একাধিক লেখক
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন সম্পাদিত
(পৃ. -)

বাউল গান[১]

 বাউল শব্দটা বাউর হইতে উৎপত্তি লাভ করিয়াছে বলিয়া কেহ কেহ বলেন। উত্তর ভারতের বাউর শব্দের সহতি আমাদের দেশের বাউলের যথেষ্ট সৌসাদৃশ্য দৃষ্ট হয়। ডক্টর ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহোদয় বলেন, বাউল শব্দটি আউল শব্দজ, কেন না আমরা সাধারণতঃ আউল বাউল বলি। আউল শব্দটি আরবী আউলিয়া সম্ভূত, আউলিয়া, ঋষি।

 বাউলের জন্ম ১৪শ শতাব্দীর শেষভাগে কি পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। বাউল জন্মগ্রহণ কারিয়াছে সিদ্ধা ও মুসলমান ফকির হইতে। ১৬শ, ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে বাউল যথেষ্ট প্রবল ছিল। বাউল দলের সঙ্গে বৈরাগীদলের কোন সম্পর্ক নাই। বাউল দল তাহাদের নিজেদের গান ব্যতীত অন্য কোন গান গাহিত না; কিন্তু অন্য লোকেরা বাউল গান গাহিত।

 বাউলের লক্ষণ হইতেছে, সে মনের মানুষ খুঁজিতেছে। তাহার ধর্ম্ম হইতেছে সহজ ভাব, দেহকে বিশ্বের ক্ষুদ্র সংস্করণ মনে করে, এই দেহের মধ্যে চন্দ্র সূর্য্য আছে, জোয়ার ভাটা চলিতেছে। তাহার ভাব চর্য্যা ভাব; জীবনের ব্যবসায় হইতে উপদেশ গ্রহণ করিতেছে। বাউলের মধ্যে মোটেই বৈরাগ্যের ভাব নাই। যদিও বা থাকে তাহা আছে শুধু মজা গ্রহণ করিবার জন্য মাত্র।

 বাউল সম্বন্ধে বেশী কথা আমার জানিবার সৌভাগ্য হয় নাই। বিভিন্ন ধরণের বাউল গানের উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হইল।

 (১) (ক) মনের মানুষ—

* * * *

আমার মনের মানুষ যে রে
আমি কোথায় পাব তারে,
হারায়ে সেই মানুষে দেশ বিদেশে
বেড়াই ঘুরে।

* * * *

আমি মন পাইলাম মনের মানুষ পাইলাম না।
আমি তার মধ্যে আছি মানুষ তাহা চিনল না।৷

* * * *

মানুষ হাওয়ায় চলে হাওয়ায় ফিরে, মানুষ হাওয়ার সনে রয়,
দেহের মাঝে আছে রে সোনার মানুষ ডাকলে কথা কয়।
তোমার মনের মধ্যে আর এক মন আছে গো—
তুমি মন মিশাও সেই মনের সাথে।
দেহের মাঝে আছে রে মানুষ ডাকলে কথা কয়।

* * * *

মনের মানুষ যেখানে
আমি কোন সন্ধানে যাই সেখানে।

* *

মনের মানুষ না হ’লে গুরুর ভাব জানা যায় কিসেরে

* * * *

আমি দেখে এলেম ভবের মানুষ ডোর
কোপনি এক নেংটি পরা—
সে মানুষ ক্ষণে হাসে ক্ষণে কাঁদে কোন যে
মণির মনোচোরা।
যে মানুষ ধরি ধরি
আশায় করি
সে মানুষ ধরতে গেলে না দেয় ধরা।

* * *

তরিতে আছে আটা-মণি কোটা জ্বল্‌ছে
বাতি রং মহলে
সেখানে মনের মানুষ বিরাজ করে
মন পবনে তরী চলে।

*

এই মানুষে আছেরে মন
যারে বলে মানুষ রতন
লালন বলে পেয়ে সে ধন, পারলাম না চিন্‌তে।

* * *

কে কথা কয়রে দেখা দেয় না,
নড়ে চড়ে হাতের কাছে
খুঁজলে জনম ভর মিলে না।

* * *

আছে যার মনের মানুষ মনে সে কি জপে মালা
অতি নির্জ্জনে ব’সে ব’সে দেখ‍্ছে খেলা।
কাছে র’য়ে ডাকে তারে, উচ্চস্বরে কোন পাগলা।
ওরে যে যা বোঝে তাই সে বুঝে থাকরে ভোলা,
যথা যার ব্যথা নেহাৎ, সেই খানেতে হাত ডলা মলা
ওরে তেমনি জেনে মনের মানুষ মনে তোলা।
যে জন দেখে সে রূপ করিয়ে চুপ রয় নিরালা
ও সে লালন ভেঁড়োর লোক জানানো হরি বোলা
মুখে হরি, হরি বোলা।

* * *

অটল মানুষ বইসা আছে, ভাব নাইরে তার চুপরে চুপ।

* * *

 (খ) মনের মানুষের পর আমরা অচিন পাখীর খবর পাই। ইহাও বাউলের একটি বিশিষ্ট লক্ষণ।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখী
কেমনে আসে যায়।

* * *

মনের মনুরায় পাখী গহীনেতে চড়েরে
নদীর জল শুখায়ে গেলেরে

পাখী শূন্যে উড়ান ছাড়েরে
মাটির দেহ ল’য়ে।

* * *

আমার মন পাখী বিরাগী হ’য়ে
ঘুরে মরো না।

 (২) সহজ ভাবে সকল জিনিষ করিবার আকাঙ্ক্ষা বাউলের একান্ত আপনার জিনিষ। অন্যের সঙ্গে তাহার এই স্থানে বিশেষ পার্থক্য।

সুখ পা’লে হও সুখ ভোলা,
দুখ পা’লে হও দুখ উতালা,
লালন কয় সাধনের খেলা
মন তোর কিসে জুৎ ধরে।

 (৩) বৌদ্ধ সিদ্ধাগণের চর্য্যা যে ধরণের রচনা, বাউলগানেও তদ্রূপ রচনা। জীবনের নানা ব্যবসায় (Occupation) অবলম্বন করিয়া গান রচনা করা। এক্ষণে এই রীতির কয়েকটি গান তুলিয়া দিতেছি।

গড়েছে কোন সুতারে এমন তরী জল ছেড়ে ডাঙ্গাতে চলে
ধন্য তার কারিগরী বুঝতে নারি এ কৌশল সে কোথায় পেলে।
দেখি না কেবা মাঝি কোথায় বসে, হাওয়ায় আসে হাওয়ায় চলে।
তরিটি পরিপাটী মাস্তলটি মাঝখানে তার বাদাম ঝোলে,
লাগেনা হাওয়ার বল এমনি সে কল সলিল দিকে সমান চলে।

তরীতে আছে আটা-মণি কোঠা জ্বলছে বাতি রংমহলে
যেখানে মনের মানুষ বিরাজ করে মন-পবনে তরী চলে।
সখিন কয় চলে ঝড়ি তুফান ভারী উঠবেরে ঢেউ মন-সলিলে,
যে দিন ভাঙ্গবেরে কল হবে অচল চলবে না আর
জলে স্থলে।

* * *

পদ্মা নদীর পুল বেঁধেছে ভাল—
কত ইট পাটকেল খাপ‍্ড়া কুচী পদ্মার কূলে দিল,
কত জায়গার মানুষ ঐ ডাঙ্গাতে ম’ল
পুলের খাম্বা ষোল জোড়া,
উপরে তার গিল্‌টি করা,
কাঁকড়া কলে মাটি তুলে খাম্বা বসাইল।
মেম সাহেবের বুদ্ধি খাসা,
পুল বেঁধেছে বড় খাসা।
ষোল জোড়া খাম বসাতে তিনজন সাহেব ম’ল।
চৌদ্দশ কুলীর মধ্যে নয়শ কুলী ম’ল।
পুলের খরচ মোটামুটি
টাকা খরচ সাত কোটী
আমার ক্ষ্যাপা চাঁদের কি কারখানা বুঝতে জনম গেল।

(“বিচিত্রা:” জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৬)

 এই প্রবন্ধ লিখিতে আচায্য ডক্টর শ্রীযুক্ত ব্রজেন্দ্রনাথ শীল মহোদয়ের নিকট অনেক উপদেশও সাহায্য পাইয়াছি। তজ্জন্য তাঁহাকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাইতেছি।

  1. মাজুতে বঙ্গীয় অষ্টাদশ সাহিত্য-সম্মিলনীতে পঠিত।