একাধিক লেখক
মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন সম্পাদিত
(পৃ. ৮৫-৮৮)
◄  ৬৭
৬৯  ►

৬৮

জাগ্‌গান

 পাবনা জিলার নানা পল্লীতে জাগ্‌গান প্রচলিত আছে। রাখাল বালকগণ পৌষ মাসের প্রথম হইতে শেষ পর্য্যন্ত রাত্রিকালে বাড়ী বাড়ী পল্লীর নিরক্ষর অজ্ঞাত কবি রচিত গান গায় এবং ভিক্ষা লয়। এই ভাবে সমস্ত পৌষ মাস গান গাহিয়া যে সমুদয় পয়সা, চাউল, ডাউল প্রভৃতি পায় তাহাই দিয়া পৌষ সংক্রান্তির দিনে নিজেরা মাঠে পাক করিয়া খায়। এই ধরণের গান অন্য কোন জিলায় প্রচলিত আছে কিনা, এবং থাকিলে উহা কি ধরণের ও কি বিষয় লইয়া রচিত, তাহা আলোচনা হওয়া নিতান্তই প্রয়োজন। এই প্রথাটী দিন দিন লোপ পাইতেছে। আমার মনে হয় অল্প দিনের মধ্যেই এই দীর্ঘকালপ্রচলিত প্রথা চিরতরে লোক চক্ষুর অন্তরাল হইয়া যাইবে। এই প্রথা কোন্‌ সময় হইতে আমাদের বাঙলায় প্রচলিত তাহাও আলোচনা করিবার যোগ্য। এই সব গানের রচনাকাল বাঙলায় মুসলমানগণের প্রতিপত্তির সময়কার বা তার পরবর্তী সময়কার এবং ইংরেজ আমলের পুর্ব্বেকার, তাহার কারণ ইহার ভাষা আরবী, ফারসী ও উর্দু শব্দবহুল। ইংরাজী পল্লী গাথার সহিত ইহার সাদৃশ্য আছে।

ধুয়া

এমা দয়া নাইরে তোর,
মা হয়ে কেন বেটায় সদা বলো ননী চোর।
কেষ্ট যায়, মা, বিষ্ণুপুরে, যশোদা যায় ঘাটে,
খালি গৃহ পেয়ে গোপাল সকল ননী লোটে।
“ননী খা’লো কেরে গোপাল ননী খা’লো কে?”
“অ মিত মা খাই নাই ননী বলাই খা’য়ছে,”
“বলাই যদি খাইতে ননী থুতো ‘আদা’ ‘আদা’
তুমি গোপাল খাইছে ননী ভাণ্ড করেছো সাদা।”
ছড়ি হাতে নন্দরাণী যায় গোপালের পিছে,[১]
একলম্ফে উঠলেন গোপাল কদম্বেরই গাছে।
পাতায় পাত য় ফেরেন গোপাল ডালে না দেয় পাও,
গাছের নীচে নন্দরাণী থরে কাঁপে গাও।

“নামো নামো ওরে গোপাল পাড়্যা দেই তোর ফুল,
কদম্বেরই ডাল ভাঙ্গিয়ে মজাবি গোকুল।”
“নামি নামি ওরে মারে একটি সত্য করো,
নন্দ ঘোষ যে তোমার পিতা যদি আমায় মারে"(?)
‘ তা কি আর হয়রে গোপাল তা কি আর হয়,
নন্দঘোষ যে তোমার পিতা সর্ব লোকে কয়।”
নালা ভোলা দিয়া গোপাল গাছ হতে নামা’,
গাভী ‘ছাঁদা” রসি দিয়ে তুই হস্ত বাঁধিল।

ধুয়া

এমা দয়া নাই তোর,
এত সাধের নীলমণি বান্ধা রইল তোর।
কিব বন্ধন বাধ্‌লি মারে বন্ধন গেল কসে,
বন্ধনের তাপে মারে লোহু চললো ভেসে।
কিবা বন্ধন বাঁধ্‌লি মারে বান্ধনের জ্ব’লায় মরি,
কাঁচা ডোরের বন্ধন ম্যরে সহিতে না পারি।
কিবা বন্ধন বাঁধ্‌লি মারে বন্ধন পিটে মোড়া,
বন্ধনের তাপে মা রে ছুটলো হাড়ের জোড়া।
তাতে যদি শোধ না হয় আর এক সত্যকরি,
নন্দঘোষের ধেনু রেখে দিব ননীর কড়ি।
তাতে যদি শোধ না হয় আর এক সত্য করি,

হাতের বালা বন্ধক থুয়ে দেব ননীর কাড়।
তাতে যদি শোধ না হয় আর এক সত্য করি,
বাড়ী ছেড়ে যাবো আমি মামাদের বাড়ী,
মামাদের গরু রেখে দিব ননীর কড়ি।
ঐ কথাটী শুনে মার একটু দয়া হ’ল,
হাতের বহু ন ছেড়ে দিয়ে গোপাল কোলে নিল।

  1. বঙ্গবাণী (জৈষ্ঠ, ১৩৩১) ডাঃ শ্রীসুরেন্দ্র নাথ সেন মহোদয় লিখিত “মারাঠী ও বাঙ্গলী’ প্রবন্ধে যে পল্লীগাথা প্রকাশিত করিয়াছেন তাহার সহিত তুলনীয়।