবে কোন দিবসে॥
ভেঙ্গে রোকড় তবীল, করছো ‘বিল’
ঠেক‍্তে হবে নিকেশে॥
এতো সামান্য পাঁচ কোম্পানীর আফিস
বিবাদ বাঁধলে পরে, দুদিন পরে, হবে এবলিস।
সাহেব বিলেত যাবে, হায় কি হবে?
তুমি রবে কোন দেশে॥
যখন জানবে তুমি প্রধান অফিসার,
অমনি সর্ব্বনেশে সার্জ্জেন এসে করবে গেরেফতার॥
কে আর করবে তালাস, আসলো কি খালাস
পাবে সে কালের পাশে॥

হায় হায় বিচার যখন করবে ম্যাজিষ্ট্রের
এযে বাবুগিরি কি ঝক‍্মারী, তখন পাবে টের॥
ধরে দাগাবাজী, সে বাবাজী অমনি ধরবে ঘাড় ঠেসে॥
এ দীন বাউল বলে ও কাজে কাজ নাই।
এসো দয়াল হরি, আফিস তারি, সেই আফসে যাই॥
কোন নিকেশের দায়, নাইরে সদায়, থাকবে
সুখে স্ববশে॥”

 ইংরেজ সভ্যতার অন্যতম সামগ্রী, আমাদের দেশে নূতন ও অদ্ভুত সামগ্রী সেই গাড়ী সম্বন্ধে বাউলের গান দেখা যাউক।

“যাচ্ছে গৌর প্রেমের রেল গাড়ী।
তোরা দেখ‍্সে আয় তাড়াতাড়ি॥
উদ্ধারের আছে যত কল,
সকলের সেরা এ কল,
আপনি কলে তুলে দিচ্ছে জল,
হুহু উড়ছে ধোয়া, ঘুর‍্ছে বোমা,
আবার হচ্ছে কলের হুড়াহুড়ি॥
গার্ড হয়েছেন নিতাই আমার,
শ্রীঅদ্বৈত ইঞ্জিনিয়ার,
এবার ভবে ভাবনা কিরে আর,
মুখে হরি হরি গৌর হরি,
করছেন টিকিট মাষ্টারী,

ভক্তি টিকিট সাধন করে ষ্টেশন বৈকুণ্ঠ পুরে,
যাচ্ছে বেদম দম দিয়ে কল ঘুরে;
কত হাজার প্রেম প্যাসেঞ্জার
পথে করতেছে দৌড়াদৌড়ি॥
যে যেমন টিকিট করে, সেই কেলাসে তারে
অমনি ভব ভূমে পার করে,
এ দীন বাউল ভণে টিকিট কিনে,
কোথা গৌর আমার লওহে বলে,
কত যেতেছে গড়াগড়ি॥”

 হাসপাতাল হইতে কি সুন্দর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হইয়াছে, তাহা নিম্নে উদ্ধৃত গান হইতে বুঝা যাইবে।

তোরা আয় কে যাবি রে,
গৌর চাঁদের হাসপাতালে নদীয়াপুরে॥
আর কেন ভাই যাতনা পাই
কলিকালে ম্যালেরিয়া জ্বরে॥
কখন এমন ছিলনা রে দেশে জীবের যন্ত্রণারে॥
কল্লেন দাতব্য এক ডাক্তাবখানা, দীনহীন তরে।
জীবন তারণ সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছেন
দেখাতে লোকেরে।
আন্‌ছেন রোগী ডেকে ডেকে তাদের জ্বর দেখে
দয়া থারমেটারে॥

গাছ গাছড়া বেদ বিধি
তার আরক তুলে করলেন বিধি
তারক ব্রহ্ম মহৌষধি,
ষোল নাম বত্রিশ অক্ষরে॥
নিতাই বাবু সিভিল সার্জন,
য়্যাসিষ্টাণ্ট অদ্বৈত হলরে,
নেটিভ শ্রীবাস আর শ্রীনিবাস হরিদাস
আছে কমপাউণ্ডারে॥
নিতাই বাবুর সুযশ ভাল,
জগাই মাধাই রোগী ছিল,
তাদের বৈষম্য জ্বর ছেড়ে গেল, একটি মিক্‌চারে।
পথ্য বলে দিচ্ছেন বাবু, সাধুবাদ দুগ্ধ সাবুরে॥
হরি কথা পাতিনেবু তাতে রুচি হ'লে অরুচি হবে,
গোসাঞি বলেন দিলাম বলে, অনন্ত ঐ ঔষধ খেলেরে।
জ্বর যেতো তোর কপট পিলে, যেতো একেবারে”

 এতদিন শুধু ‘অফিস’, ‘রেলগাড়ী” হাসপাতাল প্রভৃতির কথাই হইতেছিল। এমন ইংরাজ সভ্যতার চরম বিকাশ শাসনের কথা বলিয়াই প্রবন্ধ শেষ করিব।

ওরে মন আমার হাকিম হতে পার এবার।
মন যদি হাকিম হও আমি হই চাপরাশী,
কনেষ্টবল হয়ে হাজির হই হুজুরে।
তোমার হুকুম জোরে, আইন জারী করে।

আনবো চোরকে ধরে, করে গেরেফ্‌তার॥
ছিল পিতৃ বস্তু সত্য,
অমূল্য অসহ্য
হরে নিল তায় মদন আচার্য্য।
চোরের এমন কার্য্য ‘দীনু“র হয় না সহ্য।
মদন রাজার রাজ্য শুদ্ধ অবিচার॥
কামছে দেওনা ক্ষমা, মত্ত হও দুবেলা,
‘রুহুর’ সঙ্গে মোহ মদনের খুব জ্বালা।
“কোরক” যেমন দোষী,
মিয়াদ দা ও তায় বেশী,
মদনকে দাও ফাসি
কাম যাক্‌ দ্বীপান্তর॥
ভাই বন্ধু দারা সুত আত্মপরিজন
সময়ের বন্ধু তার অসময়ে কেউ নন।
দিয়ে চোরের সঙ্গে মেলা
হ’য়ে মাতোয়ালা,
পেয়ে চাবি তালা,
ভাঙ্গ্‌লে আমার দ্বার॥”

 দেশের সভ্যতার পরিবর্ত্তেনের সাথে সাথে পল্লীসাহিত্যের কি রকম পরিবর্তন তাহাই উপরি উদ্ধত গান সমূহ হইতে বুঝিতে পারা যাইবে। এই আলোচ্য বিষয় অত্যন্ত জটিল ও বিস্তৃত সুতরাং দুই এক জনের সংগৃহীত গান দ্বারা সম্পূর্ণভাবে আলোচনা করা যাইতে পারে না। আমার দ্বারা যতটুকু সম্ভব তাহাই করিয়াছি। এই আলোচনা যে অসম্পূর্ণ তাহা সত্য কিন্তু তবু হইা প্রকাশ করিতেছি কারণ এই প্রচেষ্টায় যদি অন্য কেহ অনুগ্রহ করিয়া আমাকে সাহায্য করেন, বা স্বাধীন ভাবে বা যুক্ত ভাবে আলোচনা করেন। আমার বিনীত নিবেদন যে আমরা “বঙ্গীয় পল্লী সঙ্গীত সংগ্রহ সমিতি” (Bengal Folk lore and Folk song Society) নামক একটি অনুষ্ঠান করিতে চাহিতেছি। যাঁহারা এই বিষয়ে উৎসাহী ও সহানুভূতিশীল তাঁহারা দয়াপরবশ হইয়া গ্রন্থকারের ঠিকানায় পত্র ব্যবহার করিলে সুখী ও অনুগৃহীত হইব।

 (বঙ্গবাণী, ফাল্গুন, ১৩৩১)

  1. এই গানটি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহাতে যে সমুদয় টীকা টিপ্পনী প্রদত্ত হইয়াছিল তাহাই ম্যাগাজিন ‘কর্ত্তৃপক্ষের’ অনুগ্রহে উদ্ধৃত করিতেছি। কর্ত্তৃপক্ষের’ সম্পাদক অধ্যাপক শ্রীযুত বনওয়ারী লাল বসু এম, এ, মহোদয়কে তজ্জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।

     (১) লায়ে লাহা ইল্লাল্লা- আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য নাই।

     সাধনাকালে হিন্দুগুরু যেমন শিষ্যকে বিশ্বের সর্ব্বত্র “ওঁ” ধ্যান করিতে উপদেশ দেন, পীর সাহেবেরাও তেমনি ভিতরে বাহিরে এই কল‍্‌মা (মন্ত্র) জপ ও ধ্যান করিতে বলেন। প্রথমেই অবশ্য এই কল্‌মা জপ করা হয় না। প্রথম শুধু “আল্লাহ”—এই কথাটি মনে মুখে জপ করিতে হয়। যে নিয়মে এই সব ধ্যান করিতে হয়, তাহা অন্য কাহারও নিকট প্রকাশ নিষিদ্ধ।
     (২) নুহ্ অল ইস্‌বাত, ‘নফি ইস‍্‌বাত’ কথার অপভ্রংশ। ইহার ভাবার্থ ‘লায়েলাহা ইল্লাল্লা’ দ্বারা নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করা এবং কল্পনায় সেই অনাদি অনন্ত পরব্রহ্মের অসীম সৌন্দর্য্যময় অস্তিত্ব অনুভব করা।
     (৩) নফুয়াল নবি, ‘নফিয়ন্নবি’ শব্দের অপভ্রংশ। ইহার আর এক নাম “ফানাফির রসুল” অর্থাৎ রসূলোল্লার (হজরত মুহম্মদ দঃ) ধ্যান করিতে করিতে আত্মবিস্তৃত হইয়া সমগ্র জগতে শুধু তাঁহারই বিকাশ উপলব্ধি করা।
     (৪) ইসলাম ধর্ম্মমতে আধ্যাত্মিক জগতের পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিতে হইলে ভক্তকে সাধনার তিনটি সিঁড়ি অতিক্রম করিতে হইবে। প্রথমতঃ “ফানাফিস্বেখ” বা আপন পীরের সহিত লয়প্রাপ্তি। সত্য সনাতন নিরাকার মহাপ্রভুর দর্শন লাভ আকাঙ্ক্ষায় অবশ্য পীরের ধ্যান করিতে হয়। পীর ভক্তের উদ্দেশ্য নয়—উদ্দেশ্য লাভের সহায় মাত্র। প্রথম স্তর অতিবাহিত হইলে, ঐ উদ্দেশ্য লইয়াই সিদ্ধিলাভের অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট সহায় রসুলোল্লার ধ্যান করিতে হয়। ইহার নাম “ফানাফির রসুল”। সাধনার সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ক্রম ‘ফানাফিল্লা’ অর্থাৎ আল্লাতে মিশিয়া যাওয়া। বহির্জগতে ও আত্মিক জগতে যাহা কিছু সবাই আল্লার, সবই তাঁহার নাম গানে বিভোর এই স্তরে উপস্থিত হইলে, সাধক আত্মজ্ঞানহীন হইয়া মহর্ষি মন্‌সুরের (“মহর্ষি মন্‌সুর” কবি মোজাম্মেলহক্ প্রণীত দ্রষ্টব্য।) মত “আয়নাল্ হক” বা অহং ব্রহ্ম বলিতে থাকেন। অনন্ত জ্ঞানময়ের সহিত মিশিয়া গেলে লোকের বাহ্যজ্ঞান বিলুপ্ত হয়। কি করেন, কি বলেন, সে জ্ঞান তখন তাঁহাদের থাকে না—কেহ পাগল বলে, কেহ ভণ্ড বলে কোন দিকেই দৃকপাত করেন না। সাহাজাদী জেব্-উন্-নিসা বলেন—

    ছারে জং আসত বা মজ‍্লুনে আজ আহ‍্লে শরিয়ত রা।
    কেদর দর‍্ছে মহব্বত নোক‍্তায়ে বাহার ছোখন গিরাদ॥”

     ঈশ্বর-প্রেম পথের পথিকেরা প্রেমাতিশয্যে জ্ঞানহীন। সাধারণ লোকেরা কিছু না বুঝিয়া তাঁহাদের সহিত অযথা তর্ক করিতে যায়, অন্যায়রূপে গালি দেয়।

     (৫) মক্‌বুল, বন্ধু = প্রিয়।

    —মৌলবী রজব আলী বি, এ

     দ্রষ্টব্যঃ—The Edward College Magazine: Vol I No. I P.12-13.

  2. নৌকার তক্তার সংযোগস্থল জীর্ণ হইয়া তাহার মধ্য দিয়ে নৌকায় জল প্রবেশ করে। তক্তার ‘বান’ ছুটেছে অর্থাৎ তক্তার সংযোগস্থল অকর্ম্মণ্য হইয়া গিয়াছে, কাজেই জল উঠিয়া ডুবিয়া যাইবার সম্ভাবনা।

     নৌকার তক্তার অল্প পরিমাণ স্থান নষ্ট হইয়া গেলে, তাহার মধ্য দিয়া জল উঠে। এই অবস্থার নাম “খোঁচ”।

     এই দুই ছয়ে নৌকার জীর্ণতা ও ধ্বংসমুখতা—ইহাই প্রমাণ করিতেছে।

  3. গোরক্ষ বিজয় (পৃ: ১৩৭-৩৮)